আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/সৌভ্রাত্র

সৌভ্রাত্র

খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে, পোর্তুগীস্‌দিগের জাহাজ ভারতবর্ষে যাতায়াত করিত, একদা এক জাহাজ, অন্যূন দ্বাদশ শত লোক লইয়া, ভারতবর্ষে আসিতেছিল। প্রথমতঃ কিছু দিন কোনও অসুবিধা বা উপদ্রব ঘটে নাই। ঐ জাহাজ নিয়ে ও নিরুদ্বেগে, আফ্রিকা পর্যন্ত উপস্থিত হইল, অনন্তর উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রান্ত করিয়া, উত্তরপূর্ব্বাভিমুখে চলিতে চলিতে, আরোহীদিগের দুর্ভাগ্যক্রমে, এক জলমগ্ন পাহাড়ে সংলগ্ন হইল। তলভেদ হইয়া এরূপে জলপ্রবেশ হইতে লাগিল যে, অবিলম্বে উহার অর্ণবপ্রবাহে মগ্ন হওয়া অপরিহার্য্য হইয়া উঠিল।

 জাহাজের উপর পিনেস্ নামে একখানি ক্ষুদ্র তরী ছিল। এই সর্ব্বনাশ উপস্থিত দেখিয়া, কাপ্তেন সেই পিনেস্ জলে ভাসাইলেন, এবং কিছু আহারসামগ্রী লইয়া, আর ঊনবিংশতি ব্যক্তির সহিত উহাতে আরোহণ করিলেন। এতদ্ভিন্ন অনেকে ঐ পিনেসে আসিবার নিমিত্ত উদ্যম করিয়াছিল, কিন্তু অধিক লোক হইলে পাছে মগ্ন হইয়া যায়, এই আশঙ্কায় তাঁহারা তরবারিপ্রহার দ্বারা উহাদিগকে নিবৃত্ত করিলেন। এইরূপে কাপ্তেন ও তৎসমভিব্যাহারীরা প্রস্থান করিলে পর, জাহাজ অবশিষ্ট আরোহিবর্গের সহিত অর্ণবগর্ভে প্রবিষ্ট হইল।

 সমুদ্রপথে, কম্পাস্ ব্যতিরেকে দিঙ্‌নির্ণয় হয় না। জাহাজে কম্পাস্ ছিল, কিন্তু কাপ্তেন, প্রাণবিনাশশঙ্কায় নিতান্ত অভিভূত ও একান্ত ব্যাকুলচিত্ত হইয়া, কম্পাস লইতে বিস্মৃত হইয়াছিলেন। সুতরাং পিনেসের লোকেরা দিঙ্‌নিরূপণ করিতে না পারিয়া, যদৃচ্ছাক্রমে দাঁড় বাহিয়া চলিলেন। সমুদ্রের জল এরূপ লবণময় যে, কোনও ক্রমে পান করিতে পারা যায় না। জাহাজে পানার্থ জল ছিল, পিনেসের লোকেরা ব্যাকুলতা প্রযুক্ত, তাহা লইতে পারেন নাই, এজন্য তাঁহাদের পিপাসানিবন্ধন কষ্টের একশেষ ঘটিয়াছিল। তাঁহারা এইরূপ দুরবস্থায়, পিনেস্, চালাইতে লাগিলেন।

 জাহাজের কাপ্তেন পূর্ব্বাবধি পীড়িত ও সাতিশয় দুর্ব্বল ছিলেন, চারি দিন পরে তাঁহার মৃত্যু হইল। এই দুর্ঘটনা দ্বারা পিনেসে অশেষবিধ বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইতে লাগিল। সকলেই কর্ত্তৃত্বভার গ্রহণে ও আজ্ঞা প্রদানে উদ্যত, কেহই অধীনতাস্বীকারে ও আজ্ঞাপ্রতিপালনে সম্মত নহেন। অবশেষে, সকলে ঐকমত্য অবলম্বন পূর্ব্বক, এক অভিজ্ঞ বৃদ্ধ ব্যক্তির হস্তে কর্ত্তৃত্বভার অর্পিত করিলেন।

