আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/৪

সমাজ-সংস্কার সমস্যা[]

 আজ আমাদের দেশে এক নবযুগের উন্মেষ হইতেছে। সমস্ত জগতে যে সাম্যবাদের বাণী প্রচারিত হইতেছে তাহা ভারতবর্ষের কর্ণে ও আসিয়আ পৌঁছিয়াছে। নূতন আকাঙ্ক্ষার আবেগে আমাদের হৃদয় আলোড়িত হইতেছে।

 কিন্তু যদি কেহ নিরপেক্ষভাবে বিচার করেন তিনি দেখিবেন আমাদের জাতীয় জীবনে কয়েকটি দুর্ব্বলতা রহিয়াছে। যে-সময়ে স্বরাজ ও হোমরুলের ধ্বনিতে দেশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত প্রতিধ্বনিত, যে-সময় প্রত্যেক সম্প্রদায় শাসনপ্রণালীর যথোচিত সংস্কারের জন্য আন্দোলনে নিযুক্ত, যে-সময়ে আমরা কল্পনার চক্ষে একতাবদ্ধ ভারতের মূর্ত্তি দেখিতে পাইতেছি—ঠিক সেই সময়ে নিজেদের মধ্যে কয়েকটি শ্রেণীর উচ্চ আর্ত্তনাদ আমাদের কর্ণে পৌঁছিতেছে। যেখানে শান্তি ও সহৃদয়তা বিরাজ করিবার কথা সেখানে এ বিরোধের সুর বাজে কেন?

 ইহার উত্তর এক কথায় পাওয়া যায়। রাজনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে ধঙ্গে সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজন—একটি ছাড়িয়া অন্যটি অসম্ভব। কোনও জাতিই নিজের কর্ম্মফল এড়াইতে পারে না। পূর্ব্বে আমরা সমাজ-সংস্কার বিষয়ে যে অবহেলা করিয়াছি এখন তাহারই বিষময় ফল ভোগ করিতেছি। ইহার জন্য রাজনৈতিক উন্নতির পথে আমরা বাধা পাইতেছি। এই সমস্যাটির বিশদ আলোচনা করিবার চেষ্টা করা যাক। আমি প্রধানতঃ বাংলাদেশের কথাই বলিতেছি, তথাপি কথা গুলি সমস্ত ভারতবর্ষের সম্বন্ধেই খাটে।

 মুসলমান ভ্রাতাদের বাদ দিলে বঙ্গে ২১০ লক্ষ হিন্দুর মধ্যে ১২ লক্ষ ব্রাহ্মণ, ১১ লক্ষ কায়স্থ এবং ৮৯ হাজার মাত্র বৈদ্য। আপনারা জানেন কেবল ইঁহারাই উচ্চজাতিভুক্ত বলিয়া বিবেচিত; তৎপরে নবশাক, যাঁহারা ব্রাহ্মণের জলস্পর্শ করিতে পারেন এবং ‘স্পর্শ’ বলিয়া পরিগণিত, যেমন তাঁতি, তিলি, কৈবর্ত্ত, সদ্গোপ, গন্ধবণিক প্রভৃতি; তৎপর প্রায় সমুদয় লোকই সমাজের অতি নিম্নশ্রেণীভুক্ত এবং অল্পাধিক অস্পৃশ্য বলিয়া বিবেচিত। এই অস্পৃশ্যরাই প্রধানতঃ আপনাদের সাহসী ও বলিষ্ঠ কৃষক সম্প্রদায়।

 একবার বঙ্গদেশের সমাজের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী হইতে একাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম্মের অল্পবিস্তর প্রাদুর্ভাব ছিল। সম্প্রতি পূর্ব্ববঙ্গের একটী তাম্রমূর্ত্তি হইতে জানা গিয়াছে যে সমতটের (গঙ্গার ব দ্বীপ) রাণী প্রভাবতী নিজে বৌদ্ধ হইলেও শর্ব্বাণী দেবীর অর্থাৎ দুর্গার পূজা করিতেন। আর একখানি তাম্রফলক হইতে ইহাও জানা গিয়াছে যে পালবংশীয় মদনপালের মহিষী মহাভারতের শ্লোকসমূহ আবৃত্তির জন্য কয়েকজন ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। চীন পরিব্রাজক হুয়েনসাংও লিখিয়াছেন যে কান্যকুব্জাধিপতি হর্ষবর্দ্ধন শৈব হইলেও বৌদ্ধভাবাপন্ন ছিলেন। বস্তুতঃ তখন কান্যকুব্জ হইতে বঙ্গদেশ পর্য্যন্ত আর্য্যাবর্ত্তের সমুদায় অংশেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ছিল। কাজেই তখন জাতিপ্রথা একেবারে উঠিয়া না গেলেও ভিন্ন ভিন্ন জাতির মধ্যে বিবাহাদি চলিত তাহা বলাই বাহুল্য।

 তৎপরে বৌদ্ধধর্ম্মের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুধর্ম্মের পুনরাবির্ভাব ঘটে। তখন পুনরায় জাতিপ্রথার উন্নতি হইতে দেখা যায়। কৌলিন্যপ্রথার প্রবর্ত্তক রাজা বল্লাল সেন জাতিপ্রথার মস্ত পৃষ্ঠপোষক হইয়া উঠিলেন, সময় বুঝিয়া অনেকেই বুদ্ধিমানের মত তাঁহাকে সমর্থন করিয়া সমাজে উন্নতিলাভ করিতে লাগিলেন এবং সুবর্ণবণিক, যুগী প্রভৃতি, যাঁহারা তাহা না পারিলেন, তাঁহারা নীচশ্রেণীর মধ্যে পরিগণিত হইলেন।

 পরবর্ত্তীকালে একটি কিম্বদন্তীর প্রচার হয় যে যখন বৌদ্ধযুগে বঙ্গদেশে বেদবিহিত ক্রিয়াকলাপের লোপ ঘটিল, তখন রাজা আদিশূর সনাতন ধর্ম্মের পুনঃ প্রচারের জন্য কান্যকুব্জ হইতে পাঁচটি বিদ্বান ব্রাহ্মণ আমদানী করেন।

 ধরিয়া লওয়া যাক যে উপরোক্ত কিম্বদন্তীর মূলে কিছু সত্য আছে, তবুও একথা নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে যে বর্ত্তমান বাঙ্গালায় ১৩ লক্ষ ব্রাহ্মণের মধ্যে কয়জন সেই পাঁচজন মাত্র পূর্ব্বপুরুষের বংশধর বলিয়া দাবী করিতে পারেন। আরও মজার কথা এই যে সেই পূর্ব্বপুরুষগণ তাঁহাদের স্ত্রী সঙ্গে লইয়া আসেন নাই। বারেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির একনিষ্ঠ সভ্য শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় যথার্থই বলিয়াছেন— “রাঢ়ী ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের কুলশাস্ত্রে বিশ্বাস করিবার আর একটি বাধা এই যে ইহাতে ধরিয়া লইতে হয় যে ৩০ হইতে ৩৫ পুরুষ পূর্ব্বে অর্থাৎ ৮ হইতে ১০ শতাব্দী পূর্ব্বে বাঙ্গালায় ব্রাহ্মণ ছিল না বলিলেই হয়। রাঢ়ীগণের কুলশাস্ত্রে লিখে যে, যে-সময়ে কনৌজ হইতে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আসেন, তখন বাঙ্গালায় ৭০০ ঘর ব্রাহ্মণ ছিল। কিন্তু আজ কাল সেই ৭০০ ঘরের কোন বংশধর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না, অথচ ৫ জন আগন্তুক ব্রাহ্মণের বংশধররাই সমস্ত দেশ ছাইয়া ফেলিয়াছে।”

 সকলেই জানেন যে যখন কোনও নিম্নজাতির মধ্যে কোনও দুরদেশীয় মুষ্টিমেয় উচ্চজাতীয় পুরুষ আসিয়া বাস করে, তখন স্বভাবতঃই তাহারা নিম্ন জাতিতেই বিবাহ করিতে বাধ্য হয়। অনেকে আবার বিশ্বাস করেন যে অন্যান্য প্রদেশের কয়েক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ মূলতঃ বিদেশীয়। ইতিহাস এবং সমাজ-বিজ্ঞান প্রমাণ করিয়াছে যে কয়েকটি জায়গা ছাড়া বাংলা ও অপরাপর প্রদেশের ব্রাহ্মণগণ বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে উৎপন্ন হইয়াছে; মানব-বিজ্ঞানেও তাহাই বলে। নাসিকা ও মস্তকের মাপ লইয়া দেখা গিয়াছে যে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণের মধ্যে বিশেষ কোনও প্রভেদ নাই। চন্দ মহাশয় তাঁহার নিজের গবেষণার ফলস্বরূপ লিখিয়াছেন:—“বহির্দেশীয় ব্রাহ্মণের মস্তকের আকৃতি দেখিয়া তাঁহাকে অন্তর্দেশীয় বৈদিক ঋষির বিশুদ্ধ বংশধর বলিয়া মনে হয় না, বরং শূদ্র এবং অন্ত্যজ শ্রেণীভুক্ত অব্রাহ্মণ প্রতিবেশীগণের সহিত তাঁহাদের আকৃতিগত যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়। একদিকে যুক্ত প্রদেশের কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ এবং বিহারের মৈথিল ব্রাহ্মণের মস্তকের গঠন এবং অপর দিকে গুজরাটের নাগর ব্রাহ্মণ এবং বাংলার রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বৈদিক ব্রাহ্মণের মস্তকের গঠন এই উভয়ের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ রহিয়াছে। কেবল মাত্র বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে রক্তের মিশ্রণ ইহার কারণ নহে, কিন্তু মনে হয় প্রান্ত-প্রদেশীয় ব্রাহ্মণগণ মূলতঃ প্রান্ত-প্রদেশবাসী জাতি, তাহাদের অব্রাহ্মণ যজমানগণ যে পরিমাণে অন্তর্দ্দেশীয় জাতিগণের রক্ত লাভ করিয়াছে, ইহারাও সেই পরিমাণে পাইয়াছে।” সার হার্বার্ট রিস্‌লী মানব-বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় যে সকল সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন তাহা আমাদের অনেকের ভাল না লাগিতে পারে, কিন্তু চন্দ মহাশয়ের গবেষণায় অন্ততঃ ইহা প্রমাণ হয় যে বিভিন্ন জাতি এবং উপজাতিগণ মূলতঃ অভিন্ন! এইত গেল ব্রাহ্মণগণের কথা। কায়স্থগণের সম্বন্ধে ত প্রবাদই প্রচলিত রহিয়াছে যে “জাত হারালে কায়স্থ”। কুলীন এবং মৌলিক ভিন্ন তাহাদের মধ্যে ৭২ উপবিভাগ আছে। ইহাদের মধ্যে যদি কোনও যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ করে, কিম্বা যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করিতে গারে, তাহা হইলে শুদ্ধ কুলীন কায়স্থগণের মধ্যে তাহাকে জামাতা করিবার জন্য হুড়াহুড়ি পড়িয়া যায়; এইরূপে অনবরত কতলোক বাহাত্তরে ঘর হইতে মৌলিক শ্রেণীতে প্রমোশন পাইতেছে। আবার মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মত একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ গবেষণাকারীর মতে, মৌলিকগণ অধিকাংশই প্রাচীনকালে বৌদ্ধ ছিলেন।

