হেক্‌টর বধ (১৮৭১)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ[]

 [হেক্টর এবং সুন্দরবীর স্কন্দর রণভূমে ফিরিয়া আইলে ট্রয়দলের মহানন্দ জন্মিল। পরে হেক্‌টর গ্রীকদলস্থ বীরদিগকে দ্বন্দ্বযুদ্ধার্থে আহ্বান করিলে আয়াস্‌নামক এক দেবাত্মজ বীরবর তাহার সহিত ঘোরতর রণ করিলেক, কিন্তু কাহারও পরাজয় হইল না, উভয়দলে আনেক সৈন্য বিনষ্ট হইলে পরে সন্ধি করিয়া উভয় সৈন্য স্ব স্ব শববৃন্দ শোকবিগলিত নয়নাসারে ধৌত করিয়া ক্ষুণ্ণ হৃদয়ে সর্ব্বগ্রাসী বৈশ্বানরকে বলিস্বরূপ প্রদান করিল। গ্রীকেরা শিবির সম্মুখে এক প্রাচীর রচিত করিয়া তৎসন্নিধানে এক গম্ভীর পরিখা খনন করিল।]

 রজনীযোগে লেম্‌নস্‌ দ্বীপ হইতে তত্রস্থ লোকপাল ঈশনপুত্র উনীয়স্‌ প্রেরিত এক সুরাপূর্ণ পোত শিবিরসন্নিধানে সাগরতীরে আসিয়া উতরিলে, গ্রীকযোধেরা কেহবা পিতল, কেহবা উজ্জ্বল লৌহ, কেহবা পশু চর্ম্ম, কেহ বৃষভ, কেহবা রণবন্দী এই সকলের বিনিময়ে সুরা ক্রয় করিয়া সকলে আনন্দে পান করিতে লাগিল। ট্রয়নগরেও এইরূপ আনন্দোৎসব হইল। পরে দীর্ঘকেশী অশ্বদমী ট্রয়স্থ যোধসকল যে যাহার স্থানে বিশ্রাম লাভ করিতে লাগিল। দেবকুলপতির ইচ্ছামতে আকাশ-মণ্ডল সমস্ত রাত্রি উজ্জ্বল হইয়া অশনিস্বনে চারিদিক প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল।

 রজনী প্রভাতা হইলে ঊষাদেবী পূর্ব্বাশা হইতে ভগবতী বসুমতীর বরাঙ্গ যেন কুসুমময় পরিধানে পরিহিত করিলেন। অমরাবতীতে দেবসভা হইল। দেবকুলনাথ গম্ভীর স্বরে কহিতে লাগিলেন, হে দেবদেবীবৃন্দ! তোমরা আমার দিকে মনোভিনিবেশ কর। আমার এই ইচ্ছা যে, কি দেবী কি দেব কেহই কি গ্রীক্‌ কি ট্রয় সৈন্যদলের এ রণক্রিয়ায় কোন সাহায্য না করেন। যিনি আমার এ আজ্ঞা অবজ্ঞা করিবেন, আমি তাহাকে বিস্তর শাস্তি দিব, আর তাহাকে এ আলোকময় স্বর্গ হইতে তিমিরময় পাতালে আবদ্ধ করিয়া রাখিব, যদি তোমাদের মধ্যে কেহ আমার রণ পরাক্রমের পরীক্ষা করিতে ইচ্ছা কর, তবে আইস, এক সুবর্ণ শৃঙ্খল ত্রিদিবে উদ্বন্ধন করিয়া তোমরা ত্রিদিবনিবাসী সকল এক দিক ধরিয়া আকর্ষণ করিয়া দেখ, তোমাদিগের সর্ব্বপ্রধান জ্যুস্‌কে স্থলযুক্ত করিতে পারক হও কি না। কিন্তু আমি মনে করিলে তোমাদিগকে সসাগরা সদ্বীপা বসুমতীর সহিত উচ্চে তুলিতে পারি। অতএব আমি তোমাদের মধ্যে বলজ্যেষ্ঠ। অন্যান্য দেবদেবী নিকর দেবেশ্বরের এই গম্ভীর বাক্য সসম্ভ্রমে শ্রবণ করিয়া নীরবে রহিলেন। সুনীলকমলাক্ষী দেবী আথেনী কহিলেন, হে দেবপিতঃ! হে পুরুষোত্তম! আমরা বিলক্ষণ জানি, যে তুমি পরাক্রমে দুর্ব্বার। কিন্তু গ্রীক্‌দলের দুঃখে আমার অন্তঃকরণ সদা চঞ্চল! তথাপি তোমার এ আজ্ঞা অবজ্ঞা করিতে কোন মতেই সাহস করিব না। রণকার্য্যে হস্ত নিক্ষেপ করিব না। কিন্তু এই মিনতি করি, যে তাহাদিগকে হিতকর পরামর্শ দিতে আপনি আমাকে অনুমতি দেন। মেঘ-বাহন সহাস বদনে উত্তর করিলেন, হে প্রিয়দুহিতে! তোমার এ মনোরথ সুসিদ্ধ কর, তাহাতে আমার কোন বাধা নাই।

