আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/১১
১১
অর্থনৈতিক সমস্যা—
বাঙ্গালী কোথায়?
ছাত্রবৃন্দের এই সভায় তাকিয়ে আজ বাংলা দেশের আশা ভরসা যুবকসম্প্রদায়ের সম্বন্ধে মনে অনেক ভাবের উদয় হয়। সকলেরই মনে কত আশা ও আকাঙ্ক্ষা। আমি আজ শতাব্দীর তৃতীয়াংশ যাবৎ শিক্ষকতা কার্য্যে ব্রতী থেকে ছাত্র জীবনের নাড়ী নক্ষত্র জানিয়াছি। প্রথম বার্ষিক শ্রেণীর দিকে তাকালে দেখি আকাঙ্ক্ষা উদ্দীপ্ত মুখ, হৃদয়ে আশা লইয়া জীবন পথে প্রবেশ করছে। কিন্তু
“He counted them at the break of day
But when the sun set where were they?”
কলেজ জীবনের গণ্ডী অতিক্রম করিতে না করিতেই সে মোহের বিচ্যুতি হয়। পরে অবশ্যম্ভাবী সেই একই হাহাকার। তাই আমি বিগত কয় বৎসর ধরে এই নিয়ে আলোচনা করছি। আজকাল যে রকম popular তাতে আর যুবক সম্প্রদায়কে Oxygen, Hydrogen মিশিয়ে জল তৈরি করে বিজ্ঞানের ভোজ বাজী দেখিয়ে আকৃষ্ট করতে হয় না। এখন বিষম সমস্যা হয়েছে যে বাঙালীর অস্তিত্ব ধরাপৃষ্ঠ হতে অচিরে বিলুপ্ত হওয়া নিবারণ করা। কোথায় বাঙালী আজ জীবনের সকল ক্ষেত্রে কৃতিত্ব লাভ করবে, না দেখছি তারা সব জায়গাতেই হঠে যাচ্ছে। একজন নিরপেক্ষ ইংরাজ সেদিন দিল্লীর ব্যবস্থাপক সভায় অন্যান্য স্থানের Legislative Council এর কার্য্যকলাপ বিচার করে বলেছেন যে আজ সকল বিষয়ে মান্দ্রাজ অগ্রণী—বম্বে দ্বিতীয় স্থানে এবং বাঙালা তৃতীয় ও সর্ব্ব নিম্নে। এই স্থানে ৭।৮ মাস পূর্ব্বে মহামতি গোখ্লের একটি কথা বলেছিলাম, সমস্ত ভারতবর্ষ বাঙলার দিকে তাকিয়ে আছে, বাঙলার বাণীই ভারতের অন্যান্য প্রদেশ উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করে। “What Bengal thinks today, the whole of India will think to-morrow” কিন্তু হায় আজ বাংলা কোথায়!
ব্যবসা বাণিজ্যের কথা তো নেইই, বাঙলা আজ সকল ক্ষেত্র হতেই বিতাড়িত হয়েছে। এর কারণ কি? ইংরাজ শাসনের পূর্ব্বে বাহিরের জগতের সংস্পর্শ শূন্য হয়ে, নিজের আবেষ্টনের মধ্যে আপনার শত অপূর্ণতাতেও আপনি বিভোর ছিল, তখন বাংলার দিন চলিয়াছিল বেশ। জীবন সংগ্রামের কঠিন প্রতিযোগিতায় বাইরের ঘাত ও প্রতিঘাত আমাদের জীর্ণ সমাজ-দেহকে আলোড়িত করিয়া তুলে নাই তাই অপর্য্যাপ্ত ক্ষেতের ধান, পুকুরের মাছ, গরুর দুধে দিন চলিত একরকম বেশ। কিন্তু আজ অন্নাভাব। জীবন ধারণোপযোগী একপোয়া মাছ আধসের দুধ আজ মহার্ঘ। শুধু কলিকাতায় নয় পল্লীগ্রামেও কখন কখন দুধের সের আট আনা। আর মাছ বলে আমরা যা খাই তা তো কেবল মনকে প্রবোধ দিবার জন্য। আজ বাংলা দেশে খাদ্যাভাব। পুষ্টিকর খাদ্য নেই; আজ আমরা যেন ঘাস পাতা খেয়ে কোন প্রকারে জীবন ধারণ করে আছি। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ আমাদের খাচ্ছেনা। তাই আমরা আমাদের দুর্গতির সমস্ত দোষ ইংরাজের স্কন্ধে চাপাইয়া বলি “ইংরাজ এই সুজলা, সুফলা বাংলা দেশের ধন ধান্য লুঠে নিচ্ছে”। বাংলার ধন, বাংলার শস্য ইংরেজ অতি কমই লুঠ করে। আজ Behar for the Beharees, Assam for the Assamese, Orissa for the Oriyas কিন্তু Bengal for every body. বাঙ্গালী অতি পারমার্থিক জাতি। বাংলার দরজা সব সময়েই খোলা। প্রথমে চৌরঙ্গি, তারপর Exchange এ যান দেখবেন আমরা পুরাকালের দধীচি মুনির মত কেমন নিঃস্বার্থভাবে নিজের অস্থি পরের উপকারের জন্য অকাতরে দান করছি। রেলি, টার্ণার মরিসন্, গিলাণ্ডর্স প্রভৃতি বণিকদের উপকারার্থে আমরা অম্লান বদনে কেরানীগিরি করিতেছি। তার পর, ভাটিয়া, মাড়োয়ারীরা সমস্ত করতলস্থ করেছে, হ্যারিসন রোড থেকে বাঙালীটোলা প্রায় মাড়োয়ারীর হস্তগত হয়েছে। আমরা স্থানচ্যুত হয়ে ৪।৫ তলা বাড়ীর পায়রার খোপের মত সব অংশে এসে আশ্রয় নিচ্ছি। এখন একটু Tightness of the market বলে যা কিছু রেহাই পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু অচিরেই যে আমাদের বিতাড়িত হতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। শ্রমজীবিদের মধ্যে খুঁজলেও বাঙ্গালী শ্রমিকের অবস্থা ভদ্রলোকদেরই মতো। প্রায় ৫০ বছর হল দেখে আস্ছি plumber সব উড়িয়া। জল, ড্রেন, গ্যাসের কাজ এরাই কর্ছে। রাঁধুনে বামন হয় উড়ে নয় খোট্টা; পাড়াগাঁয়ে অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ীতে পর্য্যন্ত দেখছি উড়ে বামুন, খোট্টা বেহারা। বাংলা দেশের ধন ধান্য কি এতই অপর্য্যাপ্ত যে এখানে কাহারো গৃহে অন্নাভাব নাই, প্রত্যেকের বাড়ীতেই মাটিতে লোহার সিন্দুক পোঁতা যে এখানে কাহারো মুটে মজুর, বেহারা প্রভৃতি হবার দরকার নেই? আমরা নবাবী করেই চলেছি, কি যে দুর্দ্দশা এতে হচ্ছে তা বুঝতে কাহারো কষ্ট হয় না। বিশদ করে বলে আর কি হবে!
