আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/৮

মিথ্যার সহিত আপোষ

ও শান্তি ক্রয়

 ইংরাজী ১৮৮৯ সালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে আমি একটী বক্তৃতা দিয়াছিলাম। তাহার সার কথা এই ছিল যে, আমরা বাঙ্গালী—আমাদের জীবনকে প্রধানতঃ দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে; (১) পোষাকী জীবন ও (২) আটপৌরে জীবন। যখন আমরা টাউন হলে ও বড় বড় সভায় বজ্রগম্ভীর স্বরে বক্তৃতা করি, বলি— সমাজ-সংস্কার করিব, অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করিব, বাল্য-বিবাহ বন্ধ করিব, বিধবা-বিবাহ প্রচার করিব তখন আমরা ‘পোষাকী’ জীবনের পরিচয় দিই; বাড়ীর ভিতর প্রবেশের সময় পোষাক ছাড়িয়া আসি— কথায় ও কার্য্যে বিপরীত আচরণ করি; ‘আটপৌরে’ জীবনের মধ্যে পড়িয়া ‘পোষাকী’ জীবনের কথা ভুলিয়া যাই।

 এই বক্তৃতার পর এক শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশেরও বেশী সময় অতিবাহিত হইয়াছে। দেখা যাউক, এই ৩৫/৩৬ বৎসরের মধ্যে আমরা কোন্ বিষয়ে কতদূর সংস্কার সাধন বা উন্নতি লাভ করিতে পারিয়াছি। যাঁহারা শিবনাথ শাস্ত্রী প্রণীত রামতনু লাহিড়ীর জীবন-বৃত্তান্ত, রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত, যোগীন্দ্র বসু কৃত মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত প্রভৃতি পড়িয়াছেন তাঁহারা জানেন হিন্দু কলেজের বাল্যাবস্থায়, ডি রোজীও প্রভৃতি অধ্যাপকগণের সংস্পর্শে আসিয়া ও তাঁহার শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হইয়া তখনকার ছাত্রগণ কি রকম মত্ত হইয়াছিল। পরলোকগত রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি তখন হিন্দু সমাজের ভিতর বসিয়া, শুধু গোমাংস ভক্ষণ করাই যে সভ্যতার চরম ও তাহাতেই আত্মার মুক্তি ও তৃপ্তি হয় এই ধারণা পোষণ ও প্রচার করিতেন তাহা নহে, তখনকার দিনে প্রকাশ্যে মদ খাওয়াও চলিত। সমাজের সর্ব্বত্রই একটা উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খলতার ভাব দেখা গিয়াছিল। পিতৃদেবের কাছে শুনিয়াছি স্বর্গীয় রাজনারায়ণ বসু মহাশয় যৌবনকালে মদকে উপাদেয় পানীয় বলিয়া মনে করিতেন; কিন্তু প্রবীণ বয়সে তাঁহার ঐ ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়—এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সার গ্রহণ করিয়া স্থূলতঃ তিনি নবজীবন লাভ করেন। শেষ বয়সে তিনি হিন্দুধর্ম্মের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। সেই সব বক্তৃতা ছাপার অক্ষরে যখন ঘরে ঘরে ছড়াইয়া পড়িল, তখন অনেকে ভাবিলেন হিন্দুসমাজ অনেকখানি এগিয়ে গেল, এইবার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সার গ্রহণ করিয়া, রামমোহন রায়ের প্রদর্শিত পথে, দেশের ও সমাজের ভাবী উন্নতির বনিয়াদ স্থাপন করিতে হইবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে আশা ফলবতী হইল না। তাহার কারণ কি? কারণ এই দেখা গিয়াছে অসত্য ও ভ্রান্ত ধারণার সহিত আপোষ করিতে করিতে আমরা এক পাও অগ্রসর হইতে পারি নাই। সমাজে বাস করিতে হইলে আপোষ দরকার—আপোষ না হইলে চলে না। যদি গাড়ীর সামনে একটা ঘোড়া যুড়ে দেওয়া যায়—এবং গাড়ীর পিছনে আর একটা সমান বলশালী ঘোড়া জুড়ে দেওয়া যায় ও তাহাদের তাড়না করা যায়, তাহা হইলে দেখা যায় গাড়ী চলে না। যাহারা mechanics পড়েছেন তাঁহারা এই কথাটা সহজেই বুঝিতে পরিবেন। আমাদের জীবনকে সত্য একদিকে টানে, মিথ্যা অপর দিকে টানে। কাজেই আপোষ দরকার-কিন্তু তাহার সীমা আছে। মিথ্যার সহিত বনিবনাও রাখিতে গিয়া আমরা সব হারিয়ে ফেলেছি। একটা মামুলী গল্প আছে—প্রাচীন কালে এক রাজা এক দীঘি খনন করাইরা তাহা উংসর্গ করাইবার জন্য কুলপুরোহিতকে ডাকিলেন। পুরোহিত বলিলেন, দুধ দিয়ে দীঘি পূর্ণ কর্ত্তে হবে—তারপর উৎসর্গ। রাজা ঢেড়া দিলেন, প্রত্যেক প্রজাকে এক ঘটী দুধ দিতে হবে, পুকুর ভর্ত্তি করিবার জন্য। প্রজারা সকলেই চালাক-প্রত্যেকে ভাবিল, সকলেই দুধ দিবে (অবশ্য তখন দুধ টাকায় ২॥ সের হয় নাই) আমি যদি রাত্রে এক ঘটী জল দিয়ে আসি, কে বুঝবে! পরদিন সকালে দেখা গেল দুধের পরিবর্ত্তে জলে পুকুর বোঝাই—সকলে জল দিয়াছে! আমরা বাঙ্গালী, উল্লিখিত প্রজাদের মতই উর্ব্বর মস্তিষ্কসম্পন্ন—প্রত্যেকেই ভাবি আমি যদি একটু ফাঁকি দিই তাহাতে জাতির কি আসে যায়। কিন্তু প্রত্যেকেই যদি এই প্রকার মনোবৃত্তির পোষকতা করেন তবে জাতির দশা কি হয় তাহা সহজেই অনুমেয়।

 জুন মাসের “কলিকাতা রিভিউ” পত্রে, আশুতোষ কলেজের একজন অধ্যাপক “নব্য বাংলা” শীর্ষক একটী সারগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন— ভূমিকায় দু’ একটা কথা উদ্ধৃত করেছেন তাহা আমার কাছে খুব সুন্দর বলে মনে হয়েছে; তাহা হইতে কয়েক ছত্র মাত্র পাঠ করিতেছি।

 “He eats beef, cracks whole bottle of cognac at Spencer's or Wilson’s but as soon as he makes his appearance in native Society, he is as it were metamorphosed into a new being. He is then a pattern to the most thorough-göing Hindu.”

