আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/৩
অন্ন-সমস্যা ও তাহার
সমাধান[১]
ম্যালেরিয়ায় দেশ শ্মশান হইয়াছে। দুই-একটি জেলা ছাড়া সমগ্র দেশে জন্ম হইতে মৃত্যুর আধিক্য। ম্যালেরিয়ার অন্যতম কারণ অন্নাভাব। উদর পূর্ত্তি করিয়া দুবেলা আহার করিবার সৌভাগ্য শতকরা ক’জনের আছে, তাহা তো সকলেই জানেন। আজ দেশের যেদিকে দৃষ্টিপাত করা যায় সর্ব্বত্র অন্নাভাব ও হাহাকার।
এই দুরবস্থা হইল কেন? আজ যে হঠাৎ হইয়াছে, এমন নয়। আজ শত বর্ষ ধরিয়া তিল তিল করিয়া আমরা এই দুঃখ অর্জ্জন করিয়াছি। আমাদের কার্য্যক্ষেত্র সঙ্কীর্ণ—ক্ষুদ্র গণ্ডীর আবেষ্টনে সীমাবদ্ধ। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভ হইতে ইংরেজী লেখাপড়া শিখিয়া আমরা কেবল উকীল, মোক্তার, ডাক্তার ও কেরাণী হইতেছি। এ রকম করিয়া জাতি কতদিন টিকে? দেশে মাম্লা মোকদ্দমা যখন আছে, তখন উকীলদের দর্কার। ব্যামো পীড়ার প্রকোপ নিবারণকল্পে ডাক্তারও একটা আবশ্যকীয় আপদ্। প্রয়োজনের প্রায় বিশগুণ অধিক উকীল সৃষ্ট হইয়াছে এবং প্রবলবেগে আরো সৃষ্ট হইতেছে। আশু-বাবু হোমিওপ্যাথিক বিষে বিষক্ষয় নীতির অনুসরণ করিয়া আরো উকীল তৈরী করিতেছেন।
মুসলমান রাজত্বের অবসানে বাঙ্গালী হিন্দু বুঝিয়া লইলেন যে, পার্শী পড়িয়া মুন্সী হইলে আর চলিবে না। তখন উদরান্নের সংস্থান ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য অনেকেই পার্শী পড়িতেন। আমার পূর্ব্বপুরুষগণে মধ্যেও কেহ কেহ পার্শীতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে ও পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সৃষ্টি হইলে সকলে ইংরেজী শিখিতে আরম্ভ করায় ইংরেজ দেখিলেন যে, ইহাদের দ্বারা রাজকার্য্য পরিচালনের বড়ই সুবিধা হয়। তাই তখন ইংরেজী জানিলেই চাকরী। কেহ ওকালতী পাশ করিলেই সরকারী উকীল, বি-এ পাশ করিলেই হাকিম। এইরূপ সরকারী চাকুরী অনায়াসলভ্য হওয়ায় ও তাহার সম্মানের সম্বন্ধে একটি মিথ্যা মোহ থাকায় বাঙালীগণ আরামপ্রিয় হইয়া উঠিলেন। ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি ত্যাগ করিয়া ইংরেজী চর্চ্চায় মনোনিবেশ করিলেন। তখনকার দিনে রামদুলাল দে, মতিলাল শীল প্রভৃতি বিখ্যাত ব্যবসায়িগণ কিরূপে প্রভূত অর্থ উপায় করিয়া ক্রোড়পতি হইয়াছিলেন, তাহা এখন আখ্যান বিশেষ। এই সমস্ত ব্যবসায়িগণের অনেকেই জমিদার হইয়া পড়েন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কৃপায় তাঁহাদের পুত্রপৌত্রাদি সেই-সমস্ত বিষয় সুখে ভোগ-দখল করিলেন। হৌসের মুৎসুদ্দি ও বেনিয়ানের পদ ক্রমে ক্রমে মাড়োয়ারীরা করতলস্থ করিলেন। অচিরাৎ উদ্যমস্পৃহার অভাবে বাঙ্গালীর ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় লুপ্ত হইল।
বাঙ্গালী জাতিকে অধঃপতিত করিবার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বহুলপরিমাণে দায়ী। এই প্রথায় যেমন কল্যাণ হইয়াছে কিছু, অপকার ও অকল্যাণ হইয়াছে অনেক বেশী। গবর্ণমেণ্ট ও জমিদার এবং প্রজার মাঝামাঝি নানা প্রকার লোকের স্বত্ব আছে। যেমন, তালুকদার, পত্তনিদার, ইত্যাদি। এ-সমস্ত উপস্বত্ব ভোগীরা শুধু আলস্যে বসিয়া বসিয়া দিন গুজ্রান করে। ইহাদের দ্বারা দেশের কল্যাণকর অর্থোৎপাদক (productive of wealth) কোন কার্য্য হয় না। এই ময়মনসিংহ জেলার ৪৫ লক্ষ লোকের মধ্যে যদি ৪৫০০০ হাজার ভদ্রলোক চাকরী আদি করেন, তবে শতকরা একজন এবং ২২॥০ হাজার হইলে শতকরা আধ জন উপার্জ্জক, আর বাদ বাকী ভদ্রলোক সকলে জমির সঙ্গে কোন না কোন প্রকারে সংসৃষ্ট হইয়া আলস্যে দিন কাটান। এই উদ্যমবিহীনতাই জাতির দুর্গতির অন্যতম কারণ, সর্ব্বপ্রকার সর্ব্বনাশের প্রধানতম হেতু।
