১৫১৩ সাল/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বল মহাশয়ের কাণ্ড আমরা আপাততঃ প্রকাশ করিব না স্থির করিলাম। কিন্তু সপ্তাহ কাটিতে না কাটিতে এমন এক ঘটনা ঘটিল যাহাতে উহা প্রকাশ হইয়া পড়িল।
একদিন প্রাতে আমরা পত্র পাইলাম যে অংশীদারগণের এক বিশেষ অধিবেশন হইবে। তাহাকে আমাদিগকে, অর্থাৎ ডাইরেক্টারগণকে, কার্য্যের এক হিসাব উপস্থিত করিতে হইবে, এবং সেই সময় একজন অংশীদার একটী প্রস্তাব করিবেন।
কাজটা বেআইনী হইলেও আমরা যথাসময় সভাস্থলে উপস্থিত হইলাম। দেখি, সকল অংশীদারগণই উপস্থিত। তাঁহাদিগের মধ্যে একজন এই বলিয়া কার্য্য আরম্ভ করিলেন:—
“অদ্যদার সভা আহ্বানের একটী বিশেষ কারণ আছে। আমি অনেকদিন হইতে ডাইরেক্টারগণ কি করিতেছেন তাহা জানিবার জন্য উৎসুক আমি। শুনিতে পাই, হাসানজী কোম্পানী কি গোলযোগ উপস্থিত করিয়াছে। কাজেই, আমরা একটা হিসাব নিকাশ লইতে বাধ্য হইতেছি। ডাইরেক্টার মহাশয়েরা নিশ্চয়ই তাঁহাদের হিসাব up-to-date রাখিয়াছেন। তাঁহারা তাহাই উপস্থিত করুন।”
আমি বলিলাম:—
“এ কিরূপ কথা? আপনারা আমাদের উপর বিশ্বাসস্থাপন করিয়া সকল বিষয়ের ভারার্পণ করিয়াছেন। আমরা যথাসাধ্য সকল কার্য্য করিতেছি। আমরা হিসাব দেখাইতে বা এতদিন কি করিয়াছি, তাহার বিবরণ উপস্থিত করিতে সর্ব্বদাই প্রস্তুত। কিন্তু বেয়াইনী ভাবে কিছুই দিব না। রীতিমত নোটিস্ দিয়া সভা আহ্ববান করুন। আমরা আহ্লাদে সকল কথা জানাইব।”
সেই অংশীদার মহাশয় বলিলেন:—
“এই সভা যথানিয়মে আহুত হইয়াছে। এ বিষয়ে বোধহয় দুইজন ব্যতীত আর কাহারও অন্যমত নাই। আমি প্রস্তাব করি যে আমাদের একজন মাননীয় অংশীদার “প্রভাতী” সম্পাদক শ্রীযুক্ত রামদাস ঘোষ মহাশয় অদ্যকার সভার সভাপতি হউন।”
এই প্রস্তাব শুনিয়া অনেকে পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিলেন। শীঘ্রই একজন অংশীদার, শ্রীপ্রিয়নাথ রায়, বলিয়া উঠিলেন:—
“প্রভাতী”—সম্পাদক আমাদের অংশীদার নহেন। তিনি কিরূপে সভাপতি হইতে পারেন?”
আমি থাকিতে পারিলাম না, বলিলাম:—
“বাস্তবিকই তিনি এখন একজন অংশীদার। বলমহাশয় সকল কথা জানেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করুন।”
বলমহাশয় বিস্মিতভাবে বলিলেন:—
“কই, কবে তিনি অংশীদার হইলেন? আমিত কিছুই জানি না?”
“প্রভাতী”-সম্পাদক সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি ব্যঙ্গোক্তি করিয়া বলিলেন:—
“দেখিতেছি, বলমহাশয়ের স্মরণশক্তি হ্রাস পাইয়াছে। এমন অবস্থায় তিনি এরূপ গুরুতর কার্য্যের সহিত জড়িত না থাকিয়া কিছুকাল আপনার চিকিৎসকাদি করান। অন্যথা তাঁহার পরিণাম শোচনীয় হইতে পারে।”
বলমহাশয় বলিলেন:—
“আপনার কথায় পরম আপ্যায়িত হইলাম। আমার স্মরণশক্তির কিঞ্চিৎ মাত্রও হ্রাস হয় নাই। আমি প্রস্তাব করি যে “প্রভাতী”—সম্পাদক মহাশয়ের যখন এখানে আসিবার কোন অধিকার নাই তখন তাঁহাকে সভা হইতে চলিয়া যাইতে অনুরোধ করা হউক।”
“কেন যাইব? কখনই নহে,” সম্পাদক মহাশয় টেবিল চাপড়াইয়া বলিয়া উঠিলেন।
বলমহাশয় দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলেন:—“আপনি অংশীদার নহেন বলিয়া।”
সম্পাদকমহাশয় দণ্ডায়মান হইয়া বলিতে লাগিলেন:—
“বটে? তবে মহাশয়গণ শুনুন। এই ভদ্রলোক তাঁহার অংশ আমার নিকট বিক্রয় করিয়াছেন। তাহার কোবালা এই দেখুন।” এই বলিয়া কতকগুলি কাগজ আমার হস্তে দিলেন।
খুলিয়া দেখি উহা কতকগুলি সাদা কাগজ মাত্র! একটিও অক্ষর কোথাও নাই!