 ইহা ১৮৫২ সালের কথা। তারপর প্রায় ৭২ বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে। এই সময়ের মধ্যে দেশের অবস্থার অনেক পরিবর্ত্তন হয়েছে। এখন বাঙ্গালীর মধ্যে ‘স্বদেশী’ ভাব প্রবল হইয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই দেখি রেস্তোরাঁর সংখ্যাও অসম্ভব রকম বাড়িয়াছে। আজ কাল কলিকাতার অলিতে গলিতে উইলসন হোটেলের ক্ষুদ্রকায় ও সাধারণ সংস্করণ। বাপ মা কত কষ্ট করে ছেলেকে টাকা পাঠায় তাদের শিক্ষার জন্য-আর তাহারা ইহার অধিকাংশ খরচ করে চপ কট্‌লেটে ও বায়স্কোপে। আমি অবাক হ’য়ে দেখি, বিকাল ও সন্ধ্যাবেলা, যখন আমাদের দেশে ছেলে বুড়ো সাধারণতঃ ভোজন করে না-তখন আমাদের শিক্ষিত যুবকগণ কাঁটা চামচের শব্দে রাস্তায় লোককে চমকিত করিয়া তুলেন। ঘরের জীবন ও বাইরের জীবনের এই বিরাট পার্থক্য আমি গত ৫০ বৎসর যাবৎ কলিকতাতেই লক্ষ্য করিতেছি। বাবুরা বাইরের বাড়ীতে, সহিস ও কোচ্‌ম্যানের মারফত মুরগী পোষেন ও তাহার কোর্ম্মা ভক্ষণ করেন—অন্তঃপুরে প্রবেশ করিবার সময় গৃহিণী একটু গঙ্গাজল ছিটাইয়া শুদ্ধ করিয়া তাঁহাদের গ্রহণ করেন। মুখ ফুটিয়া কিছু বলিবার যো নাই। বাঙালী জীবনে ভয় ও সাহসের অপূর্ব্ব সমাবেশ এইখানে। এই রকম দোটানা জীবনের মধ্যে থাকার দরুণ, গত ১০০ বৎসরের মধ্যে আমরা বিশেষ কিছু অগ্রসর হইতে পারিয়াছি বলিয়া বোধ হয় না। ব্যক্তিগতভাবেই হউক আর সমাজগতভাবেই হউক আমরা বিশেষ কোন উন্নতি লাভ করিতে পারি নাই। না পারার কারণ কি তাহাই আলোচনা করিব।

 আমাদের জাতীয় উন্নতির প্রধান অন্তরায় স্ত্রীশিক্ষার শৈথিল্য ও উদাসীনতা। নারী জাতিকে যদি শিক্ষার পথে এগিয়ে দিতে পারিতাম তবে জাতির বর্ত্তমান অবস্থা এত শোচনীয় হইত না। আমাদের দেশে যখন ইংরাজী রাজভাষা হইল-তখন ইংরাজী-ওয়ালাদের আদর খুব বেশী-বড় চাকুরী ইংরাজী-ওয়ালাদের একচেটিয়া হইল। চাকুরীর লোভে তখন লোকে ইংরাজী শিখিত। এখন সে দিন নাই। তবুও অনেকে বলেন মেয়েদের লেখা পড়া শিখে কি হ’বে—তারা ত আর, চাকুরী ক’রে খাবে না (যেন চাকুরীর জন্যই বিদ্যার প্রয়োজন)। সেনসাস্ রিপোর্টে দেখা যায়, দেশের শতকরা ৫ জন লোক বর্ণজ্ঞানবিশিষ্ট (literate); মহিলাদের মধ্যে শতকরা আধ জন মাত্র। তাহা হইলে দেখুন, শিক্ষা হিসাবে আমরা কত নীচে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করিতেছি—দোটানা জীবন ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। স্ত্রীশিক্ষার অভাবেই সমাজে আজ এত ব্যাধি, দুর্নীতি ও কুসংস্কার। পুরুষ ও মহিলাদিগের ভিতর শিক্ষা, দীক্ষা ও চিন্তার বেশী পার্থক্য থাকিলে সমাজ চিরকালই ভগ্নস্বাস্থ্য ও দুর্ব্বল হইয়া থাকিবে। জুলিয়স্ সিজারকে হত্যা করিবার জন্য ব্রুটাস্, কেসিয়াস প্রভৃতি ষড়যন্ত্র করিতে লাগিলেন। ব্রুটাসের তখন চোখে ঘুম নাই আহার বিহারে তৃপ্তি নাই—মন সর্ব্বদাই চঞ্চল ও উদ্বিগ্ন। তাঁহার স্ত্রী পোরসিয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিয়া সন্তোষজনক উত্তর পাইলেন না। ব্রুটাস স্ত্রীর নিকট আত্ম-গোপন করিলেন। তখন পোর্‌সিয়া বলিলেন,

“Is it expected I should know no secrets
That appertain to you? Am I yourself
But, as it were, in sort or limitation,
To keep with you at meals, comfort your bed,
And talk to you sometimes? Dwell I but in the suburb
Of your good pleasure? If it be no more,
Portia is Brutus’ harlot not his wife,”—Julius Caeser

 আমাদের বাঙ্গালী কবি, তাহার অতুলনীয় তুলিকায় চিত্র এঁকে দেখিয়েছেন শিক্ষিত ও অশিক্ষিতার মধ্যে ভাবের কি গভীর পার্থক্য! —

বর।  ‘বল একবার,  “আমিও তোমার,
তোমা ছাড়া কারে নাহি চাই!”

ওঠ কেন, ওকি  কোথা যাও সখি?
কনে।  (সরোদনে) “আইমার কাছে শুতে যাই!”