কার্য্যক্ষেত্রের সঙ্কীর্ণতা ধনাগমের পথকে রুদ্ধ করিয়াছে। ইংলণ্ডে ও আমেরিকায় কত লোক কত প্রকারে অর্থোপার্জ্জন করে। সেখানে চাকুরীজীবী হীন বলিয়া গণ্য হয়। সে-দেশে জাহাজে কত দেশ-বিদেশের পণ্য পারাপার হয়। এই ব্যবসায়ে কত লোকের উদরান্নের সংস্থান হয়। সাগরে ঝড়-ঝঞ্ঝা অবহেলা করিয়া কত লোক নৌবৃত্তি অবলম্বন করে। এলিজাবেথের পর হইতে বম্বেটিয়ার দস্যুতাবৃত্তি (piracy) বন্ধ হইয়াছে বটে, কিন্তু বিপৎসঙ্কুল-কার্য্য-প্রিয় ইংরেজ পৃথিবীকে তাহার জাহাজ দিয়াই করায়ত্ত করিয়াছে। বাণিজ্যজীবী ইষ্ট্ ইণ্ডিয়া কোম্পানী এ-দেশের মালিক হইয়াছিলেন। তাই আজও আমরা বলি “কোম্পানীর মূলুক।”
আগে জাহাজ পালে চলিত। বাল্যকালে গঙ্গার ঘাটে পাল-উড়ান জাহাজ দেখিতে পাইতাম। এখনত কলকব্জার দিন। এক-একখানি বাণিজ্যপোত করিতে কত লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। তা ছাড়া এক-একখানি নূতন ধরণের রণপোত নির্ম্মাণ করিতে ৩।৪ কোটি টাকার কমে হয় না। কত সরঞ্জাম, কত ইঞ্জিনিয়ার, কত নক্সাদার প্রথমেই দরকার। তারপর হাজার হাজার টন লোহার প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন সর্বরাহ করিতে কত লোহার কার্খানা। যাঁহারা তাতার লোহার কার্খানা দেখিয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, একটি লোহার কারখানা কি! কত সহস্র লোক সেখানে খাটে। দানবীর এণ্ড্রু কার্ণেগীর লোহার কার্খানা বিক্রি হইল ৯০ কোটি টাকা দামে! তারপর সেই লোহা পেটা ও ঢালাইয়ে কত লোক খাটে। হাতুড়ির ঘায়ে আর অবশ্য এখন পেটাই হয়, না, কিন্তু বাতাস-ঠেলা হাতুড়ি (pneumatic hammer) চালাইতেও কম লোক লাগে না। তারপর জাহাজ চালাইতে কয়লার দর্কার। খনিতে কত লোক খাটে তাহা আপনারা জানেন। এইরূপে একটি ব্যবসায় আরো কত ব্যবসায়কে জীবিত রাখে।
টাঙ্গাইল, ঢাকা, ফরাসডাঙ্গা অঞ্চলে যে-সমস্ত উৎকৃষ্ট বস্ত্র নির্ম্মিত হইত, লাঙ্কাসায়ার এদের স্থান কাড়িয়া লইয়া খুব উন্নত হইয়াছে এ-কথা সকলেই জানি। কিন্তু তাহাদের উন্নতি সম্বন্ধে বিবরণ পড়িয়া কোন স্পষ্ট ধারণা হওয়া সম্ভব নয়। সেদিন বিলাতে ম্যাঞ্চেষ্টারের পাইকারী সমবায় ভাণ্ডার (Co-operative Wholesale Stores) দেখিতে গিয়াছিলাম। আমি ও কয়েকটি ভারতীয় ছাত্র কর্ম্মকর্তার সঙ্গে দেখিতে যাই! মোটর কারে কার্য্যস্থলে আমাদিগকে লইয়া গেলে দেখিলাম তাঁহাদের বাৎসরিক বিক্রি প্রায় ১৫০ কোটী টাকা। আর আমাদের ভারত-সাম্রাজ্যের সমগ্র রাজস্ব হচ্ছে ১৩২ কোটী টাকা। ব্যাপার কি বুঝুন! তাদের বিক্রি তো বাইরে নয়, শুধু নিজেদের অংশীদারদের মধ্যে। আট দশটি বিস্কুটের ও সাবানের কারখানা। নিজেদের গো-চারণের সুবিস্তীর্ণ মাঠে শত সহস্র গাভী,। সেই-সমস্ত গাভীর দুগ্ধে নিজেদের জন্য জমাট্ দুধ তৈরি হয়। নিজেদের জাহাজে সুদূর সিংহল হইতে নিজেদের বাগানে উৎপন্ন চা আনা হয়।
