আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/২০
২০
বাঙ্গালী—মরণের পথে
(অর্থ-নৈতিক সমস্যা)
২০/২৫ বৎসর যাবৎ আমি নিরবচ্ছিন্ন চীৎকার করিয়া আসিতেছি যে, এই অন্নসমস্যার প্রশ্ন সমাধান করিতে না পারিলে, বাঙ্গালী জাতি ধরাপৃষ্ঠ হইতে বিলুপ্ত হইবে। গত ৫ বৎসর আমি উত্তর, পূর্ব্ব, পশ্চিম বাঙ্গালীর নগরে নগরে—এমন কি, গ্রামে গ্রামে পরিভ্রমণ করিয়াছি এবং আমার দৃষ্টি কেবল একদিকেই রহিয়াছে—বাঙ্গালীর শারীরিক শোচনীয় অবস্থা, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব। দুগ্ধ—যাহা শিশুদের একমাত্র পরিপোষক এবং যাহাতে অস্থি ও মাংসপেশী গঠনের সমস্ত উপাদান আছে,—তাহা পাড়াগাঁয়েও অনেক সময় টাকায় ৴২॥০ সের এবং তাহাও দুষ্প্রাপ্য। দরিদ্র, চাষা-ভূষার ছেলে-পিলে অনেক সময় ভাতের মাড় এবং ভদ্রঘরের সন্তানগণ বার্লি প্রভৃতির ‘লেই’ দিয়া কোন রকমে উদর ভর্ত্তি করে। এইগুলির শ্বেতসার (Starch) প্রধান উপাদান। ইহাতে কালসিয়াম, নাইট্রোজেন প্রভৃতি উপকরণ, যাহা অস্থি ও মাংসপেশী গঠনের প্রধান সহায় হয়, তাহা আদৌ নাই। বাঙ্গালী ছেলেদের বুকের (Chest) পরিধি দিন দিন সঙ্কীর্ণ হইয়া আসিতেছে এবং চেহারাও জীর্ণ-শীর্ণ,—ইহা যে কেবল ম্যালেরিয়াব্যঞ্জক তাহা নয়, পুষ্টিকর ও প্রচুর খাদ্যের অভাবও সূচনা করে। একটী মাত্র প্রবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করা অসম্ভব। আজ কেবলমাত্র এই কলিকাতা সহরের বাঙ্গালীদের অবস্থান বিষয়ে দুই চারিটী কথা বলিব।
গবর্ণমেণ্টের ও ইংরাজ-বণিকদের রিপোর্টে দেখা যায় যে, এই রাজধানী কলিকাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। অন্তর্ব্বাণিজ্য ও বহির্ব্বাণিজ্যের (Export and Internal Trade) অবস্থা দেখিলে মনে হয় যে, কলিকাতার ঐশ্বর্য্য দিন দিন কতই বাড়িতেছে। —বাড়িতেছে বটে, কিন্তু ‘বেল পাকিলে কাকের কি?’ আমি অনেকবার বলিয়াছি যে, কলিকাতার এই ধনাগম (Bank Deposit) এক্সচেঞ্জ মার্ট প্রভৃতির দ্বারা যাহা প্রতীয়মান হয়, তাহার শতকরা পাঁচভাগও বাঙ্গালীর নয়। একবার চিত্তরঞ্জন এভেনিউ দিয়া যাতায়াত করুন! দেখিবেন দুই ধারেই পাঁচতলা সৌধমালা দিন দিন উঠিতেছে। সেখানে জমি দশ হাজার হইতে পনর হাজার টাকা কাঠা। জিজ্ঞাসা কর, ইহার কয়টি বাঙ্গালীর? সমস্ত বড়বাজার, মুর্গীহাটা, এজরা স্ট্রীট, পোলক ষ্ট্রীট প্রভৃতির যত বড় বড় বাড়ী ও গুদাম ঘর, সমস্তই মাড়োয়ারী, ভাটিয়া, দিল্লীওয়ালা, পার্শি, আর্ম্মেনিয়ান ও ইহুদীদের অধিকৃত। এই গুলির দক্ষিণ হইতে সমস্ত চৌরঙ্গী রোড ইংরেজ বণিকদের করতলগত।
