আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/মহানুভবতা

মহানুভবতা

ইটালির অন্তঃপাতী জেনোয়া প্রদেশের শাসনকার্য্য সর্ব্বতন্ত্র[১] প্রণালীতে সম্পাদিত হইত। কিন্তু, তত্রত্য সম্ভ্রান্ত লোকদিগের হস্তেই, সচরাচর শাসনকার্য্য ন্যস্ত থাকিত। সম্ভ্রান্ত মহাশয়েরা সকল বিষয়েই সম্পূর্ণ আধিপত্য করিতেন, এবং শ্রেণীস্থ লোকদিগের হিতসাধনপক্ষে যাদৃশ যত্ন ও আগ্রহ প্রদর্শন করিতেন, সর্ব্বসাধারণের পক্ষে কদাচ সেরূপ করিতেন না। এজন্য উভয় পক্ষের মধ্যে সর্ব্বদা বিষম বিরোধ উপস্থিত হইত। ফলতঃ, উভয় পক্ষই সুযোগ পাইলে, পরস্পর অহিতচিন্তনে ও অনিষ্টসাধনে পরাঙ্মুখ হইতেন না। একদা, সম্ভ্রান্ত লোকদিগকে অপদস্থ করিয়া, সাধারণ লোকে কতিপয় স্বপক্ষীয় কার্য্যদক্ষ ব্যক্তির হস্তে শাসনকার্য্যের ভারার্পণ করাতে, তাঁহারাই জেনোয়াসমাজের শাসনসংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার সম্পন্ন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের সর্ব্বপ্রধানের নাম য়ুবর্টো। তিনি অতি দীনের সন্তান, কিন্তু, স্বীয় বুদ্ধি, যত্ন ও পরিশ্রমের গুণে, বাণিজ্যব্যবসায় অবলম্বনপূর্ব্বক বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন ও অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন হইয়া উঠেন।

 কিছু দিন পরে, সম্ভ্রান্ত পক্ষ, সাধারণ পক্ষকে পর্য্যুদস্ত করিয়া, পুনরায় আপনাদের হস্তে শাসনকার্য্যের ভার গ্রহণ করিলেন। উত্তরকালে আর তাঁহাদিগকে কোনও ক্রমে পর্য্যুদস্ত হইতে না হয়, এজন্য তাঁহারা সাধারণপক্ষীয় প্রধান ও ক্ষমতাপন্ন লোকদিগের দমন করিতে আরম্ভ করিলেন, সর্ব্বপ্রধান য়ুবর্টোকে সর্ব্বতন্ত্রবিদ্রোহী বলিয়া অবরুদ্ধ করাইলেন, এবং তাঁহার সর্বস্বহরণ করিয়া, সর্ব্বতন্ত্রের অধিকারসীমা হইতে নির্বাসনের আদেশপ্রদান করিলেন। এই আদেশ স্বকর্ণে শ্রবণ করিবার নিমিত্ত, য়ুবর্টো প্রধান বিচারকের নিকট আনীত হইলেন। সন্ত্রান্তপক্ষীয় এডর্ণোনামক এক ব্যক্তি প্রধান বিচারক ছিলেন, তিনি বিচারাসন হইতে গর্ব্বিতবাক্যে সম্বোধন করিয়া য়ুবর্টোকে বলিলেন, অরে পাপিষ্ঠ নরাধম, তুই অতি নীচের সন্তান, কিঞ্চিৎ অর্থসঞ্চয় করিয়া তোর এত আশা বাড়িয়াছিল যে, তুই আপন পূর্ব্বতন অবস্থার বিস্মরণপূর্ব্বক, সম্ভ্রান্ত লোকদিগকে অপদস্থ ও অবমানিত করিতে উদ্যত হইয়াছিলি। কিন্তু তাঁহারা তোর প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহপ্রদর্শন করিয়াছেন, তোর যেমন অপরাধ, তদুপযুক্ত দণ্ডবিধান না করিয়া, তোরে কেবল পূর্ব্বতন অবস্থায় স্থাপিত ও জেনোয়ার অধিকার হইতে নির্বাসিত করিলেন।

 এইরূপ গর্ব্বিত ভর্ৎসনাবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, য়ুবর্টো কোনও প্রকারে ঔদ্ধত্য বা কোপচিহ্ন প্রদর্শিত করিলেন না, বিচারকের আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া লইলেন, কিন্তু এডর্ণোকে এই মাত্র বলিলেন, আপনি আমার প্রতি যে সকল পরুষ ভাষার প্রয়োগ করিলেন, হয় ত ইহার নিমিত্ত উত্তরকালে আপনাকে অনুতাপ করিতে হইবে। অনন্তর, তিনি নেপল্‌স প্রস্থান করিলেন। তত্রত্য কতিপয় বণিক্ তাঁহার নিকট ঋণী ছিলেন। তাঁহারা সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, স্ব স্ব ঋণের পরিশোধ করিলেন। এইরূপে কিছু অর্থ হস্তগত হওয়াতে, তিনি এক সন্নিহিত দ্বীপে গমন করিলেন, এবং তন্মাত্র অবলম্বনপূর্ব্বক পুনর্বার বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হইয়া, অসাধারণ বুদ্ধি, ক্ষমতা ও পরিশ্রমের গুণে, অল্প দিনের মধ্যে বিলক্ষণ সম্পত্তিশালী হইয়া উঠিলেন।

 বিষয়কার্য্যের অনুরোধে, য়ুবর্টো সর্ব্বদা যে সকল স্থানে যাতায়াত করিতেন, তন্মধ্যে টিউনিস্ নগর মুসলমানদের অধিকৃত। মুসলমানেরা খৃষ্ট-ধর্ম্মাবলম্বীদিগের বিষম বিদ্বেষী। তৎকালে তাঁহাদের এই রীতি ছিল, যুদ্ধে পরাজিত খৃষ্টীয়দিগকে বন্দী করিয়া আনিতেন, এবং তাহাদিগকে দাস ও লৌহশৃঙ্খলে বন্ধ করিয়া, রাজদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদিগের ন্যায়, অতি নিকৃষ্ট কষ্টদায়ক কর্ম্মে নিযুক্ত বাখিতেন। একদা, য়ুবর্টো এই নগরে গিয়া, তত্রত্য এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেছেন, এমন সময়ে দেখিতে পাইলেন, এক অল্পবয়স্ক খৃষ্টীয় দাস পথের ধারে মাটি কাটিতেছে। তাহার দুই চরণ লৌহশৃঙ্খলে বদ্ধ। তদীয় আকার প্রকার দেখিয়া, ভদ্রসন্তান বলিয়া স্পষ্ট প্রতীতি হইল। যেরূপ কষ্টসাধ্য কর্ম্মে নিযুক্ত আছে, সে কোনও ক্রমে তাহা করিতে পারিতেছে না, এক এক বার কর্ম্ম করিতেছে, এক এক বার বিরত হইয়া দীর্ঘনিশ্বাসত্যাগ ও অশ্রুবিসর্জ্জন করিতেছে।

 এই ব্যাপার দর্শনে, য়ুবর্টোর অন্তঃকরণে সাতিশয় দয়ার উদয় হইল। তিনি ইটালিক ভাষায় তাহার পরিচয জিজ্ঞাসা করিলেন। সে, স্বদেশীয় ভাষাশ্রবণে, স্বদেশীয়জ্ঞানে তাঁহার দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল, এবং শোকাকুলবচনে আপন দুরবস্থার পরিচয় দিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ কথোপকথনের পর সে বলিল, আমি জেনোয়ার প্রধান বিচারক এডর্ণোর পুত্র।

 এই কথা কর্ণগোচর হইবামাত্র, নির্বাসিত বণিক্ চকিত হইয়া উঠিলেন, তৎকালে ভাবগোপন করিয়া, তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্রস্থান করিলেন, যে ব্যক্তি এডর্ণোর পুত্রকে দাস করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাঁহার অনুসন্ধান করিয়া তদীয় আলয়ে উপস্থিত হইলেন, এবং তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া জিজ্ঞাসিলেন, আপনি কি লইয়া এই খৃষ্টীয় যুবককে দাসত্বমুক্ত করিতে পারেন। তিনি বলিলেন, আমার এরূপ বোধ আছে, ঐ যুবক ধনবান লোকের সন্তান, এজন্য আমি পাঁচ সহস্র টাকার ন্যূনে উহাকে ছাডিয়া দিব না। য়ুবর্টো, অবিলম্বে ঐ টাকা দিয়া, সেই যুবকের দাসত্বমোচন করিলেন।

