আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/পুরুষজাতির নৃশংসতা
পুরুষজাতির নৃশংসতা
ইংলণ্ডের রাজধানী লণ্ডন নগরে, তামস্ ইঙ্কল্ নামে এক ব্যক্তি ছিল। সে সঙ্গতিপন্ন লোকের সন্তান, যাহাতে সে উপার্জ্জনে ও লাভালাভপরিদর্শনে সম্যক সমর্থ হয়, তাহার পিতা তাহাকে বিলক্ষণরূপে তদুপযোগিনী শিক্ষা দিয়াছিলেন। ইঙ্কলের পিতা যথেষ্ট সঙ্গতি করিয়া গিয়াছিলেন, তথাপি সে অর্থলোভের বশীভূত হইয়া, অধিকতর উপার্জ্জনের অভিলাষে, বিংশতি বৎসর বয়ঃক্রমকালে আমেরিকায় প্রস্থান করিল। ইঙ্কল যে অর্ণবপোতে যাইতেছিল, খাদ্যসামগ্রীর অসদ্ভাব উপস্থিত হওয়াতে; তৎসংগ্রহার্থে উহা আমেরিকার এক স্থানে গিয়া নঙ্গর করিল। অর্ণবপোতস্থিত অনেকেই তীরে অবতীর্ণ হইল, এবং ইতস্ততঃ ভ্রমণ ও অবলোকন করিতে লাগিল। তন্মধ্যে ইঙ্কল্ প্রভৃতি কতিপয় ব্যক্তি, অপরিজ্ঞাতরূপে অনেক দূর পর্যন্ত গমন করিয়াছিল।
ইতঃপূর্ব্বে, য়ুরোপীয়েরা আমেরিকার আদিম নিবাসীদিগের সর্ব্বনাশ করিয়াছিলেন, এজন্য উহারা তাঁহাদের উপর খড়্গহস্ত হইয়াছিল, সুযোগ পাইলে বৈরসাধনের ত্রুটি করিত না। কতিপয় য়ুরোপীয়কে তীরে উঠিয়া ভ্রমণ করিতে দেখিয়া, উহারা অস্ত্র লইয়া তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করিল। অনেকেই পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল; একমাত্র ইঙ্কল্, পলাইয়া অলক্ষিতরূপে সন্নিহিত অরণ্যে প্রবেশ করিল, এবং প্রাণভয়ে দ্রুতপদে ধাবমান হইয়া, অরণ্যের অতি নিবিড় অংশে উপস্থিত হইল। ভয়ে ও শ্রমে সে নিতান্ত নির্বীর্য্য হইয়াছিল, এক গণ্ডশৈলের নিকটে গিয়া, আর চলিতে না পারিয়া ভূতলে পতিত হইল।
এই সময়ে, ঐ প্রদেশের অধিপতির কন্যা ইয়ারিকোনাম্নী কামিনী, যদৃচ্ছাক্রমে সেই স্থানে ভ্রমণ করিতে আসিযাছিল। সে ঐ স্থানে উপস্থিত হইযা এক য়ুরোপীযকে মৃতকল্প পতিত দেখিয়া, প্রথমতঃ চকিত হইযা উঠিল, কিন্তু তদীয় আকার দর্শনে বুঝিতে পারিল, এ ব্যক্তি বিপদগ্রস্ত হইয়া এরূপ অবস্থাপন্ন হইয়াছে। স্ত্রীজাতির অন্তঃকরণ স্বভাবতঃ দয়ার্দ্র ও স্নেহপূর্ণ। ইঙ্কলের এই অবস্থা দেখিয়া,ইয়ারিকোর অন্তঃকরণে স্নেহ ও দয়ার সঞ্চার হইল। তখন সে, সঙ্কেতবিশেষ দ্বারা অভয়প্রদান করিয়া, ইঙ্কলকে এক গিরিবিবরে লইয়া গেল। সে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় অতিশয় কাতর হইয়াছে বুঝিতে পারিয়া, স্বল্প সময়ের মধ্যে সুস্বাদু ফল মূল সংগৃহীত করিয়া, আহারার্থে প্রদান করিল, এবং পানার্থে এক নির্মল নির্ঝর দেখাইয়া দিল। এইরূপে ক্ষুন্নিবৃত্তি ও পিপাসা-শান্তি