কলিকাতার যাবতীয় জুতা-নির্ম্মাতা হয় চীনা, না হয় পশ্চিমা। আমার এক জন আত্মীয়-যুবক, কলেজ ষ্ট্রীট মার্কেটে জুতার দোকান খুলিয়াছেন। তাঁহার তাঁবে পাঁচ ছয় জন পশ্চিম চামার কাজ করে। ইহারা প্রত্যেকেই সকাল হইতে কাজ সুরু করিয়া রাত্রি ৯টা ১০টা পর্য্যন্ত অবিরাম পরিশ্রম করে এবং এক জোড়া জুতা না শেষ করিয়া ছাড়ে না। আমি সেদিন জিজ্ঞাসা করিলাম, ইহাদের প্রত্যেকের রোজগার কত? উত্তর পাইলাম যে, এক জোড়া জুতা তৈয়ারীর মজুরী প্রত্যহ ১৷৷৵০ আনা অর্থাৎ মাসিক ৫০ টাকা। একজন ‘চীনা মিস্ত্রী’ ইহাদের অপেক্ষাও কর্ম্মঠ ও সুদক্ষ। ইহারা মাসিক একশত টাকার কমে কাজ করিতে রাজী হয় না। কলিকাতার যাবতীয় রাজমিস্ত্রীও পশ্চিমা। সুত্রধর অর্থাৎ ছুতারমিস্ত্রী চীনাদের সহিত প্রতিযোগিতায় দিন দিন হটিয়া যাইতেছে। চীনারা যে শুধু ভালকাজ দেয় তাহা নহে, ইহারা অধিক কষ্টসহিষ্ণু, মনিবের চোখের আড়াল হইলেও ফাঁকি দিতে জানে না। সুতরাং যদিও ইহারা বেশী মজুরী দাবী করে, P. W. D., রেলওয়ে প্রভৃতি বিভাগে কাজ ইহারা একচেটীয়া করিতেছে। এই সব চীনা মিস্ত্রী অশিক্ষিত এবং তাহারা কতদূর হইতে আসিয়া এদেশ জুড়িয়া বসিয়াছে। ইহাদের কেহ কেহ আবার কলিকাতা সহরে বিরাট কর্ম্মশালা (Carpentry) স্থাপন করিয়াছে। কলিকাতার যাবতীয় মোটর চালক ও মোটরের মিস্ত্রী প্রায়ই পাঞ্জাবী। ইহারা সংখ্যায় পাঁচ ছয় হাজারের কম হইবে না, ভবানীপুর অঞ্চলে বড় বড় উপনিবেশ সংস্থাপন করিয়াছে |
কলিকাতার যাবতীয় কুলী মজুর, রাঁধুনী বামুন, বেহারা, দারোয়ান, ডাকপিয়ন, কনেষ্টবল সমস্তই অবাঙ্গালী। আজকাল সমস্ত কলিকাতা ও সহরতলী—ভবানীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে যাবতীয় বড় বড় মিঠাইয়ের দোকানও পশ্চিমা হালুইকরগণ অধিকার করিয়াছে। আশ্চর্য্যের বিষয় এই এসমস্ত ক্ষেত্রেই বাঙ্গালী ছিল। গঙ্গা এবং অন্যান্য নদীতে যত মাঝি মাল্লা—তাহারাও বাঙ্গালী ছিল, এমন কি খেয়াঘাটওলা পর্য্যন্ত এখন পশ্চিমাদের। বজবজ হইতে আরম্ভ করিয়া ত্রিবেণী পর্য্যন্ত গঙ্গার দুই ধারে প্রায় ৮২টা পাটের কল আছে। বলা, বাহুল্য ইহার একটিও বাঙ্গালার নয়। মাত্র সম্প্রতি দুইটী মাড়োয়ারীরা খুলিয়াছেন। এই সমস্ত পাটের কলে অন্যূন চারি লক্ষ মজুর আছে। ১৯০৬ সালের একটি সরকারী রিপোর্টে প্রকাশ যে, ২০ বৎসর পূর্ব্বে (অর্থাৎ ১৮৮৬ সালে) ঐ সব কলে সমস্ত শ্রমিকই বাঙ্গালী ছিল; কিন্তু আজ শতকরা ৫ জন বাঙ্গালী হইবে কিনা সন্দেহ।
নিম্নলিখিত তালিকা হইতে দেখা যাইবে যে, কলিকাতায় অন্য প্রদেশ হইতে আগত অবাঙ্গালী এবং চীনাদের সংখ্যা কত এবং গত ৩০ বৎসরে তাহাদের সংখ্যা কিরূপ বাড়িতেছে:—
১৮৯১
১৯০১
১৯১১
১৯২১
কলিকাতায় ও সহরতলীতে অ-বাঙ্গালীদের শতকরা হিসাব ।
