আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/৯
৯
সাধনা ও সিদ্ধি
কথারম্ভে মহাত্মা রামমোহন রায়ের পবিত্র নাম গ্রহণ করি,—যাঁর সাধনায় বর্তমান ভারতের সকল প্রচেষ্টার সিদ্ধির বীজ উপ্ত হয়েছিল; যিনি নব্য ভারতের সৃষ্টিকর্ত্তা; অজ্ঞানকুসংস্কারাচ্ছন্ন অমানিশায় যিনি জ্ঞানের বর্ত্তিকা হস্তে জীবনের সকল পথে অগ্রসর হয়েছিলেন; ১০০ বৎসরেরও পূর্ব্বে যিনি জীবনবাঁশীতে জাগরণের সুর তুলে সুপ্ত দেশবাসীকে নূতন পথের পথিক হ’তে আহবান করেছিলেন; ধর্ম্ম, সমাজ ও রাজনীতিক্ষেত্রে যিনি সর্ব্বপ্রথম সংস্কার-চেষ্টা আরম্ভ করেছিলেন; আধুনিক বঙ্গভাষার একজন জন্মদাতা প্রাতঃস্মরণীয় সেই রাজা রামমোহন রায়! রামমোহনের সিদ্ধির মূলে ছিল তাঁর আজীবন সাধনা। সাধনা বিনা সিদ্ধি নাই, এই কথাই আজ আমি বাঙ্গালী যুবককে বড় আশা করে’ বল্তে এসেছি। আজ এই জীবনসন্ধ্যায় জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতার ফলে আমি শিখেছি ওই একটা পরম সত্য-সাধনা বিনা সিদ্ধি নাই।
আজ বাঙালীকে এই পরম সত্যটি গ্রহণ কর্তে হবে—শুধু মুখস্থ করা নয়, শুধু স্বীকার করা নয়, একবারে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে গ্রহণ করে’ প্রতিষ্ঠিত কর্তে হবে। মহামতি গোখলে বলেছেন— What Bengal thinks to day, the whole of India thinks to-morrow—বাঙালীর মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা সারা ভারত গ্রহণ করে। রামমোহনের সময় থেকে মস্তিষ্কচালনার ক্ষেত্রে বাঙালী অগ্রণী বলে’ গণ্য হয়ে এসেছে—বাঙ্লার কোলে অনেক ধর্ম্মসংস্কারক, সমাজসংস্কারক; সুলেখক, বৈজ্ঞানিক, দেশবিশ্রুত বাগ্মী, জন্মগ্রহণ করেছেন—বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র প্রভৃতি এক এক ক্ষেত্রে এক একজন দিক্পাল বাঙ্লার বিজয়বৈজয়ন্তী উড়িয়ে দিয়েছেন। বাঙালী আণ্ডয়ান্ হয়ে চলেছে স্বীকার করি —তবু আজ একবার বাঙালী যুবককে কঠোর আত্মপরীক্ষা ক’রে দেখ্তে হবে, তার চরিত্রের গলদ কোথায়; অন্তরের কোন্ বাধাটা তার চলার পথে পথ আগ্লে দাঁড়িয়েছে।
সক্রেটিস্ বলেছেন, যারা আঠার বৎসর পার হয়েছে, তাদের উপদেশ দিয়ে কোন ফল নেই। তাই আমার বক্তব্য আজ দেশের যুবকবৃন্দের কাছে—যাঁরা আমাদের ভবিষ্যতের আশা—আমাদের হৃদয়ের ধন। এই সম্পর্কে আর এক কথা এই যে “ন ব্রূয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্”, এটা আমার কাছে নিতান্তই বাজে কথা;—আমি বলি “ব্রূয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্” অপ্রিয় সত্য বল্তে হবে- দেশবাসীকে প্রীতি নিবেদন করে’ খুব স্পষ্টভাবেই তাদের ভুল ভ্রান্তি দেখিয়ে দিতে হবে। পত্রাবরণে ভগ্ন স্থান লুকিয়ে রাখ্লে দুর্গ-প্রাচীরও সহজেই ভূমিসাৎ হয়ে যায়। ঢাক্লে অভাব ঘোচে না; অভাবকে সকল সময়েই মোচন কর্তে হয়; —আর তার জন্যে চাই কঠোর আত্মপরীক্ষা, আর তীব্র বেগবতী ইচ্ছাশক্তি।
দুই বৎসর পূর্ব্বে মান্দ্রাজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্সেলর শ্রীযুক্ত শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার তাঁর বক্তৃতায় একস্থলে কতকগুলি মূল্যবান তথ্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন। কথাগুলি এই যে, অনেক কষ্ট স্বীকার ক’রে এবং যথেষ্ট ধৈর্য্যসহকারে তিনি মান্দ্রাজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আঠার হাজার গ্রাজুয়েটের জীবনের ইতিহাস