১৫১৩ সাল/চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ।

 বন্ধুবরকে প্রত্যহ সুবর্ণ প্রস্তুত করিতে দেখি। যে যে যন্ত্রের সাহায্যে উহা উৎপন্ন হয় তাহাও দেখি; কিন্তু শেষে কি এক দ্রব্যের সাহায্যে তিনি উহা প্রস্তুত করেন তাহা বুঝিতে অনেক চেষ্টা করিয়াও পারি না। কয়েকবার তাঁহাকে প্রশ্নও করিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি ‘হতগজ’ ভাবে উত্তর দিয়াছিলেন। একদিন বিশেষ করিয়া চাপিয়া ধরিলাম। তখন তিনি বলিলেন:—

 “তুমি প্রায়ই আমাকে এই প্রশ্ন করিয়া থাক। তুমি শিক্ষিত লোক। এ কথা তুমি বুঝ, যদি কেহ কোন কথা প্রকাশ করিতে ইচ্ছা না করে, তাহাকে তজ্জন্য পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়। তুমি মনে করিও না আমি বিরক্ত হইয়া এ কথা বলিতেছি। তুমি মনে করিতে পার যে, যে দ্রব্যটীর সাহায্যে সুবর্ণ উৎপাদন হয়, তাহা রাসায়নিক বিশ্লেষণ দ্বারা বাহির করিতে পারিবে। নাম করিয়া বলিব না, কেহ কেহ তাহার চেষ্টাও করিয়াছিল। কিন্তু কেহই কৃতকার্য্য হয় নাই, হইবেও না। তুমি জান আমার আবিষ্কার দীর্ঘ গবেষণার ফল। ইহাই অত্যন্ত আধুনিক সুবর্ণ উৎপাদনের উপায়। একটু বদলাইয়া লইয়া উহার দ্বারা তুমি অনায়াসেই স্বল্প ব্যয়ে ভূমি হইতে সুবর্ণ উত্তোলন করিতে পরিবে। বহুপূর্ব্বে যখন রীতিমত ভাবে সুবর্ণ উত্তোলন কার্য্য আরম্ভ হয় নাই, তখন কি করিয়া উহা সংগ্রহ করা হইত জান?”

 “না।”

 “তখন লোকে ore চূর্ণ করিত। পরে তাহার উপর পারা ঢালিয়া দিত। ঐ পারা সুবর্ণের সহিত এক্‌সা হইয়া যাইত, baser metals পড়িয়া থাকিত। ফলে তখন এ কার্য্য কঠিন ছিল না, খরচও কম পড়িত। কিন্তু ক্রমে ক্রমে উপরিস্থ স্তর শেষ হইয়া গেলে, নীচে কার্য্য করিতে মূল্যবান্ যন্ত্রাদির প্রয়োজন হইতে লাগিল। সেখানে সুবর্ণ refractory অবস্থায় থাকায় উহা পৃথক্ করা সহজ ছিল না। তখন stamping ও grinding যন্ত্রাদির প্রয়োজন হইল। ক্রমে দেখা গোল যে, মিশ্রণ-প্রণালীর দ্বারা খানিকটা সুবর্ণ পাওয়া যাইতে লাগিল, অবশিষ্ট নিকটস্থ নদীগর্ভে বা গুহায় চলিয়া যাইতে লাগিল। তখন এই ক্ষতি দূর করিবার জন্য নানা জটিল উপায় অবলম্বন করা হইল; কিন্তু ক্ষতি বন্ধ হইল না। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে dilute cyanide of potassium এর ব্যবহার প্রস্তাবিত হয়। ইহাতে ঘোরতর আপত্তি হয়, কেন না এই দ্রব্যটী এক দিকে যেমন মূল্যবান্, তেমনি বিষাক্ত। কিন্তু এই দ্রব্যের ব্যবহায় ক্রমে পৃথিবীর সর্ব্বত্র চলিত হইয়া গেল। তাহার প্রমাণ দেই। ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে পৃথিবীতে যত সুবর্ণ খনি ছিল, তাহাতে ৫০ টন্ এর অধিক cyanide of potassium ব্যবহৃত হয় নাই; কিন্তু ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে ২০০০০ টনের অধিক ব্যবহার হইয়াছিল। ঐ দ্রব্যের অর্দ্ধ সেরের মূল্য প্রথম প্রথম ১৷৷৹ টাকা ছিল, কিন্তু পরে ৷৷৹ আনা পর্যন্ত নামিয়াছিল। এই cyanide process দ্বারা এখনও সুবর্ণ উৎপাদন হয়। অবশ্য এখন ইহার অনেক উন্নতি হইয়াছে স্বীকার করি। এখন তুমি সহজেই অনুমান করিতে পরিবে যে, এই process এর সহিত আমার process এর আকাশ পাতাল প্রভেদ আছে। আমার process cyanide process নয় তাহার প্যমাণ দেই।” এই বলিয়া তিনি একখানি Text Book of Chemistry খুলিয়া cyanide of potassium জিনিষটা কি তাহা বুঝাইয়া দিলেন।

 আমি বলিলাম:

 “তুমি তোমার processটা পেটেণ্ট্ কর না কেন?”

 “করিয়া লাভ কি? কোন দেশে কুড়ি, কোথায় পনর, কোথায় বা পঁচিশ বৎসর মাত্র একচেটিয়া অধিকার পাইব। পরে উহা সাধারণ সম্পত্তি হইয়া যাইবে। অবশ্য সেলামী বাবত কিছু পাওয়া যাইবে; কিন্তু কয়েক বৎসরের জন্য মাত্র। অথচ আমি যদি উহা প্রকাশ না করি, তাহা হইলে জীবিত কাল পর্য্যন্ত ত উহার দ্বারা বহু ধন লাভ করিতে পারিব। আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তানসন্ততিগণও উহার দ্বারায় বেশ পয়সা উপার্জ্জন করিতে পারিবে। তাহাদিগকে কখনও দৈন্য দশায় পড়িতে হইবে না। তুমি বলিতে পার, যদি উহা কোন গতিকে প্রকাশ হইয়া পড়ে তবে কি হইবে? আমি বলি প্রকাশ কি করিয়া হইবে? কারণ গুপ্ততত্ত্ব আমার মাথার ভিতর আছে। উহার সবিশেষ বিবরণ লিখিয়া এমত এক স্থানে রাখিয়া দিয়াছি যে, দ্বিতীয় ব্যক্তি তাহা জানে না। কেবল দুইটী উপায় মাত্র দ্বারা আমার নিকট হইতে উহা জানিবার চেষ্টা হইতে পারে। এক Hypnotise করিয়া; কিন্তু তাহার সম্ভব নাই, কেন না আমি Hypnotism বিশেষরূপে শিক্ষা করিয়াছি, এবং কি প্রকারে আপনাকে সাবধানে রাখিতে হয় তাহাও সম্যক্ জ্ঞাত আছি। অন্য উপায়, ভয় প্রদর্শন করিয়া জানিয়া লওয়া। তাহাও অসম্ভব। কেন না আমি পরিচিত স্থল ব্যতীত অন্য কোথাও এক্‌লা যাই না। অপর, বাটীতে আক্রমণ করা সম্ভবপর নহে। কেন না Satineb যন্ত্রের দ্বারা শত্রু আপনি ধরা পড়িয়া যাইবে। অতএব আমি পেটেণ্ট লইবার আবশ্যকতা দেখি না।”

 সে দিন হইতে আমি বন্ধুবরকে তাঁহার সুবর্ণ প্রস্তুত করিবার প্রণালী বলিতে আর অনুরোধ করি নাই।