 শ্রেষ্ঠ ও চিন্তাশীল কবিদিগের ভাব একই রকমের হয়। বাংলার শ্রেষ্ঠ মহিলা কবিও গেয়েছেনঃ

“স্বজনের সাধ পুরাইতে শিশুপত্নী উজলিল ঘর”

* * * *
“অলঙ্কারে সহধর্ম্মিণীরে (কি বিদ্রূপ জানে অভিধান)

পুনশ্চ “জ্ঞানের আলোকে নাথ তুমি হ’লে অগ্রসর
অজ্ঞানের অন্ধকারে আমি ত বেঁধেছি ঘর॥ ”

 এই যে একই সমাজের স্ত্রী ও পুরুষদের মধ্যে একটা বিপুল ব্যবধান-ইহাই আমাদিগকে পঙ্গু করিয়া রাখিয়াছে। মায়ের স্তন্যদুগ্ধ পানের সঙ্গে সঙ্গে সন্তান মায়ের দোষ গুণ সকলের অলক্ষ্যে অর্জ্জন করে। শৈশবাবস্থার শিক্ষা দীক্ষা হয় মায়ের কাছে—মায়ের দ্বারা। ইংরাজ জাতি যে আজ এত বড় হইয়াছে তাহার একটি প্রধান কারণ এই যে, তাহার মায়ের নিকট হইতে ও মাতৃক্রোড়ে থাকিয়া কুসংস্কার শিক্ষা করিবার সুযোগ পায় না; আমাদের দেশে মায়ের চেয়ে বেশী সর্ব্বনাশ করে মায়ের মা বা দিদিমা ও আইমা। মা যদিও সংস্কার বিষয়ে একটু অগ্রণী হয়েন কিন্তু দিদিমা, ঠাকুরমার হাত এড়াবার যো নাই। এইরূপে আমরা এক পুরুষ পিছাইয়া গিয়াছি। বাল্য সংস্কার দূর করা খুব শক্ত। বইতে পা লাগিলে এখনো আমার দেহের শিরা উপশিরা আপনা আপনিই সঙ্কুচিত হয়—কিছুতেই এই কুসংস্কার ছাড়িতে পারি নাই। এখনও অনেক মেডিকেল কলেজের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত ছাত্র গঙ্গাস্নান করিয়া অক্ষয় স্বর্গবাসের কল্পনা করেন। বিজ্ঞানের সব ছাত্রেরাই জানেন অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন হইতেই জল উৎপন্ন হয়। এই জল যদি ঘরে থাকে এবং সেই ঘরে যদি একজন পরিচ্ছন্ন, তথাকথিত অস্পৃশ্যজাতীয় লোক প্রবেশ করে তবে চলিত প্রথানুসারে এ জল অশুদ্ধ হইয়া যায়। কিন্তু কেন? শরীরের বা বংশের অপবিত্রতা কি অর্জ্জুনের শর-সন্ধানের মত কলসীভরা জল দেখিলেই তাহার মধ্যে প্রবেশ করিবে? অথচ সোডা লিমনেড্, ডাব, বরফ্ প্রভৃতিতে দোষ হয় না। কি সুন্দর সংস্কার!

 স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যদি শিক্ষা-দীক্ষায় যথেষ্ট তফাৎ থাকিয়া যায় তবে সংসারে শৃঙ্খলা ও সুখের অভাব হইয়া পড়ে। শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়কে একবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, অমুক ত এক জন অধ্যাপক, অসাধারণ পণ্ডিত—কলেজের ছুটী হ’লে এক দণ্ড বাড়ীতে থাকেন না— অন্যত্র চলে যান কেন? শাস্ত্রী মহাশয় বলিলেন, এটা বুঝ্‌তে পারলেন না? বাড়ীতে সহধর্ম্মিণী এঁর মন আকৃষ্ট করে’ রাখতে পারেন না। হয়ত বেচারীর অর্থের অভাব, বই কিন্‌তে পারে না—অথচ গৃহিণী বায়না ধল্লেন, ব্রত কর্‌ব, এ চাই, ও চাই—ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে হবে ইত্যাদি। বিপদ এইখানে। পরস্পর পরস্পরের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া না চলিতে পারিলে একত্র বাস সুখকর হয় না। ছেলে বেলায় দেখেছি, উকিল, ব্যারিষ্টারকে দরকার হইলে বাড়ীতে পাওয়া যাইত না—তাসের আড্ডা, খোস গল্পের আড্ডা বা পাশের বাড়ীতে খোঁজ করিতে হইত। কারণ ইংরাজীতে যাহাকে বলে amenities of home life তাহা তাঁহারা বাড়ীতে পাইতেন না। আমরা এই অবলাজাতিকে পিছু ফেলিয়া, তাহাদিগকে অজ্ঞ ও মূর্খ রাখিয়া আগুয়ান হইতেছি— প্রকৃত পক্ষে তাহাদিগকে অ-বলা করিয়া রাখিয়াছি। আমাদের সর্ব্বনাশের সূত্রপাত এইখানে।

 তারপর বিবাহ। আজকাল সংবাদপত্রের মারফতে পাত্র পাত্রীর সন্ধান লওয়া হয়। আজকার কাগজ হইতে উদ্ধৃত করিতেছি;— দুইজন বাৎস্যগোত্র বারেন্দ্র যুবকের জন্য পাত্রী আবশ্যক। আরও একটা শুনুন,—কায়স্থ মৌদ্‌গুল্য গোত্ত্রজ যুবকের জন্য সুন্দরী ও গুনসম্পন্না পাত্রী আবশ্যক। (সুন্দরী পাত্রী ত সকলেই চাহেন, কিন্তু জিজ্ঞাসা করি যাঁহারা সুন্দরী কন্যা চাহেন তাঁহারা কি সকলেই কন্দর্পবিনিন্দিত?) এই রাঢ়ী বারেন্দ্র বঙ্গজ—এসব কেন? ব্রাহ্মণের কথা ছাড়িয়া দিই—কায়স্থের মধ্যে এই কৃত্রিম ব্যবধানের সৃষ্টি হইয়াছে মাত্র ২৫০/৩০০ বৎসর। রঘুনন্দনের ও পুরন্দর খাঁর ব্যবস্থা—শাস্ত্রসম্মত নহে—তবুও এই প্রথা মানিয়া চলিতে হইবে? বঙ্গজ কায়স্থ ও দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ পাশাপাশি বাস করে অথচ বৈবাহিক ক্রিয়া তাহাদের মধ্যে হইবে না; একই শ্রেণীর মধ্যে আবার সকল অবস্থায় কুলীন ও মৌলিকের মধ্যে বিবাহ হয় না। জানি এসব কৃত্রিম প্রথা—এসব লোকাচারের মধ্যে সত্যের অংশ নাই তবু ভয় দূর করিতে পারিতেছি না। জানিয়া শুনিয়া আবার আমরাই এই সব কুসংস্কারের পোষকতা করিতেছি। আজকাল মেয়ের বিবাহে যে এত কষ্ট পাইতে হয়—এইসব কৃত্রিম প্রথাই কি তাহার মূখ্য কারণ নয়? অসবর্ণ বিবাহ দূরে থাক্, যদি উত্তররাঢ়ী, দক্ষিণরাঢ়ী, বঙ্গজ ও বারেন্দ্রের ভিতর বিবাহের কোন প্রকার লৌকিক বাধা না থাকিত তবে মেয়ের বাপ অনেক দুর্দ্দশার হাত হইতে রক্ষা পাইত। রাজা রাজবল্লভ বিক্রমপুরের বৈদ্য—কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁহার আত্মীয়গণ গরিফা সমাজ ভুক্ত, অথচ এইটুকু সাহস হইল না যে তাহাদের বংশধরগণ পরম্পর বিবাহদি ক্রিয়া কর্ম্ম করেন। বিবাহ-সমস্যা দিন দিন প্রবল হইতে প্রবলতর হইতেছে। দেশের চিন্তাশীল যুবকগণ ও সমাজের নেতাগণ যদি এখন হইতে সাবধান না হয়েন তবে বিবাহ-সমস্যা অন্ন ও বস্ত্রসমস্যা অপেক্ষা আরও ভীষণ আকার ধারণ করিবে। মিথ্যা দেশাচার ও কপট লোকাচারের উপর যে বিধি– ব্যবস্থা প্রতিষ্টিত, জানিনা, হইতে পারে এক সময় তাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল, কিন্তু এখন সম্যক্ উপলব্ধি করেছি—যাহা অসার, যাহা বিবেকবিরুদ্ধ, যাহা কৃত্রিম সেই সব প্রথা ও সংস্কার আঁক্‌ড়ে ধরে থাকা শুধু সমাজের পক্ষে নয়—দেশের পক্ষে, জাতির পক্ষে অকল্যাণকর। যাহা অন্তঃসার শূন্য ও জাতীয় উন্নতির অন্তরায় ও পরিপন্থী তাহা সর্ব্বোতোভাবে ত্যাগ করিতে হইবে—ইহার জন্য সৎসাহসের প্রয়োজন। স্মরণ রাখা উচিত যে নৈতিক-সাহস বিবর্জ্জিত জাতি কোন দিন জগতের কোন মহৎ কাজ করিতে পারে না।

 তারপর বাল্য বিবাহ। রোজগারের ক্ষমতা নাই—অথচ বিবাহ না করিলে চলিবে না। শিক্ষিত হউক আর অশিক্ষিতই হউক, কোন তফাৎ দেখিতে পাই না। ছেলের বাপ হয়ত ছেলের পড়ার খরচ কুলাইয়া উঠিতে পারেন না কাজেই একজন বেহাই খুঁজিতে লাগিলেন— বুক ফুলাইয়া লোকের কাছে প্রচার করিতে লাগিলেন যে তিনি পণপ্রথার বিরোধী—তবে ছেলেটা খুব মেধাবী—পড়িতে না পাইলে তাহার জীবন ‘মরুভূমি’ হইয়া যাইবে, সেই জন্যই ছেলের পড়ার বাবদ মাসিক ‘যৎ কিঞ্চিৎ’ সাহায্য পাইলেই পুত্রটাকে পাত্রীস্থ করিতে সম্মত আছেন। মেয়ের বাপ দেখিলেন, একসঙ্গে ৫ হাজার টাকা খরচ করিবার সামর্থ্য তাঁহার নাই—সুতরাং মন্দের ভাল। আর ছেলে বাইরে যাহাই বলুন মনে মনে ভাবিলেন, পড়াও হইবে এবং শ্বশুরের পয়সায় কয় বৎসর বেশ আরামে ও আমোদে কাটিবে। ফেল হইলে হয়ত বাবা টাকা পাঠান বন্ধ করিতে পারেন—কিন্তু শ্বশুরের টাকা নিয়মিত ভাবেই আসিতে থাকিবে। সুতরাং অষ্টাদশবর্ষীয় যুবা এক দ্বাদশবর্ষীয়ার পাণিগ্রহণ (পাণিপীড়ন?) করিলেন। মা বলিলেন, বেশ ছোট্ট বউ হয়েছে—ঘর ‘আলো’ কর্‌বে। এই যে বাল্য বিবাহের ব্যবসাদারী— ইহাতে যে সমাজের কত অনিষ্ট হয় দু’এক কথায় তাহাই আলোচনা করিব।