 রাসায়নিক বিশ্লেষণ দ্বারা যেরূপ ঘিয়ের ভেজাল কতখানি জানিতে পারা যায়, দুঃখের বিষয়, সেইরূপ রাসায়নিক কোন বিশ্লেষণ দ্বারা ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের রক্তে কি পরিমাণ ভেজাল আসিয়াছে তাহা জানিবার উপায় নাই। যতদূর জানিতে পারা যায় তাহাতে বল্লাল সেনের সময় হইতেই জাতি সম্বন্ধে এখনকার নিয়মগুলির সৃষ্টি হয়। তৎপরে রঘুনন্দন তাহাতে তাঁহার নিজের কিছু কৃতিত্ব ফলাইয়াছেন। তিনি কায়স্থদিগকে “সচ্ছূদ্র” অর্থাৎ উচ্চদরের শূদ্র এই আখ্যা দিয়া কায়স্থদিগের প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখাইয়াছেন। পাল সাম্রাজ্যের উত্তরাংশে তিব্বত হইতে একদল অসভ্য লোক আসিয়া একটি রাজ্য স্থাপন করিয়া বসিয়াছিল, এই রাজ্যটি অর্দ্ধ শতাব্দী ধরিয়া বর্ত্তমান থাকিবার পর মহীপাল কর্ত্তৃক বিধ্বস্ত হয়। এই সমস্ত তিব্বত-হইতে-আগত অধিবাসীরা ক্রমে ক্রমে যে এদেশের লোকের সঙ্গে মিশিয়া যাইতে লাগিল, তাহা তাহাদের মন্দিরগুলি দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়। কুচবিহার রাজ্য একসময়ে উত্তর বঙ্গের অনেক অংশ ব্যাপিয়া ছিল; ইহা হইতেও মনে হয় যে বারেন্দ্রভূমিতে কোন কোন শ্রেণীর সহিত মঙ্গোলিয়ানদের রক্তের সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। টড সাহেবের অনুমানে কোন কোন রাজপুত এবং জাঠের পূর্ব্বপুরুষ হূণ এবং শক। আজকাল গবেষণা দ্বারা এই অনুমানটি সত্য বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে। এই রক্ত সংমিশ্রণের অকাট্য প্রমাণ প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে রহিয়াছে—মণিপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি করদ রাজ্যে উচ্চবংশীয়দের অঙ্গসৌষ্ঠব বিশেষতঃ মুখের গঠন (Facial Contour) দেখিলে মঙ্গোলীয় রক্তসংমিশ্রণ স্পষ্ট বুঝা যায়—অর্থাৎ রাজপুতানায় যেখানে শক, যবন, হূণ, Scythianদেৱ সহিত মিশ্রণ হইয়া “ক্ষত্রিয়” সৃষ্টি হইয়াছে বাংলার পূর্ব্ব প্রান্তেও সেইরূপ। এই প্রসঙ্গে মহামতি রানাডের “শতবর্ষ পূর্ব্বে দক্ষিণ ভারতবর্ষ”-শীর্ষক প্রবন্ধ হইতে পশ্চাল্লিখিত কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

 “দক্ষিণ ভারতে যে সকল আদিম জাতি বাস করিত তাহাদের সংখ্যা এত অধিক ছিল যে, যে-অল্পসংখ্যক ব্রাহ্মণ কয়েকজন যোদ্ধা ও বণিক সঙ্গে লইয়া সে প্রদেশে বাস করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা দেশবাসীর উপর স্থায়ী প্রাধান্য লাভ করিতে পারেন নাই। উত্তর ভারতে আর্য্যজাতির প্রভাষ বিশেষরূপে বিস্তৃতিলাভ করিয়াছিল, কিন্তু খৃষ্টীয়,অব্দের প্রারম্ভকালে শক, হূণ এবং জাঠ বা গথ (যাহারা রোমসাম্রাজ্য ধ্বংস করিয়াছিল) প্রভৃতি নূতন জাতির আক্রমণে তাঁহারা পর্য্যুদস্ত হইয়াছিলেন। উত্তর ভারতে বৈদেশিক আক্রমণে যাহা ঘটিয়াছিল, দক্ষিণ ভারতে আদিম অধিবাসী দ্রাবিড় জাতিগণের উত্থানদ্বারা তাহাই ঘটিয়াছিল। সেই জন্যই এই সময়ের লিখিত পুরাণগুলির মধ্যে একটা হতাশার এবং ভয়ের সুর শুনিতে পাই। যাহা হউক অন্ততঃ ইহা নিশ্চিত যে বৌদ্ধধর্ম্মের উত্থানের জন্য হিন্দুধর্ম্মের যে পতন হয়, সেই পতন হইতে ইহা আবার যখন পুনরুত্থান করে তখন ইহা আর তাহার প্রাচীন বিশুদ্ধি রক্ষা করিতে পারে নাই—আজকাল হিন্দুধর্ম্মকে আমরা যেরূপ ভেজাল-মিশ্রিত অবস্থায় দেখিতেছি, সেই অবস্থাই প্রাপ্ত হয়। বৌদ্ধধর্ম্মকে এবং পরে জৈনধর্ম্মকে বিনষ্ট করিবার জন্য ব্রাহ্মণগণ প্রথম যে সকল বর্ব্বর জাতিকে শূদ্র বলিয়া ঘৃণা করিতেন, পরে তাহাদিগেরই সহিত মিলিত হন। যে সকল ব্রাহ্মণ প্রথমে ঋষি এবং ধর্ম্ম প্রচারক, কবি এবং দার্শনিক ছিলেন, তাঁহারা পুরোহিত-শ্রেণীতে অবনত হইলেন এবং এইরূপে ক্ষমতা এবং লাভের জন্য তাঁহাদের স্বাধীনতা বিসর্জ্জন দিলেন। দস্যু এবং রাক্ষসগণের দেব দেবীগণকে প্রাচীন বৈদিক দেবতাগণের রূপান্তররূপে গ্রহণ করা হইল; পূর্ব্বে আর্য্য ও অনার্য্যদিগের মধ্যে যে বিভাগ ছিল, পরে তাহা ব্যবসাগত নানা জাতিতে পরিণত হইল এবং এই জাতিগণের মধ্যে কোন সম্পর্কই রহিল না। ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম অসভ্য জাতিগণকে সভ্য করিতে পারিল না, বরং তাহাদিগের দ্বারা নিজেই হীনতা প্রাপ্ত হইল।”

 তবে কেন এত বংশমর্য্যাদার বড়াই? তবে কেন কেহ আপনাকে সূর্য্য ও চন্দ্রের বংশধর বলিয়া কেহ বা আপনাকে বৈদিক ঋষিগণের সন্তান বলিয়া প্রমাণ করিতে এত ব্যস্ত?

 বর্ত্তমান কালে হিন্দুসমাজে লোকাচারই ধর্ম্মের স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছে। মনুসংহিতা, পরাশরসংহিতা ও মহাভারতাদি পাঠে দেখা যায় যে, প্রাচীন ঋষিগণ, রঘুনন্দন প্রভৃতি নব্য স্মার্ত্তগণের অপেক্ষা জাতিভেদ ও বিবাহ সম্বন্ধে অনেক উদার মতাবলম্বী ছিলেন। এস্থলে আমি কেবল দুই একটি উদাহরণ দিতেছি।

 “যক্ষ জিজ্ঞাসা করিলেন ‘হে রাজন্ জন্ম বা চরিত্র, অধ্যয়ন বা বিদ্যা কিসের প্রভাবে এক ব্যক্তি ব্রাহ্মণ হইয়া থাকেন, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলুন।’

 “যুধিষ্ঠির উত্তর করিলেন ‘যক্ষ শ্রবণ করুন। জন্ম বা অধ্যয়ন বা বিদ্যা কিছুই ব্রাহ্মণত্বের কারণ নহে—চরিত্রই ইহার কারণ। ব্রাহ্মণ যত্নের সহিত নিজের চরিত্র রক্ষা করিবেন। যিনি চরিত্র রক্ষা করিতে পারেন, তাঁহার কোনও ক্ষতি হয় না কিন্তু যিনি চরিত্র হারান তিনি বিনষ্ট হন।”

(মহাভারত, বনপর্ব্ব, ৩১২ অধ্যায়)

“বেদাঃ বিভিন্নাঃ স্বতয়োর্বিভিন্নাঃ
নাসৌ মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নং।
ধর্ম্মস্য তত্ত্বং নিহিত গুহায়াং
মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা॥ (ঐ)

 “শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া ইতর লোকের নিকট হইতেও শ্রেয়স্করী বিদ্যা গ্রহণ করিবে। অন্ত্যজের নিকট হইতেও পরম ধর্ম্ম লাভ করিবে এবং স্ত্রীরত্ন দুস্কুল হইতেও গ্রহণ করিবে।”

 “স্ত্রী, রত্ন, বিদ্যা, ধর্ম্ম, শৌচ, হিতকথা এবং বিবিধ শিল্পকার্য্য—সকলের নিকট হইতে সকলে লাভ করিতে পারে!”