আজকাল আমাদের সাধের কেরাণীগিরি হতেও বিতাড়িত হবার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। নিরামিষ ভোজী মান্দ্রাজী ব্রাহ্মণ বাঙালীর চেয়ে অল্প বেতনে কাজ কর্তে পারে বলে কেরাণীগিরিতে আজ মান্দ্রাজী। তেঁতুল-জল ও ডাল খেয়ে বারাণ্ডায় চাটাইয়ে ঘেরাও করিয়া সপরিবারে থাকতে পারে বলে বাঙালী কেরাণী অপেক্ষা অল্প খরচে এদের জীবন যাত্রা নির্ব্বাহ হয়। তাই বলি, বাঙালী যায় কোথা?
৫০ বৎসর পূর্ব্বে দেখেছি বেণ্টিঙ্ক স্ট্রীট চীনেরা দখল করেছে। এখন দেখছি, লাল বাজার, ফৌজদারী বালাখানা পর্য্যন্ত এরা এসেছে। জুতোর দোকানী, ছুতোর সব চীনে। এই বাঙলা দেশে ছুতোর ছিলনা এমন নয়। এখন তারা নিরন্ন। চীনেদের অনেক গুণ, তাই আজ তারা বাঙালী ছুতোরকে প্রতিযোগিতায় হারিয়েছে। এরা ফাঁকি দেয় না এবং এদের উপর কাজ দিয়ে ভরসা পাওয়া যায়। বাঙালী মিস্ত্রি কি রাজমিস্ত্রি কি ছুতোর মিস্ত্রি, চোখের আড়াল হলে, হুঁকো নিয়ে বসবে আর কোন কাজ আদায় করা অসম্ভব। চীনেদের মজুরী বেশী কিন্তু সস্তার তিন অবস্থা হয় বলেই লোকে বেশী মজুরী দিয়েও এদের কাজ দেয়। তাই আজকাল পূর্ব্ব ও পশ্চিম বঙ্গে চীনেরাই Contract নিয়ে কাজ করছে। আমাদের দেশের মিস্ত্রিরা দিন আনে দিন খায়। মূলধন কোন তাদের থাকে না এবং সমবেত হয়ে কাজ করবারও এদের ক্ষমতা নাই।
বাল্যকালে অনেক বাঙালীর কাঠের গোলা দেখেছি। এখন চাঁপাতলায় গেলে দেখতে পাওয়া যাবে চীনেরা সব কাঠের গোলার মালিক। আর সাবেক বাঙালী মনিবগণ এখন তাহাদেরই কেরানীগিরি করছে। এইরূপে জীবনের নানা ক্ষেত্রে অবাঙালীর peaceful penetration হচ্ছে। এ একদিনে বোঝা যায় না। ক্ষয় রোগীর মতন তিলে তিলে এই আমাদের মৃত্যু। এই অশিক্ষিত চীনেরা পিকিং, ন্যানকিং ক্যাণ্টন থেকে এসে বিনা মূলধনে আমাদের মুখের অন্ন গ্রাস করছে, আর আমরা চোখ বুজে বসে আছি। ট্যাঙ্রায় কয়েক বছর আগে একটি চীনের সামান্য দোকান দেখ্তাম, যুদ্ধের সময় Munition Boardয়ের Contract নিয়ে বড় লোক হয়ে গেল। এখন তার ছোট ছোট অনেকগুলি Sawmill. বাঙালী পারে না কেন?
Railway Stationএ ষ্টীমার ঘাটে সব কুলী মজুর হিন্দুস্থানী। ধানের ক্ষেতের মধ্য দিয়ে গ্রামের অতি সন্নিকটে রেল গেছে। এক আধ পো মাইলের মধ্যে চাষীদের বাড়ী। তারা ইচ্ছা করলে ট্রেণের সময় মাল নামিয়ে ও তু’লে দিয়ে যেতে পারে। এতে অক্লেশে দৈনিক৷৷৹ আনা রোজগার হতে পারে। কিন্তু তারা যে জমির মালেক, তারা কি এই ঘৃণিত কুলীগিরি করতে পারে! তাদের ইজ্জত সম্ভ্রম বলে তো কিছু আছে! এদিকে ঋণে ডুবুডুবু। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অফলন তো আমাদের দেশের প্রায় স্বাভাবিক অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু রেলের লাইনের ধারেই ষ্টেসনে ষ্টেসনে হিন্দুস্থানীদের উপনিবেশ বসে গেছে।
এইরূপ শ্রমবিমুখতা ও আলস্যই আমাদের সকল দুর্গতির পশ্চাতে। কিছুদিন পূর্ব্বে আমতার নিকটে একটি পল্লীগ্রামে আমাকে কোন কার্য্য উপলক্ষে যাইতে হইয়াছিল। ষ্টেসন হইতে অনেক দূরে গম্ভব্য স্থান। অনেক কষ্টে পাল্কী জুটিল কিন্তু বেহারা মিলিল না। সেখানে গরীব চাষীর তো কোন অপ্রতুল দেখিলাম না। যদি দিন গুজরান করা অসাধ্যও হয় তবু পাল্কী বহা,—সে কি করিয়া হয়! মধ্যবিত্ত ভদ্রশ্রেণীতেও দেখিতে পাই বাজার হইতে৷৷৹ আনার মাছ আনিতে হইলে ৵৹ আনা কুলী ভাড়া বাবদ দেওয়া হয়—তবে সন্ধ্যার আঁধারে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে আসা—সে স্বতন্ত্র কথা। এইরূপ false prestige বা মিথ্যা আত্মসম্মান জ্ঞানই আমাদের চরম দুর্গতির জন্য দায়ী। এই কুভাব আমাদের সমাজের স্তরে স্তরে অনুপ্রবিষ্ট হইয়াছে।
আজকাল কলেজে I. Sc., B. Sc. classএ স্থানাভাব। অভিভাবক সম্প্রদায় তাঁদের কুলতিলকেরা I. Sc., B. Sc. পড়িলেই একেবারে নিজকে ধন্য জ্ঞান করেন। এই মোহ না কাটিলে কোন উপায়ান্তর দেখি না। আমি শিক্ষক বটে কিন্তু ব্যবসায়ীও। ছেলেদের কাছে আমি শিক্ষক—ব্যবসায়ীর কাছে ব্যবসায়ী। ৭।৮টি কোম্পানীর সহিত আমাকে জড়িত থাকিতে হইয়াছে। ব্যবসায় ক্ষেত্রে কৃতী রাজেন্দ্র মুখার্জ্জি, নিবারণ সরকার মহাশয় প্রভৃতিদের সহিত আলোচনা করিয়া দেখিয়াছি যে জাতীয় চরিত্রগত ত্রুটি সংশোধন না হওয়া পর্য্যন্ত আমাদের কোন আশা নাই। পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী কার্ণেগীও সামান্য হইতেই আরম্ভ (humble beginning) করিয়াছেন। তিনি তো প্রথমে telegraph boy ছিলেন। তিনি যখন ব্যবসায় হতে বিদায় গ্রহণ করেন তখন তাঁর ব্যবসা কিনে নেবার জন্য ৯০ কোটী টাকা মূলধনে একটি syndicate করতে হয়েছিল। তাঁর Empire of business বলে একখানা বই বের হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন (Sweeping of office) ঘর ঝাড় দেওয়া হতে সুরু চাই কিন্তু বাঙালী যুবককে যদি এরূপ বলা যায় তাহলে কি উত্তর পাওয়া যাবে তা বোধ হয় বলতে হবে না।
আমাকে অনেকে বলেন “আপনি কি মাড়োয়ারী হতে বলেন?” আমি নিজে নিতান্ত গণ্ডমূর্খ নই—এখনো আমাকে গবেষণায় বেলা ৯টা থেকে ৪টা পর্য্যন্ত প্রত্যহ ব্যাপৃত থাকতে হয়—এবং কার্য্যগতিকে ব্যত্যয় হইলে সেদিন বৃথা গেল মনে করি—আমিও ব্যবসাদার। “মাড়োয়ারী হও” বলিয়া যুবকদিগকে বিপথগামী করি বলিয়া আমার প্রতি সক্রেটিসের মতো হেম্লক বিষের ব্যবস্থা করিবার পূর্ব্বে স্মরণ রাখিতে অনুরোধ করি যে আমি “লেখাপড়া ছাড়” কদাচ বলি না।
“Empire of business” এ বারংবার বলা হইয়াছে যে সর্ব্ব নিম্ন স্তর হইতে আরম্ভ কর। আমাদিগের যুবকগণের মধ্যে হীনতা স্বীকার করিয়া কৃতিত্ব অর্জ্জনের যে কষ্ট তাহা সহিবার শক্তি নাই। প্রায়ই দেখি, কর্ম্ম-শিক্ষাভিলাষী যুবক কোন প্রকারে ১।১॥০ মাস নানা বিভাগের কর্ম্ম কোন প্রকারে একবার চোখ বুলাইয়াই, একটি departmentএর head হইয়া Table Fan ও Secretariat Table পাইবার আবদার আরম্ভ করেন। এ প্রকার ধৈর্য্যহীনতার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম যাহা তাহাতো সকলেই দেখিতেছি।
ইংরেজী প্রথমশ্রেণীর M. A. মাড়োয়ারীর Correspondence clerk সুন্দর সেক্সপীয়র মিল্টনের গৎ আওড়ে তার নাগরীর তর্জ্জমা কর্ছেন! তাই বলি, ঘোড়া বেকুব না সোয়ার বেকুব। কে বুদ্ধিমান—যে চালায় না যে চলে? রামযশ আগড়ওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম—কথাবার্ত্তা হিন্দিতেই হ’ল। দেখি—এর বুদ্ধিমত্তা অদ্ভুত। তিনি প্রথমে সামান্য ফেরীওয়ালা ছিলেন। পরে মুদীর দোকান করেন। এখন ক্রোড়পতি—তাঁর জন্য Railwayএর Siding বহু ব্যয়ে নির্মিত হয়। খড়্গ প্রসাদ শীতল প্রসাদ banker (রাজা মতিলাল এঁদেরই আত্মীয়) একখানা সামান্য তুলোট কাগজের কোণ ছিঁড়ে দুর্ব্বোধ্য নাগরীতে কি লিখে দিলেন—এর ব্যাঙ্ক সমস্ত ভারতবর্ষে—সেই কিম্ভুতকিমাকার লেখার জোরে দেখাবামাত্র টাকা মিলে।
কেবল মসীজীবি হলেই কি বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হয়? অনেক বাঙালী তো partnershipএ ব্যবসা করেন। এক অংশীর অসুখ কিম্বা কোন কারণে চোখের আড়াল হলে কি হয়? আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির অত্যুত্তম বিকাশের দরুণ ব্যবসা হয় মাটি—আর এরা New York, Uganda, Kenya থেকে ক্রোড় ক্রোড় টাকা করছেন, অংশীদারে অংশীদারে কখন গোলযোগ হচ্ছে না। এরা ছাতুখোর? আমাদের মস্তিষ্কে Phosphorus আর তাঁদের Cowdung?
