আখ্যানমঞ্জরী (তৃতীয় ভাগ)/অপত্যস্নেহের একশেষ
অপত্যস্নেহের একশেষ
আমেরিকার অন্তঃপাতী চিলিনামক জনপদে সান্ফর্নাণ্ডো নামে এক নগর আছে। ষাটি বৎসরের অধিক অতীত হইল, তথা স্পেনদেশীয় মিশনরিদিগের এক আশ্রম ছিল। ঐ আশ্রমের অধ্যক্ষ মহোদয়ের এই ব্যবসায় ছিল, তিনি অস্ত্রধারী ভৃত্যবর্গ সমভিব্যাহারে লইয়া, অসহায় আদিম নিবাসীদিগের শিশুসন্তান হরণ করিয়া আনিতেন, এবং তাহাদিগকে খৃষ্টান করিয়া, দাসের ন্যায় স্বজাতীয়বর্গের পরিচর্য্যায় নিযুক্ত রাখিতেন।
একদা তিনি ঐ উদ্দেশে জলপথে প্রস্থান করিলেন, এক- স্থানে উপস্থিত হইয়া,নৌকাবন্ধনের আদেশ দিলেন। ভৃত্যদিগকে তীরে অবতীর্ণ করিয়া, শিশুসংগ্রহের নিমিত্ত প্রেরণ করিলেন, এবং স্বয়ং সেই নৌকায় অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। তদীয় ভৃত্যেরা ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে এক কুটীর দেখিতে পাইল। তাহারা অভীষ্টসিদ্ধির সম্ভাবনা দর্শনে, সাতিশয় হৃষ্ট হইয়া কুটীরদ্বারে উপস্থিত হইল। দেখিল, এক নারী আহারসামগ্রী প্রস্তুত করিতেছে, আর তাহার দুটি শিশুসন্তান সমীপদেশে ক্রীড়া করিতেছে।
ঐ নারী দর্শনমাত্র, তাহাদের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া, স্বীয় সন্তানদ্বিতয় লইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। অস্ত্রধারী মিশনরিভৃত্যেরা তাহার পশ্চাৎ ধাবমান হইল। একে স্ত্রীজাতি পুরুষ অপেক্ষা দুর্ব্বল, তাহাতে আবার ক্রোড়ে দুই সন্তান, সুতরাং পলায়ন দ্বারা সেই অনুসরণকারী দস্যুদিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাওয়া, কোনও ক্রমে সম্ভাবিত নহে। সে, কিয়ৎ ক্ষণের মধ্যেই ধৃত ও সন্তান সমভিব্যাহারে, বলপূর্ব্বক নদীতীরে নীত হইল। মিশনরি মহোদয়, নৌকায় অবস্থিত হইয়া, উৎসুকচিত্তে স্বীয় ভৃত্যদিগের প্রত্যাগমন-প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, এক্ষণে তাহাদিগকে শিশুদ্বয় সমভিব্যাহারে প্রত্যাগত দেখিয়া, প্রীতমনে ও প্রফুল্লবদনে প্রশংসাবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।
ঐ নারীর স্বামী ও দুই তিনটি অধিকবয়স্ক সন্তান, মৎস্য ধরিবার নিমিত্ত, স্থানান্তরে গিয়াছিল, তাহাদিগকে ছাড়িয়া যাইতে হইতেছে, এবং হয় ত আর তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ ও মিলন হইবে না, এই শোকে কাতর হইয়া, সে আর্ত্তনাদ, রোদন ও নৌকারোহণে অনিচ্ছাপ্রদর্শন করিতে লাগিল। তদ্দর্শনে মিশনরি মহোদয় স্বীয় ভৃত্যদিগকে এই আদেশ দিলেন, উহারে বলপূর্ব্বক নৌকায় আরোহণ করাও। তদনুসারে তাহারা বলপ্রদর্শনের আরম্ভ করিলে, ঐ স্ত্রীলোক নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া বাধাদানে বিরত হইল। যদি সে, অতঃপবও নৌকারোহণে অসম্মতি প্রদর্শন করিত, তাহা হইলে, তাহারা নিঃসন্দেহ উহার প্রাণবধ করিয়া, দুই শিশুকে নৌকায় লইয়া যাইত।
