হেক্টর বধ (১৮৭১)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
গ্রীক্সৈন্যদলের মধ্যে দ্যোমিদ্ নামে এক মহাবীর পুরুষ ছিলেন। সুনীলকমলাক্ষী দেবী আথেনী সহসা তাঁহার হৃদয়ে রণগৌরবের লাভেচ্ছা উৎপাদিত করিয়া দিলে বীরকেশরী হুহুঙ্কার ধ্বনি করতঃ রিপুদলাভিমুখে ধাবমান হইলেন। যেমন গ্রীষ্মকালে লুদ্ধক নামক নক্ষত্র সাগরপ্রবাহে দেহ অবগাহন করিয়া আকাশমার্গে উদিত হইলে, তাহার ধক্ধক্ কিরণজালে চতুর্দ্দিক প্রজ্বলিত হয়; সেইরূপ দ্যোমিদের শিরক্ষ্ন, ফলক, ও বর্ম্মসম্ভূত বিভারাশি অনিবার বহির্গত হইতে লাগিল।
এ দুর্ধর্ষ ধনুর্দ্ধরকে যোধদলের কালস্বরূপ দেখিয়া দেব বিশ্বকর্ম্মার দারেস নামক এক জন নিতান্ত ভক্তজনের দুইজন রণপ্রিয় পুত্র রথে আরোহণ পূর্ব্বক সিংহনাদে বাহির হইল। জ্যেষ্ঠ বীর রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্কে লক্ষ্য করিয়া সুদীর্ঘাকার শূল নিক্ষেপ করিলেন; কিন্তু অস্ত্র ব্যর্থ হইল। বীরর্ষভ দ্যোমিদ্ আপন শূল দ্বারা বিপক্ষের বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিলে, বীরবর সে মহাঘাতে সহসা রথ হইতে ভূতলে পতিত হইয়া কালনিকেতনে আতিথ্য গ্রহণ করিলেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার এতাদৃশী দুর্ঘটনায় নিতান্ত ভীত ও হতবুদ্ধি হইয়া সেই সুচারুনির্মিত যান পরিত্যাগ পুরঃসর ভূতলে লম্ফপ্রদান করিয়া অতিদ্রুতে পলায়ন-পরায়ণ হইতেছেন, ইহা দেখিয়া দ্যোমিদ্ তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে ভীষণ নিনাদ করতঃ ধাবমান হইলেন।
দেব বিশ্বকর্মা ভক্তপুত্রের এই দুরবস্থা দূরীকরণার্থে তাহাকে এক মায়ামেঘে আবৃত করিলেন, সুতরাং সে আর কাহারও দৃষ্টিপথে পড়িল না। ইত্যবসরে দেবী আথেনী, দেবকুলসেনানী আরেসকে টয়সৈন্যদলের উৎসাহ বর্দ্ধনার্থে ব্যগ্রতর দেখিয়া দেবযোধবরকে সম্বোধিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন; আরেস্ আরেস্, হে জনকুলনিধন! হে রক্তাক্ততাবিলাসি! হে নগর-প্রাচীর-প্রভঞ্জক! এ রণক্ষেত্রে ভাই, আমাদের কি প্রয়োজন? চল, আমরা দুজনে এস্থান হইতে প্রস্থান করি। বিশ্বপতি দেবকুলেন্দ্র, যে দলকে তাঁহার ইচ্ছা হয়, জয়ী করুন। এই কহিয়া দেবী দেবযোধবরের হস্তধারণ পূর্বক রণক্ষেত্র নিকটস্থ স্কামন্দর নামক দলশ্যাম তটে বিশ্রাম-লাভ-বাসনায় বসিলেন। রণস্থলে রণতরঙ্গ ভৈরব রবে বহিতে লাগিল। রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্নন্ প্রভৃতি মহাবিক্রমশালী বীরপুরুষেরা বহুসংখ্যক রিপুকে পরাস্ত করিয়া অকালে যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। কিন্তু রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ পরাক্রম ও বাহুবলে সর্ব্বোপরি বিরাজমান হইলেন।
যেমন, কোন নদ পর্বতজাত স্রোতসমূহের সহকারে পুষ্ট-কায় হইয়া প্রবল বলে দৃঢনির্ম্মিত সেতুনিকর অধঃপাত করতঃ বহুবিধ কুসুম ও শস্যময় ক্ষেত্রের আবরণ ভঞ্জন করে, এবং সম্মুখ-পতিত বস্তু সকল স্থানান্তরিত করতঃ দুর্বার গতিতে সাগরমুখে বহিতে থাকে। সেইরূপে রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ মহাপরাক্রমশালী জনগণকে সমরশায়ী করিয়া বিপক্ষপক্ষের ব্যুহে অবার বলে প্রবেশ করিলেন। প্রচণ্ড ধন্বী পণ্ডর্শ রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্কে রণমদে প্রমত্ত দেখিয়া, এ দুর্দ্দান্ত শূলীকে দান্ত করিতে নিতান্ত উৎসুক হইলেন। এবং ভীষণ শরাসনে গুণ যোজনা করিয়া এক তীক্ষ্ণতর শর তদুদ্দেশে নিক্ষেপিলেন। ভীষণ অশনি-সদৃশ বাণ রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদের কবচ-চ্ছেদন করতঃ দক্ষিণকক্ষে প্রবিষ্ট হইলে, সহসা শোণিত নিঃসরণে জ্যোতির্ম্ময় বর্ম্ম বিবর্ণ হইয়া উঠিল। পণ্ডর্শ সহর্ষে চীৎকার করিয়া কহিলেন, হে বীরবৃন্দ! তোমরা উল্লাসিত চিত্তে অগ্রসর হও; কেন না, আমি বোধ করি, গ্রীক্দলের বলীশ্রেষ্ঠ যে শূর, সে আমার শরে অদ্য হতপ্রায় হইয়াছে। কিন্তু বীরর্ষভ পণ্ডর্শের এ প্রগল্ভ-গর্ভ বাক্য পণ্ড হইল। দেবী আথেনীর কৃপায় রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ সে যাত্রায় নিস্তার পাইয়া পুনঃ যুদ্ধারম্ভ করিলেন। যেমন ক্ষুধাতুর সিংহ মেষপালকের অস্ত্রাঘাতে নিরস্ত না হইয়া ভীমনাদে লম্ফ দিয়া মেষাশ্রমে প্রবেশ করে, এবং সে স্থলস্থ, ভয়ে জড়ীভূত, অগণ্য মেষসমূহের মধ্যে যাহাকে ইচ্ছা, তাহকেই বধ করে; সেইরূপ রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ বৈরীদলকে নাশিতে লাগিলেন।
ট্রয়নগরস্থ বীরকুলচূড়ামণি এনেশ সৈন্য-মণ্ডলীকে লণ্ডভণ্ড দেখিয়া বীরেশ্বর পণ্ডর্শকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, হে বীরকুলতিলক! তুমি আসিয়া অতি ত্বরায় আমার এই রথে আরোহণ কর। চল, আমরা উভয়ে এই রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্কে রণে মর্দ্দন করিয়া চিরযশস্বী হই। পরে বীরদ্বয় এক রথোপরি আরূঢ় হইলে, বীরেশ এনেশ অশ্বরশ্মি ধারণ করতঃ সারথ্যকার্য্য সমাধা করিতে লাগিলেন। বিচিত্র রথ অতিবেগে চলিল। রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদের স্থিনিল্যুস নামক এক প্রিয়সখা কহিলেন, সখে দ্যোমিদ্! সাবধান হও। ঐ দেখ, দুই জন দৃঢ়কল্পী বীরবর এক যানে আরূঢ় হইয়া তোমার নিধন-সাধনার্থে আসিতেছেন। এক জনের নাম বীরকুলপতি পণ্ডর্শ। অপর জন সুধন্য বীর আঙ্কিশের ঔরসে হাস্যপ্রিয়া দেবী অপ্রোদীতীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করিয়া এনেশাখ্যায় বিখ্যাত হইয়াছেন। অতএব, হে সখে, তোমার এখন কি কর্ত্তব্য, তাহা স্থির কর!
সখাবরের এই কথা শুনিয়া রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ উত্তরিলেন, সখে, অন্য আর কি কর্ত্তব্য! বাহুবলে এ বীরদ্বয়কে শমনভবনের অতিথি করাই কর্ত্তব্য।
বিচিত্র রথ নিকটবর্তী হইলে, পণ্ডর্শ সিংহনাদে রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্কে কহিলেন, হে সাহসাকর রণপ্রিয় দ্যোমিদ্! আমার বিদ্যুৎগতি শর তোমাকে যমালয়ে প্রেরণ করিতে অক্ষম হইয়াছে বটে; কিন্তু দেখি, এক্ষণে আমার এ শূল তোমার কোন কুলক্ষণ ঘটাইতে পারে কি না? এই কহিয়া বীরসিংহ দীর্ঘ কুন্ত আস্ফালন করতঃ তাহা নিক্ষেপ করিলেন। অস্ত্র দুর্ম্মদ দ্যোমিদের ফলক ভেদ করিয়া কবচ পর্য্যন্ত প্রবেশ করিল। ইহা দেখিয়া পণ্ডর্শ কহিলেন, হে দ্যোমিদ্! নিশ্চয় জানিও, যে এইবার তোমার আসন্ন কাল উপস্থিত। কেন না, আমার শূলে তোমার কলেবর ভিন্ন হইয়াছে। রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ কহিলেন, হে সুধন্বি, এ তোমার ভ্রান্তিমাত্র। তোমার লক্ষ্য ব্যর্থ হইয়াছে। এখন যদি তোমার কোন ক্ষমতা থাকে, তবে তুমি আমার এ শূলাঘাত হইতে আত্মরক্ষা করিবার চেষ্টা পাও। এই কহিয়া বীরবর সুদীর্ঘ শূল পরিত্যাগ করিলেন।
দেবী আথেনীর মায়াবলে ভীষণ অস্ত্র প্রচণ্ড কোদণ্ডধারী পণ্ডর্শের চক্ষুর নিম্নভাগ ভেদ করিয়া চক্ষুর নিমিষে বীরবরের প্রাণ হরণ করিল। বীরবর রথ হইতে ভূতলে পড়িলেন। বহুবিধ রঞ্জনে রঞ্জিত তাহার জ্যোতির্ম্ময় বর্ম্ম ঝন্ ঝন্ করিয়া বাজিয়া উঠিল। বীর সখা পণ্ডর্শের এই দুরবস্থা সন্দর্শন করিয়া নরেশ্বর এনেশ তাহার মৃতদেহ রক্ষার্থে ফলক ও শূল গ্রহণ পূর্বক ভূতলে লম্ফ দিয়া পড়িলেন। রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ এক প্রশস্ত প্রস্তরখণ্ড, যাহা অধুনাতন দুইজন বলীয়ান্ পুরুষেও স্থানান্তর করিতে পারে না, অতি সহজে উঠাইয়া এনেশকে লক্ষ্য করিয়া নিক্ষেপ করিলেন। এনেশ বিষমাঘাতে ভগ্নোরু হইয়া রণক্ষেত্রে পড়িলেন। এনেশের শেষাবস্থা উপস্থিত হইবার উপক্রম হইতেছে, এমন সময়ে দেবী অপ্রোদীতী প্রিয়পুত্রের এতাদৃশী দুরবস্থা দর্শন করিয়া হাহাকার ধ্বনি করিতে লাগিলেন, এবং আপনার সুকোমল সুশ্বেত বাহুদ্বয় দ্বারা তাহাকে আলিঙ্গন পূর্ব্বক আপনার রশ্মিশালী পরিচ্ছদে তাহার দেহ আচ্ছাদিত করিয়া ক্ষত পুত্রকে রণভূমি হইতে দূরস্থ করিলেন।
রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ দেবী আথেনীর বরে দিব্য চক্ষুঃ পাইয়াছিলেন, সুতরাং তিনি কোমলঙ্গী দেবী অপ্রোদীতীকে দেখিয়া চিনিতে পারিলেন। এবং তাহার পশ্চাতে ২ ধাবমান হইয়া মহারোষভরে তাহার সুকোমল হস্ত তীক্ষ্ণাগ্র শূল দ্বারা বিন্ধন করিলেন, এবং কহিলেন, হে দেবপতি-দুহিতে! তুমি এ রণস্থলে কি নিমিত্ত আসিয়াছিলে? রণরঙ্গ তোমার রঙ্গ নহে। অবলা সরলা বালাকুলকে কুলের বাহির করাই তোমার উপযুক্ত রঙ্গ! অতএব তোমার এ স্থানে আসা ভাল হয় নাই। তুমি এ স্থান হইতে প্রস্থান কর।
বিষমাঘাতে ব্যথিত হইয়া দেবী পুত্রবরকে ভূতলে নিক্ষেপ করিলে, বিভাবসু রবিদেব বীরেশ এনেশকে অসহায় দেখিয়া তাহার প্রাণ রক্ষার্থে তাহাকে এমত এক ঘন ঘন দ্বারা আবৃত করিলেন, যে কেহই তাহাকে দেখিতে পাইল না এবং কোন দ্রুতগামী অশ্বারোহী গ্রীক আসিয়াও তাহার প্রাণ বিনষ্ট করিতে সমর্থ হইল না। দ্রুতগামিনী দেবদূতী ঈরীশা দেবী অপ্রোদীতীর হস্ত ধারণ করিয়া তাহাকে সৈন্যদলের বাহিরে লইয়া গেলেন। সুর-সুন্দরীর নয়ন-রঞ্জন বর্ণ বিবর্ণ হইয়া উঠিল। রণক্ষেত্রের সন্নিধানে দেবকুল-সেনানী আরেস স্কামন্দর নদ-তীরে আপন অশ্ব ও অস্ত্রজাল মায়াঅন্ধকারে অন্ধকারাবৃত করিয়া স্বয়ং সে সুদেশে বসিয়াছিলেন, ক্ষতার্ত্তা দেবী অপ্রোদীতী ভূতলে জানুদ্বয় নিপাতিত করিয়া দেবসেনানীকে কাতর বচনে কহিলেন; হে ভ্রাতঃ! যদি তুমি তোমার এ ক্লিষ্টা ভগিনীকে তোমার ঐ দ্রুতগতি রথ খানি দাও, তাহা হইলে সে তৎসহকারে অতি ত্বরায় অমরাবতীতে উত্তীর্ণ হইতে পারে। দেখ, নিষ্ঠুর দুর্দ্দান্ত রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ শূলাঘাতে আমাকে বিকলা করিয়াছে।
দেবসেনানী ভগিনীর এতাদৃশী প্রার্থনায় প্রার্থনাদ হইলে, দেবদূতী ঈরীশা তৎক্ষণাৎ আস্তে ব্যস্তে ক্ষতা দেবী অপ্রোদীতীকে সঙ্গে লইয়া উভয়ে এক রথারোহণে অমরাবতীতে চলিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া পরিহাসপ্রিয়া স্বজননী দেবী দ্যোনীর পদতলে কাঁদিয়া কহিলেন, হে জননি! দেখুন, রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ আমাকে কি যন্ত্রণা না দিয়াছে। হায়, মাতঃ! আমি প্রিয়পুত্র এনেশের রক্ষার্থে কুক্ষণে রণক্ষেত্রে পদার্পণ করিয়াছিলাম, তাহা না হইলে আমাকে এ ক্লেশভোগ করিতে হইত না। দেবী দ্যোনী দুহিতার অসহ্য বেদনার উপশম করণ মানসে নানা উপায় করিতে লাগিলেন।
তদনন্তর দেবকুলেন্দ্র হেমাঙ্গিনী অঙ্গনাকুলারাধ্যাকে সুহাস্য বদনে কহিলেন, হে বৎসে! এতাদৃশ কর্ম্ম তোমার শোভা পায় না। রণকর্ম্ম তোমার ধর্ম্ম নহে। স্ত্রীপুরুষকে প্রেমশৃঙ্খলে আবদ্ধ করা, এবং শুভ বিবাহে দম্পতীদলকে সুখসাগরে মগ্ন করা, এই সকল ক্রিয়াই তোমার প্রকৃতক্রিয়া বটে! কিন্তু ক্রূর সগ্রাম-সংক্রান্ত কর্ম্মে তোমার ও কোমল হস্তক্ষেপ করা কখনই উচিত নহে। সে সকল কর্ম্মে সেনানী আরেস ও রণপ্রিয়া আথেনী নিযুক্ত থাকুক। অমরাবতীতে এইরূপ কথোপকথন হইতে লাগিল। মর্ত্তে রণক্ষেত্রে রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ বিভাবসু রবিদেবকে অবহেলা করিয়া বীরেশ এনেশ্কে মারিতে চলিলেন। ইহা দেখিয়া দিনপতি পরুষ বচনে কহিলেন, রে মূঢ়! তুই কি অমর মরকে তুল্য জ্ঞান করিস্? রণ-দুর্ম্মদ্ দ্যোমিদ্ রোষপরবশ দেখিয়া শঙ্কাকুলচিত্তে পশ্চাদ্গামী হইলে, গ্রহকুলেন্দ্র জ্ঞানশূন্য এনেশ্কে অনতিদূরে স্বমন্দিরে রাখিলেন। তথায় দুই জন দেবী আবিভূর্তা হইয়া বীরেশের শুশ্রূষাদি করিতে লাগিলেন। এদিকে রবিদেব মায়াকুহকে বীরেশ এনেশের রূপ ধারণ করিয়া রণস্থলে রণিতে লাগিলেন। সেনানী আরেসও ট্রয় নগরস্থ সেনাদলকে যুদ্ধার্থে উৎসাহ প্রদানিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
