১৫১৩ সাল/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।
পরদিন প্রত্যূষে বন্ধুবর আমাকে শয্যা হইতে উঠাইলেন। কেমন একটা আলস্য বোধ হইতেছিল বলিয়া উঠি উঠি করিয়াও উঠিতে পারিতেছিলাম না।
তিনি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ—
“বলি আজ এক জায়গায় বেড়াইতে যাইবে?”
শয্যা হইতে লাফাইয়া উঠিয়া আশ্চর্য্যভাবে প্রশ্ন করিলামঃ—
“কোথায়?”
তিনি উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেনঃ—
“কেন জলের তলায়। নূতন স্থান। কত কি দেখিবে।”
“হাঁ। নিশ্চয়ই যাইব। কখন্ শুভযাত্রা করিতে হইবে?”
“আহারাদির পর।”
সবমেরিন্ বোট্ প্রস্তুত ছিল। যথা নির্দ্দিষ্ট সময়ে বন্ধুবর ও আমি তাহাতে আরোহণ করিলাম। উহার কাপ্তেন একটা কল টিপিলে ঘবং ঘবং করিয়া একটা বিকট শব্দ হইতে লাগিল। অর্দ্ধঘণ্টা পরে বন্ধুবর একটা যন্ত্র পরীক্ষা করিয়া আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন:—
“আমরা কোথায় আছি বলত?”
“কোথায় থাকিব? যেখানে ছিলাম সেইখানেই। কখন্ সবমেরিন্ নামিবে?”
ঈষৎ হাস্য করিয়া তিনি বলিলেনঃ—
“উহা দুইশত ফিট্ নামিয়াছে।”
“বল কি? আমিত কিছুই বুঝিতে পারি নাই।”
“দেখিবে এস,” বলিয়া তিনি আমাকে একটা ক্ষুদ্র গৃহে লইয়া গেলেন। পরে তাহার এক পার্শ্বের একখানি লৌহ আবরণ সরাইয়া ফেলিলেন। একট বৃহৎ কাচ সম্মুখে দেখিলাম। তাহার অপর পার্শ্বে লবণাম্বুরাশি! তথায় শত শত অদ্ভুত জীব বিচরণ করিতেছে। জীবনে এ এক সম্পূর্ণ নূতন দৃশ্য। আমি সবিস্ময়ে তাহাদের ক্রীড়া দেখিতে লাগিলাম। সহসা দেখি এক ভয়ঙ্কর জীব আমাদের দিকে আসিতেছে। ভয়ে আমি পশ্চাতে হটিয়া গেলাম।
বন্ধুবর আমায় ধরিয়া বলিলেন:—
“ভয় নাই। এই কাচখণ্ড ভাঙ্গিতে ১০০০০ ঘোড়ার বলের প্রয়োজন।”
আমি লজ্জিত হইয়া পড়িলাম। একটু পরে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—
“ওটা কি?”
“উহাকে ইংরাজীতে John Dory বলে। ইহা Kingfish শ্রেণীভুক্ত মৎস্যবিশেষ। কথিত আছে ইহার গাত্রে সেণ্টপিটারের অঙ্গুলির দাগ আছে।”
এমন সময় দেখি কতকগুলি লম্বা ছুঁচালমুখ মৎস্য ধীরে ধীরে আমাদের দিকে আসিতেছে। মুখ লম্বায় তিন, চারি ফিট্ কিন্তু দেহটা দশ বার ফিট্ বোধ হইল। বন্ধুবর চিৎকার করিয়া উঠিলেন:—
“সাবধান, সাবধান। সোর্ডফিসের ঝাঁক আসিয়াছে।” এই বলিয়া তিনি বেগে মোটাররুমে গেলেন।
আমি বড়ই চিন্তিত হইয়া পড়িলাম এবং তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গেলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন:—
“আঃ, বাঁচা গেল।”
আমি চিন্তিতভাবে প্রশ্ন করিলামঃ—
“ব্যাপার কি?”
“একটা ফাঁড়া গেল। যে মৎস্যগুলি দেখিয়াছিলে উহাদের নাম সোর্ডফিস্। ইহারা অতি ভয়ঙ্কর মৎস্য। ঐ লম্বা মুখ দ্বারা উহারা অনেক জাহাজের তলদেশ বিদীর্ণ করিয়াছে। লণ্ডনের British Museum ও অন্যান্যস্থানে উহাদের কর্ত্তৃক ভগ্ন অনেক জাহাজের hull দেখিতে পাইবে। উহাদের ঐ সোর্ডের ক্ষমতা এত যে উহা তাম্রাবরণ এমন কি নয় ইঞ্চি মোটা কাষ্ঠখণ্ড, বিদীর্ণ করিতে পারে। অনেকে সমুদ্রে স্নান করিতে গিয়া ঐ মৎস্যের হস্তে প্রাণ দিয়াছে। এইরূপ প্রবাদ যে, উহারা তিমি মৎস্যের চিরশত্রু। জাহাজাদিকে তিমি মৎস্য মনে করিয়া উহারা তাহাদিগকে নষ্ট করিয়া ফেলে।”
“তাইত। তাহা হইলে বাস্তবিকই মস্ত ফাঁড়া গিয়াছে। এখন কি করিলে?”
“আমি বোট্খানি আরো নামাইয়া দিয়াছি এবং তড়িতের সাহায্যে উহাদিগকে মারিয়া ফেলিয়াছি। দেখিবে?”
তিনি আমাকে পূর্ব্বোক্ত কাচখণ্ডের নিকট লইয়া গেলেন। দেখি বাস্তবিকই সোর্ডফিসগুলি মরিয়াছে এবং তাহাদের সহিত আরো শত শত মৃত মৎস্য ভাসিয়া বেড়াইতেছে।
বন্ধুবর বলিলেন:—
“উপায় নাই। তড়িতের বেগ ত একজনের উপর প্রয়োগ হইতে পারে না। সোর্ডফিসের নিকটস্থ সকল মৎস্যের উপর উহা সমভাবে লাগিয়াছে। আর এক নূতন কাণ্ড দেখ! মৎস্যের লড়াই হইতেছে।”
দেখি একটা মৎস্যকে আট দশটা মৎস্য আক্রমণ করিয়াছে। উহার অধোভাগে বেয়নেটের মত একটা দাঁড়া আছে। বুঝিলাম উহাকে স্বেচ্ছায় খাড়া করিয়াছে। যেমনই একটা মৎস্য তাহাকে আক্রমণ করিতেছে, সে উল্টাইয়া পড়িয়া ঐ দাঁড়ার দ্বারা তাহাকে বিদীর্ণ করিয়া দিতেছে।
আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ—
“ইহার নাম কি?”
বন্ধুবর উত্তর দিলেনঃ—
“ইহার সাধারণ নাম Stickle-back। উত্তর আয়ারলণ্ডে ইহাকে sprittle bag বা sprickly-bag বলে। দেখ, দেখ, দৃশ্য বড়ই সুন্দর হইল।”
চাহিয়া দেখি একটা লম্বা কুম্ভীরের মত মৎস্য সহসা উহাকে আক্রমণ করিল। ইহার দাঁতগুলি ক্ষুদ্র ও বাঁকা কিন্তু উহার মাথা হইতে করাতের মত লম্বা একটা দাঁড়া আছে। সে তাহা দিয়া ঐ Stickle-back কে আক্রমণ করিল। উহা পূর্ব্ব প্রথামত উলটাইয়া গিয়া উহার দাঁড়া দিয়া কুম্ভীরের পেট যেমন বিদীর্ণ করিতে যাইবে, উহাও সেই সময় উহার করাতখানি তাহার গলার দিকে চালাইয়া দিল। ফলে Stickleback দ্বিখণ্ডিত হইয়া গেল। “করাত মৎস্য” উহাকে ভক্ষণ করিয়া চলিয়া গেল।
এমন সময় সহসা “গেলাম, গেলাম” রব শ্রুত হইল।
ব্যাপার দেখিবার জন্য আমরা ছুটিয়া গেলাম। দেখি একজন লস্কর্ পাটাতনের উপর ছট্ফট্ করিতেছে। অনুসন্ধানে জানা গোল যে কৌতূহল বশতঃ সে ডেকের এক হাচেট্ খোলে। সেই সময় চৌবাচ্চায় একটি মৎস্য প্রবেশ করে। হাচেট্ বন্ধ করিয়া সে সেই মৎস্য যেমন ধরে অমনি চিৎকার করিয়া পড়িয়া যায়।
মৎস্যটি দেখিবামাত্র বন্ধুবর বলিয়া উঠিলেন:—
“যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিয়াছে। একটা electric silurus উহাকে আক্রমণ করিয়াছিল।”
“কি রকম?”
“এই মৎস্য আরব্যোপসাগরে সচরাচর দেখা যায় না। কেমন করিয়া একটা আসিয়া পড়িয়াছে। ইহা প্রায় নাইল্ নদীতে বাস করে। ইহার এক প্রধান গুণ এই যে, ইহা তড়িত আঘাত দিতে পারে। আঘাতের পর শরীরের ভিতর কেমন এক যন্ত্রণা উপস্থিত হয়। এমনও দেখা যায় যে কখনও দুই তিন চারিমাস পরেও ঐরূপ যন্ত্রণা অনুভূত হইতেছে। আরবীয়েরা ইহার যে নাম দিয়াছে তাহার মানে “Thunder”।”
“এখন এ ব্যক্তির যন্ত্রণা-নিবায়ণের উপায় কি?”
“বিশেষ কিছুই নাই; আপনি সারিবে।”
এই বলিয়া বন্ধুবর অপর এক লস্কর্কে শুশ্রূষা সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া পূর্ব্বোক্ত কাচের দরজার নিকট আসিলেন।
সেখানে বসিয়া বন্ধুবর কত অদ্ভুত অদ্ভুত জীব আমাকে চিনাইয়া দিতে লাগিলেন। Pipe fish, Pilot fish, Tunny, Red Band, প্রভৃতি কত প্রকারের যে নূতন মৎস্য দেখিলাম তাহা বর্ণনা করা যায় না। সেদিনকার অপূর্ব্ব আনন্দ ইহজীবনে ভুলিব না।
বন্ধুবর একটা Limpsucker দেখিয়া উহার বর্ণনা করিতেছেন, এমন সময় দেখি গোলাকার একটা কি ভাসিয়া যাইতেছে। উহার গাত্রোপরিস্থিত আঁইসগুলি সোজাভাবে অবস্থিত। উহা কি জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন:—
“উহার নাম Diodon বা Globe fish। উহা বায়ুভক্ষণ করিয়া বেলুনের মত আকার ধারণ করিতে পারে। ফলে, উহাকে কেহ আক্রমণ করিলে ঐ সোজা দাঁড়ার জন্য উহার কোনই অনিষ্ট হয় না।”
“উহা কি সাঁতার দিতে পারে?”
“অনেকের বিশ্বসে উহা পারে না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কুভিয়ার নামে যে এক বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন তাঁহারও ঐ মত ছিল। কিন্তু ডারউইন্ দেখাইয়া ছিলেন যে উহা কেবল সাঁতার দিতে পারে তাহা নহে, সোজা, উল্টা, যে ভাবে ইচ্ছা চলিতে পারে।”
বন্ধুবরের বক্তব্য শেষ হইতে না হইতেই দেখি একটা শুভ্রবর্ণের হাঙ্গর উহার দিকে ধাবিত হইয়াছে। হঠাৎ উহা থমকিয়া দাঁড়াইল। পরে ঐ Globe উহাকে আক্রমণ করিল এবং উহাকে মুখে করিয়া অদৃশ্য হইল।
বন্ধুবর বলিলেন:—
“ঐ যে জীবটা দেখিলে উহা নাবিকদিগের এক বিশেষ ভয়ের কারণ। উহাকে ধরিবামাত্র তাহারা উহার ল্যাজ কাটিয়া দেয়। তাহাদের বিশ্বাস যে ঐ ল্যাজেই উহার সকল শক্তি নিহিত আছে। উহার সম্বন্ধে যদি বিস্তারিত বিবরণ জানিতে ইচ্ছা কর, তবে Captain Hall প্রণীত Fragments of Voyages and Travels, Second Series, প্রথমভাগ, ২৬৭ পৃষ্ঠা পাঠ করিও। এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কতশত নূতন জীব দেখিলাম। তাহাতে মনে কি ভাব উদয় হইয়াছে বল—অ্যাঁ, বিপদ জ্ঞাপক ঘণ্টা বাজে কেন?” এই বলিয়া তিনি ত্র্যস্তভাবে কাপ্তেনের নিকট গেলেন। একটু পরে আসিয়া বলিলেন:—
“আমরা একটা সমুদ্রগর্ভস্থিত জাহাজের নিকটবর্ত্তী হইয়াছি, তাই ঐ ঘণ্টা বাজিয়া উঠিয়াছিল। আমাদের বোটের গতি ফিরান হইয়াছে। এখন আর ভয়ের কারণ নাই।”
আমি আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করিলাম:—
“নিমজ্জিত জাহাজ? উহা দেখাত’ ভাগ্যে ঘটে না। উহা দেখিবার কি সুবিধা হইবে না?”