এই ল্যাঙ্কাসায়ারে যুদ্ধের পূর্ব্বে প্রতিবৎসরে ৩০০ কোটী টাকার কাপড় তৈরি হইত। তন্মধ্যে প্রায় ৭৫ কোটী টাকার উপর ভারতবর্ষে আসিত। যে-সমস্ত কারখানায় ৩০০ কোটী টাকার কাপড় তৈরি হয়, তাহাতে কত কল-কার্খানা, কত যন্ত্রপাতি, কত ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার ও কত লক্ষ শ্রমজীবীর প্রয়োজন তাহা চিন্তা করুন।
চাকরী-জীবী-বাঙ্গালীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ স্বপ্ন হাইকোর্টের জজিয়তি। তাহাও তো মোটে ৫।৬ জন হইতে পারেন। আর আয়ও মাসে ৫০০০৲ টাকা। কিন্তু একজন ব্যবসাদার যার ৫০০০৲ টাকা আয়, তার কয়টা গদি বা ‘মোকাম’ থাকে, এবং সেখানে কত লোক অন্নসংস্থান করে, চিন্তা করুন।
বেঙ্গল কেমিক্যালে ১৩০০ লোক খাটে। ১৫০-২০০ ভদ্র সন্তান নিযুক্ত আছেন। এটি তো সামান্য ব্যবসায়। উকীল মোক্তারেরা অনেকে খুব রোজ্গার করেন সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহা productive labour (ধনোৎপাদক পরিশ্রম) নহে। পদ্মানদীর চরের মতো এক পাড় ভাঙ্গিয়া আর-এক জায়গায় চর পড়া। দেশের অর্থ দেশেই রহিল।
ইংরেজ প্রয়োজন হইলে সমস্ত কাজই করিতে প্রস্তুত। ঘরে অন্ন না মিলিলে দেশ বিদেশে অর্থোপার্জ্জনে যাইতে তাহার কোন বাধা নাই। অন্ধ সংস্কার তার কর্ম্মচেষ্টাকে সঙ্কুচিত করে না। ইংরেজের যত সাম্রাজ্য ও উপনিবেশ স্থাপিত হইয়াছে, তা অনেক স্থলে দেশের সব ডান্পিটে ও বদমায়েস (Criminal) এবং তথাকথিত লর্ড ক্লাইবের মতো ‘বাপেখেদানো’ ‘অকর্ম্মণ্য’ ছেলেদের দ্বারা। কুমোরের কাদার ঢিপির মতো ত্রিভঙ্গমুরারী ভালছেলে দেশে অনেক হইয়াছে,এখন কিছু ডান্পিটে বেপরোয়া ছেলের দর্কার। বাল্যে মাতা, যৌবনে স্ত্রীর বসনাঞ্চলের অন্তরালের সুরক্ষিত আশ্রয়ে বাস করিয়াই তো এই দুর্গতি হইয়াছে; আমাদের কোন অসমসাহসিকতা (spirit of adventure) নাই। পুল হইবার আগে গঙ্গা পার হইতে হইলে অনেকে কাঁদিয়া আকুল হইত। এ-অঞ্চলের মুসলমান ভ্রাতাগণ এ-বিষয়ে অনেক অগ্রসর। এখানে আর এখন জমি মেলা দায়। তাই প্রতিদিন ষ্টীমারে ময়মনসিংহ হইতে অনেক চাষীরা আসামে গিয়া জমির ইজারা নিতেছেন। বাড়ীর তিন ছেলের একজন দেশে থাকিতেছেন আর দুইজন বাহির হইয়া পড়িতেছেন, হয় জমির তল্লাসে নয় ষ্টীমার জাহাজে সারেঙ্গ কিম্বা মাঝি মাল্লা হইতে। হয়ত পদ্মায় চর উঠিয়াছে, তখনও মালিকের কোন ঠিকানা নাই। এরা গিয়ে দু’চার বছর বিনা খাজনায় চাষ আবাদ করিল। তারপর মালিকী সাব্যস্ত হইলে সেখানে থাকিয়া গেল, নয় ত ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিল। আমাদের হিন্দু ভ্রাতাদের ন্যায় বাড়ীর চার ছেলে পৈতৃক দুই বিঘা জমি চুলচেরা ভাগ-বাটোয়ারা করিয়া নিঃস্ব না হইয়া এই-রকম করিয়া এঁরা সচ্ছল অবস্থায় আছেন। এ অতি প্রশংসনীয়।
কেউ যদি কলিকাতায় গঙ্গার জেটি, Custom House, ক্লাইব ষ্ট্রীট্, এজ্রা ষ্ট্রীট্, পোলক ষ্ট্রীট্ অঞ্চলে যান, দেখিতে পাইবেন কত হাজার মণ মাল নিয়ত আসা-যাওয়া করিতেছে। এ সমস্ত কারা আনে ও নেয়? এর মুনফা কার পকেটে যায়? ভারতবর্ষে অন্যূন ৬০০ কোটী টাকার মাল আমদানী ও রপ্তানী হয়। এই ৬০০ কোটীর কত অংশ দালাল ও (middleman) ফ’ড়েদিগের রোজগার হয়? তার পর মফঃস্বলে দাদন দিয়া উৎপন্ন শস্যাদি কাহারা নামমাত্র মূল্যে চালান দিতেছেন? তারপর আমাদেরই ক্ষেত্রজাত পাট যখন পাটকলে যায়, তখনই বা কি দাম দেওয়া হয়, আর যখন কল হইতে বাহির হয় তখনই রা ইহার দাম কত হয়? বাঙ্লা দেশের শ্রেষ্ঠ জমিদার বর্দ্ধমানাধিপের আদায় ৪০।