১৫১৩ সাল/একাদশ পরিচ্ছেদ

একাদশ পরিচ্ছদ

 দেখিতে দেখিতে সেই দিন আসিল। আজ আমাদের উৎসাহ দেখে কে? সকাল সকাল আহারাদি সমাপন করিয়া আমরা “সোনার ভারতে” আরোহণ করিলাম। কয়েকজন অংশীদার বন্দরে উপস্থিত ছিলেন। তাঁহারা আমাদিকে বিদায় দিলেন। নির্দ্দিষ্ট সময়ে জাহাজ ধীরে ধীরে চলিতে আরম্ভ করিল। সবমেরিন্ বোট পশ্চাতে আগমন করিতে লাগিল। আমরা তীরস্থ বন্ধুগণকে লক্ষ্য করিয়া অনবরত রুমাল উড়াইতে লাগিলাম। যতক্ষণ তাঁহাদিগকে দেখিতে পাওয়া যাইতেছিল, ততক্ষণ তাঁহাদের দিকে চাহিয়া রহিলাম। ক্রমে তীর অদৃশ্য হইল। সমুদ্র তখন নিস্তব্ধ। ক্বচিৎ একটা ঢেউ দেখা যাইতেছিল। আকাশ নির্ম্মল। পবনদেবও সুপ্রসন্ন।

 টং করিশা একটা বাজিল। আমরা ডেকে বসিয়াছিলাম, তৎক্ষণাৎ নীচে গেলাম। বন্ধুবর একটা বোতাম টিপিলেন। দুই এক মিনিটের মধ্যে সুবর্ণ প্রস্তুত করিবার যন্ত্রগুলি চলিতে আরম্ভ করিল। পাঁচ মিনিষ্ট পরে দেখিলাম যে সুবর্ণ প্রস্তুত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। কিয়ৎক্ষণ পরে বন্ধুবর যন্ত্রগুলি বন্ধ করিয়া দিলেন।

 আমি আশ্চর্য্য হইয়া বলিলামঃ—

 “যখন চলিতেছে চলুক্‌না কেন?”

 তিনি বলিলেনঃ—

 “না। Neutral zone এর বাহির দিয়া যাইতেছি বটে, কিন্তু আইন অনুযায়ী আমরা এখনও সরকারী সীমানার মধ্যে আছি। তাহার প্রমাণ দিতেছি।”

 এই বলিয়া তিনি বোম্বাই হাইকোর্টের ল রিপোর্টের একখণ্ড আনিয়া তাহাতে দুইটা কেস্ দেখাইলেন। বুঝিলাম আমার প্রস্তাৰ মত কার্য্য করিতে গেলে আইন লঙ্ঘন করা হইবে। অর্থাৎ আমরা ভারত-মহাসাগরের গর্ভে স্থিত ও কোনও শক্তি-কর্ত্তৃক অনধিকৃত যে জনশূন্য দ্বীপের নিকট আমাদের কার্য্যস্থল অতি সংগোপনে—এমন কি অংশীদারগণের অজ্ঞাতসারে—স্থির করিয়াছিলাম, তথায় উপস্থিত হইবার পর রীতিমত কার্য্য করিতে সক্ষম হইব।

 আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ—

 “তবে তুমি একথা পূর্ব্বে বল নাই কেন? অদ্য হইতেই ত’ কার্য্যারম্ভের কথা?”

 “হাঁ। আমার ভুল হইয়াছে বটে। অদ্য প্রাতে হঠাৎ এই কথা মনে উদয় হয়। তখন ল রিপোর্টখানি দেখি। যাহা হউক, দুই এক দিনের বিলম্বে কিছুই আসিয়া যাইবে না। অংশীদার মহাশয়দিগকে বুঝাইয়া বলিলে তাঁহারা বিরক্ত হইবেন না নিশ্চয়ই। আর দুইদিন পরে আমরা কার্য্যস্থলে পৌঁছিব। তখন—”

 এই সময়ে সুন্দরলাল আসিয়া বলিল যে তারহীন যন্ত্রের ঘণ্টা অনবরত বাজিতেছে। বন্ধুবর তৎক্ষণাৎ উঠিয়া গেলেন। একটু পরে বিরক্তভাবে আসিয়া বলিলেনঃ—

 “একটা কাণ্ড দেখিবে এস।”

 উক্ত যন্ত্রের নিকট লইয়া গিয়া তিনি আমায় বলিলেনঃ—

 “দেখ, receiver এর অবস্থা।”

 দেখি উহা ভাঙ্গা! কাজেই সংবাদ পাওয়া গেলনা।

 আমি আশ্চর্য্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলামঃ—

 “একি?”

 বন্ধুবর গম্ভীরভাবে বলিবেন:—

 “তুমি আমার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিওনা। ইহা কে অদ্যই ইচ্ছা করিয়া ভাঙ্গিয়াছে।”

 “কি করিয়া বুঝিলে?”

 “অদ্য জাহাজে উঠিবার পর আমি একটা সংবাদ কলিকাতার বাটীতে পাঠাইয়াছি। তখন উহা বেশ ছিল। এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কে উহা ভাঙ্গিয়াছে।”

 “আঁ, বলকি? এরূপ কে করিল?”

 “কোনও ব্যক্তির উপর আমার সন্দেহ হইয়াছে। কিন্তু প্রমাণ না পাইলে আমি কিছুই বলিব না বা করিব না”!

 “এখন উপায় কি?”

 “উপায় না করিয়া কি আমি আসিয়াছি?” এই বলিয়া তিনি ভাণ্ডার ঘরে গিয়া একটা receiver আনিয়া ফিট্ করিয়া দিলেন। এই সকল কার্য্যে প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা সময় অতিবাহিত হইয়া গেল। তখনও কিন্তু ঘণ্টা বাজিতেছে। বন্ধুবর receiver লইলেন!

 আমাদের কোন অংশীদার বোম্বাই হইতে জানিতে চাহিয়াছেন যে আমরা কেমন আছি এবং কার্য্যারম্ভ হইয়াছে কিনা। প্রশ্নের উত্তর দিয়া বন্ধুবর আমায় পাঠাগারে লইয়া গেলেন। আসন গ্রহণান্তর তিনি বলিলেন:—

 “দেখ রজনী, মনে করিয়াছিলাম এখানে নির্ব্বিঘ্নে কার্য্য করিতে পারিব। কিন্তু এখানেও আমাদের শত্রুর চর চুকিয়াছে। আমার যাহার উপর সন্দেহ হয়, তাহার নাম তোমায় এখন বলিব না। কিন্তু এইমাত্র বলি যে আমাদের সাবধানে থাকিতে হইবে। নতুবা বোধ হয় সকল শ্রম পণ্ড হইয়া যাইবে।”

 “যদি সন্দেহ হইয়া থাকে, তবে বল কোন বন্দরে সেই চরকে নামাইয়া দিই।”

 “তুমি বালকের মত কথা বলিতেছে। বিশেষ প্রমাণ না পাইলে চরকে ধরিব কি করিয়া? হইতে পারে আমার সন্দেহের কোন ভিত্তি নাই।”

 “তা বটে। এখন কি করিবে?”

 “একটা বিশেষ অনুসন্ধান করিব। তাহার ফল যে কিছুই হইবেনা, তাহা নিশ্চিত। দেখা যাউক কি হয়।”

 আমরা দুইজনে ডেকে গেলাম। সেখানে সকল কর্ম্মচারীদিগকে ডাকিয়া receiver ভাঙ্গার কথা বলিলাম। সকলেই শুনিয়া আশ্চর্য্য হইল; এবং ঘটনার যে কিছুই জানেনা তাহাও একবাক্যে বলিল!

 আমরা বিশেষ তদন্ত করিলাম, কিন্তু অনিষ্টকারীর সন্ধান হইল না। মন বড়ই খারাপ হইল। আরম্ভ ভালবোধ হইল না।