 এইরূপে আপন অভিপ্রেত সিদ্ধ হওয়াতে, তিনি আন্তরিক পরিতোষলাভ করিলেন, এবং অবিলম্বে এক ভৃত্য ও এক উত্তম পরিচ্ছদ সমভিব্যাহারে লইয়া, সেই যুবকের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, অহে যুবক, তুমি স্বাধীন হইয়াছ, আর তোমায় মুসলমানদিগের দাসত্ব করিতে হইবে না। এই বলিয়া, তিনি স্বহস্তে তদীয় পদদ্বয় হইতে শৃঙ্খলমোচনপূর্ব্বক, নূতন পরিচ্ছদ পবিধান করাইয়া দিলেন। সে, চমৎকৃত ও হতবুদ্ধি হইয়া, এই সমস্ত ব্যাপার স্বপ্নদর্শনবৎ বোধ করিতে লাগিল, এবং সে যে যথার্থ ই দাসত্বশৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইযাছে, কোনও ক্রমে তাহার এরূপ প্রতীতি জন্মিল না। কিন্তু, যখন য়ুবর্টো, আপন আবাসে লইয়া গিয়া, তাহার প্রতি স্বীয় সন্তানের ন্যায় স্নেহপ্রদর্শন করিতে লাগিলেন, তখন তাহার অন্তঃকরণ হইতে সকল সংশয অপসারিত হইল। সেই যুবক, য়ুবর্টোর এই অসাধারণ দয়ার কার্য্য ও অলোকসামান্য সৌজন্য দর্শনে মোহিত ও বিস্মিত হইয়া, তদীয় আবাসে কতিপয় দিবস অবস্থিতি করিল।

 কিছু দিন পরেই, এক জাহাজ ইটালি যাইতেছে জানিতে পারিয়া, য়ুবর্টো সেই যুবককে স্বদেশে পাঠাইয়া দেওয়া অবধারিত করিলেন। প্রস্থানকালে তিনি তাহাকে পাথেয়ের উপযোগী অর্থ ও অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্য দিয়া বলিলেন, বৎস, তোমার উপর আমার এমনই স্নেহ জন্মিয়াছে যে, তোমাকে ছাড়িয়া দিতে আমার কোনও মতে ইচ্ছা হইতেছে না। তোমার পিতা মাতা তোমার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল আছেন, এবং অনবরত বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছেন, কেবল এই অনুরোধে আমি তোমায় তাঁহাদের নিকটে পাঠাইয়া দিতেছি, নতুবা আমি তোমায় অন্ততঃ আরও কিছু দিন আমার নিকটে বাখিতাম। যাহা হউক, জগদীশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতেছি, নিরাপদে স্বদেশে প্রতিগমন করিয়া জনকজননীর শোকাপনোদন ও আনন্দবর্দ্ধন কর। এই বলিয়া, একখানি পত্র তাহার হস্তে সমর্পিত করিয়া য়ুবর্টো বলিলেন, এই পত্রখানি তোমার পিতার হস্তে দিবে।

 সেই যুবক, তদীয় স্নেহ, সদাশয়তা ও অমায়িকতার আতিশয্য-দর্শনে মুগ্ধ হইয়া বলিল, মহাশয, আপনি আমার প্রতি যেরূপ স্নেহ ও অনুগ্রহপ্রদর্শন করিযাছেন, কেহ কখনও কাহারও প্রতি সেরূপ করে না, আপনার স্নেহ ও দয়া, যাবজ্জীবন আমার অন্তঃকরণে জাগরূক থাকিবে, আমি একদিন এক মুহূর্ত্তের নিমিত্তে তাহা বিস্মৃত হইতে পারিব না, প্রার্থনা এই, আপনি যেন এ চিবক্রীত অধীনকে বিস্মৃত না হন। এই বলিয়া সে, অকৃত্রিম ভক্তিপ্রদর্শনপূর্বক প্রণাম ও আলিঙ্গন করিল। য়ুবর্টো, স্নেহভরে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া, গলদশ্রু-লোচনে দণ্ডায়মান রহিলেন, যুবক অশ্রুবিসৰ্জ্জন করিতে করিতে প্রস্থান করিল।

