আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/১৫

১৫

জাতীয় বিদ্যালয়ের

প্রয়োজনীয়তা।[]

মাননীয় সভাপতি ও সমাগত ভদ্রমহোদয়গণ,—

 এই মেদিনীপুরের প্রান্তে উপস্থিত হইবার পর হইতে আপনারা যেরূপ বর্ষাকালের বৃষ্টির ন্যায় আমার মস্তকোপরি কৃপাবারি বর্ষণ করিতেছেন তাহাতে আমি অভিভূত হইয়াছি। বাস্তবিক আপনারা আমার প্রতি যে ভাষা প্রয়োগ করিয়াছেন আমি তাহার সহস্রাংশের একাংশেরও উপযুক্ত নহি। ইহা আপনাদের দয়া ও সহৃদয়তার চিহ্ন মাত্র। আমি আগন্তুক, তাই অতিথি সৎকারের ভাজন হইয়াছি। যাহা হউক এই ব্যক্তিগত বিষয় লইয়া আর আপনাদের সময় নষ্ট করা উচিত নহে।

 এই যে মহতী সভা—এই সভায় উপস্থিত হইবার পর আমার মনে অনেক নূতন ভাবের উদ্রেক হইতেছে। আমি বাংলাব যে অংশে থাকি তাহা ব্রাহ্মণ-কায়স্থ প্রধান স্থান। সেখানে এক রকম দেখিতেছি। আমার জীবনের যে প্রধান সাধনা তাহা এখানে কিয়ৎপরিমাণে সিদ্ধির পথে উপস্থিত হইয়াছে দেখিয়া ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। এখানে মাহিষ্য সমাজের প্রাধান্য, তাহা ছাড়া আপনারা এই সভায় পৌণ্ড্র, ক্ষত্রিয়, নমঃশূদ্র, তন্তুবায় প্রভৃতি সমাজের প্রতিনিধিগণকে আহ্বান করিয়াছেন। ইহাতে দেখা যাইতেছে যে মহাত্মা যে আদর্শ দেখাইতেছেন তাহা এখানে প্রতিফলিত হইতেছে। মহাত্মা গান্ধী যে কত বড় একজন পুরুষ, কেন যে তিনি শুধু ভারতে নয় অনেক সুসভ্য দেশেও যুগাবতার বলিয়া গণ্য হইতেছেন তাহা আমরা বুঝিতে পারিতেছি।

 জাতীয় শিক্ষা—কেন আমি এখানে আসিয়াছি? কোন্ ডাকে আসিয়াছি? আপনাদের জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রীযুক্ত পরেশনাথ মাইতি ৪।৫ মাস পূর্ব্বে আমাকে আহ্বান করিয়াছিলেন। আমি মেদিনীপুরের শ্রীযুক্ত সাতকড়িপতি রায়কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম “আপনাদের জেলায় কলাগেছিয়া বলিয়া কোন জায়গা আছে? তিনি বলিলেন “হাঁ, আছে, সেখানে কয়েকজন ত্যাগী যুবক আছেন, তাঁহারা অন্য জীবনোপায়ের পথ না রাখিয়া দেশের উন্নতির জন্য অনেক চেষ্টা করিতেছেন।” ভগীরথ যেমন শঙ্খনিনাদ করিয়া মর্ত্তে গঙ্গা আনয়ন করিয়াছিলেন, আপনাদের জাতীয় বিদ্যালয়ের সম্পাদক জগদীশবাবুও সেইরূপ বিদ্যারূপিণী গঙ্গাকে আপনাদের দ্বারে আনিয়াছেন। আপনারা এক এক ঘটী না হউক এক এক গণ্ডুষ পূত সলিল গ্রহণ না করিলে বড়ই ক্ষোভের বিষয় হইবে।

 আমি জাতীয় বিদ্যালয়ের জন্য এ দেশ সে দেশ ঘুরিয়া বেড়াই কেন? বরিশাল, বিক্রমপুর প্রভৃতি অনেক জায়গায় গিয়াছি। এখানেও আমার আসার কি প্রয়োজন ছিল? আমি ত আজীবন “গোলামখানায়” দাসখত লিখিয়া বসিয়া আছি। ২৫।২৬ বৎসর চাকুরী করিয়া পেন্সন ভোগ করিতেছি। বাংলার ভূতপূর্ব্ব গবর্ণর লর্ড রোণাল্ডসে স্বয়ং আমাকে পত্র লিখিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টের মেম্বার করিয়া দিয়াছেন। আমি বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অবৈতনিক অধ্যাপক। এইরূপে আমি অনেকগুলি “গোলামখানার” সহিত সংশ্লিষ্ট রহিয়াছি! যাঁহারা খুলনা জেলার কোনও খবর রাখেন তাঁহারা জানেন আমি খুলনার অনেক স্কুলের (affiliated) অনুষ্ঠাতারূপে পরিগণিত, এবং সেখানকার বাগেরহাট কলেজের সহিতও সম্পর্কিত। সেই আমি—আমার কি অধিকার এই জাতীয় বিদ্যালয়ে আসিয়া দাঁড়াই! ইহার কৈফিয়ৎ আপনারা চাহিতে পারেন। যে মাতাল, যে মদের নেশায় সর্ব্বস্বান্ত, মদ খাওয়ায় কত অনিষ্ট সে যেমন জানিতে পারে শুধু বইতে মদের অপকারিতা পড়িয়া কেহই তেমন জানিতে পারে না! তাহা বলিয়া আমি গবর্ণমেণ্টের স্কুল কলেজ পরিত্যাগ করিতে বলিতেছি না। কিন্তু জাতীয় শিক্ষা সম্বন্ধে আমি অনেক চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি এবং তাহার যে উপযোগিতা কি—বিশেষতঃ আপনাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে—তাহা আমি বিশেষরূপে উপলব্ধি করিয়াছি।