১৯২১
সমগ্র কলিকাতায় মিঠাইয়ের দোকানের সংখ্যা—৯৬৭টী, সহরের বিভিন্ন অংশে মিঠাইয়ের দোকানের সংখ্যা এইরূপ:—
(হেল্থ অফিসারের রিপোর্ট হইতে প্রাপ্ত।)
এই সমস্ত দোকানের মধ্যে পশ্চিমা হালুইকরের সংখ্যা দ্রুতবেগে বৃদ্ধি পাইতেছে। কবি গাহিয়াছিলেন—
নিজ বাসভূমে পরবাসী হলে
পর দাসখতে সমুদায় দিলে।
যদিও এ কয়টি কথা রাজনৈতিক পরাধীনতার সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইয়াছে, কিন্তু আজ অর্থনৈতিক হিসাবে দেখিলে মনে হয় যে, বাঙ্গালীর মুখের গ্রাস অ-বাঙ্গালীরাই কাড়িয়া লইতেছে। অর্থাৎ কেবল যে, ব্যবসা-বাণিজ্য হইতে বাঙ্গালী বিতাড়িত হইয়াছে তাহা নহে, তৎসংক্রান্ত শ্রমিকের কাজ হইতেও তাহারা বহিষ্কৃত হইয়াছে। এমন কি যাহা বাঙ্গালীর এক মাত্র নিজস্ব বলিয়া গর্ব্ব করা হইত— সেই কেরাণীগিরি হইতে মাদ্রাজীরা আসিয়া বাঙ্গালীকে ক্রমশঃ অপসারিত করিতেছে।
বিদেশী রেলী ব্রাদার্স প্রভৃতি অবশ্য চাউলের প্রধান রপ্তানিকারক। কিন্তু অ-বাঙ্গালী কচ্ছী মেমনেরা প্রধানতঃ এই কারবার চালায়। ইহারা অনেকে ইংরাজীও জানে না, কিন্তু ক্রোড়পতি। কলিকাতার যত বড় বড় জহুরী, তাহারা হয় গুজরাটী জৈন, অথবা সিন্ধী হিন্দু!
বাঙ্গালার যে কি সর্ব্বনাশ হইতেছে, তাহা নিম্নলিখিত হিসাব হইতে সহজেই বোধগম্য হইবে। বাঙ্গালাদেশে ২২ লক্ষ অ-বাঙ্গালী। কলিকাতায় মাড়োয়ারী, ভাটিয়া প্রভৃতি যাহারা কায়েমী বসতবাটী করিয়াছেন, কেবল তাঁহারাই সপরিবারে বাস করিতেছেন। অবশিষ্টাংশ সকলেই এখানে একাকী আসিয়া অর্থ উপার্জ্জন করে। যদি এই ২২ লক্ষ হইতে স্ত্রীলোক ও শিশু দুই লক্ষ বাদ দেওয়া ঘায় তাহা হইলেও ২০ লক্ষ রোজগারক্ষম অ-বাঙ্গালী বাঙ্গালাদেশে ধরিতে হইবে। সহরের যাবতীয় ধনাঢ্য মাড়োয়ারী, ভাটিয়া প্রভৃতির তো কথাই নাই। বাঙ্গালাদেশে পাট, ধান, সরিষা, ভুষিমাল, এ সমস্তের কারবারই এখন প্রধানতঃ মাড়োয়ারীদের হাতে এবং যাবতীয় আমদানী ও রপ্তানীর অধিকাংশ মুনাফা ইহাদের লভ্য। অবশ্য এখানে ইংরাজ বণিকদের কথা বলিতেছি না। এখন এই বিশলক্ষ অ-বাঙ্গালীর মাসে গড়পড়তা রোজগার ৫০ টাকা ধরিলে বোধ হয় অযথা হইবে না। ২০ লক্ষ লোকের গড়পড়তা রোজগার ধরিলে প্রতিমাসে অন্ততঃ ১০ কোটী টাকা এবং বৎসরে ১২০ কোটী টাকা অ-বাঙ্গালীর হাত দিয়া বাঙ্গালাদেশ হইতে শোষিত হয়। আর অধিক কি বলিব।
