আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/আশ্চর্য্য দস্যুদমন
আশ্চর্য্য দস্যুদমন
রাইন্ নদীর তীরে যুদফ্ নামে এক গ্রাম আছে। ঐ গ্রামস্থ এক গৃহস্থ, রবিবার প্রাতঃকালে সন্নিহিত গ্রামান্তরের দেবালয়ে, সপরিবারে উপাসনা করিতে গেলেন। একটি শিশুসন্তান ও একমাত্র তরুণী পরিচারিকা বাটীতে রহিল। এই পরিচারিকার নাম হাঁচেন্। সে গৃহস্থের আহার প্রস্তুত করিতেছে, এমন সময়ে বটেলর্ নামক এক যুবক তথায় উপস্থিত হইল। হাঁচেনের সহিত এই ব্যক্তির বিবাহের কথা উত্থাপিত হইয়াছিল, এজন্য সে মধ্যে মধ্যে আসিয়া, তাহার সহিত সাক্ষাৎ ও কথোপকথন করিত। ক্রমে ক্রমে ঐ ব্যক্তির উপর হাঁচেনের অনুরাগসঞ্চার হয়। সে তাহাকে সুবোধ ও সচ্চরিত্র ব্যক্তি বলিয়া বোধ করিত। কিন্তু বটেলব, বাস্তবিক সেরূপ লোক নহেন। হাঁচেন ব্যতিরিক্ত ব্যক্তিমাত্রেই তাহাকে অলস, অকর্ম্মণ্য ও দুশ্চরিত্র বলিয়া জানিত। গৃহস্বামী তাহাকে বিলক্ষণ চিনিতেন, এজন্য তাহাকে তাঁহার বাটীতে আসিতে নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। তদনুসারে, সে আর তাঁহার বাটীতে প্রবেশ বা হাঁচেনের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিত না। হাঁচেন সেজন্য অতিশয় দুঃখিত ছিল। রবিবার প্রাতঃকালে গৃহস্বামীর অনুপস্থিতিরূপ সুযোগ দেখিয়া, সে নির্ভয়ে ঐ বাটীতে আসিযাছিল।
হাঁচেন, তাহাকে সমাগত দেখিয়া, আহ্লাদে পুলকিত হইল, সাদর সম্ভাষণ পুরঃসর তাহাকে বসাইয়া, উত্তম ভক্ষ্য দ্রব্য আনিয়া আহার করিতে দিল, এবং তাহার নিকটে বসিয়া, প্রফুল্লচিত্তে কথোপকথন করিতে লাগিল। আহার করিতে করিতে, বটেলরের হস্ত হইতে ছুরীখানি ভূমিতে পডিয়া গেল, অথবা সে ইচ্ছা করিয়া ফেলিয়া দিল, এবং হাঁচেনকে ঐ ছুরী তুলিয়া দিতে বলিল। হাঁচেন্ হাস্যমুখে পরিহাস করিয়া বলিল, সকলে বলে, তুমি অত্যন্ত অলস ও অকর্মণ্য লোক, এ কথা নিতান্ত অলীক বোধ হইতেছে না, নতুবা, ছুরীখানি আপনি না তুলিয়া, আমায় তুলিয়া দিতে বলিবে কেন। ছুরী, আমার অপেক্ষা তোমার নিকটে আছে। সুতরাং তুমি অনায়াসে তুলিয়া লইতে পার। তুমি আপনি তুলিয়া লও, আমি কখনই তুলিয়া দিব না। পরিশ্রমে এত কাতর হওযা পুরুষের উচিত নহে।
যাহা হউক, অবশেষে হাঁচেন ছুরী তুলিয়া দিতে, তাহার নিকটে আসিল, এবং মস্তক অবনত করিয়া, যেমন ছুরী তুলিতে গেল, অমনই সেই দুরাত্মা, বাম হস্ত দ্বারা বিলক্ষণ বলপূর্ব্বক তদীয় গ্রীবা ধরিয়া, দক্ষিণ হস্ত দ্বারা বস্ত্রমধ্য হইতে এক তীক্ষ্ণধার অস্ত্র বহিষ্কৃত করিল, এবং কটূক্তিপ্রয়োগ ও ভয়প্রদর্শন করিয়া বলিল, যদি বাঁচিতে চাও, চীৎকার করিও না, এবং তোমার প্রভুর সম্পত্তি কোন্ স্থানে আছে, দেখাইয়া দাও, নতুবা এখনই তোমার কণ্ঠচ্ছেদন করিব। তদীয় ঈদৃশ ব্যবহার দর্শনে, চমৎকৃত ও ভয়ে অভিভূত হইয়া, হাঁচেন্ বলিল, কি কর, ছাড়িয়া দাও, আমার প্রাণ যায়, আর খানিক এরূপে ধরিয়া থাকিলে, আমি মরিয়া যাইব। সে বলিল, হয় তোমার প্রভুর সম্পত্তি দেখাইয়া দাও, নয় এখনই তোমার প্রাণবধ করিব।
হাঁচেন্ বিস্তর বুঝাইল, কিন্তু কিছুতেই তাহাকে নিরস্ত করিতে পারিল না। অবশেষে, নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া, সে ভাবগোপন করিয়া বলিল, আমি যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে তোমার অভিপ্রায় অনুসারে না চলিলে, আমার নিষ্কৃতি নাই। কিন্তু যদি তুমি আমায় তোমার সঙ্গে লইয়া যাও, তবেই আমি তোমায় প্রভুর সম্পত্তি দেখাইয়া দি। কারণ, তুমি সম্পত্তি লইয়া গেলে পর, প্রভু আমায় চোর বলিয়া সন্দেহ করিবেন; এবং তদুপলক্ষে অনেক শাস্তি পাইতে ও লাঞ্ছনাভোগ করিতে হইবে। সুতরাং আমি কোনও ক্রমে আর এখানে থাকিতে পারিব না, তদপেক্ষা তোমার সঙ্গে যাওয়াই, আমার পক্ষে সর্ব্বাংশে শ্রেয়স্কর। অতএব আমার কথা শুন, গ্রীবা ছাড়িয়া দাও, সত্বর কার্য্য সম্পন্ন কর, তাঁহাদের আসিবার অধিক বিলম্ব নাই, তাঁহারা আসিয়া পড়িলে তোমার সকল চেষ্টা বিফল হইবে, এবং উভযেই মারা পড়িব।
হাঁচেনের কথা শ্রবণগোচর করিয়া, সে তাহার মতানুবর্ত্তী হইয়াছে বলিয়া, বটেলরের নিশ্চিত বোধ জন্মিল। তখন সে তাহার গ্রীবা ছাডিয়া দিল। হাঁচেন, সেই দুরাত্মাকে প্রভুর শয়নাগারে লইয়া গেল, যে করণ্ডকে তাঁহার সম্পত্তি স্থাপিত ছিল, দেখাইয়া দিল, এবং গৃহের কোণ হইতে, এক কুঠার আনিয়া, তাহার হস্তে দিয়া বলিল, এই কুঠার লইয়া করণ্ডক ভগ্ন কর, কেবল হস্তদ্বারা কৃতকার্য্য হইতে পারিবে না। সত্বর কার্য্য শেষ কর। এই অবকাশে আমি একবার উপরে যাই, আমার যে দ্রব্যসামগ্রী আছে, ও এতদিন কর্ম্ম করিয়া যাহা সঞ্চয় করিয়াছি, সমুদয় লইয়া আসি। হাঁচেনের ভাবদর্শনে ও বাক্যশ্রবণে, সেই দুরাত্মা অতিশয় সন্তুষ্ট হইল, এবং প্রদর্শিত করণ্ডক ভাঙ্গিয়া, তন্মধ্য হইতে অর্থের নিষ্কাশন করিতে লাগিল। হাঁচেন, এইরূপে সেই দুরাচারের হস্ত হইতে নিস্তার পাইয়া, গৃহ হইতে বহির্গত হইল, এবং মুহূর্ত্তমাত্র ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিয়া, নিঃশব্দপদসঞ্চারে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক, নিমিষমধ্যে সেই য়নাগারের দ্বার এরূপে রুদ্ধ করিল যে, আর সে দুরাত্মার গৃহ হইতে বহির্গত হইবার উপায় রহিল না।
