আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/পতিপরায়ণতার একশেষ
পতিপরায়ণতার একশেষ
জর্ন্মনির অধীশ্বর তৃতীয় কনরাদের অধিকারকালে, বাবেরিয়ার ডিয়ুক গুযেলফু, বিদ্রোহী হইযা সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। কনরাদ, তাঁহার দমনের নিমিত্ত, বহুসংখ্যক সৈন্য সমভিব্যাহারে, উইন্সবর্গের দুর্গমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে, সেই দুর্গ অবরুদ্ধ করিলেন। গুয়েলফ্, কিছু দিন বিলক্ষণ সাহস ও পরাক্রম প্রদর্শিত করিয়া, পরিশেষে, পরাজিত হইলেন, এবং ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া, সম্রাটের নিকট দূতপ্রেরণ করিলেন।
দূত, সম্রাটের শিবিরে উপস্থিত হইযা, ডিয়ুকের প্রার্থনা নিবেদন করিল। তিনি, দূতের প্রতি সমুচিত সৌজন্য ও সমাদর প্রদর্শিত করিয়া, বলিলেন, তুমি ডিষুককে বল, তিনি, স্বীয় সৈন্য ও অনুচরবর্গ সমভিব্যাহারে, আমার শিবিরের মধ্য দিয়া প্রস্থান ককন, আমি অঙ্গীকার করিতেছি, তাঁহার উপর, কোনও প্রকারে, অত্যাচার করিব না। দূত, দুর্গমধ্যে প্রতিগমন করিয়া, স্বীয় প্রভুর নিকট সবিশেষ সমস্ত নিবেদন করিল। ডিয়ুক ও তদীয় সেনাপতিগণ শুনিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, এবং অবিলম্বে প্রস্থান করিবার উদেযাগ দেখিতে লাগিলেন।
এই সংবাদ শ্রবণে সন্দিহান হইয়া, ডিযুকের পত্নী মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, আমার স্বামী সম্রাটের সম্পূর্ণ বিপক্ষতাচরণ করিয়াছেন, এক্ষণে তিনি যে সহসা এরূপ সৌজন্যপ্রদর্শন করিতেছেন, উহা, বোধ হয় বাস্তবিক নহে, ইহাতে কোনও গূঢ় অভিসন্ধি আছে, হ্য়ত আমরা দুর্গ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলে, আমাদিগকে আক্রমণ করিবেন। এই সন্দেহভঞ্জনের নিমিত্ত, তিনি আপনার বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ, কার্য্যদক্ষ, এক ভদ্র লোককে সম্রাটের নিকট পাঠাইলেন।
এই ব্যক্তি, রাজসমীপে উপস্থিত হইয়া, নিবেদন করিলেন, মহারাজ, আপনি যে, ভিযুকের প্রার্থনা অনুসারে, দয়াপ্রদর্শন করিয়াছেন, ইহাতে তিনি ও তদীয় অনুচরবর্গ চরিতার্থ হইয়াছেন। ডিযুকের পত্নী আপনকার নিকট আর এক প্রার্থনা জানাইয়াছেন, নিবেদন করি, তিনি বলিয়াছেন, আপনি যে আমার স্বামীর প্রতি ক্ষমাপ্রদর্শন করিয়াছেন, ইহাতে আমরা সকলে চরিতার্থ হইয়াছি, এক্ষণে দুর্গমধ্যে যে সকল সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোক আছেন, তাঁহারা ও আমি দুর্গ হইতে নির্গত হইলে, যাহাতে আমাদের উপর কোনও অত্যাচার না হয়, এবং যাহাতে নির্বিঘ্নে কোনও নিরাপদ স্থানে পঁহুছিতে পারি, এরূপ এক অনুমতিপত্র লিখিয়া দিলে, আমরা নির্ভয়ে প্রস্থান করিতে পারি, আর ঐ অনুমতিপত্রে ইহাও নির্দিষ্ট থাকে, আমরা নিজে যাহা লইয়া যাইতে পারি, তাহা লইয়া যাইব, সে বিষয়ে কোনও আপত্তি না ঘটে।
ডিয়ুকপত্নীর প্রার্থনা শুনিয়া, সম্রাট তৎক্ষণাৎ তদ্বিষয়ে সম্মতিপ্রদান করিলেন। অসম্ভব, ভিয়ুক্ ও তদীয় অনুচরবর্গ দুর্গমধ্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন, এবং সম্রাটের শিবিরের মধ্য দিয়া প্রয়াণ করিতে লাগিলেন। সম্রাট ও তাঁহার সেনাপতিগণ, এক অভূতপূর্ব্ব ব্যাপার নয়নগোচর করিয়া, যৎপরোনাস্তি বিস্ময়াপন্ন হইলেন। তাঁহারা দেখিলেন, সর্বাগ্রে ডিয়ুকের পত্নী, তৎপশ্চাৎ ক্রমে ক্রমে অপরাপর সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোক, স্ব স্ব স্বামীকে স্কন্ধে লইয়া অতি কষ্টে প্রস্থান করিতেছেন।
যৎকালে ডিয়ুকের পত্নী, সম্রাটের নিকট অনুমতিপত্রের প্রার্থনা করিয়া পাঠান, তিনি ও তদীয় সেনাপতিগণ এই বিবেচনা করিয়াছিলেন যে, বসন ভূষণ প্রভৃতি যে সমস্ত মহামূল্য বস্তু আছে, তৎসমুদয় নির্বিঘ্নে লইয়া যাইবার অভিপ্রায়েই, ভিযুকপত্নী তাদৃশ অনুমতিপত্রের প্রার্থনা করিয়াছেন, তৎপরিবর্ত্তে তাঁহারা যে স্ব স্ব স্বামীকে স্কন্ধে করিয়া লইয়া যাইবেন, ইহা, এক মুহূর্ত্তের জন্যও, তাঁহাদের মনে উদিত হয় নাই। এক্ষণে, তাঁহাদের পতিপরায়ণতার ঐকান্তিকতা দর্শনে, সম্রাটের অন্তঃকরণে নিরতিশয় দয়া, বিস্ময় ও সন্তোষের আবির্ভাব হইল। তিনি সেই স্ত্রীলোকদিগকে, মুক্তকণ্ঠে, শতশত সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।
ফলতঃ, এই অদৃষ্টচর অশ্রুতপূর্ণ ব্যাপার দৃষ্টিগোচর করিয়া, সম্রাট এত প্রীত ও চমৎকৃত হইয়াছিলেন যে, সেই খ্রীলোক দিগের অভূত পতিপরায়ণতার পুরস্কারস্বরূপ, তাঁহাদের পতিদিগের অপরাধ মার্জ্জনা করিলেন, ডিযুক ও তদীয় অনুচরবর্গের প্রস্থান স্থগিত করিয়া, তাঁহাদিগকে পরম সমাদরে ও মহাসমারোহে আহার করাইলেন, এবং সরল অন্তঃকরণে, সম্পূর্ণ অভয়প্রদান করিয়া, বিদায় দিলেন।