আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/১২
১২
শিক্ষাবিষয়ক কয়েকটী
কথা[১]
আমাদের ছেলেরাই আমাদের জাতীয় জীবনের ভবিষ্যৎ আশাস্থল। তাহাদের উপর আমাদের দেশের উন্নতি সর্ব্বতোভাবে নির্ভর করিতেছে। দেশের দুঃখ দূর করিতে, ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্প দ্বারা অর্থ উপায় করিয়া আনিয়া দিতে, লোকশিক্ষার দ্বারা জনসাধারণের দৈহিক, নৈতিক ও মানসিক উন্নতি বিধান করিতে, তাহারাই আমাদের সম্বল। যথোচিত শিক্ষাদানে যাহাতে তাহাদিগকে চরিত্রবান, জ্ঞানবান ও কর্ম্মবীর করিয়া তুলিতে পারি, ইহাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। যাহাতে তাহারা মাতৃভূমির সমস্ত দুঃখ মোচন করিবার জন্য উপযুক্ত সুসন্তান হইয়া উঠিতে পারে, সেই দিকে দৃষ্টি রাখা, আমাদের সকলের একান্ত কর্ত্তব্য।
নিজের নিজের বাড়ীর পরেই স্কুল হইতেই আমাদের জীবনের শিক্ষা ও চরিত্র গঠন আরম্ভ হয়। উত্তরকালে যে যেরূপ হইবে, তাহার ভিত্তিস্থাপন স্কুলগৃহেই। এতগুলি নবীন জীবনের বিকাশের সাহায্য করিবার ভার যাহাদের উপর ন্যস্ত, তাহাদের দায়িত্ব কত বেশী, তাহা আমরা সকলেই বুঝি। ছেলেবেলায় নরম মনের উপর সহজেই যে ছাপ পড়ে, বড় হইলে কখনই তাহা আর মুছে না। তখন অলক্ষিতভাবে যে প্রবৃত্তি ও চিন্তা আমাদের মনে প্রবেশ করে, সারাজীবন আমরা তাহাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইয়া থাকি। সেইজন্য ভাল শিক্ষকের ঋণ আমরা কোন কালে শোধ দিতে পারিনা। তাহারা চেষ্টা করিলে ছেলেদের মন ভালরই দিকে ও অবহেলা করিয়া বা ভ্রমবশতঃ তাহাদিগকে মন্দের দিকে চালিত করিতে পারেন। এরূপ ভাবে দেখিলে বুঝা যায় পিতামাতার ন্যায় শিক্ষকের প্রভাব আমাদের উপর বড় সামান্য নয়।
এইরূপ গুরুভার যাঁহাদের উপর ন্যস্ত, দুঃখের বিষয় আমরা তাঁহাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখি না। যাঁহারা ছেলেদের শিক্ষা দিবেন, তাঁহারা সে কার্য্যের যথার্থ উপযোগী কিনা, শিক্ষা দিবার তাঁহাদের যথেষ্ট সামর্থ্য আছে কিনা, তাহা আমরা ভাবিয়া দেখিনা।
আমাদের স্কুলে শিক্ষকের বেতন খুব সামান্য। অনেক কাব্যতীর্থ কিংবা আই, এ, উপাধিধারী শিক্ষকের মাহিনা আমাদের দেশের সামান্য শ্রমজীবির মাসিক উপার্জ্জনের অপেক্ষা অনেক সময় কম। আজকাল বিদ্যা অপেক্ষা অর্থের আদর অনেক বেশী। জনসমাজে খাতিরও আজকাল অর্থের পরিমাণের দ্বারা হয়। শুধু অর্থোপার্জ্জনের পথ সুগম করিব এই আশায় আজকাল আমাদের বিদ্যাশিক্ষা; সে হিসাবে শিক্ষকের স্থান অনেক নীচে পড়ে। কলিকাতায় বড় লোকের বাড়ীতে বাজার সরকার, মোসাহেব প্রভৃতি আসবাবের সহিত স্কুলমাষ্টার স্থান পাইয়া থাকেন। তাঁহারা যে কিরূপ মহৎ কার্য্যে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন, তাহা আমরা ভাবিয়া দেখি না।
তাহার ফলে এই দাঁড়াইয়াছে যে যাঁহারা জীবনে আর কোন রকম জীবিকা অবলম্বন করিতে পারেন নাই, তাঁহারাই প্রায় স্কুলমাষ্টার হন। তাঁহাদের হয় হোমিওপ্যাথিক বাক্স লইয়া ডাক্তারি করিতে হইবে, না হয় স্কুলে মাষ্টারী করিতে হইবে। মাষ্টারীর মাহিনা এত অধিক নয় যে, সেটী একটী আকর্ষণ স্বরূপ হইবে। সকলেরই দৃষ্টি কোম্পানীর নোক্রী, মুন্সেফী, ডেপুটীগিরি ইত্যাদির প্রতি, সে সব না হইলে তখন অগতির গতি মোক্তারি ও ওকালতি। অনেক সময় দেখা যায়, যাঁহারা এই কার্য্যে ব্যাপৃত আছেন, তাঁহারা নিজেদের কার্য্যের গুরুত্ব বুঝেন না। তা ছাড়া জীবন সংগ্রাম তাঁহাদের কাছে অনেক সময় অতি ভীষণ আকার ধারণ করে। বেতন এত অল্প, যে, অনেক সময় বাধ্য হইয়া অবসর সময়েও উপার্জ্জনের অন্য পন্থা দেখিতে হয়। অনেকে সকাল বিকাল ও রাত্রে টিউশনি করেন। এই অক্লান্ত পরিশ্রমের পর স্কুলের কয় ঘণ্টা অনেক সময় তাঁহাদের বিশ্রাম স্বরূপ হইয়া থাকে। প্রকৃত শিক্ষাদানের জন্য যেরূপ মানসিক অবস্থা থাকা উচিত সেরূপ ধৈর্য্য ও সংযম প্রায়ই থাকেনা। ছাত্রদিগের শিক্ষার উন্নতির বিষয় ভাবিবার জন্য অবসর পর্য্যন্ত পান না। এই দায়িত্বপূর্ণ কার্য্যের প্রতি তাঁহাদের যে শ্রদ্ধা ও অনুরাগ থাকা উচিত, তাহার কিছুই থাকে না। রুটীন (Routine) অনুযায়ী “দিনগত পাপক্ষয়” করিলেই তাঁহাদের দায়িত্বের অবসান হইয়া থাকে।