 আমি গোলামখানার সহিত সম্পর্কিত হইলেও মুসলমানগণ আমাকে আলিগড় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাধি বিতরণ (Convocation) উপলক্ষে ডাকিয়া পাঠাইলেন। হাকিম আজমল খাঁ প্রথমে ঐ জন্য আমাকে তার করেন। আমি জানাইলাম আমার কাজ অনেক, এখন যাওয়া সম্ভব নহে। তখন হাকিম আজমল খাঁ ও ডক্তার আন্‌সারী উভয়ে মিলিয়া আমাকে বিশেষ অনুরোধ করিয়া পাঠাইলেন। তাঁহাদের অনুরোধ উপেক্ষা করিতে পারিলাম না। কয়দিন পরেই সেই আমিই আবার সবরমতী গুজরাট বিদ্যাপীঠে—যেখানে মহাত্মার আশ্রম—তাহার ভিত্তি সংস্থাপনের জন্য আহূত হই। এবারও চুপ করিয়া থাকিতে পারি নাই। এ বড় অদ্ভুত! বাংলা দেশেও যত জাতীয় বিদ্যালয় আছে সব স্থান হইতে আহ্বান পাই। কি কারণ? কেন আসি? শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁহারা বিদ্রূপ করেন তাঁহারা বলেন জাতীয় বিদ্যালয়গুলি মরিয়া গেল—অনেকগুলি উঠিয়া গিয়াছে—২।৪টা মাত্র শ্বাস টানিতেছে— ও-গুলিকেই বা রাখিয়া দরকার কি? কলাগেছিয়া জাতীয় বিদ্যালয় উঠিয়া গেলে আপনাদের অনেক ক্ষতি হইবে। বাংলা দেশে জাতীয় বিদ্যালয় টেকে না কেন? অতি সহজেই ইহার উত্তর দেওয়া যায়। ইহার কারণ বাংলার ব্রাহ্মণ বলুন, কায়স্থ বলুন, বৈদ্য বলুন, ইহাদের লেখাপড়া শিখিবার মূলমন্ত্র চাকুরী। আবার অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই রোগ সংক্রমিত হইতেছে। ইহার ফলে এই দাঁড়াইয়াছে যে একজন গ্রাজুয়েট ৩০৲ টাকাও উপায় করিতে অক্ষম। কিন্তু একজন কুলী ইহা অপেক্ষা অধিক উপার্জ্জন করে। তাহা বলিয়া লেখাপড়া বাদ দেওয়া উদ্দেশ্য নয়। এত চাকুরী কোথায় পাওয়া যাইবে? রজনী সেনের একটী গান মনে পড়ে যাহার অর্থ এই যে আদালতে মক্কেলের চেয়ে উকীল বেশী। গানটী এই—

“উকীল”

দুর্দ্দশার কি দিব ফর্দ্দ?
দেখ হয়েছি বেহায়ার হদ্দ;
কাজ যত, তার ত্রিগুণ উকীল,
মক্কেল তাহার অর্দ্ধ।”

আবার গবর্ণমেণ্টও ব্যয়-সংক্ষেপ করিতেছেন। চাকুরীর সংখ্যা বরং কম হইবে কিন্তু বাড়িবে না। যে কয়জন বৎসরের মধ্যে মরে বা পেন্সন পায়,ততটী চাকুরী খালি হয়। আবার মাহিষ্য, বারুই প্রভৃতি জাতি শিক্ষায় অগ্রসর হইতেছে। আর মুসলমান ভ্রাতাদের ত কথাই নাই। হাজার হাজার গ্রাজুয়েট—হাজার হাজার চাকুরী কোথায় পাওয়া যাইবে! চাকুরীকে উদ্দেশ্য করিলে চলিবে না। তারপর আমেদাবাদেই বা জাতীয় বিদ্যালয় ভাল চলে কেন? গুজরাটে জাতীয় বিদ্যালয়ে ছাত্রের স্থান সঙ্কুলান হয় না। সেখানে গিয়া একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখিয়া আসিয়াছি। আমাকে এক জায়গায় স্কুলের কর্ত্তৃপক্ষ সদর রাস্তায় লইয়া গেলেন। সেনাপতি যেমন সৈন্য পরিদর্শন করেন, সেইরূপ দেখিলাম প্রায় ১০ হাজার নিম্ন প্রাথমিক ছাত্র-ছাত্রী সারি দিয়া আমার সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল। আমেদাবাদে এক জায়গায় একটী উচ্চ শ্রেণীর জাতীয় বিদ্যালয়ে দুই হাজার ছাত্র পড়ে। ইহার কারণ অন্য কিছু নয়, কেবল গুজরাটে সকলেই ব্যবসায়ী। ব্যবসাই তাহাদের অবলম্বন। মাড়োয়ারী, ভাটিয়া, গুজরাটীদের জিজ্ঞাসা করুন—লেখাপড়া শিখিয়া কি চাকুরী করিবে? তাহারা বলিয়া বসিবে—আমরা কি বাঙ্গালী বাবু যে চাকুরী করিব, নোক্‌রী করিব? হয়ত আপনাকে প্রহার করিতে আসিবে। গুজরাটে, আমেদাবাদে ও বোম্বাইএ কাপড়ের কলের মালিকগণ যুদ্ধের সময় শতকরা ১৫০/২০০৲ টাকা মুনফা পাইয়াছে। শ্রীযুক্ত নরোত্তমদাস মোরারজি শোলাপুরের একটী কলের ম্যানেজিং এজেণ্ট, তিনি অংশীদারগণকে শতকরা হাজার টাকা মুনফা দিয়াছেন। বাংলার ধন কি? যদি এক বৎসর অজন্মা হয়, প্রজা খাজনা না দেয়, তবে কতজন জমিদার আছেন, যাঁহারা “মহামহিম শ্রী—” না লিখিয়া থাকিতে পারেন? এই ত আমাদের দেশে বর্দ্ধমান মহারাজার নীচেই কাশিম বাজারের মহারাজা। তিনি এক কোটী টাকার জন্য একটী ইউরোপীয় কোম্পানীর নিকট জমিদারী বন্ধক দিতে বাধ্য হইতেছেন। বোম্বাইয়ে এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁহারা এককোটী টাকার চেক্ হাসিতে হাসিতে দিতে পারেন। বাঙ্গালী যদি জীবন সংগ্রামে জয়লাভ করিতে চায়, তবে তাহাকে ব্যবসা অবলম্বন করিতে হইবে। বাংলার যা কিছু রক্ত, যা কিছু সার তাহা বিদেশীগণ শোষণ করিয়া লইতেছে। বাংলার অন্নসমস্যার সমাধানের জন্য আমি অনেক প্রতিষ্ঠানের সহিত জড়িত আছি। আমি স্কুল মাষ্টার—অনেক সময় বলি যাঁহারা স্কুলে শিক্ষকতা করেন তাঁহাদের মাথায় কিছুই নাই। তাঁহারা সংসারে অনভিজ্ঞ। তাঁহারা অনেক সময় ন্যায়শাস্ত্র ও স্মৃতির পণ্ডিতের ন্যায় এক হাতে কাছা, এক হাতে গাড়ু লইয়া গ্রামান্তরে চলিয়া যান। সংসারের কোনও ব্যাপারই তাঁহারা বুঝিতে পারেন না। আমি স্কুল মাষ্টারের নিকট স্কুল মাষ্টার, ব্যবসায়ীর নিকট ব্যবসায়ী। আমি ৮টী যৌথ কারবারের সহিত সংশ্লিষ্ট। তাহাদের মূলধন ৫০ লক্ষ টাকা। আমার প্রিয় বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের বর্ত্তমান মূলধন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। ৩০ বৎসর পূর্ব্বে উহা মাত্র ৮০০৲ টাকা লইয়া আরম্ভ করি। একদিন আমার ছোট ভাইর উপর চিনি কিনিবার ভার দেই। সে শ্যাম বাজারের এক ডাক্তারখানার বিলের টাকা হইতে বড় বাজারে গিয়া চিনি সওদা করিবে, তবে আমি সিরাপ প্রস্তুত করিব। ট্রামের ভারা ৪ পয়সা জুটিল এক পয়সা জুটিল না! লেখা পড়ার সহিত ব্যবসার অনেক পার্থক্য। বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠার সময় কুমিল্লার এক ব্রাহ্মণ সন্তান আদালতে পিয়াদা হইবার জন্য আবেদন করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ পরিশ্রম করিতে পারিবে না বলিয়া মুন্সেফ তাঁহার আবেদন নামঞ্জুর করেন। সেই তাঁহার সৌভাগ্য। চাকুরী করিলে তিনি হয়ত আজ মাসে ১৫৲ টাকা বেতন পাইতেন। এই ব্রাহ্মণ-সম্ভান বিফল মনোরথ হইয়া নিজের পায়ের উপর দাঁড়াইতে প্রস্তুত হইলেন। তিনি ব্যবসা করিয়া এখন বৎসরে প্রচুর অর্থ উপার্জ্জন করিতেছেন এবং তাঁহার অধিকাংশ উপার্জ্জন কুমিল্লার শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে ব্যয় করেন। তিনি তাঁহার স্বচরিত ‘ব্যবসায়ী’ নামক পুস্তকে সমস্ত ব্যক্ত করিয়াছেন। ইনি কলিকাতার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ঔষধবিক্রেতা শ্রীমহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। তাঁহারও মত, পয়সা উপার্জ্জন করিতে হইলে স্কুল কলেজে অধিক লেখাপড়ার কোনও আবশ্যক থাকে না! এই যে পিতামাতা অনাহারে থাকিয়া, এমন কি বিধবা মাতা গায়ের গহনা বন্ধক দিয়া পুত্রকে মাসে ৪০।৪৫৲ এমন কি মেডিকাল কলেজে পড়িবার জন্য মাসে ৬০৲ টাকা দিয়াও কলিকাতা পাঠান, তাহাতে শ্রীমানদের ইহকাল পরকাল যায়। তাহারা একেবারে অকর্ম্মণ্য হইয়া পড়ে। তাহারা থিয়েটার দেখে, সিনেমা দেখে, গায়ে পাঞ্জাবী, হাতে রিষ্ট ওয়াচ, পায়ে পামসু, পরণে মিহি কাপড়, আর নাদুশ নুদুশ নন্দদুলালের মত চলন। তাহারা ছুটীতে বাড়ী আসিলে যেমন সাহেবদের গ্রেহাউণ্ড কুকুর দেখিয়া গ্রাম্য কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করিতে থাকে, তেমনি পল্লী গ্রামের গো-বেচারা ছেলেরা তাহাদের দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া তাকাইয়া থাকে। সহুরে ছেলেরা গ্রামে কত রকম ফ্যাসান দেখান, তাঁহারা থিয়েটার দেখান, তাঁহাদের কতরকম সেভিং এপারেটাস দেখান, সঙ্গে সঙ্গে আবার Hazel Snow. এখনকার ছেলেরা একবেলা রান্না করিয়া খাইতে পারে না। এই সকল অকর্ম্মণ্য পুতুল লইয়া দেশের কি কাজ হইতে পারে? ননীর পুতুল হইয়া পড়ে বলিয়া আমাদের ছেলেরা ব্যবসা করিতে পারে না। আপনাদের সব ছেলে কলেজে বিদ্যা দিগ্‌গজ্ হইয়া মুন্সেফ, ডেপুটী, কেরাণী হইলে আপনাদের সব ক্ষেত পড়িয়া থাকিবে। তাই আমি বলি এখানে যদি জাতীয়ভাবে শিক্ষা হয়, জাতীয়তা রক্ষা হইবে, দেশাত্মবোধ জাগ্রত হইবে। একটা জাতীয় বিদ্যালয় ও একটী গবর্ণমেণ্ট বিদ্যালয়ের মধ্যে তফাৎ কি? আমি আমার গ্রামের স্কুলের স্থায়িত্বের জন্য কিছু সম্পত্তি দান করিয়াছি। একা গবর্ণমেণ্ট প্রায় ৪৫ হাজার টাকা গৃহ নির্ম্মাণের জন্য দান করিয়াছেন। ইন্‌ম্পেক্টর স্কুল গৃহ দেখিয়া বলিলেন যে, ইহা Finest building in Khulna, and one of the finest buildings in Bengal. কিন্তু আমার মন আর গ্রামমুখী হইতে ইচ্ছা করে না। আমি সেই স্কুলের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু কেহ মানুষ হয় নাই। পাশাপাশি গোলামখানা ও জাতীয় বিদ্যালয় থাক্‌—তাহাদের মধ্যে অনন্ত তফাৎ দাঁড়াইবে। জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রেরা মাথা উঁচু করিয়া থাকে, ইহাদের মধ্যে দেশমাতৃকার প্রতি ভালবাসা জাগ্রত, ইহারা নয়-নারায়ণের সেবায় সর্ব্বদা ব্যগ্র।

 জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সব সময় জানে যে ত্যাগ স্বীকার করিতে হইবে। দুর্ভিক্ষ আর বন্যায় তাহারাই সর্ব্বাগ্রে অগ্রসর হয়। খুলনার দুর্ভিক্ষের জন্য ৩ লক্ষ টাকা ও উত্তর বঙ্গের জল-প্লাবনের জন্য ৭ লক্ষ টাকা দেশবাসী আমার হাতে সমর্পণ করিয়াছিলেন। এই সমস্ত টাকাই আমাকে ব্যাঙ্কে জমা দিতে হইত অথবা দাতাদিগের নিকট ফেরত দিতে হইত যদি জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র ও কংগ্রেস কর্ম্মিগণ আমাকে অম্লানবদনে অকাতরে সাহায্য না করিতেন। এই সব স্বেচ্ছাসেবক আসিয়াছিলেন ফরিদপুর, মাদারিপুর, বাজিতপুর, বিক্রমপুর ও বরিশাল হইতে। খুলনার নয়, যশোহরের নয়, পশ্চিম বাংলার নয়, মেদিনীপুর হইতেও বেশী পাই নাই। এখনও ৫০।৬० জন স্বেচ্ছাসেবক সেই সকল স্থানে কাজ করিতেছেন। আপনাদের এই জাতীয় বিদ্যালয়টীকে রক্ষা করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। কিন্তু তাহা বলিয়া আমি ৯০০ শত affiliated স্কুল ভাঙ্গিতে চাই না। আপনাদের অধিকাংশ কৃষিজীবী, কৃষিই আপনাদের প্রধান উপজীবিকা। নিজের হাতে জমি চাষ করিতে হইবে, নিজেকে কোদাল ধরিতে হইবে—তবেইত ঠিক মানুষ হইবে।

