১৫১৩ সাল/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

 আমি প্রায়ই দেখি যে বন্ধুবর তারহীন বার্ত্তা প্রেরণ করিবার যন্ত্র দিনের মধ্যে পাঁচ সাত বার পরীক্ষা করিয়া দেখেন। একদিন কৌতূহল বশতঃ কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন:—

 “দেখ, এই জনমানবহীন স্থানে এই যন্ত্রটার যত প্রয়োজন আর কোন বস্তুর তত নহে। ধর, যদি এখানে আমরা একজন ব্যতীত সকলে মরিয়া যাই, তবে জীবিত ব্যক্তি তার করিয়া কলিকাতার খবর দিলে তাহাকে বাঁচাইতে পারা যাইবে। আমাদিগের কোন বিপদ ঘটিলে আমরা নিকটবর্ত্তী জনপদ হইতে সাহায্য পাইতে পারিব। আমার ঘন ঘন পরীক্ষা করিবার আর এক কারণ এই যে, যেদিন উক্ত যন্ত্র নষ্ট করিবার প্রথম চেষ্টা হইয়াছিল, সে দিন হইতে আমার মনে ধারণা হইয়াছে যে শত্রুর কোন চর আমাদিগের সহিত আসিয়াছে। তজ্জন্য সাবধানে থাকা নিতান্ত প্রয়োজন।”

 “যদি এমন কেহ থাকে, তবে এই ছয় মাসের অধিককাল আমরা কার্য্য করিতেছি, সে অন্য কোন প্রকারে অনিষ্টের চেষ্টা করে নাই কেন?”

 “করিয়াছে, কিন্তু সুবিধা করিতে পারে নাই। তোমার মনে উদ্বেগ হইবে বলিয়া এত দিন কোন কথা প্রকাশ করি নাই। যাহা হউক, “সাবধানে বিনাশ নাই” এই প্রবাদ অতি সত্য। আর এক কথা। আমাদের এই season এর কার্য্য শেষ হইতে আর অধিক বিলম্ব নাই। অতএব এখন কিছু বিশেষ সাবধানতার প্রয়োজন।”

 একটু ব্যঙ্গভাবে আমি বলিলাম:—

 “তোমার এখনও জুজুর ভয় যায় নাই দেখিতেছি। এই জনশূন্য স্থানে কোন্ শত্রুর চর আসিতে সাহস করিবে? ধরিলাম সে আসিয়াছে। আচ্ছা, সে খাইবে কি?”

 আমার বক্তব্য শেষ হয় নাই, এমন সময় তারহীন বার্ত্তা প্রেরণ করিবার যন্ত্রের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। বন্ধুবর যে সংবাদ পাইলেন, তাহা অতীব বিস্ময়কর! উহা এই:—

 “সাবধান। শত্রুর চর আপনার ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। আপনাদিগের গতি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সে লক্ষ্য করিতেছে। ঘোরতর বিপদ শীঘ্রই উপস্থিত হইবে।”

 এই সংবাদে বন্ধুবরের ও আমার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া বন্ধুবর জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “তুমি কে?”

 উত্তর আসিল:—“আমি হরিশ!”

 “তুমি এখন কোথায়?”

 “চারু বাবুর বাটীতে।”

 চারু বাবু আমাদিগের কোম্পানীর একজন ডাইরেক্টার্।

 “এতদিন কোথায় ছিলে?”

 “গুম হইয়া—সে অনেক কথা। সাক্ষাতে সব বলিব। বিশেষ সাবধানে থাকিবেন।”

 “আচ্ছা।”

 Receiver তুলিয়া রাখিয়া বন্ধুবর আমায় বলিলেন:—

 “শুনিলে ত? আমার কথা উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছিলে না?”

 এখত করিবে কি? যাহাকে সন্দেহ কর, গ্রেপ্তার করিলে হয় না?”

 “চেষ্টা করিয়া দেখিতে পার,” এই কথা কে আমাদের পশ্চাতে বলিয়া উঠিল। ফিরিয়া দেখি সুন্দরলাল দণ্ডায়মান!

 আমি বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “তুই এখানে কেন?”

 “তোমাদিগকে মারিয়া ফেলিতে আসিয়াছি!”