আমি উহা ফিরাইয়া দিয়া বলিলাম:—
“একি দিলেন? ইহাতে কিছুতেইতো লেখা নাই।”
“আঁ, বলেন কি?” বলিয়া সম্পাদক মহাশয় অতি ব্যস্ততার সহিত কাগজগুলি উল্টিয়া দেখিলেন। সহসা মস্তকে হাত দিয়া তিনি বসিয়া পড়িলেন ও কাতরভাবে বলিলেন:—“আঁ, এ কিরকম হইল? একি? আঁ?”
বল মহাশয় ব্যঙ্গভাবে বলিলেন:—
“লোকটার রকম দেখুন! বলি, এ রকম জুয়াচুরী কবে হইতে অভ্যাস হইয়াছে?”
সম্পাদক মহাশয়ের মুখ লাল হইয়া উঠিল। তিনি বলমহাশয়কে প্রহার দিবার জন্য আস্তিন্ গুটাইলেন। আমরা পড়িয়া উভয়কেই সরাইয়া দিলাম এবং সম্পাদক মহাশয়কে আর কেলেঙ্কারি না বাড়াইয়া চলিয়া যাইবার জন্য অনুরোধ করিলাম।
যাইবার পূর্ব্বে তিনি বলমহাশয়কে সম্বোধন করিয়া বলিলেন:—
“দেখ্, বল্। তুই ভীমরুলের চাকে পা দিয়াছিস্। ফলে তোর বিপদ অবশ্যম্ভাবী। তুই মনে করিস্ না যে তোর জুয়াচুরী ধরা পড়িবার জো নাই। আমার মন্দ চেষ্টা করেছিস্। না হয় কিছু টাকা লোকসান্ যা’বে। কিন্তু তোর সেই পত্র যা হাসানজীদের লিখেছিলি—বিস্তারিত খুলে বল্বনা—তা’ আমার কাছে এখনও আছে। দশ বৎসর দ্বীপান্তর, জানিস্। আমি তোকে সহজে ছাড়্বো না।”
তিনি চলিয়া গেলে পর বলমহাশয় আমাদিগকে বলিলেন:—
“লোকটা অতি নীচপ্রকৃতির। আমি উহার ভয়কে থোড়াই কেয়ার করি।”
এই গোলযোগে কার্য্য কিছুই হইল না। সর্ব্বসম্মতিক্রমে এক সপ্তাহের জন্য সভা স্থগিত থাকিল। একে একে সকলেই প্রায় চলিয়া গেলেন। রহিলাম মাত্র অমি, বন্ধুবর ও বলমহাশয়।
বলমহাশয়কে আমি শীঘ্রই গভীরস্বরে প্রশ্ন করিলাম:—
“আপনার এ কেলেঙ্কারি করিবার কি প্রয়োজন ছিল?”
তিনি চিৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন:—
“কি? কি বলেন? কেলেঙ্কারি?”
ঘৃণার সহিত তাঁহার দিকে চাহিয়া আমি বলিলাম:—
“খেলিলেন খেলা ভাল। সম্পাদককে তো জুয়াচোর প্রভৃতি মধুর বাক্যে আপ্যায়িত করিলেন। এখন জুয়াচোর কে ধর্ম্মতঃ বলুন ত?”
“কি বলেন? আমি জুয়াচোর?”
