১৯০৫ সালে বাংলা/পূর্ব্বাভাষ
পূর্ব্বাভাষ
ইংরাজ যখন প্রথমে আমাদের এদেশে আসে, তখন নানা কারণে আমাদের জাতীয় জীবন দুর্ব্বলতার আধার হইয়াছিল। তখন আমাদের ধর্ম্ম একেবারেই নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছিল, এদিকে চির পুরাতন চিরশক্তির আকর সনাতন হিন্দু ধর্ম্ম কেবল মাত্র মৌখিক আবৃত্তি ও আড়ম্বরের মধ্যে আপনার শিবশক্তিকে হারাইয়া ফেলিয়াছিল ও অপর দিকে যে অপূর্ব প্রেমধর্ম্মের বলে মহা প্রভু সমস্ত বাঙ্গলা দেশকে জয় করিয়াছিলেন, সেই প্রেমধর্ম্মের অনন্ত মহিমা ও প্রাণ-সঞ্চারিণী শক্তি কেবল মাত্র তিলককাটা ও মালা ঠকঠকানিতেই নিঃশেষিত হইয়া যাইতেছিল। বাঙ্গলার হিন্দুর সমগ্র ধর্ম্মক্ষেত্র শক্তিহীন শাক্ত ও প্রেমশূন্য বৈষ্ণবের ধর্ম্মশূন্য কলহে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছিল, তখন নবদ্বীপের চিরকীর্ত্তিময় জ্ঞানগৌরব কেবল মাত্র ইতিহাসের কথা, অতীত কাহিনী, বাঙ্গালী জীবনের সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ ছিল না, এই রূপে কি ধর্ম্মে, কি জ্ঞানে বাঙ্গালার হিন্দু তখন সর্ব্ববিষয়ে প্রাণহীন হইয়া পড়িয়াছিল।
আলিবর্দ্দি খাঁর পর হইতেই বাংলার মুসলমানও ক্রমশঃ নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছিল এবং সেই সময় তাহাদের সকল জ্ঞানী ও সকল শক্তি বলহীনের বিলাসে ভাসিয়া গিয়াছিল। এমন সময় সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে ইংরাজ বণিক-বেশে আগমন করিল এবং অল্প দিনের মধ্যেই রাজত্ব স্থাপন করিয়া অসাধারণ শক্তির পরিচয় দিল। আমাদের জাতীয় দুর্ব্বলতা নিবন্ধন আমরা ইংরাজ রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ইংরাজ জাতিকে ও তাহাদের সভ্যতা ও তাহাদের বিলাসকে বরণ করিয়া লইলাম। দুর্ব্বলের যাহা হয়, তাহাই হইল। ইংরাজী সভ্যতার সেই প্রখর আলোক সংযতভাবে ধারণ করিতে পারিলাম না। অন্ধ হইয়া পড়িলাম। অন্ধকারাক্রান্ত দিগ্ভ্রান্ত পথিক যেমন বিস্ময়ে ও মোহবশতঃ আপনার পদ প্রান্তস্থিত সুপথকে অনায়াসে পরিত্যাগ করিয়া, নিজের শাস্ত্রকে অবজ্ঞা করিয়া, নিজের সাহিত্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করিয়া, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ইঙ্গিতে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করিয়া ইংরাজের সাহিত্য ইংরাজের ইতিহাস, ইংরাজের জ্ঞান ও বিজ্ঞানের দিকে নিতান্ত অসংযতভাবে ঝুঁকিয়া পড়িলাম। সেই ঝোঁক অনেকটা কমিয়া আসিয়াছে সত্য, কিন্তু এখনও একেবারে যায় নাই। রামমোহন যে দেশে “বিজ্ঞানের তুর্য্যধ্বনি” করিয়াছিলেন, আমরা তাহাই শুনিয়াছিলাম, বা মনে করিয়াছিলাম শুনিয়াছি, অন্ততঃপক্ষে বিজ্ঞানের বুলি আওড়াইতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু রামমোহন যে গভীর শাস্ত্রালোচনায় জীবনটাকে ঢালিয়া দিয়াছিলেন, তাহার দিকেত আমাদের চোখ পড়ে নাই। তিনি যে আমাদেব সভ্যতা ও সাধনার মধ্যে আমাদের উদ্ধারের পথ খুঁজিয়াছিলেন সে কথা ত আমরা একবারও মনে করি নাই। তারপর দিন গেল। আমাদের স্কুল, কলেজ, প্রতিষ্ঠিত হইল, আমাদের ঝোঁকটা আরও বাড়িয়া গেল, তারপর বঙ্কিম সর্ব্বপ্রথমে বাঙ্গালার মূর্ত্তি গড়িলেন, প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিলেন, বঙ্গজননীকে দর্শন করিলেন, সেই “সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং শস্যশ্যামলাং মাতরম্” তাহারই গান গাহিলেন, সবাইকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ দেখ, এই আমাদের মা, বরণ করিয়া ঘরে তোল।” কিন্তু আমরা তখন সে মূর্ত্তি দেখিলাম না; সে গান শুনিলাম না, তাই বঙ্কিম আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছিলেন, “আমি একা মা মা বলিয়া রোদন করিতেছি।” তার পর শশধর তর্কচূড়ামণির হিন্দু ধর্ম্মের পুনরুখানের আন্দোলন। এই আন্দোলন সম্বন্ধে আমাদের দেশে অনেক মত ভেদ আছে। কেহ বলেন, উহা আমাদের দেশে অনেক অনিষ্ট করিয়াছিল, আবার কেহ কেহ বলেন অমিাদের অশেষ উপকার সাধন করিয়াছিল। সে সব কথা লইয়া আলোচনা করা আমি আবশ্যক মনে করি না। এই আন্দোলন যে অনেক দিকে একেবারেই অল্প ছিল, তাহা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি যেন সেই আন্দোলনের মধ্যেই বাঙ্গালী জাতির, অন্ততঃ পক্ষে শিক্ষিত বাঙ্গালীর আত্মস্থ হইবার একটা প্রয়াস—একটা উদ্যম দেখিতে পাই। সেইটুকুই আমাদের লাভ। তারপর আরও দিন গেল, ১৯০৩ খৃঃ হইতে স্বদেশী আন্দোলনের বাজনা বাজিতে লাগিল, বাঙ্গালী আপনাকে চিনিতে ও বুঝিতে আরম্ভ করিল। রবীন্দ্র নাথ গাহিলেন—
“বাংলার মাটী বাংলার জল
সত্য কর সত্য কর হে ভগবান্”
বাঙ্গালার জল বাঙ্গলার মাটী আপনাকে সার্থক করিতে লাগিল। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেক জ্ঞানীগুণী মহাপণ্ডিত আছেন, যাহারা নাকি বলেন যে, এই স্বদেশী আন্দোলন ইহা একটা বৃহৎ ভ্রান্তির ব্যাপার। আমরা নাকি সব দিকে ঠিক হিসাব করিয়া চলিতে পারি নাই। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে আমাদের দেশে একটা প্রাণহীন জ্ঞানের আবির্ভাব হইয়াছে। এই মুখস্ত করা জ্ঞানের ক্ষমতা অল্পই; কিন্তু অহঙ্কার অনেক খানি। এই জ্ঞানে যাঁরা জ্ঞানী, তাঁহারা সব জিনিষ সের দাঁড়ি লইয়া মাপিতে বসেন। তারা অঙ্ক শাস্ত্রের শাস্ত্রী, সব জিনিষ লইয়া আঁক কষিতে বসেন। কিন্তু, প্রাণের যে বন্যা, সে ত অঙ্ক শাস্ত্র মানে না, সে যে সকল মাপ কাঠি ভাসাইয়া লইয়া যায়। স্বদেশী আন্দোলন একটা ঝড়ের মত বহিয়া গিয়াছিল, একটা প্রবল বন্যায় আমাদের ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল। প্রাণ যখন জাগে তখন ত হিসাব করিয়া জাগে না। মানুষ যখন জন্মায়, সেত হিসাব করিয়া জন্মায় না, না জন্মাইয়া পারে না বলিয়াই সে জন্মায়। আর না জাগিয়া থাকিতে পারে না বলিয়াই প্রাণ একদিন অকস্মাৎ জাগিয়া উঠে। এই যে মহাবন্যার কথা বলিলাম, তাহাতে আমরা ভাসিয়া—ডুবিয়া বাঁচিয়াছি। বাঙ্গলার যে জীবন্ত প্রাণ, তাহার সাক্ষাৎ পাইয়াছি। বাঙ্গলার প্রাণে প্রাণে আবহমান যে সভ্যতা ও সাধনার স্রোত, তাহাতে অবগাহন করিয়াছি। বাঙ্গলার যে ইতিহাসের ধারা, তাহাকে