 এই কহিয়া দেবকুলপতি ব্যোমযানে আরোহণ করিলেন। এবং পিতলপদ, কুঞ্চিত-কাঞ্চন-কেশর-মণ্ডিত আশুগতি অশ্বসমূহে পৃথিবী ও তারাময় নভস্থলের মধ্যদিয়া অতিদ্রুতে উৎসময়ী বনচরযোনি ঈডানামক গিরিশিরে উত্তীর্ণ হইলেন। সেস্থলে গার্গর নামে দেবপতির এক সুরম্য উপবন ছিল। সেই স্থলে দেবনাথ ব্যোমযান মায়া-মেঘে আবৃত করিয়া আপনি আসীন হইয়া রণক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টি করিতে লাগিলেন।

 বিভাবরী প্রভাতা হইলে দীর্ঘকেশী গ্রীক্‌গণ স্ব স্ব শিবিরে প্রাতঃক্রিয়াদি সমাধা করিয়া ভোজনান্তে রণসজ্জা গ্রহণ করিলেন। ও দিকে ট্রয়নগরের রাজতোরণ উদ্ঘাটিত হইলে, রণব্যগ্র রথারূঢ় পদাতিকগণ হুহুঙ্কারে বহির্গত হইল। দুই সৈন্য পরস্পর নিকটবর্ত্তী হইলে ফলকে ফলকাঘাতে কুন্তে কুন্তাঘাতে ভৈরবারব উদ্ভবিতে লাগিল। কতক্ষণ পরে আর্ত্তনাদ ও প্রগল্‌ভতাসূচক নিনাদে চতুর্দ্দিক পরিপূরিত হইল। এবং ক্ষণমাত্রেই ভূতলে শোণিত-স্রোতঃ বহিতে লাগিল। এইরূপে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত মহাহব হইতে লাগিল।

 রবিদেব আকাশমণ্ডলের মধ্যবর্ত্তী হইলে দেবকুলপতি সহসা ঈডাগিরি চূড়া হইতে ইরম্মদস্রোতঃ বায়ুপথে মুহুর্মুহু বিস্তৃত করিতে লাগিলেন। ও বজ্রগর্জনে জগজ্জনের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। পাণ্ডুগণ্ড শঙ্কা গ্রীক্‌দিগকে সহসা আক্রমণ করিল। এমন কি, রাজকুলচক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌ননাদি বীরকুলচূড়ামণিরাও বীরবীর্য্যে জলাঞ্জলি দিয়া শিবিরাভিমুখে ধাবমান হইলেন। কেবল বৃদ্ধরথী নেস্তর রথের অশ্ব সুন্দরবীর কন্দরনিক্ষিপ্তশরে গতিহীন হওয়াতে পলায়ন করিতে সক্ষম হইলেন না। দূরে সামর্থ্যশালী রথী হেক্‌টরের দ্রুত রথ সৈন্যদল হইতে সহসা বহির্গত হইয়া রণক্ষেত্রাভিমুখে ধাইতেছে, এই দেখিয়া রণবিশারদ দ্যোমিদ বীরবর অদিস্যুস্‌কে ভৈরবে সম্বোধিয়া কহিতে লাগিলেন, কি সর্বনাশ! হে বীরকেশরী, তুমিও কি একজন ভীরুজনের ন্যায় পলায়নপরায়ণ হইলে। ঐ দেখ, কৃতান্তরূপে অরিন্দম হেক্‌টর এদিকে আসিতেছে, আইস, আমরা এ বৃদ্ধবীরকে আপনাদের বক্ষরূপ ফলকে আশ্রয় দিয়া এ বিপদ স্রোত হইতে রক্ষা করি।

 বীরবরের এই বাক্য ভয়ঙ্কর কোলাহলে প্রলীন হওয়াতে বীরপ্রবর অদিস্যুসের কর্ণগোচর হইতে পারিল না। বীর প্রবীর শিবিরাভিমুখে চলিতে লাগিলেন। এই দেখিয়া রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্‌ বৃদ্ধবীর নেস্তরের রথাগ্রে উগ্রভাবে গিয়া দাঁড়াইলেন এবং কহিলেন, হে নেস্তর, তোমার বাহুযুগলে কি আর যুবজনের বল আছে, যে তুমি ঐ আগন্তুক রিপুকুল, কৃতান্তকে দেখিয়া এখানে রহিয়াছ, তুমি শীঘ আমার রথে আরোহণ কর।

 বৃদ্ধ বীরবর আপন রথ রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদের সারথি দ্বারা সসারথি করিয়া দ্যোমিদের রথে আরোহণ পূর্বক রশ্মিগ্রহণ করিয়া স্বয়ং সে বীরবরের সারথ্যক্রিয়া নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। রথ অতি শীঘ্র বীরকেশরী হেক্‌টরের রথের নিকট উপস্থিত হইল, এবং রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্‌ কৃতান্তদণ্ড স্বরূপ দণ্ডাঘাতে ট্রয়রাজকুলের নিত্য ভরসা স্বরূপ ভাস্বর কিরীটী হেক্টরের সারথিকে মরণপথের পথিক করিলেন। অতিত্বরায় আর একজন সারথি রাজকুমারের রথারোহণ করিলে, বীরকেশরী ক্ষুণ্ণ ও রোষান্বিত চিত্তে জলদপ্রতিম-স্বনে ঘোরনাদ করিয়া উঠিলেন। এবং তদ্দণ্ডে কুলিশনিক্ষেপী কুলিশী বজ্রাঘাতে রণকোবিদ দ্যোমিদের অশ্বদলকে ভয়াতুর করিলেন। অশুগতি অশ্বদল সভয়ে ভূতলশায়ী হইল। এবং মহাতঙ্কে বৃদ্ধ সারথিবর এতাদৃশ বিহ্বলচিত্ত হইলেন, যে অশ্বরশ্মি তাহার হস্ত হইতে চ্যুত হইল। তখন তিনি গদগদ বচনে কহিলেন, হে দ্যোমিদ্‌! তুমি কি দেখিতে পাইতেছ না, যে বিশ্বপিতা দেবেন্দ্র ঐ দুর্দ্ধর্ষ ধন্বীকে অদ্য সমরে দুর্নিবার করিতে অতীব ইচ্ছুক। অতএব ইহার সহিত এ সময়ে রণরঙ্গে প্রবৃত্তি মতিচ্ছন্ন মাত্র। দ্যোমিদ্‌ কহিলেন, হে তাতঃ, এ সত্য কথা বটে; কিন্তু পলায়ন সাধন দ্বারা এ দুরন্ত হেক্‌টরের আত্মশ্লাঘা বৃদ্ধি করা কোন মতেই আমার মনোনীত নহে। বৃদ্ধবর উত্তর করিলেন, হে দ্যোমিদ্‌! তোমার এ কি কথা! তোমার পরাক্রম পরকুলে সর্ব্ববিদিত, যদ্যপি হেক্‌টর তোমাকে ভীরু ভাবিয়া হেয়জ্ঞান করে, তবে ট্রয়নগরে তোমার হস্তে বীরবৃন্দের বিধবা গৃহিণীদলকে দেখিলে তাহার সে ভ্রান্তি দূরীভূত হইবে।