ইতিমধ্যে দেবীদ্বয়ের শুশ্রূষায় বীরেশ্বর এনেশ কিঞ্চিৎ সুস্থতা ও সবলতা লাভ করিয়া পুনরায় রণক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন, এবং অনেকানেক বিপক্ষপক্ষ রথীদলকে ভূতলশায়ী করিলেন। বীরচূড়ামণি হেক্টর সর্পীদন নামক বীরের পরামর্শে রণস্থলে পুনঃ দৃশ্যমান হইলেন। ট্রয় নগরস্থ সেনা বীরবরের শুভাগমনে যেন পুনর্জ্জীবন পাইয়া মহাকোলাহলে শত্রুদলকে আক্রমণ করিল। গ্রীক্দল রিপুদলপাদোত্থিত ধূলায় ধূষরিত হইয়া উঠিল। বীরচুড়ামণি হেক্টর সিংহনাদ করতঃ সসৈন্যে যুদ্ধারম্ভ করিলেন। সেনানী আরেস্ ও উগ্রচণ্ডা দেবী বেলোনা বীরবরের সহায় হইলেন। সেনানী স্কন্দ কখন বা অরিন্দমের অগ্রে কখন বা পশ্চাতে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ বীরচুড়ামণি হেক্টরের পরাক্রমে ভয়াক্রান্ত হইয়া অপসৃত হইলেন। যেমন কোন পথিক তমোময়ী নিশাতে কোন অজ্ঞাত পথে যাইতে যাইতে সহসা শ্রুত, বর্ষার প্রসাদে মহাকায়, কোন নদ্স্রোতের গম্ভীর নিনাদে ভীত হইয়া পুরোগতিতে বিরত হয়, দ্যোমিদেরও অবিকল সেই দশা ঘটিয়া উঠিল। তিনি বীরদলকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে বীরপুরুষগণ! আমার বোধ হয়, যে কোন দেব যেন বীরচুড়ামণি হেক্টরের সহকারিতা করিতেছেন, নতুবা বীরবর রণে এরূপ দুর্ব্বার হইয়া উঠিবেন কেন? মরামরে সমর সাম্প্রত নহে। অতএব এই রণে ভঙ্গ দেওয়া আমাদের উচিত।
বীরবরের এই বাক্য শ্রবণে এবং ভাস্বর-কিরীটী বীরেশ্বর হেক্টরের নশ্বরাঘাতে বীরবৃন্দ রণরঙ্গে ভঙ্গ দিতে উদ্যত হইতেছে; এমত সময়ে শ্বেতভুজা ইন্দ্রাণী হীরী দেবী আথেনীকে সম্বোধিয়া কহিলেন, হে সখি! আমরা মহেষ্বাস মানিলুসের সকাশে কি বৃথা অঙ্গীকারে আবদ্ধ হইয়াছি। দেখ, শোণিত-প্রিয় দেব-সেনানী অরিন্দম হেক্টরের সহকারে কত শত গ্রীক্ বীরেন্দ্রকে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত ও চির-অন্ধকারে অন্ধকারাবৃত করিতেছেন। হে সখি, চল, আমরা দুজনে এই রণস্থলে অবতীর্ণ হইয়া দেখি, যদি আমরা এ দুরন্ত দেবসেনানীকে কোনপ্রকারে শান্ত করিয়া এ নরান্তক হেক্টরের বলের ত্রুটি করিতে পারি।
এই কহিয়া আয়তলোচনা দেবী আপন আশুগতি বাজীরাজিকে স্বর্ণ রণসজ্জায় সজ্জিত করিলেন। দেবকিঙ্করী হীবী হৈমময় দেবযান যোজনা করিয়া দিলেন। দেবীদ্বয় তদুপরি রণবেশে আরূঢ় হইলেন। অমরাবতীর হৈমদ্বার সুমধুর ধ্বনিতে খুলিল। বিমান নভঃস্থল হইতে আশুগতিতে ধরণীর দিকে আসিতে লাগিল। রণস্থলের নিকটবর্তী কোন এক নদতটে দেবযান মায়ামেঘে আবৃত করিয়া ভীমাকৃতি দেবীদ্বয় ভীম সিংহনাদে প্রচণ্ড খণ্ডা আস্ফালন করতঃ রণস্থলে প্রবেশ করিলেন। গ্রীক্দলের সাহসাগ্নি পুনর্ব্বার যেন দুর্ব্বার হুতাশন-তেজে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল। দেবেন্দ্রাণী হীরীও প্রবলভাষী প্রশস্তান্তঃকরণ স্তন্তুরনামক কোন এক জন বীরের প্রতিমূর্ত্তি ধারণ করিয়া হুহুঙ্কার ধ্বনিতে গ্রীকদলের উৎসাহ বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন। সুনীলকমলাক্ষী দেবী আথেনী রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদের সারথিকে অপদস্থ করিয়া তৎপদে স্বয়ং আরোহণ করিলেন। মহাভরে চক্রদ্বয় যেন আর্তনাদস্বরূপ ঘোর ঘর্ঘরনাদে ঘুরিতে লাগিল। দেবী স্বয়ং অশ্বরজ্জু ও কশা ধারণ পূর্ব্বক রক্তাক্ত সেনানীর দিকে অতি দ্রুত বেগে রথ পরিচালনা করিলেন। সুরসেনানী দুর্ম্মদ দ্যোমিদ্কে আসিতে দেখিয়া আপন রথ ভীষণ বেগে পরিচালিত করতঃ ভীষণ শূল দ্বারা নর-রিপুকে শমনধামে প্রেরণ করিবার জন্যে বাহু প্রসারণ করিয়া ভীষণ শূল দৃঢতররূপে ধারণ করিলেন। কিন্তু মায়াময়ী দেবী আথেনী অদৃশ্যভাবে সে শূলের লক্ষ্য ক্ষণমাত্রে আমোদ করিয়া দিলেন। রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ দুর্দ্ধর্ষ আরেসকে আপন শূল দিয়া আক্রমণ করিলে, দেবী আথেনী স্ববলে ঐ অস্ত্র দ্বারা সুর-সেনানীর উদর তলে ভীমাঘাত করিলেন। দেববীরেন্দ্র বিষম যাতনায় গম্ভীর আর্তনাদ করিলেন। যেমন রণমদে প্রমত্ত নয় কি দশ সহস্র রথীদল একত্রীভূত হইয়া হুহুঙ্কারিলে চতুর্দ্দিকে ভৈরবারবে পরিপূর্ণ হয়, বীরেন্দ্রের আর্তনাদে অবিকল সেইরূপ হইল।