হইলে, ইঙ্কলের শরীরে বলাধান হইল, তখন সে, সঙ্কেত দ্বারা সেই কামিনীর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে ইয়ারিকো তথা হইতে প্রস্থান করিল, এবং একখানি সুদৃশ্য পশুচর্ম্ম আনিয়া, তাহার শয়নার্থে প্রদান করিল। সে দিবস সায়ংকাল পর্য্যন্ত সেই স্থানে থাকিয়া, তাহাকে সঙ্কেত দ্বারা অভয়প্রদান পূর্বক, ঐ নিভৃত স্থানে রাত্রিযাপন করিতে বলিয়া, ইযারিকো স্বীয় আবাসে প্রতিগমন করিলে, ইঙ্কল্ একাকী সেই গুহাগৃহে রজনীযাপন করিল।
পরদিন প্রভাত হইবামাত্র, ইয়ারিকো ইঙ্কলের নিকট উপস্থিত হইল, এবং অবণ্য হইতে নানাবিধ সুরস ফল মূলের আহরণ করিয়া, আহারার্থে প্রদান করিল। তাহার আহার সমাপ্ত হইলে, ইযারিকো তদীয় সন্নিকটে উপবিষ্ট হইল। ইঙ্কল্ অতি সুশ্রী সুগঠন পুরুষ। কিয়ৎ ক্ষণ অবিচলিতনয়নে অবলোকন করিয়া, ইয়ারিকো তাহার হস্তগ্রহণ পূর্ব্বক, আপনার হস্তের সহিত তুলনা করিতে লাগিল, তাহার বক্ষঃস্থলের বসনোদ্ঘাটন করিয়া নিরীক্ষণ করিল, পরে তাহার চিবুক ধরিয়া, মুখ, নাসিকা, নয়ন প্রভৃতি প্রত্যেক অবয়বেব পরীক্ষা করিতে লাগিল। ইয়ারিকোর নিতান্ত ইচ্ছা, তাহার সহিত কথোপকথন করে, কিন্তু, পরস্পরের ভাষার বিজাতীয় বিভিন্নতা প্রযুক্ত তাহা সম্পন্ন হইয়া উঠিল না। ফলতঃ, ক্রমে ক্রমে ইঙ্কলের উপর ঐ কামিনীর নিরতিশয় স্নেহ ও অনুরাগ জন্মিল।
এইরূপে কতিপয় দিবস অতিবাহিত হইলে, তাহাদের পরস্পর বিলক্ষণ সদ্ভাব ও প্রণয় জন্মিয়া উঠিল, এবং ক্রমে ক্রমে উভয়েই উভয়ের ভাষা কিছু কিছু বুঝিতে পারিতে লাগিল। একদিন উভয়ে উপবিষ্ট হইয়া কথোপকথন করিতেছে, এমন সময়ে ইঙ্কল্ পরিণয় প্রস্তাব করিল। ইয়ারিকো সম্মতিপ্রদর্শন করিলে, উভয়ে ধর্ম্মসাক্ষী করিয়া পরিণয়পাশে বদ্ধ হইল, এবং পরস্পর নিরতিশয় প্রণয়ে কালযাপন করিতে লাগিল। ইয়ারিকো, প্রায় সমস্ত দিন তাহার নিকটে থাকিয়া, তদীয় আহারাদির সমবধান করিয়া দিত, এবং ঐরূপ অবস্থায়, সে যতদূর সুখে, স্বচ্ছন্দে ও নিরাপদে কালযাপন করিতে পারে, তদ্বিষয়ে যথাশক্তি যত্ন ও চেষ্টার ত্রুটি করিত না।
এই ভাবে কতিপয় মাস অতিক্রান্ত হইলে, একদিন ইঙ্কল্ বলিল, দেখ, এ অবস্থায় কালযাপন করা অতিশয় কষ্টদায়ক, প্রাণভয়ে আমায় সদা সশঙ্ক থাকিতে হয়, আর তুমিও আমার নিমিত্ত নিয়ত ব্যাকুল ও শঙ্কাকুল থাক। যদি তোমার মত হয়, সুযোগক্রমে এখান হইতে প্রস্থান করি। যে স্থলে আমার স্বদেশীয়েরা আছেন, তথায় গেলে সকল কষ্ট ও সকল শঙ্কার নিবারণ হইয়া যায়। তুমি অসময়ে আশ্রয় দিয়া যেমন আমার প্রাণরক্ষা কবিয়াছ, এবং এতাবৎ কাল