হেক্টর বধ (১৮৭১)/প্রথম পরিচ্ছেদ
দেব পুরোহিত আপন অভীষ্ট দেবের রাজদণ্ড, মুকুট, ও স্বকন্যার মোচনোপযোগী বহুবিধ মহার্হ দ্রব্যজাত হস্তে করিয়া গ্রীক্সৈন্যের শিবির সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। এবং সৈন্যাধ্যক্ষ রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্নন ও তাঁহার ভ্রাতা এবং অন্যান্য নেতৃগণকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন; হে বীরপুরুষগণ! ত্রিদিবনিবাসী অমরকুল তোমাদিগকে এই আশীর্ব্বাদ করুন, যে তোমরা অতিত্বরায় রাজা প্রিয়ামের নগর পরাভূত করিয়া নির্ব্বিঘ্নে স্বরাজ্যে পুনরাগমন কর। এই দেখ, আমি আপন দুহিতার মোচনার্থে বহুমূল্য দ্রব্যজাত সঙ্গে আনিয়াছি, অতএব এতদ্দ্বারা তাহাকে মুক্ত করিয়া, যে ভাস্বর দেবের সেবায় আমি নিয়ত নিরত আছি, তাহার মান ও গৌরব রক্ষা কর।
গ্রীক্সৈন্যেরা পুরোহিতের এবম্বিধ বচনাবলী আকর্ণন পূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে একবাক্যে কহিয়া উঠিল, যে এ অবশ্যকর্ত্তব্য কর্ম্মে আমরা কখনই পরাঙ্মুখ হইব না, বরং এই সকল পরিত্রাণ সামগ্রী গ্রহণ পূর্ব্বক এই মুহূর্ত্তেই কন্যাটীর নিষ্কৃতি সাধন করিব। কিন্তু তাহাদের এতাদৃশ বাক্য রাজা আগেমেম্ননের মনোনীত হইল না। তিনি মহাক্রোধভরে ও পরুষ বচনে পুরোহিতকে কহিলেন, হে বৃদ্ধ! দেখিও যেন আমি এ শিবিরসন্নিধানে তোমাকে আর কখন দেখিতে না পাই। তাহা হইলে তোমার অভীষ্ট দেবও আমার রোষানল হইতে তোমাকে রক্ষা করিতে সক্ষম হইবেন না! আমি তোমার কন্যাকে কোনক্রমেই ত্যাগ করিব না। সে আমার রাজধানী আর্গস্ নগরে আপন জন্মভূমি হইতে দূরে যাবজ্জীবন আমার সেবা করিবে। অতএব যদি তুমি আপন মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা কর, তবে অতিত্বরায় এস্থান হইতে প্রস্থান কর।
বৃদ্ধ পুরোহিত রাজার এইরূপ বাক্য শুনিয়া সশঙ্কচিত্তে তদ্দণ্ডে তাহার আদেশ প্রতিপালন করিলেন, এবং মৌনভাবে ও ম্লানবদনে চিরকোলাহলময় সাগরতীর দিয়া স্বধামে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। অশ্রুবারিধারায় আর্দ্রবসন হইয়া স্বীয় অভীষ্টদেবকে সম্বোধিয়া কহিলেন, হে রজতধনুর্দ্ধর! যদি তুমি আমার নিত্য নৈমিত্তিক সেবায় প্রসন্ন হইয়া থাক, তবে শরজাল বর্ষণে দুষ্ট গ্রীক্দলকে দলিত করিয়া, তাহারা আমার প্রতি যে দৌরাত্ম্য করিয়াছে, তাহার যথাবিধি প্রতিবিধান কর। পুরোহিতের এই স্তুতিবাক্য দেবকর্ণগোচর হইলে মরীচিমালী রবিদেব মহাক্রুদ্ধ হইয়া স্বর্গ হইতে ভূতলে অবতীর্ণ হইলেন। দেবপৃষ্ঠদেশে লম্বমান তূণীরে শরজাল ভয়ানক শব্দে বাজিতে লাগিল; এবং রোষভরে দেববদন যেন তমোময় হইয়া উঠিল। গ্রীক্ শিবিরের অনতিদূর হইতে দিননাথ প্রথমে এক ভীষণ শর নিক্ষেপ করিলেন, এবং ধনুষ্টঙ্কারের ভয়াবহ স্বনে শিবিরস্থ লোক সকলের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। প্রথম শরে অশ্বতর ও ক্ষিপ্রগামী গ্রামসিংহ সকল বিনষ্ট হইল; দ্বিতীয়বার শর নিক্ষেপে সৈন্যদল ছিন্ন ভিন্ন ও হত আহত হওয়াতে মুহুর্মুহুঃ চারিদিকে চিতাচয়ে শবদাহাগ্নি প্রজ্বলিত হইতে লাগিল। অংশুমালীর শরমালায় গ্রীক্সৈন্যেরা নয় দিবস পর্য্যন্ত লণ্ডভণ্ড ও ক্ষত বিক্ষত হইল; দশম দিবসে মহাবীর আকিলীস্ নেতৃবর্গকে সভামণ্ডপে আহ্বান করিলেন, এবং রাজেন্দ্র আগেমেম্নন্কে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, এ রাজন্! আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় আমাদিগের উচিত, যে আমরা স্বদেশে পুনরায় ফিরিয়া যাই, কেন না, যে উদ্দেশে আমরা দুস্তর সাগর পার হইয়া আসিয়াছি, তাহা কোনক্রমেই সফল হইল না। মহামারী এবং নশ্বর সমর এই রিপুদ্বয় দ্বারাই গ্রীকেরা পরাজিত হইল। তবে যদ্যপি এস্থলে কোন দেবরহস্যজ্ঞ বিজ্ঞতম হোতা কিম্বা গণক থাকেন; তাহা হইলে তিনি আমাদিগকে বলুন, যে কি কারণে বিভাবসু আমাদের প্রতি এত প্রতিকূল ও ক্রূর হইয়াছেন, আর কি আরাধনাতেই বা দেববরের প্রতিকূলতা ও ক্রূরতা দূরীভূত হইতে পারে।
বীরবরের এই কথা শুনিয়া থেষ্টরের পুত্র মুনীশশ্রেষ্ঠ কাল্কষ্, যিনি ভুত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান,—ত্রিকালজ্ঞ ছিলেন, কহিলেন, হে আকিলীস্! হে দেবপ্রিয়রথি! তোমার কি এই ইচ্ছা, যে রবিদেব কি নিমিত্ত তোমাদের প্রতি এত দূর বাম ও বিরক্ত হইয়াছেন, তাহা আমি স্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করি? ভাল, আমি তোমার বাক্যে সম্মত হইলাম। কিন্তু তুমি অগ্রে আমার নিকট এই স্বীকার কর, যে যদ্যপি আমার কথায় রাজ-হৃদয়ে কোন বিরক্তিভাবের উদয় হয়, তবে তুমি সে রাজক্রোধ হইতে আমাকে রক্ষা করিবে।