(মনুসংহিতা, ২য় অধ্যায়, শ্লোক ২৩৮, ২80)

 “ধনুমতী হইয়াও কন্যা বরং যাবজ্জীবন গৃহে থাকিবে ইহাও শ্রেয়ঃ তথাপি গুণহীন পাত্রে সমর্পণ করিবে না।”

(মনু, ১ম অধ্যায়, শ্লোক ৮৯)

 “দ্বিজাতিগণের প্রথম বিবাহের স্ত্রীই প্রশস্তা। স্বেচ্ছাকৃত পুনর্ব্বিবাহে নিম্নলিখিত স্ত্রীলোকই পর পর শ্রেষ্ঠ হয়। শূদ্রাই কেবল শূদ্রের ভার্য্যা হইবে, শূদ্রা ও বৈশ্য, বৈশ্যের বিবাহযোগ্যা। এবং শূদ্রা, বৈশ্যা, ক্ষত্রিয়া এবং ব্রাহ্মণী—ব্রাহ্মণের বিবাহযোগ্যা হইবে।”

(মনু ৩য় অধ্যায়, শ্লোক ১২-১৩)

 “বেশ্যাগর্ভে বশিষ্ঠ, দাসীগর্ভে নারদমুনি, শূদ্রাগর্ভে দুই পিতার ঔরসে ভরদ্বাজ মুনি, ধীবর কন্যাতে বেদব্যাস, ক্ষত্রিয়াগর্ভে বিশ্বামিত্র জন্ম গ্রহণ করিয়াও ব্রাহ্মণ হইলেন কিরূপে? আবার ব্যাসদেবের ঔরসে জন্মলাভ করিয়াও ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু প্রভৃতি ক্ষত্রিয় হইলেন কেমন করিয়া?”

 “ঐতরেয় ব্রাহ্মণের ২।১৯ শ্লোকে কবয ঋষির কথা উল্লেখ আছে। তিনি একজন দাসীপুত্র সুতরাং শূদ্র। কিন্তু তিনি ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের অন্তর্গত ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ও ৩৪ সূত্র রচনা করেন। কক্ষীবান ঋষি ঋগ্বেদ সংহিতার কতকগুলি সূক্ত রচনা করেন, তিনিও দাসীপুত্র, কারণ—‘কক্ষীবন্তং য ঔশিজঃ।’ ১।১৮।১ এই উশিজ দাসবর্ণীয়া ছিলেন। আবার বিশ্ববারা, রোমনা, যমী, উর্ব্বশী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরাও বেদ মন্ত্রের রচয়িত্রী বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। ইঁহারা সকলে ঋগ্বেদ মন্ত্র রচনা করেন।”

 ভাণ্ডারকরের ন্যায় প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণ বলেন যে, গুপ্তবংশের রাজ্যকালে যখন ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের পুনরভ্যুদয় হয়, তখন পুরোহিতগণের প্রাধান্য স্থাপন করিবার জন্য পুরাণ এবং অন্যান্য শাস্ত্রে অনেক অংশ প্রক্ষিপ্ত হইয়াছিল।

 এই সমস্ত বিষয় আলোচনা করিলে দেখা যায় উচ্চ জাতিগণ যে বংশমর্য্যাদার দাবী করেন তাহার মূলে ঐতিহাসিক প্রমাণ অল্পই আছে। এইবার আমি আপনাদের আর একটি বিষয় আলোচনা করিতে অনুরোধ করিতেছি। কি করিলে আমাদের সমাজের উন্নতি হইবে তাহা দেখিতে হইবে। অদৃষ্টক্রমে উচ্চবংশে জন্মিয়াছেন বলিয়া মুষ্টিমেয় কয়েকজন সমস্ত সুবিধা একচেটিয়া করিয়া লইবেন আর লক্ষ লক্ষ দেশবাসীকে ছোটলোক বলিয়া ঘৃণা করিবেন ইহা কি ধর্ম্মানুমোদিত না ইহাতে দেশের উন্নতি হইবে? নিজেদের মধ্যে অনৈক্য থাকিলে আমাদের পতন অনিবার্য্য। নিম্ন শ্রেণীর লোকেরাও আমাদের ভাই, তাহাদের বর্ত্তমান হীন অবস্থা হইতে উন্নতির পথে তুলিয়া লইবার জন্য প্রত্যেক দেশহিতৈষীরই আন্তরিক চেষ্টা করা উচিত। দেশের অধিকাংশ লোক দাসের মত থাকিবেন এবং কয়েকজন লোক তাহাদের উপর প্রভুত্ব ফলাইবেন, এরূপ অন্যায় ব্যাপার আর কত দিন চলিবে? দেশের এতগুলি লোক মূঢ় জড়ের ন্যায় পড়িয়া থাকিলে দেশ কি উন্নত হইবে? না শক্তিশালী হইবে? সমুদায় বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রজাগণের সঙ্গে সমান রাজনৈতিক অধিকার লাভের জন্য আমরা নিয়ত আন্দোলন করি কিন্তু আমাদের নিজের দেশবাসিগণকে তাহাদের জন্মগত অধিকার দিতে রাজী নই—সে কথা উঠিলেই যেন আমাদের সর্ব্বনাশ উপস্থিত হয়!

 রবীন্দ্রনাথ অনেক দুঃখে বলিয়াছেন—

 “যারা নীচে পড়ে আছে সংখ্যায় তারাই বেশি—তাহাদের জীবনযাত্রার আদর্শ সকল বিষয়েই হীন হলেও উপরের লোককে সেটা বাজে না। বরঞ্চ তাদের চাল-চলন যদি উপরের আদর্শ অবলম্বন কর্‌তে যায় তাহলে সেটাতে বিরক্তি বোধ হয়।

 তার পরে এই-সব চির-অপমানে-দীক্ষিত মানুষগুলো যখন মানবসভায় স্বভাবতঃই জোর গলায় সম্মান দাবী কর্‌তে না পারে, যখন তারা এত সঙ্কুচিত হয়ে থাকে যে বিদেশী উদ্ধতভাবে তাদের অবজ্ঞা কর্ত্তে অন্তরে বাহিরে বাধা বোধ না করে, তখন সেটাকে কি আমাদের নিজেরই কৃতকর্ম্ম বলে গ্রহণ কর্‌ব না?

 আমরা নিজেরা সমাজে যে অন্যায়কে আটেঘাটে বিধিবিধানে বেঁধে চিরস্থায়ী করে রেখেচি সেই অন্যায় যখন পলিটিক্সের ক্ষেত্রে অন্যের হাত দিয়ে আমাদের উপর ফিরে আসে তখন সেটা সম্বন্ধে সর্ব্বতোভাবে আপত্তি কর্‌বার জোর আমাদের কোথায়?

 জোর করি সেই বিদেশীরই ধর্ম্মবুদ্ধির দোহাই দিয়ে। সে দোহাইয়ে কি লজ্জা বেড়ে ওঠে না! এ কথা বল্‌তে কি মাথা হেঁট হয়ে যায় না, যে, সমাজে আমাদের আদর্শকে আমরা ছোট করে রাখব, আর পলিটিক্সে তোমাদের আদর্শকে তোমরা উঁচু করে রাখ? আমরা দাসত্বের সমস্ত বিধি সমাজের মধ্যে বিচিত্র আকারে প্রবল করে রাখব, আর তোমরা তোমাদের ঔদার্য্যের দ্বারা প্রভুত্বের সমান অধিকার আমাদের হাতে নিজে তুলে দেবে? যেখানে আমাদের এলেকা সেখানে ধর্ম্মের নামে আমরা অতি কঠোর কৃপণতা কর্‌ব, কিন্তু যেখানে তোমাদের এলেকা সেখানে সেই ধর্ম্মের দোহাই দিয়ে অপর্য্যাপ্ত বদান্যতার জন্যে তোমাদের কাছে দর্‌বার কর্‌তে থাক্‌ব এমন কথা বলি কোন্ মুখে? আর যদি আমাদের দর্‌বার মঞ্জুর হয়? যদি, আমরা আমাদের দেশের লোককে প্রত্যহ অপমান কর্‌তে কুণ্ঠিত না হই, অথচ বিদেশের লোক এসে আপন ধর্ম্মবুদ্ধিতে সেই অপমানিতদের সম্মানিত করে তাহলে ভিতরে বাহিরেই কি আমাদের পরাভব সম্পূর্ণ হয় না?

 সেখানেও কি আমরা বল্‌ব, ধর্ম্মবুদ্ধিতে তোমরা আমাদের চেয়ে বড় হয়ে থাক; নিজেদের সম্বন্ধে আমরা যে-রকম ব্যবহার কর্‌বার আশা করিনে আমাদের সম্বন্ধে তোমরা সেই রকম ব্যবহারই কর? অর্থাৎ চিরদিনই নিজের ব্যবস্থায় আমরা নিজেদের খাটো করে রাখি, আার চিরদিনই তোমরা নিজগুণে আমাদের বড় করে তোলো। সমস্ত বরাৎই অন্যের উপরে, আর নিজের উপরে একটুও নয়? এত অশ্রদ্ধা নিজেকে আর এতই শ্রদ্ধা অন্যকে? বাহুবলগত অধমতার চেয়ে এই ধর্ম্মবুদ্ধিগত অধমতা কি আরো বেশি নিকৃষ্ট নয়?

 অল্পকাল হল একটা আলোচনা আমি স্বকর্ণে শুনেচি, তার সিদ্ধান্ত এই যে, পরস্পরের মধ্যে পাকা দেওয়ালের ব্যবধান থাকা সত্বেও এক চালের নীচে হিন্দু মুসলমান আহার কর্‌তে পার্‌বে না, এমন কি সেই আহারে হিন্দুমুসলমানের নিষিদ্ধ কোনো আহার্য্য যদি নাও থাকে। যারা এ কথা বল্‌তে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করেন না, হিন্দুমুসলমানের বিরোধের সময় তারাই সন্দেহ করেন যে বিদেশী কর্ত্তৃপক্ষেরা এই বিরোধ ঘটাবার মূলে; এই সন্দেহ যখন করেন তখন ধর্ম্মবিচারে তাঁরা বিদেশীকে দণ্ডনীয় মনে করেন। এর একমাত্র কারণ ধর্ম্মের দাবী নিজের উপরে তাঁহাদের যতটা, বিদেশীর উপরে তার চেয়ে অনেক বেশি। স্বদেশে মানুষে মানুষে ব্যবধানকে আমরা দুঃসহরূপে পাকা করে রাখব সেইটেই ধর্ম্ম, কিন্তু বিদেশী সেই ব্যবধানকে কোনো কারণেই কোনো মতেই নিজের ব্যবহারে লাগালে সেটা অধর্ম্ম। আত্মপক্ষে দুর্ব্বলতাকে সৃষ্টি করব ধর্ম্মের নামে, বিরুদ্ধ পক্ষে সেই দুর্ব্বলতাকে ব্যবহার কর্‌লেই সেটাকে অন্যায় বলব।

 যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, পাকা দেওয়ালের অপর পারে যেখানে মুসলমান খাচ্চে দেওয়ালের এপারে সেখানে হিন্দু কেন খেতে পারে না, তা হলে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই আবশ্যক হবে না। হিন্দুর পক্ষে এ প্রশ্নে বুদ্ধি খাটানো নিষেধ এবং সেই নিষেধটা বুদ্ধিমান জীবের পক্ষে কত অদ্ভুত ও লজ্জাকর তা মনে উদয় হবার শক্তি পর্য্যন্ত চলে গেছে। সমাজের বিধানে নিজের বারো আনা ব্যবহারের কোনোপ্রকার সঙ্গত কারণ নির্দ্দেশ কর্‌তে আমরা বাধ্য নই; যেমন বাধ্য নয় গাছপালা কীটপতঙ্গ পশুপক্ষী। পলিটিক্সে বিদেশীর সঙ্গে কার্‌বারে আমরা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর্‌তে শিখেচি,—সে-ক্ষেত্রে সকল রকম বিধিবিধানের একটা বুদ্ধিগত জবাবদিহি আছে বলে মান্‌তে অভ্যাস কর্‌চি; কিন্তু সমাজে পরস্পরের সঙ্গে ব্যবহার, যার উপরে পরস্পর গুরুতর সুখ দুঃখ শুভাশুভ প্রত্যহ নির্ভর করে সে সম্বন্ধে বুদ্ধির কোনো কৈফিয়ৎ নেওয়া চলে একথা আমরা ভাবতেও একেবারে ভুলে গেছি।”

 এসিয়াবাসী জাতিও রাজনৈতিক উন্নতি লাভ করিতে পারে এই প্রমাণ করিবার জন্য আমরা অনবরত জাপানের দৃষ্টান্ত দিয়া থাকি। কিন্তু জাপান,সমাজ-সংস্কারের জন্য কি কি করিয়াছে তাহা আমরা ইচ্ছা করিয়া বিস্তৃত হই। বিগত শতাব্দীর সত্তরের কোটা পর্য্যন্ত আমাদের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের ন্যায় সে দেশের সামুরাই জাতি সমস্ত সুবিধা একচেটিয়া করিয়া রাখিয়াছিল। এতা এবং হিনিন নামে দুইটি অস্পৃশ্য অতিঘৃণিত জাতি ছিল, গ্রামের বাহিরে তাহাদিগকে বাস করিতে হইত। মাদ্রাজ প্রদেশে আজিও কয়েকটি নীচ জাতি এইরূপে ঘৃণিত হইতেছে। ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই অক্টোবর জাপানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় থাকিবে। কারণ ঐ দিনে সামুরাইগণ নিজেদের দেশভক্তি ও উন্নত হৃদয়ের প্রভাবে স্বেচ্ছায় আপনাদের সর্ব্ববিধ বিশেষ সুবিধা ত্যাগ করিলেন এবং ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যে সকল অন্যায় প্রভেদ ছিল তাহা উঠাইয়া দিলেন। এইরূপে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির প্রতিষ্ঠা হইল।

 ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে জাপানে যাহা সম্ভব হইয়াছিল, ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে এতদিন পরেও ভারতবর্ষে তাহা সম্ভব হইল কৈ? এখনও আমাদের দেশে “বার রাজপুতের তের হাঁড়ি” আর ৫০০ কংগ্রেস প্রতিনিধির জন্য ৫০০টি রাঁধিবার স্থান চাই! এততেও কুলায় না, এর উপর আবার মান্দ্রাজে দৃষ্টি দোষ’ ঘটিয়া থাকে! যদি কোনও ‘পঞ্চম’ শ্রেণীভুক্ত (অর্থাৎ নীচজাতীয়) লোক কোনও ব্রাহ্মণের অগ্নিপক্ব খাদ্যের প্রতি, এমন কি দূর হইতেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাহা হইলে সেই খাদ্য অপবিত্র হইয়া যায়! যদি অতি দূর হইতে দূরবীক্ষণের সাহায্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাহা হইলে খাদ্য অপবিত্র হইবে কি না তাহা মান্দ্রাজের স্মার্ত্ত পণ্ডিতগণ কি আমাদিগকে বলিয়া দিবেন? কুসংস্কার মানুষকে কতদূর হীন করিতে পারে তাহার একটি জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত মালাবারের নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণসমাজ। একসময়ে এই নাম্বুদ্রি সমাজেই শঙ্করাচার্য্যের ন্যায় অসাধারণ পণ্ডিত ও ধর্ম্মপ্রচারকের উদ্ভব হইয়াছিল, কিন্তু আজ নাম্বুদ্রিগণ ভারতবর্ষের একটি অখ্যাত ও নগন্য সম্প্রদায়। এই অধঃপতনের মূলে তাহাদের অদ্ভূত বিবাহপ্রথা। পরিবারের মধ্যে কেবল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিবাহ করিবার অধিকারী, অন্যান্য ভ্রাতাগণ বিবাহ করিতে পায় না। ফলে তাহাদের চরিত্র কলুষিত হইয়া পড়ে। এদিকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অনেক স্থলে বহু বিবাহ করিয়া থাকে। এই প্রাচীন প্রথার দাস হইয়া নাম্বুদ্রিগণ নিজেদের উন্নতির পথ নিজেরাই রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে।

 সৌভাগ্যক্রমে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় এই জাতিসমস্যা এতদূর গুরুতর আকার ধারণ করে নাই। প্রকৃতপক্ষে বাংলার কায়স্থ ও বৈদ্যগণ বিদ্যায় ব্রাহ্মণগণের সমান এবং সমাজের সম্মানে ব্রাহ্মণগণের প্রায় সমতুল্য। ব্রাহ্মণ অপেক্ষা অন্য কয়টি জাতির মধ্যে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা অধিক। বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতির একহাজার লোকের মধ্যে কয়জন লোক লিখিতে ও পড়িতে পারে তাহার গণনা করিয়া দেখা গিয়াছে, বৈদ্যগণের মধ্যে ৫৩২ জন, সুবর্ণ বণিকের মধ্যে ৪৫১ জন, ব্রাহ্মণের মধ্যে ৩৯৯ এবং কায়স্থের মধ্যে ৩৪৬ জন; বিহার ও উড়িষ্যার কায়স্থগণের মধ্যে ৩৩২ এবং ব্রাহ্মণগণের মধ্যে ১৬৮ জন; অর্থাৎ সমসংখ্যক ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের মধ্যে লেখাপড়া জানা কায়স্থের সংখ্যা লেখাপড়া জানা ব্রাহ্মণের সংখ্যার দ্বিগুণ। আর একটি কথা, বাংলায় বহুকাল হইতে কৈবর্ত্ত, নাপিত, সদ্গোপ এবং তিলি প্রভৃতি জাতি জলাচরণীয় বলিয়া পরিগণিত হওয়ায় অনেকটা সুবিধা হইয়াছে! কিন্তু মান্দ্রাজ ও বোম্বাই প্রদেশে লেখাপড়ায় ব্রাহ্মণগণ অন্যান্য জাতির অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ, ফলে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণের মধ্যে বিষম ব্যবধান রহিয়া গিয়াছে। এই ব্যবধানই ঐ দুই প্রদেশে জাতিবিদ্বেষের প্রধান হেতু। অথচ ৪ কোটী ১৫ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে মাত্র ১৫ লক্ষ ব্রাহ্মণ।