 ভাটিয়া, মাড়োয়ারীরা আমাদের দেশকে জয় করিয়াছে কেন? আর আমরা কলমপেশা হইতেছি কেন? লজ্জাই আমাদের সর্ব্বনাশের কারণ। আমরা এমন বিলাসী যে একটা ইলিশ মাছ বাজারে যদি॥৵০ আনায় কিনি তবে কুলী করিয়া আনিতে ৵৹ লাগে। আর যদি রাত্রি হয় তাহা হইলে এ দিক ওদিক তাকাইয়া চোরের মত কোনওরূপে ঘরে লইয়া আসি। এ দিকে দেখুন, সাহেবেরা কেমন শ্রমী, তাহারা nation of shop-keepers বটে কিন্তু তাহারা nation of beggars নহে। তাহারা কেমন জামার আস্তিন গুটাইয়া মই লইয়া ক্রেতাদের মন যোগাইবার জন্য হাজার হাজার জিনিস দেখাইতেছে। কোনওরূপে পছন্দ করাবেই—জিনিস কিনাবেই। তাহারা কোনওরূপেই ক্রেতাকে অসন্তুষ্ট করে না। আমরা মেসে থাকি, ৬।৭ টাকা ঘরভাড়া দেই, বিবাহের বরযাত্রীর মত আমরাও ঘরের মধ্যে পড়িয়া থাকি, মাছ হোমিওপ্যাথিক ডোজে খাই, ডালও যা খাই তা গঙ্গার জলের ন্যায় পাত্‌লা। আমি প্রতিভাশালী ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার বারণ করি না। জমিদারের ছেলেরা সকলেই উচ্চশিক্ষা করিলে তাহাদের জমিদারী দেখিবে কে? তাহারা চাকুরীর জন্য দেশ ছাড়িয়া চলিয়া গেলে দেশের কল্যাণ হইবে কি করিয়া? শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের “পল্লীসমাজ” পড়িলে পল্লীগ্রামের অবস্থা বেশ বুঝা যায়। অশিক্ষিত লোক দেশে বসিলে কেবল মামলা মোকদ্দমার সৃষ্টি করে এবং সমাজের দোহাই দিয়া একে অন্যকে এক ঘরে ইত্যাদি করিয়া বাঙ্গালী মস্তিষ্কের অপচয় করিয়া থাকে। যাহারা ইংরাজী শিক্ষা করে তাহারা কেবল চাকুরী, চাকুরী ক’রে ৩০৲ মাহিনায় বিদেশে উপবাস কমিবে তবুও পল্লীগ্রামে থাকিবে না। সৌভাগ্য যে এখন আর চাকুরী মিলিতেছে না। জাতীয়ভাবে ছাত্রদিগকে শিক্ষিত করিয়া আমাদের যুবকগণের চাকুরীর মোহও নষ্ট করিতে হইবে। যেমন সৈন্যগণ সেতুবন্ধন করিয়া নদী পার হয় এবং সম্মুখে শত্রু কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া পশ্চাদ্ধাবিত হইবার সম্ভাবনা দূর করিবার জন্ম নিজেরাই সেই সেতু নষ্ট করিয়া দেয়—সেইরূপ জাতীয়ভাবে শিক্ষা লাভ করিলে শিক্ষার্থী দিগের অনন্যোপায় হইয়া চাকুরী অবলম্বন করিবার আশা থাকে না। জাতীয় শিক্ষার আর একটা উপকারিতা আছে। অতি অল্পদিনের মধ্যে ভারতকে জগৎসভায় স্থান পাইতে হইলে তাহার সন্তানগণকে জাতীয়ভাবে শিক্ষিত হইতে হইবে। জাপান নিজের জাতীয়তা রক্ষা করিয়া পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভ করিয়াছিল বলিয়াই গত ৫০ বৎসরের মধ্যে তাহার এই অভূতপূর্ব্ব উন্নতি। জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিলে একই সময়ের মধ্যে ১০ গুণ অধিক শিক্ষালাভ করা যায়। কারণ, এখানে মাতৃভাষায় সমুদায় বিষয় শিক্ষালাভ করিয়া শিক্ষার্থিগণ পাশ্চাত্য ভাষার শব্দ গাম্ভীর্য্য, ব্যাকরণ বিভীষিকার হাত হইতে নিষ্কৃতি পায়। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী বলিয়াছেন, মহামতি জষ্টিশ রানাডে একদিন প্রশ্ন উত্থাপন করেন—ইংরাজ শাসনে আমাদের কি কি অপকার সাধিত হইয়াছে? তিনি উত্তরে বলেন আমাদের দেশে সমস্ত ধন শোষিত হইয়া বিদেশে যাইতেছে এবং শাসনে আমাদের কোনও হাত নাই। কিন্তু রানাডে মহাশয় মস্তক সঞ্চালন করিয়া বলিলেন “সর্ব্বাপেক্ষা অনিষ্ট এই যে আমরা সঙ্কীর্ণতার গণ্ডীর মধ্যে পড়িয়াছি। আমাদের wider outlook কমিয়া যাইতেছে। দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তা কমিয়া গিয়া আমরা খুঁটিনাটি লইয়া আছি এবং তাহাতে আমাদের সর্ব্বনাশ হইতেছে। যদি আমাদের স্বরাজ থাকিত তাহা হইলে আর এমনটি হইত না।” জাতীয় বিদ্যালয়ে পড়িলে এই কৌপীনধারী মহাত্মা এবং যাঁহারা দধীচির মত সর্ব্বস্ব দিয়া দেশের সেবা করিয়াছেন, তাঁহারাই ছাত্রদিগের আদর্শ হন। সেই সব ভারত মাতার সুসন্তান ধন্য। দেশ তাঁহাদিগকে শীর্ষস্থান দিবেই। মেদিনীপুরে ২৬ লক্ষ লোকের বাস, এখানে ৪টা জাতীয় বিদ্যালয়ের স্থান নাই বলিলে চলিবে কেন?

 বহিমিয়া এখন স্বাধীন হইয়াছে—তাহা বোধ হয় জানেন। কিন্তু যখন ইহা পরাধীন ছিল তখন মুষ্টিমেয় কয়েকজন যুবক জাতীয় শিক্ষার প্রচার করিয়া ঐ দেশ স্বাধীন করিবার কল্পনা করিতেন। এক দিন তাঁহারা বলিয়াছিলেন “If the ceiling of the roof under which we sit, were to fall and crush us there would be an end of the national Government.” সেই মুষ্টিমেয় যুবকসম্প্রদায় দেশের মধ্যে যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিয়াছিলেন, ভবিষ্যতে তাহাতে সমগ্র দেশের মুখ উজ্জ্বল হইয়াছিল। আজ এই একটী নিতান্ত গণ্ডগ্রাম কলাগেছিয়াতে এই যে জন কয়েক যুবক, তুষের আগুন জ্বালিয়াছেন, অদূর ভবিষ্যতে ইহার আভায় সমস্ত দেশ উজ্জ্বল হইবে। কিছুদিন পরে যখন মেদিনীপুরের ইতিহাস লিখিত হইবে—(তখন হয়ত আমার দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হইবে)—তখন তাহাতে লাগেছিয়ার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হইবে। এবং মেদিনীপুরের মধ্যে সর্ব্বপ্রথম জাতীয় বিদ্যালয় কলাগেছিয়াতে স্থাপিত হইয়াছিল বলিয়া মেদিনীপুরের ইতিহাসে কলাগেছিয়ার নাম অতি উচ্চস্থান লাভ করিবে।