 এই কহিয়া বৃদ্ধরথী শিবিরাভিমুখে রথ পরিচালিত করিতে লাগিলেন। হেক্‌টর গম্ভীর নিনাদে কহিলেন, হে দ্যোমিদ্‌! তুমি কি একজন ভীরু কুলবালার ন্যায় বীর ব্রতে ব্রতী হইতে চাহনা? হে বলীজ্যেষ্ঠ! এই কি তোমার রণব্রতের প্রতিষ্ঠা! বীরবরের এই কথা শুনিয়া রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্‌ রণেচ্ছুক হইয়া ফিরিতে চাহিলেন; কিন্তু ঘনঘনঘটার গর্জ্জনে এবং সৌদামিনীর অবিরত স্ফুরণে ভীত হইয়া সে আশা পরিত্যাগ করিলেন। বীরেশ্বর হেক্‌টর উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, হে ট্রয়স্থ বীরবৃন্দ! আইস! আমরা স্বসাহসে গ্রীকদলের রচিত প্রাচীর আক্রমণ করি, আর মূঢ়দিগকে দেখাই, যে আমাদিগের দুর্নিবার্য্য বীরবীর্য্য ওরূপ অবরোধে রুদ্ধ হইবার নহে, আর আমাদিগের বায়ুপদ অশ্বাবলী ওরূপ পরিখা অতি সহজে লম্ফ দিয়া উল্লঙ্ঘন করিতে পারে। চল, আমরা ত্বরায় যাই। আমার বড় ইচ্ছা যে ঐ স্বর্ণ ফলক, যাহার খ্যাতি জগজ্জন বিদিতা, তাহা কাড়িয়া লই; ও রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদের বিশ্বকর্ম্মার বিনির্ম্মিত কবচও আত্মসাৎ করি। হেক্‌টরের এই প্রলম্ভ বাক্যে ভগবতী হীরী সরোষে যেন সিংহাসনোপরি কম্পমানা হইয়া উঠিলেন। মহাগিরি অলিম্‌পুর ও সে আকস্মিক চালনায় থর থর করিয়া অধীর হইয়া উঠিল। দেবরাণী সংক্রোধে নীরেশ পশ্বেদন্‌কে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে মহাকায় ভূকম্পকারী জলদলপতি! গ্রীক্‌ দলের এ অবস্থা দেখিয়া তোমার কি দয়ার লেশমাত্র হয় না। জলরাজ বরুণ উত্তর করিলেন, হে কর্কশভাষিণী হীরী! তুমি ও কি কহিলে? আমি কি দেবকুলেন্দ্রের সহিত দ্বন্দ্ব করিতে সক্ষম?

 দেব দেবীতে এই রূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে ট্রয়দলস্থ অশ্বাবলী ও ফলকধারীদলে সেনানী স্কন্দরূপী অরিন্দম হেক্‌টর প্রাচীর রূপ অবরোধ ভেদ করিয়া গ্রীক্‌ সৈন্যের শিবিরাবলীতে ও তন্নিকটস্থ সাগরযান সমূহে হুহুঙ্কার নিনাদে অগ্নি প্রদান করিতে উদ্যত হইলেন। এ দুর্ঘটনা দেখিয়া গ্রীক্‌দলহিতৈষিণী বিশালনয়নী দেবীহীরী রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌ননের হৃদয়ে সহসা সাহসাগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া দিলেন। সৈন্যাধ্যক্ষ মহোদয় এক পোতের উচ্চ চূড়ায় দাঁড়াইয়া গম্ভীর স্বরে কহিতে লাগিলেন, হে গ্রীক্‌ যোধদল! এ কি লজ্জার বিষয়! তোমাদের বীরতা কি কেবল তোমাদের মধ্যেই দেদীপ্যমান। তোমরা কি হেক্‌টরকে একলা দেখিয়া, রণপরাঙ্মুখ হইতে চাহ। হে প্রজাপতি দেবকুলেন্দ্র! আপনার চিরসেবায় কি আমার এই ফল লাভ হইল! এরূপ লজ্জারূপ তিমিরে কোন দেশে কোন রাজার কোন কালে গৌরবরবি ম্লান হইয়াছে। হে পিতঃ! তুমি অদ্য এ সেনাকে এ বিষম বিপদ হইতে মুক্ত কর! রাজ চক্রবর্ত্তীর এতাদৃশ করুণারসান্বিত স্তুতিবাক্যে দেবকুলপতির হৃদয়ে করুণারসের সঞ্চার হইল। রাজহৃদয় শান্ত করণবাসনায় দেবরাজ পক্ষিরাজ গরুড়কে একটি মৃগশাবক ক্রমদ্বারা আক্রমণ করাইয়া খমুখে উড়াইলেন। এই সুলক্ষণ লক্ষ্য করিয়া গ্রীক্‌যোধসকল বীরপরাক্রমে হুহুঙ্কার ধনি করতঃ আক্রমিত রিপুদলের সহিত যুঝিতে আরম্ভ করিলেন। উভয়দলের অনেকানেক বীরপুরুষ সমরশায়ী হইল। ভাস্বরকিরীটী বীরেশ্বরের বাহুবলে গ্রীক্‌ সৈন্যমণ্ডলী চতুর্দ্দিকে লণ্ডভণ্ড হইতে লাগিল। বীরকেশরী সর্ব্বভুকের ন্যায় সর্ব্বব্যাপী হইলেন।

