আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/১৯
১৯
বাঙ্গালায় গো-ধনের
অভাব ও বাঙ্গালীর
স্বাস্থ্যনাশ
বিলাতে অনেকবার গিয়াছি; এবার পঞ্চমবার সেখানে পর্য্যটন করিয়া ফিরিয়া আসিলাম। পূর্ব্বে প্রায় রাসায়নিকের চক্ষে ইউরোপ দেখিয়াছি। কিন্তু আজ কয়েকবৎসর ধরিয়া বাঙ্গালীর অন্নসমস্যা ও তাহার সমাধান লইয়া আমি বহু চিন্তা করিয়াছি এবং সেই মর্ম্মে কত প্রবন্ধ লিখিয়াছি ও কত বক্তৃতা করিয়াছি। এইজন্য এবার আমি বাঙ্গালীজাতির (Physical deterioration) বা শারীরিক অবনতি এবং পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব (malnutrition) এবং তজ্জন্য বাঙ্গালীরা যে কি প্রকার হীনবীর্য্য ও অস্থিচর্ম্মসার হইয়া পড়িতেছে, তাহাই মনে রাখিয়া ইউরোপ সন্দর্শন করিয়াছি। মার্শেলিশ হইতে নামিয়াই, যে সমস্ত বালক বালিকাগণ প্রাতে বিদ্যালয়ে যাইতেছে, তাহাদের সবল স্বাস্থ্য ও স্ফূর্ত্তিব্যঞ্জক চেহারা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। প্যারিস নগরে অবস্থিতি কালেও মেয়ে ও ছেলেদের চেহারা দেখিয়া আমাদের দেশের সেই বয়সের মেয়ে ও ছেলেদের চেহারার পার্থক্য বুঝিতে আর বিলম্ব রহিলনা। আবার মার্শেলিশ হইতে যখন রেলগাড়ীতে প্যারিসনগরী চলিতে লাগিলাম, তখন দেখিলাম ফরাসী দেশও প্রকৃতপক্ষে গ্রীষ্মকালে সুজলা, সুফলা ও শস্যশালিনী,— দুইধারে কেবল শ্যামবর্ণ দীর্ঘ তৃণদল, কোথাও বা বিপুলকায়া গাভী চরিয়া বেড়াইতেছে এবং ইচ্ছামত শুইয়া রোমন্থন করিতেছে। সঙ্গে সঙ্গে আলু, গোধূম, দ্রাক্ষা প্রভৃতিরও চাষ। একটুকরা জমিও পতিত নাই। ফ্রান্সের দক্ষিণে আপেল, কমলালেবু প্রভৃতিও যথেষ্ট পরিমাণে জন্মে। লিও নগরী ও তাহার চতুঃপার্শ্ববর্ত্তী স্থান রেশমের চাষের জন্য বিখ্যাত।
যখন ক্যালে পার হইয়া ডোভারে পৌঁছিলাম এবং ডোভার হইতে লণ্ডনে রওনা হইলাম, তখনও অবিকল ঐ প্রকার দৃশ্য দেখিলাম। অনেকের সংস্কার যে ইংলণ্ড কেবল সহরময় এবং স্তুপীকৃত পাথর ও ইটের সমাবেশ। সত্য বটে, লণ্ডন বিশেষতঃ ম্যান্চেষ্টার, বার্ম্মিংহাম, লিভারপুল, নিউক্যাসেল প্রভৃতি সহর দেখিলে এই কথাই মনে হয়। কিন্তু এইসব সহর সমস্ত ইংলণ্ডের কতটুকু স্থান অধিকার করে? লণ্ডন হইতে মিডল্যাণ্ড রেলওয়ে (Midland Railway) দিয়া এডিনবরা যাইতে হইলে কেবলই দেখা যায় বিস্তীর্ণ তৃণপূর্ণ মাঠ। তা ছাড়া, সঙ্গে সঙ্গে নানাবিধ উদ্ভিদ ও তরীতরকারীর ক্ষেত। এক কথায় বলিতে গেলে, ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশে কৃষি শব্দে Cattle breeding বা পশুপালনও বুঝায়—এমন কি ইহাই তাহার প্রধান অঙ্গ। এই গ্রীষ্মকালে ঘাসের আবাদে প্রায় দুই কখন বা তিন কিস্তী ঘাস কাটিয়া শুকান হয়। এইজন্য ইংরাজীতে প্রবাদ আছে Make hay while the sun shines। এই শুষ্ক ঘাস রাশীকৃত করিয়া শীতকালে গরুর খোরাকের জন্য রাখা হয়। এতদ্ভিন্ন শালগম, গাঁজর, এবং এক প্রকার বৃহদাকার শালগম বিশেষ (mangel wurzel) এই সমস্ত চাষ করিয়া গরুর খাদ্যের জন্য সঞ্চয় করিয়া রাখা হয়। এতদ্ভিন্ন, গম, ওট, যব, বার্লি আদির বিচালী প্রভৃতিও যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়। লণ্ডনের সন্নিকটে একটি Dairy farm অর্থাৎ গো-শালা আমি দেখিতে গিয়াছিলাম। দেখিলাম উপরি লিখিত খাদ্যাদির সহিত প্রচুর পরিমাণে oilcake (খইল), ভূষি প্রভৃতি ব্যবহার হয়। এক একটা গাভী পনর সের হইতে আধ মণের কম দুধ দেয় না। ছয় বৎসর পূর্ব্বে একবার শীতকালে আমি যখন ইংলণ্ডে গিয়াছিলাম, তখন একটা গাভী একমণ দুধ একদিনে দিয়াছিল বলিয়া সংবাদপত্রে হুলুস্থুল পড়িয়া যায়।
আমার এই কয়টা কথা লেখার তাৎপর্য্য এই, যদি প্রকৃত পক্ষে কোন দেশে গো-পালন ও গো-সেবা থাকে, তাহা ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশে আছে। আবার গরুর কোনপ্রকার সংক্রামক ব্যাধি আছে কিনা (Foot and mouth disease, rinder pest), ইহার জন্য স্বাস্থ্যবিভাগ হইতে ইনস্পেক্টারগণ নিয়ত তদারক করিবার জন্য নিযুক্ত আছেন। কোনস্থানে সংক্রামক ব্যাধি দেখিলে তৎক্ষণাৎ সেই গরুকে গুলি করিয়া মারা হয় এবং তাহার দেহ ভস্মীভূত করা হয়, পাছে সংক্রামক ব্যাধি বিস্তার লাভ করে। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায়, আবাদ অঞ্চলে যখন ফসল উঠাইয়া লওয়া হয়, তখন গরু ও বলদ ছাড়িয়া দেওয়া হয়। এবং যদি গো-বসন্ত প্রভৃতি রোগ একবার দেখা যায়, তখন মনে করুন নদীয়া হইতে তাহার সংলগ্ন যশোহর, যশোহর হইতে তাহার সংলগ্ন খুলনা এবং খুলনা হইতে তাহার সংলগ্ন বরিশাল, ফরিদপুর প্রভৃতি স্থান পর্য্যন্ত গো-মড়ক উপস্থিত হয়। এই প্রকারে লক্ষ লক্ষ গরু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আমাদের দেশের চাষীরা শীতলার কৃপা বলিয়া হাত পা কোলে করিয়া বসিয়া থাকে।
লণ্ডনে-প্রাতে সাতটার পূর্ব্বে প্রতি গৃহস্থের বাড়ীর দরজার নিম্নে মুখ-আটা দুগ্ধপূর্ণ পাত্র দুধওয়ালারা রাখিয়া যায়। গৃহস্থ গাত্রোত্থান করিয়া সুবিধামত সেই দুধ ঢালিয়া লয়। আশ্চর্য্যের বিষয় এই, যদিও এই দুধ বাহিরে রাখিয়া চলিয়া যায়, তবু কেহ ইহা স্পর্শ করে না। ইহা ছাড়া পাড়ায় পাড়ায় Dairy অর্থাৎ “গব্যজাতের-ভাণ্ডার” আছে। ইংরেজেরা সেখান হইতে ইচ্ছামত দুধ, মাখন, কিনিয়া আনিতে পারে। ইংরেজ জাতি ‘গোখাদক’ বলিয়া বিখ্যাত। তা ছাড়া, তাহারা মেষ, শূকর, শশক ও নানাবিধ পক্ষীর (Partridge) মাংস প্রচুর পরিমাণে খায়। ইহা সত্ত্বেও ইংরাজদিগের শিশু সন্তান প্রধানতঃ দুগ্ধে পরিপুষ্টি লাভ করে এবং তাহারা নিজেরাও যথেষ্ট পরিমাণে দুগ্ধ পান করে।
এখন বুঝা যাক ইহারা কেন সবল। পুষ্টিকর খাদ্য ইহারা যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণ করে। আমি সম্প্রতি আয়রলণ্ডও ভ্রমণ করিয়াছি। ইহার একটি নাম এমারাল্ড আইল (Emerald Isle) অর্থাৎ সবুজ ঘাস পূর্ণ দ্বীপ। আয়রলণ্ডের কৃষিজাত দ্রব্যই প্রধান ধন। সেখানে কলকারখানা—কেবল মাত্র বেলফাষ্টে দৃষ্ট হয়। নিজেদের অর্থাৎ আইরিশদের অভাব মোচন হইয়া প্রচুর পরিমাণে মাখন, পণির ও ডিম্ব ইংলণ্ডে রপ্তানী হয়। হায় বাঙ্গলা! তোমার আজ কি দুরদৃষ্ট! তুমি ভারতের মধ্যে উর্ব্বরা ও সুজলা সুফলা বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছ। চাষ অর্থাৎ কৃষিজাত দ্রব্যই তোমার একমাত্র ধনসম্পত্তি। কিন্তু আজ আমি বাঙ্গলার যেখানেই যাই—বিশেষতঃ এই বর্ষাকালে, টাকায় দুই সের আড়াইসেরের বেশী দুধ মিলে না। তাহাও যথেষ্ট পরিমাণে নয়। এমনকি, একমণ, দুমণ দুধ সংগ্রহ করিতে হইলে অন্ধকার দেখিতে হয়।
আমাদের দেশের গরুর অবস্থা দেখিলে ক্রন্দন সম্বরণ করা যায় না। বিশেষতঃ পাটের চাষ বৃদ্ধি হওয়ার পূর্ব্বে যাহা কিছু গোচারণের মাঠ ছিল, তাহা বাজেয়াপ্ত হইয়া গিয়াছে। এখন গৃহস্থের গো-পালন করা একপ্রকার অসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে আমার ছেলেবেলায় অর্থাৎ পঞ্চাশ ষাট বছর পূর্ব্বে বাঙ্গালীর ঘরে গোয়ালভরা দুগ্ধবতী গাভী ছিল, আর এখন দেখা যায় অতি অল্প গৃহস্থেরই ঘরে গো-পালনের ব্যবস্থা আছে এবং গরুর খাদ্যের সুবন্দোবস্ত নাই বলিয়া সাধারণতঃ এক একটা গাভী আধ সের তিন পোয়া মাত্র দুধ দেয়। ইহারা কঙ্কালসার ও ক্ষুধাতুর। নিজের বাছুরকেই বা কি দিবে, এবং গৃহস্থকেই বা কি দিবে? আমার মনে হয় শীঘ্রই এমন আইন প্রচলন হওয়া দরকার, যাহাতে প্রত্যেক গ্রামে যথেষ্ট পরিমাণ গো-চারণের মাঠ সুরক্ষিত থাকে।
এই যে প্রায় পাঁচ কোটি বাঙ্গালী—ইহারা এবং ইহাদের শিশুগণ কতটুকু দুধ খাইতে পারে? দুধই সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর খাদ্য (A Perfect Food) অর্থাৎ ইহাতে শরীর গঠনের যাবতীয় উপাদান বিদ্যমান। শৈশবে ও বার্দ্ধক্যে দুগ্ধই প্রধান খাদ্য হওয়া উচিত। এই যে আজ বাঙ্গালীজাতির এই প্রকার শারীরিক অবনতি ও দুর্ব্বলতা তাহার প্রধান কারণ দুগ্ধের ন্যায় পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব। আর মাছের তো কথাই নাই। সর্ব্বত্রই দেখিলাম একটাকা পাঁচসিকার কমে সের মিলে না। বিশেষতঃ এবার পদ্মায় ইলিশ মাছেরও দুর্ভিক্ষ।
বাঙ্গালী আজ তাহার উদর শাকপাতা ডাটা প্রভৃতি কদর্য্য দ্রব্যে পরিপূর্ণ করে। অর্থাৎ, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে (raalnutrition) বাঙ্গালী জাতির সর্ব্বনাশ হইতেছে। আর এই যে ম্যালেরিয়া আষ্ঠেপৃষ্ঠে তাহাকে বাঁধিয়া ফেলিয়াছে, তাহারও প্রধান কারণ, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে তাহার resisting power বা রোগ বাধা দিবার ক্ষমতা হ্রাস পাইয়াছে। বারান্তরে বাঙ্গালী জাতির ঘোর দারিদ্র্যের বিষয় বলিবার বাসনা রহিল।