আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/পতিব্রতা কামিনী
পতিব্রতা কামিনী
এবরার্ডনামক এক ব্যক্তি দেশ পর্য্যটন করিয়াছিলেন। তিনি পর্য্যটনকালে, যে দেশে যে সমস্ত অসামান্য বিষয় দেখিতেন, তৎসমুদয় লিপিবদ্ধ করিয়া, এক আত্মীয়ের নিকট পাঠাইতেন। তাঁহার লিখিত পত্র সকল ১৭৭৬ খৃষ্টাব্দে প্রচারিত হয়। তন্মধ্যে এক পত্রে পতিপরায়ণতাব এক অভূতপূর্ব্ব উদাহরণ উল্লিখিত হইয়াছে। ঐ পত্রের মর্ম্ম এই—
আমি, আল্পস্ পর্ব্বতের নানা অংশে ও জর্ম্মনি দেশে পর্য্যটন করিয়া, বিবেচনা করিলাম, ইষ্ট্রিয়াতে যে পারদের আকর আছে, তাহা না দেখিয়া, স্বদেশে প্রতিগমন করা উচিত নহে। তদনুসারে, এক পথদর্শকের সমভিব্যাহারে, আকরে প্রবিষ্ট হইলাম। যাহারা কর্ম্ম করিতেছিল, তাহাদের দুববস্থা দেখিয়া, আমার যেরূপ কষ্টবোধ হইল, তাহার বর্ণনা করিতে পারি না। আমি জন্মাবচ্ছিন্নে, তাহাদের মত হতভাগ্য লোক দেখি নাই। উৎকট অপরাধবিশেষে, রাজদণ্ড অনুসারে, এক ভয়ঙ্কর স্থানে যাবজ্জীবন কর্ম্ম করিতে হয়। তাহারা, এই স্থানে প্রবিষ্ট হইয়া, এ জন্মে আর সূর্য্যের মুখ দেখিতে পায় না। যাহারা তাহাদের উপর কর্ত্তৃত্ব করে, তাহারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর, প্রহার করিয়া কর্ম্ম করায়। সর্বদা পারা ঘাঁটিয়া, তাহাদের আকার অঙ্গারের ন্যায় মলিন, এবং শরীর নিতান্ত শীর্ণ ও নিস্তেজ হইয়া গিয়াছে। তাহারা রাজব্যয়ে আহার পাইয়া থাকে, কিন্তু অল্প দিনেব মধ্যেই, এরূপ উৎকট অগ্নিমান্দ্য ঘটে যে, কিছুমাত্র আহার করিতে পারে না, এবং শরীরের সন্ধিস্থল সকল এরূপ সঙ্কুচিত হইয়া যায় যে, সচরাচর প্রায় দুই বৎসরের অধিক বাঁচে না।
এই হৃদয়বিদারণ নিদারুণ ব্যাপার দর্শনে, আমার অন্তঃকরণে অতি বিষম শোক উপস্থিত হইল। আমি, আক্ষেপ করিয়া, মনে মনে বলিতে লাগিলাম, মনুষ্যের ন্যায় নির্দ্দয় ও নির্বিবেক জন্তু ভূমণ্ডলে আর নাই, দুর্ভর অর্থলালসার বশীভূত হইয়া, দুর্বলদিগের উপর কি ভয়ানক অত্যাচার করিয়া থাকে। এই সময়ে, পশ্চাদ্ভাগ হইতে কোনও ব্যক্তি, আমার নাম গ্রহণ ও সপ্রণয় সম্ভাষণ করিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, ভ্রাতঃ। তুমি কেমন আছ। সেখানে, আমায় এরূপে সম্ভাষণ করেন, ঈদৃশ ব্যক্তি কেহ ছিলেন না, সুতরাং, আমি চকিত হইয়া মুখ ফিরাইলাম, দেখিলাম, তথাকার এক কর্ম্মকর আমার নিকট আসিতেছেন। তিনি অবিলম্বে আমার সম্মুখবর্তী হইয়া বলিলেন, কি হে, আমায় চিনিতে পারিতেছেন না? কিয়ৎক্ষণ অনিমিষ-নয়নে নিরীক্ষণ করিয়া আমি ঐ ব্যক্তিকে চিনিতে পারিলাম, দেখিলাম, আমার বহু কালের বন্ধু কৌণ্ট আল্বার্ট সম্ভাষণ করিতেছেন। তোমার অবশ্যই স্মরণ হইবে, তিনি