হেক্‌টর বধ (১৮৭১)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 এ দিকে ট্রয় নগরস্থ রাজতোরণ হইতে বীরদল রণসজ্জায় সজ্জিত হইয়া ভাস্বরকিরীটী রিপুকূল-মর্দন বীরেন্দ্র হেক্‌টরকে সেনাপতি-পদে অভিষিক্ত করিয়া হুহুঙ্কার ধ্বনিতে রণক্ষেত্রে উপস্থিত হইল। পদধূলি-রাশি কুজ্ঝটিকারূপে আকাশ মার্গে উত্থিত হইয়া রণস্থল যেন অন্ধকারময় করিল। দুই দল পরস্পর সম্মুখবর্তী হইয়া রণোদ্যোগ করিতেছে, এমন সময়ে দেবাকৃতি সুন্দর বীর স্কন্দর, হস্তে বক্র ধনুঃ, পৃষ্ঠে তৃণ, উরুদেশে লম্বমান অসি, দক্ষিণ হস্তে কুন্ত আস্ফালন করতঃ অগ্রসর হইয়া বীরনাদে বিপক্ষ পক্ষের বীরকুলেন্দ্রকে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে আহ্বান করিলেন। ক্ষুধাতুর সিংহ দীর্ঘশৃঙ্গী কুরঙ্গী কিম্বা অন্য কোন বনচর অজাদি পশু সন্দর্শনে নিরতিশয় উল্লাস সহকারে বেগে তদভিমুখে ধাবমান হয়, সেইরূপ রণবিশারদ বীরকুলতিলক মানিল্যুস চিরঘৃণিত বৈরীকে দেখিয়া রথ হইতে ভূতলে লম্ফ প্রদান করিলেন। এবং এই মনে ভাবিলেন, যে দেবপ্রসাদে সেই চির-ঈপ্সিত সময় উপস্থিত হইয়াছে, যে সময়ে তিনি এই অকৃতজ্ঞ অতিথির যথাবিধি প্রতিবিধান করিতে পারিবেন। কিন্তু যেমন কোন পথিক সহসা পথপ্রান্তে গুল্মমধ্যে কালসর্পকে দর্শন করিয়া ত্রাসে পুরোগমনে বিরত হয়, সেইরূপ সুন্দর বীর স্কন্দর মানিল্যুসকে দেখিয়া ভয়ে কম্পিতকলেবর হইয়া স্বসৈন্য মধ্যে পুনঃ প্রবেশ করিলেন।

 ভ্রাতার এতাদৃশী ভীরুতা ও কাপুষতা সন্দর্শনে মহেষ্বাস হেক্‌টর ক্রোধে আরক্ত-নয়ন হইয়া এই রূপে তাহাকে ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন,—রে পামর! বিধাতা কি তোকে এ সুন্দর বীরকৃতি কেবল স্ত্রীগণের মনোমোহনার্থেই দিয়াছেন। হা ধিক্! তুই যদি ভূমিষ্ঠ হইবা মাত্র কালগ্রাসে পতিত হইতিস্‌, তাহা হইলে, তোর দ্বারা আমাদের এ জগদ্বিখ্যাত পিতৃকুল কখনই সকলঙ্ক হইতে পারিত না। তোর মূর্ত্তি দেখিলে, আপাততঃ বোধ হয়, যে তুই ট্রয়নগরস্থ একজন বীর পুরুষ! কিন্তু তোর ও হৃদয়ে সাহসের লেশ মাত্রও নাই। তোরে ধিক্‌! তুই স্ত্রীলোক অপেক্ষাও অধম ও ভীরু। তোর কি গুণে যে সেই কৃশোদরী রমণী বীরকুলেপ্সিতা বীর পত্নীর মন ভুলিল, তাহা বুঝিতে পারি না। তোর সেই সতত-বাদিত সুমধুর বীণা, যদ্বারা তুই প্রেমদেবীর প্রসাদে প্রমদাকুলের মনঃ হরণ করিস, অতি ত্বরায়ই নীরব হইবে। আর তোর এই নারীকুল-নিগড়-স্বরূপ চূর্ণকুণ্ডল ও তোর এই নারীকুল-নয়নরঞ্জন অবয়ব অচিরে ধূলায় ধূসরিত হইবে। এমন কি, যদি ট্রয়নগরস্থ জনগণের হৃদয় দয়ার্দ্র না হইত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাহারা এই দণ্ডেই প্রস্তর-নিক্ষেপণে তোর কঙ্কালজাল চুর্ণ করিত। রে অধম! তোর সদৃশ স্বদেশের অহিতকারী ব্যক্তি কি আর দুটি আছে।