এইরূপে বটেলরকে গৃহমধ্যে রুদ্ধ করিয়া, হাঁচেন বাটীর বহির্দ্বারে উপস্থিত হইল, এবং লোকসংগ্রহ করিবার নিমিত্ত, কাতরস্বরে চীৎকার করিতে লাগিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যক্রমে সে দিন সে সময়ে সেখানে ব্যক্তিমাত্র ছিল না, কেবল গৃহস্বামীর পঞ্চমবর্ষীয় পুত্রটি কিঞ্চিৎ দূরে খেলা করিতেছিল। তাহাকে দেখিতে পাইয়া, তাহার নামগ্রহণ পূর্ব্বক হাঁচেন উচ্চৈঃস্বরে বলিল, তুমি ঐ পথ দিয়া দৌডিয়া তোমার পিতার নিকটে যাও, এবং তাঁহাকে সত্বর বাটীতে আসিতে বল, নতুবা আমার প্রাণান্ত ও তাঁহার সর্ব্বস্বান্ত হইবে। বালক, তাহার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া, নির্দ্দিষ্ট পথ দিয়া দৌড়িয়া পিতার নিকটে চলিল। সে তাহার অভিপ্রায় বুঝিয়া, তদনুযায়ী কার্য্য করিতে গেল, ইহা দেখিযা কিঞ্চিৎ অংশে নিশ্চিন্ত হইয়া, হাঁচেন্ দ্বারদেশে উপবিষ্ট হইল, এবং ঈশ্বরের কৃপায়, আজ আমি প্রভুর সম্পত্তিরক্ষা করিতে পারিলাম, এই ভাবিয়া আহ্লাদে অধীব হইয়া, আনন্দাশ্রুবিসর্জন করিতে লাগিল।
কিন্তু, হাঁচেনের এই আনন্দ অধিকক্ষণস্থায়ী হইল না। অতি বিকট তুরীশব্দ তাহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল। বটেলর এক সহচরকে সঙ্গে আনিয়াছিল, এবং এই উপদেশ দিয়া তাহাকে কিঞ্চিৎ দূরে রাখিয়া আসিযাছিল যে, আবশ্যক হইলে তুরীশব্দ দ্বারা যেরূপ সঙ্কেত করিব, তদনুযায়ী কার্য্য করিবে। সে গৃহমধ্যে রুদ্ধ হইয়া এবং হাঁচেন্ বালককে তাহার পিতার নিকট সংবাদ দিতে পাঠাইল ইহা শুনিতে পাইয়া, গৃহ হইতে বহির্গত হইবার অশেষবিধ চেষ্টা পাইল, কিন্তু কোনও ক্রমে কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া, জানালা খুলিয়া তুরীশব্দ দ্বারা স্বীয় সহচরকে সতর্ক করিয়া বলিল, ঐ পথ দিয়া যে বালক দৌড়িয়া যাইতেছে, তাহাকে ধর এবং হাঁচেনের প্রাণবধ কর। হাঁচেন শুনিয়া, চকিত হইযা চারিদিক নিরীক্ষণ করিতে লাগিল, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইল না। বালক দ্রুতবেগে দৌড়িয়া যাইতেছে, কেহ তাহাকে ধরিল না, ইহা অবলোকন করিয়া সে বিবেচনা করিল, দুবাত্মা আমায় ভয় দেখাইয়া বশীভূত করিবার অভিপ্রায়ে মিথ্যা আস্ফালন করিতেছে। কিন্তু কিয়ৎ দূর গিয়া, বালক এক সেতুর উপর উপস্থিত হইবামাত্র, বটেলরের সহচর সেতুর নিম্নদেশ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া, বালককে বগলে লইয়া সেই বাটীর দিকে ধাবমান হইল।