পর্য্যন্ত নির্বিঘ্নে ও সুখ-স্বচ্ছন্দে রাখিয়াছ, আমিও আপন আয়ত্ত স্থানে তোমায় তেমনই সুখে ও স্বচ্ছন্দে রাখিব। তুমি আমার প্রাণেশ্বরী, তোমায় পরিত্যাগ করিয়া যাইতে, আমার কোনও মতে ইচ্ছা নাই। আমি বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন লোক, আমার সমভিব্যাহারে গেলে, তুমি যাবজ্জীবন নিরতিশয় সুখসম্ভোগে কালহরণ করিতে পারিবে। তুমি এ বিষয়ে অসম্মত হইও না। ইয়ারিকো এই প্রস্তাবে সম্মতি প্রদর্শন করিলে, ইঙ্কল্ বলিল, অতঃপর তুমি প্রতিদিন সমুদ্রের তীরে যাইবে, এবং য়ুরোপীয় অর্ণবপোত দেখিতে পাইলে আমায় সংবাদ দিবে।
একদিন ইয়ারিকো, য়ুরোপীয় অর্ণবপোত দেখিতে পাইয়া ইঙ্কলকে সংবাদ দিলে, সে তৎসমভিব্যাহারে অর্ণবতীরে উপস্থিত হইল, এবং সঙ্কেতবিশেষ দ্বারা পোতস্থিত লোকদিগকে আপন গমনমানস জানাইল। একজন য়ুরোপীয়কে একাকী দেখিয়া, তাহারা তাহাকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত তৎক্ষণাৎ এক বোট পাঠাইয়া দিল। ইঙ্কল ও ইয়ারিকো, সেই বোটে আরোহণ করিয়া অর্ণবপোতে গমন কবিল। ঐ পোতে কতিপয় য়ুরোপীয়া কামিনী ছিলেন, ইয়ারিকো, তাহাদের পরিচ্ছদ, সমাদর ও আধিপত্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া মনে মনে বলিতে লাগিল, প্রিয়তমের আবাসে উপস্থিত হইলে, আমারও এইরূপ পরিচ্ছদ, সমাদর ও আধিপত্য হইবে। আমি অসভ্য জাতির কন্যা, সভ্যজাতীয়ের সহধর্ম্মিণী হইযা, অসুলভ সুখসম্ভোগে কালহরণ আমার ভাগ্যে ঘটিবে, ইহা আমি একদিন একক্ষণের জন্য মনে ভাবি নাই।
ঐ অর্ণবপোত বারবেড়োনামক স্থানে যাইতেছিল। ঐ প্রদেশ দাসদাসীবিক্রয়ের এক প্রধান স্থান। যে সকল য়ুরোপীয়েরা তথায় কৃষিব্যবসায় করিত, তাহাদের তৎসংক্রান্ত কর্ম্মনির্ব্বাহার্থে কর্ম্মকরের অত্যন্ত প্রয়োজন হইত, এজন্য য়ুরোপীয়েরা বলপূর্ব্বক, আফ্রিকা ও আমেরিকার আদিম নিবাসীদিগকে অর্ণবপোতে উঠাইয়া লইত, এবং আমেরিকার কৃষিব্যবসায়ী য়ুরোপীয়দিগের নিকট বিক্রয় করিত। সুতরাং তত্তৎপ্রদেশে অর্ণবপোত উপস্থিত হইলেই, ক্রেতৃগণ দাসক্রয়ার্থে আসিত। এই সময়ে দাসদাসীর সাতিশয় প্রয়োজন উপস্থিত হইয়াছিল, এজন্য ঐ জাহাজ নঙ্গর করিবামাত্র, ক্রেতৃগণ নৌকায় চড়িয়া জাহাজে উপস্থিত হইতে লাগিল। সে বার, ঐ জাহাজে বিক্রয়োপযোগী দাসদাসী ছিল না, সুতরাং তাহারা নিতান্ত হতাশ হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে ইয়ারিকোকে দেখিতে পাইয়া, এক ব্যক্তি তাহাকে ইঙ্কলের সম্পত্তি বলিয়া বুঝিতে পারিয়া, তাহার নিকটে ক্রয় প্রস্তাব কবিল। ইঙ্কল্ অসম্মতি প্রদর্শন করিলে, প্রথম প্রস্তাবিত ন্যূন মূল্যই অসম্মতির কারণ, এই বিবেচনা করিয়া সে একবারে অত্যন্ত অধিক মূল্যদানের প্রস্তাব করিল। ইঙ্কল্, কোনও ক্রমে বিক্রয় করিতে সম্মত হইল না। পরে সে বাসস্থান স্থির করিয়া, ইয়ারিকোকে লইয়া তথায় গমন করিল।
