হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা/মহিলাগণের বাল্যাবস্থার ক্রিয়া

মহিলাগণের বাল্যাবস্থার ক্রিয়া এবং তাহাদিগের প্রতি পিতা মাতার ব্যবহার।

 পিতা স্বীয় বালকগণকে যেরূপ যত্নপূর্ব্বক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থ প্রেরণ করেন, বালিকাগণকে সেরূপ করা দূরে থাকুক বরং বলেন, উহাদিগের বিদ্যা শিখিবার কি আবশ্যক? উহারা কি চাকরি করিয়া টাকা আনিবে? উহারা খাবে দাবে গৃহের কাজ কর্ম্ম করিবে। হা বিদ্যা! তুমি কি কেবল অর্থের নিমিত্তই হইয়াছ, জ্ঞানের নিমিত্ত নহ? যাহাদিগের অর্থ উপার্জ্জনের প্রসক্তি নাই, তাহারা কি তোমা বিহীন হইয়া এই ভূমণ্ডলে যাবজ্জীবন অজ্ঞানাবস্থায় কালক্ষেপণ করিবে? হা দেশাচার! তোমাকেই ধন্যবাদ।

 পিতা কন্যাগণকে শিক্ষা দেন না, সুতরাং তাহারা কেবল নানাবিধ অলীক আমোদে ও বৃথা খেলায় রত থাকে। তাহারা ভাণ্ড, পুত্তলিকা, ছিন্ন বস্ত্র, ও ধুলি মৃত্তিকা, লতাপল্লবাদি লইয়াই প্রায় সমুদায় বাল্যকাল শেষ করে। আহা! কি আক্ষেপের বিষয়, জনক জননী ও সহোদর প্রভৃতি বন্ধুগণই ঐ কোমলহৃদয়া-বালিকাগণকে বিদ্যারলে একেবারে বঞ্চিত করিয়াছেন। তাঁহারা কি একবার ভ্রমেও ভাবেন না, যে ইহাদের ভবিষ্যতে কি হইবে, এবং কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়াই বা ইহারা সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিবে। বিবাহের পর শ্বশুরালয়ে গমন করিয়া ভর্ত্তৃকুল কামিনীগণ এবং শ্বশুর ভাসুর দেবর ও স্বামী প্রভৃতির সহিত যে কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, আর তাহাদিগের সন্তান সন্ততি হইলে কি প্রকারেই তাহাদিগকে লালন পালন করিতে হইবে এবং কি প্রকারেই তাহাদিগকে শিক্ষা প্রদান করিতে হইবে, তদ্বিষয়ক কোন সদুপদেশ প্রদান করেন না, সুতরাং ঐ কন্যাগণ সকল বিষয়েই অতি অজ্ঞ থাকে ও অতিশয় কষ্ট ভোগ করে। হায়! নারীগণ যদি বিদ্যা শিক্ষা করিত এবং পিতা মাতা যদ্যপি তাহাদিগকে উপদেশ দিতেন, তাহা হইলে তাহাদিগের আর এরূপ কষ্ট ভোগ করিতে হইত না। হা মাতঃ বঙ্গভূমি! কত দিনে তোমার এই দুঃখিনী কন্যাগণ বিদ্যাবতী ও গুণবতী হইবে, কত দিনে এই দীন ভাবের অভাব হইয়া তাহাদিগের জ্ঞান ভাবের আবির্ভাব হইবে, এবং সেই জ্ঞান প্রভায় তোমাকে প্রান্বিত করিবে। আহা! আমাদিগের মাতা যদি বিদ্যাবতী হইতেন তাহা হইলে আর আমাদিগের এরূপ দুর্দ্দশা ঘটিত না। হায়! সেই অশিক্ষিত মাতৃগণ আপনারা যাহা উপদেশ পাইয়াছেন কন্যাগণকেও তাহাই প্রদান করিয়া থাকেন, তাঁহারা কন্যাগণকে নানা প্রকার ব্রত করান, এবং সেই সকল ব্রত করিলে কি কি ফল লাভ হয় তাহার উপদেশ দেন, কন্যাগণও তাহাই ব্রহ্মবাক্য বলিয়া গ্রহণ করে, এবং সেই উপদেশ মতেই চির কাল চলে।