 সোদরের এইরূপ তিরস্কারে ও পরুষবচনে দেবাকৃতি সুন্দর বীর স্কন্দর অতি মৃদুভাবে ও নতশিরে উত্তর করিলেন—হে ভ্রাতঃ হেক্‌টর! তোমার এ তিরস্কার ন্যায্য! তন্নিমিত্তই আমি ইহা সহ্য করিতেছি। বিধাতা তোমাকে বলীকুলের কুলপ্রদীপ করিয়াছেন বলিয়া তুমি যে সৌন্দর্য্য প্রভৃতি নারীকুল-মনোহারিণী দেবদত্ত গুণাবলীকে অবহেলা কর, ইহা কি তোমার উচিত? তবে তোমার, ভাই, যদি ইচ্ছা হয়, তুমি উভয়দল মধ্যে এই ঘোষণা করিয়া দাও, যে আমি নারীকুলোত্তমা হেলেনী সুন্দরীর নিমিত্ত মহেষ্বাস মানিল্যুসের সহিত একাকী যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত আছি। আমাদের দুই জনের মধ্যে যে জন জয়ী হইবে, সে জন সেই সুন্দরী বামাকে জয়-পতাকা-স্বরূপ লাভ করিবে। আর তোমরা উভয় দলে চিরসন্ধি দ্বারা এ দুরন্ত রণাগ্নি নির্বাণ পূর্ব্বক, যাহারা এদেশনিবাসী, তাহারা ট্রয়নগরে ও যাহারা দ্রুতগ-তুরগযোনি ও কুরঙ্গনয়না অঙ্গনাময় হেলস্-দেশ-নিবাসী, তাহারা সেই সুদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিও।

 বীরর্ষভ হেক্‌টর ভ্রাতার এতাদৃশ বচনে পরমাহ্লাদে স্বকুন্তের মধ্যস্থল ধারণ করতঃ উভয়দলের মধ্যগত হইয়া স্ববলদলকে রণকার্য্য হইতে নিবারিলেন। গ্রীক্‌যোধের অরিন্দম হেক্‌টরকে সহায়হীন সন্দর্শনে আস্তে ব্যস্তে শরাসনে শর যোজনা করিতে লাগিল। কেহ বা পাষাণ ও লোষ্ট্র নিক্ষেপণার্থে উদ্যত হইতেছে, এমত সময়ে রাজচক্রবর্ত্তী সৈন্যাধ্যক্ষ রাজা আগেমেম্‌নন্‌ উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, হে যোধদল! এক্ষণে তোমরা ক্ষান্ত হও। তোমরা কি দেখিতে পাইতেছ না, যে ভাস্বর-কিরীটী হেক্‌টর কোন বিশেষ প্রস্তাব করণাভিপ্রায়ে এ স্থলে উপস্থিত হইয়াছেন। রাজার এই কথা শুনিবা মাত্র যোধদল অতিমাত্র ব্যস্ত হইয়া নিরস্ত হইল। হেক্‌টর উচ্চভাষে কহিলেন, হে বীরবৃন্দ, আমার সহোদর দেবাকৃতি সুন্দর বীর স্কন্দর, যিনি এই সাংগ্রামিককুলের নির্ম্মূলকারী এ সংগ্রামের মূলকারণ, আমাদিগকে এই যুদ্ধকার্য্য হইতে বিরত করিবার জন্য এই প্রস্তাব করিতেছেন, যে স্কন্দপ্রিয় বীরেন্দ্র মানিল্যুস্‌ একাকী তাহার সহিত যুদ্ধ করুন, আর আমরা সকলে নিরস্ত্র হইয়া এই আহবকৌতূহল সন্দর্শন করি। এ দ্বন্দ্বযুদ্ধে যিনি জয়ী হইবেন, সেই ভাগ্যধর পুরুষ হেলেনী ললনাকে পুরস্কাররূপে পাইবেন।

 ভাস্বর-কিরীটী শূরেন্দ্র হেক্‌টরের এইরূপ কথা শুনিয়া স্কন্দপ্রিয় বীরেন্দ্র মানিল্যুস্‌ কহিলেন, হে বীরবৃন্দ! এ বীরবরের এ বীরপ্রস্তাব অপেক্ষা আর কি শান্তি ও সন্তোষ-জনক প্রস্তাব হইতে পারে? আমার কোন মতেই এমত ইচ্ছা নয়, যে আমার হিতের জন্য প্রাণী সমূহ অকালে শমন-ভবনে গমন করে; কিন্তু তোমরা, হে শূরবর্গ! দেবী বসুমতীর বলির নিমিত্ত একটী শুভ্র মেষশাবক, সূর্য্যদেবের নিমিত্ত একটী কৃষ্ণবর্ণ মেষশাবক, এবং দেবকুলপতির নিমিত্ত আর একটী মেষশাবক, এই তিনটী মেষশাবক আহরণ করিতে চেষ্টা পাও। আর বৃদ্ধ-রাজ প্রিয়ামের আহ্বানার্থে দূত প্রেরণ কর; কেননা, তাহার পুত্রেরা অতি অহঙ্কারী, ও অবিশ্বাসী, এবং বিজ্ঞ জনেরাও বলিয়া থাকেন, যে যৌবনকালে যৌবনমদে যুবজনের মনস্থিরতা অতীব দুর্ল্লভ। কিন্তু প্রাচীন ব্যক্তিসমুহ ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, এই তিনকাল বিলক্ষণ বিবেচনা না করিয়া কোন কর্ম্মেই হস্তার্পণ করেন না।