অবশেষে ঐ হতভাগা নারী, শিশুসন্তান সহিত নৌকায় আরোহিত ও মিশনরির আশ্রমে নীত হইল। স্থলপথে গেলে অনায়াসে পথ চিনিতে পারা যায়, সুতরাং সে পলাইয়া পুনরায় আপন আলয়ে যাইতে পারে, এই আশঙ্কায় মিশনরি মহোদয় উহাদিগকে জলপথে লইয়া গেলেন। স্বামী ও অবশিষ্ট সন্তানদিগের অদর্শনে, সেই স্ত্রীলোকের অন্তঃকরণে অতি প্রবল শোকানল প্রজ্বলিত হইতে লাগিল। সে আহারনিদ্রাপরিহার পূর্ব্বক, উন্মত্তার ন্যায় কালক্ষেপ করিতে, এবং মধ্যে মধ্যে দুই সন্তান লইয়া, আপন আবাসের উদ্দেশে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল, সতর্ক মিশনরিভৃত্যেরাও, প্রতিবারেই তাহাকে ধরিয়া আশ্রমে আনিতে লাগিল।
অবশেষে, মিশনরি মহাশয় অতিশয় বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। তদীয় আদেশক্রমে, তাঁহার ভৃত্যেরা একদিন ঐ স্ত্রীলোককে নিতান্ত নির্দয় প্রহার করিল। অনন্তর তিনি এই ব্যবস্থা করিলেন, উহার পুত্রেরা এখানে থাকুক, উহাকে অন্য এক আশ্রমে পাঠান যাউক। তদনুসারে সে একাকিনী আতাবাগো নদীর তীরবর্ত্তী আশ্রমান্তরে প্রেরিত হইল। মিশনরিভৃত্যেরা, হস্তবন্ধনপূর্ব্বক নৌকায় আরোহণ করাইয়া, তাহাকে ঐ আশ্রমে লইয়া চলিল। সে, আমায় কি অভিপ্রায়ে কোথায় লইয়া যাইতেছে, তাহার কোনও অবধারণ কবিতে পারিল না, ইহা বুঝিতে পারিল, অনেক দূরে লইয়া যাইতেছে। অত্যন্ত দূরবর্তী হইলে, আর আমি আবাসে আসিতে, এবং পতিদর্শন ও পুত্রমুখনিরীক্ষণ করিতে পাইব না, সেই জন্যই ইহারা আমায় এরূপে স্থানান্তরিত করিতেছে।
এই সমস্ত ভাবিয়া নিতান্ত হতাশ হইয়া, ঐ স্ত্রীলোক অকস্মাৎ আবির্ভূত প্রভূতবলসহকারে, হস্তের বন্ধনচ্ছেদন পূর্ব্বক ঝম্পপ্রদান করিল, এবং সন্তরণ করিয়া নদীর অপর পারে চলিল। স্রোতের প্রবণতা বশতঃ অনেক দূর ভাসিয়া গিয়া, সে তীরবর্ত্তী গণ্ডশৈলের পাদদেশে সংলগ্ন হইল। ঐ গণ্ডশৈল, এই ঘটনা প্রযুক্ত অদ্যাপি মাতৃশৈল নামে প্রসিদ্ধ আছে। সে, তীরে উত্তীর্ণ হইয়া, অরণ্যে প্রবেশপূর্ব্বক লুকাইয়া রহিল। তদ্দর্শনে নৌকাস্থিত মিশনরি, সাতিশয় কুপিত হইয়া ঐ পর্ব্বতের নিকট নৌকা লাগাইতে আদেশপ্রদান করিলেন। নৌকা সেই স্থানে লগ্ন হইলে, তদীয় আদেশক্রমে ভৃত্যেরা অরণ্যে প্রবেশ করিয়া, সেই স্ত্রীলোকের অন্বেষণ করিতে লাগিল; কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিতে পাইল, সে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া, গণ্ডশৈলের পাদদেশে মৃতবৎ পতিত আছে। তাহারা তাহাকে উঠাইয়া নৌকায় লইযা গেল, এবং যৎপরোনাস্তি প্রহারপূর্ব্বক তাহার দুই হস্ত পৃষ্ঠদেশে লইয়া দৃঢ়রূপে বদ্ধ করিল, এবং জাবিতানামকস্থানবাসী মিশনরিদিগের আশ্রমে লইয়া চলিল।
জাবিতায় নীত হইয়া সেই স্ত্রীলোক এক গৃহে রুদ্ধ রহিল। এই স্থান সান্ফার্নাণ্ডো হইতে চল্লিশ ক্রোশ বিপ্রকৃষ্ট, মধ্যবর্ত্তী প্রদেশ গভীর অরণ্য দ্বারা পরিবৃত, সেই অরণ্য দুষ্প্রবেশ ও দুরতিক্রম বলি, তৎকাল পর্য্যন্ত তত্রত্য লোকমাত্রের বোধ ও বিশ্বাস ছিল। কেহ কখনও স্থলপথে, এক স্থান হইতে স্থানান্তরে যাইবার চেষ্টা করিত না। ফলতঃ, যাতায়াতের পক্ষে জলপথ ভিন্ন উপায়ান্তর পরিজ্ঞাত ছিল না। বিশেষতঃ বর্ষাকাল, বর্ষাকালে ঐ প্রদেশে গগনমণ্ডল নিরন্তর নিবিড় ঘনঘটায় আচ্ছন্ন থাকে, রাত্রিকাল এরূপ অন্ধতমসে আবৃত হয় যে, কোনও ব্যক্তি বা বস্তু সম্মুখে থাকিলেও লক্ষ্য করিতে পারা যায় না। ঈদৃশ প্রবল প্রতিবন্ধক সত্ত্বে, অতি দুঃসাহসিক ব্যক্তিও সাহস করিয়া, স্থলপথে জাবিতা হইতে সান্ফার্নাণ্ডো যাইতে উদ্যত হইতে পাবে না।
কিন্তু, সুতবিরহবিধুরা জননীর পক্ষে, এই সমস্ত প্রতিবন্ধক, প্রতিবন্ধক বলিয়াই গণনীয় নহে। সেই হতভাগা নারী এই চিন্তা করিতে লাগিল, আমার পুত্রেরা সান্ফার্নাণ্ডোতে রহিল, আমি তাহাদের বিরহে একাকিনী এখানে থাকিয়া, কোনও ক্রমে প্রাণধারণ করিতে পারিব না, তাহারাও আমার অদর্শনে শোকাকুল হইআ, নিঃসন্দেহ প্রাণত্যাগ করিবে। অতএব আমি অবশ্য তাহাদের নিকটে যাইব, এবং যেরূপে পারি, খৃষ্টধর্মাবলম্বীদিগের হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া, তাহাদিগকে তাহাদের পিতার নিকটে লইয়া যাইব। তিনি আবাসে আসিয়া আমাদিগকে দেখিতে না পাইয়া, কতই বিলাপ ও কতই পরিতাপ করিতেছেন, আমরা অকস্মাৎ কোথায় গেলাম, কিছুই অনুধাবন করিতে না পারিয়া, ইতস্ততঃ কতই অনুসন্ধান করিতেছেন, এবং কোনও সন্ধান করিতে না পারিয়া, হতবুদ্ধি ও ম্রিয়মাণ হইয়া, যারপরনাই অসুখে ও দুর্ভাবনায় কালহরণ করিতেছেন। পুত্রেরাও, মাতৃশোকে ও ভ্রাতৃশোকে আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়াছে, এবং অহোরাত্র হাহাকার করিতেছে।
সেই স্ত্রীলোকের পলাইবার কোনও আশঙ্কা নাই, এই ভাবিয়া আশ্রমবাসীরা তাহার রক্ষণ বিষয়ে সবিশেষ মনোযোগ রাখে নাই। আর, প্রহার ও দৃঢ় বন্ধন দ্বাবা, তাহার হস্তদ্বয় ক্ষতবিক্ষত হইয়াছিল, এজন্য আশ্রমের পরিচারকেরা, কর্ত্তৃপক্ষের অগোচরে তাহার হস্তের বন্ধন কিঞ্চিৎ শিথিল করিয়া দিয়াছিল। সে পুত্রদিগকে দেখিবার নিমিত্ত নিতান্ত অধীর হইয়া, দন্ত দ্বারা হস্তের বন্ধনচ্ছেদনপূর্ব্বক, গৃহ হইতে বহির্গত হইল, সাধ্য অসাধ্য বিবেচনা না করিয়া, সান্ফর্নাণ্ডো উদ্দেশে প্রস্থান করিল, এবং চতুর্থ দিবস প্রত্যুষে সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া, যে কুটীরে তাহার পুত্রদিগকে রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, উহার চতুর্দিকে উন্মত্তার ন্যায় পরিভ্রমণ করিতে লাগিল।
এই হতভাগা নারী যেরূপ দুঃসাধ্য ব্যাপারের সমাধান করিয়াছিল, অসাধারণ বলবান ও অত্যন্ত সাহসী পুরুষেরাও তাহাতে প্রবৃত্ত হইতে পারে না। বর্ষাকালে তাদৃশ দুষ্প্রবেশ, দুরতিক্রম, হিংস্ৰজন্তুপরিবৃত অরণ্যের অতিক্রম করা, কোনও ক্রমে সহজ ব্যাপার নহে। প্রহারে ও অনাহারে সে নিতান্ত নির্বীর্য্য হইয়াছিল, বর্ষার প্রাবল্যনিবন্ধন জলপ্লাবন হওয়াতে, সেই অরণ্যের অধিকাংশ জলমগ্ন হইয়াছিল, মধ্যে মধ্যে সন্তরণ দ্বারা বহুসংখ্যক নদীরও অতিক্রম করিতে হইয়াছিল। এই চারি দিন, কি আহার করিয়া প্রাণধারণ করিলি, এই জিজ্ঞাসা করাতে সে বলিয়াছিল, অত্যন্ত ক্ষুধা ও ক্লান্তিবোধ হইলে, অন্য কোনও আহার না পাইয়া, যে সকল বৃহৎ কাল পিপীলিকা শ্রেণীবদ্ধ হইয়া বৃক্ষে উঠে, তাহাই ভক্ষণ করিতাম।
অপত্যস্নেহের অনির্বচনীয় প্রভাব॥।
কিয়ৎ ক্ষণ পরে আশ্রমবাসীরা সেই স্ত্রীলোককে প্রত্যাগত দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইল, এবং ক্ষণবিলম্ব ব্যতিরেকে, তাহাকে আশ্রমের অধ্যক্ষ মিশনরি মহোদয়ের নিকটে লইয়া গেল। তিনি দেখিয়া, অত্যন্ত কোপাবিষ্ট হইয়া কি জন্য ও কি রূপে সে তথায় উপস্থিত হইল, জিজ্ঞাসা করিলেন। সে অশ্রুপূর্ণ লোচনে, আকুলবচনে সবিশেষ সমস্ত নিবেদন করিল। শুনিয়া, মিশনরি মহাপুরুষের অন্তঃকরণে কিছুমাত্র দয়ার সঞ্চার হইল না। তিনি তাহাকে তৎক্ষণাৎ অধিকতরদূরবর্ত্তী আশ্রমান্তরে প্রেরিত করিবার আদেশপ্রদান কবিলেন, মিশনরি-ভৃত্যদিগের নির্দয় প্রহার ও অরণ্যে কণ্টকাবৃত স্থানের অতিক্রম দ্বারা, তাহার সর্বাঙ্গে যে ক্ষত হইয়াছিল, তাহার শোষণের নিমিত্তও ঐ পাপীয়সীকে দুই চারি দিন সেই পবিত্র আশ্রমে অবস্থিতি করিতে দিলেন না।
অরুনোকোনদীর তীরে মিশনরিদিগের যে আশ্রম ছিল, ঐ হতভাগা নারী অবিলম্বে তথায় প্রেরিত হইল, আর যে পুত্রদিগের স্নেহের বশীভূত হইয়া, এত কষ্ট ও এত যাতনা সহ্য করিয়াছিল, একবার একক্ষণের জন্য তাহাদের মুখ দেখিতে পাইল না। এই আশ্রমে নীত হইয়া, সে নিতান্ত হতাশ ও শোকে একান্ত অভিভূত হইল, এবং একবারেই আহারত্যাগ ও কতিপয় দিবসেই প্রাণত্যাগ করিল।