আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/১৬

১৬

বাঙ্গালা ভাষায় নূতন

গবেষণা

 রাজসাহীর সাহিত্য-সম্মিলন সভায় (সভাপতির অভিভাষণ, সন ১৩১৫) আমি বলিয়াছিলাম যে, “আমরা যতদিন স্বাধীনভাবে নূতন নূতন গবেষণায় প্রবৃত্ত হইয়া মাতৃভাষায় সেই সকল তত্ত্ব প্রচার করিতে সক্ষম না হইব, ততদিন আমাদের ভাষার এই দারিদ্র্য ঘুচিবে না”। এই কথা বলিবার একটু কারণ ছিল। তাহার আলোচনা প্রসঙ্গে আমাকে বুঝাইতে হইয়াছিল যে, যদিও অর্দ্ধ শতাব্দীর অধিককাল ধরিয়া বাঙ্গালা ভাষায় বৈজ্ঞানিক গ্রন্থসকল প্রচারিত হইতেছে, তবু ইহাতে বিশেষ কিছু ফললাভ হয় নাই কেন? আমি বলিয়াছিলাম, একাদশ বা দ্বাদশবর্ষীয় বালকদিগের গলাধঃকরণের জন্য যে সকল বিজ্ঞানপাঠ প্রচারিত হইয়াছে, সে সকলের দ্বারা প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের ইষ্ট কি অনিষ্ট সাধিত হইতেছে, তাহা ঠিক বলা যায় না। আসল কথা, এই বিজ্ঞানের প্রতি একটা আন্তরিক টান না থাকিলে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২।৩টি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় বিশেষ ফললাভ হয় না। সম্প্রতি এক ধূয়া উঠিয়াছে যে, বহু অর্থ-ব্যয়ে যন্ত্রাগার (Laboratory) প্রস্তুত না হইলে বিজ্ঞান শিক্ষা হয় না, কিন্তু বাঙ্গালা দেশের গ্রামে ও নগরে, উদ্যানে ও বনে, জলে ও স্থলে, প্রান্তরে ও ভগ্নস্তূপে, নদীতে ও সরোবরে, তরুকোটরে ও গিরিগহ্বরে, অনন্ত পরিবর্ত্তনশীল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অভ্যন্তরে জ্ঞানপিপাসুর যে, কতপ্রকার সম্বন্ধ বিষয় ছড়াইয়া রহিয়াছে, তাহা কে নির্ণয় করিবে? বাঙ্গালার দয়েল, বাঙ্গালার পাপিয়া, বাঙ্গালার ছাতারের জীবনের কথা কে লিখিবে?