 বীরবরের এইরূপ কথা শ্রবণে উভয় দল আনন্দার্ণবে মগ্ন হইল; রথী রথাসন, সাদী অশ্বাসন পরিত্যাগ করতঃ ভূতলে নামিয়া বসিল। এবং অস্ত্র শস্ত্র সকল রাশীকৃত করিয়া একত্রে রণক্ষেত্রোপরি রাখিল।

 বীরবর হেক্‌টর দুইজন দ্রুতগামী সুচতুর কর্ম্মদক্ষ দূতকে দুইটা মেষশাবক আনিতে ও মহারাজের আহ্বানার্থে নগরাভিমুখে প্রেরণ করিলেন। রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌নন্‌ স্বদলস্থ একজন দূতকে তৃতীয় মেষশাবক আনিবার জন্য স্বশিবিরে পাঠাইলেন।

 দেবকুলালয় হইতে দেবকুলদূতী ঈরীষা সৌদামিনীগতিতে ট্রয়নগরে আবির্ভূতা হইলেন, এবং রাজা প্রিয়ামের দুহিতৃ-কুলোত্তমা লব্ধিকার রূপ ধারণ করিয়া দেবী হেলেনী সুন্দরীর সুন্দর মন্দিরে প্রবেশিয়া দেখিলেন, যে রূপসী সখীদলের মধ্যে শিল্প-কর্ম্মে নিযুক্ত আছেন। ছদ্মবেশিনী পদ্মলোচনাকে ললিত বচনে কহিলেন, সখি হেলেনি! চল, আমরা দুজনে নগর-তোরণ-চূড়ায় আরোহণ করিয়া রণক্ষেত্রের অদ্ভুত ঘটনা অবলোকন করি। এক্ষণে উভয় দল রণক্ষেত্রে রণতরঙ্গ বহাইতে ক্ষান্ত পাইয়াছে; রণনিনাদ শান্ত হইয়াছে; কেবল স্কন্দপ্রিয় মানিল্যুস এবং দেবাকৃতি সুন্দরবীর স্কন্দর, এই দুই বীর পরস্পর দুরন্ত কুণ্ড যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে। তুমি, সখি, বিজয়ী পুরুষের পুরস্কার।

 দেবীর এইরূপ কথা শুনিয়া কৃশোদরী হেলেনীর পূর্ব্ব কথা স্মৃতিপথে আরূঢ় হইল। এবং তিনি পরিত্যক্ত পতি, পরিত্যক্ত দেশ, এবং পরিত্যক্ত জনক জননীকে স্মরণ করিয়া অশ্রুজলে অন্ধপ্রায় হইয়া উঠিলেন। কিঞ্চিৎ পরে শোক সম্বরণ পূর্ব্বক এক শুভ্র ও সুক্ষ্ম অবগুণ্ঠিকা দ্বারা শিরোদেশ আচ্ছাদন করিয়া ননদিনী লব্ধিকার অনুগামিনী হইলেন। সুনেত্রা অত্রী ও বরাননা ক্লিমেনী এই দুইজন পরিচারিকামাত্র পশ্চাতে পশ্চাতে চলিল। উভয়ে স্কিয়ান নামক নগর-তোরণ-চূডায় চড়িলেন! সে স্থলে বৃদ্ধ-রাজ প্রিয়াম্‌ বয়সের আধিক্যে প্রযুক্ত রণকার্য্যাক্ষম বৃদ্ধ মন্ত্রীদলের সহিত আসীন ছিলেন।

 শচীববৃন্দ দূর হইতে হেলেনী সুন্দরীকে নিরীক্ষণ করিয়া পরস্পর কহিতে লাগিলেন; এতাদৃশী রূপসী রমণীর জন্য যে বীর পুরুষেরা ভীষণ রণে উন্মত্ত হইবে, এবং শোণিত-স্রোতে দেবী বসুমতীকে প্লাবিত করিবে, এ বড় বিচিত্র নহে। আহা! নরকুলে এরূপ বিশ্ববিমোহনরূপ, বোধ হয়, আর কুত্রাপি দৃষ্টিগোচর হইতে পারে না। তথাপি পরমপিতা পরমেশ্বরের নিকট আমাদের এই প্রার্থনা যে, এ বিশ্বরমা বামা যেন এ নগর হইতে অতি ত্বরায় অন্যত্র চলিয়া যায়। মন্ত্রীদল অতি মৃদুস্বরে বারম্বার এই কথা কহিতে লাগিলেন।

 রাজা প্রিয়াম্‌ হেলেনী সুন্দরীকে সম্বোধিয়া সস্নেহ বচনে এই কথা কহিলেন, বৎসে! তুমি আমার নিকটে আইস। আর এই যে রণস্বরূপ বিপজ্জালে এ রাজবংশ পরিবেষ্টিত হইয়াছে, তুমি আপনাকে ইহার মূলকারণ বলিয়া ভাবিও না। এ দুর্ঘটনা আমারই ভাগ্যদোষে ঘটিয়াছে। ইহাতে তোমার অপরাধ কি? তুমি নির্ভয় চিত্তে আমার নিকটে আসিয়া গ্রীক্‌দলস্থ প্রধান প্রধান নেতৃ-দলের পরিচয় প্রদানে আমাকে পরিতুষ্ট কর।