 বন্ধুবর শ্লেষ করিয়া বলিলেন:—

 “তুই যে আমাদের শত্রুর চর তাহা অনেক দিন হইতে জানি। তোকে আমি কখনই সঙ্গে লইতোম না; কিন্তু আমার এই বন্ধুর জেদে তোকে লইয়াছিলাম। আমি তোকে প্রথম দিনেই চিনিতে পারি। তবে তুই যেরূপ ভাবে কার্য্য করিতেছিলি, তাহাতে আমি একটু ভ্রমে পড়িয়াছিলাম। তুই আমাদের তারহীন বার্ত্তা প্রেরণ করিবার যন্ত্রটা খারাপ করিয়া দিয়াছিলি, নহে কি?”

 “হাঁ। কি করিবে কর না। তোমাদের ত আর ঘরে ফিরিয়া যাইতে হইবে না, এখানেই চিতায় শয়ন করাইব। অমাদিগের ভয় কি?”

 “‘দিগের’ কারা রে?”

 “দেখিবে? দেখ।” এই বলিয়া সে একটি শিষ্ দিল।

 দেখিতে দেখিতে পাঁচ ছয় জন লস্কর্ ছটিয়া আসিল। তাহাদের প্রত্যেকের হস্তে এক এক লাঠি।

 তাহাদিগকে দেখিয়া বন্ধুবর সুন্দরলালকে জিজ্ঞাসা করিলেন:—

 “তুই কি চাস্?”

 সে বলিল:—

 “তোমরা প্রাণে বাঁচিতে চাও কিনা বল। যদি চাও, তবে এক সর্ত্তে রাজী হইতে হইবে। আর যদি আমাদের সহিত শত্রুতা কর, তাহা হইলে অন্য ব্যবস্থা করিব।”

 “তুই দেখ্‌চি লাট্ হইয়াছিস; তোর বক্তব্য বল।”

 “লাট্ ত বটেই। তা না হইলে আমি এমন ভাবে তোমাদের সম্মুখে দাঁড়াইতে সক্ষম হইতাম না। যদি বাঁচিতে চাও, তবে আমাদের এই সর্ত্তে লেখাপড়া করিয়া দাও যে, তোমরা স্বেচ্ছায় “সোনার ভারত” ও তাহাতে যে কিছু দ্রব্যাদি আছে সকলই আমাদিগকে দান করিলে; আমরা তাহার যথা ইচ্ছা ব্যবহার করিতে পারিব। যদি তোমরা পরে সর্ত্ত বাতিল করিতে ইচ্ছা কর, তাহা গ্রাহ্য হইবে না।”

 “যদি ইহাতে রাজী হই তুই করিবি কি?”

 “তুমি কি মনে কর তোমাদিগকে সাদরে ঘরে পৌঁছাইয়া দিব। যদি এরূপ মনে করিয়া থাক, ভুল বুঝিয়াছ। আমরা জাহাজে চড়িয়া চলিয়া যাইব। তোমরা দুই জনে এই দ্বীপে পরম সুখে বাস করিতে থাকিবে। তোমাদের জন্য এক বৎসরের মত খাবার দিয়া যাইব। তারপর তোমাদের ভাগ্য।”

 “ওঃ, কি দয়ার শরীর তোর! এমন তর সচরাচর দেখা যায় না। আচ্ছা যদি সর্ত্তে রাজী না হই, তবে কি করিবি?”

 “তোমাদের প্রাণবধ করিয়া মৃতদেহ সৎকার করিয়া স্বস্থানে চলিয়া যাইব। যাহাতে তোমাদের অস্তিত্ব পর্য্যন্ত লোপ পায় তাহা না করিয়া যাইব না।”

 “বটে? তবে আমাদের ছেলেপিলের অনেক কষ্টের লাঘব করিয়া দিবি দেখিতেছি। বল, তুই এরকম করিতেছিস্ কেন? কে তোর এমন মতি দিল? তুই ভবিষ্যৎ ভাবিতেছিস্ না।”

 “ভবিষ্যৎ, সে আবার কি? যাহার বরাতে যাহা আছে তাহাই হইবে। আমার আবার ভয় কি? তোমরা যদি না থাক, তবে আমাদের বিপদে ফেলিবে কে?”