শিক্ষালাভের গরবে আমরা নিজেদের সম্বন্ধে অযথা উচ্চ ধারণা পোষণ করি। আর সেই উচ্চশিক্ষাও কি প্রকারের তাহা আমি ‘সাধনা ও সিদ্ধি’তেই বলিয়াছি। আজকাল উচ্চ ডিগ্রিধারীর ইতিহাস ও ভূগোলের কোন জ্ঞান না থাকিলেও চলিতে পারে। বিজ্ঞানের কিছুমাত্র না জানিলেও উচ্চতম শিক্ষিত হইবার কোন বাধা নাই। এক প্রথম শ্রেণীর এম, এ, ভূগোলের সামান্য প্রশ্নও উত্তর দিতে পারেন নাই। তিনি Civil Service পরীক্ষা দিবেন হয় তো। Italian War of Independence কবে হয়েছিল এবং তাহার নেতা কে কে ছিল জিজ্ঞাসা করায় তাঁকে বিলক্ষণ বিপদে পড়তে হয়েছিল। American Civil War সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় বললেন সপ্তদশ শতাব্দীতে সেই যুদ্ধ হয়। এই প্রকার পণ্ডিত ও শিক্ষিত হবার জন্যই তো আমরা আমাদের সর্বস্ব পণ করিতেছি। আর মাড়োয়ারী, ভাটিয়াদের অশিক্ষিত ছাতুখোর বলিয়া ঘৃণা করিতেছি।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে শিবাজী, আকবর, হায়দার আলি, রণজিৎ সিংহ প্রভৃতি Empire builder অনেকে প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। রণজিতের কীর্ত্তি প্রত্যক্ষ করেছেন এমন লোক এখনো আছেন। আকবর লেখাপড়া জানিতেন কিনা সে সম্বন্ধে এখন তর্ক উঠছে। তিনি Great in War and in Peace ছিলেন। তাঁর সভায় তোডরমল্ল, যিনি বাঙলা দেশের রাজস্বের প্রথম ব্যবস্থা করেন, আবুল ফজল প্রভৃতি পণ্ডিত ও গুণীগণের যথেষ্ট সমাদর হইত। আকবর নিজে পক্ষীতত্ব অনুশীলনে যথেষ্ট আনন্দ পাইতেন। তাই বলিতেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা না পাইলেও শিক্ষিত হওয়া যায়। আমাদের দেশে অনেক মহিলার প্রতিভার কথা বিশ্ববিদিত। নিয়মিত শিক্ষালাভ না করিয়াও কিরূপে আত্মোন্নতি করা সম্ভব হয় তাহা প্রাতঃস্মরণীয়া রাণী ভবানী, ভূপালের বেগম প্রভৃতির জীবন হইতেই জানিতে পারা যায়। Mill তাঁর Subjugation of Women নামক পুস্তকে এদের কথা লিখেছেন। রাণী ভবানী তো কেবল রামায়ণ ও মহাভারত কিছু কিছু আলোচনা কর্তেন কিন্তু তাঁর মেধা ও ধীশক্তি ছিল অসাধারণ।
আসল কথা, there is something rotten somewhere. বাবু সুন্দরমলের কথাই ধরুন। ইঁহার গিরিধি অঞ্চলে অভ্রখনি আছে। অনেক Geologyতে Ist class M. A. এর অধীনে prospect করে। এই সমস্ত কৃতবিদ্য বঙ্গজননীর সুসন্তানগণ দ্বারা হয় ইংরেজ নয় মাড়োয়ারীর অধীনে নক্রি করা ছাড়া আর কিছু হওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু ইহারা মাইকায় শতকরা কত ভাগ ম্যাগ্নেসিয়াম ইত্যাদি আছে কিছুই জানেন না এবং Geology ও Chemistryর কোন ধার ধারেন না—কিন্তু কেমন এঁদের দৃষ্টি এঁরা বুঝতে পারেন কোথায় কোন qualityর অভ্র পাওয়া যাবে। তাঁরা সেই সমস্ত স্থানের মৌরসি নিয়ে রাখেন আর আমাদের কৃতবিদ্যরা Chemistry, Geology পড়েই যাচ্ছে কিন্তু তাহা নিজের কাজে লাগান কদাচ সম্ভব হচ্ছে না। লেখাপড়া আমি ছাড়তে বলি না কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগগুলি আমি বলি। বাঙালী ছাত্র পাঠ্যাবস্থায় যা শেখে তার দশগুণ সেই সময়ে তার শেখা উচিত। ছাত্রেরা শুধু Syllabusএর দোহাই দিয়ে বসে থাকবে—অর্থাৎ কেবল পরীক্ষকদের চোখে ধূলো দেওয়াই হচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য। জ্ঞানার্জ্জনের দিকে দৃষ্টি কোথায়? Paradise lostএর এক অংশ, ভট্টির দু’সর্গ পড়লেই কৃতবিদ্য হওয়া যায় না। এই বান্ধা রাস্তা ছেড়ে তো ছাত্রেরা রেখামাত্র বিচলিত হবে না।
Undergraduateদের ছমাস ছুটী। Post graduateদের বছরে সাত মাস। শ্রীযুক্ত আশু বাবু হিসাব করে বলেছেন এম-এ ক্লাসে বছরে ১৫০ দিনের বেশী পড়ান হয় না। আমি ছুটীর সময় ছাত্রেৱা কিরূপে সময় যাপন করে তা’ সন্ধানী রেখে জেনেছি। আমাদের পল্লীগ্রামের বাড়ীতে আমার সঙ্গের ছাত্রদের মধ্যেও দেখি দুপুর বেলায় একখানি বই হাতে নিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে নিদ্রা দেবীর স্মরণ নেওয়া। একজন সবল সুস্থ যুবক যে কেমন করে বহুমূল্য সময় এই রকম করে নষ্ট করে তা আমার বুদ্ধির অগম্য। ছুটীর সময় বাইরের বই রাশি রাশি পড়ে Syllabus এর সঙ্কীর্ণতা কেন দূর কর না? দেশে তো কাজ করিবার মতো কাজের কিছু অভাব নাই, ছুটির সময় এগুলি করিলে হয় না? নিরক্ষরের সংখ্যা এদেশে এমন কিছু কম নয়—এদের মধ্যে জ্ঞান বিস্তারের প্রয়োজন নাই এমন তো নয়। দীন মজুরদের সংসর্গ ভাল লাগে না? কেন লাগ্বে? প্রাসাদোপম hostelএ থেকে, আড্ডা দিয়ে বায়স্কোপে দিন কাটিয়ে কি আর পাড়াগাঁয়ে গিয়ে এদের নিয়ে ভাল লাগ্তে পারে? পল্লীই হচ্ছে আজ আমাদের বিস্তীর্ণ কর্ম্মক্ষেত্র। ইংরাজ বালক মায়ের কোলেই (by