৫০ লাখ টাকা; কিন্তু দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের সঙ্গে অসদ্ভাবের জন্য সদর খাজনা বেশী হয়। তার পর, কাশিমবাজার, মুক্তাগাছা প্রভৃতি ভূম্যধিকারীদের আয়। বজবজ হইতে ত্রিবেণী পর্য্যন্ত গঙ্গার দুধারে যে সমস্ত পাটের কল এদের অনেকেরই মূলধন ২৫।৫০ লাখ টাকা। ক্লাইব, কামারহাটি ইত্যাদি কোম্পানীরা শতকরা ১০০, ২০০, ২৫০ টাকা dividend (মুনাফা) দেয়। তাহা হইলে, ৫০ লাখ মূলধনে বৎসর ৫০ লাখ অংশীদারদের আয়ের উপর ম্যানেজিং এজেণ্টদের কমিশন ইত্যাদি আছে। কাজেই এক একটি পাটের কল অনায়াসে যে কোন একটি বিশাল জমিদারীকে কিনিতে পারে।
আমরা ভাবি, সিবিলিয়নগণ এ দেশের কত অর্থই না শোষণ করিয়া লইতেছেন। কিন্তু ২।৪টি ইংরেজ কোম্পানী যাহা লয়, সমস্ত ভারতবর্ষের সিবিলিয়ানগণ তাহা লন না। অথচ এ দিকে আমাদের লক্ষ্য নাই। ইহা অনায়াসেই প্রতিকারযোগ্য, অথচ কোন চেষ্টাই নাই।
আমরা আমাদের যুগে যুগে সঞ্চিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতেছি। মনু মহাশয় ব্যবস্থা দিলেন, সমুদ্রযাত্রা করিলে পতিত হইতে হইবে! কাজেই বাড়ী থেকে বাহির হওয়া আমাদের ঘটিয়া উঠিল না। কিন্তু আমরাই সিংহল, জাভা, বলিদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য ও উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছি। তারপর, হাঁচি টিকটিকি প্রভৃতির উপদ্রবে যেমন মন আমাদের সঙ্কুচিত হইল, অমনি কর্ম্মচেষ্টা, উদ্যম, উদ্যোগ প্রভৃতি হারাইয়া বসিলাম। ব্রাহ্মণের আধিপত্য বজায় রাখিতে নিজেদের অল্প-সল্প যাহা কিছু কাজ কর্ম্ম, তাহাও বেশ নিজেদের মধ্যে বিলি বন্দোবস্তের গণ্ডী আঁকিয়া সীমাবদ্ধ করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া রহিলাম। তাই সায়েস্তা খাঁর সময় টাকায় ৮ মণ চাউল। ইহা দেশের ধনহীনতারই পরিচায়ক। পলাসীর যুদ্ধের পরের একটা কথা বলিতেছি। একটি পুরানো পুঁথির শেষ পৃষ্ঠায় দুর্গোৎসবের হিসাব পাওয়া গিয়াছে! আট আনায় একমণ দই, একমণ চাল আটআনা, সমস্ত ব্যাপার পঁচিশ টাকায় নির্ব্বাহ হইত। কামার হয়ত দা, কুড়াল, লাঙ্গলের ফা’ল প্রভৃতি তৈরি করিয়া দিয়াছে, গৃহস্থ তার দাম আট আনার ধান গোলা থেকে দিতে চাহিলেন। কামার কুলীর মজুরির ভয়ে অত ধান লইতে রাজি হইল না।
আমরা তাঁতীর কাজ তাঁতীকে, কামারের কাজ কামারকে ও কুমোরের কাজ কুমোরকে সঁপিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া ইংরেজ আমলে বিদ্যাচর্চ্চায় লাগিয়া গেলাম। আমরা senior, junior scholar হইলাম। এখন প্রথম প্রথম বি-এ পাশ করিলাম সাত গাঁয়ের লোক ছুটিয়া আসিল আমাদের দেখিতে। আর যদি এম্-এ পাশ করিলাম তো হইয়া পড়িলাম ছোট-খাট এক দেবতা। এই করিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা যাঁহারা সব দেশে এবং সব জাতির সর্ব্ববিধ উন্নতির মূল তাঁহারা ইংরেজী ডিগ্রির নিকট দাসখত লিখিয়া দিয়াছেন। আর বোম্বাই অঞ্চলে লোকে ব্যবসাবাণিজ্যে লাগিয়া গেল। ওদেরও যে প্রথম বারেই সফলতা হইল,তা নয়। প্রথম প্রথম লোকসান দিয়া যে অভিজ্ঞতা অর্জ্জিত হইল তারই ফলে আজ ওরা এত উন্নত। দিন্শা ওয়াচার প্রণীত সার জম্শেদ্জি তাতার জীবন-চরিত পাঠ করিলে জানা যায় যে, ব্যবসা বাণিজ্য অমনি ধরিলেই হয় না। কত যে একাগ্র সাধনার প্রয়োজন তা এই সমস্ত ধনকুবেরদের জীবন শিক্ষা দেয়।