 সাত আট বৎসর পূর্ব্বে আমি বাঙ্গালীর মস্তিষ্কের অপব্যবহার সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি তাহা সমগ্র ভারতবর্ষ সম্বন্ধেই খাটে! সেই জন্য কথাগুলি আমি এখানেও উদ্ধৃত করিয়া দিলাম:—“নবদ্বীপের নব্যন্যায় ও স্মৃতির সূক্ষ্ম তর্কে বাঙ্গালীর যে বুদ্ধির প্রাখর্য্যের পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতে আমরা গর্ব্ব অনুভব করি সত্য, কিন্তু আমাদের ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে যে-সময়ে স্মার্ত্ত রঘুনন্দন মনু, যাজ্ঞবল্ক্য ও পরাশরের পুঁথি ঘাঁটিয়া নিয়ম বাহির করিতেছিলেন যে নয় বৎসর বয়সের বালিকা বিধবাকে কিরূপ কঠোর উপবাস করানো আবশ্যক এবং তাহা না করিলে তাহার পিতৃ পুরুষগণ নরকভোগ করিবেন; যে সময়ে রঘুনাথ, গদাধর ও জগদীশ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িকগণ প্রাচীন ন্যায়ের টীকা টিপ্পনী লিখিয়া টোলের ছাত্রগণের ভীতি উৎপাদন করিতেছিলেন, যেসময়ে আমাদের জ্যোতিষীগণ, গণনা করিতেছিলেন, নৈঋত কোণে কোন্ কোন্ মুহূর্ত্তে কাক ডাকিলে তাহার ফলাফল কি; যে-সময়ে আমাদের দেশের পণ্ডিতগণ তাল ঢিপ্ করিয়া পড়ে কি পড়িয়া ঢিপ্ করে এই গুরুতর বিষয় সম্বন্ধে প্রচণ্ড তর্কের দ্বারা সভ্যসমূহের শান্তি ভঙ্গ করিতেছিলেন; যে-সময়ে নবদ্বীপের বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিগণ অমূল্য সময়ের এইরূপ ব্যবহার করিতেছিলেন, সেই সময়ে ইউরোপে গ্যালিলিও, কেপ্‌লার, নিউটন ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিকগণ প্রকৃতির রহস্য উদ্ভেদ করিতেছিলেন এবং এক নবযুগের প্রবর্ত্তন করিয়া মানববুদ্ধির মহিমা প্রচার করিতেছিলেন।”

 স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থই বলিয়াছেন—“যে ধর্ম্মে গরীবের দুঃখ বোঝে না, মানুষকে উন্নত করে না, তাহা ধর্ম্মনামের যোগ্য নহে। আমাদের ধর্ম্ম এক্ষণে কেবল ‘ছুৎমার্গে’ পরিণত হইয়াছে—কাহাকে ছুঁইতে পারা যায়, কাহাকে ছুঁইতে পারা যায় নাং তাহারই বিচারে পরিণত হইয়াছে। হা ঈশ্বর! যে দেশের সর্ব্বপ্রধান পণ্ডিতগণ ডান হাতে খাইব না বাঁ হাতে খাইব এইরূপ কঠিন সমস্যার মীমাংসায় গত দুহাজার বৎসর ব্যস্ত আছেন; সে দেশের অধঃপতন হইবে না ত হইবে কাহার?

 বাংলার স্বামী বিবেকানন্দের মত পাঞ্জাবের স্বামী রামতীর্থও ভারতবর্ষে এবং আমেরিকায় একজন অসাধারণ ক্ষমতাশালী ধর্ম্মপ্রচারক বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছেন। তিনিও বিবেকানন্দের মত ওজস্বিনী ভাষায় বর্ত্তমান জাতিভেদ প্রথার অসারতা ও অনিষ্টকারিতা ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন:—“হিন্দুসমাজের অন্তর্গত নীচ জাতীয় লোকেরাই কঠোর পরিশ্রম দ্বারা সমাজের সেবা করিয়া থাকে, কিন্তু তাহার পরিবর্ত্তে উচ্চজাতীয় লোকেরা তাহাদিগকে নিজের ভুক্তাবশিষ্ট মাত্র দিয়া বাঁচাইয়া রাখেন। দরিদ্র নিম্নশ্রেণীস্থ লোকেরাই সমাজের চরণস্বরূপ বা ভিত্তিস্বরূপ। যে অহঙ্কারী সমাজ এই নিম্নশ্রেণীস্থ লোকেদের উপর অত্যাচার করে এবং তাহাদিগকে শিক্ষা ও সুবিধা লইতে বঞ্চিত করিয়া রাখে সে-সমাজ নিজের পা নিজেই কাটিয়া ফেলে, সে-সমাজ ভূমিশায়ী হইবেই হইবে।”

 আজকাল ‘অস্পৃশ্যতা’ ব্যাপারটি আবার একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে পরিণত হইয়াছে! একজন পারিয়া যদি একবারটি তোমার ঘরের চৌকাঠ ডিঙায় তাহা হইলেই অমনি ঘরের খাবার জল অপবিত্র বলিয়া সব ফেলিয়া দিতে হয়, কিন্তু বরফ লেমনেডের বেলায় তাহাদের তৈয়ারী হইলেও দিব্য আরামে পান করা চলে। সমাজের কেহ কোন বিশেষ সম্মান লাভ করিলে ভোজের আয়োজন হয়, পেলেটীর বাড়ী খানার বন্দোবস্ত হয়, সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা তাহাতে যোগদান করেন, তাঁহাদের নাম খবরের কাগজে বাহির হয়; তবুও কিন্তু বাবুদের জাত যায় না। কিন্তু যদি বিবাহে কি শ্রাদ্ধে কেউ মুসলমান কি তথাকথিত নীচ জাতি হিন্দুর সহিত একত্রে খাইল, অমনি সমাজ খড়্গহস্ত; তাহাকে জাতিচ্যুত করিয়া তবে নিশ্চিন্ত হয়। ইহার মধ্যে “যুক্তি, তর্ক কিম্বা সহজ বুদ্ধি” কোথাও আছে কি?

 জাতিপ্রথা একেবারে উঠাইয়া দেওয়া যদি আপাততঃ অসম্ভব বলিয়া বোধ হয়, তবে অন্ততঃ ইহার বাঁধাবাঁধি একটু শিথিল করিলে ক্ষতি কি? সমাজে যদি এত অমিল থাকে, সামান্য সামান্য চুলচেরা প্রভেদ লইয়া কেবল দলাদলি ও ঝগড়া লইয়াই যদি নিয়ত ব্যস্ত থাকি, তাহা হইলে দেশ কি আপনা আপনি স্বাধীন ও শক্তিমান হইয়া উঠিবে? জাতিভেদপ্রথাই যে আমাদের দুর্দ্দশার একটি প্রধান কারণ তাহা ‘প্রবাসী’ যথার্থই নির্দ্দেশ করিয়াছেন—

 “আমাদের হীনতার কারণ সম্বন্ধে সকলের স্পষ্ট ধারণা নাই। অনেকে এ বিষয়ে কিছু জানেন না, চিন্তাও করেন না। অনেকে পরিষ্কার করিয়া এরূপ না ভাবিলেও তাঁহাদের মনের মধ্যে যেন এই রকম একটা ধারণা আছে, যে আমাদের হীনতাটা বাহিরের কতকগুলি লোক বিদেশ হইতে আসিয়া আমাদের ঘাড়ে চাপাইয়া দিয়াছে, আমাদের ইহাতে কোন দোষ নাই। এই ধারণা ভ্রান্ত! বিদেশীদেরও দোষ আছে; কিন্তু প্রথম দোষ ও প্রধান দোষ আমাদের নিজের।

 দেশের সমুদয় পুরুষ নারী, সমুদয় বালক বালিকা লইয়া জাতি। এই-সব মানুষ বা ইহাদের অধিকাংশ হীন হইলেই জাতি হীন হইল।

 আগে হীনতার ধারণাটাই পরিষ্কার হউক। আমাদের দেশে কতকগুলি জা’তকে বলা হয় ভাল জা’ত, উঁচু জা’ত, শ্রেষ্ঠ জা’ত, ইত্যাদি; এবং অপর কতকগুলি জা’তকে বলা হয় নীচ জা’ত; ছোট জা’ত, ছোট লোক, হীন জা’ত প্রভৃতি। শিক্ষিত লোকেরা মোটামুটি জানেন যে এই তথাকথিত হীন জা’তের লোকদের সংখ্যাই বেশী, তথাকথিত উঁচু জাতের লোকদের সংখ্যা কম। সেন্সস্ রিপোর্ট দেখিলে বুঝা যায় যে এই ধারণা সত্য। আচ্ছা, যদি আমরা নিজেই আমাদের জাতির অধিকাংশ জাতের অধিকাংশ লোককে হীন মনে করি, তাহা হইলে আর-সমস্ত জাতিটা হীন হইতে বাকি থাকিল কি? অন্য জাতির লোকেরা, বিদেশী লোকেরা, আমাদিগকে হেয় মনে করিয়া অবজ্ঞা করিলে, আমাদিগের জাতিকে অপমান করিলে, আমরা চটিয়া যাই, এবং চটিয়া যাওয়া কতকটা স্বাভাবিকও বটে; কিন্তু আমরা নিজেই যে আমাদের দেশের কোটি কোটি লোককে “ছোট লোক” নাম দিয়া রাখিয়াছি, তাহাতে দোষ হয় না? তাহাতে আমাদের জাতির অপমান হয় না? ‘হীন’ জাতের লোকদিগকে কেবল যে নামেই হীন বলা হয়, তাহা নয়, সামাজিক ব্যবস্থা তাহাদিগকে, অর্থাৎ দেশের অধিকাংশ লোককে বাস্তবিকই হীন করিয়া রাখিয়াছে।”