the fire side) বা কত শেখে! কত পত্রিকা তাদের জ্ঞানস্পৃহা বৃদ্ধি করিবার জন্য। তারা বড় হয়ে স্কুল কলেজে যেয়ে জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। তারা books of adventureএ ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়ে কত কৌতূহলী হয়। আমাদের কোন শিক্ষিত যুবককে যদি Livingstoneএর কথা জিজ্ঞাসা করা যায় তাঁরা বিশেষ কিছু বলতে পারবেন না। এই তো হিমালয়ের দুরধিগম্য শৃঙ্গে আরোহণের সেদিন কত চেষ্টা হল, কয়জন যুবক তার বিবরণ পাঠ করেছেন। এই যে বিমানচারীরা কলিকাতা হতে রেঙ্গুন যাত্রা করেছিলেন এঁদের খবর জানবার জন্য কয়জনের প্রাণে আগ্রহ হয়েছিল। ইংরেজ সম্প্রদায় এঁদের খবর watched with intense interest আর আমরা তো তোয়াক্কাই রাখিনি। আমাদের জীবনের উদ্ভদ্দশ্য তো কোন প্রকারে দিনগত পাপক্ষয় করে যাওয়া। Examiner কি পছন্দ করেন তাই খোঁজ। নোট লইয়া মেসে মেসে দৌড়াদৌড়ি। উৎসাহ আমাদের ওই পর্য্যন্ত। Stephen সাহেব কি note দিয়েছেন তাই জান্তে ব্যস্ত, তাই কোন রকমে মুখস্থ করে কোনমতে ফাঁকি দিয়ে উঠ্তে পার্লেই, হ’ল—আর কেন! Boswellএর Life of Johnsonএ পড়েছি তিনি এক Garretএ বসে গোটা গোটা লাইব্রেরী পড়ে শেষ করতেন। Benjamin Franklin খুব বড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তিনিই lightning conductorএর প্রবর্ত্তক। ঘুড়ি উড়িয়ে মেঘস্থিত বিদ্যুতের সহিত পার্থিব বিদ্যুতের ঐক্য তিনিই স্থাপন করেন। আর তিনিই American War of Independence এর একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। প্রথমে ইংলণ্ডে পরে ফ্রান্সে তিনি দূত হন। তিনি ছিলেন self-taught, তাঁর আত্মজীবনী অতি চমৎকার পুস্তক—তাতে দেখি তিনি প্রথমে ছিলেন Compositor. Count Rumfordও স্ব-শিক্ষিত (self-taught) ছিলেন। বর্ত্তমান যুগে কার্য্যকরী আবিষ্ক্রিয়ায় যিনি শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করিয়াছেন সেই এডিসনের মাত্র কয়েক মাস স্কুলে শিক্ষালাভ করিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল। অথচ তাঁর মতো inventor জগতে খুব কমই হয়েছে। দু’চারখানা কেতাব স্কুলে পড়ে আর কতটুকু বিদ্যে হয়? তাই বলে converse সত্যি নয়। যাঁরা self-taught তাঁরা নিজের চেষ্টায় সব শিখেছেন।
বাঙালী কেন পারে না? বাঙালী মনঃসংযোগ করে একাগ্রচিত্তে কোন সাধনাই করতে পারে না। আমাদের জাতীয় জীবনের সর্ব্বাপেক্ষা সর্ব্বনাশ এই উড়ুউড়ু মনের জন্যই হয়েছে। আমাদের ভাবপ্রবণ প্রাণে আবেগ উচ্ছ্বাসের অন্ত নাই। খড়ের আগুনের মতো আমাদের উৎসাহ বহ্নি দপ্ করে যেমন জ্বলে উঠে, নিব্তেও তার দেরী হয়না তেম্নি। লাগপড় হয়ে লেগে না থেকে সিদ্ধি কবে কে লাভ করেছে? আজকাল ছাত্রদিগের কাহাকে কাহাকেও যদি জিজ্ঞাসা করা যায় “ওহে তুমি ল’ পড়ছ নাকি?” অমনি যেন কৈফিয়ত দেবার জন্য অতি ব্যগ্র হয়ে উত্তর করে থাকেন “আজ্ঞে হাঁ, পড়ছি কিন্তু ওকালতি করব না।” অথচ, কত বই কিন্তে হচ্ছে কত টাকা খরচ কর্তে হচ্ছে। আমাদের কেবলি দুমনা হয়ে কাজ করা। এইরূপে জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ আমরা মনঃস্থির করতে না পেরে ইতস্ততঃ ভাসমান হয়ে বেড়াতে থাকি এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল যদি বিফলতা আসে তবে কাহাকে দোষ দিব?
মাড়োয়ারীরা ছাতুখোর, কিন্তু তারা জয়ী হয়। তার কারণ তারা আমাদের মতো অত বেশী বুদ্ধিমান নয়। অতশত অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে আট ঘাট, অন্ধি-সন্ধির সন্ধান নিতে নিতেই গ্রাস তাদের মুখছাড়া হয় না। তারা ‘মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পতন’। তাদের ঝাড়ু দিতেও আপত্তি নেই, দরকার হলে এক আধমণ মোট বইতেও লজ্জা নাই।
একজন বাঙালী কর্ম্মচারী আমায় বল্ছিলেন (তিনি ইংরেজ আফিসে কাজ করেন) তিনি সেদিন বড় লজ্জা পেয়েছেন। ঘর থেকে একটা জিনিষ সরাবার প্রয়োজন হয়েছিল। তিনি বেহারার সন্ধান না পেয়ে ইতস্ততঃ কর্ছিলেন। আফিসের বড় সাহেব এসে দেখে নিজেই আস্তিন গুটিয়ে যখন লেগে গেল তখন সেই বাঙালী লজ্জা পেয়ে নিজেও লেগে যেতে বাধ্য হলেন। তাই আমি বলি, কাজে দাঁড়িপাল্লা ধরা থেকে লেগে যাও। দোকান করতে হলে বাঙালী দোকানদারের অবস্থা সাক্ষী গোপালের মতো; একজন কর্ম্মচারী বেহারা না হ’লে চলে না। ছোট স্তর গুলি এড়িয়ে এরা একেবারে হাতে স্বর্গ পেতে চান। আমরা আইনও পড়ি, ব্যবসায়ও করি। এটা যদি না হয় তবে ওটা ধরব। এইরূপ পাটোয়ারী বুদ্ধিই আমাদের সর্ব্বনাশের প্রধানতম হেতু। বিফলতা জীবনে আসেই। যার জীবনে বিফলতা আসেনি সে তো fair weather sailor. বাধা বিঘ্ন বিপদ অতিক্রম করাতেই তো প্রকৃত মনুষ্যত্ব। লাভ করতে গেলে লোকসান দিতে হয়। তাই বলে অতি বুদ্ধিমানের মতো অত অন্ধিসন্ধি এঁটে চলার পরিণাম আমাদের বাঙালী জীবনই তার উদাহরণ। বিফলতা আমাদের অকেজো করে কিন্তু জীবনে যারা জয়ী হয়েছে—বিফলতার উপর ভিত্তি করেই তাদের সৌভাগ্যের প্রাসাদ রচিত।
সম্প্রতি U. P. Governmentএর Chemical Examiner, Dr. Hankin একখানি বই লিখেছেন “Mental limitations of the Experts” এই বই থেকে কিছু বচন উদ্ধৃত করছি। এই পুস্তকের প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে যাঁরা বিশেষজ্ঞ তাঁরা টোলো পণ্ডিত। ঘটত্ব পটত্ব আলোচনায় বিশেষজ্ঞের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চলে যাওয়া কিন্তু নূতন নয়। ইংরাজীতে dunce কথাটার অর্থের উৎপত্তি বড়ই কৌতুকাবহ। Duns Scotus ব’লে ইউরোপে আমাদের নবদ্বীপের নৈয়ায়িকদেরই এক বিশিষ্ট সংস্করণ ছিলেন। Scholastic philosophyর ইতিহাসে ইনি প্রসিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এঁর ছাত্রদিগকে লোক dunce বল্ত—অর্থাৎ followers of Duns Scotus. এঁদের পাণ্ডিত্যের জোরে কথাটার অর্থের কিছু গোলমাল হয়ে এখন যা হয়েছে তাতে গুরু নিশ্চয় শুনে আহ্লাদিত হতেন না। কেতাবী বুদ্ধির সঙ্গে বুদ্ধিহীনতার সাদৃশ্যে dunce কথাটার বর্ত্তমান অর্থ হয়েছে যাঁরা যত বিশেষজ্ঞ তাঁরা তত সংসার-জ্ঞানানভিজ্ঞ। ডালে তেল দেওয়া দেখে স্ত্রীকে দেবী ভ্রমে স্তুতি করা পণ্ডিতেই সম্ভব! প্রভূত শক্তির অপব্যয় করে এই রকম পাণ্ডিত্য অর্জ্জন করতে আমাদের ১৬।১৭ বছর অর্থাৎ ২৪।২৫ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত কেটে যায়। এর মধ্যে পরীক্ষা ফেল করা আছে। ২৫।২৬ বৎসর বয়স পর্য্যন্ত প্রাণপাত পরিশ্রমে কার্য্যকরী সমস্ত শক্তির ক্ষয় হয়। তাই একটা কথা আছে, a good education is hostile to business instinct. বহুদর্শী প্রসিদ্ধ Canadian শিক্ষক Stephen Laycock বলেছেন “Those who seem the laziest and least enamoured of boóks” তারাই ব্যবসায়ে কৃতকার্য্য।
It was notorious that the education imparted was so good that its boys were constantly getting scholarships and exhibition, it was equally notorious one never seems to bear of them afterwards. যেমন আমাদের দেশের মিত্র ইন্ষ্টিটুসন প্রমুখ বিদ্যালয়—এদের ছেলে আকৃষ্ট করিবার জন্য যেমন বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় কোন বৎসর কতজন বৃত্তি পাইয়াছে ইত্যাদি। আমি কোন বিদ্যালয় বিশেষকে লক্ষ্য করে বল্ছিনা। সর্ব্বত্রই ঐ একই প্রকার। আমিও বাগেরহাট কলেজে সংশ্লিষ্ট আছি। আমাদিগকেও খদ্দের ডাকিতে এইরূপ ভনিতা করিতে হয়। কিন্তু বিদ্যার দৌড় এই সমস্ত কৃতীগণের ঐ পর্য্যন্তই। ঐ খানেই দীপ নির্ব্বাণ! Senior wrangler গণের দু’ একজন Clerk Maxwell প্রভৃতি ছাড়া জগৎ আর অনেকেরই নাম শোনেনি। The world never heard of them. এডিসন্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি কলেজম্যান তাঁর পরীক্ষাগারে নেন না কেন? তিনি উত্তর করেছিলেন “The College ones are not worth d—d etc. Herbert Spencer বলে গেছেন “absence of education and high engineering skill এক সঙ্গে সর্ব্বত্র বর্ত্তমান; জেমস্ ষ্টীফেনসন “taught himself writing during his apprenticeship.” স্যর বেঞ্জামিন বেকার (এডিনবরার নিকট) Forthbridge তৈরি করেন তা’ দেখেছি—এটি greatest and most remarkable bridge in the world. ইনিও regular engineering education পান নি। কিন্তু এঁর যা initiative, তা পুস্তকগত বিদ্বান কোথায় পাবেন। Rhodes একজন Empire builder, ইনি College don দের সম্বন্ধে (অর্থাৎ Oxford Cambridgeএর কৃতবিদ্যদের সম্বন্ধে) বলেছেন “they are babes in financial matters” এগুলো ভাববার কথা।
এই যে পাশকরার জন্য তৃষ্ণা—বিসূচিকা রোগের তৃষ্ণার মতো এর আর একটি দোষ—এক ঘেয়ে ভাবে আবহমান কাল চলার ইচ্ছা। বাপ উকীল অতএব ছেলেকে উকীল হতে হবে। কেননা, বাঁধাঘর রয়েছে—ছেলের আইনে রুচি নাই—তবুও শিখ্তে হবে। বাপের চার ছেলের উকীল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, স্কুল মাষ্টর হতেই হবে। যে পুত্ত্র প্রতিভার পরিচয় দেয় তাহাকে সর্ব্বতোভাবে শিক্ষা দাও কিন্তু জোর করে যার রুচি নাই তাহাকে বাঁধা ঘরের খাতিরে পড়ানো উচিত নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যত বেশী থাকা যায়, অকর্ম্মণ্যতা তত বেশী বাড়ে। অনেকে আমার কাছে পরামর্শের জন্য আসেন। আমি জিজ্ঞাসা করি gtaduate হয়েছেন কিনা? যাহারা graduate তাহাদের বলি— তোমাদের সকল পথ রুদ্ধ হয়েছে। শুন্লাম, ইন্কম্ ট্যাক্সের আপিসে কতগুলি বড় মাহিয়ানার চাকরী খালি হইয়াছিল। ৬।