আজকাল আমাদের দেশে চায়ের ব্যবসায় খুব লাভজনক। কিন্তু এই ব্যবসায়ের ইতিহাস পাঠ করিলে জানা যায় সমগ্র সভ্যজগৎ ও জীবন হইতে দূরে একান্তে যখন দলে দলে শ্বেতাঙ্গ চা-করেরা (planter) গিয়া আবাদ আরম্ভ করিল তখন শতকরা কতজন কালাজ্বর ম্যালেরিয়াতে মারা গেল। ও অঞ্চলে গেলে কতশত ইংরেজের কবর দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু উদ্যম ওদের এত অল্প বাধাতেই নষ্ট হয় না। তারা কুইনাইন খাইয়া মশা তাড়াইবার জন্য বাড়ীঘর লোহার জাল দিয়া ঘিরিয়া কাজ শুরু করিল। সেই লর্ড ডালহৌসির সময় হইতে চেষ্টা করিয়া আজ এতদিনে এর সুফল ফলিয়াছে। ইহার ফলভোগ করিবার তাদের নিশ্চয়ই একটা দাবী দাঁড়াইয়াছে। এইরূপে নিয়তই বিরুদ্ধপ্রকৃতির ও প্রতিকূল বাধার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া ইংরেজ লক্ষ্মীকে অঙ্কশায়িনী করিয়াছে।
ঢাকা ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে যে মাড়োয়ারী আমল পায় নাই তাহার কারণ এ অঞ্চলের সাহা, তিলি ও তাম্লি শ্রেণী ইতিপূর্ব্বে ইংরেজী শিক্ষার মোহে আকৃষ্ট হইয়া জাতীয় ব্যবসায় ত্যাগ করেন নাই। ইঁহাদের মধ্যে প্রকৃত ব্যবসায়বুদ্ধি আছে; “অন্ন সমস্যা” সম্বন্ধে বক্তৃতা করিয়া এক বিপদ্ হইয়াছে যে, দলে দলে ছাত্র আমার কাছে আসিয়া ব্যবসা করা সম্বন্ধে উপদেশ নিতে চান। ইঁহারা ভাবেন যে, আমি ডাক্তারের মতো তাঁহাদের নাড়ী টিপিয়া বলিয়া দিব তাঁহাদের কোন্ দিকে রুচি। তাঁহাদের ব্যবসা ফাঁদিবার যা-কিছু আয়োজন ও সরঞ্জাম সমস্তই “প্রেস্ক্রিপ্শ্যন্” করিয়া দিতে হইবে—ইঁহারা নিজেরা কিছু ভাধিবেন না বা দেখিবেন ও না। তাঁহাদের অনেক সময় বলি এই সমস্ত সাহা মহাজনদের ওখানে গিয়া দেখিতে, কি করিয়া তাঁহারা একটা ব্যবসায়কে দাঁড় করান। মাড়োয়ারীরা হয় ত বাঙ্গালীকে আমল দেয় না, কিন্তু ইঁহারা তো আমাদের স্বজাতীয়।
ব্যবসায় করিতে হইলে যে বিপুল মূলধন প্রয়োজন, তাহা এই লোটাকম্বল-সম্বলধারী মাড়োয়ারীদের ক্রমে ক্রমে বাংলা দেশ বিজয়ের ইতিহাস স্মরণ করিলে, অস্বীকার করিতে হয়। সুদূর পল্লীপ্রান্তে কয়েক গণ্ডা টাকামাত্র সম্বল লইয়া অনেক মাড়োয়ারী ব্যবসার পত্তন করিয়া কোটীপতি হইতেছেন। এখন আর শুধু ব্যবসায় নয়, তাঁহারা এবার জমিদারীর আস্বাদ গ্রহণ করিতেছেন। আশঙ্কা হয় আর বিশ বৎসরের মধ্যে বাংলা দেশের অর্দ্ধেক জমিদারী তাঁহাদের আয়ত্তাধীন হইবে, কলিকাতার বিপুল বিভবের শতকরা ৯৫ ভাগ অ-বাঙালীর হইবে। অনেকে বলেন, মূলধনের অভাবই তাঁহাদের ব্যবসাক্ষেত্রে নামিবার প্রধান অন্তরায়। তাঁহারা ভাবেন হাজার কয়েক টাকার তোড়া পাইয়া চৌরঙ্গীতে আফিস,বৈদ্যুতিক পাখা, দরোয়ান্ ইত্যাদি লইয়া বসিতে পারিলেই ব্যবসায়ে কৃতী হইতে পারিবেন। কিন্তু প্রকৃত ব্যবসায়ের কোন খবরই তাঁহারা রাখেন না।
হাওড়া ও শিয়ালদহ ষ্টেশনে গেলে দেখিতে পাওয়া যায় প্রতিদিন কত হাজার হাজার কেরাণী ডেলি প্যাসেঞ্জার রূপে সকাল সন্ধ্যা আসা যাওয়া করেন। ইঁহাদের কেহই ৩০।৪০ বা ৫০৲ টাকার অধিক বড় রোজগার করেন না। তন্মধ্যে ৫।৭৲ টাকা মাসিক টিকেট ক্রয় করিতেই ব্যয়িত হয়। এই তো রোজ্গার। ইহারই তাড়নায় সকালবেলা ৮ টার সময় নাকে মুখে কোন প্রকারে ভাত গুঁজিয়া হাজিরা দিতে হয়। কি শোচনীয় দৃশ্য!