 “তোর মাথার ঠিক নাই দেখিতেছি। একটু ঠাণ্ডা হ’। ব্যাপারটা বুঝাইয়া বল।”

 “মাথা ঠিকই আছে। ব্যাপারটা শুনিতে চাহিতেছ? এখন বলিতে আর আপত্তি কিছুই নাই। কেন না, তোমাদের শেষ সময় উপস্থিত। সকল কথা শুনিয়া একটু আশ্বস্ত হইয়া মরিতে পরিবে। তুমি জান, তুমি “প্রভাতী” সম্পাদকের কতই না অনিষ্ট করিয়াছ। তিনি যাহা চেষ্টা করিয়াছেন, তাহাতে একটা না একটা বখেড়া দিয়াছ। মানুষের শরীর কতদিন আর সহ্য করিতে পারে। কাজেই তিনি তোমায় রীতিমত শিক্ষা দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছেন। আমায় তুমি উঁহার ছাপাখানায় কাজ করিতে দেখিয়াছিলে, তাহা ঠিক। আমি কিন্তু মনে করি নাই তুমি আমাকে চিনিতে পারিবে। যাহা হউক, আমি কোন রকমে তাঁহার মতলব জানিতে পারিয়া তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে প্রস্তুত—একথা তাঁহাকে জানাই। তিনি আমায় নানা প্রকারে পরীক্ষা করিয়া আমার প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা দেখিয়া একদিন বলিলেন যে, যদি আমি তোমাদের জাহাজ ডুবাইয়া দিতে ও তোমাদিগের প্রাণনাশ করিতে পারি, তিনি আমায় পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার দিবেন। আমার বিশ্বাসের জন্য তিনি দশ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়াছেন। আমি কোন রকমে তোমার বন্ধুর অধীনে এক চাকুরী জোগাড় করিয়া তাঁহাকে অনেক খোসামোদ করিয়া “সোনার ভারতে” একটি কর্ম্ম যোগাড় করি। উহাতে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার বড়ই সুবিধা হইল। তুমি জান, তোমার তারহীন বার্ত্তা প্রেরণ করিবার যন্ত্র আমিই প্রথমে নষ্ট করিয়া দেই। তখন জানিতাম না যে, উহার duplicate অংশ ছিল। যাহা হউক, তাহার পর আরও কয়েকবার তোমার অনিষ্টের চেষ্টা করিয়াছি; কিন্তু তোমার সাবধানতার জন্য সুবিধা করিতে পারি নাই। অবশেষে অনেক চেষ্টায় পর স্থির করিলাম যে, তোমাদের লস্করগণকে অর্থলোতে বশীভূত করিয়া বিদ্রোহী করিতে না পারিলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে না। যে দিন আমি সমুদ্রতলস্থিত জাহাজের ধনরাশি দেখি, সেই দিনই এই মতলব্ স্থির করি। কিন্তু সেই সময়েই আমার আগেকার মতের পরিবর্ত্তন হয়। সেই সুবর্ণ ও রৌপ্যের মূল্য ত্রিশ লক্ষ টাকার কম হইবে না। “সোনার ভারতে” যে সুবর্ণ আছে, তাহার মূল্যও দশলক্ষের কম মহে। দেখিলাম যে, এই ত্রিশ লক্ষের কিছু না হ’ক, বিশ লক্ষ আমি অনায়াসেই নিজস্ব করিয়া লইতে পারিব। বাকী বিশ লক্ষ লস্কর্‌দিগকে ঘুষ দিলে, তাহারা আমার সহিত নিশ্চয়ই যোগ দিবে। আমি প্রথমে কাপ্তেনের মনোগত ভাব বুঝিয়া দেখিলাম। তিনি একেবারেই নারাজ। তখন আমি লস্কর্‌দিগকে জাপাইতে লাগিলাম। প্রথমে তাহার রাজী হয় না; কিন্তু যখন তাহাদিগকে রাতারাতি বড় মানুষ হইবার সুবিধা বিস্তারিত ভাবে বুঝাইয়া দিয়া তাহাদের এই ধারণা করাইলাম যে, তাহাদিগের কোন বিপদের আশঙ্কা নাই, তখন তাহারা অনেকেই আমার সহিত যোগ দিতে স্বীকৃত হইল। পরে আমি অন্যান্য মতলব স্থির করিয়া বিদ্রোহ করিবার সুবিধা খুঁজিতে লাগিলাম। আমি এখন আর “প্রভাতী” সম্পাদকের ভৃত্য নহি। আমাকেই তোমাদের শত্রু জানিবে।”

 বন্ধুবর বলিলেন:—

 “এখন সকল কথাই বুঝিলাম! কাপ্তেন মহাশয় কোথায়?”

 “তাঁহার হাত পা বাঁধিয়া তাঁহাকে এক কাবিনে বন্দী করিয়া রাখিয়া আসিয়াছি। চার জন্য লস্কর্ তাঁহাকে পাহারা দিতেছে। যাক্, এখন তোমরা আমার সর্ত্তে রাজী আছ কিনা বল?”

 বন্ধুবর দৃঢ় ভাবে উত্তর দিলেন:—


“যষ্টি উত্তোলন করিয়া আমাদিগকে আক্রমণ করিতে আসিল।” (পৃঃ ৭৫)

 “না।”

 “তবে মজা দেখ।”

 এই বলিয়া সুন্দরলাল একটা ইসারা করিল। তৎক্ষণাৎ যষ্টি উত্তোলন করিয়া তাহার সঙ্গীগণ আমাদিগকে আক্রমণ করিতে আসিল। আমরা প্রাণপণে তীরাভিমুখে দৌড়াইতে লাগিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জালিবোট ধরিতে পারিলাম এবং উহা এমন বেগে চালাইয়া দিলাম যে, আক্রমণকারিগণ তীরে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বে আমরা প্রায় ২০০ হাত দূরে চলিয়া যাইতে সক্ষম হইলাম। নিরুপায় হইয়া তাহারা অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগিল। আমরা তাহা গ্রাহ্য করিলাম না।

 একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া বন্ধুবরকে জিজ্ঞাসা করিলাম:—

 “বলি, যাইতেছ কোথায়?”

 “কেন, জাহাজাভিমুখে?”

 “কিন্তু সেখানেও যে বিপদ্?”

 “থাকুক। আমার বিশ্বাস আমাদের হঠাৎ আবির্ভাব অপর বিদ্রোহীদিগের মনে ভীতি-উৎপাদন করিতে সক্ষম হইবে। তাহার পর তাহাদিগকে মিষ্ট বাক্য দ্বারা বশীভূত করিব। আমার উপর নির্ভর কর।”

 “সোনার ভারতের” নিকট যখন আমাদিগের বোট পৌঁছিল, তখন দেখি ডেকের উপর দুই জন থালাসী দণ্ডায়মান আছে। তাহারা আমাদিগকে দেখিয়াই “গাঁঙ্গওয়ে” দিয়া নামিয়া আসিল এবং আমাদিগকে উপরে লইয়া গেল। তথায় অন্য কাহাকেও দেখিলাম না। বন্ধুবর তাহাদিগকে সকল কথা খুলিয়া বলিতে বলিলেন। তাহারা সংক্ষেপে বিদ্রোহের সকল বিবরণই দিল। তাহাদিগের নিকট ইহাও জানিলাম যে আন্দাজ অর্দ্ধেক খালাসী বিদ্রোহী হইয়াছে, অপর সকলে ভয়ে তাহাদিগের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছে। এই কথা শুনিয়া আমাদের একটু সাহস হইল। প্রথমে আমরা আমাদের কেবিনে প্রবেশ করিলাম। সেখান হইতে পাঁচটী রিভলবার সংগ্রহ করিয়া কাপ্তেন মহাশয়কে যে কেবিনে বিদ্রোহীরা আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, তদাভিমুখে গমন করিলাম। উহার সম্মুখেই চারিজন পাহারা বসিয়া আছে দেখিলাম। আমাদিগকে দেখিয়া তাহারা চীৎকার করিয়া আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইল। আমরা তাহাদিগের মস্তকের দিকে রিভলবার লক্ষ্য করিয়া ধরিলাম এবং বন্ধুবর দৃঢ়ভাবে তাহাদিগকে বলিলেন:—