 স্ত্রী শিক্ষা—

 সময় সংক্ষেপ, বলিবার অনেক কথা আছে। দেশে স্ত্রী-শিক্ষা দিতেই হইবে। মা যতদিন মুর্খ থাকিবে ছেলের ততদিন কোনও উন্নতি হইবে না। আপনারা যতই M. A, B. A. হউন না, আপনাদের সহধর্ম্মিণী নিশ্চয়ই গণ্ডমূর্খ। মার স্তন্য পানের সময়ই প্রকৃত শিক্ষার সময়। আপনারা রবীন্দ্রনাথের, সহধর্ম্মিণীর স্বামীর নিকট সেই “টোপাকুল ও আইমার কাছে যাব” গল্প জানেন। স্বামী যতই শিক্ষিত হউন না কেন তাহাতে দেশের ও সমাজের কিছুই উপকার হইবে না যতদিন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এমন একটা উচ্চ প্রাচীর ব্যবধান থাকিবে যাহা কখনই উল্লঙ্ঘন করা যাইবে না। আপনারা ‘আলো ও ছায়া’ প্রণেতার সেই কবিতাটী জানেন “তোমাতে আমাতে মিলন, আলোক-আঁধারে যেমন”। স্ত্রী-শিক্ষা না হইলে কিছুতেই চলিবে না। গ্রামে গ্রামে স্ত্রী শিক্ষা চাই। নেপোলিয়ান বলিয়াছিলেন ফ্রান্স দেশে যতদিন না মা তৈয়ার হইতেছেন, ততদিন ফ্রান্সের উন্নতি অসম্ভব। আমাদের দেশেও সেই অবস্থা। গ্রামে গ্রামে অন্ততঃ নিম্ন প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় থাকা নিতান্ত প্রয়োজন

 খদ্দর—

 চরকা ধরুন। ঘরে ঘরে তূলার চাষ করুন। সেদিন অন্ধ্রদেশ হইতে আসিয়াছি। সেখানে শতকরা ৯৫ জন খদ্দর পরেন। আমরা বেশী সুসভ্য, তাই খদ্দর পরি না। তাহাদের ক্ষেতে তূলা উৎপন্ন হয়, তাহারা বাঙ্গালীর মত এত সুসভ্য নয়। আমরা যে বেশী সুশিক্ষিত হইয়াছি। মিহি কাপড় না হইলে পরিতে পারি না। ইঁহারা বলেন খদ্দর খুব ভারী। ইঁহাদের ফিন্‌ফিনে ধুতি চাই। আমি জিজ্ঞাসা করি মা লক্ষ্মীদের গহনার ওজন কত? কেরাণীবাবুদের ধড়াচূড়া হ্যাট কোট ইত্যাদির ওজনই বা কত? যত দোষ এই খদ্দরের বেলায়। বিলাতী কাপড় পরিলে টাকাটা জন্মের মত দেশ হইতে বিদায় দিলাম। হাতের সূতা গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় যে তন্তুবায় আছে, জোলা আছে, তাহারা বুনিবে। গ্রামের টাকা গ্রামেই থাকিয়া যাইবে। অনেকে বলেন মিলের কাপড় পরিলেই ত হইল। কিন্তু তাহাতে কি হইবে? টাকাটা বোম্বাই কি আমেদাবাদে চলিয়া গেল। ঠিক মহাজনের নিকট নিজের বাস্তুভিটা বন্ধক দেওয়ার মত হইল। আমি এ বিশ্বপ্রেম চাই না। আমি বাঙ্গালী, আমার অন্ন সকলে কাড়িয়া খাইতেছে। ভাটিয়া, দিল্লীওয়ালা, মাড়োয়ারী, পাঞ্জাবী, উড়িয়া, সকলে বাঙ্গালীর মুখের গ্রাস কাড়িয়া খাইতেছে। কেবল বাঙ্গালী 'হা অন্ন' 'হা অন্ন' করিয়া মাথায় হাত দিয়া কাঁদিতেছে। যদি ৩০ কোটী টাকা বৎসরে বৎসরে বাংলা দেশ হইতে বাহির করিয়া না দিয়া ঘরে ঘরে চরকা, ঘরে ঘরে তুলার চাষ করি, তবে আমাদের অবস্থা অনেক উন্নত হইবে। তমলুকে দেখিলাম কত সুন্দর স্বন্দর চরকার সূতার কাপড় হইয়াছে। আমি বিশ্বাস করিতে পারি নাই যে সেগুলি চরকার সূতার কাপড়। ক্রমশঃ তাঁতির হাত আরও পাকিবে। ঢাকাই কাপড় কত ভাল ছিল। যে দেশে এমন সূক্ষ্ম কাপড় হইত, যে দেশের মসলিন রোম হইতে সারা ইউরোপ হইতে টাকা লুটিয়া আনিত আজ সে দেশের লোক দিগম্বর সাজিয়াছে। আমরা এমনই অপদার্থ। কবির কথায়,— "তাতি কর্ম্মকার করে হাহাকার, সাজ দিগম্বরের বেশ।”

 দুই বৎসর পূর্ব্বে বোম্বাইতে মহাত্মার সঙ্গে যখন আমার দেখা হয় তখন তাঁহার কাছে আমি বলিয়া আসি যে আমি খদ্দর প্রচার করিব। সেই মহাত্মাজী আজ কারাগারে। আমাদের সেজন্য প্রত্যেককেই শোকচিহ্ন ধারণ করিতে হইবে। ইংরাজীতে যাহাকে বলে “The whole nation is in mourning.”, খদ্দরই সে শোকচিহ্নের পরিচায়ক হওয়া আবশ্যক। আমাদের এক ফসলের দেশ। ৮|৯ মাস লোকে হাত পা গুটাইয়া বসিয়া থাকে। ফসল না হইলে অনাহারে মৃত্যু বা ঋণে জর্জ্জরিত কিন্তু তবুও তাহারা খাটিবে না। কিন্তু কলিকাতার ভাটিয়া, মাড়োয়ারী, যাহাদিগকে লক্ষপতি বলিলে অপমান করা হয়, তাহাদের একটুও সময় নাই। এই তমলুক হইতে এই সব দেশ হইতে শ্রীমন্ত সওদাগর শত শত জাহাজ পণ্য বোঝাই করিয়া বিদেশে বাণিজ্য করিতে যাইত। কিন্তু সেই দেশের লোক আজ নিজের দোষে অল্পের কাঙ্গাল।

 অস্পৃশ্যতা—

 জাতিভেদ কি বিষ! এ পাপেরই বা কি প্রায়শ্চিত্ত! বাঙ্গালী মানে কেবল ব্রাহ্মণ, কায়স্থ বৈদ্য নহে। ব্রাহ্মণ ১২|১৩ লক্ষ মাত্র, কায়স্থের সংখ্যাও ঐরূপ, বৈদ্যের সংখ্যাও এক লক্ষের কম। এই ২৫৷২৬ লক্ষ লোক লইয়া বাংলা হয় নাই। সমস্ত হিন্দুর সংখ্যার শতকরা ৫ জন এবং হিন্দু মুসলমান দুই ধরিলে শতকরা ২ জন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য। আমার যেখানে বাস সে অঞ্চলে ব্রাহ্মণ কায়স্থ প্রধান সমাজ বটে, কিন্তু শতকরা ৫০|৬০ জন মুসলমান। সেইজন্য বর্তমান সময়ে আমাদিগকে অনেক জটিল প্রশ্নের মধ্যে আসিয়া পড়িতে হইয়াছে। কিন্তু এখানে শতকরা ৯০ জন হিন্দু মাহিষ্য। এখানে বড় আহ্লাদের বিষয় আপনারা নিজের পায়ের উপর দাঁড়াইয়া স্বাবলম্বী হইতে শিক্ষা করিতেছেন। মাহিষ্য সমাজের মধ্যে অনেক বড় লোক জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। আপনাদের নেতা শ্রীযুক্ত বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের ত্যাগ অসাধারণ। তিনি ধনী, জমিদার, ব্যারিষ্টার হইয়াও মায়ের আহ্বানে সমস্ত ত্যাগ করিয়া কারাবরণ করিয়াছেন। এ রকম মুকুটমণি যে মাহিষ্য সমাজের মধ্যে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন তাহাতে শুধু মাহিষ্য সমাজ নহে—সমগ্র বঙ্গদেশ ধন্য হইয়াছে। আমার রাম প্রসাদের সেই গানটী মনে পড়িতেছে, “এই, মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফল্‌তো সোনা।” বাস্তবিক মাহিষ্য বলুন, পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় বলুন, ইহাদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার হয় নাই। এই সব পতিত জমি আবাদ করলে কি সোনাই ফল্‌তো! এই সমাজের মধ্যে একজন আমার প্রিয় শিষ্য এম, এস্‌-সি পরীক্ষায় বেশ প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন এবং রসায়ন-শাস্ত্রে গবেষণা করিবার জন্য বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এখন ইনি মেদিনীপুরে ওকালতি করিতেছেন। আমার অনেক ছাত্র আপনাদের বীরেনবাবুর মত অথবা তাঁহার অপেক্ষা অধিকতর ত্যাগ করিয়াছেন। ডাক্তার প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বিলাতে না গিয়াও রসায়ন শাস্ত্রে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন। ভারত গবর্ণমেণ্ট তাঁহাকে যথোচিতভাবে টাঁকশালের কর্ত্তা (Assay master of mint) করিয়া দিয়ছিলেন। আজ পর্য্যন্ত চাকুরী করিলে তাঁহার ১৭০০ টাকা বেতন হইতে পারিত। তিনি দরিদ্রের সন্তান হইয়াও আন্দোলনের প্রথমেই দেশ মাতৃকার আহ্বানে নিজের সমস্ত স্বার্থ বিসর্জ্জন দিলেন। আমার আরও অনেক ছাত্র এইরূপ যাঁহারা সমাজে অনুন্নত তাহাদিগকে টানিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছেন। আমিও সেই পথের পথিক।