অনেকে বলেন, আপনি কেবল প্রশ্নই উত্থাপন করেন, তাহার সমাধানের এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন না। এই সমস্ত প্রশ্নের সমাধান নিজের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলেই পাইবেন। এই যে এখানকার খেয়াঘাট ইহা হইতে কত আয় হইতে পারে? কিন্তু ইহাও খোট্টারা আসিয়া ক্রমে ক্রমে অধিকার করিয়াছে কেন? বাগেরহাট—খুলনা ও বসিরহাট অঞ্চলে একজন ১৬টা খেয়াঘাট জমা লইয়াছে। আমরা পারি না কেন? ডিষ্ট্রীক্টবোর্ডের কর্ত্তা তো আমরাই। প্রকাশ্য ডাকে এগুলো বিলি করা হয়, বিদেশীরা এসে সুবিধা করিয়া নেয়, আমরা পারি না কেন? একজন খোট্টা নিজে তার ঘাটে নৌকা বাওয়া, পয়সা আদায় করা ইত্যাদি সব নিজে তদারক করে, অপচয় হইবার কোন উপায় রাখেনা। আর আমরা পারি না, কেবল আমাদের একজন ১৫৲ টাকা দিয়া সরকার রাখিতে হয়, নতুবা দিনে দুইবার তাস খেলা, ঘণ্টা-কয়েক সুনিদ্রা, ইত্যাদির ব্যাঘাত হয়। ১৫৲ টাকার সর্কার নিজেকে ভাতে কাপড়ে বাঁচাইবার জন্য চুরি করিতে বাধ্য হয়। কাজেই ইজারা লইয়া আমাদের লাভ হয় না; কেননা আমরা বাবু।
সমস্ত কলিকাতা সহর খুঁজিলে কয়টা বাঙ্গালী পানওয়ালা বাহির হয়? সবই তো খোট্টা। রোজ যখন গড়ের মাঠে বিকালে বেড়াইতে যাই দেখি হ্যারিসন্ রোড ও আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীট যে-স্থানে মিশিয়াছে সেইখানে এক পানওয়ালার দোকানে লেমনেড, সর্বৎ ও বিড়ী সমেত কত বিক্রী। মাসে তার লাভ থাকে ২০০।২৫০ টাকা। একটা পানের দোকান করিতে কত টাকা মূলধনের প্রয়োজন? আজকাল তো কলিকাতা প্রভৃতি বড় বড় সহরে হাজার হাজার মোটর গাড়ীর আম্দানী হইয়াছে। এর সমস্ত চালক কোন্ জাতীয়? লক্ষ্য করিয়া দেখিলে দেখা যায় পাঞ্জাবীরা প্রায় একচেটিয়া করিয়া লইয়াছে। একজন ড্রাইভার যত বেতন পায় একজন কেরানীর বেতন তত? কলিকাতায় চাকর-বামুন হয় উড়ে নয় খোট্টা। বাঙলা দেশের চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের দিন গুজরান করা অসাধ্য হইলে আটআনা বার্ষিকের জন্য রৌদ্রে পাঁচ ক্রোশ হাঁটিয়া উপস্থিত হইবেন, কিন্তু ইঁহাদের কাহারো কাছে কোথায়ও রসুই করার কথা বলিয়া দেখিতে পারেন কি উত্তর এঁরা দেন। এই রকম করায় বাঙলা দেশ হইতে কত অর্থ অ-বাঙালীরা উপার্জ্জন করিয়া নিয়া এ দেশকে নিঃস্ব করিয়া ফেলিতেছে। এই-সমস্ত উড়ে খোট্টা কত টাকা মনিঅর্ডার করে তাহা হিসাব করিলে ঐ কথার সত্যতা সম্যক্ উপলব্ধি হইবে।
ডায়মণ্ড-হারবার লাইনে মগরাহাট প্রভৃতি স্থানে অনেক বিপুল চালের কারবার আছে। সেখানকার বহু আড়তদারের মধ্যে কয়টা দেশীয় লোক? তাহারা আমাদেরই ক্ষেতে ফলা ধান কিনিয়া লক্ষপতি হইতেছেন, আর আমরা ছেলেদের “নমিনেশন” জোগাড় করিবার জন্য নিজেদের সর্ব্বস্ব পরের হাতে সঁপিয়া দিয়া বেড়াইতেছি ম্যাজিষ্ট্রেট জজ সাহেবের কুঠীতে ঘুরিয়া। ইহার প্রধান কারণই শ্রমবিমুখতা। স্বল্পায়াসে কোন প্রকারে দিনাতিপাত করিতে পারিলেই হইল। আমাদের অঞ্চলে কৃষকরা খুব পরিশ্রম করিয়া ধান রোপে। তার পর যখন ধান একবার লাগিয়া যায় তখন ‘পশ্চিমে’ আনিবে ধান কাটাইবার ও মলাইবার জন্য। নিজেরা আর কিছুই করিবে না। তারা কি এতই ধনী? গিরিডি অঞ্চলে দেখিয়াছি নেহাৎ যখন ক্ষুধার তাড়না অসহ্য হইয়া উঠে তখন দেশী সাঁওতালরা কাজ করে। অন্য সময়, কাজ করে না কেন, জিজ্ঞাসা করিলে উত্তর দেয় “কাজ কর্ব্ব কেন?” উপোস কর্তে কি জানি না?”
তারপর কলিকাতা সহরে কত ছুতোর মিস্ত্রি কাজ পাইতে পারে, কিন্তু চীনে আসিয়া অধিকার করিয়াছে। কেন না, দেশী মিস্ত্রিরা চোখের আড়াল হলেই ফাঁকি দিবে। তাদের উপর কোন কাজ দিয়া নির্ভর করা যায় না। কিন্তু একজন চীনে মিস্ত্রি কি প্রাণপাত করিয়া পরিশ্রম করে! পূর্ব্বে চীনেপট্টির খানিকটায় চীনেরা থাকিত। এখন বেণ্টিঙ্ক ষ্ট্রীট্ অঞ্চল ছাইয়া ফেলিয়াছে। কেন? এ দেশে কি মুচি পাওয়া যায় না? নিম্নশ্রেণী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী আমাদের সকলেরই মধ্যে অকর্ম্মণ্যতা ও কুড়েমি। এই করিয়া দেশের প্রায় সকল বিভাগই বিদেশী দ্বারা বিজিত হইতেছে। কলিকাতা পটারী ওয়ার্কসের নিকট দু’এক বছর আগে একজন চীনা মিস্ত্রির সামান্য একখানি দোকান দেখিয়াছি, কিন্তু অধ্যবসায় ও সততা দ্বারা এখন সে দোকান একটি বিরাট কারবারে পরিণত হইয়াছে।
অতএব এখন আমাদের কি করা কর্ত্তব্য? সহযোগ-বর্জ্জন আন্দোলন দেশের একটি কল্যাণ করিয়াছে। দেশের লোকের দৃষ্টি অন্তর্মুখী হইয়াছে। দেশের মা-বাপেরা বুঝিয়াছেন, চল্তি রকম লেখাপড়ার অসারতা। এতদিন এই শিক্ষা ছেলেকে দিবার জন্য হইতে হইয়াছে খরচান্ত। ছেলে গ্রাজুয়েট হইয়া কি পরিমাণ অর্থ রোজগার করিতেছেন তাহা তো আমরা সকলেই দেখিতে পাইতেছি। পাঠ্যাবস্থা কাটে ভাল। কিন্তু অনেকের পাস করিলেই বিপদ্; কেন না তখন রোজগার করার প্রয়োজন হয়। কাজেই দেশের লোক অর্থকরী শিক্ষার জন্য আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছেন। সহযোগ-বর্জ্জন আন্দোলন হওয়াতে যে আমরা ভাবিতে আরম্ভ করিয়াছি ইহাই পরম সুখের বিষয়।
দেশের যুবকদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে কৃতকার্য্য হইবার পক্ষে ভগ্ন স্বাস্থ্য একটি প্রধান অন্তরায়। প্রতিদিন রৌদ্র বৃষ্টি উপেক্ষা করিয়া কোন প্রকারে একরাশি অখাদ্য বা কুখাদ্য গলাধঃকরণ করিয়া এই বিদ্যা আহরণ করিতে ৪।৫ মাইল হাঁটিয়া স্বাস্থ্য ও উদ্যম একেবারে নষ্ট হইয়া যায়। তারপর যখন প্রকৃত প্রস্তাবে জীবনের কর্ম্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে হয় তখন জীবন্মৃত অবস্থা লইয়া কোন্ কৃতকার্য্যতা আশা করা যায়? তাই বলিতেছিলাম, সকলকেই কি এই শিক্ষা লাভ করিতে হইবে? বিলাতে ৪॥০ কোটি লোকের মধ্যে ২৫০০০ হাজার ছাত্র কলেজে পড়ে আর আমাদের দেশেও ৪॥০ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় ২৩০০০ হাজার ছাত্র কলেজে পড়ে। তাই বলিয়া কি জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধের মত আমরা ইংরেজদিগের সমান? বিলাতে শতকরা ৯৫ জন প্রাথমিক শিক্ষালাভ করে। মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তে শতকরা দশ-পনেরো জন মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করিতে যায়। আমাদের দেশেও সেইরূপ হওয়া উচিত। পিতামাতা সব ছেলেকে উচ্চ শিক্ষা দিবার প্রয়াস করিয়া অযথা সর্ব্বস্বান্ত