 জাতীয় ঐক্যের প্রচারক কি বলিয়াছেন শুনুন:—ভারতবাসীরা বাস্তবিক বিশ্বাস করিতেন যে কেহ কেহ ব্রহ্মার মুখ হইতে, কেহ কেহ বা তাঁহার হাত হইতে এবং কেহ কেহ বা তাঁহার পা হইতে উৎপন্ন; তদনুসারে তাঁহারা আপনাদিগকে ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে ভাগ করিয়া কাহারও উপর লেখাপড়ার, কাহারও উপর যুদ্ধ বিদ্যার, কাহারও উপর ব্যবসার এবং বাকিদের উপর সেবার ভার দেন; ইহাতে যে একটি ‘অচলায়তনের’ সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা এখনও বর্ত্তমান রহিয়াছে এবং যতদিন ঐরূপ ধর্ম্ম বিশ্বাস থাকিবে, ততদিন উহা বর্ত্তমান রহিবে।”

 ম্যাট্‌সিনি আশি বৎসর আগে যে কথাগুলি বলিয়া গিয়াছেন আজও তাহা সভ্যজগতের কাণে বাজিতেছে।

 ভারতের ভবিষ্যৎ এই প্রশ্নের সমাধানের উপর নির্ভর করিতেছে। এই বিষয়ে কিন্তু প্রাচীন ভারত যথেষ্ট উদার ও বিজ্ঞ ছিল। ছান্দোগ্য উপনিষদে সত্যকাম জাবালের সুন্দর উপাখ্যান হইতে আমরা জানিতে পারি যে তৎকালে সত্য-প্রিয়তা ও বিদ্যার বলে লোকে সমাজের সর্ব্বোচ্চ সম্মান এবং শীর্ষস্থান (ব্রাহ্মণত্ব) লাভ করিতে পারিতেন।

 কেহ কেহ বলেন আমাদের বেদান্তের মতে সমুদয় জগতই ব্রহ্মের অংশ—উচ্চ জাতি, নীচ জাতি এইরূপ জ্ঞান প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞান হইতে উৎপন্ন। বেশ কথা, কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করি দেশের মধ্যে কয়জন এই উচ্চ দার্শনিক তর্ক হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে এবং সেই অনুসারে কাজ করিয়া থাকে? আমরা ত দেখি ব্রাহ্মণাদি উচ্চ জাতি নমঃশূদ্রাদিকে কুকুর শিয়ালের মত জ্ঞান করেন।

 অনেকে বলেন যে, অবনত জাতিরআ এতদিন ধরিয়া সমাজে তাহাদের হীন অবস্থার জন্য আদৌ দুঃখিত ছিল না, কেবল হালেই তাহাদের সম্মান জ্ঞান জাগিয়া উঠিয়াছে এবং তাহারা ইহার বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছে! আমাদের দেশের যুবকদের সম্বন্ধেও ‘এংলো ইণ্ডিয়ান্‌রা’ ঠিক এই কথাই বলিয়া থাকেন। ইউরোপীয়ান্‌দের আগমনের বহুপূর্ব্বে এমন কি খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতেও আমরা জাতিচ্যুতদের ভীষণ আর্ত্তনাদ শুনিতে পাই। সম্প্রতি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ ‘শূন্য পুরাণ’ বা ‘ধর্ম্মপুরাণ’ নামে একটি প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে; তাহাতে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম্ম যখন একটু একটু করিয়া হিন্দুধর্ম্মের সহিত মিশিয়া যাইতেছিল, সেই সময়কার অবস্থা বেশ জানিতে পারা যায়। এখানে তাহার একটি জায়গা উদ্ধৃত না করিয়া থাকিতে পারিলাম না—

দক্ষিন্যা মাগিতে যাএ জার ঘরে নাঞি পাএ
সাঁপ দিয়া পুড়াএ ভুবন।

* * *

ধর্ম্ম হইল যবনরূপী মাথা অত কাল টুপী
হাতে সোভে তিরুচ কামান।
চাপিয়া উত্তম হয় ত্রিভুবনে লাগে ভয়
খোদাঅ বলিয়া একনাম॥
নিরঞ্জন নিরাকার, হৈল্য ভেন্ত অবতার,
মুখেতে বলেত দম্বদার।
যত্তেক দেবতাগণ সভে হয়্যা একমন,
আনন্দেতে পরিল ইজার॥
ব্রহ্মা হৈল মহামদ, বিষ্ণু হৈলা পেকাম্বর,
আদম্ফ হৈল্যা শূলপানি।
গনেশ হৈল্যা গাজী কাত্তিক হইল্যা কাজী
ফকির হইল্যা মহামুনি॥
তেজিআ আপন ভেক, নারদ হৈল্যা সেখ
পুরন্দর হইল মৌলানা

চন্দ সুজ্জ আদি দেবে, পদাতিক হয়্যা সেবে,
সভে মিলি বাজান বাজনা॥
আপনি চণ্ডিকা দেবী, তিহ হৈল্যা হায়া বিবি,
পদ্মাবতী হইল বিবিনূর।
যত্তেক দেবতাগণ, হয়্যা সবে একমন,
প্রবেশ করিল জাজপুর॥

 ইহা হইতেই বুঝিতে পারা যায় যে ৬।৭ শত বৎসর পূর্ব্বেও ব্রাহ্মণবিদ্বেষ কিরূপ প্রবল ছিল।

 মধ্যে মধ্যে বিশেষতঃ গত তিন শতাব্দীতে, গুরু নানক, কবীর, চৈতন্য প্রভৃতি মহাত্মা এদেশে জন্মগ্রহণ করিয়া সকলেই “ভাই ভাই” এই সাম্যবাদ প্রচার করিয়া গিয়াছেন। যদি তাঁহারা এই শিক্ষা প্রচার না করিতেন, তাহা হইলে উত্তর ভারতে আরও অনেক লোকে নিশ্চয় মুসলমান ধর্ম্ম গ্রহণ করিত।

 আর্য্যগণ যেমন অনার্য্যদিগকে ঘৃণা করিতেন, প্রাচীনকালের ইহুদীরাও অন্যান্য জাতিকে সেইরূপ ঘৃণা করিত। তাহারা ভাবিত তাহারা ঈশ্বরের বিশেষ অনুগৃহীত ও অন্যান্য জাতিরা নীচ তাহাদের সঙ্গে আহার করিলে অশুচি হইতে হয়। যীশুখৃষ্ট প্রথমে ইহুদীদের শিক্ষা দিলেন মানুষ মাত্রেই ঈশ্বরের পুত্র—সকলেই ভাই ভাই। পরে সেণ্টপলও এই মহতী বাণীর ব্যাখ্যা করিয়া প্রচার করিলেন—“ঈশ্বর কেবল ইহুদীদেরই ঈশ্বর নহেন তিনি অন্যান্য জাতিরও ঈশ্বর।” কাজেই কাহাকেও নীচ বলিয়া অবজ্ঞা করা মূঢ়তার পরিচায়ক। মোক্ষ লাভের পথ সকলেরই পক্ষে মুক্ত। কিন্তু গর্ব্বান্ধ ইহুদী এই সনাতন সত্যের মর্ম্ম উপলব্ধি করিতে পারিল না। ইহার ফল কি হইল? ইহুদী জাতি এখন স্বদেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া পৃথিবীময় অত্যাচারিত ও ঘৃণিত হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। পৃথিবীর দুইটি প্রাচীন সভ্যজাতি হিন্দু ও ইহুদী নিজের গর্ব্বান্ধতার ফলে আজ এত দীনহীন হইয়া পড়িয়াছে।

 তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর হিন্দু একথা যেন কখন না ভোলেন যে যদি তাঁহারা তাঁদের অশিক্ষিত দেশভ্রাতাগণকে চণ্ডাল, অন্ত্যজ, পঞ্চমা প্রভৃতি অবজ্ঞাসূচক অভিধানে অভিহিত করিয়া তাহাদের নিকট হইতে দূরে থাকেন তাহা হইলে তাঁহারা সমগ্র হিন্দুজাতির উন্নতির আশা সমূলে নাশ করিবেন। বাংলা দেশের আমরা ২৫ লক্ষ তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর হিন্দু সাড়ে চার কোটী অবশিষ্ট হিন্দু ও মুসলমান হইতে পৃথক থাকিয়া নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারিয়াছি। যাহাদিগকে আজ অবজ্ঞা করিতেছি কে বলিতে পারে উপযুক্ত শিক্ষা ও সুযোগ পাইলে তাহাদের মধ্যে অনেক বীর বা জ্ঞানী হইতে পারিত না? শাস্ত্রবিশ্বাসী হিন্দু কি বিস্মৃত হইয়াছেন যে দেবর্ষি নারদ ও ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ দাসীপুত্র ছিলেন এবং মহর্ষি ব্যাস ধীবরের কন্যার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। আর এত দিনের কথায়ই বা কাজ কি? মুসলমান-অধিকারের সময়েও ভারতবর্ষে শূদ্র তুকারাম, জোলা কবির, মুচি রুহীদাস, এবং মান্দ্রাজের ঘৃণিত ও অত্যাচারিত পঞ্চমা শ্রেণীভুক্ত সাধুগণের কাহিনী পড়িলে বুঝা যায় জ্ঞান বা ভক্তি কোনো শ্রেণীবিশেষের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়! জাতিধর্ম্ম নির্ব্বিশেষে সমস্ত লোকই যে দেশে শিক্ষার অধিকার ও উন্নতির সুযোগ লাভ করিয়া থাকে সেই দেশই অচিরে সর্ব্বসৌভাগ্যশালী হইয়া উঠে।