প্রায় এক পক্ষকাল খুলনার সন্নিকটে সিদ্ধিপাশা, দৌলতপুর, নৈহাটী, বাগেরহাট প্রভৃতি স্থানে ঘুরিয়া স্বগ্রাম রাড়ুলী কাটীপাড়ায় কয়দিন যাবৎ অবস্থিতি করিতেছিলাম। সিদ্ধিপাশায় আসিয়া শুনিলাম গত আশ্বিন কার্ত্তিক মাসে চারি শত লোক এক প্রকার ভীষণ কালান্তক ম্যালেরিয়া রোগে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে। আজুগড়া এবং অন্যান্য স্থানেও এই প্রকার মহামারী হইয়া গিয়াছে। গ্রামবাসীদিগের মধ্যে যাহারা “কৃতী” অর্থাৎ একটু ইংরাজী লেখা পড়া শিখিয়াছে, তাহারা অন্নচিন্তায় দেশ বিদেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। যাহারা গ্রামে পড়িয়া রহিয়াছে তাহারা এক প্রকার নির্জীব, অলসভাবে—তাস, পাশা খেলিয়া, দিবাতেও এক দফা গাঢ় নিদ্রার পর পরকুৎসা এবং কাহাকে “এক ঘরে” করিবে, মামলা মোকর্দ্দমা করিয়া কি প্রকারে উচ্ছন্ন যাইবে ইত্যাদি ব্যাপারে দিন কাটাইতেছে। অর্থাৎ শ্রীযুত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পল্লী সমাজে’ অঙ্কিত চিত্র সর্ব্বত্রই প্রযোজ্য। জলাশয়গুলি ইতিমধ্যেই শুকাইয়া আসিতেছে। আর দুই এক মাস পরে কেবল অনেক স্থলে লোকেরা ‘কাদার গোলা’ পান করিবে; সেই জল আবার গো-মহিষাদি পঙ্কিল করে। স্ত্রীলোকগণও স্নানের সময়ে সেই জলে মূত্র ত্যাগ করে এবং নানাবিধ সংক্রামক ব্যাধির সংসৃষ্ট কাপড়, কাঁথা কাচে। এই কারণেই কলেরা, আমাশয়, প্রভৃতি রোগ ছড়াইয়া পড়ে। এই গেল এক দফা।
সম্প্রতি গো মড়ক এখান হইতে বরাবর দক্ষিণ সুন্দরবন সন্নিকটস্থ আবাদ পর্য্যন্ত বিস্তৃত। মড়কে গো জাতি এক প্রকার নির্ব্বংশ হইয়া আসিয়াছে। খুলনায় দুধ বার আনা পর্য্যন্ত পাকী সের দরে বিক্রয় হইয়াছে। গ্রামগুলিতেও এক প্রকার দুধের দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছে। কেহ বলিতে পারেন এটা সাময়িক দুর্ঘটনা (Special Case), কিন্তু সাধারণ (Normal) অবস্থাও নিতান্ত শোচনীয়। খুলনায় এবং অন্যান্য জিলার সহরে ছয় আনা সেরে হামেসা দুধ বিক্রয় হয়। ভাবী বাঙ্গালী জাতির জীবনী শক্তি ইহাতে কি প্রকারে হ্রাস হইয়া যাইতেছে, তাহা যাঁহারা রসায়ণ শাস্ত্র ও শরীরবিদ্যার তত্ত্ব কিছু অবগত আছেন তাঁহারা সম্যক বুঝিতে পারেন। এখন শিশুদিগকেও বার্লী, মেলিন্স ফুড (Mellins food) দিয়া ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করান হয়। অবশ্য যাহারা একটু অবস্থাপন্ন তাঁহারা বিলাতী জমা দুধ (Condensed milk) হরলিক সাহেবের তৈয়ারী (Horlick's milk) ইত্যাদি ব্যবহার করেন কিন্তু এই দৈন্য প্রপীড়িত বাঙ্গালীর কয়জন যাহাদের দৈনিক আয় মাত্র ৴৬ পয়সা ইহা যোগাইতে পারে? ফলকথা, শিশুদিগের অস্থি ও মাংস গঠনের একমাত্র উপযুক্ত খাদ্য দুগ্ধ। আমি বন্যপ্লাবিত রাজস্যহী জেলার আত্রাই অঞ্চল হইতে নদীয়া, যশোহর ও খুলনার গো-জাতির দুর্দ্দশা দেখিয়া অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারি না। ইহাদের আকৃতি যেমন খর্ব্ব, দেহ তেমনি জীর্ণশীর্ণ কঙ্কালসার। খাদ্যাভাব ও পালনে অযত্ন ইহার প্রধান কারণ। এখন আর গোচারণের মাঠ নাই, তাহা ছাড়া গৃহস্থগণের অবহেলা, শ্রমবিমুখতা ও তাচ্ছিল্য এই দুর্দ্দশার জন্য দায়ী। আমার নিজ গ্রামের ৬০ বৎসরের পূর্ব্বের অবস্থা নখদর্পণের ন্যায় দেখিতেছি। তখন দুধের সের দুই পয়সা ছিল এবং প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়ীতে গোয়ালভরা সবলকায় গরু থাকিত। একজন অশীতিবর্ষ বৃদ্ধের মুখে শুনিলাম ১২৬৫ সালে তিনি ক্রিয়া কর্ম্মের জন্য ৫৲—৬৲ টাকা মণ মূল্যে ছানা ক্রয় করেন এবং ইহারও কিছু পরে খাঁটী স্বগন্ধযুক্ত ঘৃত টাকায় ৴১৷০ পাঁচ পোয়া করিয়া মিলিত। তিনি বলিলেন—এবং আমারও এই ধারণা ও অভিজ্ঞতা— যে এখনকার যুবকগণ ও কুলবধূরা গরুর জাব দেওয়া, গোয়াল পরিষ্কার করা —এক কথায় যাহাকে গো-সেবা বলে—তাহা এক প্রকার ছাড়িয়া দিয়াছে। তখন আবার প্রত্যেকের বাড়ীতে তিনটা চারিটী করিয়া বিচালীর গাদা গরুর খোরাকীর জন্য মজুত থাকিত।
এখনকার স্কুল-কলেজের পড়া ছেলেরা গো-সেবা করিতে নিজেকে হেয়জ্ঞান করে, কাজেই দুধ খাইতে পায় না। এক ভ্রান্তিমূলক সংস্কার যে, গরু অনেক জবাই হয় বলিয়া দুধের পরিমাণ কমিতেছে। ইংরাজ জাতির মত গো-খাদক জাতি আর নাই; কিন্তু ইংলণ্ডে গরুর যত্ন ও পালন কত বেশী তাহা বলা যায় না। সেখানে গরুর জন্য ঘাসের ও গাঁজর এবং প্রকাণ্ড মূলা জাতীয় “Mangel Wurzel” প্রভৃতির স্বতন্ত্র চাষ হয়। এক একটা গরুর আধ মণ দুধ হয়। ঠিক ছয় বৎসর পূর্ব্বে আমি যখন লণ্ডনে ছিলাম, তখন একটা গরু একদিন ৩/৪ বার দোহনের পর একমণ দুধ দিয়াছিল। লণ্ডন, ম্যানচেষ্টার, লীডস্ প্রভৃতি সহরে যেখানে শীতকালে বরফ পড়ে, সেখানে শয্যোথ্থানেরও পূর্ব্বে গৃহস্থের ঘরে ঘরে প্রচুর পরিমাণে দুধ আসিয়া বিলি হয় এবং রাস্তায় রাস্তায়, Dairyতে দুধ, ক্রিম, মাখন অজস্র পাওয়া যায়। ইংলণ্ডে যদি কখনও গো-মড়কের সূত্রপাত হয়, তখনই হুলুস্থুল পড়িয়া যায়,—Anthrax, Foot and mouth-disease, প্রভৃতি সংক্রামক রোগ যাহাতে না ছড়াইতে পারে, তৎক্ষণাৎ তাহার প্রকৃষ্ট উপায় লওয়া হয়। আক্রান্ত পশুকে একেবারে পৃথক করিয়া ফেলা হয় এবং অনেক সময়ে তৎক্ষণাৎ তাহাকে হত্যা করিয়া ভস্মসাৎ করা হয়। কিন্তু আমরা, হিন্দুই হই, আর মুসলমানই হই—মা শীতলা ও মাণিক পীরের দোহাই দিয়া মানত করি বা জড়ভাবে বসিয়া থাকি। এদিকে এই প্রকারে জেলাময় গোজাতি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ এক একবার গো-মড়কে যত গরু হারাই, ইংরাজরা সম্বৎসরে খাইয়া তাহার এক ভগ্নাংশও নষ্ট করিতে পারে না। যদি খাইলেই জাতি ধ্বংস হইত তাহা হইলে মুরগী ও তাহার ডিম এতদিন অপ্রাপ্য হইত।