 তাহারা বাল্যকালে গোময় ও তুষ দ্বারা বড় বড় লাড়ু পাকাইয়া পৌষ মাসের উষাকালে শুষ্ক দূর্ব্বাদল ও শর্ষপপুষ্প দিয়া তাহা পূজা করে এবং মাসের শেষ দিবসে তাহা জলে নিক্ষেপ পূর্ব্বক স্নাত হইয়া অষ্ট কুসুমের কাষ্ঠ আহরণ করিয়া, তদ্দ্বরা অগ্নি জ্বালাইয়া সেই অগ্নি সেবন করিতে করিতে গুলি গুলি ভক্ষণ করিয়া থাকে। এই ব্রতের নাম তুষতুষালী, ইহার ফল পিতা মাতা ভ্রাতা প্রভৃতির সুখ সমৃদ্ধি হয় এবং হস্তী অশ্ব ও নানাবিধ রত্ন লাভ হয়। চৈত্র মাসে ইহারা হরিদ্রায় এক খণ্ড ছিন্ন বস্ত্র রঙ্গিন করিয়া তাহাকে অঞ্জন ও সিন্দূরের বহু সংখ্যক ফোঁটা দ্বারা সুসজ্জিত করে এবং তাহাতে পান, ছোপানপাট ও কৌড়ি প্রভৃতি দেয়, এবং সধবা মহিলাগণকে আহ্বান করিয়া তাহাদিগকে হরিদ্রা, আমলা, তৈল, সিন্দূর, পান, সুপারি প্রভৃতি প্রদান পূর্ব্বক তাহাদিগের পদনখর ও গাত্রের মলা লইয়া একটা পুত্তলিকা ও একটা প্রদীপ প্রস্তুত করে এবং সেই বস্ত্র খণ্ড দ্বারা ঝুলি প্রস্তুত করিয়া সেই প্রদীপ ও পুত্তলিকা তাহাতে স্থাপন পূর্ব্বক জ্ঞানার্থ গমন করে, এবং জলমগ্ন হইয়া পক্ষে সেই ঝুলি প্রোথিত করত গৃহে প্রত্যাগমন করে, এই ব্রতের নাম নখছুট, ইহা করিলে পরলোকে নখ চুল গলায় বাধিয়া মরিতে হয়। বৈশাখ মাসে ইহারা কৃত্রিম পুষ্করিণী খনন করিয়া তাহাতে বিল্ব বৃক্ষ রোপণ পূর্ব্বক পূজা করে, এই ব্রতের নাম পুণ্য পুষ্করিণী, এই ব্রত করিলে পরলোকে পিপাসা হইতে পরিত্রাণ পায় এবং ঐ মাসে তাহারা মৃন্ময় বাণলিঙ্গ নির্ম্মাণ করিয়া তাহার আরাধনা করিয়া থাকে, এই ব্রতের নাম শীলশীলেটম, পুরা কালে গিরিরাজদুহিতা গৌরী এই ব্রত করিয়াই ভূতনাথ পতি পাইয়াছিলেন, কন্যাগণও সেইরূপ পতি লাভের আশয়ে এই ব্রত করিয়া থাকে। উক্ত মাসে তাহারা আর এক প্রকার ব্রত করিয়া থাকে, তাহার নাম দশপুত্তলিকা, ভূমিতে দশটি পুত্তলিকা চিত্রিত করিয়া তাহার প্রত্যেকের নিকট এক একটি প্রার্থনা করে, যথা রামের মত পতি, দশরথের তুল্য শ্বশুর, লক্ষণ সদৃশ দেবর, কৌশল্যার ন্যায় শ্বশ্রূ, সীতার সদৃশ সতীত্ব, দ্রৌপদী সদৃশ পাচনক্ষমতা, কুন্তীর মত পুত্রবতী ও ভাগীরথীর তুল্য