 এতাদৃশ বাক্য শ্রবণ করিয়া রাণী হেলেনী রণক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতঃ রাজকুলপতি বৃদ্ধরাজ প্রিয়ামের নিকটবর্তিনী হইয়া তাঁহাকে বীরপুরুষদলের পরিচয় দিতেছেন, এমত সময়ে বীরবর হেক্‌টর-প্রেরিত দূতেরা তথায় উপস্থিত হইয়া কহিল, হে নরকুলপতি, হে বাহুবলেন্দ্র, আপনাকে একবার রণস্থলে শুভাগমন করিতে হইবেক। কেননা, উভয় দল এই স্থির করিয়াছে যে, তাহারা পরস্পর রণে প্রবৃত্ত হইবে না। কেবল মহেষ্বাস মানিল্যুস ও আপনার দেবাকৃতি পুত্র সুন্দর বীর স্কন্দর এই দুই জনে দ্বন্দ্ব রণ হইবে। আর এ রণীদ্বয়ের মধ্যে যে রণী বাহুবলে বিজয়ী হইবেন, সেই রণী এ হেলেনী সুন্দরীকে লাভ করিবেন। এক্ষণে তাহাদের এই বাঞ্ছা, যে আপনি এ সন্ধিজনক প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেন। আর শপথপূর্ব্বক এই বলেন, যে আপনি আপনার এ অঙ্গীকার রক্ষা করিবেন।

 বৃদ্ধরাজ প্রিয়াম্‌ প্রিয়তম পুত্র-প্রেরিত দূতের এই কথা শুনিয়া চকিত ও চমৎকৃত হইলেন, এবং রাজরথ সুসজ্জিত করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রাভিমুখে যাত্রা করতঃ অতিত্বরায় তথায় উপস্থিত হইলেন। রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌নন্‌ প্রথমে রাজা প্রিয়ামের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান ও সম্ভ্রম প্রদর্শন করিয়া পরে যথাবিধি দেবপূজার আয়োজন করিলেন। এবং হস্ত তুলিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিলেন, হৈ দেবকুলেন্দ্র! হে অসীম শক্তিশালী বিশ্বপিতঃ! হে সর্ব্বদর্শী গ্রহেন্দ্র রবি! হে নদকুল! হে মাতঃ বসুন্ধরে। হে পাতাল-কৃত-বসতি নরক-শাসক দেবদল! যাহারা পাপাত্মাদিগকে যথাযোগ্য দণ্ড দিয়া থাকেন। হে দেবকুল! তোমরা সকলে সাক্ষী হও, আর আমার এই প্রার্থনা শুন, যে এ দ্বন্দ্ব রণ সম্পর্কে যাহারা কূটাচরণ করিবে, তোমরা পরকালে তাহাদিগকে প্রতারণা-রূপ পাপের যথোচিত দণ্ড দিবে।  রাজা এই কহিয়া অসিকোষ হইতে অসি নিষ্কোষ করিয়া পূজা সমাপনান্তে মেষশাবক সকলকে যথাবিধি বলি প্রদান করিলেন। এই রূপে পূজা সমাপ্ত হইল। পরে বৃদ্ধরাজ প্রিয়াম্‌ রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌নন্‌কে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে রথীকুলশ্রেষ্ঠ! আপনি এ রণস্থলে আর বিলম্ব করিতে আমাকে অনুরোধ করিবেন না। রণরঙ্গে বৃদ্ধ ও দুর্ব্বল জনের কোনই মনোরঙ্গ জন্মে না। এই কহিয়া রাজা স্বযানে আরোহণ পূর্বক নগরাভিমুখে গমন করিলেন।

 মহাবীর ভাস্বর-কিরীটী হেক্‌টর ও সুবিজ্ঞ অদিস্যুস্‌ এই দুইজন উভয় জনের রণ করণার্থে রঙ্গভূমিস্বরূপ এক স্থান নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন। মহাবাহু সুন্দর বীর স্কন্দর এ কালাহবের নিমিত্ত সুসজ্জ হইলেন। তিনি প্রথমতঃ সুচারু উরুত্রাণ রজত কুড়ুপে বন্ধন করিলেন, উরোদেশে দুর্ভেদ্য উরস্ত্রাণ ধরিলেন, কক্ষদেশে ভীষণ রজতময়-মুষ্টি অসি ঝুলিল। পৃষ্ঠদেশে প্রকাণ্ড ও প্রচণ্ড ফলক শোভা পাইল। মস্তক প্রদেশে সুগঠিত কিরীটোপরি অশ্বকেশনির্মিত চুড়া ভয়ঙ্কররূপে লড়িতে লাগিল। দক্ষিণ হস্তে নিশিত কুন্ত ধৃত হইল। রণপ্রিয় বীর-প্রবীর মানিল্যুসও ঐ রূপে সুসজ্জ হইলেন। কে যে প্রথমে কুন্ত নিক্ষেপ করিবে, এই বিষয়ে গুটিকাপাতে প্রথম গুটিকা সুন্দর বীর স্কন্দরের নামে উঠিল। পরে বীরসিংহদ্বয় পূর্ব্ব নির্দিষ্ট স্থানে উপনীত হইলেন। ভাবী ফল প্রত্যাশায় উভয় দলের রসনাসমূহ নিরুদ্ধ হইল বটে; কিন্তু তত্রাচ নয়ন সকল উন্মীলিত হইয়া রহিল।

