১৯০৫ সালে বাংলা/সুরেন্দ্রনাথের সভাপ্রবেশ

সুরেন্দ্রনাথের সভাপ্রবেশ।

 সভাস্থলে সুরেন্দ্রনাথ প্রত্যাগত হইলে তথায় যে ভাবের প্রবাহ উচ্ছ্বসিত হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করা মানব ভাষার অসাধ্য। দিগ্দিগন্ত জয়ধ্বনিতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল; সকলে সমস্বরে “সুরেন্দ্রনাথের জয়” “বন্দে মাতরম্” প্রভৃতি উচ্চারণ করিতে লাগিল ভাবাবেশে গদ্গদ কণ্ঠে সকলের হৃদয় দ্রব করিয়া সুরেন্দ্রবাবু সভাপতি নির্ব্বাচন প্রস্তাবের যে প্রকারে অনুমোদন করিলেন, তাহা বর্ণনা করা অপেক্ষা অনুভব করা অল্পায়াসসাধ্য।

হৃদয়-বিদারক দৃশ্য।

 পূর্ব্বকথিত আহত যুবক বাবু ব্রজেন্দ্রলাল গাঙ্গূলীর ক্ষতস্থান চিকিৎসকেরা যে ভাবে বাঁধিয়া দিয়াছিলেন, তাঁহাকে সেই ভাবে টেবেলের উপর দাঁড় করাইয়া জ্বরগ্রস্ত, আহত চিত্তরঞ্জনের পিতা বাবু মনোরঞ্জন গুহ ঠাকুরতা মধ্যে দণ্ডায়মান হইলেন। মনোরঞ্জন বাবু বলিলেন, “বাল্যকালে মেঘনাদ বধ কাব্য পাঠ করিতে করিতে আমার দুইটি ছত্র বড় ভাল লাগিয়াছিল। পুত্ত্রশোকাতুর রাবণ বীরবাহুর মৃত দেহ ধুলায় লুণ্ঠিত দেখিয়। বলিয়াছিলেন:—

“যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ কুমার
প্রিয়তম, বীরকুলসাদ এ শয়নে
সদা! রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে ভীরু সে মূঢ়; শতধিক্ তারে।”

 আজি আমার পুত্ত্রকে পুলিশ হস্তে নিগৃহীত দেখিয়া ও ধূলাবলুণ্ঠিত এই সকল বালককে দেখিয়া আমার মুখ দিয়া যেন বাহির হইতেছে—

যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ কুমার
প্রিয়তম, বীরকুল সাদ এ শয়নে
সদা!

 এইরূপ ওজসীনী ভাষায় লোকের মর্ম্মম্পর্শ করিয়া মনোরঞ্জন বাবু যখন বলিতে লাগিলেন, তখন সভাস্থ আবাল বৃদ্ধ বণিতার কেহই বোধ হয় অশ্রুসংবরণ করিতে পারেন নাই। পুত্র জীবিত থাকিবে কি না, সেই শঙ্কা, এই উদ্বেগ, পিতার প্রাণে কি দারুণ আঘাত করিতেছিল, তাহা অন্তর্য্যামিই জানেন। কিন্তু অন্তরের ভাষা বেশ সংযত করিয়া মনোরঞ্জন বাবু যে বীরত্বের দৃষ্টান্ত দেখাইলেন, তাহা কি এই হতভাগ্য বঙ্গদেশে বিফল ইইবে?