 এডর্ণো ও তাঁহার সহধর্ম্মিণী, বহু দিন পুত্রের কোনও উদ্দেশ না পাইয়া স্থির করিয়াছিলেন, সে নিঃসন্দেহ কাল গ্রাসে পতিত হইয়াছে, সুতরাং তাহার পুনর্দর্শনবিষযে নিতান্ত নিরাশ হইয়াছিলেন। এক্ষণে সেই যুবক সহসা তাঁহাদের সম্মুখে উপস্থিত হইলে, তাঁহারা চমৎকৃত ও আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইলেন, এবং উভয়েই এককালে স্নেহভরে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া, প্রভূত আনন্দাশ্রু বিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন। তিনজনেই কিয়ৎক্ষণ জড়প্রায় হইয়া রহিলেন, কাহারও মুখ হইতে বাক্যনিঃসরণ হইল না। অনন্তর, এডর্ণো ও তাঁহার সহধর্ম্মিণী জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস, তুমি এত দিন কিরূপে কোথায় ছিলে, বল। তখন সেই যুবক, যেরূপে অবরুদ্ধ ও দাসত্বশৃঙ্খলে বন্ধ হয়, তাহার সবিস্তর বর্ণন করিলে, এডর্ণো বাষ্পপূর্ণনয়নে বলিলেন, কোন্ মহানুভাব তোমায দাসত্বশৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিয়া, আমাদিগকে জন্মের মত কিনিয়া রাখিলেন, বল। সে বলিল, এই পত্রে দৃষ্টিপাত করিলে, সকল অবগত হইতে পারিবেন।

 এডর্ণো, ব্যস্ত হইয়া সেই পত্রের উদ্ঘাটন করিলেন। পত্রের মর্ম্ম এই, আপনি যে পাপিষ্ঠ নীচের সন্তানকে, যৎপরোনাস্তি গর্ব্বিতবাক্যে ভর্ৎসনা কুরিয়া, সর্বস্ব হরণপূর্ব্বক নির্ব্বাসিত করিয়াছিলেন, সেই নরাধম আপনকার একমাত্র পুত্রকে দাসত্বশৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিয়াছে। পত্র পাঠ করিয়া, এডর্ণো, পূর্ব্বকৃত নিজ নৃশংস আচরণ ও য়ুবর্টোর অসাধারণ দয়া ও সৌজন্য প্রদর্শন, এ উভয়ের তুলনা করিয়া যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ ও লজ্জায় অধোবদন হইলেন। এই সময়ে, তাঁহার পুত্র ভক্তিরসে পরিপূর্ণ হইযা, য়ুবর্টোর স্নেহ, দয়া ও সৌজন্যের সবিস্তর বর্ণন করিতে লাগিল। এ ঋণের পরিশোধ নাই বুঝিতে পারিয়া, এডর্ণো, যথাশক্তি প্রত্যুপকারকরণে কৃতসঙ্কল্প হইলেন, এবং যাবতীয় সম্ভ্রান্ত্রদিগকে সম্মত করিয়া, য়ুবর্টোকে পত্র লিখিলেন, আপনি আমায় জন্মের মত কিনিয়া রাখিয়াছেন, আপনি যে কেমন মহানুভাব ব্যক্তি, তাহা আমি এতদিনে বুঝিতে পারিলাম। প্রার্থনা এই, আপনি আমার অপরাধ মার্জ্জনা করিয়া, আমায় বন্ধু বলিয়া পরিগণিত করেন। আপনার পক্ষে যে নির্ব্বাসনের আদেশ হইযাছিল, তাহা রহিত হইয়াছে। এক্ষণে আপনি অনায়াসে জেনোয়া আসিয়া অবস্থিতি করিতে পারেন।

 অল্প দিনের মধ্যেই, য়ুবর্টো জেনোয়ায় প্রত্যাগমন করিলেন, এবং সর্ব্বসাধারণের সম্মানাস্পদ হইয়া, সুখে ও স্বচ্ছন্দে কালযাপন করিতে লাগিলেন।


  1. যেখানে রাজা নাই, সর্ব্বসাধারণ লোকের মতানুসারে শাসন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য্যের নির্ব্বাহ হয়, তাহাকে সর্ব্বতন্ত্র বলে। সর্ব্ব—সাধারণ, তন্ত্র—রাজ্যচিন্তা।