কাল্কষের এই কথা শুনিয়া মহাবাহু আকিলীস্ উত্তরিলেন, হে কাল্কষ্! তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে মনের ভাব ব্যক্ত কর। আমি দেবেন্দ্রপ্রিয় অংশুমালী রবিদেবকে সাক্ষী করিয়া শপথ পূর্ব্বক কহিতেছি, যে এ সভায় এমন ব্যক্তিই নাই, যাহাকে আমি তোমার অবমাননা করিতে দিব। অধিক কি বলিব, সৈন্যাধ্যক্ষপদপ্রতিষ্ঠিত রাজা আগেমেম্ননেরও এতদূর সাহস হইবে না। অতএব তুমি দৈবশক্তি দ্বারা যাহা বিদিত আছ, মুক্তকণ্ঠে ও অভয়ান্তঃকরণে তাহা প্রচার কর।
এই কথায় কাল্কষ্ উত্তর দিলেন, হে বীরবর! ভাস্বর রবিদেব যে কি নিমিত্ত এ সৈন্যের প্রতি এতদূর প্রতিকূলাচরণ করিতেছেন, তাহার নিগূঢ় কারণ বলি, শ্রবণ করুন। যখন তোমরা ক্রূষা নগর লুটিয়াছিলে, তৎকালে রবিদেবের কোন এক পুরোহিতের একটী কন্যা অপহরণ করা হইয়াছিল; অপহৃত দ্রব্যজাতের বণ্টনকালে সেই কন্যাটী রাজচক্রবর্ত্তীর অংশে পড়ে। কয়েক দিবস হইল, গ্রহপতির পূজক স্বদেবের রাজদণ্ড, মুকুট, ও বহুবিধ মহার্হ বস্তুসমূহ সঙ্গে লইয়া এ শিবিরদেশে আসিয়াছিলেন, তাহার মনে এই বলবতী প্রতীতি ছিল, যে এ স্থলস্থ বীরব্যুহ বিভাবসুর রাজদণ্ড ও মুকুট দর্শন মাত্রেই তাহার সেবকের যথোচিত সম্মান করিবেন এবং তদানীত বহুবিধ মহার্হ দ্রব্যাদি গ্রহণ পূর্ব্বক দেবদাসের অবরুদ্ধা দুহিতাকে মুক্তি প্রদানিবেন। কিন্তু এই দুই আশার কোন আশাই ফলবতী হইল না। তন্নিমিত্ত তাহার অর্চ্চিত দেব তদবমাননায় রোষাবিষ্টচিত্ত হইয়া এ সৈন্য দলকে এইরূপ প্রচণ্ড দণ্ড দিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এক্ষণে দেববরকে প্রসন্ন করিবার কেবল একমাত্র উপায় আছে। সেই পরমরূপবতী যুবতীকে নানা অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করিয়া এবং দেবপূজার্থে বহুবিধ পূজোপহার ও বলি পুরোহিতের গৃহে প্রেরণ করিলে, বোধ করি, আমরা এ বিপজ্জাল হইতে অব্যাহতি পাইতে পারি, নতুবা দশ বৎসরে রিপুকুলের অস্ত্রাগ্নি যতদূর করিতে পারে নাই, অতি অল্প দিনেই দেবক্রোধে ততোধিক ঘটিয়া উঠিবে, সন্দেহ নাই। হে বীরবর! ভগবান্ অশীতরশ্মির ক্রোধে এ শিবিরাবলী অতি ত্বরায় জনশূন্য হইবে। এবং ঐ দ্রুতগামী সাগরযান সমূহও, এ সৈন্যদল যে কি কুক্ষণে স্বদেশ হইতে যাত্রা করিয়াছিল, তাহার অভিজ্ঞানরূপে এই তীরসন্নিধানে সাগরজলে বহুকাল ভাসিতে থাকিবেক।
কালকষের এবম্বিধ বচনবিন্যাস শ্রবণে রাজা অগেমেম্নন্ ক্রোধে আরক্তনয়ন হইয়া অতি কর্ক্কশ বচনে কহিলেন, রে দুষ্ট প্রতারক! তোর কুরসনা আমার হিতার্থে কখন কোন কথাই কহিতে জানে না; আমার অহিত সংবাদ তোর পক্ষে বড় প্রীতিকর। এক্ষণে যদি তোর কথা সত্য হয়, তবে আমি এ কুমারীটিকে মুক্ত করি নাই বলিয়াই রবিদেব এ সৈন্যদলকে এত কষ্টে ফেলিয়াছেন। আমি যে পুরোহিতদত্ত বহুবিধ ধন গ্রহণ করিয়া তাহার কন্যাকে মুক্ত করি নাই, সে কথা অলীক নহে। এ কুমারীটী অতি সুন্দরী, এবং আমার সহধর্ম্মিণী রাণী ক্লুতিম্নিস্তরা অপেক্ষাও আমার সমধিক নয়নানন্দিনী। এ কুমারী রূপ, গুণ, বিদ্যা, বুদ্ধি, কোন অংশেই রাণী অপেক্ষা নিকৃষ্টা নহে; তথাচ আমি ইহাকে এ সৈন্যদলের হিতার্থে পরিত্যাগ করিতে কুণ্ঠিত হইব না। কেননা, আমি লোকপাল, স্বপালিত লোকের হিতার্থে রাজার কি না করা উচিত? কিন্তু, হে বীরবৃন্দ! যদি আমাকে এ কন্যারত্নে বঞ্চিত হইতে হয়, তবে তোমরা আমাকে অপর একটা পারিতোষিক দিতে সযত্ন ও সচেষ্ট হও। কেননা, তোমাদের মধ্যে আমি যে কেবল পারিতোষিকচ্যুত হই, ইহা কোনমতেই যুক্তিযুক্ত নহে।
রাজার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া মহেষ্বাস আকিলীস্ সাতিশয় রোষাবেশে কহিলেন, হে আগেমেম্নন্! তোমা অপেক্ষা লোভী জন, বোধ হয়, এ বিশ্বে আর দ্বিতীয় নাই! এক্ষণে এ সৈন্যদল কোথা হইতে তোমাকে অন্য কোন পারিতেযিক দিবে? লুটিত দ্রব্য সকল বিভক্ত হইয়া গিয়াছে; এক্ষণে তো আর সাধারণ ধন নাই, যে তাহা হইতে তোমার এ লোভ সম্বরণ হইতে পারে। কিন্তু এক্ষণে তুমি এ কন্যাটীকে বিমুক্ত করিয়া দিলে, এই সকল নেতৃবর্গেরা ভবিষ্যতে তােমাকে এতদপেক্ষায় তিন চারি গুণ অধিক পরিতােষিক দিতে চেষ্টা পাইবে।
রাজা উত্তরিলেন, এ কি আশ্চর্য্য কথা! আমি এ নেতৃদলের অধ্যক্ষ, তুমি কি জাননা, যে এ নেতৃবৃন্দের মধ্যে যিনি যাহা পরিতােষিক রূপে প্রাপ্ত হইয়াছেন, ইচ্ছা করিলে, আমি তত্তাবৎ কাড়িয়া লইতে পারি? আকিলীস্ পুনরায় ক্রোধভরে কহিলেন, তুমি কি বিবেচনা কর, এ বীরপুরুষেরা তোমার ক্রীতদাস, যে তুমি তাহাদের সম্মুখে এরূপ আস্পর্দ্ধা করিতেছ। আমরা যে তােমার ভ্রাতার উপকারার্থেই বহু ক্লেশ সহ্য করিয়া অতি দূরদেশ হইতে আসিয়াছি, ইহা তুমি বিস্মৃত হইলে না কি? হে নির্লজ্জ পামর! হে অকৃতজ্ঞ! হে ভীরুশীল! তােমার অধীনে অস্ত্রধারণ করা কি কাপুরুষতার কর্ম! ইচ্ছা হয়, যে এ স্থলে তােমাকে একাকী পরিত্যাগ করিয়া আমরা সসৈন্যে স্বদেশে চলিয়া যাই।
এই বাক্য শ্রবণে নরপতি আগেমেম্নন্ কহিলেন, তোমার যদি এরূপ ইচ্ছা হইয়া থাকে, তবে তুমি এই মুহূর্ত্তেই এস্থান হইতে প্রস্থান কর। আমি তােমাকে ক্ষণকালের জন্যেও এস্থানে থাকিতে অনুরােধ করিতেছি না। এখানে অন্যান্য অনেকানেক বীরপুরুষ আছে, যাহারা আমার অধীনে অস্ত্র ধারণ করিতে অবমানিত বা লজ্জিত হইবেন না। তুমি আমার চক্ষের বালিস্বরূপ, তােমার অহঙ্কারের ইয়ত্তা নাই। তুমি যাও। রবিদেবের পুরােহিতের নিকট এই সুকুমারী কুমারীটিকে প্রেরণ করিবার অগ্রে তুমি যে ব্রীষীসা নাম্নী কুমারীকে পাইয়াছ, আমি তাহাকে স্ববলে গ্রহণ করিব। দেখি, তুমি আমার কি করিতে পার।
রাজার এই কর্কশ বাণী শ্রবণে মহাবীর আকিলীস্ মহাক্রোধে হতজ্ঞান হইয়া তাহার বধার্থে উরুদেশলম্বিত অসিকোষ হইতে নিশিত অসি আকর্ষণ করিতেছেন, এমত সময়ে সুরলোকে সুরকুলেন্দ্রাণী হীরী জ্ঞানদেবী আথেনীকে ব্যাকুলিতচিত্তে কহিলেন, হে সখি! ঐ দেখো, গ্রীক্সৈন্যদলের মধ্যে বিষম বিভ্রাট ঘটিয়া উঠিল! দেবযোনি আকিলীস্ রাজা আগেমেম্ননের প্রতি ক্রুদ্ধ হইয়া তাহার প্রাণদণ্ডে উদ্যত হইতেছেন। অতএব, সখি! তুমি শিবিরে অতি ত্বরায় আবির্ভূতা হইয়া এ কাল কলহাগ্নি নির্বাণ কর।
জ্ঞানদেবী আথেনী তদ্দণ্ডে সৌদামিনীগতিতে সভাতলে উপস্থিত হইয়া বীরবর আকিলীসের পশ্চাদ্ভাগে দাঁড়াইয়া তাহার পিঙ্গলবর্ণ কেশপাশ আকর্ষণ করতঃ কহিলেন, রে বর্বর! তুই এ কি করিতেছিস? এই কথা শুনিবামাত্র বীরকেশরী সচকিতে মুখ ফিরাইয়া দেবীকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, হে দেবকুলেন্দ্রদুহিতে! তুমি কি নিমিত্ত এখানে আসিয়াছ? রাজা আগেমেম্নন্ যে আমার কত দূর পর্য্যন্ত অবমাননা করিতে পারেন, এবং আমিই বা কত দূর পর্য্যন্ত তাহার প্রগল্ভতা সহ্য করিতে পারি, তুমি কি সেই কৌতুক দেখিতে আসিয়াছ?
আয়তলোচনা দেবী আথেনী উত্তর করিলেন, বৎস! তুমি এ সভাতে সৈন্যাধ্যক্ষ বীরবরকে যথোচিত লাঞ্ছনা ও তিরস্কার কর, তাহাতে আমার রোষ বা অসন্তোষ নাই। কিন্তু কোনমতেই উহার শরীরে অস্ত্রাঘাত করিও না। দেবী এই কয়েকটী কথা বীরপ্রবীর আকিলীসের কর্ণকুহরে অতি মৃদুস্বরে কহিয়া অন্তর্হিতা হইলেন। আর তাহাকে কেহই দেখিতে পাইল না।
দেবীর আদেশানুসারে বীর-কুলর্ষভ আকিলীস্, রাজ-কুলর্ষভ রাজা আগেমেম্নন্কে বহুবিধ তিরস্কার করিলে, তিনিও রাগে নিতান্ত অভিভূত হইলেন। এই বিষম বিপদ উপস্থিত দেখিয়া নেস্তর নামক একজন বৃদ্ধ জ্ঞানবান্ পুরুষ গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সভাস্থ নেতৃদিগকে সম্বোধিয়া সুমৃদুভাবে কহিতে লাগিলেন, হায়! কি আক্ষেপের বিষয়! অদ্য গ্রীক্দলের উপস্থিত বিপদে রাজা প্রিয়াম্ ও তাহার পুত্রগণের যে কতদূর আনন্দলাভ হইবে, তাহা কে বলিতে পারে? কেননা, এই গ্রীক্-দলের মধ্যে, যে দুইজন মহাপুরুষ অভিজ্ঞতা ও বাহুবলে সর্বশ্রেষ্ঠ, তাহারাই দুর্ভাগ্যক্রমে অদ্য কলহরত হইলেন। আমি সর্বাপেক্ষা বয়সে জ্যেষ্ঠ, এবং তোমাদের পূর্ব্ব দুই পুরুষের মধ্যে, যে সকল মহোদয়েরা বাহুবলে ও রণ-বিশারদতায় দেবোপম ছিলেন, তাঁহাদের সহিতও আমার সংসর্গ ছিল। তোমরা বলী বট, কিন্তু সে সকল প্রাচীন যোধদলের সহিত উপমায় তোমরা কিছুই নও। সে সকল মহাপুরুষেরাও আমার উপদেশ ও পরামর্শে কখনই অবহেলা বা অমনোযোগ করিতেন না। অতএব তোমরা আমার হিতবাক্য মনোভিনিবেশ পূর্ব্বক শ্রবণ কর। তুমি, আগেমেম্নন্, রাজকুলশ্রেষ্ঠ। এই হেতু এই সকল মহোদয়েরা তোমাকে সেনাধ্যক্ষপদে অভিষিক্ত করিয়াছেন; তোমার উচিত হয় না, যে এই বীরপুরুষদলের মধ্যে যিনি বীরপুরুষোত্তম, তাহার সহিত তুমি মনান্তর কর। তুমি, আকিলীস্, দেবযোনি ও দেবকুলপ্রিয়। বিধাতা তোমাকে বাহুবলে নরকুলতিলকরূপে সৃষ্টি করিয়াছেন। তোমারও উচিত নয়, যে তুমি এ সৈন্যাধ্যক্ষের সহিত বিবাদে প্রবৃত্ত হও। তোমাদের দুইজনের পরস্পর মনান্তর ঘটিলে এ গ্রীক্দলের যে বিষম বিপদ উপস্থিত হইবেক, তাহার কোনই সন্দেহ নাই। অতএব হে বীরপুরুষদ্বয়! তোমরা স্ব স্ব রোষানল নির্ব্বাণ করিয়া পরস্পর প্রিয় সম্ভাষণ কর।
বৃদ্ধের এবম্বিধ বচনাবলী শ্রবণ করিয়া রাজা আগেমেম্নন্ উত্তর করিলেন। হে তাত! এই দুরাত্মার অহঙ্কারে আমি নিয়তই অসন্তুষ্ট! ইহার ইচ্ছা, যে এ সকলেরি উপরি কর্ত্তৃত্ব করে। এতাদৃশী দাম্ভিকতা আমি কি প্রকারে সহ্য করিতে পারি! আকিলীস্ কহিলেন, তোমার এতাদৃশ বাক্যে পুনরায় যদ্যপি আমি তোমার অধীনে কর্ম্ম করি, তাহ হইলে আমার নিতান্ত নীচতা ও অপদার্থতা প্রকাশ হইবে। আমি এ সৈন্যদল হইতে আমার নিজ সৈন্যদলকে পৃথক্ করিয়া লইব না; কিন্তু আমি স্বয়ং এ যুদ্ধে আর লিপ্ত থাকিব না। বীরবরের এই কথান্তে সভাভঙ্গ হইল।
তদনন্তর বীরপ্রবীর আকিলীস্ স্বশিবিরে প্রস্থান করিলেন। সৈন্যাধ্যক্ষ রাজা অগেমেম্নন্ রবিদেবের পুরোহিতের সুন্দরী কন্যাটিকে নানাবিধ পূজোপহার ও বলির সহিত স্বীয় সাগরযানে আরোহণ করাইয়া এবং সুবিজ্ঞ অদিস্যুস্কে নায়কপদে অভিষিক্ত করিয়া ক্রূষানগরাভিমুখে প্রেরণ করিলেন। পরে সৈন্যসকলকে সাগররূপ মহাতীর্থে দেহ অবগাহনপূর্ব্বক পবিত্র হইতে অজ্ঞা দিলেন। অশস্য সাগরতীরে মহাসমারোহে দিবাকরের পূজা সমাধা হইল। ধূপ, দীপ, প্রভৃতি নানা সুরভিদ্রব্যের সৌরভ ধূমসহযোগে আকাশমার্গে উঠিল।
পরে রাজা দুই জন রাজদূতকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, হে দূতদ্বয়! তোমরা উভয়ে বীরবর আকিলীসের শিবিরে গিয়া ব্রীষীসা নাম্নী সুন্দরী কুমারীটিকে আনয়ন কর। যদ্যপি বীরপ্রবর আকিলীস্ সে রূপসীকে স্বেচ্ছায় ও অনায়াসে তোমাদের হস্তে সমর্পণ না করেন, তবে তোমরা তাহাকে কহিও, যে আমি স্বয়ং সসৈন্যে তাহার শিবির আক্রমণ করিয়া স্ববলে সেই কৃশোদরীকে লইব; আর তাহা হইলে সেই রাজবিদ্রোহীর নানা প্রকার অমঙ্গলও ঘটিবেক।
দূতদ্বয় রাজাজ্ঞায় একান্ত বাধিত হইয়া অনিচ্ছাক্রমে ধীরে ধীরে বন্ধ্য সিন্ধু তট দিয়া মহাবীর আকিলীসের শিবিরাভিমুখে চলিতে লাগিল। বীরবর দূতদ্বয়কে দূর হইতে নিরীক্ষণ পূর্ব্বক, তাহারা যে কি উদ্দেশে আসিতেছে, ইহা বুঝিতে পারিয়া, উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিলেন, হে দেবমানবকুলের সন্দেহবহ! তোমাদের কুশল ও স্বাগত তো? তোমরা কি নিমিত্ত এত মৌন ভাবে ও বিষণ্ণবদনে আসিতেছ? এ কিছু তোমাদের দোষ নহে, ইহাতে তোমাদের লজ্জা বা চিন্তা কি? ইহাতে আমি কখনই তোমাদের উপর কষ্ট বা অসন্তুষ্ট হইতে পারি না। তবে যাহার সহিত আমার বিবাদ, তোমরা তাহাকে কহিও, যে তিনি কালে আমার পরাক্রমের বিশেষ আবশ্যকতা বুঝিতে পারিবেন।
তদনন্তর বীরবর আপন প্রিয়বন্ধু পাত্রক্লুস্কে কহিলেন, সখে, তুমি এই দূতদ্বয়ের হস্তে সুন্দরীকে সমর্পণ কর; পাত্রক্লুস্ কন্যাটীকে দূতদ্বয়ের হস্তে সম্প্রদান করিলে, চারুশীলা স্বপ্রিয়বরের শিবির পরিত্যাগ করিতে প্রচুর অরুচি প্রকাশপূর্ব্বক বিষণ্ণবদনে মৃদুপদে তাহাদের সঙ্গে চলিলেন। এতদ্দর্শনে মহাধনুর্দ্ধর ক্রোধভরে অধীরচিত্ত হইয়া দূতদ্বয়কে পুনরাহ্বান করতঃ যেন জীমূতমন্দ্রে কহিলেন; “তোমরা, হে দূতদ্বয়! রাজা আগেমেম্নন্কে কহিও, যে আমি মরামরকুলকে সাক্ষী করিয়া এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যে আমি শত্রুদলের বিপরীতে এবং গ্রীক্সৈন্যের হিতার্থে আর কখনই অস্ত্র ধারণ করিব না। রাজচক্রবর্ত্তী রোষান্ধ হইয়া ভবিষ্যতে যে গ্রীক্দলের ভাগ্যে কি লাঞ্ছনা আছে; এখন তাহা দেখিতে পাইতেছেন না; কিন্তু কালে পাইবেন। দূতদ্বয় বরাঙ্গনাকে সঙ্গে লইয়া চলিয়া গেলে, বীরকেশরী আকিলীস্ কৃষ্ণবর্ণ অর্ণবতটে ভাবার্ণবে একান্ত মগ্ন হইয়া বসিয়া রহিলেন। এবং কিয়ৎক্ষণ পরে হস্ত প্রসারণ করতঃ জননী দেবীকে সম্বোধিয়া কহিতে লাগিলেন, হে মাতঃ, তুমি এতাদৃশী অবমাননা সহ্য করিবার, জন্যই কি এ অধীন হতভাগাকে গর্ভে ধারণ করিয়াছিলে? আমি জানি যে কুলিশ-নিক্ষেপী জ্যুস্ অমাকে অল্পায়ুঃ করিয়াছেন বটে; কিন্তু তথাচ তিনি যে সে অল্পকাল আমাকে অতি সম্মানের সহিত অতিবাহিত করিতে দিবেন, ইহাতে আমার তিলার্দ্ধমাত্রও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দেখ, এক্ষণে রাজা আগেমেম্নন্ আমার কি দুরবস্থা না করিল!
যে স্থলে সাগরজলতলে আপন পিতৃসন্নিধানে থিটীস্দেবী বসিয়াছিলেন, সে স্থলে পুত্রের এবম্বিধ বিলাপধ্বনি তাহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিলে, দেবী আস্তে ব্যস্তে কুজ্ঝটিকার ন্যায় জলতল হইতে উত্থিত হইলেন এবং বিলাপী পুত্রের গাত্র করপদ্মে স্পর্শ করিয়া জিজ্ঞাসিলেন, রে বৎস! তুই কি নিমিত্ত এত বিলাপ করিতেছিস্? তোর মনের দুঃখ ব্যক্ত করিয়া আমাকে তোর সমদুঃখিনী কর। তাহা হইলে তোর দুঃখভারের অনেক লাঘব হইবে।
বীর-চূড়ামণি আকিলীস্ জননী দেবীর এই কথা শুনিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করতঃ রাজা আগেমেম্ননের সহিত আপন বিবাদ বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত তাঁহার চরণে নিবেদন করিলেন। দেবী পুত্রবরের বাক্যাবসানে অতি ক্ষুব্ধচিত্তে উত্তরিলেন, হায় বৎস! আমি যে তোকে অতি কুলগ্নে গর্ভে ধারণ করিয়াছিলাম, তাহার আর কোনই সন্দেহ নাই। বিধাতা তোকে অল্পায়ুঃ করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার এ কি বিড়ম্বনা! তিনি যে তোকে সে অল্পকাল সুখসম্ভোগে ও সম্মানে অতিপাতিত করিতে দিবেন তাহা তো কোনমতেই বোধ হইতেছে না। বৎস! বিধাতা তোর প্রতি কি নিমিত্ত এত দারুণ! হায়! কি করি, এবিষয়ে আর কাহার প্রতি দোষারোপ করিব! এবং, কাহারই বা শরণ লইব? এক্ষণে কুলিশ-নিক্ষেপী জ্যুস্ পূজাগ্রহণার্থে দেবদলের সহিত এতোপী-দেশে দ্বাদশ দিনের নিমিত্ত প্রয়াণ করিয়াছেন। তিনি দেবনগরে প্রত্যাগমন করিলে এ সকল কথা তাঁহার চরণে নিবেদন করিব; দেখি, তিনি যদি এ বিষয়ের কোন প্রতিবিধান করেন। তুই রাজা আগেমেম্ননের সহিত কোনমতেই প্রীতি করিস্ না; বরঞ্চ হৃদয়কুণ্ডে রোষাগ্নি নিয়ত প্রজ্বলিত রাখিস্! এই কথা কহিয়া দেবী স্বস্থানে প্রস্থানার্থে জলে নিমগ্ন হইলেন।
ওদিকে সুবিজ্ঞ আদিস্যুস পুরোধা-দুহিতাকে এবং বিবিধ পূজোপযোগী উপহার দ্রব্য সঙ্গে লইয়া সাগরপথে ক্রূষানগরে উত্তীর্ণ হইলেন। এবং রবিদেবের পুরোহিতকে অভিবাদন পূর্ব্বক কহিলেন; হে গুরো! গ্রীক্সৈন্যাধ্যক্ষ মহারাজ আগেমেম্নন্ আপনার অতীব সুশীলা কুমারীকে আপনার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। এবং আপনার অর্চ্চিত দেবের অর্চ্চনার্থে বিবিধ দ্রব্যজাতও পাঠাইয়াছেন। আপনি সেই সকল দ্রব্য সামগ্রী গ্রহণ করিয়া গ্রহপতির পূজা করুন, পূজা সমাপনান্তে এই বর প্রার্থনা করিবেন, যে আলোকবর্ষী যেন গ্রীক্দলের প্রতি আর কোন বামাচরণ না করেন।
পুরোহিত এবম্বিধ বিনয়াবসানে মহাসমারোহে যথাবিধি দেবপূজা সমাধা করিলেন। এবং গ্রীক্যোধেরা দেবপ্রসাদ লাভ করতঃ মহানন্দে সুরাপানে প্রফুল্ল চিত্ত হইয়া সুমধুরস্বরে গ্রহপতি ভাস্করের স্তুতিসঙ্গীত সংকীর্ত্তন করিতে লাগিলেন। গ্রহপতি স্তুতিসঙ্গীতে প্রসন্ন হইয়া পশ্চিমাঞ্চলে চলিলেন। নিশা উপস্থিত হইল। গ্রীক্যোধেরা সাগরতীরে শয়ন করিলেন। রাত্রি প্রভাতা হইলে সকলে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক পুনরায় সাগরযানে আরোহণ করিয়া স্বশিবিরে প্রত্যাগত হইলেন। তদবধি বীরকুলর্ষভ আকিলীস্ কৃশোদরী প্রণয়িনীর বিরহানলে দগ্ধপ্রায় হইয়া এবং রাজা আগেমেম্ননের দৌরাত্ম্যে রোষপরবশ হইয়া কি রাজসভায়, কি রণক্ষেত্রে, কুত্রাপি দৃশ্যমান হইলেন না। কিন্তু গ্রীক্সৈন্যেরা মহামারীরূপ রাহুগ্রাস হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন। দ্বাদশ দিবস অতীত হইল। কুলিশাস্ত্রধারী জ্যুস্ দেবদলের সহিত অমরাবতী নগরীতে প্রত্যাগত হইলেন। জলধিযোনি বিধুবদনা দেবী থিটীস্ স্বর্গারোহণ করিয়া দেখিলেন যে, অশনিধর দেবপতি শৃঙ্গময় অলিম্পুসনামক ধরাধরের তুঙ্গসম শৃঙ্গোপরি নিভৃতে উপবিষ্ট আছেন। দেবী মহাদেবের পদতলে প্রণাম করিয়া অতি মৃদুস্বরে ও অশ্রুপূর্ণলোচনা কহিলেন; হে পিতঃ! যদ্যপি এ দাসীর প্রতি আপনার কিছুমাত্র স্নেহ থাকে, তবে আপনি এই করুন; যে জগতীতলে তাহার ভাগ্যহীন পুত্র অকিলীসের হ্রাসপ্রাপ্ত মানের পুনঃপরিপূরণে যেন তাহার বিপক্ষ গ্রীক্সৈন্যাধ্যক্ষ রাজা আগোমেম্ননের অবমাননা বিলক্ষণ সম্পাদিত হয়।
দেবীর এই যাচ্ঞা শ্রবণে দেবকুলেন্দ্র কিঞ্চিৎকাল তুষ্টীভাবে রহিলেন। দেবী দেবেন্দ্রের এবম্ভূত ভাবদর্শনে সভয়ে তাঁহার জানুদ্বয়ে হস্ত প্রদান করিয়া সকরুণে কহিলেন, হে পিতঃ! আপনিও কি আমার হতভাগা পুত্রের প্রতি বাম হইলেন! নতুবা কি নিমিত্ত আমার বাক্যের প্রত্যুত্তর দিতেছেন না? দেবনরকুলপিতা শরণাগতার এতাদৃশ বাক্য শ্রবণে উত্তর করিলেন, বৎসে! তুমি আমার উপরে এ একটা মহাভার অর্পণ করিতেছ, কেন না, তোমার আনন্দ সম্পাদন করিতে হইলে উগ্রচণ্ডা হীরীকে বিরক্ত করিতে হয়, এমনিই সে এই বলিয়া আমার প্রতি দোষারোপ করে, যে আমি কেবল সদা সর্বদা ট্রয়নগরীয় সৈন্যদলের প্রতি অনুকূলতা প্রকাশ করিয়া থাকি। সে যাহা হউক, এক্ষণে আমি বিবেচনা করিয়া দেখি, আর তুমিও এবিষয়ে সতর্ক থাকিও, যদ্যপি আমি শিরোধূনন করি, তবে নিশ্চয় জানিও, যে তোমার মনস্কামনা সুসিদ্ধ হইবে। এই বাক্যে দেবী ব্যগ্রভাবে একদৃষ্টে দেবপতির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া রহিলেন। সহসা দেবেন্দ্রের শিরঃ পরিচালিত হইল। শৃঙ্গধর অলিম্পুস্ থরথরে লড়িয়া উঠিল। দেবী বুঝিতে পারিলেন, যে এইবারে তাহার অভীষ্ট সিদ্ধি হইয়াছে, কেননা, দেবকুলপতি যে বিষয়ে শিরশ্চালনা করেন, তাহা কখনই ব্যর্থ হয় না। সাগরসম্ভূতা থেটীস্ দেবী মহা উল্লাসে জ্যোতির্ম্ময় অলিম্পুস্ হইতে গভীর সাগরে লম্ফ প্রদান করিয়া অদৃশ্যা হইলেন! কিন্তু আয়তলোচনা হীরীর দৃষ্টিরোধ হইল না, তিনি পলায়মান সাগরিকাকে স্পষ্টরূপে দেখিতে পাইলেন।
