১৫১৩ সাল/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।

 আমাদিগের যে একটা বিপদ্ ঘটিবার সম্ভাবনা আছে, তাহা কাপ্তেন মহাশয় ব্যতীত আর কাহাকেও বলি নাই। কেননা, ভয় পাইয়া খালাসী প্রভৃতি অশিক্ষিত ব্যক্তিগণ একটা কাণ্ড বাধাইতে পারে।

 আমরা সর্ব্বদাই সতর্ক রহিলাম। আমাদিগের জিনিষপত্রাদি গোছাইয়া রাখিয়া ডার্কের লাইফ্ বেলট্ সর্ব্বদাই সঙ্গে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতে লাগিলাম।

 দুই দিন গেল, চারি দিন কাটিল। ক্রমে ক্রমে লঙ্কা প্রদক্ষিণ করিয়া আমাদিগের জাহাজ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করিল। ক্রমে ক্রমে মাদ্রাজও ছাড়াইলাম। তখন বোধ হইতে লাগিল, সম্ভবতঃ হরিশ ভুল সংবাদ দিয়াছে। যাহা হউক, তখনও সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করিলাম না। পরদিন প্রাতে পুরী ছাড়াইলাম। সেইদিন দ্বিপ্রহরের সময় যখন আমরা ডেকে বসিয়া পুস্তক পাঠ করিতেছি, সেই সময় কাপ্তেন মহাশয় নিকটে আসিয়া চুপে চুপে বলিলেন:—

 “বোধ হয়, এতদিন পরে যে বিপদের আশঙ্কা করিতেছিলাম, তাহা ঘটিতে চলিল।”

 আমরা বিশেষ ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম:—কেন? কি রকমে জানিলেন?”

 “আসুন দেখাইব।” এই বলিয়া তিনি তাঁহার কেবিনে আমাদিগকে লইয়া গেলেন এবং বলিলেন:—“এই যন্ত্রের নিড্‌লগুলির কম্পন্ন আরম্ভ হইয়াছে। আমার বোধ হয়, কেহ আমাদিগের জাহাজ্ লক্ষ্য করিয়া টরপেডো ছাড়িয়াছে। উহা অতি নিকটবর্ত্তী হইয়াছে। বোধ হয়, এক পোয়—না—দেখুন নিড্‌লগুলির কম্পন্ন বড় ঘন ঘন


“উহার তলদেশ বিদ্ধ হইয়া হু হু করিয়া জল উঠিতেছে।” (পৃঃ ৮১)

হইতেছে। আর নিস্তার নাই। এই সময় ভগবানকে স্মরণ করুন। আমার কোন দোষ নাই। আমি জ্ঞানতঃ কোন ত্রুটি করি নাই। বিদায়! বিদায়!! ওঃ! ওঃ!!” এইরূপ চীৎকার করিয়া উন্মাদের ন্যায় তিনি কেবিন হইতে বহির্গত হইলেন এবং নিমিষের মধ্যে সমুদ্রে ঝম্প প্রদান করিলেন।

 তাঁহার চীৎকার শুনিয়া কতকগুলি খালাসী দৌড়াইয়া আসিল। আমরা তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ লাইফ্‌বেল্ট পরিতে বলিয়া বিপদবার্ত্তাজ্ঞাপক ঘণ্টা বাজাইতে লাগিলাম। উহা শুনিবামাত্র, যে যেখানে ছিল ছুটিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইল। আমরা তাহাদিগকেও ঐরূপ আদেশ দিয়া লাইফ্‌বেল্ট পরিয়া ডেকের উপর স্থিরচিত্তে দণ্ডায়মান হইয়া শেষ মুহূর্ত্তের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

 সহসা কি এক বস্তু আমাদিগের জাহাজকে আঘাত করিল। তাহাতেই উহার একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত কাঁপিয়া উঠিল। পর মুহূর্ত্তে একজন খালাসী চীৎকার করিয়া বলিল যে, উহার তলদেশ বিদ্ধ হইয়া হু হু করিয়া জল উঠিতেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমাদের সাধের “সোনার ভারত” অতল জলে নিমজ্জিত হইল।

 আমি একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম। আমার নিকটে আট দশ জন লোক ভাসিতেছে, তাহাদিগের মধ্যে বন্ধুবর একজন। বুঝিলাম আর সকলে “সোনার ভারতে”র সহিত ডুবিয়াছে। তখন এক দীর্ঘ নিশ্বাস আপনা আপনি বহির্গত হইল। অজ্ঞাতসারে কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল গণ্ডস্থল বহিয়া পড়িল। “হায় ভগবান্, এই কি তোমার মনে ছিল?” এই কথা মনের আবেগে চীৎকার করিয়া বলিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলাম।

 তাঁহার কৃপায় আমাদিগকে অধিকক্ষণ জলে ভাসিতে হইল না। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে দেখি একখানি বৃহৎ পোত আমাদিগের দিকেই আসিতেছে। আমরা সমস্বরে একটা বিকট্ রব করিয়া উঠিলাম। তাহা পোতস্থ সকলেই শুনিতে পাইল এবং অনতিবিলম্বে এক জালিবোট পাঠাইয়া দিয়া আমাদিগকে উদ্ধার করিল।

 সেই পোতের কাপ্তেনের ও যাত্রীগণের প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলিলাম যে, আমরা জলভ্রমণে বাহির হইয়াছিলাম; কিন্তু সহসা আমাদিগের জাহাজে এক বৃহৎ ছিদ্র হওয়ায় উহা ডুবিয়া গিয়াছে। নানা কারণে সত্য গোপন করা উচিত বিবেচনা করিয়া, এইরূপ একটা সম্ভবপর কথার অবতারণা করিলাম। সকলেই উহা বিশ্বাস করিল এবং আমাদিগের প্রতি তাঁহাদিগের সহানুভূতি জানাইল।

 যতক্ষণ পোতে ছিলাম, আমাদিগের যত্নের পরিসীমা ছিল না। যথাসময়ে জাহাজ কলিকাতায় পৌঁছিলে পর আমরা কাপ্তেন মহাশয়কে আমাদিগের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইয়া বিদায় গ্রহণ করিয়া স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম।