আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/উৎকট বৈরসাধন

উৎকট বৈরসাধন

যৎকালে মুসলমানেরা য়ুরোপের অন্তবর্ত্তী অনেক দেশের জয় ও অধিকার করিতেছিলেন, সেই সময়ে ফ্লাণ্ডর্স প্রদেশে বিদবমন নামে এক ব্যক্তি এক নগরের অধিপতি ছিলেন। ঐ নগরে মুসলমানদের আধিপত্য সংস্থাপিত হইলে, বিদবমন, তাঁহাদের অত্যাচারদর্শনে একান্ত বিকলহৃদয় হইয়া, তথা হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং এক খৃষ্টীয় রাজার অধিকারে প্রবিষ্ট হইয়া, তথায় অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। কিন্তু স্বদেশানুরাগের আতিশয্যবশতঃ, তিনি মনে মনে এই বিবেচনা করিতে লাগিলেন, স্বীয় জন্মভূমির ঈদৃশী দুরবস্থা দেখিয়া নিশ্চেষ্ট ও নিশ্চিন্ত থাকা নিতান্ত কাপুরুষ ও নিতান্ত অপদার্থের কর্ম। বিশেষতঃ, অধিকারচ্যুত হইয়া, অন্যদীয় আশ্রয় অবলম্বন পূর্ব্বক, অসারদেহভারবহন করা অপেক্ষা আমার পক্ষে প্রাণত্যাগ করা সহস্রগুণে শ্রেয়ঃকল্প। এক্ষণে উত্তম কল্প এই, স্বীয় নগরে প্রতিগমন পূর্ব্বক তত্রত্য লোকদিগের হৃদয়ে স্বদেশানুরাগ উদ্দীপিত করিবার চেষ্টা পাই, যদি এ বিষয়ে কৃতকার্য্য হই, স্বীয় জন্মভূমিকে মুসলমানদের অত্যাচার হইতে মুক্ত করিতে পারিব।

 ঈদৃশ-সঙ্কল্পারূঢ় হইয়া, বিদবমন্ প্রচ্ছন্ন-বেশে স্বীয় নগরে প্রবেশ করিলেন, এবং মুসলমানদের প্রতিকূলে অস্ত্রধারণ করিবার নিমিত্ত স্বদেশীয়দিগকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। কিন্তু ইতঃপূৰ্বে মুসলমানদিগের প্রতিকূলবর্ত্তী হইয়া, তত্রত্য লোকদিগকে যে অসহ্য যন্ত্রণা ও উৎকট অত্যাচার সহ্য করিতে হইয়াছিল, তৎসমুদয় তৎকাল পর্য্যন্ত তাহাদের হৃদয়ে বিলক্ষণ জাগরূক ছিল, এজন্য তাহারা সাহস করিয়া, তদীয় উপদেশ ও পরামর্শের অনুবর্ত্তী হইতে পারিল না। তাহারা এই বিবেচনা করিল, যদি মুসলমানদের প্রতিকূলাচরণে প্রবৃত্ত হইয়া কৃতকার্য্য হইতে না পারি, তাহারা অধিকতর অত্যাচার কবিবে, এবং রাজবিদ্রোহী বলিয়া অনেকের প্রাণদণ্ড হইবে, তদপেক্ষা এই অবস্থায় কালযাপন করা অনেক অংশে শ্রেয়স্কর। সুতরাং বিদবমন্ সিদ্ধকাম হইতে পারিলেন না।

 একদিন তিনি, কিংকর্ত্তব্য-নিরূপণে নিবিষ্টচিত্ত হইয়া উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে, এক মুসলমান সৈনিকপুরুষ, পরপ্রেরিত প্রণিধি বলিয়া তাঁহাকে অবরুদ্ধ করিল। বিচারালয়ে নীত হইলে, তিনি অশেষপ্রকারে আত্মদোষক্ষালনের চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু বিচারকর্ত্তার অন্তঃকরণ হইতে সন্দেহ দূর হইল না। বিচারকর্ত্তা তাঁহার প্রকৃত পরিচয় পাইলে ও যথার্থ উদ্দেশ্য অবগত হইলে, তিনি সহজে নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারিতেন না, তাঁহার উপর পরপ্রেরিত প্রণিধিবোধে দুরভিসন্ধির আশঙ্কামাত্র জন্মিয়াছিল, তদ্বিষয়ে সবিশেষ প্রমাণ পাওয়া গেল না, এজন্য বিচারকর্ত্তা অন্যবিধ উৎকট দণ্ডবিধানে বিরত হইয়া, কোড়া মারিয়া ছাড়িয়া দিতে আদেশ দিলেন।