বিয়েনার রাজসভার একজন প্রসিদ্ধ পারিষদ, সর্ব্বদা প্রফুল্লচিত্ত, সর্ব্বলোকের হৃদয়রঞ্জন, এবং স্ত্রী পুরুষ উভয় জাতির আদর ও প্রশংসার আস্পদ ছিলেন। আমি, অনেক বার, তোমার মুখে তাঁহার প্রশংসা শুনিয়াছি, তুমি বলিতে, তিনি ইদানীন্তন কালের অলঙ্কারস্বরূপ, দয়া ও সৌজন্যের অদ্বিতীয় আকরস্বরূপ, স্বীয় প্রভূত সম্পত্তি কেবল দীনের দুঃখবিমোচনে নিয়োজিত রাখিয়াছেন।
তাঁহার ঈদৃশ অসম্ভাবিত দুরবস্থা দর্শনে, আমি, নিতান্ত শোকাক্রান্ত ও একান্ত হতবুদ্ধি হইযা, দণ্ডায়মান রহিলাম, আমার মুখ হইতে বাক্যনিঃসরণ হইল না, নয়ন হইতে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে, শোকসংবরণ করিয়া, তাঁহার ঈদৃশ দশা ঘটিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, কিছুদিন হইল, কোনও কাবণে, এক সেনাপতির সহিত আমার বিবাদ উপস্থিত হয়, অপমানবোধ হওয়াতে সম্রাটের আদেশ অমান্য করিয়া, তাহার সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হই, এবং তাহার প্রাণসংহার করিয়াছি স্থির করিয়া, পলাইয়া, ইষ্ট্রিয়ার জঙ্গলে লুকাইয়া থাকি। রাজপুরুষেরা অনুসন্ধান করিয়া, আমাকে অবরুদ্ধ কবে। ঐ স্থানে কতকগুলি দুর্দ্দান্ত দস্যু বাস করিত। তাহারা, রাজপুরুষদিগের হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া, আমায় আশ্রয় দেয়। তাহাদের সহবাসে নয় মাস অতিবাহিত করি। এই দস্যুরা সন্নিহিত জনপদে অত্যন্ত দৌরাত্ম্য করিত। তাহাদের দমনের নিমিত্ত, একদল সৈন্য প্রেরিত হয়। দস্যুদলে ও সৈন্যদলে ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল। অবশেষে, দস্যুদলের অধিকাংশ নিধনপ্রাপ্ত হইল। হতাবশিষ্ট দস্যুদিগের সহিত ধৃত ও প্রাণদণ্ডার্থে রাজধানীতে নীত হইলাম। তথায় উপস্থিত হইলে, সকলে আমায় চিনিতে পারিল। বন্ধুবর্গের সবিশেষ অনুরোধে, আমার প্রাণদণ্ড রহিত হইয়া, যাবজ্জীবন এই স্থানে রুদ্ধ থাকিয়া, কর্ম্ম করিবার আদেশ হইয়াছে।
এইরূপে, আলবর্টি আমার নিকট স্বীয় অবস্থার বর্ণন করিতেছেন, এমন সময়ে সেই স্থলে এক স্ত্রীলোক উপস্থিত হইলেন। তাঁহার আকার প্রকার দেখিবামাত্র, আমার স্পষ্ট বোধ হইল, ইনি সামান্য নারী নহেন, অবশ্যই কোনও সম্ভ্রান্ত লোকের কন্যা হইবেন। তাদৃশ ভয়ঙ্কর স্থানে থাকাতে ও দুঃসহ ক্লেশ ভোগ করাতেও, তাঁহাব অসামান্য রূপলাবণ্য এক কালে লয়প্রাপ্ত হয় নাই, তখনও তাঁহার রূপে বিলক্ষণ মাধুরী ও মোহনী শক্তি ছিল। ফলতঃ, তিনি জর্ম্মনির এক অতি সম্ভ্রান্ত কুলের কন্যা, কৌণ্ট আল্বর্টির সহধর্ম্মিণী। তিনি অত্যন্ত পতিপরায়ণা, যাহাতে পতির অপরাধ-মার্জ্জনা হয়, প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। অবশেষে, অন্য কোনও উপায় না দেখিয়া, তদীয় বিরহে প্রাণধারণ করা অসাধ্য ভাবিয়া, সমদুঃখভাগিনী হইবার নিমিত্ত, তাঁহার সহিত এই ভয়ঙ্কর স্থানে আসিয়া রহিয়াছেন। তিনি, তাঁহার সহবাসে, সন্তুষ্ট চিত্তে, কালহরণ করিতেছেন, তাহার সহিত আকরে কর্ম্ম করিতেছেন। পূর্ব্বতন সুখসৌভাগ্যের অবস্থা, একক্ষণের জন্যও, তাঁহার মনে উদিত হয় না। এরূপ স্ত্রীলোককেই পতিব্রতা কামিনী বলে। আমি, ইঁহার আচরণ দর্শনে, মোহিত ও চমৎকৃত হইযাছি।
এই আকরের অনতিদূরে এক ক্ষুদ্র গ্রাম আছে। কতিপয় দিন আমি তথায় অবস্থিতি করি। একদিন, তিন ব্যক্তি বিয়েনা হইতে আসিয়া, আমার পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে উত্তীর্ণ হইলেন, এবং তত্রত্য লোকের নিকট হতভাগ্য কৌণ্ট আল্বর্টির বিষয়ে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। আমি শ্রবণমাত্র সেই গৃহে উপস্থিত হইলাম, এবং যে রূপে যে অবস্থায় তাঁহাদের স্ত্রীপুরুষকে দেখিয়া আসিয়াছিলাম, সজল-নয়নে তাহার সবিশেষ বর্ণন করিলাম, অনন্তর, জিজ্ঞাসা করিয়া, জানিতে পাবিলাম, এই তিন জনের মধ্যে এক ব্যক্তি আল্বর্টির পরম বন্ধু, দ্বিতীয় ব্যক্তি তাঁহার সহধর্ম্মিণীর সহোদর, তৃতীয় ব্যক্তি তাঁহার পিতৃব্যপুত্র। আল্বর্টি, যে সেনাপতির সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া, এইরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াছেন, তিনি হত হয়েন নাই, আহতমাত্র হইয়াছিলেন। সেনাপতি, সুস্থ হইয়া, আল্বর্টির অপরাধ-মার্জ্জনার প্রার্থনা করাতে, সম্রাট তাঁহাকে ক্ষমা করিয়াছেন। তদনুসারে, ইঁহারা তিনজনে তাঁহাদের স্ত্রীপুরুষকে লইয়া যাইতে আসিযাছেন।
এই সংবাদ শুনিয়া, আমি আহ্লাদে পুলকিত হইলাম, ক্ষণবিলম্ব ব্যতিরেকে, তাঁহাদিগকে আকরে লইযা গেলাম, আল্বর্টি ও তাঁহার সহধর্ম্মিণীকে এই শুভসংবাদ দিলাম। শুনিয়া, ও এই তিন জন আত্মীয়কে দেখিয়া, তাঁহারা যে অনির্ব্বচনীয় আনন্দের অনুভব করিলেন, তাহার বর্ণন করিতে পারা যায় না। বহির্গমনোপযোগী বেশপরিবর্ত্রন প্রভৃতিতে কতিপয় দণ্ড অতিবাহিত হইল। যখন, তাঁহারা স্ত্রীপুরুষে, তত্রত্য সহচরদিগের নিকট বিদায় লইতে লাগিলেন, আমি দেখিয়া আহ্লাদে অধীর হইয়া, অশ্রুবিসর্জ্জন করিতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে, আমরা সেই ভয়ঙ্কর স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আল্বর্টি ও তাঁহার সহধর্ম্মিণী বহুদিবসের পর, সূর্য্যের মুখ দেখিতে পাইলেন। রাজধানীতে প্রতিগমন করিয়া, তাঁহারা স্ত্রীপুরুষে পুনরায় রাজপ্রসাদভাজন, পূর্ব্বতন পদে প্রতিষ্ঠিত ও প্রভূত সম্পত্তিতে অধিকারী হইয়াছেন, এবং পরম সুখে কালযাপন করিতেছেন।