 কত দিনে তাঁহারা তীর প্রাপ্ত হইবেন, তাহার নিশ্চয় ছিল না। আর তাঁহারা যে আহারসামগ্রী লইয়া পিনেসে আরোহণ করিয়াছিলেন, তাহা প্রায় নিঃশেষ হইয়া আসিল। সুতরাং স্বল্পাবশিষ্ট ভাগ দ্বারা সকলের অধিক দিন প্রাণধারণ হওয়া কোনও মতে সম্ভাবিত নহে। এজন্য, নুতন কাপ্তেন এই প্রস্তাব করিলেন, আমরা পিনেসে যত লোক আছি, অবশিষ্ট আহারসামগ্রী দ্বারা অধিক দিন সকলের প্রাণধারণ অসম্ভব। অতএব লাটরি করিয়া আপাততঃ সমুদয়ের চতুর্থ ভাগ লোককে সমুদ্রে প্রক্ষিপ্ত করা যাউক, তাহা হইলে, তদ্বারা অপেক্ষাকৃত অধিক দিন চলিতে পারিবে।

 এই প্রস্তাবে সকলে সম্মতিপ্রদৰ্শন করিলেন। পিনেসে সমুদয়ে উনিশ ব্যক্তি ছিলেন, তন্মধ্যে এক ব্যক্তি পাদরি, আর এক ব্যক্তি সূত্রধর। প্রথম ব্যক্তি, অন্তিম সময়ে ধর্ম্মবিষয়ক উপদেশ দিবেন, এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি, আবশ্যক হইলে পিনেসের মেরামত করিতে পারিবেন, এই বিবেচনায় সকলে তাঁহাদের উভয়কে ছাড়িয়া, লাটরি করিতে সম্মত হইলেন। আর নূতন কাপ্তেন বয়সে প্রাচীন, বিশেষতঃ তিনি না থাকিলে, পিনেস্ চালান কঠিন হইয়া উঠিবে, এজন্য সকলে তাঁহাকেও ছাড়িয়া দিলেন। তিনি, অনেকক্ষণ পর্যন্ত এই বিষয়ে সম্মত হয়েন নাই, পরিশেষে, সকলের সবিশেষ অনুরোধে তাঁহাকে সম্মত হইতে হইল।

 এইরূপে তিন জনকে ছাড়িয়া দিয়া, অবশিষ্ট ষোল জনের মধ্যে লাটরি হইল। যে চারিজনকে অর্ণবপ্রবাহে প্রক্ষিপ্ত করা অবধারিত হইল, তন্মধ্যে তিন জন তৎকালোচিত উপাসনাকার্য্য সম্পন্ন করিয়া, প্রাণত্যাগে প্রস্তুত হইলেন, চতুর্থ ব্যক্তির কনিষ্ঠ সহোদর পিনেসে ছিলেন, তিনি জ্যেষ্ঠের প্রাণনাশের উপক্রম দর্শনে যৎপরোনাস্তি কাতর ও শোকাভিভূত হইয়া, নিরতিশয় স্নেহভরে তাঁহাকে প্রগাঢ় আলিঙ্গন করিলেন, এবং অশ্রুপূর্ণ লোচনে আকুল বচনে বলিতে লাগিলেন, ভ্রাতঃ, আমি কোনও ক্রমে আপনাকে প্রাণত্যাগ করিতে দিব না, আপনার স্থলাভিষিক্ত হইয়া, আমি প্রাণত্যাগ করিতেছি। বিবেচনা করিয়া দেখুন, আপনি বিবাহ করিয়াছেন, আপনার স্ত্রী আছেন, অনেক গুলি সন্তান হইযাছে, বিশেষতঃ, তিনটি অনাথা ভগিনী আছে। আপনি জীবিত থাকিলে সকলের ভরণপোষণ করিতে পারিবেন। এমন স্থলে, আপনার প্রাণত্যাগ কবা, কোনও ক্রমে পরামর্শসিদ্ধ নহে। আপনি প্রাণত্যাগ করিলে যত অনিষ্ট ঘটিবে, আমি অকৃতদার, আমি মরিলে অপেক্ষাকৃত অনেক অংশে অল্প অনিষ্ট ঘটিবে