 এতদিন পরে ১৩২৮ বঙ্গাব্দে এই প্রশ্নের সদুত্তর পাইয়াছি। প্রেসিডেন্সী কলেজের ভূতপূর্ব্ব ছাত্র শ্রীমান সত্যচরণ লাহার “পাখীর কথা” আমাকে যেন এক নূতন আশার বাণী শুনাইয়াছে, পুস্তক খানি পাইয়া আমি আদ্যোপান্ত পড়িয়া ফেলিলাম। পড়িতে পড়িতে যুগপৎ আনন্দে বিস্ময়ে এমন অভিভূত হইলাম যে, কিছুকালের জন্য আমার প্রিয় রসায়ন-শাস্ত্র-চর্চ্চার কথা বিস্মৃত হইতে হইল। আমাদের দেশে যাঁহারা ধনীর সন্তান হইয়া জন্ম গ্রহণ করেন, তাঁহারা তাঁহাদের “কর্ম্মহীন সুদীর্ঘ অবসরে” কি প্রকারে কালাতিপাত করেন, তাহা পাঠকবর্গের অবিদিত নাই। বহিখানি পাঠ করিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে, ইহার রচয়িতার দৈনন্দিন জীবনের Atmosphere (বেষ্টনী) ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিজ্ঞান সাধনার অনুকূল। ইচ্ছা হইল, একবার স্বচক্ষে তাহা ভাল করিয়া দেখিয়া আসি। যে পক্ষিভবনে (Aviary) তাঁহার সযত্ন সংগৃহীত বিহঙ্গগুলি উদ্যানমধ্যে পালিত হইতেছে, তাহা দেখিবার জিনিষ; যে লতাকুঞ্জের অভ্যন্তরে ময়ূরগুলি বিচরণ করিতেছে, তাহা দর্শকের চক্ষু এড়াইতে পারে না। পুষ্পভবনে বিচিত্র বিদেশী পরগাছা (Orchid) শোভা পাইতেছে। স্বতন্ত্র বড় বড় পিঞ্জরে ছোট বড় পাখী সেবা পাইতেছে। তাঁহার পাঠাগারের ও বসিবার ঘরের দেওয়ালে তাঁহারই নির্দ্দেশমত অঙ্কিত বড় বড় চিত্রে পাখীর জীবনলীলা ফুটাইয়া তোলা হইয়াছে। কাচের আলমারীর মধ্যে বিহঙ্গ-শব Stuffed হইয়া যেন জীবন্ত ভাব ধারণ করিয়া আছে; শুনিলাম, তাহার অনেকগুলি শ্যাংহাই হইতে আনীত। জীবন্ত পাখী সম্মুখে রাখিয়া তাহার চিত্রকর যে ছবিগুলি আঁকিয়াছেন, তাহা কোনও পাশ্চাত্য পাখীর ছবি অপেক্ষা কোনও অংশে হীন নহে। আমি দেখিলাম যে, আমার অনুমান মিথ্যা নহে। বুঝিতে পারিলাম যে, আমাদের দেশের হাওয়া ফিরিয়াছে।

 য়ুরোপে দেখা যায় যে, যাঁহারা জ্ঞানরাজ্যের সীমান্ত-রেখা নিজ নিজ প্রতিভাবলে সুদূর প্রসারিত করিয়াছেন, তাঁহারা একটা না একটা খেয়াল বা নেশার বশবর্ত্তী হইয়া তাহাতেই আপনাদিগকে উৎসর্গ করিয়া থাকেন। হোয়াইট (White) এর Natural History of Selbourne পাঠ করিলে বুঝিতে পারা যায়, কেমন করিয়া একজন মধ্যবিত্ত পাদ্রী কতকগুলি বিহঙ্গের হাবভাব স্বভাব (Habits) ও জীবনকাহিনী সূক্ষ্মভাবে পর্য্যবেক্ষণ করিয়া এক অপূর্ব্ব গ্রন্থ রচনা করিয়া চিরস্মরণীয় হইয়াছেন। Swallow জাতি কি প্রকারে নীড় রচনা করে এবং কোন সময়ে তাহারা ইংলণ্ডে আইসে এবং শীতের প্রারম্ভে জীবন রক্ষার্থ কোথায় চলিয়া যায়;—এই সকল বিচিত্র ঘটনা লিপিবদ্ধ করিয়া বিহঙ্গতত্ত্ববিদগণের মধ্যে তিনি উচ্চ আসন অধিকার করিয়া জনসাধারণ কর্ত্তৃক সমাদৃত হইয়া আসিতেছেন। আমাদের “পাখীর কথা” রচয়িতা যথার্থই বলিতেছেন,—“তত্ত্বলাভের তীব্র বাসনা য়ুরোপীয় বালকবৃন্দকে যে কেবল দেশীয় পক্ষীর পালন ব্যাপারে লিপ্ত করিতেছে, তাহা নহে; তাহারা বহু বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া নানাবিধ বিদেশীয় পক্ষীকে সাবধানে ও সযত্নে স্বদেশে আনয়নপূর্ব্বক অনভ্যস্ত প্রকৃতি-প্রতিকূল জলবায়ু কৃত্রিম উপায়ে অভ্যাস করাইয়া কৃত্রিম খাদ্যাদির সাহায্যে উহাদিগের পুষ্টিসাধন করিয়া বৈদেশিক পাখীগুলির জীবনলীলা পর্য্যবেক্ষণের যথেষ্ট অবসর পাইতেছে। এমন কি, কোন কোন তত্ত্বজিজ্ঞাসু কেবল বৈদেশিক পক্ষিপালনে নিযুক্ত থাকিয়া ধারাবাহিকরূপে উহার জীবন-রহস্য উদ্ঘাটনের নিমিত্ত আপনাদিগের জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন।”