 কথায় কথায় আজকাল বলি, আমরা আর্য্যসন্তান, সনাতন হিন্দুধর্ম্ম রক্ষা করাই আমাদের কর্ত্তব্য; কিন্তু কথায় ও কার্য্যে কোন প্রকার সামঞ্জস্য রাখিবার চেষ্টাও করি না। বেদ, উপনিষদ বা রামায়ণ মহাভারতের যুগে ছাত্রেরা বিদ্যাশিক্ষার জন্য গুরুগৃহে অবস্থিতি করিতেন। ব্রহ্মচর্য্যপালন করিয়া কাষ্ঠ-আহরণ, গো-পালন, গুরু-সেবা দ্বারা সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করিতেন। বিলাসিতা বর্জ্জন ও ব্রহ্মচর্য্যপালন ছাত্র জীবনের প্রধান অঙ্গ। আর আজকাল আমরা বাল্য-বিবাহ করিয়া বা তাহার সহায়তা করিয়া শাস্ত্রের মর্য্যাদা হানি করিতেছি— বর্ণাশ্রম ধর্ম্মের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছি। অর্থ-নীতি, স্বাস্থ্যনীতি ও নৈতিক জীবনের দিক দিয়া দেখিতে গেলে বুঝা যায় আমরা নিজের পায়ে নিজে কুঠারাঘাত করিতেছি। কবি গেয়েছেন, “বিয়ে হলেই পুত্র কন্যা, আসে যেন প্রবল বন্যা।” একে ৫/৭ শত বৎসরের দাসত্বের চাপে আমাদের সব সদ্গুণ গুঁড়া হইয়া গিয়াছে—তার উপর যদি স্ত্রীপুত্র লইয়া পরমুখাপেক্ষী হইয়া জীবনধারণ করিতে হয় তবে ‘স্বভাব নষ্ট’ হইবে তাহা আর বিচিত্র কি? বাল্য বিবাহ এক সময়ে আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল সত্য কিন্তু সে সময়ের বাংলা আর বিংশ শতাব্দীর বাংলায় আকাশ পাতাল তফাৎ। তখন জীবনসংগ্রাম কঠোর ছিল না—সকলেই পেট ভরিয়া খাইতে পাইত। টাকায় ২০॥৹ সের দুধ ছিল না—মাছের সের ১৷৹ সিকা ছিল না—তরকারীর অগ্নিমূল্য ছিল না। গত ১০ বৎসরের মধ্যে টাকার মূল্য এক তৃতীয়াংশ (purchasing power) হইয়া গিয়াছে। বাড়ীভাড়া ও দুধের দাম দিতে কলিকাতাবাসীর প্রাণান্ত। অতি কদর্য্য বাড়ীতে মধ্যবিত্ত গৃহস্থকে বাস করিতে হয়। যে দু’টী অমূল্য জিনিষের জন্য এখনও ট্যাক্সের বন্দোবস্ত হয় নাই— সেই বাতাস ও আলো, কলিকাতাবাসীদের পক্ষে এক প্রকার দুর্লভ। দিন দিন আমাদের জীবনীশক্তির হ্রাস হইতেছে। যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া সেই জন্য বাঙালী জাতিকে দিন দিন মৃত্যুর পথে লইয়া যাইতেছে। কাল কলিকাতাবাসী একজন ধনী, চিন্তাশীল ও সম্মানিত ব্যক্তি আমাকে একখানি পত্র দিয়াছেন। তাহাতে প্রসঙ্গক্রমে তিনি লিখিয়াছেন, “বাল্য-বিবাহ, বিলাসিতা, অর্থাভাব এবং বেকার-সমস্যার দরুণ আমরা বিবেকবুদ্ধি সমূলে নষ্ট করিয়া আত্ম-সম্মান হারাইয়াছি—এই চাটুকার জাতির প্রতি জগতের কাহারও শ্রদ্ধা থাকিতে পারে না।” আফিসে সাহেব সুবার কাছে এত লাঞ্ছনা ও গ্লানি সহ্য করিতে হয় কেন? কারণ, আমরা রোজগার-অক্ষম। একদিন বাড়ী বসিয়া থাকিলে হাঁড়ি চড়ে না। জীবনে স্বাধীনতা থাকিলে, স্বাবলম্বনের ভাবকে জাগ্রত করা যায়—মনুষ্যত্বের বিকাশ করিবার সুযোগ অন্বেষণ করা যায়। কিন্তু একবার স্ত্রীপুত্রের ভরণপোষণের বোঝা ঘাড়ে চাপিলে, স্বাবলম্বন হারাইয়া যায়—আত্মপ্রচেষ্টার অবসর কমিয়া যায়। এখানে অনেক যুবক উপস্থিত আছেন, যাহারা ইণ্টারমিডিয়েট বা বি, এ, পড়িতে পড়িতে বিবাহ করিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করিলে বলেন, “কি কর্‌ব, বাবা ছাড়েন না, মার কষ্ট হয়” ইত্যাদি। বরিশালের অশ্বিনী বাবু বলেছিলেন—বিবাহের সময় বাংলার ছেলেরা মাতৃপিতৃভক্তি দেখাইবার সুবর্ণসুযোগ পায়। আমি বলি, আহা কি সেয়ানা ছেলে! বাপ মা বলিলেই বিবাহ করিবে? লেখা পড়া শিখিয়াছ বা শিখিতেছ—কেন, তুমি কি গরু না ঘোড়া যে ক্রেতাবিক্রেতার মধ্যে দরদস্তুর ঠিক হইলেই গলায় দড়ি দিয়ে হড়্ হড়্ করে টেনে নিয়ে বরের আসনে বসিয়ে দিবে? বিধাতা কি তোমায় কিছুমাত্র বিচারশক্তি দেন নাই। বিবাহের হাটে নিজেকে বিক্রয় করিতে তোমার কি কুন্ঠা হয় না—আত্ম-সম্মানের লাঘব হয় না?

 কথা এই, আমরা ক্রমাগত মিথ্যার সহিত আপোষ করিয়া আসিতেছি—বুদ্ধি ও বিবেচনাকে অন্ধকার ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছি। যুবকেরা আজকাল বলিয়া থাকেন-বুড়োর দল না মরিলে কিছুই করিতে পারিতেছি না—যত অন্তরায় সৃষ্টি করিয়াছে এই সব old fools। আমি জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা, বুড়োর দল যদি একদিনে একই সময়ে গঙ্গাযাত্রা করে, তবে কি যুবার দল তাদের স্থলাভিষিক্ত হইয়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতির অন্ধ-সংস্কার ও সামাজিক ব্যাধি দূর করিয়া দিতে সমর্থ হইবেন? বুড়োর দলকে বাধা না দিয়া বরং তাহাদের কথামত চলিয়া, বাল্য-বিবাহ করিয়া বা নিজ পরিবারের মেয়েদেৱ উপযুক্ত শিক্ষার বন্দোবস্ত না করিয়া, যুবার দল জ্ঞানকৃত পাপ করিতেছেন। এ বিষয়ে বৃদ্ধ ও যুবার মধ্যে মনোবৃত্তির ত কোন প্রভেদই দেখি না; মনে হয় কার্য্যে ও চিন্তায় প্রত্যেক যুবাই এক একজন, ছোটখাট বৃদ্ধের মতই রক্ষণশীল। যুবকেরা কি বুঝিতে পারেন না যে একজন অশিক্ষিতাকে বিবাহ করিয়া তাঁহারা যে অবিবেচনার প্রশ্রয় দেন তাহার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ, কুসংস্কার ব্যাধি ও দুর্নীতিগুলি অন্ততঃ আর এক পুরুষ ধরিয়া সমাজদেহকে স্বাস্থ্যহীন ও দুর্ব্বল করিয়া রাখিবে? তোমার অবিবেচনার জন্য তুমি দেশের শত্রু হইলে— নিজেরও শত্রুতা সাধন করিলে! তোমার জ্ঞানকৃত পাপের জন্য, তোমার মনের অসুস্থতা ও দুর্ব্বলতার দরুণ, তোমার সমাজ-সংস্কারের চেষ্টার অভাবে, কদর্য্য দুর্নীতি ও পাপাচারগুলিকে সমাজের বুকের উপর মৌরসীপাট্টা দিয়া বসবাস করিবার সুবিধা দিলে!

 জাপান আজ ৫০ বৎসরের মধ্যে কি প্রবল শক্তিসম্পন্ন হয়েছে! সে ইংরাজ, আমেরিকাকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলে। কিন্তু আমাদের স্থান কোথায়? আমরা যে এখনও নীচে পড়িয়া আছি তাহার একটা কারণ আত্মপ্রবঞ্চনা ও ব্যবসাদারী। আমাদের দ্বিধাবিভক্ত জীবনের বাইরের দৃশ্য যেমন সুন্দর, ভিতরের দৃশ্য তেমনি কুৎসিৎ। বাইরে—দেশোদ্ধার, সমাজ-সংস্কার, বিধবা-বিবাহ, জাতি-ভেদ রহিত, ছুৎমার্গ পরিহার, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রভৃতির আদর্শ লইয়া বক্তৃতা করিতে করিতে আকাশ বাতাস কম্পিত করি—আর ভিতরে, উত্তর-রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বঙ্গজ, কাশ্যপ, শাণ্ডিল্য, ২৬ পর্য্যা, গঙ্গাস্নানের পুণ্যফল, একাদশীতে বিধবার নিরম্বু উপবাস ইত্যাদি অযৌক্তিক কপটাচারের প্রশ্রয় দিই।

 ছেলে স্কুলে মাষ্টার মহাশয়ের নিকট শিখিয়া আসিল যে চন্দ্রের উপর পৃথিবীর ছায়াপাতে চন্দ্রগ্রহণ হয়। বাড়ীতে আসিয়া শুনিল, দিদিমা বলিতেছেন, রাহুদৈত্য চন্দ্রকে গ্রাস করে বলিয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়—গ্রহণের সময় হাঁড়ি ফেলিতে হয়—কিছু খাইতে নাই—স্নান করিয়া শুদ্ধ হইতে হয়—ইত্যাদি। দিদিমা এক কথাতেই ছেলের যুক্তিতর্ক ঠান্ডা করিয়া দিলেন। বাঙালী ছাত্রের গোড়ার শিক্ষা এই প্রকার সুতরাং তাহার ভবিষ্যৎ জীবন যে দ্বিধা-বিভক্ত হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?

 বাঙালী জাতি ভারতবর্ষের আদর্শস্থানীয় বলিয়া আমরা গর্ব্ব করিয়া থাকি এবং মহামতি গোখেলের সার্টিফিকেট্ (‘What Bengal thinks to-day, India thinks to-morrow’) জাহির করিয়া আমাদের কথার সমর্থন করি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই কথা এক সময় খাটিত, আজকাল খাটে না। সমাজ সংস্কার বিষয়ে একদিন বাঙালী অগ্রণী ছিল—আজ অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছাইয়া পড়িতেছে। কংগ্রেসের একজন নেতা, পরলোকগত পরমেশ্বর পিলে—"Representative Indians” নামে একখানা বই লিখেছেন। তাহাতে তিনি রাজা রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতির জীবনী আলোচনা করিয়া বলিয়াছেন, সমাজ-সংস্কারকের জন্ম বাংলাদেশেই হইয়াছে। কিন্তু বর্ত্তমান বাঙ্গালী জীবনের দৈনন্দিন ইতিহাস ও কার্য্যপদ্ধতি আলোচনা করিলে মনে হয় সমাজ সংস্কার বাংলাদেশ ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছে। মনে ভাবুন—পর্দ্দাপ্রথা। ইহা ত মুসলমানদিগের নিকট হইতে ধার করা— ইহা হিন্দু ধর্ম্ম বা সমাজের সনাতন প্রথা নয়। দাক্ষিণাত্য, বোম্বাই, মধ্যপ্রদেশ, মহীশূর প্রভৃতি স্থানে—পর্দ্দাপ্রথা নাই বলিলেই হয়। এই সমস্ত দেশের উচ্চ ও সদ্বংশজাত মহিলারা স্বচ্ছন্দচিত্তে দলে দলে রাস্তায় ভ্রমণ করেন। প্রায় দেড় বৎসর পূর্ব্বে বোম্বাই নগরে অবস্থিতি কালে সমুদ্রতীরে সন্ধ্যার পর বেড়াইতে গিয়া দেখি, সেখানে মহিলারা অবাধে হাস্যালাপ করিতে করিতে সমুদ্রের বায়ু সেবন করিতেছেন। মান্দ্রাজে মহিলাদের কলেজ সমুদ্রের তীরে—এমন কি একটা প্রাচীর পর্য্যন্ত নাই। এই স্থানে অনেক গোঁড়াহিন্দুঘরের মেয়েরা লেখাপড়া শিখিয়া থাকেন—আর কলিকাতার মহিলারা বদ্ধ-বায়ু ও অন্ধকার ঘরের কোণে রাতদিন থাকিয়া স্বাস্থ্য নষ্ট করিয়া থাকেন। অসুস্থতার দরুণ কেহ কেহ কদাচিত মাঠের দিকে বেড়াইতে যান সত্য কিন্তু তাহাও সন্ধ্যার পর—নির্জ্জন রাস্তার ধারে এবং অতি সঙ্কুচিত ভাবে। আবরু বিষয়ে আমাদের গোঁড়ামি অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় অনেক বেশী।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় দেশের জন্য আজীবন শক্তি, সামর্থ্য ও ধন উৎসর্গ করিলেন—আমরা বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর দিনে তাঁহাকে স্মরণ করি বটে কিন্তু তাঁহার জীবনের প্রধান ব্রতকে কি আমরা প্রতিদিন পদাঘাতে ডুবাইয়া দিই না? আড়াই কোটী বাঙালী হিন্দুর মধ্যে কয় জন বিধবাবিবাহে অগ্রণী। গত বৎসর পাঞ্জাবে ৮৭৫টী বিধবা-বিবাহ হইয়াছে। সার গঙ্গারাম তাঁহার জীবনের অর্জ্জিত অর্থ বিধবা-বিবাহ প্রচারকল্পে ও অন্যান্য সামাজিক সংস্কার কার্য্যে নিয়োজিত করিয়াছেন। আর বাংলাদেশে একজন বিধবার বিবাহ হইলে, সেই সংবাদ খবরের কাগজে ছাপা হয়, যেন কত বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার। অনেক সময় পুরোহিতেরা বিধবা বিবাহে তাঁহাদের কর্ত্তব্য কর্ম্ম করেন না। সম্প্রতি কুমিল্লায় এইরূপ একটা ঘটনা হইয়াছে। ব্রাহ্মণ পাওয়া গেল না দেখিয়া প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ও দাতা মহেশ ভট্টাচার্য্য বলিলেন—“আমি ত এক সময় পৌরোহিত্য করিয়াছি—কেহ না আসে আমিই বিবাহ দিব,” এবং দিলেনও।

 নৈতিক জীবন সুস্থ ও সবল থাকিলে সমাজের স্বাস্থ্য অক্ষুণ্ণ থাকে —সমাজের অধঃপতন হয় নৈতিক বলের অভাবে। ইতিহাসই ইহার প্রমাণ। গ্রীস এক সময়ে সভ্যতা, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যে আদর্শ ছিল। যে দেশে সক্রেটীস, আরিষ্টটল্, প্লেতো, হোমর প্রভৃতি জন্মগ্রহণ করিয়াছেন—সেই গ্রীস্ কি জন্যে রোমের পদানত হইল? একজন চিন্তাশীল লেখক কারণ দেখাইতেছেন—

