আখ্যানমঞ্জরী (প্রথম ভাগ)/ভ্রাতৃবৎসলতা

ভ্রাতৃবৎসলতা।

ইণ্টাফনিস নামে এক ব্যক্তি উৎকট অপরাধ করাতে, পারস্যের অধীশ্বর দারা, অত্যন্ত কুপিত হইয়া, তাহার স্ত্রী পুত্র কন্যা প্রভৃতি পরিবারের ও আত্মীয়গণের প্রাণবধের আদেশপ্রদান করেন। তদীয় পত্নী, নিতান্ত শোকাকুল হইয়া, ক্ষমা প্রার্থনা করিবার নিমিত্ত, প্রত্যহ রাজবাটীতে যাতায়াত করিতে লাগিল। সে অবাধে এইরূপ করাতে, দারার অন্তঃকরণে করুণার সঞ্চার হইল। তখন তিনি, দূত দ্বারা, তাহার নিকট এই কথা বলিয়া পাঠাইলেন, তোমার কাতরতা দর্শনে, রাজার অন্তঃকরণে দয়ার উদয় হইয়াছে, তদনুসারে তিনি তোমাদের এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করিতে সম্মত হইয়াছেন, কোন্‌ ব্যক্তির প্রাণরক্ষা সর্ব্বাপেক্ষা তোমার অধিক প্রার্থনীয়, ইহা জানিবার নিমিত্ত তিনি আমায় তোমার নিকট পাঠাইয়াছেন।

 এই রাজকীয় নির্দেশ শ্রবণে, সেই স্ত্রীলোক মনে মনে কিয়ৎ ক্ষণ বিবেচনা করিয়া কহিল, যদি রাজা কৃপা করিয়া আমাদের হতভাগ্য পরিবারের ও আত্মীয়বর্গের মধ্যে কেবল এক ব্যক্তির প্রাণরক্ষায় সম্মতি দেন, তাহা হইলে আমি আমার ভ্রাতার প্রাণরক্ষা প্রার্থনা করি। দূত এই প্রার্থনা রাজার গোচর করিলে, তিনি শুনিয়া সাতিশয় চমৎকৃত হইলেন, এবং সেই দূতকে পুনরায় তাহার নিকট পাঠাইয়া দিলেন।  তদনুসারে, দূত পুনরায় তাহার নিকটে গিয়া কহিল, স্ত্রীলোকের ভ্রাতা অপেক্ষা স্বামী অধিক প্রিয়, ও সন্তান অধিক স্নেহপাত্র, ইহাই সর্ব্বদা সর্ব্বত্র লক্ষিত হইয়া থাকে, কিন্তু তোমার আচরণে তাহার সম্পূর্ণ বৈপরীত্য লক্ষিত হইতেছে, তুমি, স্বামী ও সন্তান পরিত্যাগ করিয়া, কি কারণে ভ্রাতার প্রাণরক্ষা প্রার্থনা করিতেছ, রাজা তাহা সবিশেষ জানিতে চাহেন।

 তখন সেই স্ত্রীলোক কহিল, আপনি রাজাকে বলিবেন, যদি তিনি আমার স্বামীর প্রাণদণ্ড করেন, ইচ্ছা করিলে, আমি পুনরায় স্বামী পাইতে পারিব, যদি তিনি আমার সন্তানদিগের প্রাণদণ্ড করেন, পুনরায় আমার সন্তান লাভ অসম্ভব নহে। কিন্তু আমার ভ্রাতার প্রাণদণ্ড করিলে, আমি আর ভ্রাতা পাইতে পারিব না, কারণ, আমার পিতা মাতা উভয়েরই মৃত্যু হইয়াছে। এই সমস্ত আলোচনা করিয়া, আমি ভ্রাতার প্রাণরক্ষা প্রার্থনা করিয়াছি, এক্ষণে, তাঁহার যেরূপ অভিরুচি হয়।

 দূত, রাজসমীপে উপস্থিত হইয়া, এই সমস্ত নিবেদন করিলে, তিনি, সেই স্ত্রীলোকের উপর যৎপরোনাস্তি প্রীত হইলেন, তাহার প্রার্থনা অনুসারে তদীয় ভ্রাতার প্রাণরক্ষার আদেশ দিলেন এবং তাহার সদ্বিবেচনার পুরস্কারস্বরূপ, তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্রেরও অপরাধ মার্জ্জনা করিলেন।