বন্ধুবর হাস্য করিয়া বলিলেন:—
“খুব সুবিধা আছে। দেখিবে কি?”
“হাঁ।”
“তবে এস।”
আমরা দুইজনে কাপ্তেন মহাশয়ের নিকট উপস্থিত হইলাম। আমার অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া, তিনি ধীরে ধীরে বোট্খানিকে ভগ্ন জাহাজের নিকট লইয়া গেলেন। তাহার পর ডাইভিং পোষাক পরিয়া আমরা পাঁচ ছয় জন উহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম যে, উহা Eastern Star Line এর একখানা জাহাজ। তখন মনে পড়িল যে, প্রায় দশ বৎসর পূর্ব্বে উহা ধন লইয়া ইংলণ্ডাভিমুখে যাইতেছিল; কিন্তু অপর এক জাহাজের সহিত ধাক্কা লাগিয়া ডুবিয়া যায়। তাহাতে খুব অল্প প্রাণী নষ্ট হইয়াছিল।
জাহাজখানি আমরা ভাল করিয়া দেখিলাম। প্রত্যেক কামরাস্থিত দ্রব্যাদি একেবারেই নষ্ট হইয়া গিয়াছে। দরওয়াজা জানালাদি এতই জীর্ণ হইয়াছে যে, হাত দিলেই খসিয়া পড়িতেছে। প্রত্যেক কামরা দেখিয়া অবশেষে ধনাগারে গেলাম। দেখি উহায় দারওয়াজা বেশ দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত। বুঝিলাম, স্বাভাবিক অবস্থায় উহা খোলা একরূপ অসম্ভব; কিন্তু আমাদের দুই চারিটা পদাঘাতে উহা ভাঙ্গিয়া গেল। সম্মুখে এক অপূর্ব্ব দৃশ্য দেখিলাম। স্তরে স্তরে রৌপ্য ও সুবর্ণ bars সজ্জিত রহিয়াছে। অনুমান করিয়া দেখিলাম, উহার মূল্য কুড়ি হইতে ত্রিশ লক্ষ হইবে। উহা দেখিয়া কাপ্তেন মহাশয়ের কিঞ্চিৎ লোভ হইল। তিনি প্রস্তাব করিলেন যে, ঐ ধন আমরা তুলিয়া লইয়া আপনাদিগের মধ্যে ভাগ করিয়া লই।
বন্ধুবর বলিলেন:—
“আমি এ প্রস্তাবে সম্মত নহি। জানিয়া শুনিয়া ইহা লইলে যদি কোন প্রকারে কথাটা প্রকাশ পায়, তাহা হইলে আমাদিগকে ফৌজদারীতে পড়িতে হইবে। তবে এক কাজ করিতে পারি। ইহা তুলিয়া লইয়া গিয়া যাহাদের ধন তাহাদের পৌঁছাইয়া দিলে তাহারা Salvage বাবৎ শতকরা কুড়ি টাকা পর্য্যন্ত দিতে অস্বীকার করিবে না। আপনি তাহার শতকরা পাঁচ টাকা মত অংশ লইবেন। আর পাঁচ টাকা মত অংশ আমরা লইব।”
ভগ্নস্বরে কাপ্তেন মহাশয় বলিলেন:—
“আপনার কথা স্বীকার করি; কিন্তু এত ধন উত্তোলন করিতে সময় লাগিবে। আর আমাদিগের কার্য্যের বিলম্ব ঘটিবে। আপনি যাহা ভাল বুঝেন করুন।”
“আমিও ঐ কথা বলিতে যাইতেছিলাম। কেননা, আমরা যে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহার ব্যাঘাত কোন মতেই করিতে পারি না। কাজেই এখন এই ধন উত্তোলন প্রস্তাব স্থগিত থাকুক। সময়ান্তে যাহা ভাল হয় করিব।”
একটী নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কাপ্তেন মহাশয় বলিলেন:—
“তাহাই হইবে। আমি ইহার যথার্থ bearing লইয়া রাখিব।”
আর বিলম্ব না করিয়া আমরা স্বস্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম।
কাপ্তেন মহাশয় এক ঈঙ্গিত করিয়া সবমেরিন্ চালাইতে হুকুম দিলেন। কিন্তু অর্দ্ধঘণ্টা কাটিয়া গেল, তথাপি উহা চলিল না।
তিনি একটু চিন্তিত হইয়া পড়িলেন ও সত্বর এই কথা আমাদিগকে জানাইলেন। বন্ধুবর সকল যন্ত্রাদি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন। কোথাও কোন ত্রুটী দেখা গেল না। ব্যাপার কিছু গুরুতর বোধ হইল।
আমি উদ্বিগ্নচিত্তে বলিয়া উঠিলাম:—
“এখানেও নিশ্চয়ই শত্রুর চর চুকিয়াছে। সে কোনরূপ অনিষ্টের চেষ্টা করিতেছে। বোধ হয় আমাদিগকে এই সমুদ্রগর্ভে প্রোথিত করিয়া রাখা তাহার মনোগত ইচ্ছা।”
বন্ধুবর বলিলেন—
“তাহা হইতে পারে।” পরে কাপ্তেন মহাশয়কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন:—“চলুন, একবার আশ্ পাশ্ ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখা যাউক।”
অতি সত্বরই উভয়ে ডাইভিং পোষাক পরিধান করিলেন। আমিও তাঁহাদের অনুগমন করিলাম। তড়িতালোকে বহুদূর উদ্ভাসিত হইতেছিল। আমরা চারি পার্শ্ব ভাল করিয়া দেখিলাম।
সহসা বন্ধুবর এক বিকট হাস্য করিয়া বলিলেন:—
“যাহা ভাবিয়ছিলাম তাহাই ঘটিয়াছে। কাপ্তেন মহাশয়, একবার বোটের তলভাগ দেখুন।”
কাপ্তেন মহাশয় চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন:—
“বাঃ! এ যে কতকগুলি মৎস্য দেখিতেছি। উহারাই কি আমাদিগের গতিরোধ করিয়াছে। উহারাই কি আমাদিগের শত্রুর চর?”
বন্ধুবর হাস্য করিয়া বলিলেন:—
“চর হউক না হউক, উহারাই আমাদিগের গতিরোধ করিতেছে। উহাদিগের নাম Remora। উহাদিগের মস্তকের উপর এক Sucking disc দেখিতেছেন ত? উহার এত শক্তি যে উহা জাহাজের গতিরোধ করিতে সক্ষম। দেখিতেছি সংখ্যায় প্রায় ত্রিশটা। হউক।”
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলাম:—
“আঃ, বাঁচা গেল। আমার মনে নানা সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল। এখন উপায় কি?”
“স্বস্থানে গিয়া বলিব। চল।”
কালবিলম্ব না করিয়া আমরা আমাদিগের কামরায় প্রবেশ করিলাম। ডাইভারের পোষাক ত্যাগ করিয়াই, বন্ধুবর একটা বোতাম সজোরে টিপিলেন। দুই তিন মিনিট পরে জাহাজ চলিতে আরম্ভ হইল।
আমার প্রশ্নোত্তরে তিনি বলিলেন:—
“Remora দিগকে একেবারে নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছি। দেখিবে এস।”
এই বলিয়া তিনি পূর্ব্বকথিত কাচের আর্শীর নিকট লইয়া গেলেন। দেখিলাম বাস্তবিকই Remora গুলি মরিয়া ভাসিতে ভাসিতে চলিয়া যাইতেছে।
আমরা আর বিলম্ব না করিয়া উপরে উঠিতে লাগিলাম। একেবারে উপরে উঠবার পর দেখিলাম যে চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। ঘড়ি খুলিয়া দেখি প্রায় ১০ টা বাজিয়াছে। “সোনার ভারত” অদূরে নোঙ্গর করিয়াছিল। সকলে তাহাতে আরোহণ করিয়া স্ব স্ব শয্যা গ্রহণ করিলাম। বড়ই পরিশ্রান্ত ছিলাম। নিদ্রাদেবীও সত্বর আমাদিগকে তাঁহার ক্রোড়ে আশ্রয় দিলেন।