শঙ্কা দেবী সহসা উভয় দলের মধ্যে দর্শন দিলেন। যেমন গ্রীষ্মকালে বাত্যারম্ভে মেঘগ্রামের একত্র সমাগমে আকাশমণ্ডল ঝটিত অন্ধকারময় হয়; সেইরূপ ভয়জনক মালিন্যে মলিন বদন হইয়া নিত্য রণপ্রিয় সুররথী অমরাবতীতে চলিলেন।
দেবেন্দ্রের সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া দেব বীরকেশরী নিবেদিলেন, হে বিশ্বপিতঃ! দেখুন, আপনি কেমন একটী উন্মত্তা ও পাষাণ-হৃদয়া দুহিতার সৃষ্টি করিয়াছেন। দেবী আথেনীর উৎসাহ সহকারে রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদ্ আমার কি দুরবস্থা না করিয়াছে? এই বাক্যে দেবপতি উত্তর করিলেন, রে দুরন্ত নিত্যকলহপ্রিয় দেব কুলাঙ্গার! তুই অন্যের উপর কোন্ মুখ দিয়া অভিযোগ ও দোষারোপ করিস্! তুই তোর গর্ভধারিণী হীরীর খর ও অনমনশীল স্বভাব প্রাপ্ত হইইয়াছিস! সে এত দূর অদমনীয়া, যে আমিও তাহাকে দমন করিতে অক্ষম। সে যাহাহউক, তুই আমার ঔরসজাত, নতুবা আমি উরানুসপুত্র দৈত্যদলের সহিত তোকে এইমুহূর্তেই চিরকালের নিমিত্ত কারাগারে আবদ্ধ করিতাম। এই কহিয়া দেবকুলপতি দেবধন্বন্তরী পায়ন্কে যথাবিধি ঔষধে ক্ষত সেনানীকে আরোগ্য করিতে আজ্ঞা দিলেন।
রণস্থল হইতে দেবসেনানীকে পলায়মান দেখিয়া জননী অতীব বীর্য্যবতী দেবী হীরী মহাবলবতী সহকারিণী দেবী আথেনীর সহিত স্বর্গধামে পুনর্গমন করিলেন। তদনন্তর ক্রমে ক্রমে বীরকুলের পরাক্রমাগ্নি রণস্থলে যেন নিস্তেজ হইতে লাগিল। কিন্তু ইতস্ততঃ সে পরাক্রমাগ্নি যৎকিঞ্চিৎ প্রজ্বলিত রহিল।
এমত সময়ে কোন এক ট্রয়স্থ বীরবর দুর্ভাগ্যক্রমে স্কন্দপ্রিয় বীরেশ মানিল্যুসের হস্তে পড়িলেন। ভাগ্যহীন বীরবরের অশ্বদয় সচকিতে রথসহ ধাবমান হইলে পর, রথচক্র পথস্থিত কোন এক বৃক্ষের আঘাতে ভগ্ন হইলে, বীরবর লম্ফ দিয়া ভূতলে পড়িলেন। এ দুরবস্থায় নিরস্ত্র হইয়া ভগ্নরথ রথী কালদণ্ডধারী কালের ন্যায় প্রচণ্ড শূলী রণপ্রিয় বীরসিংহ মানিল্যুস্কে সকাশে দণ্ডায়মান দেখিলেন, এবং সভয়ে তাহার জানুদ্বয় গ্রহণ করতঃ বিনীত বচনে কহিলেন, হে বীরকুলহর্ষ্যক্ষ! আপনি আমাকে প্রাণ দান দিউন। আমি যে আপনার বন্দী হইয়া এ মানবলীলাস্থলে জীবিত আছি, আমার ধনাঢ্য পিতা এ সুসম্বাদ পাইলে বহুবিধ ধনে আমার মোচনক্রিয়া সমাধা করিতে সযত্ন হইবেন। রিপুবরের এতাদৃশী কাতরতায় বীরকেশরী মানিল্যুসের হৃদয়ে করুণার সঞ্চার হইল। তিনি তাহার রক্ষার উপায় করিতেছেন, এমত সময়ে রাজচক্রবর্তী আগেমেম্নন্ আরক্ত নয়নে অগ্রগামী হইয়া পরুষ বচনে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, হে কোমল-হৃদয়! ট্রয়স্থ লোকদিগের হস্তে তুমি কি এত দূর পর্য্যন্ত উপকৃত হইয়াছ যে, তোমার অন্তঃকরণ এখনও তাহাদিগের প্রতি দয়ার্দ্র। দেখ ভাই! আমার বিবেচনায়, ও পাপনগরের আবাল বৃদ্ধ বনিতা, কি উদরস্থ শিশু, যাহাকে পাও, তাহাকেই যমালয়ে প্রেরণ করা তোমার পক্ষে শ্রেয়। সহোদরের এই ব্যঙ্গরূপ নিদাঘে বীরবর মানিল্যুসের হৃৎসরোবরস্থ করুণারূপ মুকুলিত কমল শুষ্ক হইল। তিনি হতভাগা অদ্রুস্তুস্কে ভ্রাতৃ সন্নিধানে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিলে, নিষ্ঠুর জ্যেষ্ঠভ্রাতা তাহার উদরদেশ খরশুলে ভিন্ন করিলেন। অদ্রুস্তুস্ ভীমার্ত্তনাদে ভুপতিত হইলেন। রাজচক্রবর্তী সৈন্যাধ্যক্ষ মহোদয় তাহার বক্ষঃস্থলে পদ নিক্ষেপ করিয়া স্ববলে শূল টানিয়া বাহির করিলেন। ক্লিব বিভাবরী অভাগা অদ্রুস্তুসের নয়নরশ্মি চিরকালের নিমিত্ত অন্ধকারাবৃত করিল। এবং বীরবরের দেহাগার হইতে অকালমুক্ত আত্মা বিষণ্ণবদনে যমালয়ে