 বাংলার মুসলমান আমাদের রক্তমাংস। তাঁহারা হিন্দু সমাজের সংকীর্ণতা ও অনুদারতার নিমিত্ত ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য হইয়াছেন। তারপর আমরা যাহারা হিন্দু আছি আমাদের মধ্যে আত্মকলহ উপস্থিত। আজ যে বাংলায় শতকরা ৫২ জন মুসলমান তাহারা আমাদের “পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ। এই সকল অস্পৃশ্যজাতি আমাদেরই অত্যাচারে— রাজশক্তি প্রয়োগে নয়—ইসলাম ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছেন। যদি রাজশক্তি প্রয়োগে হিন্দুরা মুসলমান হইত তাহা হইলে দিল্লী বা মুর্শিদাবাদ প্রভৃতির নিকটবর্ত্তী স্থানে মুসলমান সংখ্যা সর্ব্বাপেক্ষা অধিক হইত। তাহা না হইয়া দেখা যায় যতই রাজতক্ত হইতে বেশী দূরে ততই মুসলমানের সংখ্যা অধিকতর। বল্লালী নিয়মের কঠোরতাই ইহার একমাত্র কারণ। ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র একতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব । যখন মুসলমানগণ এদেশে আসিয়া এই মূলমন্ত্র প্রচার করিলেন তখন সকলে দলে দলে গ্রামের পর গ্রাম আসিয়া মুসলমান হইতে লাগিল। তাহাদের আমির ফকীর একসঙ্গে উপাসনা করেন। বাদসাহ যেখানে উপাসনার জন্য বসিবেন একজন গরীব ডিস্তিওয়ালাও সেইখানে উপাসনার জন্য বসিবে। দেখুন দেখি তাহদের মধ্যে ভ্রাতৃভাব কতখানি! কত বড় সমতা! ইসলাম ধর্ম্ম বলিয়া পরিচয় দিলে সব এক। এক পাত্র হইতে খাইতে হইবে। আরব দেশে মুসলমান অতিথিকে ভিন্ন পাত্রে খাইতে দিলে তাহার অবমাননা করা হয়। আমাদের বার রাজপুত ত তের হাঁড়ি। কপটতা সহ্য হয় না। আমরা যে কত পাপ করিতেছি তাহা বলিবার নয়। সেনসাস্‌ দেখিলে বুঝিতে পারিবেন মুসলমানের সংখ্যা বাড়িতেছে। ৫০ বৎসর পরে গঙ্গার ওপারে—এদিকে নয়-সব মুসলমান হইয়া যাইবে। ভেদনীতিতে দেশ দুর্ব্বল বই সবল হইবে না। ব্রাহ্মণ কায়স্থের উচিত নিম্নশ্রেণীকে আলিঙ্গন করা। হিন্দুজাতি যে ধ্বংসোন্মুখ! ভগবানের নিকট কেহই উচ্চ নয় কেহই নীচ নয়। চণ্ডালোহপি দ্বিজ শ্রেষ্ঠ। এখন সকলকে আলিঙ্গন করিতে হইবে। যদি হিন্দুজাতি বাঁচিয়া থাকিতে চায় তবে আপনি মাহিষ্য হউন বা যাহাই হউন না কেন ভাই ভাই বলিয়া আলিঙ্গন করিয়া থাকিতে হইবে। এই যে আমাদের দেশাত্মবোধ জাগ্রত হইয়াছে ইহা শুভ চিহ্ন বুঝিতে হইবে। যদি আত্মকলহ থাকে তবে চিরকালই পরের অধীন হইয়া থাকিতে হইবে। যাহাতে ধরাপৃষ্ঠ হইতে হিন্দুজাতি বিলুপ্ত না হয়-তাহারই চেষ্টা করিতে হইবে। যাঁহারা অনুন্নত আছেন তাঁহারা কতকটা উঠুন আর যাঁহারা উন্নত আছেন তাঁহারাও কতকটা নামুন। তাই মহাত্মা গান্ধী বলিয়াছেন “যদি স্বরাজ চাও তবে অস্পৃশ্যতা দূর কর”। বিবেকানন্দ বলিয়াছেন, “আমাদের ধর্ম্ম গিয়াছে ছুঁৎমার্গের মধ্যে। আপনি উপপত্নী রাখুন, যত পাপ করুন ছাই চাপা দিলে সব চুপ।” এই ত মেদিনীপুর। এখানকার বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ সমর্থন করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার বিলাপে কে কান দিল? কেনা জানে সমাজ পাপে কলুষিত হইয়াছে। আর আপনি ৬৫ বৎসর বয়সে ১০।১২ বৎসরের বালিকাকে বিবাহ করিলেন সে বিধবা হইয়া কি নির্জলা একাদশী করিবে? এই যে পাপ, ইহা কি সহ্য হয়? তাই বলি সমাজ সংস্কার দরকার, শিক্ষা সংস্কার দরকার, ধর্ম্মসংস্কার দরকার, যাবতীয় কুসংস্কার দূর করা দরকার।

 উপসংহার—

 আজ আমার বড় শুভদিন। আপনাদের সকলকে এক সঙ্গে পাইয়াছি। আমার নিকট হিন্দু নাই, মুসলমান নাই, মাহিষ্য নাই, এক বাঙ্গালী, এক রক্ত, এক বাঙ্গালার মাটী, বাঙ্গালার জল, বাঙ্গালার বায়ুতে সকলেই পরিপুষ্ট। আমরা সকলেই ভাই। আমরা সকলেই এক। মনে পড়ে কেবল মহাত্মার সেই অদ্ভুত বাণী যাহার স্পর্শে এত লোক নবজীবন লাভ করিয়া ধন্য হইয়াছে। আপনাদের নিকট আজ করযোড়ে প্রার্থনা করি এই যে ১০।১২ জন যুবক বিদেশে না গিয়া দেশের জন্য জীবন আহুতি দিয়াছেন এই জাতীয় বিদ্যালয় যদি তাঁহাদের এত বড় ত্যাগ স্বীকার সত্ত্বেও না বাঁচে তাহা হইলে আমি বলিব বঙ্গমাতা তুমি চিরদিনই হতভাগিনী। আমি আপনাদের নিকট প্রার্থনা করি আপনারা এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সহিত একটী জাতীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করিয়া ইহাকে একটী আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করুন। বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে গঙ্গার বন্যা আসিয়াছে। আসুন এই শুভমুহূর্ত্তে পাল তুলিয়া স্বরাজের পথে যাত্রা করি।

  1. মেদিনীপুর জেলার কলাগাছিয়া গ্রামে প্রদত্ত বক্তৃতা ১৫ই জানুয়ারী ১৯২৪।