সংগ্রহ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ৩৭০০ জন সর্কারের চাক্রী করেছেন, তারও অধিক ইস্কুল মাষ্টার হয়েছেন, আর ৭৬৫ জন ডাক্তার হয়ে বাহির হয়েছেন। এই তালিকা দৃষ্টে এঁরা ভবিষ্যৎ জীবনে কি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা অতি সহজেই অনুমেয়। মান্দ্রাজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীগণ জীবনের একটানা বাঁধা রাস্তা ছেড়ে জ্ঞানজগতে নব নব পথের সন্ধানে বের হ’ন নি। আর মান্দ্রাজী গ্রাজুয়েট সম্বন্ধে যা সত্য, বাঙালী গ্রাজুয়েট সম্বন্ধে সেই কথাই সর্ব্বোতোভাবে প্রযুজ্য। বাঙ্গলা দেশেও ঐ— একই দশা-কেরাণী, মাষ্টার, ডাক্তার আর উকীল। আর সেই গলাধঃকরণ, উদ্গিরণ, পরীক্ষাপাশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ, তারপর মা সরস্বতীর সঙ্গে সেলাম্ আলেকম্। মুন্সেফ, ডেপুটী, জজ,—তা মান্দ্রাজী গ্রাজুয়েট বাঙালীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হ’টে গিয়েছেন, কিন্তু সবাই বাঁধা ওই চাকরীর ঘানীতে আর সবার অন্তরের কথা হচ্ছে— “মা আমায় ঘুরাবি কত—কলুর চোখ-ঢাকা বলদের মত।”
আবার এই গ্রাজুয়েট উৎপন্ন কর্বার শক্তি মান্দ্রাজের চেয়ে কল্কাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরই বেশী। এই ব্যাপারে কল্কাতা সবার অগ্রণী—কিন্তু হেসো না, এ-সব ঘরের কথা বাইরে না যায়। অসহযোগ, সহযোগ স্বীকার করি না; এবার ২০,০০০ ছেলে ম্যাটিকুলেশন পরীক্ষা দেবে আর শতকরা অন্ততঃ ৮০ জন পাশ হবে। কিন্তু একজন উপাধিধারী কি প্রকার কুপমণ্ডুক তা চিন্তা কর্লে মন বিষাদিত হয়। বর্ত্তমান প্রথানুসারে একজন এম-এসসি কিম্বা এম-এর ভূগোলের কোন জ্ঞান না থাক্লেও চলতে পারে। ইতিহাস পাঠও ইচ্ছাধীন। আব্রাহাম লিঙ্কল্ন্, ফ্রাঙ্ক্লিন প্রভৃতির নাম শোনেন নি এমন গ্রাজুয়েটও অনেক আছেন। ভূগোল চাই না, ইতিহাস চাই না, দেশের কথা চাই না, পৃথিবীর কথা চাই না,—শুধু পাশ করে যাও—ম্যাটিক, আই-এ, বি-এ, ফার্ষ্ট ক্লাস সরেস এম্-এ। উচ্চশিক্ষিত যুবক হয়ত ম্যাট্সিনীর নাম শুনেছেন— গ্যারীবাল্ডিকেও হয়ত মস্ত একটা বীর ব’লে জানেন কিন্তু কাবুলের কথা জিজ্ঞাসা কর্লেই মাথা চুলকাতে আরম্ভ করবেন। যদি প্রশ্ন করি আমেরিকায় অন্তর্বিবাদ (Civil War) কেন হ’ল—এ বিপ্লবে, কে কে রথী ছিলেন—লিঙ্কল্ন্, জ্যাক্স্ন কে, কোন্ পক্ষ জয়ী হ’ল? বিরোধের ফলাফলে দেশের লাভ লোক্সান কি হ’ল? তাহলেই ফিলসফির ফার্ষ্ট ক্লাস এম্ এ একেবারে অবাক্ হ’য়ে হাঁ ক’রে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন —এ-সব আবার কি? প্রফেসারের কোনো নোটে ত এ-সব লাল নীল সবুজ পেন্সিলে দাগ দিয়ে কস্মিন্ কালে পাঠ করি নি।
চতুর্থবার বিলাত গিয়ে গতবৎসর এই সময় আমি দেশে ফিরে আসি। সেখানে লণ্ডন, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, বার্মিংহাম্, লীড্স, এডিন্বরা প্রভৃতি স্থানের বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছি। অনেকস্থলে এক একটা কলেজ এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়। নানা বিদ্যানুশীলনের জন্য বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে আর প্রত্যেক বিভাগেই পাঁচ ছয় জন ছাত্র সেই বিশেষ বিদ্যা সম্বন্ধে মৌলিক গবেষণা করছেন। আর পর পর এমন বড় লোক ঐসকল বিদ্যামন্দির থেকে বাহির হয়ে আস্ছেন, যা ভাব্লে আশ্চর্য্য হয়ে যেতে হয়। এঁদের অনেকে একটা বিশেষ বিষয়ের গবেষণার নেশায় ভরপূর হয়ে সারা জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। শ্রেষ্ঠ মনীষীগণ একের শূন্যস্থান অপরে পূরণ কর্ছেন। আর এই-সকল বিষয়ের বৈচিত্র্যই বা কি!, একখানা “নেচার” তুলে নিয়ে চোখ বুজে তার যে-কোন স্থান খুলে যুরোপে অনুশীলিত কত রকম বিদ্যার কত রকম রোজনাম্চা যে দেখ্তে পাওয়া যায়; সেখানে কতশত অনুসন্ধান-সমিতি, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, রাষ্ট্রনৈতিক, পুরাতত্ত্ব প্রভৃতিতে মানবের জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ত পরিপুষ্ট কর্ছে। এই ইউরোপের সব দেশে স্বাধীন চিন্তার স্রোত নিয়ত মানবের জীবনকে কত উচ্চতর স্তরে নিয়ে যাচ্ছে, যে তার আর শেষ নেই। কত শত বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে কত শত প্রচেষ্টা, কত অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান, কত একনিষ্ঠ জ্ঞানসাধকের ঐকান্তিক চেষ্টা ঐ-সব দেশে বিদ্যার্থীগণের তথা জনসাধারণের চিত্তবৃত্তিকে সদা জাগ্রত করে’ রেখে দিয়েছে। ৩০০০ বৎসর পূর্ব্বে মিশর, আসীরিয়া, বাবিলন প্রভৃতি দেশে লোকে কিরূপ জীবনযাপন করেছিল সেই-সকল প্রত্নতত্বের বিচারের ফলে যুরোপীয় সুধীবৃন্দ জ্ঞান-রাজ্যের এক একটা নূতন দিক উন্মুক্ত করে দিয়েছেন যার নাম হয়েছে—ইজিপ্টলজি, আসিরিওলজি ইত্যাদি। লেয়ার্ড, রলিন্সন, পেত্রি (Layard, Rawlinson, Petrie) প্রভৃতি এই-সকল বিদ্যার হোতা।
তারপর প্রাচ্যের প্রান্তে এসে দেখা যাক্। জাপানে তোকিও, কোবে, কিয়োতো, প্রভৃতি বিখ্যাত নগরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সৌষ্ঠবে ও জ্ঞানানুশীলনে সর্ব্বাংশে য়ুরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেবার বিলাতগামী জাহাজে আমার সঙ্গে প্রায় দুই শত ভারতবাসী ছাত্র ইউরোপে চলেছিলেন। এদের মধ্যে দুই এক জন ছাড়া সবাই কেমন করে’ ফাঁকি দিয়ে একটি বিলাতী সস্তা ডিগ্রি এনে দেশী ডিগ্রির উপর টেক্কা দিবেন সমস্ত সময় সেই চিন্তা ও পরামর্শ কর্ছিলেন। আমাদের দেশের যে-সব ছাত্র ম্যাটিক-বা আই-এ, আই-এসসি প্রভৃতি পাশ করে’ বিলাত চলে’ যান, দেখ্তে পাওয়া যায় জ্ঞানান্বেষণ তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। তাঁদের চিন্তা, কি করে’ শীঘ্র একটা বিলাতী ডিগ্রী নিয়ে এসে দেশবাসীর চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দেবেন। জাপানী ছাত্র আপন দেশে কোন একটি বিষয়ে যথেষ্ট পারদর্শিতা লাভ কর্বার পর যুরোপ যান এবং সেখানে সেই বিশেষ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ মহামহোপাধ্যায়ের নিকট অবস্থান করে’ সেই বিষয়টিই শিক্ষা করেন। আর আমাদের ছাত্রগণ অনেকস্থলে ভিটে মাটী বেচে, কেউ বা বড়লোকের জামাতা হবার লোভে ডিগ্রী লাভের আশায় মুগ্ধ হ’য়ে বিলাত যান। অবশ্য সব ক্ষেত্রেই যে এরূপ ঘটে তা বল্ছি না। এর ব্যতিক্রম আছে নিশ্চয়ই। আমাদের ছাত্র জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ ও মেঘনাদ সাহা বিদেশে একবার জাপানী ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনারা কি লণ্ডনের ডিগ্রী নিতে এসেছেন?” তাঁরা জাতীয় গর্ব্বে অনুপ্রাণিত হয়ে বলেন, তাঁরা নিজেদের দেশের ডিগ্রীকে কোন প্রকারে হীন জ্ঞান করেন না। আমাদের দেশেরও উক্ত শ্রীমান্দ্বয় বিলাতি ডিগ্রীর মোহে স্বাদেশিকতাকে খর্ব্ব করেন নি, এ পরম গৌরবের কথা। বাস্তবিক ঐ-সব জাপানী ছাত্র এসেছেন স্যার জোসেফ টম্সন, রাদারফোর্ড প্রভৃতি বিজ্ঞানবিশারদদের নিকট থেকে জ্ঞান অর্জ্জন করবার জন্য, ডিগ্রীলাভের জন্য নয়।
কিন্তু আমাদের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হ’তে সেই ১৮৫৭ সাল থেকে আজ পর্য্যন্ত যে হাজার হাজার গ্রাজুয়েট উৎপন্ন হয়েছে তাদের মধ্যে ক’জন পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে নিজের কিছু দিতে পেরেছে যা একেবারে মৌলিক ও নূতন, যাতে মানবের জ্ঞান পুষ্টিলাভ ক’রে বৃদ্ধি পেয়েছে। কেহই যে কিছু দেন নি এমন কথা বল্ছি না। ব্যতিক্রম ত আছেই। কিন্তু তাঁদের আজীবন সাধনার ভিতরের কথা কে বুঝ্বার চেষ্টা করে-কে তাঁদের অহেতুকী জ্ঞানতৃষ্ণার যথার্থ সন্মান কর্তে পারে? এখানে যে সব ছাত্রই ডিগ্রী চাচ্ছেন আর চাকরী কর্ছেন! কোন বিষয়ে কৃতিত্ব ত কেউ দেখাতে পার্লেন না। অধ্যাপক যদুনাথ সরকার দেশের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক। আপন রোজ্গারের প্রধান অংশ পুরাতন পার্সী পুঁথি ক্রয় কর্তে ব্যয় করেছেন, পাটনা খোদাবক্স্ লাইব্রেরীতে বৎসরের পর বৎসর ধ’রে নিবিষ্টভাবে অধ্যয়ন করেছেন। তাই মোগলযুগের ইতিহাস সম্বন্ধে তিনি আজ Authority বা প্রামাণ্য পণ্ডিত। তাঁর উপর আর কেউ কথা বল্তে পারেন না, এদেশেও নয়, যুরোপেও নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীই এর পাণ্ডিত্যের কারণ নয়—এই কৃতিত্বের পশ্চাতে রয়েছে তাঁর জীবনের সাধনা।
কি কুক্ষণেই শিক্ষিত বাঙালীর চাকরীর দিকে ঝোঁক পড়েছিল। সেই পুরাতন হিন্দুকলেজের ছাত্র হ’তে আরম্ভ ক’রে সকলেই আজ চাকরীর উমেদার। হিন্দু কলেজের ছেলেরা যার মাইকেল-রাজনারায়ণের সমপাঠী—তাঁরা গ্রাজুয়েট হ’লেই প্রথম লর্ড হার্ডিঞ্জের গবর্ণমেণ্ট তাঁদের ডেকে বড় বড় চাক্রী দিতেন। এই সময় থেকে মতিগতি যে চাকরীর দিকে গেল সে আর ফির্লো না। বাঙ্লার ধনে ইংরেজ-মাড়োয়ারীর সিন্ধুক বোঝাই হ’ল, আর বাঙ্লার গোপালেরা শান্ত শিষ্টভাবে ডিগ্রীলাভের সাধনা কর্তে লাগ্লেন। সাধনা—ডিগ্রী, তাই সিদ্ধি-চাকরী!
এইরূপে আদর্শ খাটো হয়ে গেল। তাই গভীর জ্ঞানসাধনা দেশে প্রতিষ্ঠিত হ’ল না। ভাসা-ভাসা জ্ঞানেই বাঙালী যুবক সন্তুষ্ট থাক্তে শিখ্লেন। মল্লিনাথ, বল্লভ, তারাকুমার, সারদারঞ্জন—এইসব টীকার সাহায্যে এক সর্গ ভট্টি, বা রঘুবংশ প’ড়েই সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত হলেন, কেউ বা আধ সর্গ প্যারাডাইস-লষ্টের নোট মুখস্থ করে’ ইংরেজি সাহিত্য দখল করে’ বস্লেন। কিন্তু লাইব্রেরী থেকে একখানা বাহিরের বই নিয়ে কেউ পড়ে’ দেখ্লেন না—যেহেতু সে পাশ করার কাজেই লাগে না। এখন বিশ্ববিদ্যালয় হতে ভূগোল এক প্রকার নির্ব্বাসিত হয়েছে; ইতিহাসও না পড়্লে চলে। বাস্তবিক কি লজ্জা, কি পরিতাপের কথা যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ এম্-এ, এম.এস্সি গণ অশিক্ষিত, অর্দ্ধশিক্ষিত অথবা কুশিক্ষিত। ক্যালেণ্ডারে পাঠ্যপুস্তকের তালিকা অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, হার্ভার্ডকেও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু সারা দুবছর ফুটবল ক্রীকেট খেলেছে ও দেখেছে বলে’ আমার এক বন্ধু যখন আপন পুত্রের এম-এ পাশ করা সম্বন্ধে হতাশ হয়ে পড়্লেন, তখন চতুর পুত্র কয়েক দিনের মধ্যে মেস থেকে মেসান্তর ঘুরে নোট জোগাড় কর্লে এবং পরীক্ষকের মন জুগিয়ে চলে’ অবহেলে পাশ করে ফেলে বাপকে একেবারে তাক্ লাগিয়ে দিলে!
তাই বলি সর্ব্বনাশ হয়েছে এই ভাসা-ভাসা জ্ঞানে, আর অতি সস্তা পাশে। ফিস্ক্যাল-কমিশনে স্যার ইব্রাহিম রহিমতুল্লা, ঘনশ্যামদাস বির্লা প্রভৃতি বস্বেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেণ্ডারে এঁদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু ক্যালেণ্ডারে যাঁদের নাম জ্ব্লজ্ব্ল কর্ছে সেই (Cobden Medalist) স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত বাঙালী যুবক ত ঐ অতি প্রয়োজনীয় ব্যাপারের আলোচনায় আহূত হলেন না। স্যার বিঠল্দাস ঠাকর্সে বড় বড় কলের মালিক-পরন্তু “গোল্ড মেডেলিষ্ট” নন। টাকা নিয়ে হাতে-কলমে কাজ করেন বলে’ মহামতি গোখ্লে বজেট-বক্তৃতা প্রস্তুতের কালে তাঁর পরামর্শ বহুমূল্য জ্ঞানে গ্রহণ কর্তেন। ভারতবর্ষে রেলওয়ে-কার্বার-সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপারে যাঁর মতামত বহুমূল্য বলে’ বিবেচিত হয় তিনি হচ্ছেন ডিগ্রীহীন সাতকড়ি ঘোষ। চিন্তামণি, কালীনাথ রায় প্রমুখ সংবাদপত্রসম্পাদকগণ অনেকেই ডিগ্রীশূন্য; কিন্তু এঁরা সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে যে-সব মূল্যবান কথা লেখেন, বড় বড় ডিগ্রীধারীগণ তা থেকে যথেষ্ট শিক্ষালাভ কর্তে পারেন।
আমরা নিজেদের আধ্যাত্মিক জাতি বলে’ গর্ব্ব করে থাকি আর যুরোপীয়দের জড়বাদী ব’লে গালি দিই। কিন্তু জড়বাদী ওরাই আমাদের দেশের স্থানে স্থানে নানা কুষ্ঠালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থাপন করে। ভারতবর্ষে ৭২টি কুষ্ঠালয় আছে, তন্মধ্যে দেওঘরে যোগীন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক স্থাপিত একটি ছাড়া আর সবই তো ওদের। ফাদার ডামিয়েন তাঁর জীবনই তো কুষ্ঠীর সেবায় তিলে তিলে বিলিয়ে দিলেন! আর্ত্তকে কেউ কোলে তুলে নিচ্ছে আবার কেউ বা বল্ছে—ওকে ছুঁয়ো না। বাস্তবিক কি বৈচিত্র্য ওদের জীবনে! জান্বার, বুঝ্বার, পাবার কি দুর্ণিবার চেষ্টা! কেউ হিমালয়ের উত্তঙ্গ শিখরে আরোহণ কর্বার জন্যে বৎসরের পর বৎসর চেষ্টা কর্ছেন, তার আয়োজনই বা কত; কেউ বা আফ্রিকা মহাদেশের কিলিমেন্জেরো পর্ব্বতের চিরতুহিনাচ্ছন্নচূড়ায় কোন চিরনূতনকে দেখবার প্রয়াস করছেন। সু-উচ্চ গিরিদেশে শ্বাসরোধ হয়ে কেউ বা প্রাণ হারিয়েছে—তবু দৃকৃপাত নেই। মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পাতন। মেরুসন্নিহিত প্রদেশের প্রাকৃতিক অবস্থা জানবার জন্য ফ্রাঙ্ক্লিন, ন্যান্সেন, শ্যাক্ল্টন প্রমুখ অনুসন্ধিৎসু কত অসাধ্য না সাধন করেছেন। মানুষের যা সাধ্য তা এরা কর্বে, আবার মানুষের যা অসাধ্য তাও এরা কর্বে। কি বিপুল দুর্দ্ধান্ত জীবন! উদ্ভিদতত্ত্ববিৎ ইংরেজ হুকার বিচিত্র লতাগুল্মের সন্ধানে সিকিম প্রদেশে গিয়ে সেখানে বন্দী হলেন। তাই নিয়ে যুদ্ধই বেধে গেল। যুদ্ধজয়ের পর তিনি মুক্ত হলেন। তাঁর Flora Indica বর্ণিত সংগ্রহ বিলাতে কিউ গার্ডেনে (Kew Garden) কত যত্নে রক্ষিত হয়েছে। আবার পশুতত্ত্ববিৎ যুরোপীয়ান্ সিংহ বন্য হস্তি প্রভৃতি শ্বাপদসঙ্কুল আফ্রিকার জঙ্গলে খাঁচার মধ্যে বাস করে’ মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছেন—উদ্দেশ্য গরিলা সিম্পাঞ্জী প্রভৃতি বনমানুষের অভ্যাস ও আচরণ জানবেন; তাদের ত ভাষা নেই, তাই সঙ্কেতে তাদের ভাববিনিময় লক্ষ্য কর্বেন। এমনি অসাধারণ অধ্যবসায় সহকারেই তাঁরা সত্যের আবিষ্কার করেন।
জ্যোতির্ব্বিদ্যায় টাইকো ব্রেহী, কেপ্লার, গ্যালিলিও, নিউটন, হার্শেলের সম্পর্ক কত নিবিড়, কত গভীর! এত গভীরতা শোণিতসম্পর্কে কোথায় পাবে! গ্যালিলিও কেপ্লার সমসাময়িক ছিলেন। কেপ্লারের অভাবে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের নিয়মাবলীর আবিষ্কারের পথ সুগম হত না। কত বিনিদ্র রজনীতে উদার উন্মুক্ত অসীম আকাশের দিকে কি আনন্দে কি আশায় এঁরা চেয়ে থাক্তেন! কি অমূল্য রত্ন এঁরা পৃথিবীর জ্ঞান-ভাণ্ডারে দিয়ে গেছেন। এঁদের জ্ঞান-সাধনার মূলে গভীর অভিনিবেশ! একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে এঁরা সাধ্য বস্তুর সন্ধান করেছিলেন, তাই সিদ্ধিলাভ ঘটেছিল। জ্ঞানান্বেষণে নিউটন এমনই তন্ময় হয়ে যেতেন যে আপন আহারের কথাই বিস্মৃত হতেন। একদিন নিউটন গভীর চিন্তায় মগ্ন। ভৃত্য আহার্য্যদ্রব্য সম্মুখে রেখে গেল। তাঁর বন্ধু কৌতুক ক’রে সেইগুলি খেয়ে নিয়ে হাড়গুলি ঢাকা দিয়ে রাখ্লেন। ধ্যানভঙ্গের পর আহার কর্তে গিয়ে নিউটন দেখ্লেন হাড়গুলি প’ড়ে আছে। অতএব পণ্ডিতবর সিদ্ধান্ত কর্লেন তাঁর আহার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অত মনে নেই; তাই পাছে কেউ ঠাট্টা করে এই আশঙ্কায় চারিদিক চেয়ে সেখান থেকে চ’লে গেলেন। কি আপন ভোলা ভাব! এরূপ তন্ময়ত্বের আরও কয়েকটি নিদর্শন দেখাই। রেনেসাঁস যুগে প্যারিস নগরে হোমারভক্ত প্রোটেষ্টাণ্ট স্কালিগার আপন ঘরে পাঠে নিমগ্ন; এদিকে বাহিরে হত্যাকাণ্ড হয়ে গেল Massacre of St. Bertholomew); কত প্রোটেষ্টাণ্টকে খুন করা হ’ল, কিন্তু তিনি এমনই তন্ময় যে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপার তার পরদিন জান্লেন। এথেন্সের সৈন্যদলভুক্ত হয়ে জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ সক্রেটিস একটানা ২৪ ঘণ্টা নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতেন, তবেই ত দুরূহ তত্ত্বসমূহের মীমাংসা পেতেন। গ্রীকদর্শনের তিনি শ্রেষ্ঠ গুরু। প্লেতো তাঁর শিষ্য। ভাষাতত্ত্ববিদ্ বুদিয়স্এর বিবাহদিনে গির্জায় কনে এসেছেন, অন্যান্য বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রীও উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু বর কোথায়? বরকে ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন বরের পাঠগৃহে গিয়ে দেখা গেল তিনি ভাষাতত্বের আলোচনায় মগ্ন আছেন। যাঁর বিয়ে তাঁর মনে নেই। রোমান্ সৈন্য যখন আর্কিমিডিসকে খুন কর্তে এসেছে তখন আর্কিমিডিস বল্লেন— দাঁড়াও একটু, এ বৃত্তটা নষ্ট ক’রে দিও না, এ প্রমাণটা শেষ করি। বর্ব্বর সৈনিক তাঁকে খুন ক’রে জগতের মহৎ সত্য উদ্ঘাটনের পথ হয়ত রুদ্ধ ক’রে দিয়ে গেল। এমনই ক’রে আপনহারা হয়ে সাধনা না কর্লে কি কেউ কখনও কোন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছে?
এই নিঃস্বার্থ সাধনায় সকলেই মুগ্ধ হয়েছে। যেখানে স্বার্থপরতা সেখানেই সঙ্কোচ—স্বার্থপর ক্রোড়পতির কেউ সংবাদ লয় না। কিন্তু তাঁর অর্থ যখন ‘জনহিতায়’ ব্যয় হয়, তখন তিনি হন শ্রেষ্ঠ ও মান্য। জ্ঞানসাধকের সাধনলব্ধ যা-কিছু তা পৃথিবীর সকলেরই সম্পত্তি। তাই তাঁরা সকলেরই বড় আপনার জন। কিন্তু আমরা নষ্ট হয়েছি সাধনার অভাবে, সঙ্কুচিত হয়েছি স্বার্থপরতার প্রভাবে। তাই বিদ্যাক্ষেত্রে, ব্যবসাক্ষেত্রে সব ক্ষেত্রেই আমরা হ’টে গিয়ে পিছনে প’ড়ে গেছি। সর্ব্বনাশকারী পল্লবগ্রাহিতা আমাদের নষ্ট করেছে। ৺প্রতাপ মজুমদার বল্তেন “জাপানীরা অপেক্ষাকৃত হাঁদা, বাঙালী অতি বুদ্ধিমান।” সেইজন্যই বাঙালী আজ দুর্দ্দশাগ্রস্ত। আত্মঘাতী উদ্যমহীনতা আমাদিগকে স্বল্পায়াসে কৃতকার্য্যতা লাভ কর্তে চেষ্টিত করে। তাই আজ সব ক্ষেত্রেই চাই সাধনা। অন্নসমস্যা, বস্ত্রসমস্যা, অর্থসমস্যা, স্বাস্থ্যসমস্যা প্রভৃতি নানাসমস্যায় প’ড়ে আমরা সব রকমে মাটি হয়ে যেতে বসেছি। এখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সহকারে লেগে প’ড়ে থেকে এক একটি সমস্যার মীমাংসা কর্তে না পারলে আমাদের আর বাঁচ্বার আশা নেই।
আর একটা কথা। আমাদের সর্ব্বদা স্মরণ রাখ্তে হবে চেষ্টামাত্রেই অথবা কিছুদিনের চেষ্টাতেই যে এই সকল কঠিন সমস্যার মীমাংসা হ’য়ে যাবে তা কখনই নয়। সুতরাং কাজ আরম্ভ ক’রেই ফলের আকাঙ্ক্ষ কর্লে চল্বে না। মনে রাখ্তে হবে, প্রয়াসসাধ্য সকল কার্য্যেই করার আনন্দটাই মুখ্য, পাওয়ার আনন্দ নয়; মৃগয়ায় যেমন অন্বেষণেই আমোদ, তেমনি প্রকৃতির গূঢ়রহস্য যাঁরা উদ্ঘাটন করেন তাদের সেই চেষ্টাতেই অপার আনন্দ। আজ আমাদের তাই এই প্রচেষ্টার আনন্দের আস্বাদ গ্রন্থণ কর্তে হবে। জর্ম্মান দার্শনিক লেসিং সম্বন্ধে একটা কথা আছে যে যদি ঈশ্বর এসে তাঁকে বল্তেন—তুমি সত্য চাও না সত্যের সন্ধান চাও, তবে তিনি জবাব দিতেন—আমি সত্যের সন্ধান চাই, কিসে পাব, কেমন করে পাব, এই সে দেখা দেবে, পরক্ষণে আড়ালে লুকোবে; এই খোঁজের খেলার বিপুল আনন্দে আমি ভরপুর হ’য়ে থাক্তে চাই। এই ত প্রাণবন্তের লক্ষণ; বাস্তবিক আনন্দ প্রাপ্তিতে নয়, অন্বেষণে আর এই অন্বেষণ বা সাধনা একই কথা।
ধর্ম্মজগতে বুদ্ধ, যীশু, মোহম্মদ, চৈতন্য এঁদের সিদ্ধিলাভের ইতিবৃত্ত একই। জনকোলাহলের বাহিরে পর্ব্বতে জঙ্গলে, গুহার মধ্যে জীবনের কিয়দংশ সাধনা ক’রে এঁরা ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। অরণ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ গ্রথিত হয়েছে। আবার বুদ্ধদেবেরও অপর নাম এইজন্য “সিদ্ধার্থ”; আমরা অতীতের গর্ব্ব করে’ থাকি, কিন্তু অতীতের প্রাণের লক্ষণগুলিকে আপন জীবনে ফুটিয়ে তুল্তে চাই না;—অতীতের সিদ্ধির উপর আমাদের লোভটুকু ষোল আনা আছে, কিন্তু তার জীবনব্যাপী কঠোর সাধনার কথা শুনেই আমরা আতঙ্কে মরে’ যাই। রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভা আজ শতদলপদ্মের মত বিকশিত হয়েছে। কিন্তু একটির পর একটি করে’ এই শতদল ফুটেছে,—এর পিছনে আছে একনিষ্ঠ সাধনা। গোখলে ইস্কুলমাষ্টার ছিলেন, শ্রীনিবাস শাস্ত্রীও ছিলেন। পরাঞ্জপেও তাই। ৭৫৲ টাকা মাহিনায় গোখলে ফার্গুসন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু গোখলে আজ দেশপূজ্য, তার কারণ তিনি দেশসেবার সাধনা করেছিলেন। এই দারিদ্র্যব্রতধারীর বজেট-বক্তৃতায় ব্যবস্থাপক সভায় লাট কর্জ্জন কাঁপ্তেন। আর এক প্রাতঃস্মরণীয়ের কথা বলে আমার কথা শেষ করি;—তিনিও দারিদ্র্যব্রতধারী, মহাসাধক মহাত্মা গন্ধী। গন্ধী আজ বিশ্ববিশ্রুত। কিন্তু একদিনেই কি তাঁর নাম সারা বিশ্বের বিস্ময় উৎপাদন করেছে? ২১ বৎসর পূর্ব্বে আলবার্ট হলে দক্ষিণআফ্রিকা-প্রবাসী ভারতবাসীদের দুর্দ্দশা দেশবাসীর নিকট বিবৃত কর্তে আমিই প্রথম তাঁকে আহবান করি। স্বর্গগত নরেন্দ্রনাথ সেন সেই সভায় সভাপতি ছিলেন। মহাত্মা গন্ধীর বক্তৃতার বিষয় ছিল—কেপ কলোনিতে (Cape Colony) ভারতবাসীর অশেষ দুর্দ্দশার কথা। মহাত্মা তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতবাসীদের নেতা। তিনি দেশবাসীর হিতের জন্য আপনাকে একবারে নিঃশেষ করে’ উৎসর্গ করে’ দিয়ে ছিলেন। নেটাল প্রদেশে তিনি তাদের সঙ্গে তুল্য-ভাবে নিগৃহীত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন। মাসে ৫/৬ হাজার টাকা আয়ের ব্যারিষ্টারী তিনি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে সবার ব্যথাকে বুক পেতে দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। কতবার জেলে গেছেন, কত কষ্ট সহ্য করেছেন, মেথরের কাজ পর্য্যন্ত করেছেন। তাই ত তিনি আজ জনসাধারণের হৃদয় মন অধিকার কর্তে পেরেছেন। আজ অন্তঃত ২৭/২৮ বৎসর যাবৎ তিনি নিগৃহীত ভারতবাসীর নেতা—যেখানে অত্যাচার উৎপীড়ন, সেইখানেই মহাত্মা গান্ধী; তাই আজ তাঁর নামে দলিত জনসঙ্ঘের প্রাণ আনন্দে নেচে ওঠে-আশায় উৎফুল্ল হয়। এই অনন্যপ্রতিদ্বন্দ্বী-প্রভাবের পশ্চাতে রয়েছে মহাত্মাজীর আজীবন সাধনা |
রামমোহন রায়কে বাঙালীর ঘরে পাঠানো বিধাতার একটি বিশেষ বিধান বলে আমার মনে হয়। আমার স্থির বিশ্বাস, বাঙালীর দ্বারাই ভারতের সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনের পথ উন্মুক্ত হবে। কিন্তু এই গৌরবের পদ অধিকার কর্তে হলে বাঙালীর জীবনে আজ চাই সাধনা —তিল তিল করে’ আত্মদান। বাঙ্গালী আজ স্থিরপ্রতিষ্ঠ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ব্যক্তিগত সুখের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের কাজে লেগে পড়ে থাক্লে ভারতের নিদারুণ দুর্দ্দশা ঘুচ্বেই। আজ বিধাতার ইঙ্গিত—বাঙালীর সাধনা ভারতের সিদ্ধি আনয়ন কর্বে।