আখ্যানমঞ্জরী (প্রথম ভাগ)/পরের প্রাণরক্ষার্থ প্রাণদান
সেণ্ট এটিয়ন নামে এক ব্যক্তির প্রাণদণ্ডের আদেশ হওয়াতে তিনি লুকাইয়া থাকেন। রাজপুরুষেরা সবিশেষ অনুসন্ধান আরম্ভ করাতে, তিনি প্রকাশভয়ে, অধিকদিন এক স্থানে থাকিতে পারিতেন না, কোনও স্থানে দুই তিন দিন থাকিয়া, স্থানান্তরে প্রস্থান করিতেন। প্রতিক্ষণেই, তাঁহার রাজপুরুষদিগের হস্তে পতিত হইবার আশঙ্কা হইত। যাহার আলয়ে লুকাইয়া থাকেন, পাছে সেই ব্যক্তিই ভয়ে প্রকাশ করিয়া দেয়, এই আশঙ্কায় তিনি কোনও স্থানেই নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারিতেন না। কারণ, যাহারা তাঁহাকে লুকাইয়া রাখিবে, অথবা তাঁহার লুকাইয়া থাকিবার স্থান জানিতে পারিয়াও রাজপুরুষদিগের গোচর না করিবে, তাহাদেরও প্রাণদণ্ড অবধারিত ছিল।
পারিস নগরে পেসক-নাম্নী এক অতি সচ্চরিত্রা দয়াশীলা মহিলা ছিলেন। তিনি অনুসন্ধান করিয়া, এটিয়নের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, এবং কহিলেন, আপনি যে বিষম বিপদে পড়িয়াছেন, তাহার সবিশেষ অবগত হইয়াছি, আপনি আমার আলয়ে চলুন, সেখানে থাকিলে, কেহই সন্ধান পাইবে না।
এই প্রস্তাব শ্রবণ করিয়া, এটিয়ন কহিলেন, আপনি যে আমার দুঃখে দুঃখিত হইয়াছেন, এবং এই বিপদের সময় দয়া করিয়া, আশ্রয় দিতে চাহিতেছেন, ইহাতে আমি কি পর্য্যন্ত উপকৃত বোধ করিতেছি, বলিতে পারি না। কিন্তু এ হতভাগ্যকে আশ্রয় দিলে, আপনি নিঃসন্দেহ বিপদ্গ্রস্ত হইবেন, আপনার প্রাণদণ্ড পর্য্যন্ত ঘটিতে পারে, এই কারণে, আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারি না। যেরূপ দেখিতেছি, আমার রক্ষার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই, এমন স্থলে, আমি অকারণে আপনার প্রাণদণ্ডের হেতু হইতে পারিব না।
এটিয়নের এই কথা শুনিয়া, পেসক কহিলেন, মহাশয়। আপনি অন্যায় কহিতেছেন, আপনার প্রাণরক্ষার চেষ্টা করিলে, পাছে বিপদে পড়ি, এই ভয়ে আমি, তাহাতে ক্ষান্ত হইয়া, আপন আবাসে নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকিব, সাধ্যানুসারে আপনার সাহায্য করিব না, ইহা কখনই হইবে না। আপনি কহিতেছেন, আপনি আমার আলয়ে গেলে, আমারও প্রাণনাশের সম্ভাবনা আছে, কিন্তু বিপদের সময়ে যদি বন্ধুর সাহায্য করিতে না পারি, তাহা হইলে প্রাণ থাকিবার কোনও প্রয়োজন দেখিতেছি না।
অবশেষে এটিয়ন পেসকের যত্ন ও বিনয়ের বশীভূত হইয়া নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্ব্বক তাঁহার আলয়ে গমন করিলেন। যাহাতে তিনি সেখানে লুকাইয়া আছেন বলিয়া, কেহ জানিতে না পারে, পেসক, অশেষ প্রকারে, সেইরূপ যত্ন ও কৌশল করিতে লাগিলেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই, এই বিষয় প্রকাশ হইয়া পড়িল। এটিয়নের প্রাণদণ্ড হইল। পেসক তাঁহাকে আশ্রয় দিয়াছিলেন, এই অপরাধে, তিনিও অবিলম্বে তাঁহার অনুগামিনী হইলেন।
যৎকালে, এই দয়াশীল স্ত্রীলোক ধৃত ও রাজপুরুষদিগের সম্মুখে নীত হইয়াছিলেন, তিনি, কিছু মাত্র ভীত বা দুঃখিত হন নাই, তাঁহার আকারে বা কথোপকথনে ভয় বা দুঃখের কোনও লক্ষণ লক্ষিত হয় নাই। প্রাণদণ্ডের আদেশ হইলে, তিনি অকুতোভয়ে তাহাতে সম্মত হইলেন, তাঁহার দয়া, সৌজন্য ও অকুতোভয়তা দর্শনে ব্যক্তি মাত্রেই মুগ্ধ ও বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিল।