১৯০৫ সালে বাংলা/ভূপেন্দ্র নাথ বসুর পত্র
অনারেবল বাবু ভূপেন্দ্র নাথ বসু সভায় উপস্থিত হইতে পারেন নাই বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়া একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন, বৃষ্টির প্রাবল্যে ও জনতার বাহুল্যে ঐ পত্র কিঞ্চিৎ বিলম্বে মঞ্চোপরি উপস্থাপিত হইয়াছিল। সুতরাং তাহা এই সময়ে পঠিত হইল। পত্রখানি এই—
“My dear Kabyabisarad, I am truly sorry that a too recent bereavement renders it impossible for me to attend to-day's meeting held in honour of the martyrs in the Swadeshi cause. I am in hearty sympathy with the object of the meeting. It is the height of supercilious sanctimoniousness to treat these gentlemen as convicted criminals: neither history nor ethics would justify such an attitude of mind towards men who have dared the terrors of the law for the sake of their convictions. Constitutional authority not unoften represents hidebound superstition or ignorance; and those great men who have hallowed the history of the world have suffered for what they believed and preached as the true principles of religious or national life. Jesus of Nazareth, whom the peoples of Europe profess to worship and adore, was a convict, sentenced by a constitutional authority; and the regenerator of the French nation, Joan of Arc, was burned at the stake by authority legally exercised. I might name Luther and Galileo, and coming to our own times and to lesser men, the Nonconformist ministers who have suffered imprisonment for disobedience of the Education Act. Our gratitude is due to our friends for proving to the world that the Bengalees of today can do more than talk— they can suffer for their country-and their truest reward will be not what we can offer them at this meeting, but their example always kept in sight and borne in mind. May He, who holds in the hollow of his palm the weak and the strong, and judges them equally, grant them years of strenuous work, to the glory of His name and the everlasting good of my unhappy country, is the earnest prayer of.
Bhupendra Nath Bose,
প্রিয় কাব্যবিশারদ-স্বদেশের কল্যাণ কামনায় যাঁহারা লাঞ্ছিত হইয়াছেন, তাঁহাদের প্রতি সম্মান প্রকাশের সভায়, অধুনাতন একটা পারিবারিক দুর্ঘটনার জন্য উপস্থিত হইতে পারিলাম না বলিয়া বড়ই দুঃখিত হইয়াছি। অদ্যকার সভার কার্য্যে আমার আস্তরিক সহানুভূতি আছে। এই সকল লাঞ্ছিত মহাত্মাগণকে রাজদণ্ডে দণ্ডিত জ্ঞানে ঘৃণা করা বড়ই নীচতার পরিচায়ক। দেশের মঙ্গলের জন্য যাঁহারা রাজদণ্ড দেখিয়াও বিচলিত হন নাই, তাঁহাদিগকে ঘৃণা করা ঐতিহাসিক অথবা দার্শনিক কাহারও দৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত নহে। রাজপুরুষগণ অনেক সময়ে ভ্রমে পতিত হইয়া প্রকৃত মহাত্মাদিগকে লাঞ্ছিত করেন সত্য, কিন্তু মহাত্মারা কখনও রাজপুরুষগণের ভ্রুকুটী ভঙ্গীতে বিচলিত হন না। যে যিশুখৃষ্টকে আজ সমগ্র ইউরোপ পূজা করিতেছেন বলিয়া প্রকাশ, সেই খৃষ্টও বিধিসঙ্গত বিচারালয়ে রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন; ফ্রান্সের উদ্ধারকর্ত্রী জোয়ান অফ আর্ককে রাজপুরুষগণ রাজ বিধানের দোহাই দিয়া দগ্ধ করিয়াছিল; মার্টিন লুথার, গ্যালিলিও এবং আমাদের সমকালে বহু সংখ্যক নন্কনফাৰ্মিষ্ট মন্ত্রী কারাদণ্ড ভোগ করিয়াছেন। যে সকল মহাত্মা সমগ্র পৃথিবীর নিকট সপ্রমাণ করিয়াছেন যে, বাঙ্গালী কেবল বাক্যবীর নহেন, কর্ম্মবীর, তাঁহারাও দেশের কল্যাণের জন্য সকল প্রকার উৎপীড়ন সহ্য করিতে পারেন, সেই সকল মহাত্মা বাস্তবিকই আমদের আস্তরিক ধন্যবাদের পাত্র। অদ্যকার সভাতে আমরা যাহা উপহার জিতেছি, তাহাই তাঁহাদের চরম পুরস্কার নহে; দেশের সকলেই যে তাঁহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে চেষ্টা করিবে, ইহাই তাঁহাদের প্রকৃত পুরস্কার। যিনি দুর্ব্বল ও বলবান্কে সমদৃষ্টিতে দেখিয়া সমান বিচার করেন, সেই সর্বনিয়ন্তা ভগবান্ এই সকল মহাত্মাদিগকে দেশের মুখ উজ্জল করিবার জন্য—চিরদুঃখিনী বঙ্গভূমির দুঃখ মোচন করিবার জন্য, সুদীর্ঘ আয়ুঃ প্রদান করুন, ইহাই আমার প্রার্থনা।
অনন্তর “দণ্ড দিকে চণ্ডমুণ্ডে এস চণ্ডি যুগান্তরে, পাষণ্ড প্রচণ্ড বলে অঙ্গ খণ্ড খণ্ড করে,” এই আগমনী সঙ্গীত গীত হইল। তৎপরে বানারীপড়ার (বরিশাল) শ্রীযুক্ত প্যারীমোহন গুহ ঠাকুরত। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া একটী অনতিদীর্ঘ বক্তৃতা করেন। এই অশীতপর বৃদ্ধের প্রত্যেক কথায় লোকের হৃদয় বিচলিত হইয়াছিল। কলিকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট, জানকীনাথ দত্ত নামক যে বালকটিকে বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত করিয়াছিলেন, সেই বালকের পিতা বাবু বসন্তকুমার দত্ত, পুত্রের মুখপাত্র স্বরূপ সভার অনুষ্ঠাতৃবর্গের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অনন্তর হবিবপুরের লাঞ্ছিত ব্যক্তিদিগের অন্যতম বাবু বিপিনচন্দ্র গুহ সভার কর্ত্তৃপক্ষের ধন্যবাদ করিয়া সভাপতির হস্তে নয় আনা পয়সা দিয়া বলিলেন যে, তিনি এবং তাঁহার সহযোগীরা যখন কারামুক্ত হয়েন, তখন কারাধ্যক্ষ তাহাদের পাথেয় স্বরূপ এই নয় আনা পয়সা প্রদান করিয়াছিলেন। এই পয়সা ন্যাশন্যাল ডিফেন্সফাণ্ডে প্রেরণ করিবার জন্য বিপিন বাবু সভাপতিকে অনুরোধ করিলেন।
তবে কাব্যবিশারদ মহাশয়ের বিষয়ে আমি আরও কয়েকটা কথা না বলিয়া থাকিতে পারি না। তাঁহার মত ব্যক্তি এরূপ শ্রম স্বীকার ও অকাতরে অর্থব্যয় না করিলে অদ্যকার এই অলৌকিক দৃশ্য নয়নগােচর হইত না। এ প্রস্তাব তাঁহার, এ উদযােগ তাঁহার, ব্যয় ভারও তাঁহার; তিনি বিঘ্নে নিরস্ত হন নাই, সুতরাং এ উদ্যোগ যে কার্যে পরিণত হইয়াছে সেজন্য তিনি স্বদেশবাসীর অজস্র ধন্যবাদের পাত্র। অধিক কি বলিব, তাঁহার গুণগ্রাহিতায় আমরা মুগ্ধ হইয়াছি।
জ্ঞানচন্দ্র বাবুর বক্তৃতা শেষ হইলে মৌলবী লিয়াকৎ হােসেন বলিলেন যে, ১৬ই ফেব্রুয়ারী শুক্রবার অপরাহ্ণে কলিকাতার মুসলমানগণ লাঞ্ছিত ব্যক্তিদিগের প্রতি সম্মান প্রকাশ করিবার জন্য এলবার্ট হলে একটী সভা করিবেন। অনন্তর ডাক্তার গফুর ওজস্বিনী ভাষায় একটা অনতিদীর্ঘ বক্তৃতা করিলে সভাপতির ধন্যবাদ পূর্ব্বক সভা ভঙ্গ করা হইল। সভাভঙ্গের পূর্বে স্বদেশ-সেবক সম্প্রদায় আর একটা জাতীয় সঙ্গীত গান করিয়াছিলেন।