চলিল। গ্রীক্ সৈন্যদল মধ্যে যেন পুনরুত্তেজিত অগ্নির ন্যায় রণাগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদের পরাক্রমে ট্রয়দল রণপরাঙ্মুখতার লক্ষণ প্রদর্শন করাইতে লাগিল। এতদ্দর্শনে রাজকুলপতি প্রিয়ামের সুবিজ্ঞ দৈবজ্ঞ পুত্র হেলেন্যুস্ ভাস্বর-কিরীটী বীরেশ্বর হেক্টর ও বীরেশ এনেশকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে বীরদ্বয়, তোমরা রণপরাঙ্মুখ সৈন্যদলকে পুনরুৎসাহান্বিত কর। কেন না, তোমরা এ দলের বীরকুলশ্রেষ্ঠ! পরে যোধগণ দৃঢ়চিত্তে ও অধ্যবসায় সহকারে রণারম্ভ করিলে, তুমি, হে ভ্রাতঃ হেক্টর, নগরান্তরে প্রবেশ করতঃ আমাদিগের রাজ-জননীর চরণতলে এই নিবেদন করিও, যে তিনি যেন অতি ত্বরায় ট্রয়স্থ বৃদ্ধা কুলবধূ দলের মধ্যে সুকেশিনী মহাদেবী আথেনীর দুর্গশিরস্থিত মন্দিরে উপস্থিত হইয়া বহুবিধ উপহারে তাঁহার আরাধনা করিয়া এই বর মাগেন যে, দেবকুলেন্দ্র-বালা যেন এ রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদের হস্ত হইতে আমাদিগকে রক্ষা করেন। আমার বিবেচনায় এ রথীপতি দেবযোনি আকিলীসের অপেক্ষাও পরাক্রমশালী। ভ্রাতারা এই হিতকর বাক্য শ্রবণে ভাস্বর-কিরীটী বীরেশ্বর হেক্টর রথ হইতে লম্ফ দিয়া ভূতলে পড়িলেন। এবং স্বীয় ভীষণ দীর্ঘ-ছায় শত্রুঘ্ন শূল আন্দোলন করতঃ হুহুঙ্কার ধ্বনিতে রণক্ষেত্র পরিপূর্ণ করিলেন। গ্রীক্ সৈন্যদল বীরবরের এতাদৃশী অকুতোভয়তা সন্দর্শনে পলায়ন-পরায়ণ হইয়া পরস্পর কহিতে লাগিল, এ রথী কি মানবযোনি না নরমণ্ডলে নক্ষত্রমণ্ডিত আকাশমণ্ডল হইতে দেবতার?
এদিকে অরিন্দম ট্রয়কুলবীরেন্দ্র আপনাদের স্বদলকে পুনরুৎসাহ প্রদান পূর্ব্বক সুন্দর স্যন্দনে আশুগতি অশ্বযোজনা করিয়া নগরাভিমুখে প্রয়াণ করিলেন। কতক্ষণ পরে বীরকেশরী স্কিয়ান্-নামক নগর তোরণসম্মুখে উপস্থিত হইলেন। অমনি চতুর্দ্দিক হইতে কুলবালা কুলবধূ ও কুলজননীগণ বহির্গত হইয়া সুমধুর স্বরে, কেহবা ভ্রাতা, কেহবা প্রণয়ী জন, কেহবা স্বামী, কেহবা পুত্র, এই সকলের কুশলবার্ত্তা অতীব বিকল হৃদয়ে জিজ্ঞাসিতে লাগিলেন। কিন্তু বীরপতি তাহাদিগকে এই কহিয়া বিদায় করিলেন, যে তোমরা এ সকল প্রিয়পাত্রের মঙ্গলার্থে মঙ্গলকারী দেবদলের আরাধনা কর। কেননা, অনেকের দুর্ভাগ্য আসন্ন প্রায়, এই কহিয়া রাজপুত্র অতিদ্রুত গমনে রাজ-অট্টালিকার নিকটবর্তী হইলেন। রাজরাণী হেকাবী রাজা প্রিয়ামের রাজহর্ম্ম্য হইতে পুত্রকুলোত্তম বীরবর হেক্টরকে দর্শন করিয়া তৎসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন, এবং স্নেহার্দ্র হইয়া তাহার করগ্রহণপূর্ব্বক কহিলেন, বৎস! তুই কি নিমিত্ত রণক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়া নগর মধ্যে আসিয়াছিস্। তুই কি এ জঘন্য রিপুদলের জিঘাংসায় দেবপিতা দেবেন্দ্রকে দুর্গস্থিত মন্দিরে বন্দিতে আসিয়াছিস্, তুই কিয়ৎকাল এখানে অবস্থিতি কর। এই দেখ, আমি স্বর্ণপাত্রে করিয়া প্রসন্নকারক দ্রাক্ষারস আনিয়াছি। তুই আপনি তার কিঞ্চিদংশ পান কর, কেননা, ক্লান্ত জনের ক্লান্তিহরণার্থে সুধারূপ সুরাই পরম ঔষধ। আর কিঞ্চিদংশ দেবকুলপতির তর্পণার্থে ভূমিতে ঢালিয়া দে, ভাস্বর-কিরীটী রণীকুলেশ্বর হেক্টর উত্তর করিলেন, হে জননি! তুমি আমাকে সুরাপান করিতে অনুরোধ করিও না। কেননা, তাহার মাদকতা শক্তি আছে, হয়ত, তাহার তেজে বাহুবলের অনেক অনিষ্ট হইতে পারিবে, আর আমি, হে ভগবতি! এ অপবিত্র রক্তাক্ত হস্ত দিয়া পাত্রগ্রহণ করতঃ দেবেন্দ্রের তর্পণার্থে সুরা ঢালিয়া দি, ইহা কোন মতেই যুক্তিযুক্ত নহে। এই উদ্দেশেই নগর প্রবেশ করি নাই। আমি তোমার নিকট এই যাচ্ঞা করিতেছি, যে তুমি, হে রাজমাতঃ, অবিলম্বে ট্রয়স্থ বৃদ্ধা অতি মাননীয়া কুলবধূদলের সহিত দুর্গশিরস্থ সুকেশিনী মহাদেবী আথেনীর মন্দিরে গিয়া নানাবিধ উপহারে দেবীর পূজা করিয়া এই বর প্রার্থনা কর, যে তিনি যেন রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদের পরিক্রমাগ্নি হইতে আমাদিগকে রক্ষা করেন। আমি ইত্যবসরে একবার স্কন্দরের সুন্দর মন্দিরে যাই, দেখি, যদি সে ভীরু কাপুরুষের হৃদয়ে রণপ্রবৃত্তি জন্মাইতে পারি, হায়, মাতঃ! তুমি যখন এ কুলাঙ্গারকে প্রসব করিয়াছিলে তখন বসুমতী দ্বিধা হইয়া কেন তাহাকে গ্রাস করেন নাই। তাহা হইলে কখনই এ বিপুল রাজকুলের এতাদৃশী দুর্গতি ঘটিত না। রাজ কুলতিলক এই কহিলে, দেবী হেকাবী দ্রুতগতিতে আপন সুগন্ধময় মন্দির হইতে বহুবিধ পূজোপহারের আয়োজন করিলেন। এবং দূতীদ্বারা বৃদ্ধা ও মান্যা কুলবতীদলকে আহ্বান করতঃ মহাদেবীর মন্দিরাভিমুখে চলিলেন। তেয়ানীনাম্নী কিসীশনামক কোন এক মাননীয় ব্যক্তির ইক্ষুনিভাননা দুহিতা, যিনি মহাদেবীর নিত্য সেবিকা ছিলেন, মন্দির-দ্বার উদ্ঘাটন করিলে রমণীদল ক্রন্দনধ্বনিতে মন্দির পরিপূর্ণ করিলেন। এবং মনে মনে নানা মানসিক করিয়া এই বর প্রার্থনা করিলেন, যে দেবকুলেন্দ্রবালা রণদুর্ম্মদ দ্যোমিদের এবং অন্যান্য গ্রীক্যোধের বাহুবল দুর্ব্বল করিয়া ট্রয়নগরস্থ কুলবধূ ও শিশুকুলের মান ও প্রাণ রক্ষা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সুকেশিনী মহাদেবী এ বর প্রদানে বিমুখ হইলেন।
এদিকে অরিন্দম হেক্টর সুন্দরবীর স্কন্দরের বিচিত্র পাষাণ-নির্ম্মিত সুন্দর মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, যে বিলাসী আপন সুচারু বর্ম্ম, ফলক, ও অস্ত্র শস্ত্র প্রভৃতি রণপরিচ্ছদ সকল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিতেছেন। বীরবর হেক্টর তাহাকে পরুষ বচনে ভর্ৎসনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, রে দুরাচার দুর্ম্মতি! তোর নিমিত্তে শত শত লোক শোণিত প্রবাহে রণভূমি প্লাবিত করিতেছে। আর তুই এখানে এরূপ নিশ্চিন্ত অবস্থায় বিশ্রাম লাভ করিতেছিস্। হায়, তোরে ধিক্!
দেবাকৃতি সুন্দরবীর স্কন্দর ভ্রাতার এতাদৃশ বচন বিন্যাসে উত্তরিলেন, হে ভ্রাতঃ! তোমার এ তিরস্কারবাক্য অনুপযুক্ত নহে। সে যাহা হউক, তুমি ক্ষণকাল এখানে অপেক্ষা কর, আমাকে রণসজ্জায় সজ্জিত হইতে দাও। নতুবা তুমি অগ্রগামী হও। আমি অতি ত্বরায় তোমার অনুসরণ করিব। এই কথায় বীরবর হেক্টর কোন উত্তর না করাতে হেলেনী রূপসী অতি সুমধুর ভাবে কহিলেন, হে দেবর! এ অভাগিনীর কি কুক্ষণে জন্ম; দেখুন, আমি সতীধর্ম্মে ও কুললজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়া কেমন ভীরুচিত্ত জনকে বরণ করিয়াছি। আমার কি দুর্ভাগ্য! কিন্তু ও আক্ষেপ এক্ষণে বৃথা। আপনি অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া আসন পরিগ্রহ পূর্ব্বক কিয়ৎকালের নিমিত্ত বিশ্রাম লাত করুন। হেক্টর কহিলেন, হে ভদ্রে! আমার বিরহে দূররণক্ষেত্রে রণীবৃন্দ অতীব কাতর, অতএব আমি এস্থলে আর বিলম্ব করিতে পারি না। কেননা, আমার এই ইচ্ছা, যে আমি পুনঃ রণযাত্রার অগ্রে একবার স্বগৃহে প্রবেশ করিয়া প্রিয়তমা পত্নী, শিশু-সন্তানটী ও তাহাদের সেবানিযুক্ত সেবক-সেবিকাদিগকে দেখিয়া যাই। কে জানে, যে আমি এই রণভুমি হইতে আর পুনরাবর্ত্তন করিতে পারিব কি না। এই বলিয়া ভাস্বর-কিরীটী হেক্টর দ্রুত গতিতে স্বধামে চলিলেন। এবং গৃহে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, যে শ্বেতভুজা অন্ধ্রমোকী সে স্থলে অনুপস্থিত, শুনিলেন, যে রণে গ্রীকদলের জয়লাভ হইতেছে, এই সম্বাদে প্রিয়ম্বদা আপন শিশু সন্তানটী লইয়া তাহার সুবেশিনী দাসীর সমভিব্যাহারে রণক্ষেত্র-দর্শনাভিপ্রায়ে যাত্রা করিয়াছেন। এই বার্তা শ্রবণমাত্র বীরকেশরী বাগ্রচিত্তে তদভিমুখে বায়ুবেগে চলিলেন। অনতিদূরে অরিন্দম, চিরানন্দ ভার্য্যার সাক্ষাৎকার লাভ করিলেন, এবং দাসীর ক্রোড়ে আপনার শিশুসন্তানটাকে দেখিয়া ওষ্ঠাধর স্নেহাহ্লাদে সুহাসাবৃত হইয়া উঠিল। কিন্তু অন্ধ্রমোকী স্বামীর