 এই সম্বন্ধে ‘প্রবাসীর’ উক্তি প্রণিধানযোগ্য:—“জ্ঞানে, ধর্ম্মে, চরিত্রাংশে, সাহসে, স্বার্থত্যাগে, ধনশালিতায়, দৈহিক বলে, শিল্পনৈপুণ্যে,—নানাদিকে হীন হইলে, জাতিকে হীন বলে। আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক নিরক্ষর ও অজ্ঞ; পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যে অজ্ঞতা খুব বেশী; আমরা সাত্ত্বিকতার বড়াই যতই করি না, সাত্ত্বিকতার প্রকৃত অর্থ অনেকেই বুঝি না; সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক আমাদের মধ্যে কম। যিনি শ্রেয়কে বরণ করেন, এবং যিনি নিজের ও লোকের শ্রেয়ের জন্য সর্ব্বপ্রকার ক্ষতি ও দুঃখ সহ্য করিয়া সৎকর্ম্ম করেন, তিনি সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক। দেশের অধিকাংশ লোক দারিদ্র্যবশতঃ ভাল করিয়া খাইতে পায় না; তজ্জন্য তাহারা দুর্ব্বল। তাহার উপর নানা রোগে তাহাদিগকে আরো দুর্ব্বল করিয়া রাখে। বৈদেশিক প্রতিযোগিতায় এবং শিক্ষার অভাবে শিল্পনৈপুণ্য দেশে না থাকারই মধ্যে। তাহাতে আমাদিগকে আরো দরিদ্র, দুর্ব্বল ও ভীরু করিতেছে।

 আমাদের হীনতার কারণ একটি নয়, অনেক। তাহারই দুই-একটির উল্লেখ করিতেছি।

 দেশের প্রত্যেক পুরুষ ও প্রত্যেক নারীর সমান-মনুষ্যত্ব অস্বীকার আমাদের হীনতার একটি প্রধান কারণ। জন্মতঃ কেহই বড় নয়, কেহ ছোটও নয়। সেই সামাজিক ব্যবস্থাই সুব্যবস্থা, যাহা জন্মনির্বিশেষে প্রত্যেক নারী ও পুরুষকে তাহার শক্তি ও চেষ্টা অনুসারে যে কোন দিকে ভাল ও বড় হইবার, সমাজসেবক হইবার, সমান সুযোগ দেয়। এ পর্য্যন্ত কোন দেশের সমাজব্যবস্থাই এরূপ নিখুঁত হয় নাই; কিন্তু পাশ্চাত্য কোন কোন দেশের সমাজনীতি এই আদর্শের দিকে অনেকটা অগ্রসর হইয়াছে। আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থায় এই সাম্যনীতি যে ভাবে অস্বীকৃত হইয়া আসিতেছে, এখন তাহা আর কোন দেশে সেভাবে কার্য্যতঃ অস্বীকৃত হইতেছে না। এজন্য আমরা হীন হইয়া আছি, অন্য কোন জাতি শক্তিশালী ও অগ্রসর হইতেছে। অনেকে সামাজিক সাম্যের মানে না বুঝিয়া বা উহার কদর্থ করিয়া সাম্যনীতিকে উপহাস করিয়াই নিশ্চিন্ত থাকেন। সামাজিক সাম্যের মানে ইহা নয় যে প্রত্যেক মানুষেরই বুদ্ধিবৃত্তি বা অন্যবিধ শক্তি সমান, এবং সব মানুষ সব বিষয়ে সমান। ইহার মানে এই, যে জন্মনির্বিশেষে সকল মানুষের কোন না কোন দিকে ভাল, শক্তিশালী ও গুণশালী হইবার সমান সম্ভাবনা থাকায়, সকলেরই ব্যক্তিত্ব ও গুণ বিকাশের, শক্তি অর্জ্জনের সমান সুযোগ পাওয়া উচিত। জা’তবিশেষে, পরিবারবিশেষে কেহ জন্ম গ্রহণ করিয়াছে বলিয়াই ধরিয়া লইবার কোন কারণ নাই যে সে বুদ্ধিতে, জ্ঞানে, শক্তিতে, চরিত্রে, বীরত্বে, বা অন্য কোন বিষয়ে হীন হইবেই। পক্ষান্তরে ইহাও ধরিয়া লওয়া উচিত নহে যে কেহ কোন জা’তে, বংশে, বা পরিবারে জন্মিয়াছে বলিয়াই তাহার একটা গুণশালী মানুষ হইবার সম্ভাবনা বেশী। পৃথিবীর সব দেশের ইতিহাসেও দেখা যায় যে; অধিকাংশ সুপ্রসিদ্ধ লোক তাঁহাদের বংশকে ধন্য করিয়াছেন, কিন্তু বিখ্যাত বংশে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহারা ধন্য ও কীর্ত্তিমান হন নাই।”

 স্বর্গীয় ডি, এল, রায় বলিয়াছিলেন—“জাতির সমস্ত বিদ্যা, যশ, ক্ষমতা আত্মসাৎ করে’ নিজে বাড়বে? শরীরকে অনশনে রেখে মস্তিষ্ক বড় হবে? তা কি সয়? সয় না। তাই এই অধঃপতন।”

 তারপর আমাদের সমাজে মেয়েদের অবস্থাটা একবার ভাবুন; ইহার আমূল পরিবর্ত্তন কি একান্ত বাঞ্ছনীয় নয়? অমর কবি সেক্সপিয়র লিখিয়া গিয়াছেন যে অজ্ঞতা ভগবানের অভিসম্পাত। যদি তাহাই হয় তবে স্ত্রীলোকের অজ্ঞতা কি আরও দশগুণ অধিক অভিসম্পাত নহে? পুরুষেরা সদাসর্ব্বদাই বাহিরে রহিয়াছে, নানান রকম লোকের সহিত ব্যবহার করিতেছে, তাহাদের আচার, শিক্ষা, নীতি প্রভৃতি দেখিতেছে ও নিজেদের দোষগুলি বুঝিয়া লইয়া সংশোধন করিয়া লইতেছে। কিন্তু কি দুঃখের বিষয় যে আমাদের দেশের মেয়েরা অস্বাস্থ্যকর অন্দরের মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া বহির্জগতের কোনও সম্পর্কে আসিতে পায় না, কূপমণ্ডুকের ন্যায় জীবন যাপন করিতে বাধ্য হয়। ইহার ফলে তাহারা ছেলেবেলায় মাতার নিকট হইতে যে সমস্ত ভ্রান্ত শিক্ষা ও কুসংস্কারগুলি শিখে, সেগুলি তাহাদের মনে ধ্রুব সত্য বলিয়া গাঁথিয়া যায়, বড় হইয়াও আর সেগুলি ভুল বলিয়া বুঝিতে পারে না; কাজেই আবার নিজেদের ছেলেদের সেইমত শিক্ষা দিয়া থাকে; এইরূপে ভুল শিক্ষাগুলি তাহাদের অস্থিমজ্জাগত হইয়া উঠে।

 বাস্তবিক আমাদের বালিকা বধূদের চরিত্র ঠাকুরমাদের দ্বারাই গঠিত হইয়া থাকে। আমরা ‘হোমরুল’ সম্বন্ধে অনেক কথা কাটাকাটি করিয়া থাকি কিন্তু অন্দরের ভিতর যে ঠাকুরমারূপী একজন যথেচ্ছাচারী সম্রাট রহিয়াছেন, এবং তিনি বালিকা বধূদের অনুমাত্র ব্যক্তিত্ববিকাশের সুযোগ না দিয়া যথেচ্ছ ছাঁচে ঢালাই করিতেছেন, একথা একেবারেই ভুলিয়া যাই। এইরূপে শিক্ষিত যুবকদিগের জীবনে দুটি ভাগ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার একটির সহিত আর একটির কোন সম্পর্ক নাই। বৈঠকখানায় তাঁহারা উপনিবেশগুলির ন্যায় ‘হোমরুল’ পাইবার জন্য বিস্তর বাক্‌বিতণ্ডার পর অন্দরে প্রবেশ করিয়া খেলাঘরের পুতুল খেলা আরম্ভ করেন। তাঁদের জীবন-সঙ্গিনীগণ জ্যান্ত পুতুল ছাড়া আর কি?

 এই সব জ্যান্ত পুতুলের নিখুঁত ছবি রবীন্দ্রনাথের নিপুণ তুলিকায় চমৎকার ফুটিয়াছে:—

(বাসর শয়নে)

বর। জীবনে জীবনে প্রথম মিলন
সে সুখের কোথা তুলনা নাই।

এস, সব ভুলে’ আজি আঁখি তুলে’
শুধু দুঁহুঁ দোঁহা মুখ চাই।

* * *

বল একবার, “আমিও তোমার,
তোমা ছাড়া কারে নাহি চাই!”
ওঠ কেন, ওকি,  কোথা যাও সখি
কনে। (সরোদনে) “আইমার কাছে শুতে যাই!”

(অন্দরের বাগানে)


বর। কি করিছ বনে শ্যামল শয়নে
আলো করে’ বসে’ তরুমূল?
কোমল কপোলে যেন নানা ছলে
উড়ে এসে পড়ে এলোচুল!
পদতল দিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া
বহে’ যায় নদী কুলকুল।

* * *

কানন নিরালা আঁখি হাসি-ঢালা,
মন সুখস্মৃতি-সমাকুল!
কি করিছ বনে কুঞ্জ ভবনে?
কনে। খেতেছি বসিয়া টোপাকুল! (মানসী)

 আপনাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী অনেকেই হয়ত বিবাহের সময় যেখানে সব চেয়ে বেশী টাকা পাওয়া যাইবে, সেই খানেই আপনাকে বিক্রয় করিতে কুণ্ঠা বোধ করিবেন না। আপনাদের মধ্যেই আবার কেহ কেহ বা জ্ঞানতঃ বা অজ্ঞানতঃ স্নেহলতার ন্যায় অনেক কন্যার আত্ম বিসর্জ্জনের জন্য দায়ী আছেন বা দায়ী হইবেন। আমাদের সমাজের অনেক নেতাই বরপনের বিরুদ্ধে বক্তৃতায় পঞ্চমুখ, কিন্তু আপনাদের ছেলের বিবাহের বেলায়, তাঁহারা সে সব কথা ভুলিয়া যান ও বেশ পীড়ন করিয়া টাকা লইয়া থাকেন। কিছু বলিতে গেলে তখন মায়ের বা স্ত্রীর ঘাড়ে অম্লানবদনে দোষ চাপাইয়া আপনি সাধু সাজিয়া বসেন। দেশের আশাভরসা-স্থল হে যুবকবৃন্দ! অন্যায়ের বিরোধী হইবার সাহস কি আপনাদের নাই? আত্মমর্য্যাদাজ্ঞান কি একেবারে লোপ পাইয়াছে?

 প্রাচীনকালে ভারতে গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি বিদুষী জন্মগ্রহণ করিয়া গিয়াছেন বলিয়া আমরা অহরহ গর্ব্ব করিয়া থাকি। বেদের অনেক স্ত্রোত্র যে মেয়েরা লিখিয়া গিয়াছেন তাহাও আমরা জানি এবং সুবিধামত উল্লেখ করি। বৌদ্ধধর্ম্মের অভ্যুদয়কালে মেয়েরাও যে ধর্ম্মসম্বন্ধে বক্তৃতা করিয়া লোক মাতাইতে পারিতেন, তাহাও আমরা পড়িয়াছি। তবে আজকাল স্ত্রীশিক্ষার প্রতি আমরা এত উদাসীন কেন?

 উচ্চ জাতির মেয়েরাও যে কোন কোন বিষয়ে ঠিক অবনত জাতিদের ন্যায়ই কষ্ট ও অসুবিধা ভোগ করিয়া থাকেন, সে বিষয়ে কোন সংশয় নাই। আমরা তাঁহাদিগকে খাইতে পরিতে দিই এবং মোটের উপর ভাল ব্যবহার করিয়া থাকি সত্য, কিন্তু দুর্লভ মানবজীবনে খাওয়া পরাই কি সার হইল? আর কিছুই কি করণীয় নাই? অঁহাদিগকে লেখাপড়া শিখাইতে এবং যাহাতে তাঁহাদের মানসিক বৃত্তিগুলি যথোচিত মার্জ্জিত ও পরিবর্দ্ধিত হইতে পারে, তাহার চেষ্টা করিতে কি আমরা ধর্ম্মতঃ এবং ন্যায়তঃ বাধ্য নহি? সমাজের অর্দ্ধাঙ্গই যদি ঘোর অজ্ঞানান্ধকারে নিমজ্জিত রহিল, তবে তাহার উন্নতি কিরূপে সম্ভব হইবে?

 যাঁহারা মনে করেন যে সমাজের ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি ব্যতিরেকেও রাজনৈতিক উন্নতি সাধন সম্ভবপর তাঁহারা নিতান্তই ভ্রান্ত। দেহের সকল অঙ্গ পরিপুষ্ট না হইলে দেহ সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবল হয় না। জাতীয় সমস্যার কেবল একদিক হইতে আলোচনা না করিয়া সকল দিক হইতেই আলোচনা করিতে হইবে। এই আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া দেশের কাজ করিলে আমরা অবশ্যই কৃতার্থ হইব।

 পরিশেষে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ের কেবলমাত্র, উল্লেখ করিয়া এই সব বিষয়ের আলোচনার ভার যোগ্যতর ব্যক্তিদিগের হস্তে অর্পণ করিতেছি—

 (১) হিন্দু সমাজে বালকবালিকাদের বিবাহের বয়স বৃদ্ধি।

 (২) সহবাস-সম্মতির বয়স ষোড়শ বৎসর ধার্য্য করা।

 (৩) ১৮৭২ সালের ৩ নম্বর আইনের ভূপেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের মতানুযায়ী সংশোধন।[]

 (৪) সমুদ্র যাত্রার বিরুদ্ধে সামাজিক বাধা বিপত্তির দূরীকরণ।

 একসময়ে ভারতবর্ষ জ্ঞান-ধর্ম্ম-সভ্যতায় জগতের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল। ভারতবর্ষ হইতে সভ্যতার আলোক দেশ বিদেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। মানবেতিহাসের জন্মলগ্নে সমগ্র জগত ভারতের নিকট জ্ঞান বিজ্ঞান শিখিত, সমাজিক রীতিনীতি শিখিত, স্বার্থত্যাগ ও পবিত্রতা শিখিত। কিন্তু পরে কয়েক শতাব্দীব্যাপী সামাজিক অবিচার ও অত্যাচারের ফলে ভারত এক্ষণে অন্যান্য জাতির পদতলে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহার শরীরে বল নাই, মনে স্ফুর্ত্তি নাই। জাতীয় শরীরের হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে যে রক্ত সঞ্চরণ করে তাহা তাহার নিম্ন অঙ্গে পৌঁছায় না। ইহার ফলে নিম্ন অঙ্গগুলি পক্ষাঘাতগ্রস্ত পঙ্গু হইয়া পড়িয়াছে। যতদিন না আবার এই অসাড় অঙ্গগুলির মধ্যে রক্ত-সঞ্চার আরম্ভ হয়, যতদিন না সমাজের নিম্নশ্রেণীর মধ্যে এবং নারীজাতির মধ্যে জ্ঞানের আলোচনা আরম্ভ হয়, ততদিন পর্য্যন্ত ভারতের জাতীয় উন্নতি লাভ দুরাশা মাত্র। ধনী ও দরিদ্র, উচ্চপদস্থ, ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ আমার দেশবাসী সকলের নিকট আমি যুক্তকরে প্রার্থনা করিতেছি যে তাঁহারা নিজ নিজ বংশমর্য্যাদা ও পদগৌরব বিস্মৃত হইয়া সকলের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করুন। সমাজের অবিচারের ফলে আমরা সভ্য জগতের নিকট ঘৃণিত হইতেছি। শিক্ষিত জগৎ আমাদিগকে কি চক্ষে দেখে তাহার নিদর্শনস্বরূপ সিনেটার রিড আমেরিকায় সম্প্রতি (May 26, 1919) যে বক্তৃতা দিয়াছেন তাহার কিঞ্চিৎ এইখানে উদ্ধৃত করা যাইতেছে।

 I can give you a picture of India in a word. She has a population of 294, 301, 056·········Such a people mark and brand themselves at once as not only unfit for the government of others, but as almost unfit for their own government; yet I would not deny that right to the lowest of God’s creatures if he lived off with others like himself and wanted a government of his own. Amongst those 294, 000,000, people there is no excuss of superstition to which they have not gone; there is no shadow of intellectual night so black that they have not wrapped their souls in its sable folds; there is no species of caste by which men have sought to divide themselves and keep oppressed by power and priestcraft their fellowmen that has not been rife in India for centuries of time.

 ভারতবাসী নিদ্রা ত্যাগ করুন, জড়তা দূর করুন, সকলের হৃদয়ে আশা উৎসাহ জাগাইয়া তুলুন, নারীসমাজের ও অবনত জাতিগণের অবস্থার উন্নতি করুন, সামাজিক অনৈক্য ও অবিচারের প্রতিবিধান করুন। তাহা হইলেই আমাদের জন্মভূমি আবার জগদ্বরেণ্যা হইয়া উঠিবেন, আবার আমরা তাঁহাকে তাঁহার প্রাচীন রত্নসিংহাসনে অধিষ্টিতা দেখিতে পাইব। এই আশা ও আকাঙ্ক্ষা আমাদের বাহুতে শক্তিপ্রদান করুক, আমাদের হৃদয়ে সাহস প্রদান করুক। ভগবান আমাদের সহায় হউন।[]

  1. Presidential Address at the Indian National Social Conference held at Calcutta, December 1918.
     অধ্যাপক শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এম্ এ কর্ত্তৃক অনূদিত এবং পরিবর্দ্ধিতাকারে প্রকাশিত।
  2. এখন পেটেল বিল।
  3. ১০৫ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে যে বর্ত্তমান রাজপুতদের পূর্ব্বপুরুষগণ শক ও হূণ ছিল। ইদানিন্তন কালেও অনেক পাহাড়িয়া মঙ্গোলীয় জাতি হিন্দু কায়স্থ ও বৈদ্য বলিয়া পরিগণিত হইতেছে:—
     “The same was doubtless the case in the Surma Valley which must once have been dominated by Bodo tribes allied to the Tipperas on the south and the Garos and Koches on the north. At the present day, there are very few traces of a recent aboriginal element, but this is due largely to the absorbent power of Hinduism; as lately as 1835 Pemberton found that members of Jaintia royal family were able in course of time to gain admission to the Kayastha and Vaidya castes, and if these castes opened their portals to aborigines of high social position other less exalted communities doubtless did the same to those of a humbler origin. The Kaibarttas and Chandals of Namasudras, probably include in their ranks large number of Bodo proselytes.”
    Gait’s “Assam”