 দেবাকৃতি সুন্দরবীর স্কন্দর রিপুদেহ লক্ষ্য করিয়া হুহুঙ্কার শব্দে কুন্তনিক্ষেপ করিলেন। অস্ত্র উল্কাগতিতে চতুর্দ্দিক আলোকময় করিয়া বায়ুপথে চলিল; কিন্তু মানিল্যুসের ফলকপ্রতিঘাতে ব্যর্থ হইয়া ভূতলে পড়িল। ফলকের দৃঢ়তা ও কঠিনতায় অস্ত্রের অগ্রভাগ কুণ্ঠিত হইয়া গেল। পরে স্কন্দপ্রিয় বীর কুলেন্দ্র মানিল্যুস স্বকুন্ত দৃঢ়রূপে ধারণ করতঃ মনে মনে এই ভাবিয়া দেবকুলপতির সন্নিধানে প্রার্থনা করিলেন যে, হে বিশ্বপতি! আপনি আমাকে এই প্রসাদ দান করুন যে, আমি যেন এই অধর্মাচারী রিপুকে রণস্থলে সংহার করিতে পারি; তাহা হইলে, হে ধর্ম্মমূল, ভবিষ্যতে আর কখন কোন অধর্ম্মাচারী অতিথি কোন ধর্ম্মপ্রিয় আতিথেয় জনের অনুপকার করিতে সাহস করিবে না। এইরূপ প্রার্থনা করিয়া বীরকেশরী দীর্ঘচ্ছায় স্বকুন্ত নিক্ষেপ করিলেন। অস্ত্র মহাবেগে প্রিয়াম্‌পুত্রের দীপ্তিশালী ফলকোপরি পড়িয়া স্ববলে সে ফলক ও তৎপরে বীরবরের উরস্ত্রাণ ভেদ করিলে তিনি আত্মরক্ষার্থে সহসা এক পার্শ্বে অপসৃত হইয়া দাঁড়াইলেন। পরে মহেষ্বাস মানিল্যুস সরোষে রিপুশিরে প্রচণ্ড খণ্ডাঘাত করিলেন। সুন্দরবীর স্কন্দর ভীমপ্রহারে ভূমিতলে পতিত হইলেন। কিন্তু রণমুকুটের কঠিনতায় খণ্ডা শত খণ্ড হইয়া ভগ্ন হইয়া গেল। বীরশ্রেষ্ঠ পতিত রিপুর কিরীটচূড়া ধরিয়া মহাবলে এমত আকর্ষণ করিলেন, যে চিবুক নিম্নে সুনির্ম্মিত কিরীটবন্ধন চর্ম্ম গলদেশ নিষ্পীড়ন করিতে লাগিল।

 এই রূপে জিষ্ণু মানিল্যুস ভূপতিত রিপুকে আকর্ষণ করিতেছেন, ইহা দেখিয়া দেবী অপ্রোদীতী স্বগৌরব বর্দ্ধক জনের কাতরতায় অতীব কাতরা হইয়া সেই বন্ধন মোচন করিলেন। সুতরাং মানিল্যুসের হস্তে কেবল শিরস্ত্রাণ মাত্র অবশিষ্ট রহিল। বীরবর অতি ক্রোধভরে কিরীটটী দূরে নিক্ষেপ করিয়া কুন্তাঘাতে রিপুকে যমালয়ে প্রেরণার্থে ধাবমান হইলেন। দেবী অপ্রোদীতী প্রিয়পাত্রের এ বিষম বিপদ উপস্থিত দেখিবামাত্র তাহাকে এক ঘন মায়াঘনে পরিবেষ্টিত করতঃ বাহুদ্বয়ে ধারণ পূর্ব্বক শূন্যমার্গে উঠিয়া সৌদামিনীগতিতে নগর মধ্যে সুবর্ণ-নির্ম্মিত হর্ম্ম্যে কুসুম-পরিমল-পূর্ণ শয়নাগারে শয্যোপরি প্রিয় বীরকে শয়ন করাইলেন।

 এ দিকে ভুবনমোহিনী রাণী হেলেনী তোরণ-চূড়ায় দাঁড়াইয়া রণক্ষেত্রের দিকে নিরীক্ষণ করিয়া রহিয়াছেন, এমত সময়ে দেবী অপ্রোদীতী সুনেত্রার ধাত্রীর রূপ ধারণ করতঃ আপন হস্ত দ্বারা তাঁহার হস্ত স্পর্শিয়া কহিলেন, বৎসে! তোমরা মনোমোহন সুন্দর বীর স্কন্দর তোমার বিরহে অধীর হইয়া তোমার কুসুমময় বাসর ঘরে বরবেশে তোমার অপেক্ষা করিতেছেন। তাঁহাকে দেখিলে, তোমার এরূপ বোধ হইবেনা, যে তিনি রণস্থল হইতে প্রত্যাবৃত্ত। বরঞ্চ তুমি ভাবিবে, যে তিনি যেন বিলাসীবেশে নৃত্যশালায় গমননোন্মুখ হইয়া রহিয়াছেন।

 হেলেনী সুন্দরী দেবীর এই কথা শুনিয়া চকিতভাবে কথিকার দিকে দৃষ্টি ক্ষেপণ করিয়া তাহার অলৌকিক রূপ লাবণ্যের বৈলক্ষণ্যে বুঝিতে পারিলেন, যে তিনি কে। পরে সসম্ভ্রমে কহিলেন, দেবি, আপনি কি পুনরায় এ হতভাগিনীকে মায়ায় মুগ্ধ করিয়া নব যন্ত্রণা দিতে মন্ত্রণা করিয়াছেন। আনন্দময়ী অপ্রোদীতী ইন্দীবরাক্ষীর এইরূপ বাক্যে অদৃশ্যভাবে তাহাকে স্কন্দরের সুন্দর মন্দিরে উপনীত করিলেন! বীরবর কুসুমময় কোমল শয্যায় বিশ্রাম লাভ করিতেছেন, এমত সময়ে রাজ্ঞী হেলেনী তৎসন্নিধানে দেবদত্ত আসনে আসীন হইয়া মুখ ফিরাইয়া এই বলিয়া তিরস্কার করিতে লাগিলেন, হে বীর কুলকলঙ্ক! তুমি কেন যুদ্ধস্থল হইতে ফিরিয়া আসিয়াছ? আমার রণপ্রিয় পূর্ব্বপতি মহেষ্বাস মানিল্যুসের হস্তে তোমার মৃত্যু হইলে ভাল হইত। যখন প্রথমে আমাদের এই কুলক্ষণা প্রীতির সঞ্চার হয়, তখন তুমি যে সব আত্মশ্লাঘা করিতে, এখন তোমার সে সব আত্মশ্লাঘা কোথায় গেল? এখন তুমি কি সে সব অহঙ্কারগর্ভ অঙ্গীকার এই রূপে সুসঙ্গত করিতেছ? মহেষ্বাস মানিল্যুসের সহিত তোমার উপমা উপমেয় ভাব কখনই সম্ভব হইতে পারে না।

 সুন্দর বীর স্কন্দর প্রাণপ্রিয়াকে এইরূপ রোষপরবশ দেখিয়া সুমধুর ও প্রবোধ-বচনে কহিলেন, বিনোদিনি! তোমার সুধাকর স্বরূপ বদন হইতে কি এ রূপ বিষরূপ গ্লানির উৎপত্তি হওয়া উচিত? দুষ্ট মানিল্যুস এ যাত্রায় বাঁচিল বটে; কিন্তু যাত্রান্তরে কোন না কোন কালে আমার হস্তে যে তাহার মৃত্যু হইবে, তাহার আর কোনই সন্দেহ নাই। এই কহিয়া, বীরবর সোহগে ও সাদরে কৃশোদরীর কোমল করকমল নিজ করকমল দ্বারা গ্রহণ করিলেন।

 সমরান্তে দুরন্ত মানিল্যুস বিনষ্টাশন ক্ষুৎক্ষামকণ্ঠ বন পশুর ন্যায় রণস্থলে ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করতঃ সকলকেই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, হে বীরব্রজ! তোমরা কি জান, যে দুষ্টমতি কাপুরুষ স্কন্দর কোন্‌ স্থানে লুক্কায়িত আছে? কিন্তু কেহই সেই রণস্থল পরিত্যাগীর কোন বার্ত্তাই দিতে পারিল না। পরে রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌নন্‌ অগ্রসর হইয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, হে বীরদল! তোমরা ত সকলেই স্বচক্ষে দেখিতেছ, যে স্কন্দপ্রিয় মানিল্যুস সমরবিজয়ী হইয়াছেন। অতএব এখন শপথানুসারে মৃগাক্ষী হেলেনী সুন্দরীকে ফিরিয়া দেওয়া বিপক্ষ পক্ষের সর্ব্বতোভাবে কর্তব্য কি না? সৈন্যাধ্যক্ষের এই কথা শ্রবণ মাত্র গ্রীক্‌যোধদল অতিমাত্র উল্লাসে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। মর্ত্ত্যে এই রূপ হইতে লাগিল।

 অমরাবতীতে দেব-দেবী-দল দেবেন্দ্রের সুবর্ণ অট্টালিকায় রত্নমণ্ডিত সভায় স্বর্ণাসনে বসিলেন। অনন্তযৌবনা দেবী হীরী স্বর্ণপাত্রে করিয়া সকলকেই সুপেয় অমৃত যোগাইতে লাগিলেন। আনন্দময়ী সুধা পান করতঃ সকলেই ট্রয়নগরের দিকে একদৃষ্টে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছেন, এমত সময়ে দেবকুলেন্দ্রাণী বিশালাক্ষী হীরীকে বিরক্ত করিবার মানসে দেবকুলেন্দ্র এই গ্লানিজনক উক্তি করিলেন, কি আশ্চর্য! এই অমরাবতী-নিবাসিনী দুই জন দেবী যে বীরবর মানিল্যুসের সহকারিতা করিতেছেন, ইহা সর্ব্বত্র বিদিত। কিন্তু আমি দেখিতেছি, যে দূর হইতে রণকৌতূহল দর্শন ভিন্ন তাহারা আর অন্য কিছুই করিতেছেন না। কিন্তু দেখ, সুন্দর বীর স্কন্দরের হিতৈষিণী পরিহাসপ্রিয়া দেবী অপ্রোদীতী আপনার আশ্রিত জনের হিতার্থে কি না করিতেছেন। হে দেব-দেবীবৃন্দ! তোমরা কি দেখিলে না যে, দেবী বহু ক্লেশ স্বীকার করিয়া তাহাকে রণক্ষেত্রে আসন্ন মৃত্যু হইতে রক্ষা করিলেন।