স্নিগ্ধতা এবং ধরণী সদৃশ ভারসহিষ্ণুতা প্রাপ্ত হইবে। শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্ত্তিক এই মাস চতুষ্টয়ের প্রত্যেক অমাবস্যা দিবসে ইহারা মনসার ডাল, নেকড়া, পুত্তলিকা এবং ভাঁঁড় ও মৃত্তিকা কপর্দ্দক প্রভৃতি লইয়া পূজা করে, এবং পুত্তলিকার বিবাহদি দিয়া থাকে, এই ব্রতের নাম অমাবস্যা। এই ব্রত করিলে বিষয় বৈধব্য যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ পায়। কার্ত্তিক মাসে আরও ইহারা যমপুকুর নামক কৃত্রিম পুষ্করিণী খনন করে, এবং সেই পুষ্করিণীতে কদলী, কচু, ধান্য, ও হরিদ্রা, শুশনি, কলমি, ছোলা, মটর, মাষ, মুগ, মান, প্রভৃতি বৃক্ষ ও লতা স্থাপন করে এবং মৃন্ময় গ্রাহ, কূর্ম্ম, কাক, বক, চিল, শাকওয়ালী, মেছুনী, ধোপা, যমের মার দ্বারা তাহার চতুষ্পাশ্ব সুসজ্জিত করে। এই ব্রত না করিলে তাহাদিগের শ্বশুর ও শ্বশ্রূগণ পরলোকে বিষম ক্ষুৎপিপাসায় প্রপীড়িত হয়েন। অগ্রহায়ণ মাসে ইহারা সাঁজুতি ও মৌনী ধারণ প্রভৃতি ব্রত আচরণ করিয়া থাকে, পিঠালি দ্বারা নানাবিধ কাম্য বস্তু ও নক্ষত্র চন্দ্র সূর্য্যাদি ভূমিতে চিত্রিত করিয়া তাহার পূজা করে, ও সেই সেই কাম্য বস্তুর নিকট এক এক প্রার্থনা করিয়া থাকে, তাহাতেই উহাদিগের সেই সকল বস্তু লাভ হয়। কিন্তু মৌনাবলম্বনের নিয়ম ভিন্ন প্রকার, তাহারা সুর্য্যাস্ত সময়ে সাত গাছ দূর্ব্বা অঞ্চলে বন্ধন পূর্ব্বক মৌনাবলম্বন করে, এবং সন্ধ্যার পর আকাশ মণ্ডলে সপ্ত তারা দর্শন করত ঐ চিত্রময় তারা সমূহ পূজা করিয়া থাকে।

 হা ভ্রম! কত দিনে তুমি এই বঙ্গভূমি পরিত্যাগ করিবে, হা মাতঃ! কত দিনে তুমি এই অজ্ঞান ভাব পরিত্যাগ করিয়া এবং সর্ব্ব দোষ শূন্যা হইয়া অতি পবিত্র ভাব ধারণ করিবে, কত দিনে তোমার এই কুমারীগণ মোহন্ধকার। হইতে মুক্ত হইয়া জ্ঞানালোক সংযোগে সুখী হইবে। হে পরম কারুণিক পরমেশ্বর! কত দিনে তুমি আমাদিগের প্রতি সদয় হইয়া এই বিষমবিষ তুল্য ভ্রমজাল হইতে আমাদিগের মনকে সত্য ধর্ম্মের আশ্রয় প্রদান করিবে। হ বিধাতঃ! আমাদিগের সেই দিনের আর কত দিন আছে, যে দিনে আমরা পবিত্র ধর্ম্মের আশ্রয়ে অবস্থিতি করিব।