আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/দস্যু ও দিগ্বিজয়ী
দস্যু ও দিগ্বিজয়ী
মাসিডোনিয়ার অধীশ্বর, প্রসিদ্ধ দিগ্বিজয়ী, মহাবীর আলেকজাগুরের অধিকারকালে, থ্রেস্ দেশে এক অতি পরাক্রান্ত দুর্দ্দান্ত দস্যু ছিল। ঐ দস্যুর দৌরাত্মে, থ্রেস্ ও তৎপার্শ্ববর্ত্তী প্রদেশ সকল কম্পিত হইযাছিল। একদা, সে ধৃত ও আলেকজাণ্ডারের সম্মুখে নীত হইলে, তিনি সরোষ নয়নে ও উদ্ধত বচনে বলিতে লাগিলেন, অরে দুরাত্মন্, তুই দস্যুবৃত্তি করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করিস্। সর্ব্বদাই তোর অশেষবিধ অত্যাচারের কথা শুনিতে পাই। আমি, বহুদিন অবধি তোরে ধরিবার চেষ্টা করিতেছিলাম, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। আজ তুই আমার সম্পূর্ণ বশে আসিয়াছিস্, তোরে সমুচিত শাস্তিপ্রদান করিব। এক্ষণে, তুই আপন সবিশেষ পরিচয় দে।
এই কথা শুনিয়া, সেই দস্যু, কিঞ্চিম্মাত্র ভীত বা ক্ষুব্ধ না হইয়া, বলিল, আমি থ্রেসদেশনিবাসী একজন প্রসিদ্ধ যোদ্ধা। আলেকজাণ্ডর বলিলেন, অরে নরাধম, তুই যোদ্ধা বলিয়া পরিচয় দিতেছিস্? তুই চোর, তুই দস্যু, তুই লুণ্ঠনব্যবসায়ী, তুই হত্যাকারী, তুই দেশের কণ্টকস্বরূপ। তোর অসাধারণ সাহস আছে, এজন্য আমি তোর প্রশংসা করি। কিন্তু, তুই অতি দুরাচার ও সর্ব্বসাধারণের যার পর নাই অনিষ্টকারী, এজন্য আমি অবশ্যই তোরে ঘৃণা করিব ও সমুচিত শাস্তি দিব।
ইহা শুনিয়া, দস্যু বলিল, আমি কি করিয়াছি যে, আপনি আমায় এত ভৎসনা করিতেছেন? তিনি বলিলেন, তুই, আমার অধিকারে বাস করিয়া, আমার প্রভুশক্তির অবমাননা করিয়াছিস, এবং আমার প্রজাগণের প্রাণহিংসা ও সর্ব্বস্বলুণ্ঠন করিয়া কালযাপন করিস্। দস্যু বলিল, এক্ষণে আমি আপনকার বশে আসিয়াছি, সুতরাং আপনি যে তিরস্কার, যে অপমান বা যে শাস্তি প্রদান করিবেন, আমায় সে সমস্ত সহ্য করিতে হইবে, আমি সেজন্য কিঞ্চিম্মাত্র শঙ্কিত বা দুঃখিত নহি। কিন্তু, যদি আমায় আপনকার ভর্ৎসনাবাক্যের উত্তর দিতে হয়, আমি অকুতোভয়ে দিব।
আলেকজাণ্ডর বলিলেন, যাহা বলিতে হয়, স্বচ্ছন্দে বল, কোনও ব্যক্তি আমার বশে আসিয়াছে বলিয়া যে, তাহাকে অকুতোভয়ে কথা কহিতে দিব না, আমার সেরূপ রীতি বা প্রকৃতি নহে। দস্যু বলিল, তবে অগ্রে আমি আপনকার প্রতি এক প্রশ্ন করিব, পরে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিব। আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কিরূপে কালযাপন করিতেছেন? তিনি বলিলেন, বীর-পুরুষের ন্যায়, দেশে দেশে আমার নাম ও কীর্ত্তি ঘোষিত হইতেছে, আমার তুল্য সাহসী, পরাক্রান্ত সম্রাট ও দিগ্বিজয়ী আর কে আছে?
দস্যু বলিল, আমার আত্মশ্লাঘা করিতে ইচ্ছা নাই, আর, যাহারা আত্মশ্লাঘা করে, তাহাদিগকে ঘৃণা করি। কিন্তু, এ সময়ে বলা আবশ্যক, এজন্য বলিতেছি, আমারও বহুদূর পর্যন্ত নাম ও কীর্ত্তি ঘোষিত হইযাছে, আর, আমার তুল্য সাহসী সেনাপতি আর কেহই নাই। আপনি বিলক্ষণ অবগত আছেন, আমি সহজে বিজিত ও আপনকার বশে আনীত হই নাই।
আলেকজাণ্ডর বলিলেন, তুই যত বল্ না কেন, তুই পাপাশ্য় দুর্বৃত্ত দস্যু ব্যতিরিক্ত আর কিছুই নহিস। দস্যু বলিল, আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, দিগ্বিজয়ী কাহাকে বলে? আপনি দিগ্বিজয়ী, আপনি কি অকিঞ্চিৎকর আধিপত্যলাভের দুরাশাগ্রস্ত হইয়া, অন্যায় পথ অবলম্বন পূর্ব্বক মানবমণ্ডলীর প্রাণবধ, সর্ব্বস্বলুণ্ঠন প্রভৃতি অশেষবিধ উৎকট অনিষ্টাচরণ করেন নাই? আমি শত সহচর সমভিব্যাহারে এক প্রদেশে যাহা করিযাছি, আপনি লক্ষ সহচর সমভিব্যাহারে শত শত প্রদেশে তাহাই করিয়াছেন। আমি কতিপয় সামান্য ব্যক্তির সর্বনাশ করিয়াছি, আপনি শত শত ভূপতির সর্ব্বনাশ করিয়াছেন। আমি কতিপয় সামান্য গৃহের উচ্ছেদসাধন করিযাছি, আপনি কত সমৃদ্ধ রাজ্য ও কত সমৃদ্ধ নগরীর উচ্ছেদসাধন করিয়াছেন। এক্ষণে, বিবেচনা করিয়া দেখুন, আমাতে ও আপনাতে বিশেষ কি? তবে, আমি সামান্য-কুলে জন্মিয়াছি, এবং সামান্য দস্যু বলিয়া পরিচিত হইয়াছি। আপনি বিখ্যাত-কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, এবং সেইজন্য, আমা অপেক্ষা প্রবল ও পরাক্রান্ত দস্যু হইযাছেন, এইমাত্র বিশেষ।
আলেকজাণ্ডর বলিলেন, আমি অন্যের ধন লইয়াছি বটে, কিন্তু অকাতরে সেই ধনের বিতরণ করিয়াছি। আমি কোনও কোনও রাজ্যের ও নগরের উচ্ছেদ করিয়াছি বটে, কিন্তু কত শত সমৃদ্ধ রাজ্য ও নগর সংস্থাপিত করিয়াছি। তদ্ব্যতিরিক্ত, আমার যত্নে ও উৎসাহদানে শিল্প, বাণিজ্য ও দর্শনশাস্ত্রের কত উন্নতি হইয়াছে। দস্যু বলিল, আমি ধনৰানের ধনহরণ করিযাছি বটে, কিন্তু, সেই ধন অকাতরে অনেক দরিদ্রকে দান করিয়াছি। আমি কখনও কাহারও গৃহদাহ করিয়াছি বটে, কিন্তু নিজ অর্থ দিয়া, অনেক অনাথের গৃহনির্মাণ করিয়া দিয়াছি। আমি অন্যের উপর অত্যাচাব করিয়াছি বটে, কিন্তু অনেক বিপন্ন ব্যক্তির বিপদুদ্ধার করিয়াছি। আপনি যে দর্শনশাস্ত্রের উল্লেখ করিলেন, আমি তাহার কিছুমাত্র জানি না বটে, কিন্তু ইহা স্থির জানি, আমি অথবা আপনি জগতের যত অনিষ্ট করিয়াছি, আমরা কিছুতেই তাহার প্রতিবিধান করিতে পারিব না।
দস্যু এইরূপ অকুতোভয়তা ও স্বরূপবাদিতা দর্শনে, আলেকজাণ্ডার পর নাই প্রীতি প্রাপ্ত হইলেন, তৎক্ষণাৎ তাহার বন্ধনমোচনের এবং সমুচিত পরিচর্যার আদেশপ্রদান করিলেন, অনন্তর, একান্তে আসীন হইয়া, দস্যু ও দিগ্বিজয়ীর বিশেষ কি, নিবিষ্টচিত্তে, এই বিষয়ে চিন্তা করিতে লাগিলেন।