 য়ুরোপবাসীদিগের মধ্যে যাঁহারা পুরাকালে ভারতবর্ষে সিভিলসার্ভিস্ এ প্রবেশলাভ করিয়া উচ্চপদস্থ হইতেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চাঙ্গের পক্ষিতত্ত্ববিদ্ বলিয়া গণ্য হইয়াছেন। ইঁহারা সরকারী কাজে ব্যস্ত থাকিয়াও স্ব স্ব খেয়ালের বশবর্ত্তী হইয়া অবসরমত ভারতবর্ষের নানাজাতীয় বিহঙ্গের বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন। যে মিষ্টার হিউম্‌কে (A. O. Hume) আমাদের ন্যাশন্যাল কংগ্রেসের জন্মদাতা বলিয়া সকলেই জানেন, তিনি যে পাখীর বিষয়ে পুস্তক রচনা করিয়া য়ুরোপীয় প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন, তাহা বোধ হয় অল্প লোকই জ্ঞাত আছেন। তাঁহার রচিত Nests and Eggs of Indian birds নামক বৃহৎ পুস্তকের উল্লেখ মাত্র করিলেই যথেষ্ট হইবে। স্বনামখ্যাত ডগলাস দেওয়ারের (Douglas Dewar) নাম পক্ষিবিজ্ঞান বিভাগে সুপরিচিত।