 স্কন্দপ্রিয় রথীশ্বর মানিল্যুস যে রণে জয়লাভ করিয়াছেন, তাহার আর অণুমাত্রও সংশয় নাই। অতএব আইস, সম্প্রতি আমরা এই বিষয় বিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখি,যে হেলেনী সুন্দরীকে দিয়া এ রণাগ্নি নির্বাণ করা উচিত, কি এ সন্ধি ভঙ্গ করাইয়া, সে রণাগ্নি যাহাতে দ্বিগুণ প্রজ্বলিত হইয়া ট্রয়নগর অকস্মাৎ ভস্মসাৎ করে তাহাই করা কর্তব্য।

 উগ্রচণ্ডা দেবকুলেন্দ্রাণী হীরী এই রূপ প্রস্তাবে রোষদগ্ধ প্রায় হইয়া কহিলেন, হে দেবেন্দ্র! তুমি এ কি কহিতেছ? যে জঘন্য নগর বিনষ্ট করিতে আমি এত পরিশ্রম স্বীকার করিয়াছি, তুমি কি তাহা রক্ষা করিতে চাহ? মেঘশাস্তা দেবেন্দ্রও দেবেন্দ্রাণীর বাক্যে ক্রোধান্বিত হইয়া উত্তর করিলেন, রে জিঘাংসাপ্রিয়ে, রাজা প্রিয়াম্‌ ও তাহার পুত্রগণ তোর নিকটে এত কি অপরাধ করিয়াছে, যে তুই তাহাদের নিধনসাধনে এত ব্যগ্র হইয়াছিস? রে দুষ্টে, বোধ করি, রাজা প্রিয়াম্‌ ও তাহার সন্তান সন্ততির রক্ত মাংস পাইলে তুই পরম পরিতুষ্টা হস্! তুই কি জানিস্ না, যে ঐ ট্রয়নগর আমার রক্ষিত? সে যাহা হউক, এ ক্ষুদ্র বিষয় লইয়া তোর সহিত আমার আর বিবাদ বিসম্বাদে প্রয়োজন নাই। তোর যাহা ইচ্ছা, তাহাই কর্‌। কিন্তু যেন এই কথাটা তোর মনে থাকে যে, যদি তোর রক্ষিত কোন নগর আমি কোন না কোন কালে বিনষ্ট করিতে চাই, তখন তোর তৎসম্পর্কীয় কোন আপত্তিই কখন ফলবতী হইবে না। গৌরাঙ্গী দেবমহিষী দেবেন্দ্রের এইরূপ বাক্য শুনিয়া অতি সুমধুর স্বরে কহিলেন, দেবরাজ! আমার অধীনস্থ যে কোন নগর যখন তুমি নষ্ট করিতে ইচ্ছা কর, করিও, আমি তদ্বিষয়ে কোন বাধা দিব না। কিন্তু তুমি এখন এইটী কর, যে যেন ট্রয়নগরের লোকেরা এই সন্ধি ভঙ্গ বিষয়ে প্রথমে হস্ত নিক্ষেপ করে।

 দেবপতি দেবকুলেশ্বরীর অনুরোধে সুশীলকমলাক্ষী আথেনীকে হাস্যবদনে কহিলেন, বৎসে! তুমি রণস্থলে গিয়া দেবেদ্রাণীর মনস্কামনা সুসিদ্ধ কর। যেমন অগ্নিময়ী উল্কা বিস্ফুলিঙ্গ উদ্গীরণ করতঃ পবনপথ হইতে অধোমুখে গমন করে, এবং সাগরগামী জনগণ ও রণোন্মত্ত সৈন্যসমূহকে অমঙ্গল ঘটনারূপ বিভীষিকা প্রদর্শনপূর্বক ভূতলে পতিত হয়, দেবী সেইরূপ অতিবেগে ও ভয়জনক আগ্নেয় তেজে রণস্থলে সহসা অবতীর্ণ হইলেন। উভয়দল সভয়ে কাঁপিয়া উঠিল। কোলাহলপূর্ণ স্থলে সহসা যেন শান্তিদেবীর আবির্ভাব হইল। রণরসনা সহসা স্বধর্ম্ম ভুলিয়া গেল। দেবী রাজা প্রিয়ামের পরম রূপবান্ পুত্র লদ্ধকুশের রূপ ধারণ করিয়া ট্রয়দলের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। এবং পণ্ডর্শ নামক একজন বীরবরের অন্বেষণে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিয়া দেখিলেন, যে বীরেশ্বর ফলকশালী কুন্তহস্ত যোধদলে পরিবেষ্টিত হইয়া এক প্রান্তভাগে দাঁড়াইয়া আছেন। ছদ্মবেশিনী দেবী কহিলেন, হে বীরর্ষভ পণ্ডর্শ! তোমার যদি অক্ষয় যশোলাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে তুমি স্বতূণ হইতে তীক্ষ্ণতম শর বাছিয়া লইয়া স্কন্দপ্রিয় মানিল্যুসকে বিদ্ধ কর।

