আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/১৮

১৮

ঘর সামলাও[]

 প্রায় আট বৎসর কাল আমি ইংলণ্ডে ছিলাম। এই ইউরোপ প্রবাসের কালে ৪ বার যাতায়াত করতে হয়েছে। গত ৩ বৎসরে ও মোটমাট ৪০ হাজার মাইল ভ্রমণ করেছি, গত তিন মাসেও আট হাজার মাইলের বেশী পর্য্যটন করেছি। আজ এই জীবনসন্ধ্যায় সকল বিষয় আলোচনা করবার স্পৃহা হয়। সকল শ্রেণীর লোকের সহিত আমি মেলামেশা করেছি, বোম্বাইর বহু ক্রোড়পতি হইতে সামান্য পর্ণকুটীরবাসী—সকলের সঙ্গেই সমান ভাবে মিশেছি। এক সময় নব জাগরণের উত্তাল তরঙ্গে সমস্ত ভারতবর্ষ প্লাবিত হয়েছিল। ঢেউতে নৌকার মাঝি যেমন উঁচুনীচু হয়, হাবুডুবু খায়, তেমনি আন্দোলন স্রোতে গা ভাসায়ে কত তোলপাড় খেয়েছি। আজকাল আমরা কেন, কিসের জন্য, পিছিয়ে পড়েছি? এর কারণ কি? প্রভঞ্জন-তুল্য প্রবল এত বড় আন্দোলন হঠাৎ এত শীঘ্র আকাশে বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণ কি?

 সব আন্দোলনই ভাসা ভাসা—কোন আন্দোলনই আমাদের অন্তরতম প্রদেশে প্রবেশ করতে পারে না। বাঙালী বড় ভাবপ্রবণ। আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ,—‘লাগপড়’ হয়ে কোন বিষয় কাম্‌ড়ে থাকতে পারি না। আমাদের আবেগ উৎসাহ খড়ের আগুণের মত দপ্ করে জ্বলে’ উঠে’ অচিরেই আবার খপ্ করে নির্ব্বাপিত হয়ে যায়! কিছুরই চিহ্ন পর্য্যন্ত থাকে না।

 তেঁতুল কাঠ, কুলকাঠ একবার জ্বাল্‌লে উপরে ভস্মাচ্ছাদিত হ’লেও ভেতরে ভেতরে আগুণ জ্বল্‌তে থাকে। বৃহৎ কাঠ একমাস দুইমাস ধরে’ জ্বল্‌তে থাকে—তার ভেতরের আগুণ কিছুতেই নিভে না—অনবরত জ্বল্‌তেই থাকে।

 আমাদের জাতির মধ্যে কিসের অভাব? জাতীয় জীবনে কোথায় কি কি গলদ আছে, সমস্ত ত্রুটি দুর্ব্বলতা আজ আলোচনা করে দেখা দরকার। এই দেখুন হলণ্ডের মত ক্ষুদ্র দেশ—যা আয়তনে বাংলাদেশের একটি জিলার মত, এক মৈমনসিংহ জিলার আয়তন অপেক্ষা হলণ্ডের আয়তন বড় নয়—তাও আবার অধিকাংশ সমুদ্র গর্ভের নীচে; বাঁধ ভেঙ্গে গেলে দেশের অর্দ্ধেক জলে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এই দেশে সর্ব্বদা অস্তিত্ব সঙ্কট, দিবানিশি প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাক্‌তে হয়। তিন শ’ বছর আগে যখন স্পেন সাম্রাজ্য পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ছিল, যখন স্পেনের পদতলে অর্দ্ধেক ইউরোপ লুণ্ঠিত ছিল, যখন ব্রাজিল, পেরু, মেক্সিকো স্পেনের করতলস্থ ছিল, উপনিবেশ হইতে রাশি রাশি স্বর্ণরৌপ্য আনিয়া স্পেন যখন তাহা মুদ্রায় পরিণত করিতে ছিল, স্পেন যখন বিপুল গৌরবে ইংলণ্ড বিজয়ের চেষ্টায় ব্যাপৃত ছিল—স্পেনিস আরমাডার কথা বলা বাহুল্য—ক্ষুদ্রকায় হলণ্ড তখন সেই প্রবল প্রতাপান্বিত স্পেনকে অমিতবিক্রমে বাধা দিয়েছিল—কখনও আপনাকে বিজিত করতে দেয় নাই—হলণ্ড তখন প্রটেষ্টাণ্ট ধর্ম বজায় রেখেছিল—স্পেনের সেই সুবিখ্যাত ডিউক অব এল্‌বা এ জাতির কিছুই কর্‌তে পারেনি। হলণ্ডের তুলনায় আমাদের দেশের আয়তন কত বড়, লোক সংখ্যা কত বেশী। অথচ জগতে আজও আমরা উপহাসাম্পদ হই, পরাধীন, পরমুখাপেক্ষী, পরপদানত, বলে পদে পদে লাঞ্ছনা গঞ্জনা অপমান সহ্য করি।

 এখন কথা হচ্চে এই যে আমরা ‘বাঙ্গালী জাতি’, ‘ইণ্ডিয়ান নেশন’ বলে চীৎকার করি, একটা গোটা জাতি বলে জগৎ সমক্ষে পরিচয় দেই। কিন্তু জাতির ভেতর কত রকম গলদ, কত দুর্ব্বলতা রয়েছে, তা একবার স্থিরচিত্তে ভেবে দেখতে হবে। মানুষ মানুষের হাতে খাবে না, মানুষ মানুষের ছায়াটি পর্য্যন্ত মাড়াবে না, একথা বাইরের লোকে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। হিন্দু ভারতের বাইরে এসব কথা লোকে ধারণাই কর্ত্তে পারে না; কোন ভীল,সাঁওতাল, গারো—তাহারা পর্য্যন্ত ধারণা কর্ত্তে পারে না, মানুষ মানুষকে ছুঁলে অপবিত্র হয় কিরূপে। মহাত্মা গান্ধী বলিয়াছেন যে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা কুকুরকেও কোলে করে আদর করে কিন্তু একজন মানুষ এলে তাকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সম্প্রতি মান্দ্রাজে একটী ঘটনা ঘটেছে। একজন প্যারিয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে, পবিত্র ধর্ম্মভাবের আবেগে মন্দিরের সম্মুখস্থ হয়—আত্মবিস্মৃত হয়েই সে মন্দিরের সম্মুখীন হয়েছিল। তাহার মোহ অপসারিত হ’লে সে মন্দির ছেড়ে চলে আস্‌ছিল এমন সময় ধরা পড়ে গেল। ‘মন্দির অপবিত্র হয়েছে— সর্ব্বনাশ হয়েছে’ ইত্যাকার কোলাহলের মধ্যে ঐ লোকটীকে চোর, ডাকাত কিম্বা খুনী আসামীর মত অপরাধীজ্ঞানে পুলিশের হাতে সমর্পণ করা হইল। উচ্চশ্রেণীর হিন্দু বিচারপতি তাহার জরিমানা করিলেন—কারাদণ্ডের ব্যবস্থা দিলেন। এই লঘুপাপে গুরুদণ্ডের ব্যবস্থা দেখে অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান নেতা শ্রীযুক্ত রাজাগোপাল আচারী নিজেকে আর সাম্‌লে রাখ্‌তে পারলেন না। তিনি ঐ প্যারিয়ার পক্ষাবলম্বন করে উচ্চ আদালতে আপীল কর্‌লেন। আপীলে লোকটা নিষ্কৃতি পেল—জেল আর হ’ল না। জজ একটা টেকনিক্যাল গ্রাউণ্ডে তাকে মুক্তি দিলেন—বল্লেন ইচ্ছাকৃত অপবিত্র করার কোন প্রমাণ নেই। তাই তিনি নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখলেন না। দেবতার অর্চ্চনার অপরাধে ভক্ত নিগ্রহ ও লাঞ্ছনার হাত হতে অব্যাহতি পেল।

 আমাদের মধ্যে যে সব আন্দোলন হয় তাহা মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ। খুলনা দুর্ভিক্ষ কিম্বা উত্তর বঙ্গের বন্যার সময় অর্থের জন্য লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, লোকে যথেষ্ট সাড়াও দিয়াছে, কিন্তু জাতীয় কাজ—নানাবিধ জাতীয় অনুষ্ঠান যাতে জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণ নিহিত—এমন সব কাজের জন্য অর্থাভাব ঘটে কেন, কেন লোকে টাকা দেয় না? কারণ আমার মনে হয় এই সব জাতীয় আন্দোলনে সাধারণের সহানুভূতি থাকে না—দেশাত্মবোধ মুষ্টিমেয় জনকতক লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ—সামান্য কয়েকজন শিক্ষিত লোকের গণ্ডীর বাইরে দেশাত্মবোধ জাগে নাই বল্লেও চলে। আর সেই শিক্ষিতের সংখ্যাই বা কত?

 ইংলণ্ডে চার্লস্ দি ফার্স্টের সময় গৃহবিবাদের কথা স্মরণ করুণ, ক্রমওয়েল হামডেন পিম প্রভৃতি বীরবৃন্দ চার্লসকে বাধা প্রদান করলেন, পার্লিয়ামেণ্ট এই civil war এ অগ্রণী ছিল। তখন এক লণ্ডন সহর সাধারণের স্বার্থ রক্ষার্থ অজস্র অর্থ দিয়েছিল। রয়েলিষ্ট নোবেলম্যানেরা সাধারণের সহানুভূতি হইতে বঞ্চিত, তাঁরা অর্থ পান না, নিজেদের রৌপ্য বাসন গহনাপত্র গলিয়ে টাকা ক’রে রাজার পক্ষে লড়েছিলেন। দেশের বড় বড় সহর পার্লিয়ামেণ্টের নেতাদের অজস্র টাকা যোগায়েছিল। হলণ্ডের বড় বড় সহরের বণিকেরাও অম্লানবদনে তাঁদের সমস্ত অর্থ William, the Silent—তাদের নেতার হাতে সমর্পণ করেছিল। আর আমাদের দেশের অবস্থাটা একবার ভাবুন দেখি।

 আমাদের দেশে দেশাত্মবোধ যাদের ভিতর জেগেছে তারা হচ্ছে মধ্যবিত্ত। কোন রকমে কষ্টে সৃষ্টে দিনপাত করে মাত্র। এসব কথা “অন্ন সমস্যা”য় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। আমাদের দেশের যে ধনী সম্প্রদায় মাড়োয়ারী, ভাটিয়া, দিল্লীওয়ালা—সাহা, তিলি, গন্ধবণিক, সুবর্ণবণিক তাদের সঙ্গে আমাদের সহানুভূতি আছে কি? ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজেও গত শুক্রবার বলেছি যে আমাদের মধ্যে সহানুভূতির বড়ই অভাব। স্বর্গীয় দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী মহাশয় “অবলা বান্ধবে” প্রথমে এই কখাটী ব্যবহার করেন—শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় সহ+অনুভূতি ব’লে ইহার ব্যাখ্যা করেন। সমস্ত জাতির ভিতর বৈদ্যুতিক প্রবাহের মত একটা অনুভূতি সমানভাবে বহিয়া গেলেই তাকে বলে সহানুভূতি। কিসের দ্বারা সহানুভূতির বিস্তার হয়? কিসে all the people can think alike—সকল লোক একভাবে ভাবতে, চিন্তা কর্‌তে পারে! আমাদের দেশের অবস্থা হচ্ছে এই যে এদের কাছে আবেদন কর্‌লে, এরা কিছু বুঝতে পারে না। বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ—সে আজ ১৭।১৮ বৎসরের কথা—সে সময়ে কয়েক লক্ষ শিক্ষিত বাঙালী আন্দোলন কর্‌লে—নিরক্ষর অশিক্ষিত বাকী ৪।৫ কোটী লোক—যারা দেশের কথা ভাবতে পারে না,—স্বদেশী আন্দোলনের মর্ম্ম বুঝ্‌তে পারে না—বাবুরা কেন দেশী কাপড় পর্‌তে খোসামুদি করে, বাবুদের খোসামুদি করতে দেখে তারা সব হেসে উড়ায়ে দিতে লাগ্‌ল। তাই বলি দেশের ক’জন লোক আজ দেশের কথা ভাব্‌তে শিখেছে।

 বাংলা দেশে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুর সংখ্যা কত? আমি অনেকবার বলেছি—বাংলা দেশের পৌণে ৫ কোটী অর্থাৎ ৪৭৫ লক্ষ লোকের মধ্যে আমরা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য মাত্র ২৭ লক্ষ। ব্রাহ্মণ কায়স্থ প্রায় সকলে সমান—২৬ লক্ষ আর বৈদ্য ১ লক্ষের কিছু কম। এই ২৬।২৭ লক্ষ লোকের মধ্যে যা একটু শিক্ষার বিস্তার হয়েছে—তাও আবার শতকরা ৫ জন আর বাকী ৯৫ জন কোথায়?

 ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের শিক্ষিতদের মধ্যে চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায় কিম্বা ঘোষ বসু গুহ মিত্র এই উচ্চ শ্রেণীর কুলীনের সংখ্যাই বেশী—ক্যালেণ্ডারে পাশের লিষ্ট খুঁজলেই আমার কথার সত্যতার প্রমাণ পাবেন। ১৩ লক্ষ ব্রাহ্মণের মধ্যেই বা আবার কতজন শিক্ষিত? পাড়াগাঁয়ে কত নিরক্ষর ব্রাহ্মণ ঘুরে বেড়ায়। বাংলা দেশে ৭২ ঘর কায়স্থ আছে। আম বেচা বরফ বেচা কত রকমেরই কায়েত আছে—‘জাত হারালেই কায়েত’। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও রাঁধুনে, পূজারি, ভিখারী ব্রাহ্মণের অন্ত নাই। বামুন এবং ঠাকুর দুটো কথাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই দুটী শ্রেষ্ঠ কথার সংযোগে একটা অদ্ভুত কথার সৃষ্টি হয়েছে—বামুন ঠাকুর। কথাটী শুনে আপনাদের হাসি পায় বটে কিন্তু আমার বুক ফেটে কান্না আসে। বাঁকিপুরে ১৭।১৮ বৎসর আগে একবার বক্তৃতা দিতে গিয়াছিলাম। তখন সেখানকার একজন প্রফেসর বলেছিলেন যে বেহারের অনুন্নত শ্রেণী হচ্ছে ব্রাহ্মণ। বিহার ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে দোবে, চোবে, তেওয়ারী প্রভৃতি উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণেরা আমাদের দেশে কি সম্মান পান তা আপনারা জানেন। বাড়ীর দরওয়ান হয়ে খাটিয়া পেতে বসে থাকে, দিনান্তে ময়দা ঠেসে ছেকে চাপাটী করে খেতে বসে যায়। দোবে অর্থাৎ দ্বিবেদী, চোবে অর্থাৎ চতুর্ব্বেদী ব্রাহ্মণেরা আজ গরুর গাড়ীর গাড়োয়ান, কেহ বা স্বহস্তে লাঙ্গল চষে জীবিকা নির্ব্বাহ করে। বিহারের লালা কায়েতরা তাদের চেয়ে অনেক উন্নত—স্বর্গীয় সুন্দর লাল, পণ্ডিত নেহেরু, পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য প্রভৃতি কাশ্মীরি বা মালবীয় ব্রাহ্মণ—উত্তর পশ্চিম প্রদেশের ব্রাহ্মণদের স্থান কোথায়!

 কথা হচ্ছে এই যে যখন একটা সম্মান সুবিধা নিজের চেষ্টা যত্ন দ্বারা আয়ত্ত করতে হয় না, যখন আভিজাত্যের সম্মান বংশপরম্পরা ক্রমে অনায়াস লভ্য হয়ে উঠে, সেই দিন হইতেই জাতির অধঃপতন সুরু হয়। তাই আজ এ দেশে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মিয়া লেখা পড়া না শিখিয়া বর্ণ জ্ঞানহীন হইয়াও পূজা করিতে পারে—আজ ৫৪ বৎসর কলিকাতায় আছি, কলেজ ষ্ট্রীট ও হ্যারিসন রোডের মোড়ে কৃষ্ণদাস পালের মর্ম্মরমূর্ত্তির ধারে দেখেছি সাবেকী, বৃদ্ধারা লোক দেখ্‌লে জিজ্ঞেস করতেন, “আপনি কি ব্রাহ্মণ—একটু যদি পাদোদক দেন—” বৃদ্ধারা ব্রাহ্মণের পাদোদক গ্রহণ না করে জল স্পর্শ করতেন না—তা সে ব্রাহ্মণ যতই গণ্ডমূর্খ ও কদাচারী হৌক না কেন! ক্ষমতা ও প্রভুত্ব বংশগত হয়ে গেলে নিজের আর কোনো চেষ্টা করার দরকার হয় না। মানুষ সব অলস ও, কর্ম্ম বিমুখ হয়ে যায়। বংশগত জমিদারদের দেখে বড় দুঃখ হয়—অলস বিপুলকায় জমিদারেরা শারীরিক পরিশ্রম করবে না, exercise নেবে না, বেড়াবে না, মাটিতে তাদের পা স্পর্শ হতে পারবে না, তাতে তাদের অপমান হয়। সাড়ে আঠারো রকমের ব্যামো তাদের লেগেই আছে। একজন ইংরেজ লর্ডের অবস্থা দেখুন না—লণ্ডনে টিউব রেলওয়েতে একজন শ্রমজীবীর সাথে এক আসনে বসে যাচ্ছে— ইংলণ্ডে বহু কোটীপতিও একজন মুটে মজুরের পাশে বসে যেতে লজ্জা বোধ করে না। আধমনী গ্লাডষ্টোন ব্যাগ হয়ত হাতে করেই চল্ল, কারণ, সেখানে অঙ্গুলি সঙ্কেতেই ভারবাহী মুটে পাওয়া যায় না।

 আমাদের দেশে পিতা পিতামহ অর্থ সঞ্চয় করে কিম্বা জমিদারী কিনে আমাদের শাপগ্রস্ত করে রেখে যান। ভগবান যিশুখৃষ্ট বলেছেন, “Ye shall not eat except by the sweat of your brow.” ইংরেজী আরও একটা সুন্দর কথা আছে “Live on six pence a day and earn it.” বল্লাল সেন আচার বিনয় বিদ্যা দেখে কুলীন করে দিয়ে গিয়েছেন; আর আজ গুণের সঙ্গে দেখা নাই অথচ কৌলিন্য বজায় আছে। নানারূপ সামাজিক Privilege আমরা অকাতরে বংশপরম্পরা ক্রমে উপভোগ করে আস্‌ছি। “কুলীন কুল সর্ব্বস্ব” নাটক অনেকে দেখে থাক্‌বেন। নৈকষ্য কুলীনের বিবাহের অন্ত ছিল, না, এক এক জনের একাদি ক্রমে ৫।৭টা বিয়ে আমি স্বচক্ষে দেখেছি। এক সঙ্গে সাত পাক ঘুরিয়ে বিয়ে ছেলে বেলা অনেক দেখেছি। শত শত বৎসর এইরূপ এক চেটিয়া প্রভুত্ব ভোগ করে সর্ব্বনাশের ধ্বংসের পথে চলেছে সবাই। যক্ষ্মার বীজ যখন প্রবেশ করে, প্রথম তার লক্ষণ বোঝা যায় না। সমাজে পৌরোহিত্যরূপ অত্যাচারের কথা ধরুন। ইংলণ্ডে ধর্ম্ম যাজক Archbishop of Canterbury উচ্চতম জ্ঞানেবিজ্ঞানে মণ্ডিত সর্ব্ব বিষয়ে সমুন্নত—ওদের পাদ্রীরা পর্য্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত; ওদের ধর্ম্ম যাজক আর আমাদের পুরোহিতের মধ্যে অনেক তফাৎ। যে Alexander Duff রাজর্ষি রামমোহনকে ইংরেজী শিক্ষায় সাহায্য করেছিলেন তিনি কত সু-পণ্ডিত ছিলেন তা বোধ হয় অনেকে জানেন—শিক্ষা ও সাধনার সঙ্গে তাঁরা সর্ব্বোচ্চ সম্মান লাভ করে থাকেন। এঁদের মধ্যে বংশগত কিছুই না—ইংরেজ ও মোছলমানের মধ্যে যে কেহ পাদ্রী বা মৌলবী হইতে পারে। আমাদের ধর্ম্মযাজক বংশানুক্রমিক! যত মোহন্ত আছে তাদের চরিত্র সম্বন্ধে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। পুরোহিত সংস্কৃত জানে না, দুই পয়সা এক পয়সা দক্ষিণায় পূজা করে—অর্দ্ধেক মন্তর আওড়ায়, তাও আবার উচ্চারণ অশুদ্ধ। মন্ত্র জানে না, মন্ত্রের অর্থ বোঝে না, চল্ল পূজা কর্ত্তে। সে মন্ত্র পড়লে তাহা ভগবানের কাণে পৌঁছবে, আর তার অপেক্ষা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি যিনি ব্রাহ্মণবংশ সম্ভূত নহেন—তিনি উচ্চারণ করলে হবে না, তুমি আমি মন্ত্র পড়লে তার শুদ্ধ সংস্কৃত হবে না। পুরোহিতের বেশ সুন্দর একটা শ্লোক আছে—“পুরীষের ‘পু’, রোষের রো, হিংসার ‘হি’ ও তস্কর্য ‘ত’ ইতি পুরোহিত”—concentrated essence of all. মনে কর্‌বেন না যে আমি নিজে শ্লোক তৈরী করেছি। ২ হাজার বৎসর পূর্ব্বে বাণভট্টের “হর্ষ চরিতে” ব্রাহ্মণের যে বিবরণ পাঠ করা যায় তাহাও অতি আশ্চর্য্য। এই পুরোহিত ঠাকুরদের ব্যবসা-সম্বন্ধে সকলেরই একটু বিশেষ করে ভাবা উচিত।

 জাতিভেদের কথা তুলে প্রায়ই শুন্‌তে পাই যে ইংরেজদের দেশেও ত জাতিভেদ আছে। ইংলণ্ডেও জাতিভেদ আছে স্বীকার করি— কিন্তু আমাদের দেশের জাতিভেদ এবং ওদের দেশের জাতিভেদে অনেক পার্থক্য। ইংলণ্ডে যে কোনো লোক Peer হইতে পারে। ম্যাকলে তাঁহার ইংলণ্ডের ইতিহাসে ত্রয়োদশ শতাব্দীর সমাজের কথা বল্‌ছেন—“It had none of the invidious character of caste. Any one could become a peer.” আমাদের বর্ত্তমান বড়লাট লর্ড রেডিং সামান্য লস্কর হয়ে মাস্তুল তোলা হইতে ডেক পরিষ্কার পর্য্যন্ত সবই করতেন—একবার কল্‌কাতায়ও এসেছিলেন। তিনি জাতিতে ইহুদি। যুদ্ধের সময় আমেরিকায় দৌত্য কার্য্যে প্রেরিত হ’ন—শেষে Peer of the Realm হ’ন। আর বিদেশের কথায় কাজ কি—আমাদের লর্ড সিংহের কথাই ধরুন না। তিনি জাতিতে বাঙ্গালী হইয়াও লর্ড উপাধিতে ভূষিত হলেন! “From Subaltern to the Field-marshal.” নিম্নতম সৈনিক হইতে উচ্চতম সেনাপতি হওয়া কেবল ওদের দেশেই সম্ভব। আর ইংলণ্ডে কেবল জ্যেষ্ঠ পুত্ত্রই লর্ড হয়—লর্ডের অন্যান্য ছেলেরা সাধারণ শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত হ’ন। ক্ষমতাশালী উইনষ্টন চার্চিল Duke of Marlboroughর ছেলে—উচ্চ অভিজাত বংশোদ্ভূত হইলেও নিজে Mr. W. Churchill. ইংলিশ লর্ড ও আমাদের উচ্চশ্রেণীর মধ্যে অনেক তফাৎ।

 আমাদের দেশে নৈকষ্য কুলীনেরা গণ্ডীর ভিতর আবদ্ধ—প্রত্যেক পরিবার গড় কেটে, পরিখা কেটে বাস করে—এই সর্ব্বনাশকর বংশগত আভিজাত্যের প্রথা একটু বিশেষ ভাবে আলোচনা করা দরকার। বল্লাল সেন নব কুল লক্ষণ দেখে কুলীন করে গেলেন—আমরা চিরকাল কৌলিন্যের দাবী করব এ কেমন কথা?

 কায়স্থ ব্রাহ্মণ বৈদ্যের কথা বাদ দিলে বাংলার ৪৭০ লক্ষের উপর লোক থাকে। এর মধ্যে ২ ১/২ কোটী মুসলমান আর নমঃশূদ্র প্রায় ২৫ লক্ষ—মাহিষ্য, রাজবংশী, ব্রাত্যক্ষত্ত্রিয় প্রভৃতি জলাচরনীয় জাতির লোক—সাহা, তিলি, শুরী হইতে বাগ্দী চামার—মৈমনসিংহে আর এক জাত আছে ভূঁইমালী—হিন্দু সমাজে সব যেন থার্মোমিটারের স্কেলের মত গ্রেড করা। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ডাক্তার এনিবেসাণ্টের সভাপতিত্বে ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে এই Graded Thermometric Scale এর সম্বন্ধে বলেছিলাম। মান্দ্রাজের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়—মান্দ্রাজী হিন্দুদের মধ্যে দৃষ্টিদোষ আছে। সুখের বিষয় বাংলা দেশে সেটা নাই। মান্দ্রাজে লোকে ঘেরাও করে খায়। আমি একবার বলেছিলাম যে দূর হইতে দূরবীক্ষণ (Telescope) দিয়া দেখিলে তারা খাদ্য দ্রব্য ফেলে দেবে কি না? ১৩।১৪ বৎসর পূর্ব্বে বলেছি বাঙালীর মস্তিষ্ক অতি অদ্ভুত মস্তিষ্ক। মান্দ্রাজের আয়ার আয়াঙ্গারদেরও তদ্রূপ— মস্তিষ্কের ভিতর সব water tight compartments—প্রাত্যাহিক জীবনে বিদ্যার সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নাই—বিদ্যা শুধু বক্তৃতা দিবার জন্য—দিল্লী এসেমব্লীতে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিবার জন্য। অনেক বক্তাকে আমি জানি, তাঁহারা জাতিভেদের বিষময় ফল সম্বন্ধে লম্বা গলায় বক্তৃতা করেন কিন্তু কাজের বেলা সমাজে ঘোরতর গোঁড়া হয়ে উঠেন—তাদের লিষ্ট আমার নিকট আছে। মান্দ্রাজে ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণের অহিনকুলের সম্পর্ক—Madras Ministry হইতে ব্রাহ্মণদের বিতাড়িত করেছে—অব্রাহ্মণদের নিজেদের Justice বলে একখানা কাগজও আছে। ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণদের ভেতর হিংসা দ্বেষের অন্ত নাই— খুব রেষা রেষি চল্‌ছে—সে হিসাবে বাংলাদেশ—রামমোহন কেশবচন্দ্র বিবেকানন্দের দেশ ত স্বর্গ।

 গত অক্‌টোবর মাসে বক্তৃতা দিতে নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম। অমরাবতীতে অস্পৃশ্য জাতদের দেখেছি—বেরারে মারাঠাদের দেশে—মারাঠা মানে শূদ্র। তথায় তূলোর দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় রায়তারী বন্দোবস্তের দৌলতে যোতদাররা বছরে ১০।১২ হাজার টাকা আয় করেন। এই অনুন্নত ধনী সম্প্রদায়ের আবেদন ও মর্ম্মবেদনা শুন্‌লে পাষাণও বিগলিত হয়ে যায়। তারা নিজেরা স্কুল করেছে—অজ্ঞান অন্ধকার অমানিশার মতই ঘন—তারা জাগ্রত হচ্ছে—হৃদয়ে রোষ হিংসা দ্বেষ পোষণ করে নিজেদের অবস্থা উপলব্ধি করিতেছে—নিজেদের লোক নাই—মান্দ্রাজ হইতে পিলাই নাইডু প্রভৃতিদের ডেকে এনে সভাপতি কর্‌ছে। ব্রাহ্মণদের প্রতি ভয়ঙ্কর বিদ্বেষ। অমরাবতীতে মুসলমান সংখ্যা খুব কম, ভেবে ছিলাম জাতি গঠনের অনেক সুবিধা হবে ওখানে। তা’ নেতাদের হৃদয়েও ব্রাহ্মণদের উপরে গাঢ় বিদ্বেষ। নাগপুরে মাহার অন্ত্যজ বলে ব্রাহ্মণদের উপর ভয়ঙ্কর বিদ্বিষ্ট। মাহারদের ব্রাহ্মণেরা পশুর চেয়েও অধম বলে ঘৃণার চক্ষে দেখে। “আমি যদি একটী ব্রাহ্মণকে খুন করে মরতে পারি তবে জীবন ধন্য হইবে” কলেজের কোন মাহার ছাত্রের মুখে এ প্রকার কথা শুনেছি। ভাবুন দেখি আমাদের ভিতরে কত গলদ, আমরা মুখে একজাতি একজাতি করি তাতে লাভ কি।

 বাংলা দেশে হিন্দু মুসলমানের ধমনীতে একই রক্ত—মোগল আফগান তাতার বংশোদ্ভূত মুসলমান বাংলায় ক’জন? মৌলনা আক্রাম খাঁর এবং ঠাকুর পরিবারের এক পূর্ব্ব পুরুষ—উভয়ে এক বংশজাত—ঘ্রাণে অর্দ্ধভোজনের গল্পটা সকলেই জানেন বোধ হয়—রবিবাবু বলেন যে ঘ্রাণের চেয়ে একটু বেশী এগিয়ে ছিল বোধ হয়। ঠাকুর পরিবারের কথা বাদ দিন—ধন বিদ্যা ও অশেষগুণালঙ্কৃত এঁরা—সমাজে এঁদের মর্য্যাদা, প্রতিপত্তির কথা বিচার না করে— ইহাদের জ্ঞাতিগোত্র পাড়াগাঁয়ে কি ভাবে থাকেন, তা কাহারও অজানা নেই।

 একটা কথা শুনি যে মুসলমানরা জোর করে হিন্দুদের মোছলমান করেছে। কথাটা সত্য বলে মনে হয় না। মুর্শিদাবাদ ও দিল্লীর নিকটবর্ত্তী স্থানে হিন্দুর সংখ্যা খুব বেশী—আবার দিল্লী বা মুর্শিদাবাদ হইতে দূরে চাটগাঁ অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা খুব বেশী, আমার বিশ্বাস হিন্দু সমাজের অত্যাচারে কৃষিজীবী অনুন্নত পদদলিত লোকেরাই দলে দলে ইসলাম ধর্ম্ম গ্রহণ করেছে। সুবিধা দেখেই গ্রামকে গ্রাম মুসলমান হয়েছে। বাগেরহাটে খাঞ্জেয়ালির দরগা দেখেছি—শত সহস্র হিন্দু তথায় মানত করে, ভক্তিশ্রদ্ধা সহকারে সিন্নি দেয়। মওলালির দরগার কথা শুনেছি; হিন্দুরা তথায় মানত না কর্‌লে পীরসাহেবকে উপোষ করে থাক্‌তে হয়। শাহজালালের দরগার কথা সকলেই জানেন। মনীষী কার্লাইল বলেছেন যে “Islam is a perfect equaliser of men”— ইসলাম ধর্ম্ম মানুষের সহিত মানুষের মোটেই প্রভেদ রাখে না—বাদসা আমীর ওমরাহ হইতে মুটে মজুর সকলেই এক মসজিদে উপাসনা করে—এক পাত্রে আহার করবার অধিকারী। যে দিন ইসলামধর্ম্ম গ্রহণ করা যায় সেই দিন হইতে সমাজে এক পদবী লাভ, একত্র আহার বিহার, বিবাহ আদান প্রদান প্রভৃতি চলে। খৃষ্টধর্ম্ম হইতেও ইস্‌লাম ধর্ম্ম এবিষয়ে উদার এবং অগ্রসর।

 মুসলমানেরা হিন্দুদের শুদ্ধি ও সংগঠন আন্দোলনে একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছেন কিন্তু আমি তাদের বল্‌ছি, পাঁচশত শ্রদ্ধানন্দ এলেও পাঁচ জন মুসলমানকে হিন্দু কর্‌তে পার্‌বেন না—মোছলমানরা কিছুতেই হিন্দু হবে না—আমি জানি অনেক হিন্দু বিধবা কলঙ্কময় জীবন যাপন করা অপেক্ষা ইসলাম ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া উদ্বাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়া শ্রেয় জ্ঞান করেন। হিন্দু সমাজে স্বামী অনায়াসে স্ত্রীকে ত্যাগ করে, পুনরায় বিবাহ কর্ত্তে পারেন—স্ত্রীর আর কোনো উপায় থাকে না। ইসলামধর্ম্মগ্রহণ কর্‌লে বিবাহ বন্ধন খণ্ডন করা যায়—ঘরের ভিতর কত বিবাদ কত গলদ, ভাব্‌লে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতে হয়।

 জাতির প্রয়োজনে টাকা পাই না—কারণ হচ্ছে পাপের প্রায়শ্চিত্ত—জাতিভেদের বিষময় ফল, আমরা এখন ভোগ করছি। মাড়োয়ারীদেরও বাঙালী বল্‌তে হবে—এক হিসেবে তারাও বাঙালী বৈ কি—বাংলায় বসবাস করিতেছে—মাড়োয়ারী is making his piles—মাড়োয়ারী টাকা করতে ব্যস্ত। সাহা, তিলি, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিকেরাও ঐ পথের পথিক। মহারাজা স্যার মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর মত দুই একজন লোক—তাঁরা হচ্ছেন— exceptions proving the rule. আর তিলি, সাহা, সুবর্ণবণিক, কংসবণিক, গন্ধবণিক এদের ভিতর শতকরা ক’জনই বা শিক্ষিত?

 দেশে যখন কোন জাতীয় জাগরণ বা আন্দোলন আরম্ভ হয় তখন দেশের বণিককুলই অজস্র অর্থ সংগ্রহ করে’ সে আন্দোলনকে সজীব রাখে। পূর্ব্বে বলেছি গৃহবিপ্লবের সময় লণ্ডনের বণিকেরা বিপুল অর্থ সাহায্য করেছিল; ইংলণ্ডের বড় বড় সহরের বণিকেরা অজস্র অর্থ দিয়ে দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় অগ্রসর হয়েছিলেন। সব দেশেই জাতির নানা কাজে যখনই অর্থের প্রয়োজন হয়েছে তখনই বণিককুল অকাতরে দিয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশের ব্যবসায় বাণিজ্যে রত সাহা, তিলি, গন্ধবণিক, মাড়োয়ারী প্রভৃতি সকলেই অজ্ঞান অন্ধকারে নিমগ্ন। আমার একটি মেধাবী ছাত্র প্রাণের আবেগে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়েছিল—একটি জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করে’ দেহমন অর্পণ করে’ নগ্নপদে অস্থিচর্ম্ম সার হয়ে’ দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তার কাছে শুনেছি যে টাকা তোলা দায়—লোকে এসব কাজে এক পয়সাও দিতে চায় না। অথচ,একজন বাবাজী এসে যদি আড্ডা গেড়ে বসে মহোৎসবের জন্য ঘি, ডাল, চা’লের এক লম্বা ফর্দ্দ দাখিল করেন তবে অনেক ধনী সওদাগর মহাজন গললগ্নীকৃতবাসে বল্‌তে থাকে “প্রভু, এ অধম আপনার কি উপকার কর্‌তে পারে—আপনার কোন্ কোন্ বিষয়ের ভার আমার উপর দিবেন?” বাবাজী হয়তঃ একসের গাঁজা— দাম ৮০ টাকা—ও মহোৎসবের বিবিধ উপকরণের এক ফর্দ্দ দেন। মহোৎসবে হাজার লোক খাওয়াতে হবে। সওদাগর মহাজনদের ভিতর এই সময় অর্থদান নিয়ে ভীষণ প্রতিযোগিতা চলে। প্রয়াগে কুম্ভমেলায় বড় বড় মোহান্ত স্বর্ণরৌপ্যখচিত সিংহাসনে বসে হাতীতে চড়ে বেড়ায়—অপার ঐশ্বর্য্যের অদ্ভুত আড়ম্বর। হায়! আমাদের দেশের ধনী সম্প্রদায় দেশহিতকর কাজে টাকা না দিয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে স্বামীজি বা বাবাজি মহারাজের পায়ে সমস্ত নিবেদন করে। এতমণ ঘি, এতমণ ময়দা যোগাইতে পারলেই স্বর্গে তাদের মৌরসী পাট্টা হয়ে গেল। শ্রাদ্ধে, মহোৎসবে, মঠমন্দির প্রতিষ্ঠায় কে কি রকম ক্রিয়াবান তার প্রতিযোগিতা চল্‌বে আর দেশের কাজে দশের কাজে—জনহিতকর কোন কাজে কেউ প্রাণান্তেও একটি পয়সাও দেবে না। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইচ চ্যাঞ্চেলর স্যার বি, কে, বসু বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে আবেদন করে বড় কিছু পেলেন না, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে এক মাড়োয়ারী ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়লের মত দুগ্ধফেননিভ মারবেল পাথরে ৮।১০ লক্ষ টাকা খরচ করে বিরাট এক মন্দির গড়ে তুলেছেন—সেই মন্দিরে আবার endowment—দেবার্চ্চনার বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ কোটী কোটী টাকা ধর্ম্মের নামে পরকালের জন্য অকাতরে ব্যয় করছে—আর শিক্ষাদানের নিমিত্ত, জ্ঞানের আলোক বিতরণের নিমিত্ত এক কাণাকড়ি দিতে লোকের প্রাণে বাজে।

 হিন্দু সমাজে নির্য্যাতিত, অধঃপতিত, পদদলিত তথাকথিত নিম্নশ্রেণীদের জন্য কেহ ভাবেনা—সমবেদনা সহানুভূতির বড়ই অভাব। সকলে সমান ভাবে শিক্ষিত হইবার কোন সুযোগ সুবিধা পায় না—শিক্ষা উচ্চ শিক্ষিত জনকতক লোকের মধ্যে আবদ্ধ। লর্ড ডাফ্‌রীন্ আমাদের বিদ্রূপ করেছিলেন—তোমরা কংগ্রেস কর—তোমরা ত মুষ্টিমেয় (microscopic minority), তোমরা আন্দোলন কর, তোমাদের চেনে কে? একথার আমরা কি জবাব দিতে পারি? সত্য সত্যিই এক জাতি? আমরা কি একজাতি বলে পরিচয় দেবার যোগ্য?

 জাতিভেদের দোষ সম্বন্ধে আমি অনেক বলেছি। আমার একজন ছাত্র আছে, যার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য আমি আজ গর্ব্বভরে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াইতে পারি—মেঘনাদ সাহার নাম আজ জগৎবিখ্যাত—Saha’s Law এর কথা সকলেই জানে—কোথায় দুর্নিরীক্ষ্য নক্ষত্র কি উপাদানে তা গঠিত, সুপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিকেরা যাহা যুগযুগান্তর ধরে নির্ণয় করে উঠ্‌তে পারে নি, আজ Saha’s equation এ সেই সমস্ত সূক্ষ্ম তত্ত্ব উদ্ঘাটিত হয়েছে। ভাবুন দেখি জাতিটা আজ কত বড় হইত যদি এই ৫ কোটী লোকের ভেতর সমান মস্তিষ্ক চালনা হইত। প্রেসিডেণ্ট উইলসন তাঁর New Freedom নামক পুস্তকের এক স্থানে আমেরিকার বিশেষত্ব সম্বন্ধে বলছেন যে সে দেশের রাস্তার মুটে পর্য্যন্ত প্রেসিডেণ্ট হবার আশা পোষণ করতে পারে—আজ যে মুটে মজুর, কাল সে রাষ্ট্রনায়ক হইবে, কেউ আট্‌কে রাখতে পারবে না; ওদের দেশেই “From Log Cabin to White House” সম্ভব হয়। ওরা শ্রমের মর্য্যাদা বোঝে—কৃষক, শ্রমজীবী, খানসামা, মুটে, মজুর শীতকালে কলেজে পড়ে—রকফেলারের মত কোটীপতির ছেলের সাথে এক সঙ্গে একত্র পড়ছে—এক মেসে থাকে কেউ কাকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করবার জো নাই—যদি করে সকলে তাকে ill-bred অভদ্র বলে বিতাড়িত করে দেয়। আমেরিকা কত বড় জাতি—Dignity of labour কত? আর আমাদের দেশে আমরা শ্রমের মর্য্যাদা বুঝি না—একটা মাছ কিনে হাতে করে আন্‌তে পারিনা—আট আনায় ইলিস মাছ কিনে দুই আনা দিতে হয় মুটে ভাড়া— নিজেরা সাহস করে মাছটা হাতে করে আনতে পারি না।

 জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি সম্বন্ধে অনেক কথাই বলেছি। ইংলণ্ডের কথা ধরুন—নরম্যানরা ইংলণ্ড দখল করে বিজিত স্যাকসনদের সমস্ত জমাজমি কেড়ে নিয়ে Deer Park মৃগয়া ক্ষেত্র করে কত রকম অত্যাচার করেছে। William the Conqueror এর সময় হইতে “Down with the Saxons”, “Down with the Normans” এই রব শুনা যেত কিন্তু যে দিন Magna Charta সকলে মিলে রাজা জনের কাছে থেকে আদায় করা হ’ল, যে দিন Barons and Yeomen রা মিলে নিজেদের right—birth right এর দাবী কর্‌ল সেই দিন বিজেতা ও বিজিত এক হয়ে গেল। মেকলে বলেছেন “Here commences the History of the English nation.” বিবাহের আদান প্রদান ও আহারাদিতে বিবাদ বা মনোমালিন্য থাক্‌তে পারে না। আমাদের দেশে সব অদ্ভুত ব্যাপার। পদ্মার ওপার গিয়ে যারা বসবাস করল—তারা হ’ল বঙ্গজ—যত নৈকষ্য কুলীন সব বিক্রমপুরে। বঙ্গজ ও রাঢ়ীতে কাজ হবে না—উত্তর রাঢ়ী দক্ষিণ রাঢ়ী আলাদা—এর ভিতর কোনো Logic নাই। কায়স্থ গেল পদ্মার ওপার, তার সঙ্গে আর ক্রিয়া কর্ম্ম চল্‌বেনা—কোন যুক্তি তর্ক নাই— Without any Rhyme and Reason. গৌহাটী, তেজপুরের এক এক জন উকিল মেয়ের বিয়ে দিতে সর্ব্বস্বান্ত হ’ন—যিনি বারেন্দ্র শ্রেণী ভুক্ত, বর খুঁজ্‌তে ৬ মাস এসে বরেন্দ্র ভূমিতে বাস কর্‌তে হবে—বম্বে নাগপুরে যে সমস্ত বাঙ্গালী আছে, বর খুঁজ্‌তে তাদেরও বাংলা দেশে আস্‌তে হয়, তাই একবার মেয়ের বিয়ে দিতে ৪।৫ বছরের জমান টাকা খরচ হয়ে যায়। পরিবারবর্গ নিয়ে যাতায়াত—কত ঝঞ্ঝাট। নাগপুর বম্বে অঞ্চলে যাঁরা থাকেন তাঁদের কত অসুবিধা— বাংলা পড়িবার জো নাই, ভাবুন দেখি আমাদের অসুবিধার অন্ত নেই। আর একজন ইংরাজ ফ্রান্স বা জর্ম্মেণীতে গিয়ে সেখানেই একজন ফরাসী বা জার্ম্মাণ বিয়ে করে ঘর সংসার করে। মুসলমানেরা যেখানে খুসী বিয়ে থা’ করে বসবাস করতে পারে। আমাদের হিন্দুদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডী, কোটর করে প্রত্যেকে পৃথক খাঁচার মধ্যে চুপ করে বসে আছি।

 গত শুক্রবার ভবানীপুর ব্রাহ্ম সমাজে জাপানের কথা বলেছিলাম। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দ হইতে নব্য জাপানের (New Japan) অভ্যুত্থান। কাউণ্ট অকুমার কীর্ত্তি কলাপ আমি নখ দর্পণে দেখিতেছি। ৫০ বৎসরে জাপান পৃথিবীর সভ্য জাতি সমূহের সমকক্ষ হয়েছে। আমরা সকল দোষ গভর্ণমেণ্টের ঘাড়ে চাপাই, মনে করিবেন না যে আমি গভর্ণমেণ্টের খোসামুদি করছি—আর আমি গভর্ণমেণ্টের কতটুকু খোসামুদি করে চলি তা সবাই জানে। আমাদের সমাজ দেহের ভেতরে ব্রণ—পূতিগন্ধময় ক্ষত, উপরে মলম প্রলেপ দিয়ে লাভ কি? অস্ত্রোপচার (Surgical operation) দরকার। ব্যাধি পোষণ করে কি লাভ? কত ক্ষতি হচ্ছে তাত চক্ষের উপর দেখিতেছি। যখন আমি খুলনা দুর্ভিক্ষ নিয়ে বিব্রত ছিলাম, তখন একদিন এক গ্রামে গিয়েছি। তখন জ্যৈষ্ঠ মাস, কতগুলি যুবক এসে বল্ল “দেখুন এসে আপনি ত দুর্ভিক্ষ নিবারণে ব্যস্ত—Relief operation নিয়ে বিব্রত আছেন, দেখুন এসে ষ্টীমারে কি ভিড়—কত বিধবা লাঙ্গল-বাঁধ তীর্থে যাচ্ছে।” বিধবারা সারাজীবনের গচ্ছিত ধন পরের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছে দেখে মনে বড় ব্যথা হ’ল। কত বিধবা শাকান্নে তৃপ্ত হয়ে, নটে শাক, কলমি শাক খেয়ে টাকা মাটিতে পুঁতে ৪০৲, ৫০৲, ১০০৲ জমায়ে অর্দ্ধোদয়, লাঙ্গলবন্ধ, শ্রীক্ষেত্র, গঙ্গাস্নান প্রভৃতি তীর্থ যাত্রা উপলক্ষে সর্ব্ব পাপ ক্ষয় করে পরকালের গতির ব্যবস্থা করে। সংস্কারের ভালমন্দ সম্বন্ধে কিছুই বল্‌বোনা—তীর্থ যাত্রার ন্যায় অন্যায় সম্বন্ধে কিছু বল্‌তে চাই না—আর এই ব্রাহ্মসমাজের পুলপিট থেকে তীর্থযাত্রার বিরুদ্ধে বল্লেও বোধ হয় তেমন কোন অপরাধ হবে না। যাহোক, আমি Economic—অর্থ নৈতিক দিক হইতে এ বিষয় আলোচনা করছি। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বলছি এই জন্য যে চন্দ্রনাথ, গয়া, কাশী, প্রয়াগ, মথুরা, বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থ যাত্রা দ্বারা খরচের চৌদ্দ আনা টাকা লণ্ডনে মনি অর্ডার করি; বাদবাকী দু’ আনা গরীব ষ্টেশন মাষ্টার, কেরাণী, কুলি ও তীর্থের পাণ্ডাদের দেই। কোথায় বদরিকাশ্রম আর কোথায় রামেশ্বর সেতুবন্ধ—কত কোটী, কত লক্ষ লক্ষ টাকা আমরা তীর্থযাত্রা উপলক্ষে ব্যয় করি; অথচ দেশের কাজের জন্য, জাতির কল্যাণের নিমিত্ত, জলাশয় দীঘী খনন, পথ ঘাট নির্ম্মাণ প্রভৃতি সৎকাজের জন্য টাকা পাওয়া যায়, না—পুণ্যশ্লোকা রাণী ভবানী ও অহল্যা বাইয়ের দৃষ্টান্ত লোকে অনুসরণ করে না। “তস্য প্রিয়কার্য্য সাধনঞ্চ তদুপাসনমেব”—অন্ধ আতুর কলেরা ম্যালেরিয়া কালাজ্বর গ্রস্থ দুস্থ গ্রামবাসীদের সেবার জন্য টাকা পাওয়া যায় না—অথচ কত টাকা তীর্থের জন্য ব্যয় হয়। পূর্ব্বে যখন রেল ষ্টীমার ছিল না—তখন অবশ্য এই তীর্থের টাকার অনেকাংশ দেশী মাঝি মাল্লার হাতে ঘুরত। তীর্থ যাত্রার ন্যায় অন্যায় আলোচনা আমি করব না—অর্থনৈতিক দিকের কথাই বল্লাম। কি সর্ব্বনাশকর মোহ—আমার উদ্ধার হোক— আর দুনিয়াশুদ্ধ সব উৎসন্নে যাক—কি ঘোরতর স্বার্থপর ভাব “প্রয়াগে মুড়িয়ে মাথা মরগে পাপী যথা তথা” কি অন্ধসংস্কার। এই ভাবে আমরা দিন দিন জাহান্নামে যেতেছি।

 ইউরোপীয় এবং আমেরিকানদের আমরা জড়বাদী বলি— Materialistic— আমেরিকার বহুক্রোড়পতির নাম জানি— প্রবাসীতে কয়েক মাস পূর্ব্বে এদের আয়ের একটা তালিকা দেওয়া হয়েছিল—এরা এই কোটী কোটী টাকা কি ভাবে ব্যয় করে? আমরা অর্থ উপার্জ্জন করি পরকালের সদগতির নিমিত্ত, এরা করে ইহকালের জন্য—কোটী কোটী টাকা ব্যয় করে রিসার্চ্চ ইনিষ্টিটিউট, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। কার্ণেগী ১০০ কোটি টাকা ও রকফেলার বিদ্যাশিক্ষা ও নরহিতের জন্য ন্যূনাধিক ১৫০ কোটী টাকা দান করেছেন। মান্‌সিন্‌ আট মিলিয়ন পাউণ্ড অর্থাৎ ১২ কোটী টাকা আর্ট ও কালচারের জন্য ব্যয় করেছেন। জনহিত কর কাজে যাতে কুসংস্কার বিদূরিত হবে এমন কল্যাণকর কাজে দেশহিতের জন্য অজস্র অর্থ ব্যয় করেন আমেরিকার ধনী সম্প্রদায়।

 আর আমাদের দেশে আমরা আমাদের পূর্ব্ব পুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতেছি—আমরা মধ্যবিত্তেরা ত লক্ষ্মীছাড়া। যাদের ঘরে লক্ষ্মী আশ্রয় নিয়েছেন সেই মাড়োয়ারী—মাড়োয়ারীদের কথা বল্‌তে আমি বাধ্য, না বল্‌লে অকৃতজ্ঞ হতে হবে। খাইতে পায়না, পরের দুঃখ কষ্ট শুনিলে দয়ায় তাদের হৃদয় বিগলিত হয়। পিঞ্জরাপোলই করুক আর মন্দিরই তুলুক, তাদের হৃদয় আছে। সাহা, তেলী, সুবর্ণবণিক প্রভৃতির সহানুভূতি লাভে আমরা বঞ্চিত। ঐ সব ব্যবসায়ীদের মধ্যে যদি সমান ভাবে লেখাপড়ার বিস্তার হইত তবে দেশের কাজে ওদেরও সাড়া পাওয়া যাইত।

 বিগত শতাব্দীর সত্তরের কোটা পর্য্যন্ত আমাদের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের ন্যায় জাপানের সামুরাই জাতি সমস্ত সুবিধা একচেটিয়া করে রেখেছিল। সামুরাইরা জাপান জাতির মস্তক স্বরূপ, আমাদের দেশে যেমন ব্রাহ্মণ। ১৮৫৩ সালে যেদিন কমোডোর পেরী জাপানের তীরে এসে কামান পেতে অবাধ বাণিজ্যের দাবী করে বস্‌ল, সেদিন জাপানের চোখ্ ফুটল—জাপানীরা অবশ্য, তীর ধনুক নিয়ে বাধা দিতে দণ্ডায়মান হয়েছিল। কিন্তু ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে জাপানের Feudal System এর অবসান হ’ল—অভিজাত সম্প্রদায় স্বেচ্ছায় সমস্ত প্রভুত্ব, সম্রাটের পদতলে বিসর্জ্জন দিলৈন। সামুরাই Nobility—আমাদের যেমন ব্রাহ্মণ কায়েস্থ বৈদ্য—সমস্ত অলঙ্ঘনীয় ব্যবধান তুলে দিল। সমস্ত জাতি পরষ্পর সহানুভূতিতে এক হতে পারল। এতা ও হিনিন নামে দুইটী জাতি অস্পৃশ্য অতি ঘৃণিত বলে বিবেচিত হ’ত—আমাদের দেশের হাড়ি ডোম চামার প্রভৃতি হীন অনুন্নত ইতর শ্রেণীর সামিল—গ্রামের বাইরে তাদের বাস কর্‌তে হ’ত। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দের ১২ই অক্টোবর জাপানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়, স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। কারণ ঐদিনে আভিজাত্য দর্পে গর্ব্বিত সামুরাইগণ নিজেদের দেশভক্তি ও উন্নত হৃদয়ের প্রভাবে স্বেচ্ছায় আপনাদের সর্ব্ববিধ বিশেষ সুবিধা ত্যাগ করলেন—এতা ও হিনিন সম্প্রদায়কে আলিঙ্গন করে বল্লে “আজ থেকে সমস্ত জাপান এক—আমরা সব ভাই ভাই।”

 “Indian Caste” নামক পুস্তুকে জনৈক সাহেব লিখেছেন যে ভারতে অন্ততঃ পাঁচ হাজার রকম শ্রেণীবিভাগ বিদ্যমান—একই বৈদ্য, তা বিক্রমপুর আর কালনায় ক্রিয়াকর্ম্ম চল্‌বে না। সায়ান্স কলেজে দেখি দোবে চোবে ব্রাহ্মণরা ৪।৫টা উনুন করে রাঁধছে, একদিন বল্লাম, যে “তোমরা সবাইত বামুন—একত্র রান্না বান্না করলেই ত পার, তাতে খরচও কম পড়ে—কয়লা কম লাগে, পরিশ্রম কম লাগে—পালা করে রাঁধলেই ত পার।” উত্তরে তারা বল্ল যে ওত ঠিক বাত হ্যায় বাবুজি লেকেন হাম কনোজী বামন, অমুক ত গয়া জিলামে আতা হ্যায় ইত্যাদি।

 অনেক কুচক্রী বক্তৃতাবাগীশ সমাজপতির নাম আমি জানি— “আমার কাছে লিষ্ট আছে—যাদের যত লম্বা টিকি তারাই তত নষ্টের মূল—একেবারে in the direct ratio, গৃহ বিবাদে সব ত উৎসন্নে যেতে বসেছে!

 আমাদের পদে পদে বিপদ! সে দিন বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে কি কাণ্ডটাই না হয়ে গেল। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভিতর কত গলদ। ঢাকায় কিন্তু এক অপূর্ব্ব দৃশা দেখেছি—রমণার কালীবাড়ী ও মুসলমানদের মসজিদ খুব কাছাকাছি; কালীবাড়ীর ঢাকঢোল শঙ্খ ঘণ্টার নিনাদ ২।৪ রসি তফাতে মসজিদ থেকে খুব স্পষ্টই শোনা যায়; কৈ মুসলমানরাত তাতে কোনদিন টু শব্দটীও করে নি; সম্রাট জাহাঙ্গীর কিম্বা শায়েস্তা খাঁর অঙ্গুলী সঙ্কেতে কালীবাড়ী উধাও হয়ে যেতে পারত। সন্ধ্যাবেলা মসজিদে নামাজ এবং মন্দিরে ঢাক ঢোল শঙ্খ ঘণ্টা করতালের প্রকাণ্ড কলকোলাহলের মধ্যে সন্ধ্যা আরতি সম্পন্ন হয়।

 আজ কেন এই হিন্দু মুসলমানের বিবাদ, ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণের রেষারেষি দ্বেষাদ্বেষি—তাই বলছি সময় থাকিতে এখনও ঘর সামলাও। ঘর শত্রুতে রাবণ নষ্ট। আমরা স্বার্থত্যাগ করবো না, নিজেদের অন্যায় আবদার অধিকার ছাড়বোনা, কি করে বড় হ’ব, জাতি গড়ে তুলবো? জাপানে যা একদিন সম্ভব হয়েছে, ভারতে কি তা হবে না? অস্পৃশ্যতা পাপ হিন্দু ভারতবর্ষ ব্যতীত কোথাও পাবেন না। “Cleanliness is next to godliness” একথা কে অস্বীকার করবে? লিবিগ্ বলেছিল “Civilisation of a nation is measured by the amount of soap it consumes.” পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, হওয়া সকলের আগে চাই—কিন্তু হিন্দু সমাজ ত সে দিকে চায় না— ঊড়িষ্যা বা বিহার হইতে যে কেহ গলায় একগাছ দড়ি দিয়া আস্‌লেই হইল—সে যে জাতেরই হৌক না তা খোঁজ করবার দরকার নাই— গলায় দড়ি থাকলেই হ’ল। এই উড়ে বামুনদের 95 percent suffer from incurable and abominable diseases—শতকরা ৯৫ জন ঘৃণিত কুৎসিৎ ব্যাধিগ্রস্থ।

 মনীষী ইমার্সন বলেন “Only that good avails which we can share in common.” জাতিভেদের উপকারিতা হয়তঃ এককালে ছিল—এখন উহার মাহাত্ম্য একেবারে চলিয়া গিয়াছে। জানেন ত সেদিন প্রেসিডেন্সী কলেজের একটী promising চোখা ছেলে কোন তরুণীর প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করেছে—তথাকথিত শূদ্রশ্রেণী ও ব্রাহ্মণে বিয়ে হবে কি করে? “আলো ও ছায়া”র কবি বলিয়াছেন যে

“সংসারে দোহারে তাঁরা বাঁধিল হাতে হাতে।
বাঁধিতে নারিল তারা হৃদয় হৃদয় সাথে॥”

 বাঙালীর মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহারের আলোচনায় বলেছি যে বঙ্কিমচন্দ্র বলিয়াছেন যে “অবনতাবস্থায়ও বঙ্গমাতা রত্নপ্রসবিনী”—রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের নাম করে বঙ্কিমচন্দ্র ঐ কথা বলেছেন। বঙ্গমাতা যে রত্ন প্রসব করেছেন সে রত্ন মনু, যাজ্ঞবল্ক, পরাশর প্রভৃতি মন্থন ও আলোড়ন করে নবম বর্ষীয়া বিধবা নির্জ্জলা একাদশী না করলে তার উর্দ্ধ ও অধঃ কয় পুরুষ নিরয়গামী হবে তার সমাধান করেছেন— কেহ বা কাকচরিত্র রচনা করেছেন—প্রাতে দুই দণ্ড দশ পল গতে নৈঋত কোণে কাক কা কা রব করলে সেদিন কি প্রকারে যাবে— কেহ বা পাত্রাধার তৈল না তৈলাধার পাত্র, তাল পড়িয়া ঢিপ করে না ঢিপ করিয়া তাল পড়ে এই সব অমোঘ তত্ত্বের মীমাংসায় ব্যস্ত রয়েছেন—ঠিক এই সময়েই ইউরোপে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন প্রভৃতি মনস্বীগণ নব নব বৈজ্ঞানিকতত্ত্ব আবিষ্কারে ব্যস্ত ছিলেন।

 বঙ্গমাতা উপরোক্ত শ্রেণীর রত্ন যত কম প্রসব করবেন ততই দেশের মঙ্গল হবে। পৃথিবীর বৈঠকে ভাতরবাসীর স্থান কোথায়? প্যারিয়াকে যেমন আমরা কুকুর বিড়াল অপেক্ষাও অধম করিয়া ইতর অন্ত্যজ পঞ্চম শ্রেণীভুক্ত করে’ রেখেছি, তেমনি সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপই যেন পৃথিবীর বৈঠকে আমরা এক ঘরে হয়ে আছি। তাই আজ কায়মনোবাক্যে ভগবানের নিকট প্রার্থনা করা উচিত যে তিনি যেন অচিরে মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের মতন একজন যুগাবতার পাঠান, যিনি হিন্দু, মুসলমান, জৈন, খৃষ্টিয়ান সকলকে সমানভাবে দেখিবেন, ভগবান যেন অচিরে এইরূপ একজন অলোকসামান্য মহাপুরুষ প্রেরণ করেন।

  1. সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে ছাত্রসমাজের সমক্ষে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের মৌখিক বক্তৃতার সার মর্ম্ম।