১৯০৫ সালে বাংলা/সৎকার্য্যে বাধাদানের চেষ্টা
স্বদেশী আন্দোলন উপলক্ষে নিগৃহীত মহোদয়গণের প্রভি যৎসামান্য সম্মান প্রকাশে উদ্যত হইয়া আমাদিগকে সামান্য বিড়ম্বিত হইতে হয় নাই। আমাদিগের স্বদেশবাসী এক শ্রেণীর লোকের কাপুরুষতা, খলতা ও নীচাশয়তাই এস্থলে বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। যাহারা স্বদেশী আন্দোলনে সহায়তা করিতে গিয়া জন্মভূমির সেবায় আগ্রহাধিক্য প্রকাশ পুরঃসর রাজপুরুষ দিগের বিরাগ-ভাজন হইয়াছেন, ইংরাজের ধর্ম্মাধিকরণে অভিযুক্ত হইয়া দণ্ডিত হইয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রতি সম্মান প্রকাশের চেষ্টাতে বিবিধ ব্যক্তি অশেষ প্রকারে বাধা দানের প্রয়াস পাইয়াছিল। যাঁহারা স্বদেশের হিতসাধন করিতে গিয়া, রাজপুরুষদিগের হস্তে নিগৃহীত হইয়াছেন, এবং প্রফুল্লবদনে সেই সকল নিগ্রহ সহ্য করিয়া আবার স্বদেশ-সেবায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন, সেই সকল মহাপ্রাণ ব্যক্তির প্রতি যে প্রকাশ্যভাবে কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রকাশ করা আমাদের প্রধান কর্ত্তব্য, একথা কে না স্বীকার করিবেন? সকল দেশেই এইরূপ বীরপূজা হইয়া থাকে। যাঁহারা দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করেন, তাঁহাদিগের নাম সকল দেশে প্রাতঃস্মরণীয় হইয়া থাকে। যে জাতি বীরপূজা করিতে জানে না, বা আত্মোৎসর্গকারীর মহত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিয়া তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অগ্রসর হয় না, সে জাতির উন্নতির সম্ভাবনা অতি অল্প, একথা বলাই বাহুল্য।
দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের একদল মহাত্মা এই সদনুষ্ঠানে বাধা দানে সাধ্যমত ত্রুটী করেন নাই। ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ দেশবাসীর নিকট পণ্ডিত ও সম্ভ্রান্ত বলিয়া পরিচিত; কাহারও কাহারও স্বদেশভক্ত বলিয়া পরিচয় দানের আগ্রহও অল্প নহে। তথাপি ভীরুতা বশেই হউক, অথবা স্বভাব-দোষেই হউক, তাঁহারা রাজপুরুষদিগের হস্তে লাঞ্ছিত দেশের লোকের প্রতি প্রকাশ্যভাবে সম্মান প্রকাশে প্রতিবাদ করিয়াছেন। তাহার পর যাহাতে কলিকাতা টাউনহলে এরূপ সভার অধিবেশন না হয়, দেশের নেতৃবৃন্দ যাহাতে এই কার্য্যে যোগ না দেন, সেজন্যও গুণধরেরা চেষ্টার ত্রুটী করেন নাই। এই সকল ব্যক্তির চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইয়াছিল সত্য, তথাপি ইহাদের নীচতামূলক ব্যবহার কোন মতেই উপেক্ষণীয় নহে। নানা শ্রেণীর লোক ভিন্ন ভিন্ন কারণে এবিষয়ে আপত্তি করিয়াছিল। আমরাও কাহারও নামোল্লেখ না করিয়া অতি সংক্ষেপে কারণ গুলির উল্লেখ ও আলোচনা করিতেছি।
প্রথম আপত্তি, লাঞ্ছিত ব্যক্তিরা সম্মান প্রাপ্তির যোগ্য কোন কার্য্য করেন নাই। অন্যান্য দেশে যাহা্রা বড় বড় কার্য্য করেন তাঁহাদিগেরই সম্মান লাভ ঘটে। আমরা কেন তিলকে তাল করিয়া তুলিব? তাহাতে কি লাভ হইবে?
ইহার উত্তরে আমরা এই মাত্র বলিব, প্রাণের যে উচ্চতা, সৎসাহস ও মহানুভবতা সর্ব্বত্র সমাদৃত হয় আমাদিগের লাঞ্ছিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সেই সকল গুণের অসদ্ভাব ছিল না, যাঁহারা সম্মানিত হইতেছেন, আমরা তাঁহাদিগকে এই মাত্র জানাইতেছি যে, তাঁহারা রাজদ্বারে নিগ্রহ ভোগ করিলেও দেশের লোক তাঁহাদিগের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে; আমরা তাঁহাদিগকে সম্মানিত করিয়া নিজের সম্মানই বাড়াইতেছি, তাঁহাদিগের ইহাতে ব্যক্তিগত লাভ নাই, আমাদিগেরই জাতিগত লাভ। রাজপুরুষেরা এই কার্য্যে জানিতে পারিবেন যে, তাঁহাদিগের অকারণ লাঞ্ছনায় মানের হ্রাস না হইয়া বৃদ্ধিই হইয়া থাকে। দুর্ব্বল চিত্ত ব্যক্তিরাও ঈদৃশ সম্মান প্রদর্শন দর্শনে উন্নতচেতা হইয়া থাকে।
দ্বিতীয় আপত্তি, রাজপুরুষেরা বিরক্ত হইবেন, তাঁহারা রীতিমত বিচার করিয়া যাহাদিগকে দোষী সাব্যস্ত করিলেন, প্রজা হইয়া আমরা তাহাদিগকে সম্মানিত করি কিরূপে? যাঁহারা বিরক্ত হন হউন আমরা কি করিব? মান্যবর বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বসুর পত্রে, ইহার একটি সদুত্তর দেওয়া হইয়াছে। ফলতঃ ইংরাজের দেবতা পাশ্চাত্য জগতের উপাস্য প্রভু ও যীশুখৃষ্টও প্রকাশ্য আদালতে রীতিমত বিচারে “দোষী সাব্যস্ত” হইয়া কঠোরতম প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন, ইহা বাইবেলের উক্তি।
তৃতীয় আপত্তি, যাহারা স্বদেশের কার্য্য করেন নাই, অকারণে রাজপুরুষদিগের ভ্রমে বা কাহারও চক্রান্তে লাঞ্ছিত, তাঁহাদিগকে সম্মানিত করা সম্মানের অপব্যবহার। এ উক্তি অত্যন্ত অসার। কারণ যাহারা লাঞ্ছিত তাঁহারা অধিকাংশস্থলে অভিযোগের বিষয়ীভূত ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকিলেও অন্যরূপে স্বদেশী আন্দোলনের জন্য কর্ত্তৃপক্ষের বিরাগভাজন। এ বিষয়ে অধুনা অধিক কিছু বলা যুক্তিসিদ্ধ বোধ করি না। এই পর্য্যন্ত বলিতে পারি, যদি কোন ব্যক্তি যোগ্যতা ব্যতিরেকে সম্মানিতই হন, তাহাতে যোগ্যের গৌরব লাঘব হয় না।
এই গেল স্বদেশবাসী কতিপয় ধুরন্ধরের বিরুদ্ধাচরণের কথা। ইহার পর শ্বেতাঙ্গ মহোদয়েরাও বিরুদ্ধাচরণে ক্ষান্ত হন নাই। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি (১৯০৬) সোমবার এই বিরাট সভার অধিবেশন করিবার কন্য যখন টাউনহলে স্থান-প্রার্থনা করিয়া সুরেন্দ্র বাবু মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান এলেন সাহেবকে পত্র লিখেন, তখন তিনি টাউনহলে এই সভার অধিবেশন বিষরে অনুমতি-দান করিয়াছিলেন। তদনুসারে সংবাদ পত্রাদিতে টাউনহলে সভা হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হয়। বলা বাহুল্য, যে উদ্দেশ্যে সভা হইবে, তাহা সুরেন্দ্র বাবুর পত্রে অতি স্পষ্টভাষায় খুলিয়া লেখা হইয়াছিল। এলেন সাহেব তখন উহাতে সম্মতি প্রকাশ করিয়া সভার অধিবেশনের অব্যবহিত পূর্ব্বে অর্থাৎ ১২ই ফেব্রুয়ারি সোমবারে মতের পরিবর্তন করিলেন; তিনি উক্ত সোমবারে সুরেন্দ্র বাবুকে যে পত্র পাঠাইয়াছিলেন, তাহা এস্থলে উদ্ধৃত হইল— MY DEAR SIR,
When you asked me for permission to hold a meeting at the Town Hall to express sympathy with the sufferers in the cause of Swadeshi, I did not clearly understand the object of your meeting. I now learn that you intend to express sympathy with persons who have been convicted for offences committed in connection with the boycott agitation. I certainly do not consider that the Town Hall is the proper place for a demonstration of this character and I regret that I must revoke my sanction to the use of the Town Hall for this purpose.
C ALLEN
অর্থাৎ এলেন সাহেব বলিয়াছেন যে, প্রথমবার সম্মতিদানের সময় তিনি, যে উদ্দেশ্যে সভা করা হইবে, তাহা ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। কিন্তু পরে বিশেষ বিবেচনা করিয়া তিনি বুঝিয়াছেন যে, বিলাতী বর্জ্জন ব্যাপারে যাহারা অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া আদালতে দণ্ডিত হইয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রতি সম্মান প্রকাশের জন্য টাউন হলে সভার অধিবেশন করা হইবে। এই নিমিত্ত টাউন হল কোনক্রমেই দেওয়া উচিত বলিয়া আমি মনে করি না। এই বলিয়া চেয়ারম্যান মহাশয় টাউন হলে সভার জন্য স্থানদান করিবার পূর্ব্ব প্রদত্ত অনুমতির প্রত্যাহার করিলেন।
টাউনহল পাওয়া যাইবেনা, অধিবেশনের দুই দিন পূর্ব্বে এই কথা শ্রবণগোচর হইল; সেই দুই দিনের মধ্যে আয়োজন করিয়া অন্যত্র সভা করিতে হইল, ইহা কীদৃশ শ্রম, ব্যয় ও কষ্টসাপেক্ষ তাহা ভুক্তভোগী ভিন্ন অন্যে বুঝিতে পারবেন না। কত হ্যাণ্ডবিল, প্লেকার্ড নষ্ট হইল, পুনশ্চ মুদ্রাঙ্কন হইল না, পরিশেষে একজন দয়ালু হিন্দুস্থানী মহাজনের অনুগ্রহে স্থান-লাভ ঘটিলেও কি কষ্টে সেই স্থান সুসজ্জিত করিতে হইয়াছিল, তাহা সকলে জানেন না। পূর্ব্বে এই বাটীতে থিয়েটার হইত, কয়েক মাস পূর্ব্বে তাহা বন্ধ হইয়া যাওয়ায় স্থানটি অব্যবহার্য্য হইয়া উঠিয়াছিল; গ্যাস কাটা, বৈদ্যুতিক আলোক বন্ধ, বসিবার আসন নাই, স্থানটি ধূলিরাশি সমাকীর্ণ, কত কষ্টে তাহা পরিস্কৃত করিতে হইয়াছিল তাহা অন্যে বুঝিবে না।
ইহার উপর পুলিশ কমিশনার মহাশয়ের ভয় হইয়াছিল ছাত্রেরা “লাঠী” প্রভৃতি ভয়ঙ্কর অস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া দাঙ্গা হাঙ্গামা করিবে! দাঙ্গা হাঙ্গামার উদ্বেগ-প্রকাশক পত্র পাঠ করিয়া আমরা হাস্যসংবরণ করিতে পারি নাই।
এ ত গেল এক পর্ব্ব। তাহার পর মিউনিসিপাল আফিসের কত্তৃপক্ষগণ টাউনহলে যে সভা হয় নাই, সেই সভার আলোক, পাহারা, ফরাস প্রভৃতির হিসাব দাখিল করিয়া আমাদিগের নিকট হইতে ৬৩ টাকা চাহিয়াছেন। তাহাদিগের মূলপত্র এইঃ– No. 1244.9 M.
MUNICIPAL OFFICE
Calcutta, the 14th February 1906,
Re: Engagement of the Town Hall for a Public Meeting on 14th February 1906. Dear Sir,
In continuation of my letter No, 11979 M, dated the 6th February 1906, I write to ask you to kindly remit Rs. 63 to meet the undernoted charges –
Provisional cost for gas... | RS. | 30 |
Lighting charges... | RS. | 5 |
Police Attendance... | RS. | 8 |
Total | Rs. | 63 only, |
The amount mentioned in item (1) will be adjusted in accordance with the actual consumption of gas and the balance if any refunded to you.
(Illegible)
ইহাতেও শেষ হয় নাই। টাউনহল হইতে চেয়ার ভাড়ার জন্য আরও ৪১ টাকার দাবীতে একজন ইনস্পেক্টর তাগাদা করেন তাহারও উত্তর দেওয় হইয়াছে।