হন। তিনজন ছেলের মধ্যে প্রতিভাশালী একটিকে উচ্চশিক্ষা দিবার ব্যবস্থা করিয়া বাকী কয়জনকে মাধ্যমিক শিক্ষার মান অবধি পড়াইয়া রুচি অনুযায়ী কোন কাজের মধ্যে দিলে এরূপ দুরবস্থা হইরে না। ল’ কলেজে তো তিন বছর পড়িতে হয়। তার পর যাত্রার জুড়ি সাজিয়া বটগাছের তলায় কয়েক বছর ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়। সেই কয় বছর যদি কেউ কোন ব্যবসায়ে শিক্ষানবিশ হইয়া প্রবেশ করেন তবে ওকালতির দুর্ভোগ ভুগিতে হয় না। অনেক সময় প্রশ্ন হয় যে, কোথায় শিক্ষানবীশি করা যাইবে? গ্রামে গ্রামে গিয়া দেখিলে দেখিতে পাওয়া যায় অনেক সাহা প্রভৃতি ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোক ব্যবসা করিয়া কৃতী হইতেছেন। ইঁহাদের নিকট গিয়া বিনা মাহিনায় নিজ হাতে কাজ শিখিতে গেলে অবশ্য ইঁহারা আপত্তি করিবেন না। শুনিয়া থাকি, মাড়োয়ারীরা নাকি বাঙালীদের ব্যবসাতে লইতে আপত্তি করেন। কিন্তু অনেক বাঙালী দেশে গ্রামে আছেন যাঁহারা চাউল, ডাল, কেরোসিন ইত্যাদির ব্যবসা করিয়া অর্থোপার্জ্জন করিতেছেন। ইঁহাদের নিকট যাইয়া চাকরের মত খাটিতে হইবে। তুচ্ছ আত্মসম্মানের মিথ্যা মোহে শিক্ষাকে বিড়ম্বিত করিলে চলিবে না।
অনেকে ব্যবসায় শিখিবেন বলিয়া School of Commerce ইত্যাদিতে ভর্ত্তি হইতে ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন। ব্লাক্বোর্ডে ও খড়িমাটির সাহায্যে ব্যবসা শিক্ষা হয় না। তূলো, পাট কোথায় জন্মে, Commercial History ও Geography ইত্যাদি না পড়িয়াও মাড়োয়ারী ও ভাটিয়াদের তাহা জানিতে ও ব্যবসা চালাইতে কোন কষ্ট হয় না। ইংরেজীতে হিসাব রাখা কিম্বা নির্ভূল পত্রলিখন-পদ্ধতি জানা কৃতকার্য্য হইবার পক্ষে একান্ত প্রয়োজন নয়।
ছেলে পরীক্ষায় কৃতকার্য্য না হইলে তাহাকে বৃথা চোখ রাঙাইবার কোন প্রয়োজন নাই। এখনো তার কোন “মিথ্যা আত্মসম্মান বোধ” (false sense of dignity) হয় নাই, তাহাকে কোন ছোট দোকান করিয়া দিন। কিম্বা কোন দোকানে বেচাকেনা শিখিতে দিন। “বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কীর্তন” করিয়া কি হইবে?
যাহা হউক, দেশের হাওয়া ফিরিয়াছে—ইহা খুব শুভলক্ষণ সন্দেহ নাই। আজ জীবনসংগ্রামের মহা-আবর্ত্তে ধীর ভাবে অকুতোভয় হইয়া আমাদিগকে কার্য্য করিতে হইবে। নিজেদের সমগ্র চেষ্টা ও শক্তি জতীয় দুর্গতি অপনয়ন করিতে নিয়োজিত করিতে হইবে। মিথ্যা আত্মসম্মান-বোধ আমাদের কর্ম্মকুশলতাকে যেন খর্ব্ব না করে। যাহারা আজ জগতে শীর্ষস্থান লাভ করিয়াছে, তাহারা কোন যাদুবলে সিদ্ধিলাভ করে নাই। চেষ্টাদ্বারাই সমস্ত সাধিত হইয়াছে ও হইবে, ইহাই স্মরণ করিয়া আমরা কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইব।
- ↑ টাঙ্গাইল জনসাধারণের নিকট প্রদত্ত মৌখিক বক্তৃতার সারাংশ। শ্রীমান জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায়, এম্-এস-সি কর্ত্তৃক অনুদিত।