 যে সকল মনীষী প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনে আপনাদিগকে উৎসৃষ্ট করিয়াছেন, তাঁহাদের বিষয় পর্য্যালোচনা করিতে বসিতে স্বতঃই হিউবারের (Huber) কথা মনে পড়ে। ইনি প্রায় দেড়শত বৎসর পূর্ব্বে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন এবং মক্ষিকাতত্ত্ববিদ্‌ বলিয়া বিদ্বজ্জন সমাজে প্রথিতনামা। যৌবন কালে ইনি চক্ষুরত্ন হইতে বঞ্চিত হয়েন; কিন্তু তাঁহার সহধর্ম্মিণী স্বামীর চক্ষুস্বরূপ হইয়া মধুমক্ষিকা জীবনের সমস্ত বৃত্তান্ত আদ্যোপাত্ত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লক্ষ করিতেন। সেই মনস্বিনী নারীর পরীক্ষণের উপর নির্ভর করিয়া তদবলম্বনে হিউবার অনেক বৎসর ধরিয়া অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ‘Natural History of the Bees’ নামক একখানি সুন্দর গ্রন্থ রচনা করেন। এই যে আজকাল আমরা কথায় কথায় queen bee, drone, মৌমাছি ও পিপীলিকা জাতির republicএর কথা এতটা জানি, তজ্জন্য ইঁহার নিকটে আমরা কৃতজ্ঞ; কারণ, ইনি একজন প্রধান পথপ্রদর্শক। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, এক একটি খেয়াল পোষণ করিতে না পারিলে অনেক সময় জীবন মধুময় হয় না। সার জন লাবক (Sir John Lubbock, পরে Lord Avebury) একজন ধনী শ্রেষ্ঠীর সন্তান এবং প্রসিদ্ধ রাজনীতিজ্ঞ পণ্ডিত বলিয়া পরিগণিত। কিন্তু তাঁহার এই কর্ম্মবহুল জীবনের মধ্যেও তিনি ‘Ants, Bees and Wasps’ নামক এমন একখানি বহি লিখিয়া ফেলিয়াছেন, যাহা পাঠ করিলেই বুঝিতে পারা যায়, কি বিপুল ধৈর্য্য ও অক্লান্ত পরিশ্রম সহকারে গ্রন্থকর্ত্তা পিপীলিকা ও মক্ষিকাগণের জীবনলীলা পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছেন; তাঁহার এই খেয়াল ছিল বলিয়াই তিনি পুস্তকান্তরে Pleasures of Life ও Beauties of Life নিপুণ ভাবে চিত্রিত করিতে সমর্থ হইয়াছেন। হেন্‌রী ক্যাভেণ্ডিসের নাম জড়বিজ্ঞানে অদ্বিতীয়। ইনি ইংলণ্ডের অভিজাত-শ্রেণীর মধ্যে সর্ব্বোচ্চ কৌলীন্য-মর্য্যাদাসম্পন্ন একজন ডিউর্কের পুত্ত্র (Duke of Devonshire); ইনিও এক খেয়ালের বশবর্ত্তী হইয়া, পার্থিব সুখ-সম্পদ তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া আজীবন পরীক্ষাগারে (Laboratory) কালাতিপাত করেন এবং নিউটনের ন্যায় তদ্গতচিত্ত হইয়া জড়তত্ত্বের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন করিতে পারিয়াছেন। সংসারধর্ম্ম করিবার অবসর পর্য্যন্ত ইনি পান নাই। একদিন ব্যাঙ্ক অব ইংলণ্ডের জনৈক প্রতিনিধি সহসা তাঁহার পরীক্ষাগারে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, “মহাত্মন্! ব্যাঙ্কে আপনার এক কোটী টাকা মজুত; আপনি আদেশ করিলে আমি তাহা সুবিধামত খাটাইবার বন্দোবস্ত করি।” সাধকের তপোভঙ্গ হইল। তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া আগন্তুকের প্রতি এমন ভ্রুকুটী কুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন যে, সে ব্যক্তি উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া তথা হইতে পলায়ন করিল। আবার বৎসরান্তে ব্যাঙ্ক তাঁহার টাকার কথা তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিলে, তিনি বিরক্ত হইয়া উত্তর করিলেন—“দেখ যদি তুমি ফের আমাকে বিরক্ত কর, তাহা হইলে তোমার কাছ থেকে প্রত্যেক পাই পয়সাটি পর্য্যন্ত তুলে নে’ব (Look here Sirrah! If you trouble me again I shall withdraw every farthing from your Bank)”। আভিজাত্যাভিমানী Salisbury সেসিল-বংশধরগণ (House of Cecil), মারলবরো বংশীয়েরা (The Churchills) ও অন্যান্য অনেক বড় বড় কুলপতি বিদ্যাবুদ্ধি, রাজনীতিকুশলতায় কাহারও অপেক্ষা এখন ন্যূন নহেন। ধনবান্ চিকিৎসকের সন্তান চার্লস ডার্বিণ (Charles Darwin) বহু বৎসর পরিশ্রম করিয়া বিবর্ত্তনবাদ, বা ক্রমবিকাশ বাদ প্রচার করিতে পারিয়াছিলেন। ফলতঃ আজীবন এই রকম একটী খেয়ালের বশৱর্ত্তী হইয়া থাকা, একনিষ্ঠ সাধক হইয়া বিজ্ঞানানুশীলনে রত থাকা কেবল য়ুরোপেই দেখা যায়, তবে জাপানও য়ুরোপের পশ্চাদানুসরণ করিতেছে।