এই অতর্কিত নূতন বিপদ উপস্থিত দেখিয়া, হাঁচেন অত্যন্ত শঙ্কিত ও চিন্তাম্বিত হইল, এবং সত্বর বাটীর মধ্যে প্রবেশ পূর্ব্বক দৃঢ়রূপে বহির্দ্বার রুদ্ধ করিয়া ফেলিল। এই দ্বার ব্যতিরিক্ত বাটীতে প্রবেশ করিবার আর পথ ছিল না। অনেক গুলি জানালা ছিল বটে, কিন্তু সে সমস্তই লোহার গরাদ দ্বারা বিলক্ষণরূপে রক্ষিত। সুতরাং দ্বিতীয় দস্যুর বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিবার সম্ভাবনা নাই এই স্থির করিয়া, হাঁচেন্ ভাবিতে লাগিল, যদি প্রভুর প্রত্যাগমন পর্য্যন্ত ইহাদিগকে এই অবস্থায় রাখিতে পারি, তাহা হইলেই মঙ্গল, নতুবা ইহারা আমার প্রাণবধ করে তাহাও স্বীকার, তথাপি প্রাণ থাকিতে প্রভুর সর্ব্বনাশ করিতে পারিব না।
হাঁচেন, উদ্বিগ্নচিত্তে উপবিষ্ট হইয়া এই চিন্তা করিতেছে, এমন সময়ে সেই দুরন্ত দস্যু দ্বারদেশে উপস্থিত হইল, এবং কুৎসিত কটূক্তিপ্রয়োগ ও অশেষবিধ ভযপ্রদর্শন পূর্ব্বক, হাঁচেন কে সম্বোধন করিয়া বলিল, যদি ভাল চাহিস্, দরজা খুলিয়া দে, নতুবা আমি দরজা ভাঙ্গিয়া প্রবেশ করিব। ঈশ্বরের ইচ্ছায় যাহা আছে তাহাই হইবে, হাঁচেন এইমাত্র উত্তর দিল। বালক, ভয়ে অস্থির হইযা ক্রমাগত বিকট চীৎকার করিতে লাগিল। হাঁচেন কোনও ক্রমে দ্বার উদ্ঘাটিত করিল না দেখিয়া, জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া বটেলব স্বীয় সহচরকে বলিল, যদি সে অবিলম্বে দরজা খুলিয়া না দেয়, তাহার সমক্ষে ঐ বালকের গলা কাটিয়া ফেল। ঈদৃশ ভয়প্রদর্শন শ্রবণে, হাচেনের হৃৎকম্প ও বুদ্ধিভ্রংশ হইল। তখন সে দ্বার খুলিয়া দিয়া, বালকের প্রাণরক্ষা করিতে উদ্যত হইল। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষণেই বিবেচনা করিল, নিবপরাধ বালকের প্রাণবধ করায় উহাদের কোনও ইষ্টাপত্তি দেখিতেছি না। কিন্তু দ্বার খুলিয়া দিলে, আমার প্রাণবধ ও প্রভুর সর্ব্বনাশ অবধারিত। বিশেষতঃ, দ্বার খুলিয়া দিলে, বালকের প্রাণবধ করিবে না, তাহারই স্থিরতা কি। অতএব আমি কোনও ক্রমে দ্বার খুলিব না, ভাগ্যে যাহা আছে, তাহাই ঘটিবে। এই স্থির করিয়া, সে উপবিষ্ট রহিল। কিন্তু সেই দস্যু, দরজা খুলিয়া দে, নতুবা বালককে কাটিয়া ফেলি, এবং বাটীতে আগুন লাগাইয়া দি, নিরন্তর এই ভয়প্রদর্শন করিতে লাগিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে সেই দস্যু, বালককে ভূতলে ফেলিয়া, বাটীতে আগুন লাগাইয়া দিবার অভিপ্রায়ে, অগ্নিপ্রজ্বালনের উপযোগী দ্রব্যের অন্বেষণ করিতে লাগিল। ঐ বাটীতে একটি মিল্[১] ছিল। যে গৃহে মিল্ থাকিত, উহার ভিত্তিতে একটি বৃহৎ গর্ত্ত ছিল। ঐ গর্ত্ত দ্বারা মিলের চক্রেব উপব যাইতে পারা যায়। দস্যু, সহসা সেই গর্ত্ত দেখিতে পাইয়া, এবং গর্ত্ত দ্বারা বাটীতে প্রবিষ্ট হইতে পারা যায় বুঝিতে পারিয়া, অতিশয় আনন্দিত হইল, এবং বালকের পলায়ননিবারণার্থ তাহার হস্তপদবন্ধন পূর্ব্বক, উদ্ভাবিত গর্ত্ত দ্বারা বাটীতে প্রবেশ কবিবার চেষ্টা দেখিতে গেল। বাটীতে ঐরূপ গর্ত্ত আছে, কিংবা তদ্দারা বাটীতে প্রবেশ করিতে পারা যায, হাঁচেন ইহা অবগত ছিল না, এবং দস্যু ঐ উপায় অবলম্বন করিয়া বাটীতে প্রবেশ করিবার উদ্যোগ করিতেছে, তাহাও জানিতে পারে নাই, কারণ, সে যেখানে বসিয়াছিল, তথা হইতে ঐ দিক দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু ভাবিতে ভাবিতে, এই সময়ে তাহার মনে সহসা এক বিষয় উদিত হইল। সে বিবেচনা করিল, ববিবারের দিন মিল্ অবধারিত বন্ধ থাকে, কেহ কখনও উহা চলিতে দেখে নাই। কিন্তু আজ যদি মিল চালাইয়া দি, তাহা হইলে প্রতিবেশীরা নিঃসন্দেহ বোধ করিবে, অবশ্যই কোনও অসামান্য ব্যাপার ঘটিয়াছে, এবং সেরূপ বোধ হইলে অনেকে এস্থানে উপস্থিত হইতে পারে। আর, প্রভুও দূর হইতে দেখিতে পাইয়া, এরূপ বিরূপ ঘটনার কারণনির্ণয করিতে না পারিয়া, ব্যস্ত হইয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিতে পারেন।
এই স্থিব করিয়া, হাঁচেন মিল্ চালাইতে চলিল। বহু দিন ঐ বাটীতে থাকাতে, সে মিল্ চালাইবার প্রণালী বিলক্ষণ অবগত ছিল, এক্ষণে মিল্ঘরে প্রবেশ করিয়া, মুহূর্ত্তের মধ্যে কল চালাইয়া দিল। সমুদয় যন্ত্র প্রবলবেগে চলিতে আরম্ভ করিল। চক্র ও যন্ত্রের অপরাপর অবয়ব হইতে ভয়ঙ্কর শব্দ উত্থিত হইতে লাগিল। এই সময়ে, সেই দস্যু অতি কষ্টে গর্ত্ত দ্বারা প্রবেশ করিয়া, মিলের বৃহৎ চক্রে দণ্ডায়মান হইল, এবং নিতান্ত অনায়ত্ত হইয়া, সেই চক্রের সঙ্গে ঘুরিতে লাগিল। প্রথমতঃ, সে যন্ত্রের গতি স্থগিত করিবার, তৎপরে ঘূর্ণমান চক্র হইতে অপসৃত হইবার বিস্তর চেষ্টা পাইল, কিন্তু কোনও ক্রমে কৃতকার্য্য হইতে পারিল না। তখন সে ভয়ে ও বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া গেল, এবং প্রতিক্ষণেই প্রাণবিনাশের আশঙ্কা করিতে লাগিল। অবশেষে, প্রাণবক্ষা বিষয়ে নিতান্ত হতাশ হইয়া, সে বিকট আর্ত্তনাদ ও উৎকট আত্মভর্ৎসনা আরব্ধ করিল। হাঁচেন, অসম্ভাবিত আর্তনাদ শ্রবণে চকিত হইয়া, সত্বরগমনে সেই স্থানে উপস্থিত হইল এবং দেখিল, ইঁদুর যেমন কলে পড়িয়া বিবশ হইয়া ছটফট করিতে থাকে, ঐ দুরন্ত দস্যুর অবিকল সেই অবস্থা ঘটিয়াছে।
হাঁচেন্কে উপস্থিত দেখিয়া, দস্যু নিতান্ত কাতরবাক্যে এই প্রার্থনা করিতে লাগিল, তুমি যন্ত্রের গতি স্থগিত করিয়া, আমায় প্রাণদান কর, আমি জন্মের মত তোমার ক্রীতদাস হইয়া থাকিব। হাঁচেন তাহার প্রার্থনায় কর্ণপাত করিল না, দাঁড়াইয়া হাস্যমুখে কৌতুক দেখিতে লাগিল। চক্রের সঙ্গে, অবিশ্রামে ঘূর্ণিত হওয়াতে, দস্যু ক্রমে ক্রমে বিচেতন হইল, এবং যন্ত্রের নিম্নভাগে পতিত হইয়া, সেই অবস্থায় ঘুরিতে লাগিল। যত ক্ষণ পর্যন্ত তাহার চেতনা ছিল, সে একবার বিনয়, একবার লোভপ্রদর্শন, একবার বা ভয়প্রদর্শন করিয়া নিরন্তর হাঁচেনের নিকট এই প্রার্থনা করিয়াছিল, তুমি আমায় প্রাণদান কর। সে মনে করিলে, যন্ত্রের গতি স্থগিত করিয়া, অনায়াসে ঐ দস্যুকে অবতীর্ণ করিতে পারি, কিন্তু সেরূপ করা তাহার পক্ষে কোনও ক্রমে পরামর্শসিদ্ধ ছিল না, কারণ, বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইলেই দস্যু পুনরায় নিজমূর্ত্তি ধরিত, তাহার সন্দেহ নাই। হাঁচেন ইহাও জানিত, যন্ত্রে থাকিলে তাহার প্রাণনাশের কোনও আশঙ্কা নাই, কেবল উৎকট ভয়ে সাতিশয় অভিভূত থাকিয়া, আন্তরিক যাতনা ভোগ করিবে। এই সকল কারণে, সে তাহার অবতারণে বিরত রহিল।
অবশেষে, হাঁচেন বহির্দ্বারের কপাটে উৎকট আঘাত শুনিয়া, সত্বরগমনে তথায় উপস্থিত হইল, এবং স্বীয় প্রভুকে প্রত্যাগত দেখিয়া, অবিলম্বে দ্বার খুলিয়া দিল। গৃহস্বামী সপবিবারে ও সমবেত প্রতিবেশিবর্গ সমভিব্যাহারে বাটীতে প্রবেশ করিলেন। তিনি, রবিবারে মিল চলিতে দেখিয়া, যৎপুরোনাস্তি বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া আসিয়াছিলেন, পরে বাটীর বহির্ভাগে পঞ্চমবর্ষীয় বালককে বদ্ধহস্ত বদ্ধপদ, ভূতলে নিক্ষিপ্ত, এবং বহির্দ্বার রুদ্ধ দেখিয়া, কি সর্বনাশ ঘটিয়াছে কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, নিবতিশয় ব্যাকুলচিত্ত হইয়াছিলেন, এজন্য নিতান্ত ব্যগ্র হইয়া, হাঁচেনকে এই সমস্ত বিরূপ ঘটনার কারণ জিজ্ঞাসিলেন। সে, সংক্ষেপে সমস্ত বৃত্তান্ত বিদিত করিয়া, মুর্চ্ছিত ও ভূতলে পতিত হইল। গৃহস্বামী, অনেক কষ্টে তাহার চৈতন্যসম্পাদন করিলেন। অনন্তর সকলে মিলঘরে প্রবেশ করিয়া, যন্ত্রের গতি স্থগিত করিলেন। অচেতন দস্য তন্মধ্য হইতে নিষ্কাশিত হইল। পরে, সকলে গৃহস্বামীর শনাগারের দ্বার উদ্ঘাটিত করিয়া, বটেলবকে রুদ্ধ করিলেন। উভয়ে তৎক্ষণাৎ রাজপুরুষদিগের হস্তে সমর্পিত হইল, এবং অনতিবিলম্বে উৎকট অপরাধের সমুচিত প্রতিফল পাইল। গৃহস্বামী, হাঁচেনের মুখে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত সবিশেষ অবগত হইয়া, তদীয় অদ্ভুত সাহস, অবিচলিত প্রভুভক্তি ও নিরতিশয় প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দর্শনে মোহিত ও চমৎকৃত হইলেন, এবং এই সমস্ত অসাধারণ গুণের যথোপযুক্ত পুরস্কারস্বরূপ আপন জ্যেষ্ঠ পুত্রের সহিত তাহার বিবাহ দিলেন। হাঁচেন অতি দীনের কন্যা। তাহার ভাগ্যে ঈদৃশ সমৃদ্ধিশালী পরিবারে পরিণয় ঘটিবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। সে, এক্ষণে, আশার অতিরিক্ত ফললাভ করিয়া, সুখে ও স্বচ্ছন্দে কালহরণ করিতে লাগিল।
- ↑ যব কলায় প্রভৃতি শস্য বা অন্যবিধ কঠিন দ্রব্য চূর্ণ করিবার যন্ত্র