তদনন্তর দেবকুলপতি দেবসভাতে উপস্থিত হইলে, দেবদল সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দেবকুলেন্দ্র রাজসিংহাসন পরিগ্রহ করিলে দেবকুলেন্দ্রাণী বিশালাক্ষী হীরী অতি কটুভাবে কহিলেন; হে প্রতারক! কোন্ দেবীর সহিত, কোন্ বিষয় লইয়া অদ্য তুমি নিভৃতে পরামর্শ করিতেছিলে? আমি নিকটে না থাকিলে, দেখিতেছি, তুমি সর্ব্বদাই এইরূপ করিয়া থাক। তোমার মনের কথা আমার নিকট কখনই স্পষ্টরূপে ব্যক্ত কর না। এই কথায় দেবদেব মেঘবাহন ক্রুদ্ধভাবে উত্তরিলেন, আমার মনের কথা তোমাকে কি কারণে খুলিয়া বলিব? আমার রহস্যমণ্ডলে তুমি কেন প্রবেশ করিতে চাহ? শ্বেতভুজা হীরী কহিলেন, আমি জানি, সাগর-দুহিতা থেটীস্ অদ্য তোমার নিকটে আসিয়াছিল, অতএব তুমি কি তাহার অনুরোধে গ্রীক্সেনাদলকে দুঃখ দিতে মানস করিতেছ? তুমি কি রাজা আগেমেম্ননের মানের হানি করিয়া আকিলীসের সম্ভ্রম বৃদ্ধি করিতে চাহ? দেবেন্দ্রাণীর এতাদৃশ বাক্যে দেবেন্দ্রকে রোষান্বিত দেখিয়া তাহাদের বিশ্ববিখ্যাতপুত্র বিশ্বকর্ম্মা এ কলহাগ্নি নির্ব্বাণার্থে এক স্বর্ণপাত্র অমৃত পূর্ণ করিয়া আপন মাতাকে প্রদান করতঃ কহিলেন, হে মাতঃ! আপনারা দুইজনে বৃথা কলহ করিয়া কি নিমিত্ত সুখময়ী দেবপুরীর সুখসম্ভোগ ভঞ্জন করিতে চাহেন। পুত্রবরের এই বাক্যে আয়তলোচনা দেবেন্দ্রাণী নিরস্ত হইলেন। পরে দেবতারা সকলে একত্র হইয়া সমস্ত দিন দেবোপাদেয় সামগ্রী ভোজন ও অমৃত পান করিয়া কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। দেব দিনকর করে স্বর্ণ বীণা গ্রহণ পূর্ব্বক নরগায়িকা দেবীর সুমধুর ধ্বনির মাধুর্য্য বৃদ্ধি করিয়া সকলের মনোরঞ্জনে প্রবৃত্ত হইলেন। এমত সময়ে রজনীদেবীর আবির্ভাব হইল।
সুরলোকে ও নরলোকে সর্ব্বজীবকুল নিদ্রাবৃত হইল। কিন্তু নিদ্রাদেবী দেবকুলপতির নেত্রদ্বয় এক মুহূর্তের নিমিত্তও নিমীলিত করিতে পারিলেন না। কেননা, তিনি কি রূপে আকিলীগের সম্ভ্রম বৃদ্ধি, ও রাজা আগেমেম্ননের অধঃপাত সাধন করিবেন, এই ভাবনায় সমস্ত রাত্রি জাগরিত রহিলেন। অনেকক্ষণ পরে দেবরাজ কুহকিনী স্বপ্নদেবীকে আহ্বান করিয়া, কহিলেন, হে কুহকিনি! তুমি দ্রুতগতিতে রাজা আগেমেম্ননের শিবিরে যাও, এবং তথায় গিয়া রাজ-শিরোদেশে দণ্ডায়মানা হইয়া এই কহিও যে, হে আগেমেম্নন্! অলিম্পুসনিবাসী অমরকুল দেবেন্দ্রাণী হীরীর অনুরোধে তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছেন, তুমি সসৈন্যে প্রশস্তপথশালী ট্রয়নগর আক্রমণ করতঃ তাহা পরাজয় কর। দেবেন্দ্রের এই আদেশ পালনার্থে স্বপ্নদেবী অতিবেগে শিবিরপ্রদেশে আবির্ভূতা হইলেন। এবং আগেমেম্ননের শিরোদেশে দাঁড়াইয়া কহিলেন, হে বীরকুলসম্ভব রাজন্! তুমি কি নিদ্রাবৃত আছ। হে মহারাজ! যে ব্যক্তির উপর এতাদৃশ অগণ্য সৈন্যদলের হিতাহিত বিবেচনার এবং তত্তাবৎ জনগণের রক্ষার ভার সমর্পিত আছে, সে ব্যক্তির কি এরূপ নিশ্চিন্তভাবে সমস্ত রাত্রি নিদ্রায় যাপন করা উচিত? অতএব তুমি অতি ত্বরায় গাত্রোত্থান কর, এবং দেবকুলের অনুকম্পায় বিপক্ষপক্ষকে সমরশায়ী করিয়া জয়লাভ কর। স্বপ্নদেবী এই কথা কহিয়া অন্তর্হিতা হইলেন। পরে রাজা এই বৃথা আশায় মুগ্ধ হইয়া গাত্রোত্থান করতঃ অতি শীঘ্র রাজ-পরিচ্ছদ পরিধান করিলেন, এবং জ্যোতির্ম্ময় অসিমুষ্টি শারসনে বন্ধন পূর্ব্বক স্ববংশীয় অক্ষয় রাজদণ্ড হস্তে গ্রহণ করিয়া বহির্গত হইলেন।
ঊষাদেবী তুঙ্গশৃঙ্গ অলিম্পুসপর্ব্বতোপরি আরোহণ করিয়া দেবকুলপতি এবং অন্যান্য দেবকুলকে দর্শন দিলেন, বিভাবরী প্রভাতা হইল। রাজা আগেমেম্নন্ উচ্চরব বার্ত্তাবহগণকে সভামণ্ডপে নেতৃবৃন্দের আহ্বানার্থে অনুমতি দিলেন। সভা হইল। রাজা আগেমেম্নন্ সভাস্থ বীরদলকে সম্বোধন করিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, হে বীরবৃন্দ! গত সুধাময়ী নিশাকালে স্বপ্নদেবী মান্যবর নেস্তরের প্রতিমূর্ত্তি ধারণ করিয়া আমার শিরোদেশে দণ্ডায়মান হইয়া কহিলেন, “হে আগেমেম্নন্! তুমি কি নিদ্রাবৃত আছ? হে মহারাজ! যে ব্যক্তির উপর এতাদৃশ অগণ্য সৈন্যদলের হিতাহিত বিবেচনার এবং তত্তাবৎ জণগণের রক্ষার ভার সমর্পিত আছে, সে ব্যক্তির কি এরূপ নিশ্চিন্তভাবে সমস্ত রাত্রি নিদ্রায় যাপন করা উচিত? অতএব তুমি অতি ত্বরায় গাত্রোত্থান কর, এবং দেবকুলের অনুকম্পায় বিপক্ষপক্ষকে সমরশায়ী করিয়া জয়লাভ কর।” স্বপ্নদেবী এই কথা বলিয়া অন্তর্হিতা হইলেন।
তদনন্তর আমারও নিদ্রাভঙ্গ হইল। এক্ষণে আমাদের কি করা কর্ত্তব্য, তাহার মীমাংসা কর। আমার বিবেচনায়, চল, আমরা স্বদেশে ফিরিয়া যাই। এই প্রতারণাবাক্যে আমি যোধদলকে স্বদেশে ফিরিয়া যাইতে মন্ত্রণা দি, আর তোমরা কেহ কেহ, তাহা নয়, আইস, আমরা এখানে থাকিয়া যুদ্ধ করি, এই বলিয়া তাহাদিগকে এখানে রাখিতে চেষ্টা পাও, এই রূপ বিপরীত ভাবের আন্দোলনে যোধবৃন্দের মনের প্রকৃত ভাব বিলক্ষণ বুঝা যাইবেক।
রাজার এই কথা শুনিয়া প্রাচীন নেস্তর গাত্রোত্থান করিয়া কহিলেন, হে গ্রীক্দেশীয় সৈন্যদলের নেতৃবৃন্দ! যদ্যপি এরূপ কথা আমি আর কাহার মুখ হইতে শুনিতাম, তাহা হইলে ভাবিতাম, যে সে ভীরুচিত্ত জন প্রবঞ্চনা দ্বারা আমাদিগকে লজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়া এ দেশ হইতে স্বদেশে কিরিয়া যাইতে প্ররোচনা করিতেছে। কিন্তু যখন রাজা আগেমেম্নন্ স্বয়ং এ কথার উল্লেখ করিতেছেন, তখন এ আমাদের অণুমাত্রও অবিশ্বাস করা উচিত হয় না। অতএব কিরূপে আমাদের যোধদল এখানে থাকিয়া, যে উদ্দেশে আমরা অকূল দুস্তর সাগর পার হইয়া এ দেশে আসিয়াছি, তাহা সম্পন্ন করিবে, তাহার উপায় চিন্তা কর। সভা ভঙ্গ হইলে রাজদণ্ডধারী নেতা সকল স্ব স্ব শিবিরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। যেমন গিরি-গহ্বরস্থিত মধুচক্র হইতে মধুমক্ষিকাগণ অগণ্য গণনায় বহির্গত হইয়া কতকগুলি বাসন্ত কুসুমসমূহের উপর উড়িয়া বসে, আর কতক গুলি দলবদ্ধ হইয়া বায়ুপথে ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিতে থাকে, সেইরূপ গ্রীক্সৈন্যদল আপন আপন শিবির হইতে বদ্ধশ্রেণী হইয়া বাহির হইল। বহু-রসনা-শালী জনরব বহুবিধ বার্ত্তা বহু দিকে বিস্তৃত করিতে লাগিল। সৈন্যদলে মহা কোলাহল হইয়া উঠিল।
তদনন্তর রাজসন্দেশবহ ঊর্দ্ধবাহু হইয়া, তোমরা সকলে নীরব হও, তোমরা সকলে নীরব হও, এই কথা বলিবা মাত্রেই যে যেখানে ছিল, অমনি বসিয়া পড়িল। সেই মহা কোলাহল-স্থলে অকস্মাৎ যেন শান্তিদেবী পদার্পণ করিলেন। রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্নন্ দক্ষিণ হস্তে রাজদণ্ড ধারণ করতঃ উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিলেন, হে বীরবৃন্দ। দেবকুল-ইন্দ্র যে অঙ্গীকার করিয়া আমাদিগকে এ দূর দেশে আনিয়াছেন, এক্ষণে তিনি সে অঙ্গীকার রক্ষা করিতে বিমুখ। যে কুহকিনী আশার কুহক যেন কোন দৈব ঔষধ স্বরূপ আমাদিগকে এই দুরন্ত রণে ক্লান্ত হইতে দিত না, এবং আমাদের দেহ রক্তশূন্য হইলে পুনরায় তাহা রক্তপূর্ণ করিত, আমাদের বাহু বলশূন্য হইলে পুনরায় তাহা বলাধান করিত, এক্ষণে সে আশায় আমাদিগকে হতাশ হইতে হইল। এ দুর্দ্ধর্ষ রিপুদল যে আমাদের বীরবীর্য্যে ও পরাক্রমে পরাভুত হইবে, এমত আর কোনই আশা বা সম্ভাবনা নাই। এই আদেশ আমি সম্প্রতি দেবেন্দ্রের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছি। কি লজ্জার বিষয়! আমার বিবেচনায়, আমাদের এ দুঃখের কাহিনী শুনিলে, বর্ত্তমানের কথা দূরে থাকুক; বোধ হয়, ভবিষ্যতের বদনও ব্রীড়ায় অবনত ও মলিন হইবে। কি আক্ষেপের বিষয়! আমরা এমত প্রচণ্ড ও প্রকাণ্ড সৈন্য সহকারে এ ক্ষুদ্র রিপুদলকে দলিত করিতে পারিলাম না? নয় বৎসর পরিশ্রমের পর কি আমাদের এই ফললাভ হইল? দেখ, আমাদের তরীবৃন্দের ফলক সকল ক্ষত হইতেছে, রজ্জুসকল জীর্ণাবস্থা প্রাপ্ত হইতেছে, আর আমাদিগের চিরানন্দ গৃহে পতি-বিরহ-কাতরা কলত্রবৃন্দ, ও পিতৃ-বিরহকাতর শিশুসন্তান সকল আমাদিগের প্রত্যাগমন প্রতীক্ষায় পথ নিরীক্ষণ করিতেছে। এ সকল যন্ত্রণার কি এই ফল? কিন্তু কি করি, বিধাতার নির্ব্বন্ধ কে খণ্ডন করিতে পারে? এক্ষণে আমার এই পরামর্শ, যে যখন ট্রয়নগর অধিকার করা আমাদের ক্ষমতাতীত হইল, তখন চল, আমাদের এ দেশে থাকায় আর কোনই প্রয়োজন নাই।
মহাবাহু সেনানীর এতাদৃশ বাক্যাবলী শ্রবণ করিয়া, যাহারা রাজমন্ত্রণার নিগূঢ় তত্ত্ব না জানিত, তাহাদের মন, যেমন শস্যপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রবল বায়ু বহিলে, শস্যশিরঃ তদ্বহনাভিমুখে পরিণত হয়, সেইরূপ রাজপরামর্শের দিকে প্রবণ হইল। সৈন্যদল আনন্দধ্বনি করতঃ এ উহাকে আহ্বান করিয়া কহিতে লাগিল, ডিঙা সকল ডাঙা হইতে সমুদ্র জলে নামাও। চল, আমরা স্বদেশে ফিরিয়া যাই। এইরূপ কোলাহলময় ধ্বনি অমরাবতীতে প্রতিধ্বনিলে দেবকুলেন্দ্রাণী কৃশোদরী হীরী নীলকমলাক্ষী আথেনীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে সখি, গ্রীক্ সৈন্যদল কি এই সকলঙ্ক অবস্থায় স্বদেশে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইল? তাহারা কি আপনাদের পরাভবের অভিজ্ঞানরূপে হেলেনী সুন্দরীকে ট্রয়নগরে রাখিয়া চলিল? এই জন্যেই কি এত বীরবৃন্দ এ দূর রণক্ষেত্রে প্রাণ পরিত্যাগ করিল? অতএব তুমি, সখি, অতি দ্রুতগতিতে বর্ম্মধারী যোধদলের মধ্যে অবির্ভূতা হইয়া সুমধুর ও প্ররোচক বচনে তাহাদিগকে সাগরযানসমূহ সাগরমুখে ভাসাইতে নিবারণ কর।
দেবীর বচনানুসারে আথেনী অলিম্পুসনামক দেবগিরি হইতে গ্রীক্সৈন্যের শিবির মধ্যে বিদ্যুৎগতিতে আবির্ভূতা হইলেন; এবং দেখিলেন, যে সুকৌশলী অদিস্যুস্ ক্ষুণ্ণচিত্তে ও মলিনবদনে স্বপোত-সন্নিধানে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। দেবী তাহাকে স্পর্শ করিয়া কহিলেন, বৎস! ও যোধদল কি লজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়া স্বদেশে ফিরিয়া চলিল। তোমরা কি কেবল জগন্মণ্ডলে হাস্যাস্পদ হইবার নিমিত্ত এদেশে আসিয়াছিলে। সে যাহা হউক, তুমি সর্ব্বাপেক্ষা বিজ্ঞতম। অতএব তুমি অতি ত্বরায় এই স্বদেশগমনাকাঙ্ক্ষিণী অক্ষৌহিণীর মনঃস্রোতঃ পুনরায় রণসাগরাভিমুখে বহাইতে সচেষ্ট হও। অদিস্যুস্ স্বরবৈলক্ষণ্যে জানিতে পারিলেন, যে এ দেববাক্য! এবং দেবীর প্রসাদে দিব্য চক্ষুঃ লাভ করিয়া দেবমূর্ত্তি সম্মুখে উপস্থিতা দেখিলেন। তদ্দর্শনে প্রফুল্লচিত্ত হইয়া রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্ননের রাজদণ্ড রাজানুমতিরূপে চাহিয়া লইয়া অনেককে অনেকানেক প্রবোধবাক্যে শান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।
লণ্ডভণ্ড এবং কোলাহলপূর্ণ সৈন্যদলকে শান্তশীল ও শ্রবণোৎসুক দেখিয়া অদিস্যুস্ উচ্চৈঃস্বরে কহিয়া উঠিলেন, হে বীরবৃন্দ! তোমরা কি পুর্ব্বকথা সকল বিস্মৃত হইয়া কলঙ্কসাগরে নিমগ্ন হইতে ইচ্ছা করিতেছ? স্মরণ করিয়া দেখ, যখন আমরা এই ট্রয়নগরাভিমুখে যাত্রা করি, তখন দেবতারা কি ছলে, আমাদের অদৃষ্টে ভবিষ্যতে যে কি আছে, তাহা জানাইয়াছিলেন। আমরা যৎকালে যাত্রাগ্রে মহা সমারোহে দেবকুলপতির পূজা করি, তৎকালে পিঠতল হইতে সহসা এক সর্প ফণা বিস্তৃত করিয়া বহির্গত হইল। এবং অনতিদূরে একটী উচ্চ বৃক্ষের উচ্চতম শাখাস্থিত পক্ষীনীড় লক্ষ্য করিয়া তদভিমুখে উঠিতে লাগিল। সেই নীড়মধ্যে জননী পক্ষিণী আট্টী অতি শিশু শাবকের উপর পক্ষ বিস্তৃত করিয়া তাহাদিগকে রক্ষা করিতেছিল। কিন্তু সমাগত রিপুর উজ্জ্বল নয়নানলে দগ্ধপ্রায় হইয়া আত্মরক্ষার্থে পবনপথে বৃক্ষের চতুষ্পার্শে আর্ত্তনাদে উড়িতে লাগিল। অহি একে২ আট্টী শাবককেই গিলিল। জন্মদায়িনী এই হৃদয়কৃন্তনী ঘটনা সন্দর্শনে শূন্য নীড়ের নিকটবর্ত্তিনী হইয়া উচ্চতর আর্তনাদে দেশ পুরিতেছে, এমত সময়ে সর্প আচম্বিতে লম্বমান হইয়া তাহাকেও ধরিয়া উদরস্থ করিল। উদরস্থ করিবামাত্র সে আপনি তৎক্ষণাৎ পাষাণদেহ হইয়া ভূতলে পড়িল। দেবমনোজ্ঞ কালকষ্ তৎকালে এই অদ্ভুত প্রপঞ্চের ব্যঙ্গতা ব্যক্তার্থে মুক্তকণ্ঠে কহিলেন, হে বীরবৃন্দ! তোমরা যে ট্রয়নগর অধিকার করিয়া রাজা প্রিয়ামের গৌরব-রবিকে চিররাহুগ্রাসে নিক্ষেপ করিয়া চিরযশস্বী হইবে, দেবকুল তাহা তোমাদিগকে এই ইঙ্গিতে দেখাইয়াছেন; কিন্তু তন্নিমিত্ত নয় বৎসর কাল তোমাদিগকে দুরন্ত রণক্লান্তি সহ্য করিতে হইবেক। এই কহিয়া অদিস্যুস্ পুনরায় কহিতে লাগিলেন, হে বীরকুল! তোমরা সে দেবভেদভেদকের কথা কেন বিস্মৃত হইতেছ? দেখ, নবম বৎসর অতীত হইয়া দশম বৎসর উপস্থিত হইয়াছে। এই বর্ত্তমান বর্ষে যে আমরা কৃতকার্য হইব, তাহার আর কোনই সন্দেহ নাই। তোমর তবে এখন কি বিবেচনায় পরিপকব শস্যপূর্ণ ক্ষেত্রে অগ্নি প্রদান করিতে চাহ। এ কি মৃঢ়তার কর্ম্ম?
বীরবরের এই উৎসাহদায়িনী বচনাবলী জ্ঞানদেবী আথেনীর মায়াবলে শ্রোতৃনিকরের মনোদেশে দৃঢ়রূপে বদ্ধমূল হইল। এবং তাহারা মুক্তকণ্ঠে বীরবরের অভিজ্ঞতা ও বীরতার প্রশংসা করিতে লাগিল। অদিস্যুসের এই বাক্যে প্রাচীন নেস্তর অনুমোদন করিলে রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্নন্ নেতৃদলকে যুদ্ধার্থে সুসজ্জ হইতে আজ্ঞা দিলেন। যোধ সকল স্ব স্ব শিবিরে প্রবেশ পূর্ব্বক ভাবী কাল যুদ্ধ হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য স্ব স্ব ইষ্টদেবের অর্চ্চনা করিলেন।
সৈন্যদল রণসজ্জায় বাহির হইল। যেমন কোন গিরিশিরস্থ বনে দাবানল প্রবেশ করিলে, বিভাবসুর বিভায় চতুর্দ্দিক আলোকময় হয়, সেইরূপ বীরদলের বর্ম্ম-জ্যোতিতে রণক্ষেত্র জ্যোতির্ম্ময় হইল। যেরূপ কালে সারসমালা বদ্ধমালা হইয়া পবন পথ দিয়া ভীষণ স্বনে কোন তড়াগাভিমুখে গমন করে, সেইরূপ শূরদল শূরনিনাদে রিপুসৈন্যাভিমুখে যাত্রা করিল। প্রতিনেতারাও স্ব স্ব যোধদলকে বদ্ধপরিকর হইয়া অস্ত্র শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্ববক সমরে প্রবৃত্ত হইতে আজ্ঞা দিলেন। যেমন যূথপতি যূথমধ্যে বিরাজমান হয়, সেইরূপ রাজচক্রবর্ত্তী রাজা আগেমেম্নন্ও সৈন্যদলমধ্যে শোভমান হইলেন। বীরপদভরে বসুমতী যেন কাঁপিয়া উঠিলেন।
―――
প্রথমপরিচ্ছেদ সমাপ্ত।