৭ হাজার প্রার্থী দরখাস্ত করেছিল। আবার এদিকে Civil Serviceএর চার ফেলা হয়েছে। সমস্ত ভারতবর্ষ হতে ১০।১২টি চাকরী। বীজগণিতের chance & probability হিসেব করলে এর একটি পাওয়ার সম্ভাবনা কোথায় দাঁড়ায়? ফরিদপুর কলেজের কর্ত্তৃপক্ষ খুব আনন্দ করে কিছুক্ষণ পূর্ব্বে টেলিগ্রাম করেছেন যে তাঁহাদের কলেজের nomination করিবার অধিকার মিলিয়াছে। তাঁহারা যে পরিমাণে nomination করিবেন তাহাতে তাঁহাদের ছাত্রদের সম্ভাবনা কিরূপ (probability অনুযায়ী) তাহা চিন্তা করিলে আনন্দবেগ নিশ্চয়ই সম্বরণ করিতে হইবে।
এক সময় ছিল যখন ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রভৃতি ভদ্রশ্রেণীর ভিতরই শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আজ সমাজের নিম্নস্তরেও সাড়া পড়িয়াছে। এখন নমঃশূদ্র মুসলমান সকলের মধ্যেই অসাধারণ চেতনা জাগিয়াছে। কিন্তু এই শিক্ষার লক্ষ্য কি কয়টি appointmentএর জন্য প্রতিযোগিতায় দাঁড়াইবে? কাজ খালি হয় আর কয়টী।
বাঙালা অবাঙালীর হয়ে গেছে। পূর্ব্ব ও পশ্চিম বঙ্গে মাড়োয়ারী পাট, তিসি, সরিষা, ধানের দাদন দিতে আরম্ভ করেছে। পাড়াগাঁয়ে এখনো জমিদার মহাজন আছেন বটে কিন্তু আসলে মাড়োয়ারীগণ মালিক। তারা ঊষর মাড়োয়ার হতে লোটা কম্বল সম্বল করে এসে আমাদের দেশটা তিলে তিলে জয় করে নিচ্ছে আর আমরা সুখ নিদ্রায় সমাসীন। আমরা civil serviceএর সুখ স্বপ্নে, এসব নজরে নিচ্ছি না। আর সেই Civil Service আন্দোলনেরও তো মরণ কামড় আরম্ভ হয়েছে। মর্নিং পোষ্ট লর্ড রেডিং এর recall দাবী করেছে | England এ Civil Servantরা কেরাণী এখানে তারা শাসন কর্ত্তা। খুলনা দুর্ভিক্ষের সময় Civil Service এর file দুরস্ত কাজের নমুনা আমার দেশবাসী একটু পেয়েছে; ম্যাজিষ্ট্রেটের হাতে দুর্ভিক্ষ তদন্তের হুকুম ছোট বড় নানা প্রভুর মধ্য দিয়া পেয়াদাতে এসে পৌঁছায় এবং সেই রকমে তথ্য সংগ্রহ হলে তার বিবরণ পড়ে দেশবাসী অবাক হয়। খুলনার দুর্ভিক্ষের সময় নাকি Milk could be had for the asking—and fruits were in abundance—মাছও নাকি যথেষ্ট ছিল—ধরে খেলেই হল। File ভিন্ন ম্যাজিষ্ট্রেট্রা চলেন না তাও personal assistant ডকেট করে দেয়। এইরূপ কার্য্যকুশলতার অধিকারে তাঁরা দেশের প্রকৃত শাসনের কাজগুলি একচেটিয়া বলিয়া দাবী করেন। আমাদেরও সংস্কার Civil Service এর জবরদস্ত শিক্ষা ছাড়া কলিকাতা করপোরেশনের চেয়ারম্যানী করা চলে না। কিন্তু সম্প্রতি এই ভবানীপুর অঞ্চলেরই সুরেন্দ্রবাবু দেশবাসীর সে ভ্রম দূর করেছেন। (Official Spectacle) সরকারী চশমায় দেখলে আর sound common sense থাকে না। ধরা বাঁধা রাস্তায় চল্লে বিদ্যা বুদ্ধি বাঁধা সাঁধা হয়ে পড়ে। কর্ণেগির লোহার কারবার কিনে নেবার জন্য সিণ্ডিকেট তৈরি হয়েছিল। সেই সিণ্ডিকেট তৈরি করেছিলেন Morgan, তিনি এক অসাধারণ পুরুষ। যুদ্ধের সময় যখন আমেরিকার টাকা তোলার দরকার হল তখন এই ব্যক্তির খোঁজ পড়ল। এই Morgan বলেন ২৷৷৹ শত ডলার দিয়ে একজন বিশেষজ্ঞের নিকট হতে ২৷৷৹ লাখ ডলারের কাজ আদায় করা যায়। আমাদের দেশেরও সুন্দরমল প্রমুখ ব্যবসায়ীগণ ২৷৷৹।৩ শত টাকার মাহিয়ানা দিয়ে যে সমস্ত বিশেষজ্ঞ রাখেন তাদের দ্বারা কত টাকা রোজকার করেন তার ঠিকানা নাই। বিশেষজ্ঞ ‘কলুর চোখ ঢাকা বলদের’ মতোই চলিতে জানে। কিন্তু ব্যবসায়ী কলু এদের দ্বারাই তৈল প্রস্তুত করেন। আমাদের দেশের স্যর রাজেন্দ্র মুখার্জি যদি আজ B. E. হ’তেন তাহলে দেশের কত বড় যে লোকসান হত তা কি করে বলব। তিনি হয়ত সরকারী উন্নতি মার্গে এতদিনে বড় জোর District ইঞ্জিনিয়রত্বে এসে পৌঁছিতেন; এবং Chairman এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের কুঠীতে প্রমোশনের জন্য হাঁটা হাঁটি করে অন্তরনিহিত শক্তি নিঃশেষ করিতেন। কিন্তু ভাগ্যগতিকে তাঁহাকে নিজের পায়ের উপর দাঁড়াবার প্রয়োজন হওয়াতে আজ তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ একজন পুরুষ। J. C. Banerjiর career আমি অনেক বার বলেছি। বাঙালীদের মধ্যে Railway administration এ যিনি বিশেষজ্ঞ সেই সাত কড়ি ঘোষও কেবল নিজের পায়ে চলেই আজ পুরোভাগে এসেছেন। Associated Pressএর কেশবচন্দ্র রায় মহাশয়ের জীবন আরো শিক্ষাপ্রদ। ইনি হিন্দু হোষ্টেলের বাজার সরকার ও লাইব্রেরীয়ান ছিলেন। এঁর ক্ষমতা অসীম। মধ্যরাত্রে বড়লাটকেও টেলিফোঁ করিয়া ইনি পরামর্শ করিবার ক্ষমতা রাখেন।