 “The immediate cause of the decline of a society in the order of morals is a decline in the quantity of its conscience, a deadening of its moral sensitiveness, and not a depravation of its theoretical ethics. The Greeks became corrupt and enfeebled, not for lack of ethical science, but through the decay in the numbers of those who were actually alive to the reality and force of ethical obligations”—Morley’s Compromise. আমাদের দশাও তাই। হিন্দুসাম্রাজ্যের অধঃপতনের কারণ বিবেকশক্তি ও নৈতিক বলের অভাব। আমরা আজকাল খুব শাস্ত্রবচন আওড়াইয়া থাকি। অতীত যুগের কীর্ত্তি ও সভ্যতা, শিল্প ও উৎকর্ষতা, সাহিত্য ও দর্শন, বেদ ও বিজ্ঞান, শৌর্য্য ও বীর্য্যের জয়গান করিয়া নিজেদের দোষ ও দুর্ব্বলতা ঢাকিবার চেষ্টা করি। একবার বেথুন কলেজের পুরস্কার বিতরণী সভায় আমাদের দেশের একজন গণ্যমান্য নেতা (গোঁড়া হিন্দুও বটে) ও উচ্চপদস্থ লোক, লাটসাহেবের সম্মুখে বক্তৃতা দিতে দিতে বলিয়াছিলেন, আমাদের গার্গী, মৈত্রেয়ী ছিল—খণা, লীলাবতী ছিল—এই ছিল, সেই ছিল—ইত্যাদি। কিন্তু তাঁহার বাড়ীতে ‘অষ্টমবর্ষে ভবেৎ গৌরী’। বিদেশীর কাছে বাহবা লইবার জন্য ভারতের অতীত ইতিহাসের পৃষ্ঠা খুলিয়া থাকি,কিন্তু গৃহিণীর রাজ্যে পদার্পণ করিবার সঙ্গে সঙ্গেই নূতন মানুষ হইয়া যাই।

 মরা জাতি ও জীবন্ত জাতিতে কত প্রভেদ দেখুন। চীন খুব রক্ষণশীল জাতি—কিন্তু আমাদের মত বিপদ তাহাদের নাই, তাহাদের মধ্যে ধর্ম্ম ও সাম্প্রদায়িক বিভিন্নতা নাই। আমার মনে আছে, ১৫/১৬ বৎসর আগে যখন চীনের সহিত জাপানের যুদ্ধের সূচনা হয় তখন দশ হাজার চীন রমণী ক্যান্‌টনে সভা করিয়া প্রস্তাব করিলেন যে তাঁহারা জাপানী মাল বয়কট করিবেন। এসব কি আমাদের দেশে সম্ভব? সান্‌ ইয়াট্ সেন্‌ সাধারণতন্ত্র স্থাপন করিয়া ঘোষণা করিলেন-টিকি কাটিতে হইবে। তখন কালিফর্নিয়া, মালয়, ব্রহ্মদেশ, চীনদেশ প্রভৃতি স্থানে যেখানে যত চীনা ছিল সকলেই শিখা ছেদন করিল। এমন কি বেন্টিক ষ্ট্রীটের জুতাব্যবসায়ী চীনারা পর্যন্ত একটু ইতস্ততঃ করিল না। যেমন একটী বৈদ্যুতিক বোতাম টিপিলে এক সঙ্গে শত শত আলো জ্বলিয়া উঠে তেমনি চীনারা একদিনে টিকি কাটিয়া ফেলিল—বলিল,টিকি মাঞ্চুদিগের প্রবর্ত্তিত দাসত্বের নিদর্শন—আজ মাঞ্চুরাজতন্ত্রের অবসান। আর আমরা সনাতন হিন্দুধর্মের দোহাই দিয়া টিকির গোড়ায় তেল ঢালিতেছি—এবং তাহার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিতে আরম্ভ করিয়াছি। আর একটা জীবন্ত জাতি এঙ্গোরার দিকে চেয়ে দেখুন—কি প্রবলবেগে তাহারা উঠিতেছে। কপট দেশাচার, ভণ্ডামি পর্দ্দাপ্রথা দূর করিতেছে। একটা নূতন ভাবের একটা জাগরণের নেশায় তাহারা উন্নতির দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে।

 যুবকেরাই জাতির আশাভরসাস্থল—দেশসেবার পুরোহিত। তাহারাই এগিয়ে যাবে-কিন্তু তাহারাই অনেক সময় পিছাইয়া যায়। কথা হইতেছে, কে আগে যাবে। সকলেই বলেন, আমি আগে যাব কেন? যাইতে হয় ত এক সঙ্গেই যাইব, কাজ করিতে হয় ত একসঙ্গে করিব। ‘দশে মিলি’ করি কাজ, হারি জিতি নাই লাজ’।

ন গণস্যাগ্রতোগচ্ছেৎ সিদ্ধে কার্য্যে সমং ফলং
যদি কার্য্যে বিপত্তি স্যাৎ মুখরস্তত্র হন্যতে।

 কিন্তু মনে ভাবুন গ্রামে একটা বাঘ আসিয়া খুব অনিষ্ট করিতেছে। কেহই এগুতে সাহস করিতেছে না। তখন এমন লোক এক একজন থাকেন যাঁহারা বন্দুক বা লাঠি সড়কি লইয়া বাঘ মারিতে অগ্রসর হয়েন। তাঁহারা বলেন, তোমরা আসিতে হয়, এস। দেখাদেখি আরও পাঁচ জন অগ্রসর হয়। এই রকম ভাবে এগুতে হবে—দেশের সব লোক অনুসরণ না করুক অন্ততঃ পাঁচ জনও করিবে। না এগুলে রক্ষা নাই—বাঁচিবার অন্য পথ নাই। কার্‌লাইল্‌ বলেছেন, “Every new opinion, at its starting is precisely in a minority of one. In one man's head alone, there it dwells as yet. One man alone of the whole world believes it, there is one man against all men” অন্যত্র, “If he has to ask at every turn the world’s suffrage; if he cannot dispense with thẻ vvorld's suffrage, and make his own suffrage serve, hể is a poor eye-servant; the work committed to him will be mis-done. Every such man is a daily contributor to the inevitable downfall.”—Hero-worship.

 ১৯০৬ সালে ‘স্বদেশী’ আন্দোলনের সময় শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়কে একবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম যে বাঙালী যুবক নিজের স্বার্থের জন্য নয়, যশের জন্য নয়, দেশোদ্ধার হইবে এই ধারণার উপর কার্য্য করিয়া অম্লানবদনে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিতে শিথিয়াছে—কিন্তু সমাজ-সংস্কার কার্য্যে, বিধবা-বিবাহ করিতে লোক পাওয়া যায় না;—ইহার কারণ কি? তিনি বলিলেন,বাঙালী ভাবপ্রবণ জাতি—হুজুগের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়া মৃত্যুর সম্মুখীন হইতেও ভীত হয় না; কিন্তু আজীবন সামাজিক নির্য্যাতন সহ্য করিতে অসীম আত্মত্যাগের প্রয়োজন—অবিচলিত সাহসের আবশ্যক। প্রকৃত বীর কে? যুদ্ধক্ষেত্রে কামানের সম্মুখে যে বুক ফুলাইয়া এগিয়ে যায় সে বীরপুরুষ বটে, কিন্তু যাঁহারা সমাজকে টানিয়া তুলিতে গিয়া—সমাজসংস্কার করিতে গিয়া—বিবেক-বুদ্ধি প্রণোদিত হইয়া কার্য্য করিতে গিয়া, আজীবন সমাজের অত্যাচার ও অবিচার সহ্য করেন, তাঁহাদের বীরত্ব অতুলনীয়, যদিও সাধারণের চক্ষে এই বীরত্বের সম্মান অনুভূত হয় না। বিখ্যাত দার্শনিক এমার্‌সন্‌ এই মতটী স্বন্দরভাবে বিবৃত করিয়াছেন। আমাদের আশুবাবুর (যাঁহার অকাল মৃত্যুতে সমস্ত বাংলা আজ শোকসন্তপ্ত) জীবনচরিতে অনেক ঘটনাবলী বিবৃত হইয়াছে, কিন্তু তাঁহার চরিত্রের একটা দিক— একটা বড় দিক—একটু অন্তরালে পড়িয়াছে। তিনি জীবনে সমাজ সংস্কার বিষয়ে যথেষ্ট নৈতিক সাহস ও বীরত্ব দেখাইয়া গিয়াছেন, বিধবা দুহিতার বিবাহ দিয়াছেন—একটী পুত্রকেও “বর্ণ ব্রাহ্মণের” কন্যার সহিত বিবাহ দিয়াছেন। বিধাতা এক এক জনকে এমন প্রেরণা দেন যে তাঁহারা কাজ না করিয়া কিছুতেই নিরস্ত হয়েন না। তাঁহারা বেন প্রত্যাদিষ্ট হইয়া কর্ত্তব্য সম্পাদনের জন্য বদ্ধপরিকর হইয়া উঠেন। তখন যাঁহারা ইতস্ততঃ করিতেছিলেন—লাভ লোকসান বিচার করিতেছিলেন—তাঁহারা অনুবর্ত্তী হন। জগতের অধিকাংশই গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ভাসাইয়া দেয়। ব্রাহ্ম-সমাজের আদি ইতিহাস যাঁহারা অবগত আছেন তাঁহারা জানেন, শিবনাথ শাস্ত্রী পিতামাতার একমাত্র পুত্ত্রসন্তান, কত আদরের জিনিষ ছিলেন—তিনি যখন ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিত হইলেন তখন বাপমায়ের বুকে বাজ পড়িল। কিন্তু শিবনাথ যাহা কর্ত্তব্য বলিয়া বুঝিয়া ছিলেন তাহা হইতে বিচলিত হইলেন না। ব্রাহ্মসমাজের পরলোকগত নগেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রভৃতি যদি হিন্দু সমাজে থাকিতেন তবে লাভবান হইতেন—ভোগ-বিলাস ও বিভবের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করিতে পারিতেন। কিন্তু কি নির্য্যাতনই তাঁহারা সহ্য করিয়াছেন, তবু কর্ত্তব্য-পথ হইতে বিচলিত হয়েন নাই। বাংলা দেশে অনেক পথপ্রদর্শক জন্মিয়াছেন—কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা আমাদের কর্ত্তব্য কার্য্য করিতেছি না। স্রোতস্বিনীর গতি রুদ্ধ হইলে উহা যেমন পঙ্কিল হইয়া উঠে ও তাহাতে নানাপ্রকার রোগাণু জন্মায় ও বৃদ্ধি পায়—তেমনই হিন্দুসমাজ এখন পঙ্কিল হইয়া উঠিয়াছে—এত বিষ সমাজদেহে জন্মাইতেছে ও প্রসারিত হইতেছে যে এরূপভাবে আর কিছু দিন চলিলে সমাজের মৃত্যু অনিবার্য্য। হিন্দু-সমাজ বিশিষ্টতা হারাইতেছে—উদারতা হারাইতেছে। উর্ব্বরমস্তিষ্ক-প্রসূত উপর চালাকির জন্য আমাদের মেরুদণ্ড বাঁকা হইয়া পড়িতেছে। মিথ্যার সহিত আপোষ করিতে করিতে বিবেক-বুদ্ধি ও সাহস হারাইয়াছি— সমাজের ভিতর ভণ্ডামি ও কপটাচরণের অন্তঃসলিলা প্রবাহিত হইবার পথ পরিষ্কার করিয়া দিতেছি। ‘স্বরাজ’ ‘স্বরাজ’ বলিয়া চীৎকার করি— বলি, স্বরাজের উপর আমাদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু আমাদের সমাজ বিশ্লেষণ করিলে দেখিতে পাই—সমাজের রীতিনীতির পনের আনাই ফাঁকি—মানুষের গড়া মানুষ-মারা কল। আমরা চাই রাজনীতিক অধিকার লাভ করিতে— কিন্তু যাহারা আমাদের মুখের দিকে চাহিয়া আছে, আমরা যাহাদের উন্নতিপথের সহায়ক, যাহাদের সহিত জাতীয় উন্নতি ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত—তাহাদিগকে আমরা অবহেলা করিয়া আসিতেছি। ১৯১৮ সালে, Indian Social Conference এর সভাপতির অভিভাষণে বলিয়াছিলাম, “It is the women of India who really belong to the depressed class” —আমাদের দেশের স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে অনুন্নত জাতিভুক্ত। মাতৃজাতির অজ্ঞানতা দূর করিবার মত সাহস ও প্রচেষ্টা আমাদের নাই—কোন্ মুখে আমরা স্বরাজ লাভের যোগ্য বলিয়া মনে করি?

 যুবকেরাই জাতির প্রাণ—জাতির জীবনীশক্তি। তাই আশা হয় বাঙালী মস্তিষ্কের অপব্যবহার হইবে না। যে দেশে বিধির বিধানে মহাপুরুষেরা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন—ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি, সেই দেশের যুবকেরা মহাপুরুষদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া ত্যাগ ও বীরত্বের মহিমায় বাঙালী জাতিকে উজ্জ্বল করুন—ঈশ্বরের শক্তি যেন তাঁহাদের জীবনের পথে চিরসহায় হয়।