 শ্বেতভুজা দেবীহীরী প্রিয় পক্ষের এদুর্গতিতে নিতান্ত কাতরা হইয়া দেবী আথেনীকে কহিতে লাগিলেন; হে সখি, হে দেবকুলেন্দ্রদুহিতে! আমরা কি গ্রীক্‌দলকে এ বিপজ্জাল হইতে মুক্ত করিতে যথার্থই অশক্ত হইলাম। ঐ দেখ, রিপুকুলান্ত দুর্দ্দান্ত হেক্‌টর এক শরে অদ্য গ্রীক্‌দলের সর্ব্বনাশ করিল। দেবী অথেনী উত্তরিলেন, এত বড় আশ্চর্য্যের বিষয়, যদ্যপি আমার পিতা দেবপতি ও দুরাত্মার সহায় না হইতেন, তবে ও এতক্ষণ কোথায় থাকিত! কিন্তু আইস! তোমার রথে তোমার বায়ুগতি অশ্ব যোজনা কর! আমি ক্ষণমধ্যে দেবধামে প্রবেশ করিয়া রণবেশ ধারণ করিয়া আসি। দেখি, রণক্ষেত্রে আমাকে দেখিয়া ভাস্বর কিরীটী প্রিয়াম্‌পুত্রের হৃদয়ে কি আনন্দভাবের আবির্ভাব হয়। ভগবতী হীরী মনোরঙ্গে ত্বরিতগতিতে আপন তুরঙ্গম-অঙ্গ রণপরিচ্ছদে আচ্ছাদিত করিলেন।