তাই বলিতেছিলাম, লক্ষ্য স্থির রাখিয়া সাধনা করিলে সিদ্ধি নিশ্চিত। দুর্গা বলে ঝুলে পড়। Policy of driftingই সর্ব্বনাশ করবে। ল’ পড়ছি—পড়ে রাখিনা—ওকালতি তো করব না—বাপের কাছে কিম্বা শ্বশুরের কাছে তিন বছর আরো খরচ পাওয়া যায়। এই রকম উদ্দেশ্য বিহীন জীবন যাপন আর করো না।
অনেকে বলেন “তবে কি আপনি আমাদিগকে মাড়োয়ারী হতে বলেন”? আচ্ছা এই যে Sir Hugh Bray, Sir Alex, Murray এঁরা কি অশিক্ষিত? Oxford, Cambridge এ নাই বা পড়লেন? Siry Edmund Ironside কি মাড়োয়ারী? Fiscal Committee তে সদস্য স্যর ইব্রাহিম করিমভাই। ইনি ক্রোড়পতি কাপড়ের কলওয়ালা। কোন্ বাঙালী Cobden medallist—ইহার মেম্বর হবার জন্য আহুত হলেন?—এদেশে Economiesএর প্রথম শ্রেণীর তো অভাব নাই? শ্রীযুক্ত ঘনশ্যাম দাস বির্লা এর একজন মেম্বর হয়েছেন। এঁদের শিক্ষা হাতে কলমে। বোম্বায়ে মিঃ দালাল Reverse Council এর কুফল সম্বন্ধে যে রকম মন্তব্য করেছিলেন তাইতো ফলে গেল, কিন্তু কয়টা Economicsএর Ist. class বা অন্য কেহ সেটা তখন বুঝ্তে পেরেছিলেন? স্যর সাপুরজি ভারুচ্চা, ইনি prince of share market. স্যর জমসেদ্জী তাতা নিজে বৈজ্ঞানিক ছিলেন না, কিন্তু ৩০ লাখ টাকা দিয়ে ব্যাঙ্গালোরে Institute of Science করেছেন। Chemistry, Geology না জেনেও তো তাতা অতবড় লোহার কারখানা সৃষ্টি করেছেন। তাতার ম্যানেজার বড় লাটের চেয়ে বেশী বেতন পান। এদের Expert Perrin বছরে দুতিন মাস থেকে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে যান। যিনি এত বড় বড় সব Scheme করেছেন, তিনি ছিলেন স্বয়ংশিক্ষিত (self-taught).
Venice তার স্বাধীনতার জন্য বাণিজ্যজীবি সন্তানদের কাছে ঋণী ছিল। আসল কথা, যেখানে স্বাধীন চিত্তা, সেখানেই অবাধ বাণিজ্যোন্নতি এবং সেখানে স্বাধীনতাও অবশ্যম্ভাবী। Dutch republicএর ইতিহাস আলোচনা করলেও ঐ একই মুলসূত্র দেখতে পাওয়া যায়। হল্যাণ্ডের অর্দ্ধেক সমুদ্রতল হ’তে নিম্ন ভূমিতে স্থিত। ডাইক বেঁধে, বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে নিয়ত সংগ্রাম করে তাদের জীবন ধারণ করতে হয়। Philip II এর মতো নরপতির সঙ্গে তারা অবহেলে যুদ্ধ করল। William the Silent ছিলেন তাদের নেতা। ডাচেরা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়, ফিলিপের অজস্র সম্পদ,—মেক্সিকে, পেরু খনি হতে রাশীকৃত রূপা তার আয়ত্তাধীন কিন্তু তবুও ডাচদের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হল। কেননা, বাণিজ্যজীবী ডাচেরা স্বাধীনতার প্রকৃত মর্ম্ম জানত।
আমাদের গৃহের আবহাওয়া আমাদের চরিত্রগঠনোপযোগী নয়। আনন্দময় গৃহের প্রভাব জীবনকে সুগঠিত করে কিন্তু আমাদের যুবকগণ গৃহের শত দৈন্য প্রভৃতিতে অকালে ভারাক্রান্ত হয়ে উদ্যম শক্তি হারিয়ে ফেলে। স্যাডলার বলেছেন যে তিনি বাঙালী যুবককে হাসতে দেখেন নাই। আশ্চর্য্য হবার কোন কথা নয়। বাড়ীতে গুরুজনদের দিবা রাত্র শত অভারের আলোচনা শুনে যুবকগণ হৃদয়ে বল হারিয়ে ফেলে। তারপর, নানা সামাজিক কুসংস্কারও এইরূপ অবস্থার জন্য কম দায়ী নয়। সামাজিক কুপ্রথার কথা আলোচনা করে কোন ফল নাই। আমরা Spiritual জাতি—ইউরোপীয়রা জড়বাদী। আমাদের আর কিছু শিখিবার, সংশোধন করিবার নাই। রাস্তায় কুষ্ঠ রোগী দেখে আমরা পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত পাপের ঘাড়ে বেচারার রোগ যন্ত্রণা চাপিয়ে রেহাই পাই কিন্তু জড়বাদী ইউরোপীয়রা নিজের জীবন তুচ্ছ করে তাদের সেবা করে। মরে আমাদের জাত ভায়েরা কুষ্ঠ রোগে, আর পরমাধ্যাত্মিক আমরা দূরে পলায়ন করি, সেবা করে বিধর্ম্মী জড়বাদী ওরা। দেশের প্রায় সমস্ত কুষ্ঠাশ্রম গুলিই তো ওদের। ওরাই আবার সাঁওতাল পরগণার ঘোর অরণ্যে যেয়ে সাঁওতালদের মানুষ করছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন “আমাদের spirituality অকর্ম্মণ্যতার অজুহাত মাত্র।”
যাক্, নিরাশার কথা আর বলব না। আজ দিকে দিকে সাড়ার লক্ষণ দেখিতেছি ইহাই আশার কথা। সেদিন পরলোকগত বরেন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের স্মৃতি সভা হল। ইনি যুবকমাত্র ছিলেন কিন্তু বম্বে অঞ্চলে কাপড়ের কল স্থাপন করে যশ্বস্বী হয়েছিলেন, অনেক জেনে কারবার স্থাপন করে গেলেন। এইরূপ যুবকগণের ভিতর প্রাণের সঞ্চার হইতেছে—ইহাই ভরসার কথা। আজ ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি—বাঙালীর আশা পূর্ণ হউক—নব প্রেরণার উৎস শতধা হইয়া আমাদের জাতীয় জীবনকে কানায় কানায় পূর্ণ করুক। আমরা অন্তরের অন্তঃনিহিত অজস্র শক্তির খনির যেন সন্ধান পাইয়া স্বাবলম্বী হই—প্রকৃত শিক্ষার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া চলিয়া যেন আবার নিজেদের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করিতে সমর্থ হই।