 “খবরদার্। এক পা এগুলেই তোদের মাথা উড়িয়া যাইবে। যদি ভাল চাস্, তবে তোদের লাঠি এক পাশে ফেলিয়া দে। নইলে তোদের রক্ষা নাই।”

 বন্ধুবরের সেই দৃঢ়তা-ব্যঞ্জক স্বর বিদ্রোহীদিগকে নরম করিয়া দিল। তাহারা দুই একবার “হাঁ,—না” বলিয়া লাঠি দিল এবং অপরাধের জন্য বারংবার ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিল।

 বন্ধুবর নরম ভাবে বলিলেন:—

 “তোদের বিশেষ দোষ নাই জানি। তোরা মন্দলোকের প্ররোচণায় এইরূপ দুঃসাহসিক কার্য্য করিয়াছিস্। আয়, আমাদের সঙ্গে আয়। তোদের দোষ এবারকার মত মাপ করিলাম।”

 বারংবার কৃতজ্ঞতা জানাইয়া তাহারা আমাদিগের সহিত কপ্তেন মহাশয়ের কেবিনে প্রবেশ করিল। তাঁহাকে সত্বর মুক্ত করিয়া তাঁহার মুখে বিদ্রোহের সকল বিবরণ শুনিয়া লইলাম। আমাদিগের দল এখন ভারী হইল। তখন বন্ধুবরের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে সকলে ডেকের নিম্নে অবতরণ করিলাম। সেখানে অপরাপর বিদ্রোহীরা জটলা করিতেছিল।

 হঠাৎ আমাদিগকে, বিশেষতঃ কাপ্তেন মহাশয়কে, দেখিয়া তাহারা বুঝিল যে আর নিস্তার নাই। কেহ কেহ “মার” “মার” করিয়া লাঠি তুলিয়া দাঁড়াইল। সকলকে সম্বোধন করিরা বন্ধুবর বলিলেন:—

 “হুঁসিয়ার! তোদের যে পালের গোদা, সে ধরা পড়িয়াছে। তোরা তার মিথ্যা লোভে পড়িয়া আমাদিগের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিস্। তোরা আমাদিগের কিছুই অনিষ্ট করিতে পারিবি না। যদি এক্ষণেই দোষ স্বীকার করিয়া ক্ষমা চাস্, ত ভালই; নচেৎ তোদের আর রক্ষা নাই। ভাবিবার জন্য দুই মিনিট সময় দিলাম।”

 এই বলিয়া তিনি ঘড়ি খুলিয়া ধরিলেন।

 তাহাদের ভিতর একটা গোলযোগ উপস্থিত হইল। তিন জন ব্যতীত অপর সকলেই অবিলম্বে বশ্যতা স্বীকার করিল! আমাদিগের ভয় দূর হইল। বন্ধুবরের হুকুম মত সেই তিন জনকে রজ্জু দ্বারা বাঁধিয়া একটা কেবিনে বন্দী করিয়া রাখা হইল। পরে থালাসীগণকে একত্র করিয়া তাহারা সুন্দরলালের প্ররোচনায় যে ভয়ানক অন্যায় কার্য্য করিায়াছে, তাহা বন্ধুবর তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিলেন। তাহারা ঈশ্বরের নামে শপথ করিয়া বলিল যে আর কখনও বিদ্রোহী হইবে না।

 তাহার পর আমরা বারোজন উপযুক্ত ভাবে সজ্জিত হইয়া তীরে গেলাম। নিকটেই সুন্দরলাল ও তাহার বন্ধুগণ বসিয়াছিল। আমাদিগকে দেখিয়া তাহারা “মার” “মার” শব্দে আক্রমণ করিল। কিয়ৎক্ষণ যুদ্ধ চলিল। কিন্তু শীঘ্রই তাহারা পরাভূত ও একে একে ধৃত হইল। তাহাদিগকে বাঁধিয়া জাহাজে চালান দেওয়া গেল। আমরা দুইজনে তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলাম এবং তীরে বসিয়া শ্রা্ন্তিদূর করিতে লাগিলাম।