 জ্যেষ্ঠ, কনিষ্ঠের এই অদ্ভুত প্রস্তাব শ্রবণে বিস্ময়াপন্ন ও তদীয় স্নেহের ও সৌজন্যের আতিশয্য দর্শনে যৎপরোনাস্তি মুগ্ধ ও আর্দ্র হইয়া, অশ্রুবিসর্জ্জন করিতে করিতে গদগদ বচনে বলিতে লাগিলেন, বৎস, আমি কোনও ক্রমে তোমার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারি না, কাবণ, পরের প্রাণ দিয়া আপনার প্রাণরক্ষা করা অপেক্ষা অধর্ম্ম আর নাই। বিশেষতঃ, তুমি কনিষ্ঠ সহোদর, নিরতিশয় স্নেহপাত্র, তাহাতে আবার তুমি আমার প্রাণরক্ষার প্রস্তাব করিয়া, অনির্বচনীয় স্নেহপ্রদর্শন করিয়াছ। যদি আমি তোমায় আমার স্থলে প্রাণত্যাগ করিতে দি, তাহা হইলে আমার অধর্ম্মের একশেষ হইবে, এবং অবশেষে শোকে ও অনুশয়ে দগ্ধ হইয়া, আত্মঘাতী হইতে হইবে। অতএব ক্ষান্ত হও, আমায় প্রাণত্যাগ করিতে দাও।

 জ্যেষ্ঠের এই সকল কথা শুনিয়া কনিষ্ঠ বলিলেন, আপনি অবধারিত জানিবেন, আমি কোনও ক্রমে আপনাকে আমার সমক্ষে প্রাণত্যাগ করিতে দিব না। কনিষ্ঠ, এই বলিয়া, জানুপাতন পূর্ব্বক, দৃঢ়বন্ধনে তাঁহার চরণে ধরিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। জ্যেষ্ঠ ও অন্যান্য সকলে বিস্তর চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু, কোনও ক্রমে তাঁহার ভুজবন্ধনের অপনয়ন করিতে পারিলেন না। তখন জ্যেষ্ঠ বলিলেন, বৎস, তুমি এ অধ্যবসায় পরিত্যাগ কর। আমি যেরূপ করিতেছিলাম, আমি অবিদ্যমানে তুমি সেইরূপ আমার পুত্রকন্যাদিগেব লালনপালন, আমার পত্নীর রক্ষণাবেক্ষণ ও অনাথা ভগিনীদিগের ভরণপোষণ করিতে পারিবে। অতএব, আমার কথা শুন, ক্ষান্ত হও, আমায় প্রাণত্যাগ করিতে দাও।

 এইরূপে জ্যেষ্ঠ, কনিষ্ঠকে অনেক প্রকারে বুঝাইলেন, কিন্তু কোনও ক্রমে তাঁহাকে বিরত করিতে পারিলেন না। অবশেষে, তাঁহাকে কনিষ্ঠের প্রস্তাবে সম্মত হইতে হইল। অনন্তর অপর তিন জন ও সেই যুবক অর্ণবপ্রবাহ প্রক্ষিপ্ত হইলেন। তিন জন তৎক্ষণাৎ অদর্শন প্রাপ্ত হইলেন, কিন্তু সেই যুবক সন্তরণ-বিষয়ে বিলক্ষণ নিপুণ ছিলেন, এজন্য সহসা জলমগ্ন হইলেন না। তিনি কিয়ৎক্ষণ সন্তরণ পূর্ব্বক, প্রাণভয়ে অভিভূত ও কাতর হইয়া, দক্ষিণ হস্ত দ্বাবা পিনেসের ক্ষেপণী ধারণ করিলেন। একজন পোতবাহ অস্ত্র দ্বারা তৎক্ষণাৎ তাঁহার হস্তচ্ছেদন করিলে, তিনি পুনরায় সন্তরণ করিতে লাগিলেন, এবং কিয়ৎ ক্ষণ পরে, অপর হস্ত দ্বারা পিনেসের ক্ষেপণী অবলম্বন করিলেন। তখন পোতবাহ পূর্ব্ববৎ তাঁহার ঐ হস্তের ছেদন করিল। তিনি পুনরায় অর্ণবপ্রবাহে পতিত হইলেন, কিন্তু তখনও জলমগ্ন না হইয়া, শোণিতোদ্গারী দুই ছিন্ন হস্ত ঊর্দ্ধে তুলিয়া, পোতের সন্নিহিত স্থানে সন্তরণ করিতে লাগিলেন।

 সেই যুবকের ভ্রাতৃস্নেহেব একশেষ দর্শনে, সকলের হৃদয় দ্রবীভূত হইয়াছিল, এক্ষণে তাঁহার এই অবস্থা নয়নগোচর করিয়া, সকলেরই অন্তঃকরণে যারপরনাই করুণার উদয় হইল। তাঁহারা সকলেই অশ্রুবিসৰ্জ্জন করিতে লাগিলেন, এবং কিয়ৎক্ষণ পরে একবাক্য হইয়া বলিলেন, আমাদের ভাগ্যে যাহা থাকে তাহাই ঘটিবে, আমরা অবশ্যই উহার প্রাণরক্ষা করি। জন্মাবচ্ছিন্নে কেহ কখনও ভ্রাতৃস্নেহের এরূপ দৃষ্টান্ত দৃষ্টিগোচর করি নাই। এই বলিয়া, তাঁহারা তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে পিনেসে উঠাইয়া লইলেন, এবং কথঞ্চিৎ তদীয় হস্তের শিরাবন্ধন করিয়া, শোণিতস্রাব স্থগিত করিলেন।

 পিনেসের লোকেরা, সে দিবস অবিশ্রামে দাঁড় বাহিতে লাগিলেন। পরদিন প্রভাত হইবামাত্র, তাঁহারা অনতিদূরে স্থল দেখিতে পাইলেন। তদ্দর্শনে সকলেরই অন্তঃকরণে সাহস ও উৎসাহের সঞ্চার হইল। তখন তাঁহারা, সেই দিক্ লক্ষ্য করিয়া, বিলক্ষণ বলসহকারে ক্ষেপণীক্ষেপণ করিতে লাগিলেন। কিঞ্চিৎ কাল পরে, পিনেস আফ্রিকার অন্তর্বর্ত্তী মোজাম্বিক্ পর্ব্বতের সন্নিহিত হইলে, তাঁহারা জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া, বাষ্পবারিপরিপূরিত নয়নে, তীরে অবতীর্ণ হইলেন। সৌভাগ্যক্রমে, অনতিদূরে পোর্ত গীসদিগের এক উপনিবেশ ছিল, তাহা অনতিবিলম্বে, সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া, আশ্রয় প্রাপ্ত হইলেন।

 উপনিবেশের লোকেরা, তাহাদের দুরবস্থার আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া, যৎপবোনাস্তি দুঃখিত হইলেন, কিন্তু ঐ দুই সহোদরের, বিশেষতঃ কনিষ্ঠের, ভ্রাতৃস্নেহেব এক- শেষ শ্রবণগোচর কবিয়া, এবং পরিশেষে যেরূপে কনিষ্ঠের প্রাণরক্ষা হইয়াছে তৎসমুদয় বিদিত হইয়া, নিরতিশয় আহলাদিত হইলেন, এবং তাঁহাদের দুই সহোদবকে, এবং কনিষ্ঠের প্রাণরক্ষা উপলক্ষে পিনেসস্থিত লোকদিগকে, মুক্তকণ্ঠে সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।