 ছদ্মবেশিনী এই কথা কহিয়া মায়াবলে পণ্ডর্শ বীরর্ষভের মনে এইরূপ ইচ্ছাবীজও রোপিত করিয়া দিলেন। পণ্ডর্শ প্রচণ্ড শরাসনে গুণযোজনা পূর্ব্বক মানিল্যুসকে লক্ষ্য করিয়া এক মহা তেজস্কর শর পরিত্যাগ করিলেন; কিন্তু ছদ্মবেশিনী অদৃশ্যভাবে মানিল্যুসের নিকটবর্তিনী হইয়া, যেমন জননী করপদ্ম সঞ্চালন দ্বারা সুপ্ত সুত হইতে মশক, কিম্বা অন্য কোন বিরক্তিজনক মক্ষিকা নিবারণ করেন, সেইরূপ সেই গরুত্মান্ বাণ দূরীকৃত করিলেন বটে; কিন্তু শরীরের নিম্নভাগে, কিঞ্চিন্মাত্র আঘাত করিতে দিলেন। শোণিত-স্রোতঃ বহিল। রুধির ধারা বীরবরের শুভ্রকায়ে সিন্দুর-মার্জ্জিত দ্বিরদরদের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। এ অধর্ম্ম কর্ম্মে রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌ননের রোষাগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি ক্ষত বিক্ষত ভ্রাতাকে সুশিক্ষিত ও সুবিচক্ষণ রাজবৈদ্যের হস্তে ন্যস্ত করিয়া পরে বীরদলকে মহাহবে প্রবৃত্ত হইতে আজ্ঞা দিলেন। রাজযোধদল আস্তে ব্যন্তে বিবিধ অস্ত্র শস্ত্র গ্রহণ করিলেন। পুরোভাগে অশ্ব ও রথারোহী জনসমূহ, পশ্চাতে পদাতিকবৃন্দ এই ত্রি-অঙ্গ সৈন্যদল সমভিব্যাহারে রাজসৈন্যাধ্যক্ষ মহোদয় রণব্রতে ব্রতী হইলেন।

 যেমন সাগরমুখে প্রবল বাত্যা বহিতে আরম্ভ করিলে ফেনচূড় তরঙ্গনিকর পর্য্যায়ক্রমে গভীর নিনাদে সাগরতীর আক্রমণ করে, সেইরূপ গ্রীক্‌যোধদল হুহুঙ্কার শব্দ করিয়া রণক্ষেত্রে রিপুদলকে আক্রমণ করিল। তুমুল রণ আরম্ভ হইল। ত্রাস, পলায়ন, কলহ, বধিরকর নিনাদ, দৃষ্টিরোধক ধূলারাশি, এই সকল একত্রীভূত হইয়া ভয়ানক হইয়া উঠিল। এক দিকে দেবকুলসেনানী স্কন্দ, অপর দিকে সুনীলকমলাক্ষী দেবী আথেনী বীর্য্যশালী বীরদলের সাহায্য করিতে লাগিলেন।

 বরিদেব নগরের উচ্চতম গৃহচূড়ায় দাঁড়াইয়া উৎসাহ প্রদানহেতু উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিলেন, হে অশ্বদমী ট্রয়নগরস্থ বীরগ্রাম! তোমরা স্বসাহসে নির্ভর করিয়া যুদ্ধ কর। গ্রীক্‌যোধগণের দেহ কিছু পাষাণনির্ম্মিত নহে। আর ও দলের চূড়ামণি বীরকুলেন্দ্র আকেলিসও এ রণস্থলে উপস্থিত নাই। সে সিন্ধুতীরে শিবির মধ্যে অভিমানে স্থিরভাবে আছে। তোমরা নিঃশঙ্ক চিত্তে রণক্রিয়া সমাধা কর।

 ট্রয়নগরস্থ বীরদল এইরূপে দেবোৎসাহে উৎসাহান্বিত হইয়া বৈরীবর্গের সম্মুখীন হইলে ভীষণ রণ বাজিয়া উঠিল। ফলকে ফলকাঘাত, করবালে করবালাঘাত, হন্তা ও মুমূর্ষু জনের হুহুঙ্কার ও আর্ত্তনাদ, এই প্রকার ও অন্যান্য প্রকার নিনাদে রণভূমি পরিপূরিত হইয়া উঠিল। যেমন বর্ষাকালে বহু উৎসগর্ভ হইতে বহু জলপ্রবাহ একত্রে মিলিত হইয়া গভীর গিরিগহ্বরে প্রবেশ পূর্ব্বক মহারবে দেশ পরিপূরণ করে। সেইরূপ ভৈরব রবে চতুর্দ্দিক পরিপূর্ণ হইল। ভগবতী বসুমতী রক্তে প্লাবিত হইয়া উঠিলেন।


―――