আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী
আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের
প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী
চক্রবর্ত্তী, চাটার্জ্জি এণ্ড কোং লিঃ
১৫নং কলেজ স্কোয়ার
কলিকাতা
১৯২৭
১৫ নং কলেজ স্কোয়ার, কলিকাতা হইতে
শ্রীরমেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী এম্, এস্-সি
কর্তৃক প্রকাশিত।
প্রিণ্টার—শ্রীচন্দ্রমাধব বিশ্বাস
কুন্তলীন প্রেস
৬১ বহুবাজার ষ্ট্রীট, কলিকাতা।
আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের নাম বাংলা দেশের সর্ব্বত্র সুপরিচিত। বাংলাদেশের ছাত্রবৃন্দ তাঁহাকে দেবতাজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিয়া থাকে। তাঁহার জ্ঞানগরিমা, অসাধারণ বিজ্ঞান-চর্চ্চা, দেশ হিতৈষণা, সর্ব্বোপরি তাঁহার ঋষিকল্প চরিত্র, কোমল এবং প্রেমিক হৃদয় দেশবাসীকে গুণমুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। তিনি ছাত্র সমাজের একাধারে গুরু, বন্ধু ও সহায়। জাতীয় শিল্পের উন্নতির জন্য তাঁহার অসীম উদ্যম, দেশহিত-ব্রতে তাঁহার অনাড়ম্বর ও কঠোর স্বার্থত্যাগ, সমাজের কল্যাণে তাঁহার আজীবন চেষ্টা, বিজ্ঞান-চৰ্চ্চার প্রতিষ্ঠাকল্পে তাঁহার অসাধারণ উদ্যম ও উৎসাহ—ইহা কিছু নূতন করিয়া আজ আর বলিবার আবশ্যক আছে মনে করিনা। যাহাতে তাঁহার জীবনের আদর্শ ও উপদেশাবলী দেশের ভবিষ্যৎ যুবকসম্প্রদায়ের পক্ষে পথ-প্রদর্শক হইতে পারে, তাহাদিগকে দেশমাতৃকার সেবা ও মঙ্গলব্রতে অনুপ্রাণিত করিতে পারে, সমাজের কলঙ্ক অপনোদন পূর্ব্বক সমাজকে স্থিতিশীল ও প্রতিষ্ঠাবান করিবার উপায় নির্দেশ করিতে পারে—এই মহৎ উদ্দেশ্যেই আমরা আচার্য্যদেবের বহুবিধ সারগর্ভ প্রবন্ধ ও বক্তৃতারাজির একত্র সমাবেশ করিয়া সাধারণে প্রকাশ করিবার জন্য সচেষ্ট হইয়াছি। দুই চারিটি ভিন্ন অধিকাংশ প্রবন্ধই আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের বক্তৃতার সারাংশ এবং বিভিন্ন বক্তৃতা-লেখক (Reporter) কর্ত্তৃক সংগৃহীত। অতএব প্রবন্ধগুলিতে কিছু কিছু পুনরুক্তি দোষ ঘটা স্বাভাবিক। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁহার বহুমুখী প্রতিভাবলে সমাজ, শিল্প, জাতীয় উন্নতি, জাতিগঠন ইত্যাদি সম্বন্ধে যে সমস্ত ভাবধারার সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় প্রকাশিত ছিল। যে উদ্দেশ্যে এই সমস্ত মূল্যবান প্রবন্ধ সংগ্রহ করিয়া একত্র প্রকাশ করিতে প্রস্তুত হইয়াছি, আমাদের সেই উদ্দেশ্য কথঞ্চিং ফলবান হইলেও আমরা আমাদের পরিশ্রম সার্থক মনে করিব। এই সঙ্গে শ্রীপ্রসন্নকুমার রায় লিখিত ও “প্রকৃতি"তে প্রকাশিত “আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র” নামক প্রবন্ধ অবলম্বনে সঙ্কলিত আচার্য্যদেবের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনীও সংযোজিত হইল।
আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র
জন্ম ও বংশকথা
বর্ত্তমান খুলনা সহরের সাতচল্লিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে সুপ্রসিদ্ধ কপোতাক্ষতীরে রাড়ুলি গ্রাম প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মস্থান। প্রফুল্লচন্দ্র যে বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, উহা পাঠান রাজত্বের ধ্বংসের সমকালে, বা কিঞ্চিং পরে হুগলী জেলার সপ্তগ্রাম হইতে আসিয়া যশোহর ঝিকরগাছার নিকটবর্ত্তী বোধখানায় বসতি স্থাপন করেন। এই বংশের অনেকে বাদশাহ বা বাঙ্গালার নবাবগণের অধীনে নানা সম্মানজনক কার্য্যে নিয়োজিত ছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র হইতে উৰ্দ্ধতন ষষ্ঠ পুরুষে রামপ্রসাদ রায়; ইনি মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজউদৌলার সরকারে কর্ম্ম করিতেন। সিরাজের পরাভবের পর ইনি মুর্শিদাবাদ পরিত্যাগ করিয়া রাড়ুলি গ্রামে বসতি স্থাপন করেন বলিয়া বোধ হয়।
প্রফুল্লচন্দ্রের পিতা হরিশ্চন্দ্র রায় চৌধুরী যে সময়ে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন তাহাকে বাঙ্গালা দেশের তামস যুগ, ‘Dark Age’ বলা যাইতে পারে। তিনি পারস্য ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। উচ্চ ইংরাজী জ্ঞান লাভ করিবার জন্য তিনি কৃষ্ণনগর কলেজে জুনিয়ার স্কলারসিপ বিভাগে ভর্তি হইয়া সুবিখ্যাত অধ্যাপক রিচার্ডসন সাহেবের নিকট বহুদিন অধ্যয়ন করেন। খুলনায় ইংরাজী শিক্ষার প্রচারে হরিশ্চন্দ্র একজন অগ্রদূত ছিলেন। দেশমধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান প্রচার করিবার জন্য তিনি সর্ব্বপ্রথম স্বীয় বাসভবনে একটা আদর্শ মধ্য ইংরাজী বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি স্বীয় বাসভবনে এক বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, এবং সকলকে উৎসাহিত করিবার জন্য সর্বপ্রথমে স্বীয় পত্নী ও ভগিনীকে উক্ত বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করিয়া দিয়াছিলেন।
হরিশ্চন্দ্র তাঁহার প্রজাগণকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন। প্রজারা আসিয়া তাঁহার নিকট নিজ নিজ দৈন্য জানাইলেই তিনি তাহাদিগের খাজনা মাপ করিতেন; অথচ গভর্ণমেণ্টের রাজস্ব তাঁহাকে ধার করিয়া চালাইতে হইত। এই কারণে ক্রমে অনেক সম্পত্তি তাঁহার হস্তচ্যুত হইয়া যায়। হরিশ্চন্দ্রের সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা সম্বন্ধে বহু ঘটনা অনেকের বিদিত আছে।
কলিকাতার আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটের-জমিদার বাবু অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের পিতা রামতারণ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় হরিশ্চন্দ্রের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। “হরিশ্চন্দ্রের বন্ধুত্বের প্রতি রামতারণের এত বিশ্বাস ছিল যে, তিনি কেবল মুখের কথায় বিনা দলিলে তাহাকে অনেকগুলি টাকা কৰ্জ দিয়াছিলেন। হরিশ্চন্দ্র যখন রামতারণের দেনা পরিশোধ করিতে অসমর্থ বিবেচনা করিলেন, তখন কাহাকেও কিছু না বলিয়া তাহার বাটীর সন্নিকটস্থ একখানি উৎকৃষ্ট জমিদারি রামতারণের বরাবর একখণ্ড বিক্রয় কোবালা লিখিয়া রেজেষ্টারী করিয়া রাখিয়াছিলেন। রামতারণ ইহার বিন্দু বিসর্গও জানিতেন না; পরে যখন হরিশ্চন্দ্রের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়, হরিশ্চন্দ্র ঐ কোবালাখানি রামতারণের হস্তে প্রদান করিয়া দেনা হইতে অব্যাহতি প্রার্থনা করেন।”
কলিকাতা সমাজেও হরিশ্চন্দ্রের বেশ প্রতিপত্তি ছিল। তিনি British Indian Association নামক জমিদার সভার সভ্য ছিলেন এবং অনেক প্রধান প্রধান ব্যক্তির সহিত তাঁহার বন্ধুত্ব ছিল। তাঁহার বন্ধুগণের মধ্যে কৃষ্ণদাস পাল, শিশির কুমার ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দিগম্বর মিত্র প্রভৃতি অনেক প্রধান ব্যক্তির নাম করা যায়।
১৩০২ সালের (ইং ১৮৯৫) ২৭শে বৈশাখ তারিখে প্রায় সত্তর বৎসর বয়সে হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ পুত্ত্র ও এক কন্যা রাখিয়া গিয়াছিলেন।
হরিশ্চন্দ্র ভাড়াশিমলা গ্রামে নবকৃষ্ণ বসু মহাশয়ের কন্যা ভুবনমোহিনীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। ভুবনমোহিনী যেরূপ অসামান্য রূপবতী সেইরূপ অসামান্য গুণবতীও ছিলেন। তাঁহার মধুর প্রকৃতি ও কোমল হৃদয় নিতান্ত পরকেও আপন করিয়া লইত। প্রফুল্লচন্দ্র আজ যে পরোপকার ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন, তাহার দীক্ষা তাঁহার পিতামাতার নিকটেই হইয়াছিল। ১৩১১ সালে ভুবনমোহিনীর মৃত্যু হয়।
হরিশ্চন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্ত্র জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ১২৬৩ সালের ১৭ই বৈশাখ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। ওকালতি পরীক্ষা পাশ করিয়া তিনি ডায়মণ্ডহারবারে ওকালতি করেন। বর্ত্তমানে বার্দ্ধক্যবশতঃ অবসর গ্রহণ করিয়াছেন।
নলিনীকান্ত হরিশ্চন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্ত্র; ১২৬৫ সালে ইঁহার জন্ম হয়। ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুলে প্রবেশ করিয়া তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং তথায় শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া বাটীতে গিয়া চিকিৎসা ব্যবসায় আরম্ভ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই সুচিকিৎসক বলিয়া ইঁহার খ্যাতি প্রচারিত হইয়া পড়ে। কিন্তু ক্যাম্বেলের বিদ্যায় ইনি অধিক দিন সন্তুষ্ট থাকিতে পারেন নাই। তিনি বম্বে মেডিক্যাল কলেজে ৬ বৎসর অধ্যয়নের পর ডাক্তার হইয়া বাড়ী আসেন। তাঁহার সার্ব্বজনীন সামাজিকতা এবং দেবপ্রকৃতিক সহৃদয়তা তাঁহাকে লোকমাত্রেরই বরণীয় ও ভালবাসার বস্তু করিয়া রাখিয়াছে।
নলিনীকান্ত রাডুলিবাসিগণের প্রাণস্বরূপ ছিলেন। তিনি স্বীয় বাসভবনকে এক সরকারি দপ্তরখানায় পরিণত করিয়াছিলেন;—একই বাটীতে উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়, সমবায় ঋণদান সমিতির আফিস সাবরেজেষ্টারি আফিস বিরাজমান। নলিনীকান্ত বাটীতে থাকিয়া কর্ণধাররূপে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালনা করিতেন। ১৩২৯ সালে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।
১২৬৮ সালের শ্রাবণ মাসে প্রফুল্লচন্দ্রের এবং ১২৭১ সালে তাঁহার অনুজ পূর্ণচন্দ্রের জন্ম হয়। সর্ব্বকনিষ্ঠ গোপাল অল্প বয়সেই মারা গিয়াছেন।
বাল্যকাল ও শিক্ষা
চতুর্থ বৎসরে প্রফুল্লচন্দ্রের ‘হাতে খড়ি’ হয়। পাঠশালার পড়া শেষ করিয়া নলিনীকান্ত ও প্রফুল্লচন্দ্র উভয়েই মধ্য-ইংরাজী স্কুলে প্রবেশ করেন। পুত্ত্রগণের বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিরূপে তাহাদিগকে সুশিক্ষা দিবেন ইহাই হরিশ্চন্দ্রের চিন্তার বিষয় হইয়া উঠে। কলিকাতায় রাখিয়া তাহাদিগের পড়ার বিশেষ কোন সুবন্দোবস্ত করিতে না পারিয়া অগত্যা স্বয়ং পুত্র ও পরিজনবর্গকে লইয়া কলিকাতায় গিয়া বাস করিতে আরম্ভ করেন। হরিশ্চন্দ্র নিজেই তাহাদিগের পাঠের তত্ত্বাবধান করিতেন, অন্য কোন গৃহ-শিক্ষকের আবশ্যক হইত না।
কলিকাতায় আসিয়া জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র হিন্দু স্কুল এবং নলিনীকান্ত ও প্রফুল্লচন্দ্র হেয়ার স্কুলে ভর্ত্তি হন। প্রফুল্লচন্দ্র হেয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণীতে ভর্ত্তি হইয়া তথায় চারি বৎসর অধ্যয়ন করেন। এই সময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব্ব ভাইস চ্যান্সেলার মাননীয় শ্রীযুক্ত দেবপ্রসাদ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় প্রফুল্লচন্দ্রের সহপাঠী ছিলেন। উত্তরকালে প্রফুল্লচন্দ্র অধ্যয়ন ও আহারাদি সম্বন্ধে যেরূপ সংযত ও মিতাচারী হইয়াছেন, এই সময়ে তিনি তদ্রূপ ছিলেন না। পাঠে অত্যাসক্তি নিবন্ধন প্রায় দিবারাত্রি পুস্তক লইয়াই থাকিতেন। সন্ধ্যা রাত্রিতে নয়টার বেশী পড়িতেন না বটে, কিন্তু শেষ রাত্রিতে তিনটার সময় উঠিয়া পুস্তক পাঠ করিতে অত্যন্ত ভালবাসিতেন; কোনরূপ বিঘ্ন ঘটিলে তিনি মনে মনে অত্যন্ত দুঃখিত হইতেন। একদিন উঠিয়া দেখিলেন, তাঁহার প্রদীপে তৈল নাই এবং ঘরেও কোনরূপে তৈল পাইবার উপায় নাই, তখন অনন্যোপায় হইয়া ফুলেল তৈল প্রদীপে ঢালিয়া পড়িতে আরম্ভ করেন। আহার সম্বন্ধে তাঁহার বিশেষ সংযম ছিল না; নিজের খেয়ালে যাহা আসিত, তাহাই আহার করিতেন। আহার সময়েরও কোনরূপ ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না, যতবার খুসি আহার করিতেন। শরীরের প্রতি এইরূপ অনিয়মিত অত্যাচারের ফলে বালক প্রফুল্লচন্দ্র শীঘ্রই পীড়িত হইয়া পড়েন, এবং দুরন্ত আমাশয় রোগ তাঁহাকে আক্রমণ করে। তিনি এই রোগে প্রায় দুই বৎসর ভুগিয়াছিলেন; প্রথম বৎসর রোগভোগে এবং দ্বিতীয় বৎসর রোগজনিত দুর্ব্বলতায় তাঁহাকে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়া বাটীতেই বসিয়া থাকিতে হইয়াছিল।
আহার ও অধ্যয়ন রীতি সম্বন্ধে এই সময়ে প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনে সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন উপস্থিত হয়। পাঠ ও ভোজন বিষয়ে যে সংঘম তাঁহার মহৎ চরিত্রের অংশ স্বরূপ হইয়া তাঁহাকে সাধারণের আদর্শ স্থানীয় করিয়াছে,তাহার বীজ এই সময়েই উপ্ত হইয়াছিল। যাহাকে বলে ‘ঠেকিয়া শেখা’ তাঁহার তাহাই হইয়াছিল। আহারে অসংযত বালক রোগে পড়িয়া একেবারেই সংযমী হইয়া উঠিলেন। অধ্যয়ন প্রণালী সম্বন্ধেও এই সময়ে ঘোর পরিবর্ত্তন ঘটে। অসুখে পড়ার পর হইতে তিনি কদাচ শেষ রাত্রিতে পড়িতেন না; এবং রোগমুক্তির পর হইতে ইঁহাকে রাত্রি নয়টার পর পড়াশুনা করিতে কখনও দেখা যায় নাই।
প্রফুল্লচন্দ্রের সাহিত্য-সাধনা, রাসায়নিক গবেষণা ও লোকহিতকর অনুষ্ঠান এত অধিক যে তাহাতেও পৃথিবীর বিস্ময় উৎপাদিত হইয়াছে। রুগ্নদেহে এই অদ্ভুত সাফল্য লাভের একমাত্র কারণ আত্মহারা হইয়া কার্য্যসম্পাদনের চেষ্টা। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁহার জীবনের কৃতকার্য্যতার কারণ সম্বন্ধে বলিয়াছেন, “He believes in doing one thing at a time and doing that well”—এক সময়ে এক টি মাত্র কাজে হাত দিবে এবং তাহাই সুসম্পন্ন করিবে— এই একনিষ্ঠাই জীবনের সফলতার কারণ।
প্রফুল্লচন্দ্র দ্বাদশ বর্ষ বয়সে পীড়িত হন এবং স্কুলের সহিত সর্ব্বপ্রকার সম্পর্ক-বিরহিত হইয়া দুই বৎসর বাটীতে থাকিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্রের পিতার সুবৃহৎ লাইব্রেরীর কতকাংশ কলিকাতায় স্থানান্তরিত হইয়াছিল এবং কতকাংশ বাটীতে ছিল। স্কুলের পড়ার কোন চাপ না থাকায় প্রফুল্লচন্দ্র গভীর অভিনিবেশ সহকারে এই সকল পুস্তকপাঠে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় হইতেই তাঁহার ইংরাজী সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি অত্যন্ত আসক্তি জন্মে। এই সময়ে ইংরাজী সাহিত্য ও ইতিহাসের চর্চা ভিন্ন তিনি ল্যাটিন ও ফরাসী ভাষাও শিক্ষা করিয়াছিলেন। এই পাশ্চাত্য ভাষাজ্ঞান উত্তরকালে তাঁহার বিলাতে শিক্ষালাভের পথ সুগম করিয়া দেয়।
রোগমুক্ত হইয়া প্রফুল্লচন্দ্র কলিকাতায় এলবার্ট স্কুলে (Albert School) প্রবেশ করেন। তখন এই বিদ্যালয়ের সুনাম বঙ্গদেশময় ব্যাপ্ত হইয়া গিয়াছিল, এবং ইহা একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় বলিয়া গণিত হইত। সুবিখ্যাত কেশবচন্দ্র সেনের অনুজ লব্ধপ্রতিষ্ঠ কৃষ্ণবিহারী সেন তখন এই স্কুলের অধিনায়ক (Rector) ছিলেন। তিনি ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপনা করিতেন। তাঁহার ন্যায় ইংরাজী ভাষার শিক্ষক তখনকার দিনে বাস্তবিকই দুর্লভ ছিল। শুধু তখনকার দিনে কেন, ইংরাজী শিক্ষার প্রচলন হইতে অদ্য পর্য্যন্ত যে সমস্ত বাঙ্গালী শিক্ষক ইংরাজী ভাষার অধ্যাপনায় কৃতিত্ব লাভ করিয়াছেন, কৃষ্ণবিহারী তাঁহাদিগের অন্যতম। এই বিদ্যালয়ে ব্রাহ্ম শিক্ষকগণের সাহচর্য্যে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাবান হইয়া উঠেন; কালক্রমে কেশবচন্দ্র সেনের বক্তৃতায় এই শ্রদ্ধা হইতে আকর্ষণ জন্মে, এবং ১৮৮২ খৃঃ অব্দে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সভ্য হন। প্রফুল্লচন্দ্র এফ, এ, পড়িবার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মেট্রপলিটান কলেজে ভর্ত্তি হন।
ঠিক এই সময়ে বঙ্গদেশে এক নবজাগরণের সাড়া পড়িয়া যায়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবাবিবাহ বিষয়ক আন্দোলন সমাজের সর্ব্ব স্তরে প্রবেশ করিয়া সকলকেই ভালমন্দ বিবেচনায় নিয়োজিত করিয়াছিল। কেশবচন্দ্র সেনের উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতায় অনেকেই ধর্ম্ম সম্বন্ধে উদার মত পোষণ করিতে আরম্ভ করেন। অন্য দিকে মাননীয় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসু প্রভৃতি ভারতসভা স্থাপিত করিয়া জাতীয় মিলনের পথ পরিষ্কার করিতেছিলেন। যুবক প্রফুল্লচন্দ্রের উপর ইঁহাদের সকলেরই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কেশবচন্দ্র সেনের বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হইয়া ইনি ব্রাহ্মমতাবলম্বী হন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবাবিবাহ প্রচারের চেষ্টা ও হিন্দু নেতৃগণের অযৌক্তিক প্রতিশোধ-তৎপরতা দেখিয়া তিনি হিন্দুসমাজের সংস্কারের আবশ্যকতা উপলব্ধি করিতে থাকেন। আনন্দমোহনের দৃঢ়তা, সততা ও দেশসেবাব্রতে তিনি অনুপ্রাণিত হইয়া তাঁহার ভক্ত হইয়া উঠিলেন। সর্ব্বোপরি দেশনায়ক সুরেন্দ্রনাথের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় তাঁহার হৃদয়ে দেশাত্মবোধ জাগিয়া উঠে, এবং তিনি ভারতে রাজনৈতিক সংস্কারের আবশ্যকতা হৃদয়ঙ্গম করেন। এই সময়ে সুরেন্দ্রনাথ মেট্রপলিটান কলেজে ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথের বক্তৃতায় তিনি এরূপ মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে, মাত্র তাঁহার নিকট পড়িবার সুযোগ হইবে বলিয়াই তিনি মেট্রপলিটান কলেজে প্রবেশ করেন। এই কলেজে পড়িবার সময় প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশ করিয়া সুবিখ্যাত অধ্যাপক স্যার জন এলিয়ট ও স্যার আলেকজাণ্ডার পেডলার সাহেবের নিকট যথাক্রমে পদার্থবিজ্ঞান (Physics) ও রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করেন।
প্রফুল্লচন্দ্র ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিভাগে এফ, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরীক্ষার কয়েকমাস পূর্ব্বে তিনি বিশেষ অসুস্থ হইয়া পড়েন। হরিশ্চন্দ্রের ইচ্ছা ছিল, তিনি পুত্রগণকে বিলাত পাঠাইয়া তথায় সকলকে উচ্চ শিক্ষা দিবেন। কিন্তু ক্রমশ: তাঁহার অবস্থা হীন হইতে থাকায়, তিনি স্বীয় সংকল্প কার্য্যে পরিণত করিতে না পারিয়া বিশেষ দুঃখিত হইয়া পড়েন। প্রফুল্লচন্দ্র পিতার মনোভাব অনেকটা অবগত ছিলেন, তাই ধীরে ধীরে গিলক্রাইষ্ট (Gilchrist) বৃত্তি পরীক্ষার জন্য আপনাকে প্রস্তুত করিতে থাকেন। ১৮৮২ খৃঃ অন্ধে তিনি উক্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া বৃত্তিলাভ করেন।
১৮৮২ খৃঃ অব্দে বি, এ, পরীক্ষা দেওয়ার পূর্ব্বেই প্রফুল্লচন্দ্র বিলাত যাত্রা করেন। বাল্যকাল হইতেই ইতিহাস ও ইংরাজী সাহিত্যের উপর তাঁহার খুব ঝোঁক ছিল। তিনি যখন বুঝিতে পারিলেন, ভারতের স্থায়ী মঙ্গল করিতে হইলে যুরোপীয় ভাষা ও সাহিত্যের দ্বারা তাহা সম্ভাবিত নহে, পরন্তু যুরোপীয় বিজ্ঞানের উপরই ভারতের স্থায়ী উন্নতি নির্ভর করিতেছে, তখন এডিনবরায় প্রবেশ করিয়া পাঠ্য নির্ব্বাচন করিতে তাঁহার ক্ষণকাল বিলম্ব হইল না; তাঁহার চির ঈপ্সিত ইতিহাস ও সাহিত্যের চর্চা পরিত্যাগ করিয়া তিনি রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়নে আত্মনিয়োগ করিলেন।
প্রফুল্লচন্দ্রের সৌভাগ্যক্রমে তিনি এডিনবরায় প্রবেশ করিয়া তৎকালীন যুরোপ-প্রসিদ্ধ দুই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের পাদমূলে উপবেশন করিয়া শিক্ষালাভের সুযোগ পাইয়াছিলেন। সুবিখ্যাত পি, জি, টেইট (P. G. Tait) সাহেব পদার্থ বিজ্ঞানের এযং এ, সি, ব্রাউন (Alexander Crum Brown) রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপনা করিতেন। ইঁহারা উভয়েই প্রফুল্লচন্দ্রের প্রতি সদয় ব্যবহার করিতেন; ইঁহাদেরই শিক্ষাগুণে অতি অল্প দিনের মধ্যেই প্রফুল্লচন্দ্র রসায়নশাস্ত্রের দিকে আকৃষ্ট হইতে থাকেন। অতি শীঘ্রই একজন বিজ্ঞানানুরক্ত মেধাবী ছাত্র বলিয়া তাঁহার খ্যাতি সর্ব্বত্র বিস্তৃত হইয়া পড়ে, এবং তিনি সকলের প্রিয় হইয়া উঠেন।
কলেজের নির্দ্দিষ্ট কালের পর তিনি খুব অল্প সময়ই পাঠে ব্যয় করিতেন। কিন্তু যেটুকু সময় পাঠে নিয়োগ করিতেন, তাহা গভীর মনোযোগের সহিতই করিতেন। নিয়মিত অধ্যয়নের ফলে প্রফুল্লচন্দ্র ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে বি-এস্-সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে ডি-এস্-সি ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁহার রচিত প্রবন্ধ সর্ব্বোৎকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ায় তিনি ‘Hope Prize’ নামক সম্মানজনক পুরস্কারও লাভ করিয়াছিলেন। ঐ পুরস্কারের মূল্য পঞ্চাশ পাউণ্ড, অর্থাৎ তখনকার দিনে প্রায় ছয়শত টাকা ছিল। ঐ বৃত্তিলন্ধ অর্থে তিনি আরও ছয় মাসকাল এডিনবরায় অবস্থিতি করিয়া তাঁহার আরব্ধ রাসায়নিক গবেষণা শেষ করিতে পারিয়াছিলেন।
বিজ্ঞানের সেবায় আত্মনিয়োগ করিলেও প্রফুল্লচন্দ্র তাঁহার চিরপ্রিয় ইতিহাসকে তাঁহার হৃদয় হইতে একেবারে অপসারিত করিতে পারেন নাই। তাঁহার অবকাশকাল স্বদেশের ইতিহাসচর্চ্চায় অতিবাহিত হইত। বি-এস্-সি পরীক্ষা দেওয়ার প্রাক্কালে তিনি ‘India before and after the Mutiny’ নামক এক প্রবন্ধ রচনা করিয়া উহা পুস্তকাকারে প্রকাশিত করেন। ইহাতে সিপাহীবিদ্রোহের পূর্ব্বে এবং পরে ভারতের অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছিল। এই পুস্তক একদিকে যেমন তাঁহার ইংরাজীভাষার অভিজ্ঞতার পরিচায়ক, অন্য পক্ষে তেমনি তাঁহার গভীর স্বদেশানুরাগ, ভারতের ইতিহাসে এবং সাধারণ রাজনীতিমূলক বিষয়গুলিতে তাঁহার সূক্ষ্ম জ্ঞানের পরিচয় প্রদান করে। উক্ত পুস্তক অতি ক্ষুদ্র হইলেও উহা বিলাতের প্রধান প্রধান লোকের এবং সংবাদপত্রের প্রশংসালাভে সমর্থ হইয়াছিল। এই প্রবন্ধে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এত তথ্য সন্নিবেশিত হইয়াছিল যাহা অন্যত্র পাওয়া দুর্ঘট। তাঁহার ইতিহাস লিখিবার প্রণালী কি সুন্দর, উহা পাঠ করিলে জানা যাইবে।
ডি-এস্-সি ডিগ্রী প্রাপ্তির পর বিলাতের বিজ্ঞানাগারে স্বীয় আরব্ধ গবেষণা পরিসমাপ্ত করিয়া প্রফুল্লচন্দ্র ভারতীয় শিক্ষা-বিভাগে প্রবেশ করিবার জন্য তদানীন্তন ভারত-সচিবের নিকট আবেদন করেন। কর্ম্মপ্রাপ্তি সম্বন্ধে তাঁহার বিলাতী বন্ধুগণও বিশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু কি কারণে বলা যায় না, তাঁহার ন্যায় উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত এবং রসায়নশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ব্যক্তিকে ভারত-সচিব মহোদয় ভারতীয় শিক্ষা বিভাগে (Indian Educational Service) গ্রহণ করা আবশ্যক বিবেচনা করেন নাই।
১৮৮৮ সালের আগষ্ট মাসে প্রফুল্লচন্দ্র স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া ভারত-সচিবের উপদেশানুযায়ী কর্ম্মপ্রাপ্তির জন্য বঙ্গীয় গভর্ণমেণ্টের নিকট আবেদন করেন। সুখের বিষয় বঙ্গীয় গভর্ণমেণ্ট তাঁহার প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া তাঁহাকে প্রাদেশিক শিক্ষা-বিভাগে (Provincial Educational Service) গ্রহণ করতঃ গুণগ্রাহিতার কথঞ্চিৎ পরিচয় দিয়াছিলেন। পরবর্ত্তী জুন মাস হইতে মাসিক ২৫০৲ টাকা বেতনে প্রফুল্লচন্দ্রকে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন শাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপকরূপে নিযুক্ত করা হয়। এই সময়ে সুবিখ্যাত টনি সাহেব (C. H. Tawney) প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এবং আলেকজান্দার পেডলার সাহেব (যিনি পরে সার হইয়াছিলেন) রসায়নশাস্ত্রের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন।
প্রফুল্লচন্দ্র যখন কর্ম্মপ্রাপ্তির জন্য চেষ্টা করিতেছিলেন, তখন সুপ্রসিদ্ধ ক্রফট্ (Croft) সাহেব শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর। তিনি এই সময় দার্জিলিংএ ছিলেন। ২৫০৲ টাকা বেতনে নিযুক্ত হইয়াছেন শুনিয়া প্রফুল্লচন্দ্র মনের দুঃখে দার্জিলিংএ ডিরেক্টর সাহেবের নিকট ছুটিয়া যান। কিন্তু ডিরেক্টর সাহেব তাঁহার আবেদন সমবেদনার সহিত গ্রহণ না করিয়া বরঞ্চ একটু তীব্রভাবই প্রদর্শন করিয়াছিলেন। তিনি তাঁহাকে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছিলেন—“There are other works in life, who asks you to accept service?”—“চাকুরী ভিন্ন জীবনে অনেক কাজ করিবার আছে, কে তোমাকে চাকুরী লইতে সাধাসাধি করিতেছে?” ডিরেক্টর সাহেবের এই শ্লেষোক্তিতে প্রফুল্লচন্দ্রের আত্মাভিমানে অত্যন্ত আঘাত লাগে এবং তাঁহার চাকুরী করিবারে সাধ একেবারে চলিয়া যায়; কিন্তু তাঁহাকে দায়ে ঠেকিয়া কর্ম্মগ্রহণ করিতে হয়; তিনি বিলাত হইতে উচ্চ রসায়নীবিদ্যা আয়ত্ত করিয়া দেশে ফিরিয়াছেন, অন্য পথে যাওয়াও সুবিধাজনক নহে। বিশেষতঃ মৌলিক গবেষণা দ্বারা নূতন নূতন তত্ত্বাবিষ্কার করিবার স্পৃহা তাঁহাকে অনুপ্রাণিত করিয়া তুলিয়াছিল। এমন কি, প্রেসিডেন্সি কলেজ ভিন্ন অন্য কোন কলেজে নিযুক্ত হইলেও তাঁহার এই বাসনা ফলবতী হইবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। সুতরাং একরূপ বাধ্য হইয়াই ‘রোগী যেন নিম খায় মুদিয়া নয়ন’ গতিকে তাঁহাকে এই কর্ম্ম গ্রহণ করিতে হইল।
ঈপ্সিত জ্ঞানানুশীলনের পথে এইরূপে নানা বিঘ্ন-বাধা উপস্থিত হওয়ায় প্রফুল্লচন্দ্রের জ্ঞানপিপাসু চিত্ত সহজেই বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। তিনি শিক্ষাবিভাগের এই সকল নীরব অত্যাচার মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিলেন বটে; কিন্তু পরাধীনতার একটা গ্লানি আসিয়া বৃশ্চিক দংশনের ন্যায় তাঁহার সর্ব্ব শরীরে এমন একটা জ্বালা উৎপন্ন করিল যে তাহারই ফলে তাঁহার সমগ্র জীবন ভবিষ্য বংশীয়গণের মুক্তির সন্ধানে উৎসৃষ্ট হইয়াছে।
এই সময়ে প্রফুল্লচন্দ্রের অন্তরপ্রদাহে সার জগদীশ্চন্দ্রের পারিবারিক স্নেহ, যত্ন ও ভালবাসা কতকটা বাহ্য প্রলেপের কাজ করিয়াছিল। প্রফুল্লচন্দ্র যখন এডিনবরায় অধ্যয়ন করিতেন, বাঙ্গালার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রত্ন বিজ্ঞানাচার্য্য সার জগদীশ্চন্দ্র বসু মহাশয় তখন কেম্ব্রিজের ছাত্র ছিলেন। উভয়ের প্রথম লণ্ডনে সাক্ষাৎ হয়। প্রথম সাক্ষাৎ হইতেই চুম্বকের ন্যায় উভয়ে উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হইতে থাকেন এবং প্রথম আলাপ হইতেই উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্দ্যের সৃষ্টি হয়। “সম্বন্ধমাভাষণপূর্ব্বমাহুঃ”। জগদীশ্চন্দ্র ১৮৮৬ সালে ভারতীয় শিক্ষাবিভাগে প্রবেশ করেন। প্রফুল্লচন্দ্র কলিকাতায় ফিরিয়া তাঁহার এই অকৃত্রিম সুহৃদের গৃহে প্রায় এক বৎসর কাল অতিবাহিত করিয়াছিলেন। এখানে বসুপত্নীর নিকট অনুজোচিত স্নেহ লাভ করিয়া তাঁহার ক্লান্ত দেহ সুস্থ ও ক্ষুব্ধ চিত্ত শান্ত হইল।
১৮৮৯ খৃষ্টাব্দের গ্রীষ্মাবকাশের পর কলেজ খুলিলেই প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানাগারে প্রবেশ করিয়া সেই যে টেষ্ট টিউবকে (test tube) সাদরে বরণ করিয়া লইলেন, তাঁহার জীবনের অর্দ্ধ শতাব্দী অতীত হইয়া গিয়াছে, তবুও তিনি তাহার সহিত সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছেন। তিনি সেদিনও বলিয়াছেন—‘বিজ্ঞানাগারই আমার শান্তি ও কর্ম্মের স্থল; সেখানে টেষ্ট টিউব-এর সহিত আলাপে আমি আমার বার্দ্ধক্য ভুলিয়া যাই,—৩৩ বৎসর, এক শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশ কাল বিজ্ঞানাগারের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া বাহ্য জগতের সহিত সকল সম্বন্ধচ্যুত হইয়া পড়িয়াছি।’
প্রফুল্লচন্দ্রের আজীবন সাধনার ফল, তাঁহার বিশ্ববিখ্যাত আবিষ্ক্রিয়া, বেঙ্গল কেমিক্যাল ও ফারমাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের প্রতিষ্ঠা ও হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস-সঙ্কলন প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানাগারেই সম্ভাবিত হইয়াছিল।
প্রফুল্লচন্দ্র যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশ করেন তখন এদেশে বিজ্ঞানশিক্ষার অবস্থা অতি শোচনীয় ছিল। পরীক্ষা পাশের উদ্দেশ্য ভিন্ন অন্য কোন অভিপ্রায়ে কেহ বিজ্ঞানচর্চ্চা করিতে ইচ্ছা করিত না। পরীক্ষাপাশের সুবিধা হইবে মনে করিয়া যাহারা পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নশাস্ত্র পাঠ করিত, পরীক্ষা পাশের সঙ্গে সঙ্গে তাহারা উহা বিস্মৃত হইতে আরম্ভ করিত। এই সময়ে যাহারা এম, এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হইয়া প্রথম স্থান অধিকার করিত তাহারা ভ্রমে কোন দিনও মৌলিক গবেষণার কথা মনে করে নাই!
প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশ করিয়া তাঁহার প্রধান চেষ্টা হইল ছাত্রগণের মনে বাস্তবিক বিজ্ঞানালোচনার জন্য একটা আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করা। প্রথম হইতে ছাত্রগণকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করিবার জন্য তিনি প্রায়ই প্রথম ও দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে অধ্যাপনা করিতেন। ‘কলেজে নব প্রবিষ্ট ছাত্রগণের মনে রসায়নশাস্ত্র শিক্ষার জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যেই তিনি নিম্নতম শ্রেণীতে অধ্যাপনা করিতেন। তিনি রাসায়নিক তত্ত্ব, বিশ্লেষণে অথবা বিভিন্ন মতবাদের আলোচনায় সময় ক্ষেপ না করিয়া কিরূপে রসায়নের সেবায় আত্মনিয়োগ করা যায় তাহার দৃষ্টান্ত ছাত্রগণের সম্মুখে উপস্থাপিত করিতেন; বিদ্যার জন্য বিদ্যাচর্চ্চা, সত্যানুসন্ধান, নৃতন তথ্যের আবিষ্কার, রসায়নশাস্ত্রের পরিপুষ্টির জন্য রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন প্রভৃতি খাঁটি সত্যগুলি ছাত্রগণের মনে সুপ্রবিষ্ট করিয়া দিতেন; উচ্চ শ্রেণীর ছাত্রগণের সম্মুখে তাঁহার নিজের আবিষ্ক্রিয়ার বিবরণ সবিস্তারে বর্ণনা করিতেন; কেবলমাত্র পরীক্ষায় পাশের জন্য সাহায্য করিতেন না। মধ্যে মধ্যে কৌতুকজনক সন্দর্ভের অবতারণা, সামাজিক ব্যাধির আলোচনা প্রভৃতি দ্বারা ছাত্র গণের মনে পৌরুষের আদর্শ জাগাইয়া উহা লাভ করিবার পন্থা নির্দ্দেশ করিয়া দিতেন। নিম্নশ্রেণীতে প্রীতিকর রাসায়নিক পরীক্ষা উপস্থাপিত করিয়া ছাত্রগণকে রসায়নবিজ্ঞানের গুপ্ত রহস্যের সহিত পরিচিত ও উহা উদ্ঘাটনের জন্য উৎসাহিত করিতেন।’
এই সময়ে এফ্ এ ও বি, এ পরীক্ষায় রসায়নশাস্ত্র পঠিত হইত বটে, কিন্তু কাহাকেও হাতে-কলমে কোন কাজ করিতে হইত না; এমন কি, এম, এ পরীক্ষার জন্যও হাতে কাজ সামান্য মাত্র আবশ্যক হইত। সুতরাং প্রেসিডেন্সি কলেজের যন্ত্রাগারের অবস্থাও তত উন্নত ছিল না। এডিন্বরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রাগারে কাজ করিয়া আসিয়া কলিকাতার এই সামান্য যন্ত্রাগারে স্বাধীন গবেষণার কার্য্য চালান প্রফুল্লচন্দ্রের পক্ষে একরূপ অসম্ভব ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায়। কত ধৈর্য্যের সহিত যে তাঁহাকে এই সময়ে নানা বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া, সত্যের পথে অগ্রসর হইতে হইয়াছে, তাহা ভাবিলেও বিস্মিত হইতে হয়।
আদর্শ অধ্যাপকরূপে প্রফুল্লচন্দ্রের যশ সুপ্রতিষ্ঠিত হইল বটে, তাঁহার চেষ্টায় যন্ত্রাগারেরও যথেষ্ট উন্নতি হইল, কিন্তু তাঁহার অন্তরে অন্তরে যে অনিদ্র বাসনা চক্ষু চাহিয়া জাগিয়া রহিল, তাহাকে শান্ত করিবার কোন উপায়ই তিনি সহজে করিতে পারেন নাই। সেই যে এডিন্বরায় অধ্যয়নকালে তিনি ব্যথিত চিত্তে লক্ষ্য করিয়াছিলেন জাপানী ছাত্রগণের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে লণ্ডন ও বার্লিনের বৈজ্ঞানিক পত্রগুলি পূর্ণ হইতেছে; আর জাপানের সভ্যতার মূলাধার ভারতবর্ষ মহানিদ্রায় শায়িত; তিনি যে আশা করিয়াছিলেন, ভারতের এ মহানিদ্রা ঘুচাইয়া পুনরায় জ্ঞানের বর্ত্তি প্রজ্জ্বলিত করিতে হইবে, ভারতীয় ছাত্রগণের মৌলিক গবেষণায় ও প্রবন্ধগৌরবে জগতের বিস্ময় উৎপাদন করিতে হইবে[১]। কিন্তু বহু দিন চলিয়া গেল, কোন ছাত্রই তৃষ্ণার্ত চিত্তে তাঁহার নিকট আসিল না; যদি বা দুই এক জন আসিল, তাহারা দুই এক মাস কাজ করিয়া ডেপুটীগিরি বা ওকালতীর গন্ধে ছুটিয়া পলাইল।
প্রফুল্লচন্দ্র নীরবে তাঁহার গবেষণার পথে অগ্রসর; শ্রান্তি নাই, বিশ্রাম নাই, সমান ভাবে নীরব কর্ম্মী পথ বাহিয়া চলিয়াছেন! তাঁহার কেবলই মনে হইতেছে, তিনি যে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভাব জাগাইয়া তুলিয়াছেন তাঁহার অবর্ত্তমানে কে তাহা সঞ্জীবিত রাখিবে? তিনি ভগবানকে কাতর ভাবে সর্ব্বদাই অন্তরের বেদনা জানাইতেছেন,—“আমি মরি হে মুরারি, দুখ নাই অন্তরে গো”, কে আমার এই আরদ্ধ কর্ম্মের স্রোত বহমান রাখিবে?
দেবতার অনুগ্রহে তাঁহার ও দেশের মুখরক্ষা হইল! পূর্ব্বে কোন কোন ছাত্র তাঁহার সহিত সামান্য ভাবে গবেষণায় নিয়োজিত হইলেও, তাঁহাদের কার্য্য স্থায়ী হয় নাই। কিন্তু বাস্তবিক স্রোত ফিরিল ১৯১০ সাল হইতে, যখন শ্রীযুক্ত জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিত প্রমুখ ছাত্রগণ আসিয়া প্রেসিডেন্সি কলেজের নির্জ্জন লেবরেটারী মুখরিত করিয়া তুলিলেন। যতীন্দ্রনাথ সেন, জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিত, হেমেন্দ্রকুমার সেন, নীলরতন ধর, রসিকলাল দত্ত, বিমানবিহারী দে, জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি, মেঘনাদ সাহা প্রভৃতি কৃতী ছাত্র নানা মৌলিক প্রবন্ধে য়ুরোপ ও আমেরিকার বৈজ্ঞানিক পত্রগুলির স্তম্ভ পূরণ করিতে লাগিলেন। দিন দিন নূতন আবিষ্ক্রিয়া দ্বারা বাঙ্গালী মস্তিষ্কের উর্ব্বরতার সাক্ষ্য বাহিরে প্রচারিত হইতে লাগিল। প্রফুল্লচন্দ্র হিন্দু রসায়নীবিদ্যার ইতিহাস সঙ্কলনকালে বাঙ্গালীর জড়ত্ব সম্বন্ধে যে হতাশ ভাব প্রকাশ করিয়াছিলেন দশ বৎসরের মধ্যেই তাহা পরিবর্ত্তিত হইয়া তাঁহাকে পুনরায় আশার সঙ্গীত গাহিতে হইল।
প্রেসিডেন্সি কলেজে কার্য্যারম্ভ করিবার পর, প্রফুল্লচন্দ্র পিতৃঋণের জন্য বিশেষ ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়েন। নিজ অসাধারণ মিতব্যয়িতার ফলে তিনি তিন বৎসরে প্রায় ৪০০০৲ টাকা পিতৃঋণ পরিশোধ করেন এবং কলিকাতায় নিজ খরচা বাদে ৮০০৲ শত টাকা বাঁচাইয়া তাহা দ্বারা ১৮৯২ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের পত্তন করেন। এই সময় ইনি জগদীশচন্দ্রের বাটী হইতে আসিয়া ৯১ নম্বর অপার সার্কুলার রোডের বাটীতে অবস্থিতি করিতে থাকেন। এইখানেই বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের জন্ম হয় এবং অল্পদিন পূর্ব্ব পর্য্যন্ত এই বাটীতেই ইহার প্রধান আফিস ছিল। বেঙ্গল কেমিক্যালের জন্য অনেক জিনিষের পরীক্ষা এই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের লেবরেটারীতে (যন্ত্রাগারে) হইত।
১৮৯৫ সাল প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনের প্রধান স্মরণীয় বৎসর। এই বৎসর তাঁহার গবেষণার ফল স্বরূপ Mercurous Nitrite আবিষ্কৃত হয়। ইহাই তাঁহার সর্ব্বপ্রধান ও সর্ব্বপ্রথম আবিষ্কার। এই বৎসরই গন্ধকদ্রাবক প্রস্তুত করিবার যন্ত্রপাতি (Sulphuric Acid Plant) সংস্থাপিত হইয়া প্রকৃত প্রস্তাবে বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের কার্য্যারম্ভ হয়। আবার এই বৎসরই তাঁহার স্নেহময় পিতার মৃত্যু হইল। এইরূপ পরস্পর-বিরোধী হাসিকান্না, সুখদুঃখ, হর্ষ ও বিষাদের সঙ্ঘাতে তাঁহার প্রকৃতি এক অনির্ব্বচনীয় ভাবে বিভোর হইয়া পড়ে।
১৯০২ খৃঃ অব্দে তাঁহার হিন্দু রসায়নীবিদ্যার ইতিহাসের প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়। প্রাচীন ভারতে রসায়নীবিদ্যার কিরূপ উন্নতি হইয়াছিল, তাহা প্রমাণ করিবার জন্যই তিনি বহু পরিশ্রমে এই ইতিহাস প্রণয়ন করেন। ১৯০৫ খৃঃ অব্দে ইহার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইল। ১৯০৭ সালে উক্ত গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগ প্রচারিত হইয়াছে।
প্রেসিডেন্সি কলেজের রাসায়নিক যন্ত্রাগারের উন্নতিসাধন করিবার ও রাসায়নিকগণের সংস্পর্শে আসিবার অভিপ্রায়ে বাঙ্গালা সরকার প্রফুল্লচন্দ্রকে ১৯০৭ খৃঃ অব্দে য়ুরোপের প্রধান প্রধান যন্ত্রাগার পরিদর্শন করিবার জন্য প্রেরণ করেন। ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও জার্ম্মণীর প্রধান প্রধান যন্ত্রাগার দেখিয়া তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তাহার ফলে ১৯১২ সাল হইতে প্রেসিডেন্সি কলেজের রাসায়নিক যন্ত্রাগারের বহু উন্নতি সাধিত হইয়াছে।
য়ুরোপে প্রবাসকালে প্রফুল্লচন্দ্র যখন যেখানে গিয়াছিলেন, তথায় বিশেষ সম্মানলাভ করিয়াছিলেন। এই সময়ে প্রফুল্লচন্দ্রের গবেষণার কথা পৃথিবীময় রাষ্ট্র হইয়া বৈজ্ঞানিকদিগের বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছিল। তিনি এখন হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসেরও প্রণেতা বলিয়া সর্ব্বত্র সম্মানিত। তাঁহার আদর্শ চরিত্র য়ুরোপীয়গণের নিকট অপরিজ্ঞাত ছিলনা, তাই য়ুরোপীয় বৈজ্ঞানিকগণ বহু অনুষ্ঠানে তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া সম্বর্দ্ধনা করিয়াছিলেন।
প্রফুল্লচন্দ্র স্বকীয় গবেষণা ও মৌলিক আবিষ্ক্রিয়া দ্বারা য়ুরোপীয় বিদ্বন্মণ্ডলীর নিকষ্ট সম্মানিত; হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস প্রণয়ন ও প্রকাশে তাঁহার যশঃ সর্ব্বত্র পরিব্যাপ্ত; তাঁহার আদর্শচরিত্রে তিনি লোকমাত্রেরই বরণীয়; তাঁহার আদর্শ শিক্ষাপ্রণালীর ফলে দেশে মৌলিক গবেষণার স্রোত প্রবাহিত; কিন্তু আমাদের গবর্ণমেণ্ট তাঁহার গুণ গ্রহণে কতকটা অন্ধ ছিলেন। তাঁহাকে যে প্রাদেশিক শিক্ষাবিভাগে কোণ-ঠেসা করিয়া রাখা হইল, তাহার আর কোন নড়চড় হইল না। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁহার সরকারী চাকুরী সম্বন্ধে লিখিয়াছেন, “তিনি ২৫০৲ টাকা মাসিক বেতনে ১৮৮৯ খৃঃ অব্দে শিক্ষাবিভাগে প্রবেশ করেন এবং সেই বেতনে সাত বৎসর কর্ম্ম করার পর, তাঁহার বেতন ৪০০৲ টাকা হয়। আরও সতের কি আঠার বৎসর পরে তাঁহাকে প্রাদেশিক শিক্ষাবিভাগের উচ্চতম সোপানে উন্নীত করা হয় এবং তিনি ৭০০৲ টাকা বেতন পাইতে থাকেন।” স্যার জগদীশচন্দ্র বসু প্রভৃতির মত কার্য্যকুশলতা প্রদর্শন করিয়াও স্থায়ীভাবে উচ্চতম ভারতীয় শিক্ষাবিভাগে (Indian Educational Service) উন্নীত হইতে পারেন নাই।
এই কারণেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনে প্রফুল্লচন্দ্র বলিতে বাধ্য হইয়াছিলেন যে,—“It was not consistent with a sense of self-respect that men equally educated, doing the same kind of work and of equal calibre, should be ranked in two different services.”
প্রফুল্লচন্দ্রের কার্য্যকালে মিঃ পেডলার (পরে সার), মিঃ পি, মুখার্জি, মিঃ ষ্টেপল্টম ও মিঃ ক্যানিংহাম যথাক্রমে প্রেসিডেন্সি কলেজের রাসায়নিক বিভাগে প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। মিঃ পেডলার ও মিঃ মুখার্জি প্রফুল্লচন্দ্রকে অত্যন্ত প্রীতির চক্ষে দেখিতেন। মিঃ ষ্টেপল্টন কিছু ক্ষমতাপ্রিয় ছিলেন। মিঃ ক্যানিংহাম প্রফুল্লচন্দ্রের গুণমুগ্ধ ছিলেন এবং বাঙ্গালী ছাত্রগণকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন। ক্যানিংহামের চেষ্টায়, বাঙ্গালাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছে। প্রফুল্লচন্দ্রের উপরে তাঁহাকে সংস্থাপিত করায় তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া গভর্ণমেণ্টের কার্য্যের প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। ১৯১০ সালে তাঁহার মৃত্যু হয়। ক্যানিংহামের পর হইতে প্রফুল্লচন্দ্রের উপর প্রেসিডেন্সি কলেজের রাসায়নিক বিভাগের কর্ত্তৃত্বভার দেওয়া হয় এবং অবসর গ্রহণ না করা পর্য্যন্ত তিনি প্রধান অধ্যাপকের কাজ করিতেন।
১৯১২ সালে লণ্ডন নগরে বৃটিশ সাম্রাজ্যের যাবতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মহাসম্মেলন (Congress of the Universities of the Empire) হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও দেবপ্রসাদ সর্ব্বাধিকারী উহার প্রতিনিধি নির্ব্বাচিত হন। এই সম্মেলনে তাঁহারা বিশেষ যোগ্যতার সহিত ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ও ছাত্রগণের পক্ষ সমর্থন করিয়াছিলেন। তাঁহাদের যোগ্যতার পুরস্কার স্বরূপ এবার্ডিন বিশ্ববিদ্যালয় ডাঃ সর্ব্বাধিকারীকে এল, এল, ডি এবং ডার্হাম বিশ্ববিদ্যালয় ডাঃ রায়কে ডি-এস্-সি ডিগ্রী প্রদান করেন। এই বৎসর গভর্ণমেণ্টও প্রফুল্লচন্দ্রকে সি, আই, ই উপাধি প্রদান করিয়াছিলেন।
বিজ্ঞানশিক্ষা প্রচারের জন্য ১৯১২ সালে স্যার টি, পালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্তে পনের লক্ষ টাকা দান করেন। পরবর্ত্তী বৎসরে এই মহদুদ্দেশ্যে স্যার রাসবিহারী ঘোষ মহোদয়ও অতিরিক্ত দশ লক্ষ টাকা দান করেন। এই দুই মহাত্মার অর্থ-সাহায্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্রবে বিজ্ঞান কলেজের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। প্রফুল্লচন্দ্র বিলাতে থাকিতেই সার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহোদয় তাঁহাকে পালিত-প্রতিষ্ঠিত রাসায়নিক অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করিবার জন্য আহ্বান করেন। বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি ঐ পদ গ্রহণে স্বীকৃত হইলে ১৯১৬ সালে বাঙ্গালা সরকারের অনুমতি লইয়া তাঁহাকে ঐ পদে নিযুক্ত করা হয়। ১৯১৪ সালে বিজ্ঞান কলেজের নবনির্ম্মিত ভবনে বিস্তারিত ভাবে কার্য্যারম্ভ হইয়াছে।
১৯১৭ সালে প্রফুল্লচন্দ্র সরকারী কার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহার কার্য্যাবসানে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রগণ তাঁহাকে যে অভিনন্দনপত্র প্রদান করেন তাহা শিক্ষকের প্রতি ছাত্রগণের ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রকৃষ্ট নিদর্শন।
রাসায়নিক গবেষণা
স্বাধীন চিন্তা ও মৌলিক গবেষণার গৌরবে যাঁহারা বিদেশে বাঙ্গালী জাতির সম্মান বৃদ্ধি করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে আচার্য্য জগদীশচন্দ্র ও আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের নামই সর্ব্বাগ্রে স্মরণীয়! সহস্রাধিক বৎসরের জড়তার ফলে স্বাধীন ভাবে কোন বিষয়ের সত্যানুসন্ধানের শক্তি বাঙ্গালীর মস্তিষ্ক হইতে যেন চিরবিদায় লইয়াছিল। এই ঊষর ক্ষেত্রে আচার্য্য জগদীশচন্দ্র ও আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র আবির্ভূত হইয়া আমাদিগের সম্মুখে শুধু গবেষণার নূতন পথ খুলিয়া দিয়াছেন এমন নহে, পরন্তু এই প্রারম্ভাবস্থায় তাঁহারা যে নূতন তথ্যের আবিষ্কার করিয়াছেন, তাহা বিজ্ঞানচর্চ্চাগর্ব্বিত য়ুরোপীয়গণেরও বিস্ময়োৎপাদন করিয়াছে।
তীক্ষ্ণ পর্য্যবেক্ষণশক্তি ও ঘটনার কারণনিরূপণের ইচ্ছা প্রফুল্লচন্দ্রের পঠদ্দশাতেই প্রতিভাত হইয়াছিল। এডিন্বরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় তিনি এক শ্রেণীর নূতন যৌগিক পদার্থ (Conjugated Sulphates of the Copper Magnesium Group) আবিষ্কার করেন। এই গবেষণার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ত্তৃপক্ষ যে তাঁহাকে তথাকার সর্ব্বোচ্চ সম্মান ডি-এস্-সি ডিগ্রী প্রদান করেন, তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে।
নাইট উপাধি লাভ, বিলাত যাত্রা, দেশসেবা, দানশীলতা, জাতীয় শিক্ষা ও রাজনীতি ক্ষেত্র।
বিগত জার্ম্মাণ-যুদ্ধের সময়, যুদ্ধ চালাইবার জন্য বহুপরিমাণে গোলাগুলি ও বারুদের প্রয়োজন হইয়াছিল। সেই সময় বেঙ্গল-কেমিক্যাল ভারত সরকারকে বহু পরিমাণে ঐ সকল জিনিষ সরবরাহ করে। যুদ্ধে এই সাহায্যের জন্য ও মৌলিক গবেষণার জন্য সম্রাট্ বেঙ্গল কেমিক্যালের নেতা আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্রকে ‘স্যার’ উপাধিতে বিভূষিত করেন। উচ্চাঙ্গের রসায়ন-চর্চ্চা করিবার জন্য ১২৯১ সালের আগষ্ট মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য্য রায়কে বিলাতে প্রেরণ করেন। খুলনা জেলা ব্যাপী যখন ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছিল—সেই সময় আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র দেশের লোকের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া তিন লক্ষ টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন। আচার্য্যের দানশীলতার কথা বাংলা দেশে সকলেই অবগত আছেন—তাই দেশবাসী বিশ্বাস করিয়া তাঁহার হাতে তিন লক্ষ টাকা অনায়াসেই প্রদান করিয়াছিল।
এই সময় অসহযোগ আন্দোলন প্রবল বেগে প্রবাহিত হইতেছিল এবং মহাত্মা গান্ধী চরকা-মন্ত্র প্রচার করিতেছিলেন। আচার্য্য রায় প্রথমে চরকা ও খদ্দরের পক্ষপাতী ছিলেন না। খুলনার দুর্ভিক্ষ তাঁহার মতের পরিবর্ত্তন ঘটায়। দুর্ভিক্ষের প্রকোপ প্রশমিত হইলে তিনি চিন্তা করিতে লাগিলেন, দুর্ভিক্ষ পীড়িত লোকদিগকে কি কার্য্য দেওয়া যাইতে পারে যাহাতে তাহারা সমস্ত দিন ব্যাপৃত থাকিয়া স্ব স্ব জীবিকার সংস্থানেও সক্ষম হয়। তিনি দেখিলেন যে দুর্ভিক্ষ পীড়িত নরনারীরা অবসর সময়ে চরকা কাটিলে, তাহাদের অনেক সাহায্য হইবে। এই সময়ে তিনি চরকা-মন্ত্রে দীক্ষিত হইলেন এবং তাঁহার অদম্য চেষ্টা ও উৎসাহে খুলনার ঘরে ঘরে চরকা চলিতে লাগিল। আচার্য্য রায়ের দেশ সেবা এই খানেই শেষ হইল না। শীঘ্রই দেশ সেবার অন্য সুযোগ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইল।
১৯২২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর-বঙ্গে ভীষণ বন্যা হয়। বন্যাপীড়িত নরনারীর দুঃখ দুর্দ্দশার কথা চিন্তা করিয়া প্রফুল্লচন্দ্র স্থির থাকিতে পারিলেন না। তিনি কলিকাতাবাসীকে এক মহতী সভায় আহ্বান করিয়া “বেঙ্গল রিলিফ কমিটি” নামে একটী কমিটী সংগঠন করিলেন। বন্যা পীড়িতদের সাহায্যের সকল ভার ও বন্দোবস্ত এই কমিটির হস্তে অর্পণ করিয়া তিনি কার্য্যে অগ্রসর হইলেন। শুধু বাংলা দেশ নয়, বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রভৃতি ভারতের নানা প্রদেশ হইতে এই কার্য্যে তিনি আশাতীত সাহায্য পাইয়াছিলেন। সুদূর প্রবাসী ভারতবাসীগণও তাঁহাকে এই কার্য্যে সাহায্য করিয়াছিলেন। ভিক্ষালব্ধ প্রায় দশ লক্ষ টাকা তিনি তাঁহার যুবকমণ্ডলীর সাহায্যে বন্যাপীড়িতদের দুঃখ দূর করিতে ব্যয় করিয়াছিলেন।
১৯২২ সালে বিজ্ঞান চর্চ্চার জন্য আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দশ হাজার টাকা দান করেন। তাঁহার জীবনের সঞ্চিত অর্থের অধিকাংশই এই কার্য্যে দান করিয়া তিনি অপূর্ব্ব দানশীলতার পরিচয় দিয়াছেন। ১৯২৫ সালে বক্তৃতা দিবার জন্য নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়, আচার্য্য রায়কে আহ্বান করেন। পারিশ্রমিক হিসাবে সমস্ত প্রাপ্য টাকা তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রত্যর্পণ করেন। বিজ্ঞান-মন্দিরের স্থাপনার প্রারম্ভ হইতেই আচার্য রায় রসায়নশাস্ত্রের পালিত অধ্যাপকরূপে নিযুক্ত আছেন। পালিত ট্রাষ্টের নিয়মানুসারে অধ্যাপকের ষাট বৎসর বয়স হইলে কর্ম্মত্যাগ করা দরকার—তবে ট্রাষ্টিরা ইহার ব্যতিক্রম করিতে পারেন। ষাট বৎসর পূর্ণ হইলে আচার্য্য রায় পদত্যাগ-পত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁহাকে আরও পাঁচ বৎসরের জন্য অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। এই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে পত্র লিখিয়াছিলেন—তাহাতে তাঁহার হৃদয়ের মহত্ত্বই প্রকাশ পায়। তিনি লেখেন—“আমার জীবনের বাকী দিন গুলি বিজ্ঞানমন্দিরের পরীক্ষাগারে কাটাইয়া দিতে খুবই ইচ্ছা করি, কিন্তু এই কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট হইতে আর পারিশ্রমিক গ্রহণ করিতে আমি অক্ষম। সেই জন্য আমার নিবেদন যে পালিত অধ্যাপকের প্রাপ্য মাসিক এক হাজার টাকা আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রত্যর্পণ করিতেছি, যাহাতে এই টাকা বিজ্ঞান মন্দিরে রাসায়নিক বিভাগে ব্যয় হইতে পারে।” তাঁহার জীবনের শ্রেষ্ঠ দান খাদি-প্রচারের জন্য। তিনি আজীবন প্রায় ৫৬০০০৲ টাকা—‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ ও অন্যান্য কোম্পানীর ‘শেয়ার’ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। খাদি প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব দান করিয়া দেশের কাজে উৎসর্গ করিয়াছেন। সমস্ত ভারতবাসী তাঁহার স্বার্থত্যাগের কথা শুনিয়া বিস্মিত হইয়াছে।
জাতীয় শিক্ষায় আচার্য্য রায়ের বিশ্বাস আছে। বাংলা ভাষার মধ্য দিয়া শিক্ষা দিবার তিনি বিশেষ পক্ষপাতী। জাতীয় শিক্ষার পক্ষপাতী বলিয়া, স্যর আশুতোষ চৌধুরীর মৃত্যুর পর, তাঁহাকেই “জাতীয় শিক্ষা পরিষদের” (National Council of Education) সভাপতি করা হইয়াছে। তাঁহারই উৎসাহ ও চেষ্টায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ নূতন কর্ম্মক্ষেত্রে উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছে। এই কারণে ১৯২৩ সালে আলিগড় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাধিদান সভায় তাঁহাকে আহ্বান করেন। এই উপলক্ষে তিনি যে বক্তৃতা দিয়াছিলেন তাহা সকলের দৃষ্টিই আকর্ষণ করিয়াছিল।
প্রথম জীবনে আচার্য্য রায় রাজনীতি হইতে দূরে থাকিতেন। অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হইবার পূর্ব্বেও তিনি রাজনীতি ক্ষেত্রে যোগ দেন নাই। খুলনা দুর্ভিক্ষের পর হইতে তিনি চরকার কার্য্যকারিতায় বিশ্বাস করিয়া—চরকা ও খদ্দর প্রচারের ভার গ্রহণ করিলেন। এই সময় হইতে তিনি রাজনীতি ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন এবং রাজ-নৈতিক হিসাবে উৎকল, কোকনদ ও অন্যান্য স্থান হইতে তাঁহার নিমন্ত্রণ আসিতে লাগিল। এই উপলক্ষে দেশপ্রাণ প্রফুল্লচন্দ্র এখন ভারতময় ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।
- ↑ Essays and Discourses by Sir P. C. Roy (G. A. Natesan.)—৩২ পৃষ্ঠা।
সূচিপত্র।
বিষয়। |
পৃষ্ঠা |
১। | ১ |
২। | অন্ন সমস্যা (অর্থনৈতিক) |
৪০ |
৩। | ৮৫ |
৪। | সমাজ-সংস্কার সমস্যা (সামাজিক) |
১০০ |
৫। | জাতিভেদ (ঐ) |
১৩০ |
৬। | পাতিত্য সমস্যা (ঐ) |
১৫১ |
৭। | ১৬২ |
৮। | ১৭৬ |
৯। | সাধনা ও সিদ্ধি (শিক্ষা) |
১৯৬ |
১০। | বঙ্গীয় যুবক সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ জীবিকার্জ্জন (অর্থনৈতিক) |
২১০ |
১১। | ২২৩ |
১২। | শিক্ষা বিষয়ক কয়েকটী কথা (শিক্ষা) |
২৪৪ |
১৩। | ২৬১ |
১৪। | ২৭৪ |
১৫। | ২৮৮ |
১৬। | বাঙ্গালা ভাষায় নূতন গবেষণা (বিবিধ) |
৩০৫ |
১৭। | জাতিভেদ ও তাহার প্রায়শ্চিত্ত (সামাজিক) |
৩১৪ |
১৮। | ঘর সামলাও (ঐ) |
৩২৪ |
১৯। | বাঙ্গালায় গো-ধনের অভাব ও বাঙ্গালীর স্বাস্থ্যনাশ (অর্থ নৈতিক) |
৩৪৮ |
২০। | বাঙ্গালী মরণের পথে (অর্থ নৈতিক) |
৩৫৩ |
২১। | চা-পান না বিষপান? (বিবিধ) |
৩৬৬ |
২২। | পল্লীর ব্যথা (বিবিধ) |
৩৭২ |
এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।