ইঙ্কলের অর্থলালসা অত্যন্ত প্রবল, অধিক অর্থলাভের অভিলাষেই, সে আমেরিকায় গমন করে। কিন্তু, দৈবঘটনায় এ পর্যন্ত উপার্জ্জন দূরে থাকুক, প্রাণান্ত ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা হইয়াছিল। যত দিন অরণ্যে ইয়ারিকোর আশ্রয়ে ছিল, বাঁচিয়া স্বদেশীয় সমাজে আসিতে পারে কি না, তাহারই নিশ্চয় ছিল না, সুতরাং তৎকালে লাভালাভের ভাবনা একবারও তাহার হৃদয়ে উদিত হয় নাই। এক্ষণে, ঐ সকল শঙ্কা একবারে নিবারিত হওয়াতে, সে অনুক্ষণ এই ভাবিতে লাগিল, যদি আমি বিপদগ্রস্ত না হইয়া, যথাকালে এই স্থানে আসিতে পারিতাম, তাহা হইলে এতদিন আমার কত লাভ হইত। এখন কি উপায়ে অপচয়পূরণ কবিব, এই চিন্তাই বিলক্ষণ বলবতী হইয়া উঠিল। আপাততঃ ক্ষতিপূরণের উপায়ান্তর না দেখিয়া, এক দিন সে মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, যদি ইয়ারিকোর সহবাস না ঘটিত, তাহা হইলে আমি কোনও ক্রমে সে অরণ্যে এতদিন থাকিতাম না, অবশ্যই সুযোগ করিয়া, অনেক পূর্ব্বে এখানে আসিয়া উপার্জ্জন করিতে পাবিতাম। বিবেচনা করিতে গেলে, উহার জন্যই আমার এত ক্ষতি হইয়াছে। সে দিবস এক ব্যক্তি উহাকে অনেক মূল্যে কিনিতে উদ্যত হইয়াছিল। এক্ষণে দাসদাসীর যেরূপ আবশ্যকতা দেখিতেছি, বোধ করি, তদপেক্ষা অধিক মূল্যে বিক্রয় করিতে পারিব, তাহা হইলে আপাততঃ কিয়ৎ অংশে ক্ষতিপূরণ হইবে।
এই স্থির করিয়া, সমধিক মূল্য পাইয়া, ইঙ্কল্ তত্রত্য এক দাসবণিকের নিকট ইয়ারিকোকে বিক্রয় করিল। ইয়ারিকো, এই সর্ব্বনাশ উপস্থিত দেখিয়া, বারংবার পূর্ব্ববৃত্তান্ত স্মরণ করাইতে লাগিল। ইঙ্কল্ তাহাতে কর্ণপাত করিল না। অবশেষে, তোমার সহযোগে আমার গর্ভ হইযাছে অন্ততঃ প্রসবকাল পর্য্যন্ত অপেক্ষা কর, এমন অবস্থায় আমার প্রতি এরূপ নৃশংস, আচরণ করা তোমার কদাচ উচিত নয়। কাতরবচনে গলদশ্রুলোচনে এই সকল কথা বলিয়া, ইয়ারিকো তাহার অন্তঃকরণে করুণা জন্মাইবাব যথেষ্ট চেষ্টা পাইল। কিন্তু তাহার নিষ্ঠুর অন্তঃকরণ পূর্ব্ববৎ অবিচলিতই রহিল, বরং গর্ভসংবাদ অবগত হইয়া, সে দাসক্রয়বিক্রয়ের নিয়মানুসারে, ক্রেতার নিকট অধিক মুল্যের প্রার্থনা করিতে লাগিল। ক্রেতা, তাহার প্রার্থনা পূর্ণ করিয়া, ক্রীত-দাসী লইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিল।