১৯০৫ সালে বাংলা/সমিতির অন্যান্য কার্য্যবিবরণ
সমিতির অন্যান্য কার্য্যবিবরণ।
সভাপতি-নির্ব্বাচন।
বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বসু সভাপতি নির্ব্বাচনের প্রস্তাব উপস্থিত করিয়া যে তেজোগর্ভ বক্তৃতা করেন, তাহা শ্রবণ করিয়া সকলেই বিষম উত্তেজিত হইয়াছিলেন। তিনি বলেন, একদিন সকলেই এদেশে ইংরাজরাজত্ব দীর্ঘকাল স্থায়ী হইবে বলিয়া মনে করিত। কিন্তু অদ্যকার ব্যাপার দেখিয়া অন্যরূপ মনে হইতেছে। নিরীহ, শান্তিপ্রিয় ভদ্রজনসমাজের প্রতি এরূপ ঘোর অবৈধ অত্যাচার কখনই রাজ্যের পক্ষে কল্যাণকর নহে। তাঁহার অগ্নি-গর্ভ বক্তৃতার শেষ হইলে ছয় সহস্র কণ্ঠে ভীষণ রবে “বন্দেমাতরম্” ধ্বনি হইল। বাবু মতিলাল ঘোষ এই প্রস্তাব অনুমোদন ও বাবু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি সমর্থন করিলে সর্ব্বসম্মতিক্রমে উহা পরিগৃহীত হয়। তখন মিঃ রসুল সভাপতির আসনে গিয়া উপবেশন করিলেন। সভাপতি মহাশয়ের অসুস্থতা নিবন্ধন তাঁহার বক্তৃতার একাংশ শ্রীযুক্ত হালিম গজনভি মহোদয় পাঠ করিয়াছিলেন।
প্রথম প্রস্তাব।
সভাপতির বক্তৃতার পর বাবু মতিলাল ঘোষ প্রথম প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। সে প্রস্তাবের মর্ম্ম এই:–যে হেতু আজ দিবালোকে, সমস্ত সহরের লোকের সম্মুখে ডিষ্ট্রীক্ট ও আসিষ্টাণ্ট সুপারিণ্ডেণ্টের আদেশে পুলিশ সভাপতি মিঃ রসুলের অভ্যর্থনার জন্য সমবেত প্রতিনিধিদের উপর অবৈধভাবে লাঠি চালাইয়াছে এবং দেশবাসীর নেতা বাবু সুরেন্দ্রনাথকে বিনা কারণে এরূপভাবে কয়েদ করিয়াছে, তাহাতে প্রতিপন্ন হয় যে, বরিশালে আইনসঙ্গত শাসনপ্রণালী বিলুপ্ত হইয়াছে।
যেহেতু পূর্ব্ববাঙ্গালা ও আসামের নানা স্থানের লোক স্বদেশসেবা করার অপরাধে প্রহৃত ও নানারূপে নিগৃহীত হইয়াছে, তজ্জন্য এই সমিতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, এই প্রদেশে আর বৈধ শাসনপ্রণালী প্রচলিত নাই; সুতরাং নিজের শক্তির যে সকল কার্য্য নির্ভর করে, বর্ত্তমান বর্ষের সমিতি কেবল সেই সকল প্রস্তাবের আলোচনা করিবেন। বর্ত্তমান দায়িত্বশূন্য গবর্ণমেণ্টের উপর যে সকল কার্য্যের মীমাংসার ভার আছে, বর্ত্তমান বর্ষের সমিতি তাহার আলোচনা হইতে ক্ষান্ত থাকিবেন। এই প্রস্তাব সর্ব্বসম্মতিক্রমে পরিগৃহীত হইলে সেদিনকার মত সভা ভঙ্গ হয়।
দ্বিতীয় দিবস।
অদ্য সহরে গুজবে অন্ত নাই। কেহ বলিল, আজ প্রতিনিধিগণ রাস্তায় শ্রেণীবদ্ধ হইয়া বাহির হইলেই পুলিশ গুলি চালাইবে। কেহ বলিল, রাস্তায় যে বন্দে মাতরম্ বলিবে, তাহাকেই পুলিশ গুলি করিবে বলিতেছে। এমন কি গুজব রটিল যে, ফুলার সাহেব বরিশালে আসিয়াছেন। তাঁহার ব্রহ্মকুণ্ড নামক ষ্টীমারে দেখা করিবার জন্য ম্যাজিষ্ট্রেট ইমার্সন সাহেব গমন করিয়াছেন। বলা বাহুল্য, সেইদিন ফুলার সাহেবের ষ্টীমার বরিশালের ঘাটে আসিয়া লাগিয়াছিল, তবে ফুলার সাহেব সে ষ্টীমারে ছিলেন কি না তাহা ঠিক জানা যায় নাই।
এই সকল জনরবে প্রতিনিধিগণ ভীত হন নাই। যথারীতি পূর্ব্বাহ্ন ১১টার সময় সভার অধিবেশন হইল। দলে দলে প্রতিনিধিগণ রাজপথ দিয়া উচ্চ কণ্ঠে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি করিতে করিতে সমিতির মণ্ডপে উপনীত হইতে লাগিলেন। পূর্ব্ব দিনের অপেক্ষা অদ্য মণ্ডপে অধিক সংখ্যক লোকের সমাগম হইয়াছিল। পূর্ব্ব দিবসে দুই শত রমণী সভায় যোগদান করিয়াছিলেন, অদ্য উপস্থিত রমণীর সংখ্যা প্রায় পঞ্চশত হইয়াছিল। সভাস্থল স্থির নিশ্চল বিশাল জন-সমুদ্রের আকার ধারণ করিল। প্রথমে বন্দে মাতরম্ সঙ্গীত গীত হয়। সভায় উপস্থিত সমগ্র জনমণ্ডলী সসম্মানে দণ্ডায়মান হইয়া জন্মভূমির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিলেন। তৎপরে ভবানীপুরের স্বদেশ-সেবক সম্প্রদায় ও এণ্টিসারকুলার সোসাইটীর যুবকগণ মঞ্চোপরি দণ্ডায়মান হইয়া “মাগো যায় যেন জীবন চলে, শুধু জগৎ মাঝে তোমার কাজে বন্দে মাতরম্ বলে” এই গানটী প্রাণ খুলিয়া গাইলেন।