খাদ্যের পক্ষে আর এক সর্ব্বনাশ উপস্থিত। আমার ছেলেবেলায় এ অঞ্চলের নদী সকল মাছে পরিপূর্ণ ছিল। আধমণী বড় বড় ভেটকী কথায় কথায় মিলিত। ‘এক পুঁজী’ (নয়টা) বড় গল্দা চিংড়ী ৪/৫ পয়সায় পাওয়া যাইত, এখন তাহা চোখে দেখা দায় এবং তাহার মূল্য অন্ততঃ নয় আনা। আমাদের দেশে ধীবরেরা অজ্ঞ, মূর্খ। তাহারা জাল ফেলিয়া চুণা, পুঁটি ও বড় মাছ সবই তুলিয়া ফেলে। ইংলণ্ডের নদী সকলে বাচ্চা মাছ ধরা নিষেধ। আমেরিকা ও ইংলণ্ডের মাছের চাষের (Pisciculture) জন্য বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত আছেন। ষ্টীমার ও রেলওয়ে হইয়া গ্রামের সমস্ত মাছ ঝাঁটাইয়া কলিকাতাভিমুখে চলিয়া যাইতেছে; দেশের লোকের জন্য কিছুই থাকে না। ফলকথা মাছ দুধই বাঙ্গালীর প্রধান পুষ্টিকর খাদ্য ছিল এবং তাহার অভাবই স্বাস্থ্যহানির প্রধান কারণ। পুষ্টিকর খাদ্য এখন দেব-দুর্ল্লভ। বাঙ্গালীর উদর এখন শাক, পাতা অর্থাৎ নটে শাক, কলমী শাক, পুঁইশাক, থোড় ইত্যাদির দ্বারা পূর্ণ হইতেছে। সামান্য ছোট চিংড়ী, চুণামাছ ইহার সহিত মিশ্রিত করিয়া এবং অপর্য্যাপ্ত লঙ্কা ও সরিষা বাটনা দিয়া চচ্চড়ী প্রস্তুত করিয়া কতক স্ত্রীলোক মনের প্রবোধ দেন যে, তাঁহারা সধবা।
আর এক সর্ব্বনাশ উপস্থিত। কলিকাতায় এখন মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান এবং এই সংক্রামক ব্যাধি মফঃস্বলের কলেজে এবং গ্রামেও বিস্তার হইতেছে; কেবল ঢক্ ঢক্ করিয়া যুবকগণ চা পান করে। চার খাদ্য হিসাবে কোন মূল্য নাই, কেবল স্নায়ুর উত্তেজক মাত্র ও অজীর্ণ রোগের আকর। সেদিন বাগেরহাট কলেজে ছেলেদিগকে এই প্রকার বিষ পান করিতেছে কেন জিজ্ঞাসা করিলাম। ইহারা প্রতি পেয়ালা চার পয়সা দিয়া ক্রয় করে। আমি বলিলাম যদি একসের চিড়া ৷৹ ও একসের নূতন গুড় ৶৹ (যাহা সেখানে যথেষ্ট মিলে) একবারে ক্রয় করিয়া রাখ তবে অন্যূন পনর দিনের জলখাবার সংস্থান হয়। এবং প্রতিবার দুই পয়সা হিসাবে পড়ে। আর ইহার সহিত যদি একটা কলা ও একটু নারিকেল কোরা মিশাইতে পার তাহা হইলে সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর হয় অর্থাৎ রাসায়নিকভাবে ইহাকে perfect food কহে। একটা “দুম্যো” অর্থাৎ যাহার শাঁস একটু শক্ত হইয়াছে এরূপ নারিকেল দুইদিন ভাগ করিয়া খাওয়া যায়; তাহা ছাড়া আমি নিজে সর্ব্বদাই নূতন পয়রা গুড়ের (আমাদের এখানে মৌঝোলা গুড় বলে), তৈয়ারী মুড়ির চাক্তী বড় টিনের কোঁটায় মচমচ অবস্থায় সংরক্ষিত করি এবং প্রত্যহ উপাদেয় বলিয়া আহার করি। “ডাব” “দুম্যো” ও “ঝুনা” নারিকেল খাদ্য হিসাবে