স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া রোদন করিতে করিতে গদ্গদস্বরে কহিতে লাগিলেন, হায় প্রাণনাথ! আমি দেখিতেছি, এই বীরবীর্য্যই তোমার কাল হইবে, রণমদে উন্মত্ত হইলে এ অভাগিনী কিম্বা তোমার এ অনাথ শিশু-সন্তানটী, আমরা কেহই কি তোমার স্মরণ পথে স্থান পাই না। হায়! তুমি কি জাননা, যে আমাদর কুলরিপুদলের যোধবর্গ তোমার নিধনসাধনে নিরবধি ব্যগ্র? আর যদি তাহাদের এতাদৃশ মনস্কামনা ফলবতী হয়, তবে আমাদের উভয়ের যৎপরোনাস্তি দুর্দশা ঘটিবে। বরঞ্চ ভগবতী বসুমতী এই করুন যে, তিনি যেন এ বিষম বিপদ উপস্থিত হইবার পূর্বেই দ্বিধা হইয়া এ হতভাগিনীকে আশ্রয় দেন। হে নাথ! তোমার অভাবে এ ধরণীতলে এ অভাগিনীর ভাগ্যে কি কোন সুখভোগ সম্ভবে। তোমা ব্যতীত, হে প্রাণেশ্বর! আমার আর কে আছে? জনক, জননী, সহোদর সকলেই এ হতভাগিনীর ভাগ্যদোষে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন, হে নাথ! তোমা বিহনে আমি যথার্থই অনাথা কাঙ্গালিনী হইব। তুমি আমার জীবন সর্বস্ব! তুমি আমার প্রেমাকর। অতএব আমি তোমাকে এই মিনতি করিতেছি, যে তুমি তোমার এই শিশু-সন্তানটীকে পিতৃহীন, আর এ অভাগিনীকে ভর্ত্তৃহীনা করিও না। রিপুদলের সহিত নগর-তোরণ-সম্মুখে যুদ্ধ কর, তাহা হইলে রণ-পরাজয়কালে পলায়ন করা অতি সহজ হইবে। ভাস্বর কিরীটী মহাবাহু হেক্টর উত্তরিলেন, প্রাণেশ্বরি! তুমি কি ভাব, যে এ সকল দুর্ভাবনায় আমারও হৃদয় বিদীর্ণ হয় না। কিন্তু কি করি, যদি আমি কোন ভীরুতার লক্ষণ দেখাই, তাহা হইলে বিপক্ষদলের আর আস্পর্দ্ধার সীমা থাকিবে না। এবং আমাদেরও বিলক্ষণ ব্যাঘাতেরও সম্ভাবনা, তাহা হইলেই এই ট্রয়স্থ পুরুষ ও সুবেশিনী স্ত্রীদের নিকট আমি আর কি করিয়া মুখ দেখাইব। বিশেষতঃ যদি আমি বিপদের সময়ে উপস্থিত না থাকি, তাহা হইলে আমাদের এ বিপুল কুলের গৌরব ও মান কিসে রক্ষা হইবে। প্রিয়ে, আমি বিলক্ষণ জানি, যে রিপুকুল রণজয়ী হইয়া অতি অল্পদিনের মধ্যেই এ উচ্চ প্রাচীর নগর ভস্মসাৎ করিবে, এবং রাজকুলতিলক প্রিয়াম্ তাহার রণবিশারদ জনগণের সহিত কালগ্রাসে পতিত হইবেন। কিন্তু রাজকুলেন্দ্র প্রিয়াম্ কি রাজকুলেন্দ্রাণী হেকুবা কিম্বা আমার বীরবীর্য্য সহোদরাদিগণ এ সকলের আসন্ন বিপদে আমার মন যত উদ্বিগ্ন হয়, তোমার বিষয়ে, হে প্রেয়সি! আমার সে মন তদপেক্ষা সহস্রগুণ কাতর হইয়া উঠে। হায় প্রিয়ে! বিধাতা কি তোমার কপালে এই লিখেছিলেন, যে অবশেষে তুমি আরগস্ নগরীর কোন ভর্ত্রিণীর আদেশে, অশ্রুজলে আর্দ্রা হইয়া নদ নদী হইতে জল বহিবে, এবং ভ্রষ্ট জন সমূহে ইঙ্গিত করিয়া এ উহাকে কহিবে, ওহে, ঐ যে স্ত্রীলোকটা দেখিতেছ, ও ট্রয় নগরস্থ বীরদলের আদমী হেক্টরের পত্নী ছিল। এই কথা কহিয়া বীরবর হস্ত প্রসারণ পূর্ব্বক শিশু সন্তানটীকে দাসীর ক্রোড় হইতে লইতে চাহিলেন, কিন্তু জ্ঞানহীন শিশু কিরীটের বিদ্যুতাকৃতি উজ্জ্বলতায় এবং তদুপরিস্থ অশ্বকেশরের লড়নে ডরাইয়া ধাত্রীর বক্ষনীড়ে আশ্রয় লইল। বীরবর সহাস্য বদনে মস্তক হইতে কিরীট খুলিয়া ভূতলে রাখিলেন, এবং প্রিয়তম সন্তানের মুখচুম্বন করিয়া কহিলেন, হে জগদীশ! এ শিশুটিকে ইহার পিতা অপেক্ষাও বীর্য্যবত্তর কর। এই কথা কহিয়া দাসীর ইস্তে শিশুকে পুনরর্পণ করিয়া শিরোদেশে কিরীট পুনরায় দিয়া যুদ্ধক্ষেত্রাভিমুখে যাত্রার্থে প্রেয়সীর নিকট বিদায় লইলেন। সুন্দরী রাজ-অট্টালিকাভিমুখে চলিলেন বটে; কিন্তু মুহুর্মুহু পশ্চাৎভাগে চাহিয়া প্রিয়পতির প্রতি সতৃষ্ণে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতঃ মেদিনীকে আশ্রুবারিধারায় আর্দ্র করিতে লাগিলেন।
এ দিকে সুন্দরবীর স্কন্দর দেদীপ্যমান অস্ত্রালঙ্কারে অলঙ্কৃত হইয়া, যেমন বন্ধন-রজ্জুমুক্ত অশ্ব গম্ভীর হ্রেষারব করিয়া উচ্চপুচ্ছে মন্দুরা হইতে বহির্গত হয়, সেইরূপ নগর তোরণ হইতে বাহিরিলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ সমাপ্ত।