 এইত গেল য়ুরোপীয়ের কথা। এ সকল কথা আমি তুলিতাম না, যদি আজ আমার মনে একটু আশার সঞ্চার না হইত। আমাদের দেশের অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেও এই সু-লক্ষণ দেখা যাইতেছে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীর কথা উত্থাপন করা নিষ্প্রয়োজন। দর্শন, কাব্য, গদ্য, সাহিত্য,সঙ্গীত, চিত্রবিদ্যা, অর্থাৎ যাহা কিছু কলা বিদ্যা নামে অভিহিত, সমস্তই ঠাকুর বাড়ী হইতে উৎসারিত হইতেছে। আহ্লাদের বিষয়, ক্ষলিকাতার প্রসিদ্ধ লাহা পরিবারের মধ্যে লক্ষ্মী ও সরস্বতী দ্বন্দ্ব ভুলিয়া গিয়াছেন। শ্রীমান্ নরেন্দ্রনাথ প্রত্নতত্ত্ব আলোচনায় কায়মনোবাক্যে আপনাকে নিয়োজিত করিয়াছেন; শ্রীযুত ভবানীচরণ নিপুণ চিত্রশিল্পী হইয়াছেন; শ্রীমান সত্যচরণ পক্ষিবিজ্ঞানে ভারতবাসীর পথপ্রদর্শক হইলেন।

 এতদিন আমাদের দেশের পাখীর তথ্য জানিতে হইলে বিদেশী গ্রন্থ উদ্ঘাটন করা ভিন্ন উপায়ান্তর ছিল না। শতাধিক বর্ষ পাশ্চাত্য শিক্ষা এতদঞ্চলে প্রচলিত হইলেও প্রাণিবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও জীবতত্ত্ব বিষয়ে আমাদের রুচি আদৌ স্ফুরিত হয় নাই। এ স্থলে ইহাও স্মরণ রাখা উচিৎ যে, পুরাতন হিন্দু কলেজের প্রথিতনামা অধ্যাপক রামচন্দ্র মিত্র, ১৮৩৪ খৃষ্টাব্দে ‘পক্ষিবিবরণ’ নামক ৬৬০ পৃষ্ঠা পরিমিত একখানি গ্রন্থ সঙ্কলন করেন। কিন্তু বড়ই আক্ষেপের বিষয়, এই ৮৭ বৎসরের মধ্যে এদিকে কাহারও মন যায় নাই। আবহমান কাল হইতে হতভাগ্য বাঙ্গালীর ছেলে মেয়েরা কেবল মাত্র মুখস্থ বা কণ্ঠস্থ বিদ্যাকে পরমার্থ জ্ঞান করিয়া আসিয়াছে। ফলে এত দিন এ দেশীয়ের মস্তিষ্ক এক প্রকার অসাড় ও নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। প্রাণিতত্ত্ব বিষয়ে যে দুই একখানি গ্রন্থ বাঙ্গলা ভাষায় ইতঃপূর্ব্বে রচিত হইয়াছে, তাহা প্রায়ই ইংরাজী পুস্তকের অনুবাদ মাত্র, এমন কি, সহিমুহুরী নকল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