কতকটা বুঝিতে পারিয়াছি। বৌদ্ধের বুদ্ধ, শৈবের শিব, শাক্তের শক্তি, বৈষ্ণবের ভক্তি, সবই যেন চক্ষের সম্মুখে প্রতিভাত হইল। চণ্ডিদাস বিদ্যাপতির গান মনে পড়িল। মহাপ্রভুর জীবন-গৌরব আমাদের প্রাণের গৌরব বাড়াইয়া দিল। জ্ঞান দাসের গান, গোবিন্দ দাসের গান, লোচন দাসের গান সবই যেন এক সঙ্গে সাড়া দিয়া উঠিল। কবিওয়ালাদের গানের ধ্বনি প্রাণের মধ্যে বাজিতে লাগিল। রামপ্রসাদের সাধন সঙ্গীতে আমরা মজিলাম। বুঝিলাম, কেন ইংরাজ এদেশে আসিল, রামমোহনের তপস্যার নিগূঢ় মর্ম্ম কি? বঙ্কিমের যে ধ্যানের মূর্ত্তি সেই—
“তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম্ম
তুমি হৃদি তুমি মর্ম্ম,
ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে,
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা—ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে”—
সেই মাকে দেখিলাম, বঙ্কিমের গান আমাদের “কানের ভতর দিয়া মরমে পশিল,” বুঝিলাম, রামকৃষ্ণের সাধনা কি— সিদ্ধ কোথায়! বুঝিলাম কেশব চন্দ্র কেন কাহার ডাক শুনিয়া ধর্ম্মের তর্ক রাজ্য ছাড়িয়া মর্ম্মরাজ্যে প্রবেশ করিয়া ছিলেন। বিবেকানন্দের বাণীতে প্রাণ ভরিয়া উঠিল। বুঝিলাম, বাঙ্গালী হিন্দু হউক, মুসলমান হউক খৃষ্টান হউক, বাঙ্গালী বাঙ্গালী।
বাঙ্গালীর একটা বিশিষ্টরূপ আছে, একটা বিশিষ্ট প্রকৃতি আছে, একটা স্বতন্ত্র ধর্ম্ম আছে। এই জগতের মাঝে বাঙ্গালীর একটা স্থান আছে, অধিকার আছে, সাধনা আছে কর্ত্তব্য আছে। বুঝিলাম, বাঙ্গালীকে প্রকৃত বাঙ্গালী হইতে হইবে। বিশ্ববিধাতার যে অনন্ত বিচিত্র সৃষ্টি, বাঙ্গালী সেই সৃষ্টিস্রোতের মধ্যে এক বিশিষ্ট সৃষ্টি। অনন্তরূপ লীলাধারের রূপ বৈচিত্র্যে বাঙ্গালী একটী বিশিষ্টরূপ হইয়া ফুটিয়াছে। আমার বাঙ্গালা সেইরূপের মূর্ত্তি আমার বাঙ্গালা সেই বিশিষ্টরূপের প্রাণ, যখন জাগিলাম, মা আমার আপন গৌরবে—তাঁহার বিশ্বরূপ দেখাইয়া দিলেন, সে রূপে প্রাণ ডুবিয়া গেল, দেখিলাম, সে রূপ বিশিষ্ট, সে অনন্ত! তোমরা হিসাব করিতে হয় কর, তর্ক করিতে চাও কর—সেরূপের বালাই লইয়া মরি।
(বাংলার কথা হইতে উদ্ধৃত) “দেশবন্ধু।”
তারপর স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল ঢেউ বাংলার হৃদয়-কূলে আঘাতে করিল। দেশবন্ধু বাংলাকে যতটা ভালোবাসিয়াছিলেন ঠিক ততটা আবেগ এবং উন্মাদনা লইয়া বাংলার দুর্গম-পন্থী যুবকগণ এই আন্দোলনের স্রোতে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। শাসকের অমোঘ বজ্র তাহাদের উপর নিক্ষিপ্ত হইল। কিন্তু প্রলয়ের ইঙ্গিত পাইয়া সমুদ্রের ঢেউ যেমন চঞ্চল হইয়া ওঠে রাজশক্তির এই প্রতিকূলতায় স্বদেশী আন্দোলনের স্রোতে জোয়ার আসিয়া গেল।
প্রলয়ের সেই সংশয় জটিল মুহুর্ত্তে যাহারা লাভ-লোকসানের হিসাব না খতাইয়া ভরা জোয়ারে গা ভাসাইয়াছিলেন, এবং রাজরোষে পড়িয়া লাঞ্ছিত হইয়াছিলেন, তাঁহাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিতে যাইয়া আমাদের কম বেগ পাইতে হয় নাই। তাহারই অনতিরঞ্জিত ইতিহাস এই ক্ষুদ্র গ্রন্থে সন্নিবেশিত হইল।