 এইরূপ দণ্ড ব্যবস্থা হইলে, বিদবমন তদনুযায়ী কার্য্যকরণের উপযোগী স্থানে নীত হইলেন। রাজপুরুষেরা নির্দিষ্ট স্তম্ভে তাঁহার হস্তবন্ধন করিল। যে ব্যক্তির উপর কোড়া মারিবার ভার ছিল, সে অপরাধীর নিকট কিঞ্চিৎ পাইলে প্রহারের সংখ্যা ও ঔৎকট্য উভয়েরই অনেক লাঘব করিত। কিন্তু বিদবমন্ উৎকোচদানে অসমর্থ বা অসম্মত হওযাতে, সে সাতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়া, বিলক্ষণ বলপূর্ব্বক প্রহার করিতে লাগিল। বিদবমন্ যাতনায় অস্থির হইয়া আর্তনাদ করিলে, সে, অরে দুরাত্মন্! অসন্তোষ প্রদর্শন করিতেছ, এই বলিয়া পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর বলসহকারে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। বিদবমন, নিতান্ত কাতর হইয়া, কিয়ৎক্ষণ ক্ষান্ত থাকিতে অনুরোধ করিলে, সে পূর্ব্ববৎ, অরে দুরাত্মন্! অসন্তোষ প্রদর্শন করিতেছ, এই বলি উপর্য্যুপরি প্রহার করিতে আরম্ভ করিল।

 এইরূপ যাতনাভোগ ও অবমাননালাভ কবিয়া, বিদবমন বৈরসাধনে কৃতসঙ্কল্প হইলেন, এবং শপথ পূর্ব্বক প্রতিজ্ঞা করিলেন, যেরূপে পারি, এই অত্যাচারের সমুচিত প্রতিফল প্রদান করিব। তিনি অনতিচির সময়ের মধ্যেই, কি প্রধান, কি সামান্য, কি ধনী, কি দরিদ্র, কি উদাসীন, কি রাজপুরুষ সর্ব্ববিধ লোকের নিকট বিশিষ্টরূপ পরিচিত ও প্রতিপন্ন হইলেন এবং সর্ব্বত্র অব্যাহতগতি ও একজন গণনীয় ব্যক্তি হইয়া উঠিলেন।

 যে ব্যক্তি কোড়াপ্রহার করিয়াছিল, তাহাক্ষে সমুচিত শাস্তিপ্রদান করাই তিনি সর্ব্বপ্রথম ও সর্ব্বপ্রধান কর্ম্ম বলিয়া অবধাবিত করিলেন, এবং অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া, কেবল তদনুকূল উদ্যেগে ব্যাপৃত রহিলেন। সুযোগ পাইয়া, তিনি নগরাধ্যক্ষের আলয় হইতে এক বহুমূল্য স্বর্ণপাত্রের অপহরণ করিলেন, এবং কৌশলক্রমে সেই স্বর্ণপাত্র ঘাতকের আলয়ে সংস্থাপিত করিয়া, অন্য লোক দ্বারা রাজপুরুষদিগের নিকট অপহৃত দ্রব্য অমুক স্থানে আছে, এই সংবাদ দেওয়াইলেন। তাঁহারা ঘাতকের আলয়ে প্রবিষ্ট হইয়া, অপহৃত স্বর্ণপাত্র বহিষ্কৃত করিলেন। সে চৌর্য্যাভিযোগে বিচারালয়ে নীত হইল। তাহার গৃহে অপহৃত বস্তু লক্ষিত হইযাছিল, সুতবাং, সেই অভিযোগ নিঃসংশয়িতরূপে সপ্রমাণ হইল। আরবীয় বিধানশাস্ত্রের ব্যবস্থা সকল অত্যন্ত কঠিন, চৌর্য্যাপরাধ প্রমাণসিদ্ধ হইলে, অপরাধীর প্রাণদণ্ড হয়। তদনুসারে, সেই ঘাতকের প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা হইলে, সে বধস্থানে নীত হইল। সেই নগরে ঐ ব্যক্তি ব্যতিরিক্ত ঘাতকান্তর নিযুক্ত ছিল না। বিদবমন্, স্বয়ং ঘাতককর্ম্মের অনুষ্ঠানে সম্মত হইয়া, তীক্ষধার তরবারি লইয়া, প্রফুল্লচিত্তে বধস্থানে উপস্থিত হইলেন।

 সেই ঘাতকের উপর তাঁহার মর্মান্তিক আক্রোশ জন্মিয়াছিল, এজন্য তিনি, তাহার বধসাধন করিয়াই, বৈরসাধনপ্রবৃত্তি চরিতার্থ হইল, এরূপ বোধ করিলেন না। কেবল তাঁহার চেষ্টায়, বিনা অপরাধে, তাহার প্রাণদণ্ড হইতেছে, ইহা তাহাকে অবগত না করিলে, তাঁহার চিত্তে সন্তোষবোধ হইল না। উপস্থিত ব্যাপার নির্ব্বাহের সমুদয় আয়োজন হইলে, তিনি তাহাকে অনুচ্চস্বরে বলিলেন, দেখ, যে অভিযোগে তোমার প্রাণদণ্ড হইতেছে, সে বিষয়ে তুমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। কিছুকাল পূর্ব্বে তুমি আমায় অত্যন্ত যাতনা দিয়াছিলে, সেই আক্রোশে আমি নগরাধ্যক্ষের আলয় হইতে স্বর্ণপাত্রের অপহরণ করিয়া উহা তোমার আবাসে রাখিয়া, অমূলক চৌর্য্যাভিযোগে তোমার বধসাধন করিতেছি।

 এই কথা শুনিবামাত্র, ঘাতক, উচ্চৈঃস্বরে, পার্শ্ববর্ত্তী লোকদিগকে সম্বোধন কবিয়া বলিল, এ ব্যক্তি কি বলিতেছে, তোমরা শুনিলে? তখন বিদব্‌মন, অরে দুরাত্মন। তুমি অসন্তোষ প্রদর্শন করিতেছ, এই বলিয়া, এক প্রহারেই তাহার মস্তকচ্ছেদন করিলেন।

 মানুষ, ক্রোধের অধীন ও বৈরসাধনবাসনার বশবর্ত্তী হইলে, ধর্ম্মাধর্ম্মবিবেচনায় এককালে জলাঞ্জলি দেয়।

 যে ব্যক্তির হস্তে বিদবমন্‌কে যাতনাভোগ করিতে হইয়াছিল, তিনি তাহাকে সমুচিত প্রতিফলপ্রদান করিলেন, অতঃপর যাঁহাদের আদেশে তাঁহার যাতনাভোগ ঘটিয়াছিল, তাঁহাদের উপর বৈরসাধনে উদ্‌যুক্ত হইলেন। অভিপ্রেত-সম্পাদনের নিমিত্ত, তিনি নগরপ্রাচীরের সন্নিধানে এক বাড়ী ভাড়া লইলেন, এবং অবিচলিত অধ্যবসায় সহকারে, সুরঙ্গখনন করিতে আরম্ভ করিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই, সেই সুরঙ্গ প্রস্তুত হইল। ঐ নগরপ্রাচীর এরূপে নির্ম্মিত হইয়াছিল যে, পুরদ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিলে, বিপক্ষের পক্ষে, সেই নগরে প্রবেশ করা, কোনও ক্রমে, সহজ ব্যাপার নহে। সুরঙ্গ প্রস্তুত করিয়া রাখিবার উদ্দেশ্য এই যে, যখন মুসলমানদিগের কোনও বিপক্ষ সেই নগর আক্রমণ করিবে, তাহাদিগকে ঐ সুরঙ্গ দেখাইয়া দিবেন, তাহা হইলে, তাহারা, অনায়াসে নগরে প্রবেশ করিয়া, মুসলমানদিগকে পরাজিত করিতে পারিবে।

 অতঃপর বিদবমন, উৎসুকচিত্তে বিপক্ষের আগমনপ্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। অনতিবিলম্বে, তাঁহার অভিপ্রেতসিদ্ধির সম্পূর্ণ সুযোগ ঘটিয়া উঠিল। কিছু দিন পরেই, ফরাসিসৈন্য সেই নগর আক্রমণ করিল। প্রথম উদ্যমে নগর হস্তগত করিতে অসমর্থ হইয়া, তাহারা শিবির ভঙ্গ করিয়া প্রতিপ্রয়াণের উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময়ে বিদবমন, ফরাসিসেনাপতির নিকটে গিয়া, সবিশেষ সমস্ত বলিয়া, সেই উদ্যোগের নিবারণ করিলেন। সেনাপতি, অভিপ্রেতসমাধানের ঈদৃশ অসম্ভাবিত সদুপায়লাভে, যৎপরোনাস্তি প্রীতিপ্রাপ্ত হইলেন, এবং অবিলম্বে, বিদবমনের সমভিব্যাহারে, কতিপয় অকুতোভয অসংসাহসিক সৈনিক-পুরুষ প্রেরিত করিলেন। তাহাবা সেই সুরঙ্গ দ্বারা নগরে প্রবিষ্ট হইয়া, পুরদ্বার উদ্ঘাটিত করিলে, সমুদয় ফরাসিসৈন্য, অতর্কিতরূপে, উচ্ছলিত অর্ণবপ্রবাহেব ন্যায়, নগরে প্রবেশ করিল। অনধিক সময়ের মধ্যেই নগরস্থ সমস্ত মুসলমান তদীয় তরবারি-প্রহারে ছিন্নমস্তক ও ভূতলশায়ী হইল।