মূল্যবান্। আমি স্বয়ং এইগুলির রাসায়নিক বিশ্লেষণ (Chemical analysis) করিয়াছি। ইহাদের শাঁসে তৈলাক্ত পদার্থ প্রচুর আছে। বাঙ্গালীর ঘরে এখন ঘি একপ্রকার দেখাই যায় না, আর তৈলও যাহা ব্যবহার হয় তাহা কলের। কিন্তু এই নারিকেল কোরায় যথেষ্ট তৈলাক্ত উপকরণ বিদ্যমান; এমন কি ইহাকে ঘৃতের বিনিময় (Substitute) বলা যায়। নারিকেল কোরা গালিয়া যে ‘দুধ’ বাহির হয় তাহাতে আমড়া দিয়া উত্তম অম্বল তৈয়ার হয় এবং নারিকেলের যে সমস্ত মেঠাই—রসকরা, চন্দ্রপুলি যেমন মুখরোচক তেমনি খাদ্য হিসাবে পুষ্টিকর। অবশ্য এখনও পাড়াগাঁয়ে ইহার চলন আছে, কিন্তু সহরের শিক্ষণ ও সভ্যতাভিমানী বাঙ্গালী-যুবকগণের কপাল পুড়িয়াছে; তাহারা ডাবের জলটুকু খাইয়া আসল জিনিষটা ফেলিয়া দেন; এমন যে সুন্দর ‘নেওয়াপাতি’ তাহা আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এই প্রকারে দেখা যায় কলিকাতার এক একটা ডাবের দোকানে স্তুপীকৃত ছেঁদা করা ডাব গড়াগড়ি যাইতেছে। এমন রুচির বিকার হইয়াছে যে, ডাব কাটিয়া তাহার শাস খাইলে পাছে লোকে ছোটলোক বলে এই ভয়ে আসল জিনিষটুকু খাইতে সাহস হয় না। হায়রে বাঙ্গালী! তুমি কি কুগ্রহের পাকে সকলই হারাইতে বসিয়াছ।
নারিকেলের প্রস্তুত মিঠাই খাওয়া এখন সহরে এক প্রকার ফ্যাসন বিরুদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং ঘৃতপক্ক নানাবিধ খাবার না হইলে চলে না। এই ‘ঘৃত’ যে কি তাহা বলাই বাহুল্য। ইহাতে খাঁটি ঘৃত কতটুকু! গরুর চর্ব্বি, শুকরের চর্ব্বি, বড় বড় অজগরের চর্ব্বি, সময়ে সময়ে তাহা ভিন্ন মাটীবাদাম, মহুয়া প্রভৃতির তৈল থাকে। আর খাবারগুলি যে প্রকার অনাবৃত রাখে, মাছি ভন্ ভন্ করিতেছে ও ধূলায় ধূসরিত হইতেছে। সত্য বটে কাঁচের আধারের ভিতরে রাখিবার নিয়ম, কিন্তু সে কেবল আইন বাঁচান মাত্র। আজ কাল খাঁটি ঘি ৩৲ টাকা সেরের কম মিলে না তাহা দ্বারা প্রস্তুত মিঠাই রাজরাজড়া, আমীর, ওমরাহ ভিন্ন অন্যের সাধ্যায়ত্ত নহে। কিন্তু ফ্যাসানের ধন্য মহিমা! এই সমস্ত ভেজাল অভক্ষ্য মিষ্টীন্ন খাইব, তবুও নারিকেলের প্রস্তুত দ্রব্যাদি ছুঁইয়া হীনতার পরিচয় দিব না। চিড়া, মুড়ি ও খইতে ভেজাল চলে না, কিন্তু এ সব জিনিষ শিক্ষিত যুবকগণের অনুপাদেয়, অখাদ্য ও অস্পৃশ্য। সম্প্রতি College of Science এ আমার ছাত্রগণকে একটা ভদ্রলোকের দোকান হইতে ফরমাইস দিয়া প্রায় সাড়ে তিনশত টাটকা মুড়ির মোয়া আনিয়া খাইতে অর্পণ করি। আমার উদ্দেশ্য এই যে এই প্রকারে ইহার ব্যবহার প্রচলিত হউক এবং বর্তমান কুরীতিগুলিও দেশ হইতে অন্তর্হিত হউক। এ বিষয়ে এত লিখিবার আছে যে এক প্রবন্ধে তাহা সমাপন করা দুঃসাধ্য।