 দেবী আথেনী আপন নিত্য অতীব মনোরম বসন পরি ত্যাগ করিয়া কবচাদি রণভূষণে বিভূষিত হইয়া আগ্নেয় রথে আরোহণ করিলেন। যে ভীষণ শূলদ্বারা দেবী রোষপরবশা হইয়া মহা মহা অক্ষৌহিণীকে রণক্ষেত্রে এক মুহূর্ত্তে ক্ষত বিক্ষত করেন, সেই ভয়গর্ভ শূল দেবীর হস্তে শোভিতে লাগিল, শ্বেতভুজা দেবী হীরী সারথ্য কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। অমরাবতীর কনক তোরণ আপনাআপনি সহজে খুলিল। নভোমণ্ডলে ভীষণ স্বনে ব্যোমযান ভূতলাভিমুখে ধাইতেছে এমন সময়ে ঈড়া নামক শৃঙ্গধরের তুঙ্গতম শৃঙ্গ হইতে মহাদেব দেবীদ্বয়কে দেখিয়া অতিরোষে গরুত্মতী দেবদূতী ঈরীষাকে কহিলেন, তুমি, হে হৈমবতী দেবদূতি! অতিশীঘ্র ঐ দুটী দুষ্টা কলহপ্রিয়া দেবীকে অমরাবতীতে ফিরিয়া যাইতে কহ। নচেৎ আমি এই দণ্ডে প্রচণ্ড আঘাতে উহাদিগের রথ চূর্ণ করিয়া দিব! এবং বাজীব্রজকে খঞ্জ করিয়া ফেলিব। দেবদূতী দেবদেশে বাত্যাগতিতে চলিলেন। এবং দেবীদ্বয়কে অমরাবতীতে ফিরাইয়া দিলেন। কতক্ষণ পরে দেবকুলেন্দ্র আপন সুচক্র ও সুন্দর স্যন্দনে অলিম্পুষের শিরস্থিত নিত্যানন্দ ভবনে পুনরাগমন করিলেন। এবং আপনার উগ্রচণ্ডা পত্নী দেবী হীরীকে কহিলেন। যতদিন পর্যন্ত রাজ চক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌নন্‌ বীরচক্রবর্ত্তী আকিলীসের রোষাগ্নি নির্ব্বাণ না করে, ততদিন ভাস্বর কিরীটী হেক্‌টরের নাশক পরাক্রমে গ্রীক্‌দলের এই অনির্ব্বচনীয় দুর্ঘটনা ঘটিবে। অমরাবতীতে এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে দিননাথ জলনাথের নীলজলে যেন নিমগ্ন হইয়া আপন কাঞ্চন কিরণজাল সম্বরণ করিলেন। রজনী সমাগমে গ্রীক্‌দল আনন্দ সাগরে ভাসিলেন। কিন্তু ট্রয়স্থ বীরবরেরা অসন্তুষ্টচিত্তে রণকার্য্যে পরাঙ্মুখ হইলেন। ভীমশূলপাণি হেক্‌টর উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন; হে বীরবৃন্দ! ভাবিয়াছিলাম, যে অদ্য রণে গ্রীক্‌দলের গৌরবরবিকে চির রাহুগ্রাসে নিপতিত করিব; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিরামদায়িনী নিশাদেবী, দেখ, আসিয়া উপস্থিত হইলেন, সুতরাং আমাদিগের এক্ষণে বিরাম লাভেই প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। কিন্তু অদ্য এই স্থলেই আমাদের অবস্থিতি। কেহ কেহ নগর হইতে সুখাদ্য পিষ্টকাদি দ্রব্য ও সুপেয় সুরাদি পানীয় দ্রব্য আনয়ন কর, এবং নগরবাসী জনগণকে সাবধানে রজনী যোগে নগর রক্ষার্থে কহ, এবং বাজীরাজীর রথবন্ধন নির্ব্বন্ধন কর, এবং তাহাদিগের খাদ্য দ্রব্য সকল তাহাদিগকে প্রদান কর, দেখি, কোন গ্রীক্‌ যোধ আগামী কল্য আমাদিগের পরাক্রম হইতে নিষ্কৃতি পায়।

 বীরবরের এই বাক্যে ট্রয়স্থ যোধনিকর মহানন্দে সিংহনাদ করিল। এবং তাহার বাক্যানুসারে কর্ম্ম করিল। অগ্নিকুণ্ড জ্বালাইয়া রণীগণ রণসাজে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া রণভূমিতে বসিল, যেমন অভ্রশূন্য নভোমণ্ডলে নক্ষত্রমণ্ডলী নক্ষত্ররাজের চতুষ্পার্শ্বে দেদীপ্যমান হওতঃ তুঙ্গশৃঙ্গ শৈলসকল ও দূরস্থিত বন উপবন আলোক বর্ষণে দৃশ্যমান করায়, এবং মেষপালদলের আনন্দ উৎপাদন করে, সেইরূপ গ্রীক্‌ শিবির ও স্কন্দস্‌ নদ স্রোতের মধ্যস্থলে ট্রয়দলস্থ অগ্নিকুণ্ড সমূহ শোভিতে লাগিল। এক সহস্র অগ্নিকুণ্ড জ্বলিল। প্রতিকুণ্ডের চতুষ্পার্শ্বে পঞ্চাশৎ রণবিশারদ রণী বিরাজ করিতে লাগিলেন। রণযূথের সন্নিধানে অশ্বাবলী ধবল যব ভক্ষণ করিতে লাগিল, এইরূপে সকলে কনক সিংহাসনাসীনা ঊষার অপেক্ষায় সে রণক্ষেত্রে অপেক্ষা করিতে লাগিল।


চতুর্থ পরিচ্ছেদ সমাপ্ত।



  1. এ স্থলে ৭/৮ পাত হারাইয়া গিয়াছে, এক্ষণে সময়াভাবে গ্রন্থকার পুনরায় লিখিতে সমর্থ হইলেন না।