এই প্রণালীতে কার্য্য চলাতে, যে সকল কুফল হইতেছে তাহা আমাদের কাহারও অজ্ঞাত নাই। যথার্থ জ্ঞানের উপর আমাদের ভক্তি শ্রদ্ধা চলিয়া যাইতেছে। পড়াশুনা কেবল এখন পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। প্রকৃত বিদ্যার আদর নাই। আমরা কেহই এ শিক্ষাপ্রণালীর উপর সন্তুষ্ট নই। এমন কি শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর মহোদয় স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন যে আমাদের স্কুলের অবস্থা শোচনীয়। স্কুলগৃহে ছাত্র সংখ্যা বেশী হওয়ায় স্থানাভাব। অল্প বেতনে শিক্ষক মহাশয়েরা কেহই সন্তুষ্ট নহেন।
বিদ্যাদানের বিষয়ে আমাদিগকে এরূপ অমনোযোগী হইলে চলিবেনা। ইহার উপর আমাদের জাতীয় জীবনের সমগ্র ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। যাহাতে শিক্ষকদিগের অর্থকষ্ট দূর হয় তাহার জন্য সকলের চেষ্টা করা উচিত। স্কুলের সংখ্যা যাহাতে আরও বৃদ্ধি পায়, শিক্ষা যাহাতে আরও বিশেষ করিয়া জনসাধারণের অনায়াসলভ্য হইয়া উঠে, তাহার জন্য চেষ্টা করা আমাদের প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তির কর্ত্তব্য। পুরাকালে অধ্যাপকেরা যেরূপ অল্পে সন্তুষ্ট থাকিতেন, এখনও যে তাঁহারা তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিবেন, তাহা আশা করা অন্যায়। সময়ের পরিবর্ত্তনের সঙ্গে আমাদের জীবনযাপনের প্রণালীরও যথেষ্ট পরিবর্ত্তন হইয়াছে। অনেক নূতন নূতন আকাঙ্ক্ষা আমাদের মনে জাগিতেছে। অভাবও বাড়িয়া চলিয়াছে। সুতরাং এখন আর সেরূপ অল্প টাকায় কাহারও চলিতে পারে না। শিক্ষকদিগের বেতন না বাড়াইলে আমরা যোগ্য শিক্ষকের আশা করিতে পারি না। নিজেদের অন্ন চিন্তার জন্য যদি তাঁহাদিগকে ব্যস্ত থাকিতে হয় তবে শিক্ষকেরা কিরূপে প্রশান্তভাবে শিক্ষাকার্য্যে মনোনিবেশ করিবেন?
ইহাও আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে, যে কার্য্যে তাঁহারা ব্যাপৃত আছেন তাহা অতি মহৎ কার্য্য। সমগ্র জাতির ভবিষ্যৎ তাঁহাদের উপর পরোক্ষভাবে নির্ভর করিতেছে। অর্থের দিক দিয়া সমাজে তাঁহাদের সম্মান কি আসন ঠিক করিলে চলিবে না। যে গুরুভার তাঁহাদের উপর ন্যস্ত সে দিকে আমাদের দৃষ্টি থাকা চাই। আমাদের বুঝিতে হইবে, যে, ইহার ন্যায় মহৎ কার্য্য আর নাই। যাঁহারা এই কার্য্যে মন ঢালিয়া দিয়াছেন, তাঁহারা সকলের পূজ্য ও শ্রদ্ধার পাত্র।
এ সম্পর্কে একটা কথার উল্লেখ করিতে হয়। আমাদের দেশে পূর্ব্বকালে অধ্যাপকবর্গের সমাজে যেরূপ সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল, আজকাল শিক্ষকবর্গের তাহার কিছুই নাই। এইরূপ শিক্ষকের সম্মান হ্রাস হওয়া যে দেশের দুরদৃষ্ট তাহাতে আর কোনও সন্দেহ নাই। আমাদের সদা সর্ব্বদা মনে রাখিতে হইবে যে শিক্ষকের বৃত্তি কখনও বাণিজ্যাদি অন্যান্য বৃত্তির ন্যায় লাভজনক হইতে পারে না। কাজেই যদি আমরা চাই যে বুদ্ধিমান ও চরিত্রবান যুবকগণ অন্যবৃত্তি ত্যাগ করিয়া শিক্ষকবৃত্তি অবলম্বন করিবেন, তাহা হইলে দেখাইতে হইবে, সমাজ শিক্ষকের আর্থিক দৈন্য সম্মানের প্রাচুর্য্য দ্বারা ঢাকিয়া দিতে সম্মত আছে।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, আমাদের স্কুলের দুরবস্থার প্রতি আমাদের গবর্ণমেণ্টের নজর পড়িয়াছে; শিক্ষা বিভাগের উন্নতির জন্য তাঁহারাও মনোনিবেশ করিয়াছেন। তবে আমাদের দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, অনেক সময়ই দেখা যায়, শিক্ষকের মাহিয়ানা কিম্বা সংখ্যা বৃদ্ধি করা অপেক্ষা ইন্সপেক্টরের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যৈন কার্য্যকর বলিয়া গবর্ণমেণ্ট মনে করেন। তাঁহাদের মতে উপযুক্ত তত্ত্বাবধানের অভাবে আমাদের স্কুলগুলিতে আমাদের আশানুরূপ ফল ফলিতেছে না। বৎসরে একদিন কি দুইদিন স্কুলটী পরিদর্শন করিয়া আসিলে কিরূপ তত্ত্বাবধান হয় তাহা আমরা বুঝি না। তাহা ছাড়া ইন্সপেক্টরেরা যে মন্তব্য প্রকাশ করেন তদনুযায়ী কাজ করা, আর বিধবার একাদশী করা দুইই সমান। করিলে লাভ নাই, না করিলে ক্ষতি যথেষ্ট। এইরূপ পরিদর্শনের প্রাচুর্য্যের ফলে হইয়াছে এই, স্কুলের কর্ত্তৃপক্ষের নজর আজকাল কোনক্রমে বাহিরের ঠাট বজায় রাখিবার দিকে। ভিতরে যথার্থ কাজ কিরূপ হইতেছে তৎপ্রতি কেহ একবার চাহিয়াও দেখেন না। তবে, বর্ত্তমান বড় লাট মহোদয় শিক্ষাকল্পে যে ত্রিশ লক্ষ টাকা ব্যয় করিবেন বলিয়াছেন, তাহার ৯ লক্ষ শুধু বাঙ্গালার প্রাথমিক ও উচ্চ ইংরাজী স্কুলের শিক্ষকের অবস্থার উন্নতির জন্য ব্যয়িত হইবে। ইহা আমাদের পক্ষে একটা আশা কথা। আমাদের যথার্থ যাহা প্রয়োজন তাহা বুঝিয়া এই টাকাটা খরচ করিলে বাংলার যথেষ্ট লাভ হইবে।
জনসাধারণের শিক্ষার উন্নতি বিধান জনসাধারণের উপর বেশীর ভাগ নির্ভর করে। আমরা আমাদের জন্য যতটা করিতে পারি, অন্য কেহ কখনও ততদূর করিতে পারে না। আমাদের ধনী ও শিক্ষিত লোকদিগের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আমরা বিবাহ, শ্রাদ্ধ, তীর্থপর্য্যটন ও অন্যান্য কার্য্যে অজস্র অর্থ অকাতরে ব্যয় করি। ধর্ম্মের নামে যে কত টাকা দেবালয়ে ও মঠে উৎসর্গীকৃত রহিয়াছে ও হইতেছে তাহার কে ইয়ত্তা করিবে? অথচ গ্রামের স্কুলের উন্নতির জন্য চেষ্টা করিয়া অর্থ যোগাড় করা অত্যন্ত কঠিন। লোক শিক্ষার সহায়তা যে ধর্ম্মসাধনের একটী প্রধান অঙ্গ, তাহা সমাজের অনেকেই বুঝেন না। আমাদের আর একটা দুর্দ্দশার কারণ এই যে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অধিকাংশই গ্রাম ছাড়া। যে পল্লীগ্রামে তাঁহারা লালিত ও বর্দ্ধিত হইয়াছেন, যাহার নিকট তাঁহারা ঋণী, এখন ম্যালেরিয়ার প্রকোপে ও অর্থান্বেষণের বাতিকে, তাঁহারা কদাচিৎ সেই পল্লীগ্রামে পদার্পণ করেন। তাঁহারা মায়া কাটাইয়াছেন বলিলেই চলে। ফলে যাঁহারা সচরাচর পল্লীগ্রামে থাকেন তাঁহাদের মধ্যে শিক্ষার প্রভাব সম্যক্রূপে হৃদয়ঙ্গম করেন, এরূপ লোক খুব অল্প। তাঁহাদের জীবনের সমস্ত উদ্যম স্কুল প্রভৃতি ভাল বিষয়ের দিকে ব্যয়িত না হইয়া, দলাদলি ও নিরর্থক আমোদ প্রমোদেই ব্যয়িত হয়। স্কুলের প্রতি কাহারও যথেষ্ট সহানুভূতি নাই। ইহাও স্কুলের দুর্দ্দশার একটী অন্যতম কারণ। যে সকল কৃতী সন্তান, পল্লীগ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়া শিক্ষালাভ করিয়া উত্তরকালে যশস্বী ও ধনী হইয়াছেন তাঁহাদের ছোট গ্রামের কথা ভুলিয়া গেলে চলিবে না। এ বিষয়ে তাঁহাদের সময় ও মনের উপর গ্রামের স্কুলের যথেষ্ট দাবী আছে। নিজ নিজ গ্রামের স্কুলের উন্নতির জন্য যদি তাঁহারা ভাবেন, তাহা হইলে সত্য সত্যই আমাদের কাজ যথেষ্ট সহজসাধ্য হইয়া উঠিবে।
সুখের কথা এই যে, মনে হয়, যেন আজকাল একটু হাওয়া বদলাইয়াছে। শিক্ষিত সম্প্রদায় জনসাধারণের যথার্থ হিতসাধনের জন্য ভাবিতে আরম্ভ করিয়াছেন। দানবীর “পালিত” ও মনস্বী “ঘোষের” কথা আজকাল কে না জানে? তাঁহাদের দৃষ্টান্ত আমাদের জ্বলন্ত আদর্শ স্বরূপ হওয়া উচিত।
পূর্ব্বে আমাদের দেশের ছেলেদের প্রথমে পাঠশালে পাঠান হইত, উদ্দেশ্য এই যে তাহারা পড়িতে লিখিতে এবং অঙ্ক কষিতে (ইংরাজীতে যাহাকে the three R’s বলে, অর্থাৎ reading, writing and arithmetic) শিখুক। অনেকে তখন পাঠশালের পড়া শেষ করিয়া পৈতৃক পেশা আরম্ভ করিত। এখন জনসাধারণের মতে কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তন লক্ষিত হইতেছে। এখন পিতামাতা ইচ্ছা করেন যে তাহার ছেলে বেশী লেখাপড়া শিখুক। কারণ বেশী লেখাপড়া শিখিলে বেশী অর্থোপার্জ্জন করিতে সমর্থ হইবে এবং সুখে স্বচ্ছন্দে জীবিকা নির্ব্বাহ করিতে পারিবে। এই জন্যই প্রবাদ আছে, যে, “লেখাপড়া করে যে, গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে;” এই অর্থকরী বিদ্যার মোহিনী মায়ায় আবদ্ধ হইয়া অনেকে পুত্ত্রদিগকে উচ্চশিক্ষা দিতে লালায়িত হন। সুতরাং উচ্চশিক্ষার যে যে অংশটুকু অর্থ উপার্জ্জনের সহায়তা করে কেবলমাত্র সেইটীর উপরেই লোকের দৃষ্টি থাকে। রাজকীয় উচ্চপদই বল, আর ডাক্তারী ওকালতিই বল, অর্থোপার্জ্জনের প্রচলিত পথে চলিতে হইলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপযুক্ত ডিগ্রীরূপ টিকিট চাই। যাঁহার গাত্রে ঐ নির্দ্দিষ্ট ছাপ আছে তিনি অনায়াসে ঐ পথে অগ্রসর হইতে পারেন। যাঁহার নাই তিনি বিতাড়িত হইবেন। এই জন্যই ডিগ্রীর এত আদর। এই ডিগ্রীর প্রতি অত্যধিক আসক্তিই আজকাল যত অনর্থের মূল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এইজন্য পাঠ্যপুস্তকের স্থলে নোটবুক বা অর্থ পুস্তকের এত আদর। শিক্ষকের নিকট Notes বা টীকা আদায় করিবার জন্য যত তাগাদা, আর পাঠ্যপুস্তক ছাড়িয়া দিয়া পুরাতন বৎসরের প্রশ্নপত্রের যথাযথ উত্তর মুখস্থ করিতে তত ব্যস্ততা দেখা যায়। প্রশ্নপত্র চুরিও এই অত্যধিক ডিগ্রীব্যাধির কুফল। এই শিক্ষার ফলে লোকে সর্ব্বশাস্ত্র পাঠ করিয়াও মূর্খ হইয়া থাকে। যতদিন অর্থের উদ্দেশ্য বিদ্যাশিক্ষা এই ভুল ধারণা আমাদের মন হইতে সম্যক্রূপে অপসারিত না হইবে, ততদিন প্রকৃত শিক্ষা জনসাধারণের নিকট পৌঁছিবে না। নৈতিক ও মানসিক উন্নতি সাধনই যে শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য একথা ভুলিলে চলিবে না। অর্থ উপার্জ্জনের ত বিবিধ পন্থা আছেই এবং উচ্চশিক্ষা লাভ করিলে যে অর্থ উপার্জ্জনের সহায়তা হয় সে বিষয়ে সন্দেহ নাই, কিন্তু তাই বলিয়া উচ্চ শিক্ষাকেই অর্থোপার্জ্জনের একমাত্র উপায় স্থির করিলে চলিবে না। এ ভ্রম দূর করিতে হইবেই। না করিলে নিস্তার নাই। শত শত বালক পরীক্ষায় অকৃতকার্য্য হইলে বলে—“My career is ruined” আমার জীবনের গতি রুদ্ধ হইয়া গেল, যেন পাশ হইলে তাহারা স্বর্গের চাঁদ হাতে পায়। এখানে Career অর্থে অর্থ উপার্জ্জনের সহজ উপায় বুঝাইতেছে। যদি অর্থ উপার্জ্জনই লক্ষ্য হয় তাহা হইলে এত অর্থ ব্যয় করিয়া অনর্থক শরীর পাত করিবার কি আবশ্যক? কই স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, জে সি ব্যানার্জ্জি এবং হাজার হাজার মাড়োয়ারী তাঁরা ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ পান নাই।
বাস্তবিক কথা বলিতে কি, আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আর তেমন অর্থকরী নহে। অর্থোপার্জ্জনের জন্য শিক্ষিত বাঙ্গালী যুবকের পক্ষে ব্যবসা বাণিজ্য অবলম্বন ভিন্ন গত্যন্তর নাই। দূরদেশ হইতে মূর্খ মাড়োয়ারী ও গুজরাটীগণ আসিয়া আমাদের টাকা লুটিয়া লইয়া যাইতেছে, আর আমরা দেখিয়াও দেখিতেছি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি শিক্ষিত বাঙ্গালী ব্যবসায়ে মন দেন তাহা হইলে এই টাকাটা ভদ্র লোকগণের বর্ত্তমান ভীষণ অন্নকষ্ট কিয়ৎ পরিমাণে দূর করিতে পারে।
অর্থের কথা ছাড়িয়া দিয়া যদি প্রকৃত শিক্ষার জন্যই বিদ্যালয়ে বালকদিগকে প্রেরণ করা হয় তাহা হইলেও আর এক বিপদ উপস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুসারে সকল বালককেই স্ব স্ব স্বাতন্ত্র্য ভুলিয়া একই পথে চলিতে হইবে এবং একই পথ দিয়া বাহির হইতে হইবে। নির্দ্দিষ্ট পথের একটু এদিক ওদিক্ হইলেই হয় শিক্ষকের তাড়না, না হয় পরীক্ষায় অকৃতকার্য্যতা সতর্ক করিয়া দিবে। এই প্রণালীতে শিক্ষা দিলে বালকের প্রতিভা স্ফুরিত হইবার অবকাশ পায় না। যাহার মনের গতি যে দিকে, যদি বলপূর্ব্বক সেই গতি রোধ করিয়া তাহাকে অন্যদিকে চালিত করিবার চেষ্টা করা যায় তাহা হইলে সে গতি যে দুর্গতি হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। অবশ্য অসৎ পথে প্রধাবিত হইলে যে তাহাকে বাধা দেওয়া উচিত নয় একথা আমি বলি না। তবে সকলেরই যে একই বিষয় ও একই কথা তোতাপাখীর মত কণ্ঠস্থ রাখিতে হইবে এ কথা আমি বলি না এবং সময় উপস্থিত হইলে তাহা আবৃত্তি করিয়া প্রশংসা পাইবে, এমন ব্যবস্থার দ্বারা কি উপকার সাধিত হয় তাহা আমার বোধগম্য নহে।
যে সকল বিষয়ে কিছু কিছু জ্ঞান থাকা আবশ্যক, সেই সকল বিষয় সকল বালকই কিছু কিছু শিখুক। কিন্তু তাই বলিয়া যে বালকের অঙ্কশাস্ত্র আদৌ ভাল লাগে না তাহাকে যে বাধ্য হইয়া নীরস জ্যামিতিক টীকা টিপ্পনীর অনুপানের সহিত মিলাইয়া সরস করিয়া শিক্ষকের তাড়নায় ও পরীক্ষায় অকৃতকার্য্য হওয়ার ভয়ে গলাধঃকরণ করিতে হইবে এমন কি কথা আছে? হয়তঃ তাহার ইতিহাস পাঠে অধিক ইচ্ছা; কিন্তু গণিত শিক্ষক যদি দেখেন যে সে বালক তাহার দুর্ব্বোধ্য জ্যামিতি পুস্তক ফেলিয়া ইতিহাস পাঠ করেন, তাহা হইলে তাহার হাতে ইতিহাস পরিহাসের বিষয় হইয়া উঠে। এইরূপে বাধাপ্রাপ্ত তাহার প্রতিভা স্বতঃ-প্রণোদিত পথে প্রধাবিত হইতে পারে না। ফলে তাহাকে অনেক বিষয় তিক্ত ঔষধের ন্যায় হজম করিতে হয়, এবং হয়তঃ দুর্ভাগ্যবশতঃ যে বিষয়ে তাহার আদৌ প্রবৃত্তি নাই সে বিষয়ের পরীক্ষায় অকৃতকার্য্য হইয়া উচ্চতর শিক্ষার মন্দিরে প্রবেশ করিবার অনুমতি পত্র পাওয়ায় বঞ্চিত হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সুরকীর কলের মত আমা, ঝামা, হাজা, শুকা সর্ব্ব প্রকার ইট পরীক্ষা যন্ত্রে পেষণ করিয়া ১নং, ২নং ৩নং সুরকী করিয়া ছাপ দিয়া দেয়।
এক একটা শ্রেণীতে অনেক রকমের ছেলে লইয়া শিক্ষকগণের কারবার করিতে হয়। কেহ বা অসাধারণ প্রতিভাশালী, কেহ বা মধ্যম কল্পের, কেহ বা হীনবুদ্ধি (dull)। শিক্ষক ক্লাশে এক ঘণ্টায় (official তিন কোয়ার্টার) এই সমস্ত ছাত্র লইয়া মাত্র একটি প্রশ্নের সমাধান, কি একটি প্যারার ব্যাখ্যা করিতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত প্রতিভাশালী ছাত্র সেই সময়ের মধ্যে তাহার দশগুণ পাঠ আয়ত্ত করিতে পারে।
এইজন্য অনেক সময় দেখা যায় পাঠ্য পুস্তকে নির্দ্ধারিত বিদ্যাশিক্ষা অনেকের পক্ষে প্রকৃত জ্ঞান লাভের অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায়। তা ছাড়া আজকাল ভূগোল কি ইতিহাস একেবারে বাদ দিলেও পরীক্ষা পাশের কোন ব্যাঘাত ঘটে না। আমি দুই বৎসর হইল “দেশে” গিয়া আমার বসিবার ঘরে ইউরোপের একখানি মানচিত্র টাঙ্গাইয়া রাখিয়াছিলাম এবং কয়েক জন আই, এ, বি, এ, পরীক্ষার্থী ছেলেদের যুদ্ধক্ষেত্রের স্থান নির্দ্দেশ করিতে বলিলাম; তাহারা অন্ধের ন্যায় হাতড়াইতে লাগিল। এক এক জন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী এই সকল বিষয়ে এত অজ্ঞ যে দেখিলে দুঃখ হয়। যাঁহারা ভাল ভাল ইংরেজী সংবাদপত্র পাঠ করেন তাঁহারা নানা বিষয়ে এত জ্ঞান অর্জ্জন করিতে পারেন যে নির্দ্ধারিত পাঠ্য পুস্তক পাঠ করিয়া তাহা অসম্ভব। এই জন্য মহানুভব কব্ডেন একবার পার্লামেণ্টে বলিয়াছিলেন যে এক কপি টাইম্স্ পড়িলে এত বিষয় জানা যায় যে সমগ্র গ্রীক ইতিহাস পড়িলেও তাহা কোন কালেই হয় না। যদি কোন শিক্ষিত লোককে আমি জিজ্ঞাসা করি যে আজকাল যুদ্ধের অবস্থা কিরূপ, আর তিনি যদি তাহা আমাকে বুঝাইতে অক্ষম হন, আমি বলিব, তাহার বিদ্যাশিক্ষা পণ্ড হইয়াছে।
সেইরূপ প্রত্যেকেরই স্বাস্থ্যরক্ষা ও নিজের দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু কিছু জ্ঞান থাকা আবশ্যক। ইতিহাস অর্থে কেবল কতকগুলি রাজার নাম ও তারিখ নহে—দেশের সভ্যতা ও সামাজিক অবস্থার ধারারাহিক বিবরণই প্রকৃত ইতিহাস নামের যোগ্য। এইরূপ ইতিহাস পাঠে সুকুমারমতি বালক বালিকাগণের মনে স্বদেশ প্রেমের বীজ বপন হয়। তাহারা জানিতে পারে কত বড় উচ্চ অঙ্গের আর্য্য সভ্যতার তাহারা উত্তরাধিকারী। আর আমাদের মত ম্যালেরিয়া পীড়িত দেশের পক্ষে স্বাস্থ্যরক্ষা সম্বন্ধীয় জ্ঞান যে কত প্রয়োজনীয় তাহা কি আর বুঝাইতে হইবে? যদি আমাদের দেশের লোক ম্যালেরিয়ার কারণ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে তাহা হইলে হয়তঃ তাহারা কোমর বাঁধিয়া ডোবা ও জঙ্গল পরিষ্কার করিয়া গ্রামগুলিকে ম্যালেরিয়া রাক্ষসীর করাল কবল হইতে মুক্ত করিতে পারে। আমি জানি পল্লীগ্রামের অনেক লোকের যথেষ্ট অবকাশ আছে। যদি তাহারা অজ্ঞানান্ধকারে নিমজ্জিত না থাকিত তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাহারা নিজের হাতে কুড়াল ধরিয়া বাড়ীর চারি পাশের জঙ্গল সাফ করিয়া ফেলিত, নিজের হাতে কোদাল ধরিয়া ডোবার পঙ্কোদ্ধার করিত।
অনেক সময় দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির ছাপ অজ্ঞতা ঢাকিবার আবরণ মাত্র। ফলতঃ নিজের চেষ্টায় যেটুকু শেখা যায় সেইটুকুই আমাদের কাজে আসে। পাঠ্য পুস্তক কণ্ঠস্থ করিয়া “কেতাবী” হওয়া যায় বটে কিন্তু প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। আমাদের কেশবচন্দ্র সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধার বড় একটা ধারেন নাই। কিন্তু তাই বলিয়া কি তাঁহাদিগকে আমরা শিক্ষিত সম্প্রদায় হইতে বাদ দিব? আল্ফিরি জ্যামিতির প্রথম ভাগের ৫ম প্রতিজ্ঞা অনেক চেষ্টা করিয়াও বুঝিতে পারেন নাই, লর্ড বাইরনেরও জ্যামিতি দেখিলে আতঙ্ক উপস্থিত হইত। স্যর ওয়াল্টার স্কট সম্বন্ধে তাঁর এক শিক্ষক বলিয়াছিলেন—“Dunce he is, and dunce he will remain”, ওটা নিরেট বোকা, নিরেট বোকাই চিরদিন থাকিবে।
তাই আমি শিক্ষকমণ্ডলীকে নিবেদন করি, তাঁহারা যেন কোন ছাত্রকে নির্দ্ধারিত কোন বিষয়ে পারদর্শিতা দেখাইতে না পারিলে, তাহাকে গাধা ও অকর্ম্মা বলিয়া নিরুৎসাহ না করেন। হয়ত তাহারা অন্য বিষয়ে প্রতিভার পরিচয় দিতে পারিবে।
তাই বলিতেছি যে, নির্দ্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তকের সহিত অন্যান্য বিবিধ বিষয়ক পুস্তকও বালকদিগের হস্তে দেওয়া উচিত। যাহার যেরূপ রুচি সে সেইরূপ পুস্তক বাছিয়া লইবে। ইহাতে তাহার প্রতিভা বিকাশের সহায়তা করিবে। এ বিষয়ে মার্কিন দেশীয় বিখ্যাত দার্শনিক এমার্সন যাহা বলিতেছেন তাহা প্রণিধানযোগ্য:—
“I advise teachers to cherish mother art. I assume that you will keep the grammar, reading, writing and arithmetic in order; it is easy and of course you will. But smuggle in a little contraband wit, fancy, imagination, thoughts. * * * They shall have no books but school books in the room; but if one has brought in a Plutarch or Shakespeare or Don Quixote or Goldsmith or any other good book, and understands what he reads, put him at once at the head of the class * * *. If a child happens to show that he knows any fact about astronomy or plants or rocks or history that interests him and you hush all the classes and encourage him to tell it that all may hear, then you have made your school room like the world.”
মোট কথা এই, যে ছেলে পাঠ্যতালিকাভুক্ত পুস্তকের বাহিরে যত খবর রাখিবে আমি সেই ছেলেকে তত বাহবা দিব। অর্থাৎ যে শিক্ষার দ্বারা স্বাভাবিক প্রতিভার স্ফুরণ হয় ও ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে, ও মৌলিকতা ও উদ্ভাবনী শক্তির উন্মেষ হয় তাহাই প্রকৃত শিক্ষা। আমার নিজের জীবনস্মৃতির কথা বলিতে আমি বড়ই সঙ্কুচিত হই, কিন্তু একটা কথা প্রসঙ্গক্রমে বলিতে হইতেছে। আমি যখন হেয়ার স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে পড়িতাম তখন একবার দুরন্ত আমাশয় রোগে আক্রান্ত হইয়া এক বৎসর ভুগি। সম্পূর্ণ সুস্থ হইতে প্রায় দুই বৎসর লাগিয়াছিল। এই দুই বৎসর বাধ্য হইয়া আমাকে বাড়ীতে আবদ্ধ থাকিতে হয়। ঐ সময়ে লাটিন, ফরাসী ইত্যাদি ভাষা আয়ত্ত করি। বঙ্গদর্শনে রামদাস সেন প্রমুখ ব্যক্তিগণ যে প্রত্নতত্ত্বঘটিত প্রবন্ধ লিখিতেন আমি তাহা আগ্রহের সহিত পাঠ করিতাম। সেই অল্প বয়সে আমার মনে ঐ যে ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসার প্রতি আগ্রহ হইয়াছিল তাহা বহুকাল ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় গুপ্ত থাকিয়া হিন্দুরসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস লিখিবার সময় পুনর্ব্বার প্রকাশিত হয়। বাল্যের সেই যে প্রবৃত্তি বদ্ধমূল হইয়াছিল তাহাই উত্তরকালে কিয়ৎ পরিমাণে কার্য্যকরী হইয়াছে।
প্রকৃত শিক্ষা কিরূপ সে সম্বন্ধে আলোচনা করিতে গিয়া আমার এত কথা মনে আসিতেছে যে দুই এক কথার মধ্যে তাহা শেষ করা অসম্ভব। শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষ তৈয়ারি করা অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বৃত্তিগুলি যথোচিতরূপে পরিস্ফুট করিয়া তোলা। কি উপায়ে তাহা নিষ্পন্ন হইতে পারে তদ্বিষয়ে প্রাচীনকাল হইতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মনীষীগণ মাথা ঘামাইয়া আসিতেছেন। তাঁহাদের চিন্তাপ্রসূত যে সকল অমূল্য গ্রন্থরাজি রহিয়াছে প্রত্যেকের কর্ত্তব্য তাহা পাঠ করা। শিক্ষকতা কার্য্য অত্যন্ত কঠিন ও অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ, এই কার্য্যের জন্য বিশেষভাবে পাঠ ও চিন্তা না করিলে কেহ প্রকৃত শিক্ষকপদবাচ্য হইতে পারেন না।
প্রসঙ্গক্রমে এক্ষণে আমি শিক্ষাসংক্রান্ত দু-একটা কথার উল্লেখ মাত্র করিতে চাই। আমাদের স্কুলে বালকগণের শারীরিক বৃত্তিগুলির অনুশীলনের কোনও ব্যবস্থা নাই বলিলেই হয়। যাহাতে ছেলেরা মাঝে মাঝে দশবিশ মাইল হাঁটিতে পারে, দু—চার মাইল দৌড়িতে পারে, দু—এক মাইল সাঁতার কাটিতে পারে, বা দশ পনেৱ মাইল দাঁড় বাহিতে পারে, তাহার বন্দোবস্ত থাক। উচিত। শরীরকে সবল ও কষ্টসহকরা যে কত প্রয়োজনীয়, বর্ত্তমান ইউরোপীয় মহাযুদ্ধে তাহা প্রমাণ হইতেছে।
এক্ষণে সভ্যজাতিগণের সকল সুস্থ যুবককেই সৈন্যশ্রেণীভুক্ত হইয়া দেশের সম্মান রক্ষা করিতে হইতেছে। আমাদের গভর্ণমেণ্ট বাঙ্গালীকেও সৈনিক হইবার সুযোগ প্রদান করিয়াছেন। সুতরাং আজকালকার দিনে সৈনিকোচিত সুপটু দেহ নির্ম্মাণ করা যে সকল যুবকেরই অবশ্য কর্ত্তব্য তাহা কি আর বলিয়া দিতে হইবে?
মানসিক শিক্ষা সম্বন্ধে কয়েকটী কথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। নৈতিক শিক্ষা সম্বন্ধে সর্ব্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় কথা হইতেছে চরিত্র গঠন। উহা কয়েকখানি নীতিপুস্তক পাঠ বা কিছু উপদেশ প্রদান দ্বারা সম্পন্ন হইবার নহে। দিনের পর দিন পরোপকার, চিত্তের পবিত্রতা রক্ষা ও ভগবচ্চিন্তা প্রভৃতি কয়েকটা সৎ অভ্যাস পালন করা হইলে কালক্রমে আদর্শ চরিত্র গঠিত হইয়া থাকে। প্রত্যেক ছাত্রের উচিত প্রতিদিন কিছু না কিছু ভাল কাজ করা, যেমন কোনও স্বার্থত্যাগ করা বা ক্রোধাদি কোন রিপুর দমন করা, আর্ত্তত্রাণ হেতু বীর্য্য প্রদর্শন করা, ধর্ম্মপুস্তক পাঠ করা ইত্যাদি। শিক্ষক উপদেশ দ্বারা, বিশেষতঃ নিজের দৃষ্টান্ত দ্বারা, ছাত্রকে ধর্ম্মপথে চলিতে উৎসাহিত করিবেন। প্রসঙ্গক্রমে বলিতে চাই, নৈতিক শিক্ষাসম্বন্ধে আমাদের ব্রহ্মচর্য্য নামক প্রাচীন শিক্ষা প্রণালী হইতে এখনও অনেক শিখিবার আছে।
উপসংহারে আমার বক্তব্য এই, যাঁহারা এই মহান্ কার্য্যে ব্রতী হইয়া জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, তাঁহারা যেন সর্ব্বদাই মনে রাখেন, যে দেশের মঙ্গলের জন্য ঈশ্বরের প্রেরণায় কার্য্য করিতেছেন। পল্লীগ্রামের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, দলাদলির মধ্যে তাঁহাদের জীবনের উচ্চ আদর্শ, ছাত্রদিগকে যেন সতত মঙ্গলের দিকে চালিত করে। আমার বিশ্বাস যে, আমাদের দেশ এখনও এত অধঃপতিত হয় নাই, যে দেশের লোকে বিদ্যা ও বিদ্বানের আদর করিবে না।
“স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে” প্রাচীন নীতিবিশারদের এই উক্তি, পূণ্যভূমি ভারতবর্ষের উপর এক সময় প্রযুজ্য ছিল। বর্ত্তমান সময়ের শিক্ষকেরা সাধারণের দৃষ্টির অগোচরে ও অন্তরালে, নীরবে যে কাজ করিতেছেন, তাহার গুরুত্ব ও মহত্ত্ব প্রত্যেক সহৃদয় ব্যক্তিই হৃদয়ঙ্গম করিবেন। এই কার্য্যে তাঁহাদের যথেষ্ট যশ কিংবা খ্যাতি হইতেছে না বলিয়া যেন তাঁহারা অবসাদ সাগরে নিমজ্জিত না হন।
এই সময় আমার কর্ম্মবন্ধু পরলোকগত মহাত্মা গোখলের কথা মনে হইতেছে। তিনি বিশ বৎসর ধরিয়া মাত্র ৭৫৲ টাকা বেতনভুক্ শিক্ষক থাকিয়াও স্বদেশ প্রেমিক ও রাজনীতিজ্ঞদের মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিলেন। প্রতিভাশালী শিক্ষকদের মধ্যে যে কেহ ইচ্ছা করিলে গোখলের মত উচ্চস্থান অধিকার করিতে পারেন। যুক্তরাজ্যের বর্ত্তমান প্রেসিডেণ্ট উড্রো উইলসনও একজন শিক্ষক। এইরূপ আরও অনেক দৃষ্টান্ত হইতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে প্রতিভাশালী ব্যক্তি শিক্ষকবৃত্তি অবলম্বন করিয়াও দেশপ্রসিদ্ধ হইতে পারেন, যদি তিনি নিজের প্রতিভার উপযুক্ত কার্য্যে আপনার সমস্ত শক্তি অক্লান্তভাবে নিয়োগ করিতে পারেন।
উপসংহারে আমার বলিবার কথা এই যে, প্রত্যেক জেলাতেই উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় বালকদিগের শিক্ষাকার্য্যে সহায়তা করিতেছে। প্রত্যেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে আপন আপন কার্য্য করিতেছেন। বৎসরান্তে একবার তাঁহারা একস্থানে মিলিত হইয়া পরস্পর আপন আপন অভিজ্ঞতার বিষয় আলোচনা কিম্বা শিক্ষাসংক্রান্ত কোন জটিল প্রশ্নের মীমাংসা করিবার চেষ্টা অথবা স্ব স্ব স্বাধীন চিন্তার আদান প্রদান করিয়া উৎসাহিত হউন। পরিশেষে, আমার দেশবাসী যে যেথায় আছেন, আজ আমি সকলের নিকট যুক্তকরে প্রার্থনা করিতেছি, আমাদের মাতৃভূমির অজ্ঞানান্ধকার দূর করিয়া পুনরায় তাঁহাকে প্রাচীন কালের মত জগদ্বরেণ্যা করিবার জন্য প্রত্যেকে অকাতরে নিজ নিজ শক্তি প্রয়োগ করুন। ধনবান, আপনি ধনের কোষ উন্মুক্ত করুন; বিদ্বান, আপনি অর্থলোভ ত্যাগ করিয়া শিক্ষকতা বৃত্তি অবলম্বন করুন। আর আমার যে সকল দেশভ্রাতা ধনসম্পদ বা বিদ্যাসম্পদ লাভে সৌভাগ্যবান্ হন নাই, তাঁহারা প্রত্যক্ষভাবে না পারেন, পরোক্ষ ভাবে এই মহৎ কার্য্যের সহায়তা করুন— সকলে মিলিয়া শিক্ষককে তাঁহার পদোচিত মর্য্যাদা দান করিতে থাকুন। তাহা হইলেই যোগ্য শিক্ষকের হাতে আমাদের ছেলেরা মানুষ হইয়া উঠিবে—আমাদের সকল দুঃখ দূর হইবে।
- ↑ বাগেরহাট শিক্ষক সম্মিলনের সভাপতির অভিভাষণ।