“হাঁ। আপনি বিষম জুয়াচোর, দাগা বাজ, প্রবঞ্চক, দস্যু—”
“মুখ সামলাইয়া কথা কহিবেন। না হইলে বিশেষ অনিষ্ট ঘটিতে পারে।”
আস্তিন্ গুটাইয়া হাত দেখাইয়া আমি বলিলাম:—
“শরীরের উপর নহে। এই দেখুন বহরটা।”
“আপনার নামে নালিশ করিয়া কিছুদিন শ্রীঘর দর্শন করাইব।”
“আমায় যাইতে হইবে না। সম্পাদক আপনার সেখানে বাসের আয়োজন করিবেন।”
“আপনি ভাল চাহেন তবে ক্ষমা প্রার্থন করুন।”
“কখনই না।”
বন্ধুবর এতক্ষণ চুপ করিয়া সকল কথা শুনিতেছিলেন। তিনি এখন বাধা দিয়া বলিলেন:—
“রজনী বাড়াবাড়ি করিও না। থাম।”
“লোকটার প্রবঞ্চনার প্রমাণ এক্ষণেই দিতেছি।” এই বলিয়া আমি এক ভৃত্যকে একটা spirit lamp আনিতে বলিলাম। তাহার উপর সম্পাদকের তথা-কথিত কোবালার একপৃষ্ঠা দুইচারি মিনিট ধরিবার পর ইংরাজী ভাষায় লিখিত অনেকগুলি অক্ষর বাহির হইয়া পড়িল।
আমি পড়িতে উদ্যত হইলে, বল বাধা দিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু আমি চিৎকার করিয়া কিছু কিছু পাঠ করিলাম।
বন্ধুবর বলিলেন:—
“এ ত’ আমরা যে কোবালা পূর্ব্বে দেখিয়াছি তাহারই অনুলিপি। অক্ষরগুলি লোপ পাইয়াছিল কি করিয়া?”
এ আর বুঝিতে পারিলেন না? বল, বড় চালাক লোক কিনা। তাই অদৃশ্যকালী দিয়া এই কোবালা লেখায়! লেখার অবস্থা দেখিয়া বোধ হইতেছে ও অদৃশ্যকালী প্রস্তুতের উপায় জানে।”
বলকে সম্বোধন করিয়া বন্ধুবর বলিলেন:—
“দেখুন আমরা আপনার সকল জুয়াচুরিই জানিতে পারিয়াছিা! ইচ্ছা ছিল আপনার গুপ্ত কথা চাপিয়া রাখিব। কিন্তু একটা প্রবাদ আছে, “ধর্ম্মের কল বাতাসে নড়ে”। আপনার কাণ্ড প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। আপনার একথা অস্বীকার করিবার জো নাই। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে আপনিই হাসানজীদের ভাঙ্চি দিয়া আমাদের অনিষ্ট করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। আপনি “প্রভাতী” সম্পাদকের সহিত মিলিয়া এক প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানী স্থাপন করিবার চেষ্টায় আছেন। তাহার হাতে-কলমের প্রমাণ আমাদের নিকট আছে। সে যাহা হউক আপনি যে জুয়চুরী করিয়াছেন তাহার জন্য আপনার শাস্তি হওয়া উচিত। আপনি ভদ্র সন্তান, আপনাকে জেলে পাঠান উচিত মনে করি না। আমরা আপনাকে একটা ultimatum দিতেছি। আপনি “প্রভাতী”-সম্পাদককে আপনার যে অংশ বিক্রয় করিয়াছেন, সেই কার্য্য আমাদের articles of association এর বিরুদ্ধে। আমি প্রস্তাব করি আপনি আমাদের কোম্পানীর ডাইরেক্টারের পদ ত্যাগ করুন এবং অদ্যই আপনার অংশ আমাদিগকে ন্যায্য মূল্যে বিক্রয় করুন; এবং একটা অঙ্গীকার পত্র লিখিয়া দিউন যে ভবিষ্যতে আমাদের মত কোম্পানী কেহ যদি স্থাপন করেন, আপনি তাহার সহিত কোনরূপ সংস্রব রাখিবেন না। যদি তাহার সহিত যোগ দেন, তবে এক লক্ষ টাকা খেসারতস্বরূপ দিতে বাধ্য থাকিবেন।”
স্থিরচিত্তে বল সকল কথা শুনিল এবং একটু পরে উত্তর দিল:—
“চিন্তা করিবার জন্য আমায় দুই একদিন অবকাশ দিতে হইবে।”
বন্ধুবর বলিলেন:—
“কখনই দিব না। অর্দ্ধঘণ্টা সময় দিতেছি। হয় এদিক না হয় ওদিক, এখানেই স্থির করিয়া ফেলিতে হইবে।”
একটী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বল জিজ্ঞাসা করিল:—
“আমি যদি আপনার সর্ত্তে রাজী হই, তাহা হইলে এই কোবালা ফেরত দিবেন ত?”
“হাঁ নিশ্চয়ই।”
“আমি স্বীকার করিলাম।”
বন্ধুবর তৎক্ষণাৎ আমাদিগের উকীলকে টেলিফোঁ করিলেন। অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি উপস্থিত হইলেন। সেইদিনই বিক্রয় কোবালা আমার নামে লেখা হইল। বল উহা সহি করিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন। পরদিন যথারীতি উহা রেজেষ্ট্রী হইয়া গেলে পর তাহার প্রাপ্য চুকাইয়া দিয়া তাহার জাল কোবালা খানি ফেরৎ দেওয়া গেল।