 সত্যচরণের ‘পাখীর কথা’ সে দলের নহে, গ্রন্থকার স্বয়ং নানা শ্রেণীর পাখী প্রতিপালন করিয়া তাহাদের habits দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, মাতোয়ারা হইয়া পর্য্যবেক্ষণ করিয়া যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছেন, তাহার বহু নিদর্শন এই পুস্তকের মধ্যে, এবং বোম্বাইএর ও বিলাতের নানা বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় দিয়াছেন। বুলবুল পাখীর Albinism ও Melanism লক্ষ্য করিয়া এই বিচিত্র রহস্যময় বর্ণ-বিপর্যয়ের সম্যক পরিচয় ইনিই সর্ব্ব প্রথমে পক্ষিবিজ্ঞান জগতে প্রচার করিয়াছেন। এই সমস্ত খণ্ড প্রবন্ধের বিষয় আপাততঃ ছাড়িয়া দিলেও গ্রন্থকারের এই প্রথম প্রকাশিত বাঙ্গালা পুস্তকে পাখী সম্বন্ধে যথেষ্ট মৌলিক গবেষণার পরিচয় পাওয়া যায়। কোনও ইংরাজ পণ্ডিতও এ-দেশীয় পালিত অথবা বস্তু বিহঙ্গের পরিচয় এমন ভাবে দিবার চেষ্টা করেন নাই। পাখী পুষিতে হইলে কি কি করা চাই, পোষা পাখীর পর্য্যবেক্ষণ কিরূপ হওয়া উচিৎ, আবদ্ধ অবস্থায় প্রসূত বর্ণ সঙ্করের বন্ধ্যত্ব দোষ থাকে কি না, পাখীর সহজ সংস্কারের পশ্চাতে কোনরূপ বিচার বুদ্ধি আছে কি না, কৃত্রিম পক্ষীগৃহে নীড়স্থ ডিম্বগুলি হইতে একই সময়ে কি উপায়ে শাবক বাহির করিতে হয়,—এই সমস্ত অত্যন্ত কৌতূহলপ্রদ রহস্যময় ঘটনার বিবৃতি ও আলোচনা অন্যান্য বহু অবশ্য জ্ঞাতব্য বিষয়ের মধ্যে যথাযথ পুস্তকের প্রথম ভাগে সুবিন্যস্ত রহিয়াছে। তরুণ, গ্রন্থকারের লিপি চাতুর্য্যও বিশেষ প্রশংসার্হ। দ্বিতীয় ভাগে ব্যবহারিক পক্ষিতত্ত্ববিষয়ক এমন অনেক কথা সুনিপুণ ভাবে আলোচিত হইয়াছে, যাহা পাঠ করিলে পাঠক বর্গের কৌতূহল চরিতার্থ হইতে পারে এবং বোধ হয় কৃষিজীবী বাঙ্গালীর উপকারে আসিতে পারে। তৃতীয় ভাগে কালিদাস সাহিত্যে বিহঙ্গ-পরিচয় বিষয় আলোচিত হইয়াছে। ইহাতে শুক্, সারী, চক্রবাক্, কুররী প্রভৃতি বিহঙ্গ কুলের পরিচয় দেওয়া হইয়াছে। প্রত্যেক পাখীকে সনাক্ত (Identify) করিবার জন্য গ্রন্থকার যে, কেবল সংস্কৃত সাহিত্য ও অভিধান মন্থন করিয়াছেন, তাহা নহে; য়ুরোপীয় বিশেষজ্ঞগণের রচনা হইতে ভূরি ভূরি প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়াছেন। কবিবর হেমচন্দ্র, সেক্‌সপীয়ারকে উদ্দেশ করিয়া বলিয়াছেন—“ভারতের কালিদাস, জগতের তুমি।” অবশ্য মানব প্রকৃতি বর্ণনায় ইংরাজ কবি অতুলনীয়; কিন্তু আমার বোধ হয় যে, Nature বা নিসর্গ চিত্র অঙ্কনে ভারতের কবির সমকক্ষ কেহ নাই। আমি পূর্ব্বে বুঝিতে পারি নাই যে, মহাকবি কালিদাস বিহঙ্গ জাতির স্বভাব-চরিত্র, যাযাবরত্ব প্রভৃতি এত সূক্ষ্ম ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লক্ষ্য করিয়াছেন।

 উপসংহারে বক্তব্য এই যে, গ্রন্থকার বাঙ্গালা ভাষায় এই পুস্তক প্রচারিত করিয়া মাতৃভাষাকে বিশেষ সমৃদ্ধিশালিনী করিয়াছেন। আশা করি, নবীন লেখক Ornithology বা পক্ষিতত্ত্বের নূতন নূতন তত্ত্ব উদ্ঘাটিত করিয়া আমাদের জ্ঞান ভাণ্ডার পূর্ণ করিতে থাকিবেন।