আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/২
২
অন্নসমস্যা
বাংলাদেশে কোন শিল্প-প্রদর্শনীর কথা শুনলেই বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। আমাদের শিল্পই নাই তার আবার প্রদর্শনী! বঙ্গশিল্পের প্রদর্শন আর বাংলার বিষাদকাহিনীর এক অধ্যায় উন্মোচন, একই কথা। একদিন ছিল,যখন বাংলার সূক্ষ্ম শিল্প সুদূর ভিনিস্ নগরের বাণিজ্যকেন্দ্রে আদৃত হ’ত। কিন্তু এখন প্রদর্শনীর আসরে নেমে অন্য সভ্য জাতির তুলনায় আমরা কি দেখাব? এ ত বেদ বেদান্ত উপনিষদ্ নয়, এ যে স্থূল-জড়জগতের কথা। প্রদর্শনীতে আমাদের জীবনধারণের উপযোগী নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু যা আমরা আপন হাতে প্রস্তুত করতে পারি তারই একত্র সমাবেশ করতে হয়। এখানে কৃতিত্বের পরিচয় দিতে এসে আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারি জীবনসংগ্রামে ক্রমাগত পরাজিত হয়ে বাঙালী দুর্দ্দশার কোন্ আবর্ত্তে আজ ঘুরপাক খাচ্ছে। বিদেশ থেকে বস্ত্রের আমদানী না হলে আমাদের লজ্জা নিবারণ হয় না, দিয়াশালাই না এলে আমাদের সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বলে না। ষ্টীম এঞ্জিন থেকে সূচ সূতা পর্য্যন্ত সকল রকম জিনিষের জন্য আমরা পর-প্রত্যাশী। উঠ্তে বস্তে খেতে শুতে এমন পরবশ আর কোন জাতি আছে কিনা জানি না। যুদ্ধের সময় আমদানি বন্ধ হল; জার্ম্মাণী, ইংলণ্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ থেকে জিনিষপত্র নিয়মিতরূপে না আসায় বিদেশী প্রতিযোগিতা অনেকটা কমে গেল। কিন্তু আমরা এমনই অক্ষম যে সে-সুবিধার কোন ব্যবহারই করতে পারলাম না। অথচ এদিকে রুচি আমাদের বড় সুমার্জ্জিত! অভাবের দিন হলেও দেশী কার্খানা থেকে ভাঁড়ে ওষুধ দিলে আমরা তা স্পর্শ করব না, সলিতা পাকিয়ে দের্কোর উপর রেড়ির তেলের প্রদীপ রেখে পড়তে বসব না। তাই জাপান ফট্ফটে চিম্নি আর শিশি বোতল জুগিয়ে আমাদের রুচির মান রক্ষা ক’রে লাখ লাখ টাকা নিয়ে গেল। গত মহাসমরে ইউরোপ যখন নিজের ঘর সাম্লাতে ব্যস্ত সেই সুযোগে জাপান পূর্ব্বাপেক্ষা দশ গুণ বেশী জিনিষ ভারতবর্ষে পাঠিয়েছে। এই সব কারণে বলি প্রদর্শনী দেখতে মন উঠে না—আনন্দ হয় না | কিন্তু তবু প্রদর্শনী হওয়া চাই, কারণ তা হলে জান্তে পার্ব রোগ কি এবং তা দেহযন্ত্রের কোন্ স্থান পর্যন্ত সঞ্চারিত হয়েছে। প্রদর্শনীর আয়োজন কর্লে এই রোগ কতকটা ধরা পড়্বে। তখন ঔষধের ব্যবস্থার কথা ভাববার অবসর হবে।
যুবকবৃন্দ দেশের ভবিষ্যৎ আশাস্থল। তাঁদের ভেবে দেখতে বলি—আমরা আজ দাঁড়িয়েছি কোথায়, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ আজ কি অবস্থায়! শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের মেরুদণ্ডস্বরূপ; কিন্তু দারিদ্র্যের কঠোর নিষ্পেষণে সেই মেরুদণ্ড আজ ভেঙ্গে যাচ্ছে। এর শোচনীয় পরিণাম যে কি তা মনে হলেও হৃৎকম্প উপস্থিত হয়! উপার্জ্জনক্ষম মধ্যবিত্ত গৃহস্থের মাসিক আয় গড়ে ২৫৲ হ’তে ৩০৲ টাকা, কেউ বলেন ৩০৲ হ’তে ৩৫৲ টাকা। কিন্তু তাঁর পোষ্য অন্ততঃ পক্ষে পাঁচটি—স্ত্রী পুত্র আছে, কোথাও বিধবা ভগ্নী এবং তাঁর ছেলেপুলে আছে। সুতরাং এই স্বল্প আয়ে তাঁদের দুর্দ্দশার সীমা নেই। চালের মণ আজ ১০৲। ১২৲ টাকা, তেলের সের ১৲ টাকা, আর ঘি ত জোটেই না। আমরা রাসায়নিক, বাজার চলন ঘির উপাদান যে কি তা আমাদের জান্তে বাকী নেই, কিন্তু সে কথা আর নূতন করে বলতে চাই না। আর মাছ, দুধ, বাঙালীর শরীরপুষ্টির যা প্রধান উপাদান, তা কয়েক বছর পরে দেশে আর পাওয়া! যাবে না এমন লক্ষণ দেখা দিয়েছে। খাদ্যদ্রব্য ত এই প্রকার দুর্ম্মূল্য, তার সঙ্গে এই অল্প আয়ের মধ্যে আবার কাপড় জামা জুতা লোকলৌকিকতা এবং ভদ্রয়ানার আর পাঁচরকম উপকরণ আছে, তার উপর যখন পুত্রের উচ্চশিক্ষা ও কন্যার বিবাহের কথা এসে পড়ে তখন বুঝতে পারা যায় আমরা দুর্দ্দশার কোন স্তরে নেমে গেছি। আমাদের পেট ভ’রে খাওয়া হয় না, বাড়ীতেও না, বাহিরেও না। কলকাতা বা মফঃস্বলের কলেজ-মেসে ঘর ভাড়া বাদ ন্যূনকল্পে ১৫৲ টাকা খরচ পড়ে, তা’তে ডাল ভাত আর একটি তরকারী ছাড়া অন্য কিছুর বন্দোবস্ত হয় না। একজন ছাত্রের মোট খরচ ৩৫।৪০ টাকার কমে হয় না। এইরূপে শাকান্ন আহারের ফলে শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি সাংঘাতিক ব্যাধি বুকের উপর পাথর হয়ে চেপে বসে। সার শঙ্করন্ নায়ার বলেছেন, গত কয়েক মাসে ভারতবর্ষে ইনফ্লুয়েঞ্জা ৬০ লক্ষ লোককে গ্রাস করেছে। সমগ্র ভারতে প্রতিবর্ষে ১২ লক্ষ লোক ম্যালেরিয়া রাক্ষসীর কাছে বলি হয়। এ সকলের মূলে দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা। ডাঃ বেণ্ট্লি বলেন, ম্যালেরিয়া গরীবের রোগ! অনেকদিন ধরে পুষ্টিকর আহারের অভাবে লোক বারবার এই রোগে আক্রান্ত হয়। কল্কাতায় যক্ষ্মা রোগ বেড়ে চলেছে। শিশু যতগুলি জন্মায় তার এক তৃতীয়াংশ এক বৎসর বয়স হবার আগে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। গত পাঁচ বৎসরে কল্কাতায় বাড়ীভাড়া শতকরা ২০%৲, বেড়েছে। এদিকে সাধারণ গৃহস্থের আয় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ। কাজেই এঁদো গলিতে অন্ধকার বাড়ী ভাড়া করে থাকতে হয়; সেঁতসেতে মেজে, অষ্ট প্রহর দরজা বন্ধ পাছে আবরু নষ্ট হয় বা ছেলে গাড়ী চাপা পড়ে। বাতাস রৌদ্র ও আলোক, যা গরীবের প্রতি বিধাতার দান, কল্কাতায় কতজন বাঙ্গালীর ভাগ্যে তা জোটে? এ যজ্জীবনং তন্মরণম, মরণ সোহস্য বিশ্রামঃ” মরণ হলেই বিশ্রাম। শিশুকে চাম্চেয় করে মেলিন্স ফুড খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়। এরাই ত ভবিষ্যতে বংশবৃদ্ধি করে। কাজেই জাতটা যে ক্রমে স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ছে তা আর বিচিত্র কি! আমাদের পিতৃপিতামহ ৭০।৮০ বৎসর বেঁচে থাক্তেন। এখন আমরা? ইংরেজের আয়ু গড়ে ৪৬ বৎসর, আমাদের মাত্র ২৩। দারিদ্র্য ও মহামারী আমাদের বুকের রক্ত শুষে বার করে নিচ্ছে! এদের তাড়াবে কে?
বিপদ যখন একেবারে সমুখে এসে দাঁড়িয়েছে; জীবনসংগ্রাম যখন ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে উঠ্ছে, চারিদিকে সমস্যাগুলি যখন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে আস্ছে, তখন আমরা কি করছি? প্রায় নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে আছি। আমরা ভাবি না, বুঝবার চেষ্টা করি না। উপায় নির্দ্দেশ হলেও কার্য্যক্ষেত্রে অগ্রসর হবার উৎসাহ বা সাহস আমাদের থাকে না। আমরা সার বুঝেছি চাকরী করা, আর আমাদের ছেলেদের লক্ষ্য হয়েছে এম-এ এম-এস্সি পাশ করা, অথবা উকীল হওয়া। এখন একজন গ্রাজুয়েটের বাজার দর কত? এম্-এ বা এম্-এস্সি বড় জোর ১০০৲ পেতে পারেন, বি-এ বি-এস্সি ৪০৲ থেকে ৫০৲ টাকা। কিন্তু এর সঙ্গে বিবেচনা কর্তে হবে যে একটি পদ খালি হলে তার জন্যে পাঁচশ দর্খাস্ত পড়ে। সুতরাং এই সিদ্ধান্ত হয় যে গড়ে গ্রাজুয়েটের বিশেষ কোন সুবিধা পাবার জো নেই। পাঁচ বৎসর বয়স থেকে A. B. C. D. আরম্ভ করে ২২।২৩ বৎসর পর্য্যন্ত ম্যালেরিয়া ও নানারোগের অত্যাচারে উৎপীড়িত হতে হতে ভগ্নস্বাস্থ্য বাঙালী যুবক যখন স্কুল কলেজ পার হয়ে ডিগ্রী নিয়ে সংসারের সমুখে এসে দাঁড়ান তখন দেখেন তাঁর পুঁথিগত বিদ্যা জীবন-সংগ্রামে কোথাও তাঁকে বিশেষ কোন সাহায্য কর্বে না। এ কি ভীষণ সমস্যা! আবার যিনি গ্রাজুয়েট্ হয়েছেন তিনি ভাবেন আইন পড়্তে না গেলে মহা অপরাধ হবে, আর জিজ্ঞাসা কর্লে বল্বেন “পাশটা করে রাখি।” আজকাল জেলার সদরে বা মহকুমায় উকিলরা কি রোজগার করেন, তাঁদের কজন অন্ন পান এবং কজন গাছতলায় কেরোসিনের বাক্সের উপর বসে দিন কাটান এরূপ কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর্লে বিজ্ঞ ব্যক্তি উত্তরটা কানে-কানে দেবেন—কারণ সেটা সাধারণের বড় প্রীতিকর হবে না। স্যর্ আশুতোষ প্রতিভাশালী পণ্ডিত, শিক্ষা বিস্তারের জন্য অনেক করেছেন—এ সবই স্বীকার করি। কিন্তু আইন কলেজ সম্বন্ধে তাঁর সঙ্গে আমার বন্ল না। আমায় যদি কেউ একদিনের জন্যও কলকাতার সর্ব্বময় কর্ত্তা (Dictator) করে, তবে “ল-কলেজ”টাকে আমি আগে ভূমিসাৎ করি; অন্ততঃ দশবছরের জন্যে আইন পড়া উঠিয়ে দিই। কারণ তা হলে উপোষী উকীলদের অন্ন হ’তে পারে। আর ব্যাধির শেষ কি এইখানে? এদেশের ছাত্র বি-এল্ পাশ করে ভাবেন এম্-এল্ হবেন। যেন বিধাতা তাঁদের সৃষ্টি করেছেন শরীর ও স্বাস্থ্য নষ্ট ক’রে পরীক্ষা পাশ কর্তে এবং যম-সদনে যেতে।
৬০।৭০ বৎসর আগে কল্কাতার হৌসের বাঙ্গালী মুৎসুদ্দী ছিলেন। উদাহরণ-স্বরূপ ললিতমোহন দাস, গোরাচাঁদ দত্ত, প্রভৃতির নাম করা যেতে পারে। তাঁরা মাসে আট দশহাজার টাকা উপার্জ্জন কর্তেন অর্থাৎ এখনকার প্রায় বিশহাজার টাকা। কিন্তু আজকাল সে-সব উপন্যাসের কথা হয়ে গেছে! ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি কল্কাতায় প্রথম কার্বার করেন বাঙ্গালীর সঙ্গে! বাংলার শিল্পজাত দ্রব্য তাঁরা বাঙ্গালীর নিকট কিন্তেন। তখন ব্যবসা ছিল বাঙ্গালীর হাতে। এমন কি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে বাঙ্গালীর সাহায্য ব্যতীত ইউরোপীয় সওদাগরগণ তাঁদের কার্য্যসিদ্ধি করতে পার্তেন না। এই জন্যই রামদুলাল দে, মতিলাল শীল প্রভৃতি ক্রোড়পতি হয়েছিলেন! কিন্তু এখন ব্যবসার ক্ষেত্র থেকে বাঙ্গালী হটেছে, বিতাড়িত হয়েছে। বর্ত্তমানে কল্কাতার জনসংখ্যা যত তার একতৃতীয়াংশ বাঙালী, অথচ কল্কাতা বাংলার প্রধান সহর। এই সহরে যেসব অ-বাঙালী স্থানে প্রতি দিন লক্ষ লক্ষ টাকার কার্বার হয় সেখানে বাঙালীকে ক্বচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। অত্যাশ্চর্য্য ব্যাপার! ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়! এদেশে ইংরেজী শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল—সহজে চাক্রী জুট্বে। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে বাঙালী যে পরিমাণে ইংরেজী শিক্ষায় অগ্রসর হতে লাগল চাকরীর মোহ তার সেই পরিমাণে বেড়ে গেল। তারপর যখন ডেপুটি-কালেক্টরী মুন্সেফী প্রভৃতি পদের সৃষ্টি হল এবং গবর্ণমেণ্ট আফিসে অল্পাধিক বেতনের কেরানীগিরির দ্বার উন্মুক্ত হল তখন দশ পনের বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার এক চরম উদ্দেশ্য হয়ে দাড়াল শীঘ্র শীঘ্র পাশ করে এইরূপ একটা পদ লাভ করা। ক্রমে ইংরেজীনবীশ বঙ্গযুবকেরা কেরানী, উকীল, মাষ্টার ডাক্তার হয়ে উত্তর ভারতবর্ষের সর্ব্বত্র ছড়িয়ে পড়ল, মনে ভাব্লে এই নূতন শিক্ষা দীক্ষা ও সাহেবিয়ানার চক্চকানি নিয়ে তারা না জানি কোন্ দিগ্বিজয়ে বাহির হয়েছে! কিন্তু কেউ তখন বুঝ্লে না যে বিপদের মেঘ ঘনীভূত হয়ে উঠছে। এদিকে অবসর বুঝে তখন উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ বিশেষতঃ মাড়বার থেকে একদল লোক “লোটাকম্বল” মাত্র সম্বল করে কল্কাতায় এসে আপন পুরুষকারের বলে, অক্লান্ত চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের সহায়তায় বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য হস্তগত করে নিলে। বাঙালীর মুখে তখন ইংরেজি বুলি আর অন্তরে মাড়োয়ারির প্রতি ঘৃণা,তারা অসভ্য ছাতুখোর! কিন্তু ইংরেজিশিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী বা ছাপ এ ক্ষেত্রে বাঙালীকে রক্ষা করতে পার্লে না। বাঙালী হটে গেল; ব্যবসা গেল, বাণিজ্য গেল, হৌস্ গেল; তারপর চাক্রীও আর মেলে না। প্রয়োজনের সঙ্গে আয়োজনের সামঞ্জস্য রইল না—পাশ করা ছেলের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল, কিন্তু সে পরিমাণে অজস্র চাক্রী সৃষ্টি হল না। তাই বাঙালী এখন দরিদ্র, রোগগ্রস্ত; মধ্যবিত্তের আজ অন্নসমস্যা, অস্তিত্ব-সঙ্কট উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু মোহ ঘুচেছে কি? বাঙালীযুবকের বুদ্ধি, কল্পনা ও কর্ম্মশক্তি আজ এমনই আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে যে কেরানীগিরি, মাষ্টারী বা ওকালতী ছাড়া দুনিয়ায় যে অন্য পথ আছে এ কথা সে ভাবতে পারে না, ভাবতে গেলে অনিশ্চিতের আশঙ্কায় সে অতিমাত্র ভীত হয়ে উঠে। তাই তারা আজও কলেজে পড়্ছে আর পাশই কর্ছে।
শিক্ষা সকলেরই চাই। ইংলণ্ড, আমেরিকা, জার্ম্মেনী, জাপান প্রভৃতি দেশে আপামর সাধারণের মধ্যে যে-প্রকার শিক্ষার বিস্তার হয়েছে তার তুলনায় আমরা যে কোথায় পড়ে আছি তার স্থিরতাই হয় নাই। কিন্তু শিক্ষার অর্থ কি শুধু ডিগ্রী নেওয়া? বিলাতের ম্যাট্রিকুলেশান এদেশের ইণ্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্রায় কাছাকাছি। সেখানে ম্যাট্রিক পাশ ক’রে শতকরা ১০।১৫ জন ছাত্র কলেজে প্রবেশ করে। বাকী কোথা যায়? তারা অবশ্য উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করে না অথবা সমুদ্রে ঝাঁপ দেয় না। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের বিবিধ ক্ষেত্রে নানারূপে শিক্ষানবিশী আরম্ভ করে এবং হাতে-কলমে কাজ শিখে ভবিষ্যতে প্রায় সকলেই কাজের লোক হয়ে উঠে। কিন্তু এদেশে ম্যাট্রিক পাশ ক’রে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ কর্তে না পার্লে যুবকগণ ভাবেন জীবনটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। তারপর আই-এ পাশ কর্লে বি-এ পড়তে হবে, আই-এস্সি পাশ করলে বি-এস্সি; নইলে উপায় নেই। এমার্সন বলেন “University makes a havoc of originality!” দলে দলে ১ম, ২য় ও ৩য় বিভাগে পাশ করানো যেন কল থেকে ১, ২, ৩ নং সুর্কী বার করা! এখানে ভাল পোড়ের ইঁট আমা-ঝামার সঙ্গে পেষাই হয়ে গিয়ে সুর্কীতে পরিণত হয়। যার স্বাভাবিক শক্তি ও প্রবৃত্তি যেমনই হউক না কেন সকলকেই যেতে হবে সেই এক গোল গর্ত্তের মধ্য দিয়ে। এতে মানুষের মৌলিকতা বড় নষ্ট হয়ে যায়। কথাগুলি খুব সত্য; কিন্তু কার্য্যক্ষেত্রে এই সহজ সত্যগুলি আমরা এত সহজে অস্বীকার করি যে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে এই একই কথা বার বার বল্তে হচ্ছে। দুচারজন যাঁরা ক্ষণজন্মা তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ধার ধারেননি; যেমন—কেশব সেন, প্রতাপ মজুমদার, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, শিশিরকুমার ঘোষ, নলিনবিহারী সরকার, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথ ডিগ্রী নিয়ে হাইকোর্টে প্রবেশ কর্লে ‘গীতাঞ্জলী’ পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ! ব্যবসাক্ষেত্রে যে ক’জন বাঙালী কৃতী হয়েছেন স্যর রাজেন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম। তাঁর ডিগ্রী কি? Calendar খুঁজলে পাবেন না। সেটা বড় শুভক্ষণ যে তিনি বি-ই হননি, হলে বড়জোর গবর্ণমেণ্টের অধীনে মোটা মাহিয়ানার একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে থাক্তেন। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও কর্ম্মঠ; তাঁর মধ্যে মানুষ হব এই একটা জিদ্ ছিল! মূলধনের অভাব বা অন্য কোন প্রকার অভাব তাঁকে আট্কে রাখ্তে পারেনি! এখন একটা Capital এর (মূলধনের) কান্না শোনা যায়। কিন্তু পাশকরা ছেলের পক্ষে এটা শোভা পায় না; কারণ এম্-এ-তে ফার্ষ্টক্লাস পেয়ে রিসার্চ্ কর্ছেন এমন কোন যুবককে দশহাজার টাকার তোড়া দিলে ছ-মাসে তা খরচ ক’রে আর দশহাজার টাকা ধার ক’রে বস্বেন। তাই বল্ছি ব্যবসায়ক্ষেত্রে প্রধান জিনিষ প্রবল আগ্রহ ও চেষ্টা কোন অসুবিধাতেই দমে না যাওয়া এবং অল্প বেতনে বা বিনা বেতনে কোন চল্তি কারবারে শিক্ষানবিশী করা। মিষ্টার জে, সি, ব্যানার্জ্জি কল্কাতার একজন খুব বড় কণ্ট্রাক্টর্। তিনি দুবার ওভার্সিয়ারি ফেল ক’রে কলেজ থেকে তাড়িত হবার পর শুধু আত্মচেষ্টায় অতি সামান্য অবস্থা থেকে কত বড় হয়েছেন! এমন যুবক নেই যিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে কৃতকার্য্য হতে না পারেন। এখন আয়াদের লক্ষ্য হওয়া উচিত “মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পতন।”
আমাদের দেশের লোকে শ্রমের মর্য্যাদা (Dignity of Labour) বুঝেন না। একটা ইলিশ মাছ কিনে মুটে খোঁজেন, নহিলে সন্ধ্যার পর এদিক ওদিক চেয়ে মাছটা হাতে ক’রে লুকিয়ে বাড়ী আসেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস্ যখন খোলা হয় তখন আমার একজন বিশিষ্ট বন্ধু আড়ালে ঔষধ তৈরী ক’রে আড়াল থেকে বেচ্তে পরামর্শ দেন। যাহোক শ্রমের মর্য্যাদা আমাদের এখন স্বীকার কর্তেই হবে। এখন ব্যবসা চাই, অন্নসংস্থানের নূতন নূতন পথ উন্মুক্ত না কর্লে আর চল্বে না, ‘নাস্তি গতিরন্যথা’।
ব্যবসা সম্পর্কে বাংলাদেশে পাটের কথা আগে মনে হয়। পাট জন্মায় শুধু বাংলায়। সিরাজগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে পাটের খুব বড় বড় আড়ত আছে। কিন্তু আমরা সে দিকে তাকাই না। দেশের উৎপন্ন দ্রব্য থেকে সেই দেশের লোকে যে সহজে টাকা রোজগার কর্তে পারে এ ধারণা আমাদের স্পষ্ট হয় না। আমরা অপদার্থ। ছেলে পাশ হবার পর তার চাক্রীর জন্য ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে গিয়ে nomination চাই, তাঁকে শত অনুনয় করি, তাঁর পায়ে খাঁটি (তাও আর মেলে না) সরিষার তৈল মর্দ্দন করি। পনেরো টাকার নকলনবীশির জন্য সাহেরের বড়বাবু ও তাঁর অফিসের পেয়াদার খোসামুদি ক’রে ছ মাস কাটাতে আমাদের লজ্জাবোধ হয় না। এদিকে আমাদেরই জমিতে কে এসে দাদন দিয়ে পাটের কারবার একচেটে করে নেয়? সে মাড়োয়ারী, আর্ম্মিনিয়ান, আর ইংরেজ। ইংরেজ সোজা চাষার বাড়ী যায়, মিষ্টি কথা বলে, তাঁর ছেলেপুলের সঙ্গে খেলে ও তাদের খেলনা দেয় আর স্বকার্য্য সাধন ক’রে আসে। জমিদাররা কি চেষ্টা ক’রে এত বড় ব্যবসাটা আপন হাতে রাখতে পারেন না? একেবারে কিছু রেলিব্রাদার্স্ হওয়া যায় না; কিন্তু আত্মচেষ্টায় আস্তে আস্তে হতে পারা যায় ত’ বটে। পাটের সময় অনেক নিরক্ষর চাষী বিভিন্ন গ্রাম থেকে পাট নিয়ে নিকটবর্ত্তী আড়তে যোগান্ দিয়ে এসে তিন চার মাসের মধ্যে ১০০০৲। ১২০০৲ টাকা রোজগার ক’রে নেয়।
মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের দুরবস্থার কথা আর কি বল্ব। যাঁরা পূর্ব্ববাংলার খবর রাখেন তাঁরা জানেন সেখানে মাছ কিন্তে গেলে জেলেরা বলে—“বাবু, সন্ধ্যার পর ঝড়তি পড়তি নিয়ে যাবেন।” দুর্দ্দশার একশেষ! ঈর্ষার কথা বলছি না, মাড়োয়ারী যদি লোটা ছাতু সম্বলে লক্ষ টাকা আনেন, বাংলার পাট থেকে রোজগার ক’রে যদি ইংরেজ কলওয়ালা টাকার আণ্ডিলে গড়াগড়ি দেন, তা হ’লে বাংলায় জন্মগ্রহণ করে বাংলার আবহাওয়ায় মানুষ হ’য়ে বাঙালী আমরা কিছু কর্তে পারি না?
আর একটা ক্ষুদ্র ঘটনার উল্লেখ করি। পদ্মায় অজস্র ইলিশ মাছ জন্মায়; কিন্তু দাদন দিয়ে জেলেদের নিকট থেকে সেই মাছ সংগ্রহ করবার এবং বরফ ঢাকা দিয়ে কলকাতায় পাঠাবার ভার বিদেশীর হাতে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হ’য়ে নিদ্রাসুখ ভোগ কর্ছি আর লাভের টাকা অপরে লুট্ছে। এইরূপে সকল দিকে আমাদের কর্ম্মক্ষেত্রের পরিসর গুটিয়ে আস্ছে। টাকা ত পড়ে আছে, কিন্তু আমাদের নেবার শক্তি নেই। কি দারুণ লজ্জা!
বজ্বজ্ থেকে আরম্ভ ক’রে ত্রিবেণী পর্য্যন্ত গঙ্গার দুধারে সর্ব্বশুদ্ধ ৮১টি পাটের কল আছে; কলের মালিক সবাই ইংরেজ। তাঁরা শতকরা ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ডিভিডেণ্ড (dividend) দিচ্ছেন। এক-একটা পাটের কলের মূলধন ২৫।৩০ লক্ষ টাকা হবে। তবেই দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক পাটের কল ২৫।৩০ লক্ষ টাকা লাভ করেছে। আমাদের বর্দ্ধমানের মহারাজার আয় অধিকাংশ পত্তনী বিলি বলিয়া ১২ লক্ষ টাকার বেশী হবে কি না সন্দেহ। শুনেছি দ্বারভাঙ্গার মহারাজার ২৫।৩০ লক্ষ টাকা আয় হবে, অর্থাৎ এক-একটি পাটকলের আয় আমাদের দেশের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ জমিদারের আয়ের সঙ্গে সমান। এই কয় বৎসরের সমস্ত পাটের কলে বৎসরে ১০।১২ কোটি টাকা রোজগার করে কলওয়ালারা বিদেশে নিয়ে গেছেন। এ লাভের কার্বারে এদেশীদের কোন হাত নেই,—সব বিদেশীর। ভারতবর্ষের লোকেরা পাটকলের কুলি। পাটকলের আশেপাশে বস্তির মধ্যে তারা কি জঘন্য অবস্থায় দিন কাটায় তা সকলেই জানেন।
কল্কাতায় দশহাজার ভাটিয়া আছেন। তাঁদের সকলেরই কার্বার আছে। সবাই অবস্থাপন্ন, তাঁদের মধ্যে কেরাণী নাই। কলকাতায় মাড়োয়ারীর সংখ্যা ৯০,০০০ থেকে ১০০,০০০ মধ্যে। সকলেই সঙ্গতিপন্ন। যার খুবই কম আয় তিনি মাসে ১০০ টাকা রোজগার করেন। আর কল্কাতার লক্ষপতিরা যে অনেকেই মাড়োয়ারী, একথা কারও অবিদিত নাই। ছেলে নকুরী (চাক্রী) কর্বে এরূপ ভাবতে মাড়োয়ারী অপমান বোধ করেন। দিল্লীওয়ালাও কল্কাতায় অনেক আছেন। মুরগীহাটায় তাঁদের বড় বড় দোকান। আমড়াতলার গলিতে প্রকাণ্ড দ্বিতল ত্রিতল বাড়ী তাঁরা হাজার, দেড়হাজার টাকায় ভাড়া করেছেন। সেখানে বিস্কুট, ওষুধ, দিয়াশালাই প্রভৃতি জিনিষ বোঝাই করা আছে। এসব বিদেশী মালের এঁরা একমাত্র এজেণ্ট। পূর্ব্ববাংলা, সুদূর দিল্লী ও রেঙ্গুন, প্রভৃতি স্থানে এঁরা পাইকারী হিসাবে মাল পাঠান। এঁদের আয় যথেষ্ট। দিল্লীওয়ালা মুসলমান ব্যবসা বোঝেন। বাঙ্গালী মুসলমান বোঝেন না। তাঁরা হিন্দুদের চেয়ে এই বিষয়ে নির্জ্জীব ও উপায়বিহীন।
তারপর আমাদের যৌথ কারবার (Joint Stock Company) নেই বললেই চলে। এরূপ কারবার এদেশে চলে না, কারণ আমরা পরস্পর বিবাদ করি, হিংসা করি, আপনাদের বিশ্বাস করি না। কাজেই আমাদের অর্থ, শক্তি ও কৌশল সম্মিলিত হবার সুবিধা ও অবকাশ পায় না। যৌথ কারবারে ইংরেজ সফল হয়, আমরা হই না।
ব্যবসায়ক্ষেত্র থেকে এম্নি ক’রে সবদিকে হটে গেলে আমাদের অন্নসমস্যার মীমাংসা হবে না, অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইংরেজ, মাড়োয়ারী, ভাটিয়া, দিল্লীওয়ালা—যাঁরা কলকাতার সকল প্রকারের ব্যবসা একচেটে করেছেন—তাঁদের চরণতলে বসে ব্যবসার প্রথম পাঠ আমাদের শিখতে হবে। তাঁরা যে উপায়ে কৃতী হয়েছেন আমাদেরও সেই উপায় অবলম্বন কর্তে হবে। আলস্য ও বিলাস ছাড়তে হবে। প্রথম ব্যবসা আরম্ভ করে মাড়োয়ারী কাপড়ের বস্তা পিঠে নিয়ে ফিরি করেন, গাছতলায় বিশ্রাম করেন। তাঁরা রেলগাড়ীতে তৃতীয় শ্রেণীতে চড়েন, পাঁচলক্ষ টাকা না হ’লে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠেন না। কিন্তু আমরা,—বাবুরা “দেড়া কেরায়াকা” গাড়ীতে উঠি, এদিকে পেটে অন্ন নাই। ব্যবসাক্ষেত্রে দাঁড়াতে হলে উদ্যম অধ্যবসায় ও কষ্টসহিষ্ণুতায় এঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতে হবে—একথা যেন আমাদের শিক্ষাভিমানী পাশকরা, ছেলেরা কখনও বিস্তৃত না হন। কারণ সকল ক্ষেত্রেই শিক্ষানবিশীর একটা মূল্য আছে। ভূঁইফোঁড় বা না পড়ে পণ্ডিত হবার মত ভয়ঙ্কর জিনিষ আর কিছুই নাই। বিশেষতঃ ব্যবসায়ক্ষেত্রে উত্থান পতন অতি ভয়ানক; এরূপ গভীর দায়িত্বপূর্ণ কাজে হাত দেবার আগে একটু শিক্ষার দরকার একথা আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। অনভিজ্ঞ লোকের ব্যবসায়-চেষ্টা অল্পদিনের মধ্যেই নিষ্ফল হয়ে গেছে এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে। সুতরাং এ শিক্ষানবিশীকে আমাদের যুবকগণ যেন কখনও উপেক্ষার ভাবে না দেখেন।
যুবকগণের প্রতি আমার নিবেদন, ফেল হলে তাঁরা যেন জগৎ অন্ধকার না দেখেন এবং ক্ষোভে ও দুঃখে শেষে আত্মহত্যা করে না বসেন। আর তাঁদের অভিভাবকদের হাতজোড় করে বলছি যে ছেলে ফেল্ হলে তাঁরা যেন হা হুতাশ না করেন, পোড়া কপাল দুরদৃষ্ট বলে নিজেকে ও পুত্ত্রকে ধিক্কার না দেন। আমাদের ছেলেরা পরীক্ষা পাশ করতে না পারলে যেন মহাপাতকী দস্যুর চেয়েও বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। কি দুর্দ্দশা! যে ক’জন বাঙালী পাটের দালাল আছেন তাঁরা সব ফেলকরা ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার বন্ধ করলে কি টাকা পয়সা বা মনুষ্যত্বের দ্বার বন্ধ হয়? আমি আজীবন ভেবেছি, নব্যবঙ্গের সব ছেলেদের আমি জানি। আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে জীবনে সফলতা লাভ করবার জন্যে গ্রাজুয়েট হবার কোন দরকার নেই। কিন্তু তাই বলে বিদ্যাশিক্ষার আবশ্যকতা নেই আমি এমন কথা বলছিনা। লেখাপড়া চাই। ইংলণ্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে উচ্চশিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা ও লোকশিক্ষার নানাপ্রকার বন্দোবস্ত আছে। তারা লেখা পড়া শিখে শিল্প বাণিজ্য ব্যবসায় প্রভৃতি নানা কাজে লেগে যায়। তারা জানে Knowledge is power জ্ঞানই শক্তির উৎস। রাসায়নিক পরীক্ষাগারে বর্ত্তমান যুদ্ধের ফলাফল অনেক পরিমাণে নির্দ্ধারিত হয়েছে। প্রকৃত শিক্ষা চাই, কিন্তু চাইনা কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ, যা জীবনপথে কখনও আমাদের সম্বল হয় না।
আমাদের দেশের প্রদর্শনী উন্মুক্ত হবার পর কান্না পায়, দেখতে পাবেন দেখবার মত যা কিছু আছে তার সবই ইউরোপীয় চালিত, কারখানায় প্রস্তুত। তবু প্রদর্শনী চাই। প্রদর্শনীতে গিয়ে, আমরা আমাদের দারিদ্র্য ও অভাব আরও স্পষ্ট ক’রে বুঝতে পার্ব। বাঙ্গালী যুবকের মধ্যে মনুষ্যত্বের উপকরণ আছে। এখন পরীক্ষা ফেল্ ক’রে জীবনটা বৃথা হল এ কথাটা মন থেকে একেবারে মুছে ফেল্তে হবে। আজ এই ভীষণ অন্নসমস্যার দিনে আমাদের যুবকগণ কি শুধু পাশ ফেল্ গণনা ক’রে জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাগ নষ্ট ক’রে ফেল্বেন! চাকরী হলনা বলে জগৎ অন্ধকার দেখবেন! এ মোহ ছাড়িয়ে উঠ্তেই হবে। আমাদের এখন একটা সবল জীবন্ত যুবক-সমাজের দরকার হয়েছে যাঁরা গতানুগতিকের গণ্ডী ভেঙে অনিশ্চিতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে একটুও ভয় পাবেন না, পাশ ফেলের হিসাব না রেখে যাঁরা আপনার তেজে আপনি দীপ্ত হয়ে প্রচণ্ড কর্ম্ম-চেষ্টা প্রকট করে দেখাবেন। যাঁরা রাজ্য গঠন করেছেন—আকবর, শিবাজী, রণজিৎ সিংহ, হায়দার আলি, ক্লাইভ, ওয়ারেন হেষ্টিংস প্রভৃতি—তাঁদের কেহই স্কুল-কলেজে প’ড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি পান্নি। পরহিতব্রত কার্ণেগী ৯০ কোটি টাকা মূল্যে তাঁর লোহার কার্খানা বিক্রয় করেছিলেন; তিনি জীবন-সংগ্রামের প্রারম্ভে রাস্তায় খবরের কাগজ বেচ্তেন। লর্ড রবার্টস্ সামান্য সৈনিক থেকে নিজের চেষ্টায় ক্রমে ফিল্ডমার্শাল হয়েছিলেন। লর্ড কিচ্নারও তাই। তাতা, বিটলদাস ঠাকুরসে, ফজল ভাই করিম ভাই, লিপটন, এই কল্কাতার গোয়েনকা, ঝুনঝুন্ওয়ালা, হর্দিৎ রায় চামারয়া অথবা আয়রন্সাইড্ বার্ক্মায়ার এঁরা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ উপাধির কোন ধারই ধারেননি। তাই বলে এঁদের অশিক্ষিতও বলা চলে না, এঁরা সম্পূর্ণ শিক্ষিত; এঁদের শিক্ষার মূলে স্বাবলম্বন। এঁরা পাঠাগারে ব’সে বই পড়েন,—“নোট” পড়েন না। আমাদেরও নিজের চেষ্টায় শিখ্তে হবে ও আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যে প্রবেশ কর্তে হবে, শিল্পের উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে, নইলে অস্বাস্থ্য ও অন্নাভাবে অচিরে বাঙালী জাতির অর্দ্ধেক ধ্বংস হয়ে যাবে। বর্ত্তমানে আমরা সামান্যভাবে কলকারখানা স্থাপন কর্তে ও নানাপ্রকার ব্যবসার কাজে প্রবৃত্ত হতে আরম্ভ করেছি। কিন্তু কোথাও এখনও রীতিমত সফলতার মুখ দেখ্তে পাইনি। এই কারণে অনেকে একটা আত্মঘাতী চীৎকার আরম্ভ করেছেন, বাঙ্গালীর দ্বারা কিছু হবে না। কিন্তু আজ ইউরোপ যে ব্যবসায়-ক্ষেত্রে একাধিপত্য লাভ করেছে তা পাঁচশ বছর বা ততোধিক কালের বংশপরম্পরালব্ধ অভিজ্ঞতার ফল এই কথাটা মনে রাখ্লে আমরা কা’রও গঞ্জনাবাক্যে নিরুৎসাহ হয়ে পড়্ব না। আর আপনাদের চেষ্টায় কল কারখানা স্থাপন কর্তে না পার্লে ইংলণ্ড, আমেরিকা প্রভৃতি স্থান হতে অনেক বাঙালী যুবক শিল্প ও বাণিজ্য সম্বন্ধে যে জ্ঞান নিয়ে দেশে ফিরে আসছেন সে জ্ঞান কর্ম্মক্ষেত্রের অভাবে সম্পূর্ণ নিরর্থক হবে। বিদেশ থেকে কোন একটা শিল্পে পারদর্শিতা লাভ ক’রে ফিরে এলেই ত হবে না—তাকে কাজে লাগাবার জন্য ক্ষেত্র রচনা কর্তে হবে। অতএব বিশেষ অনুধাবন ক’রে দেখুন; আজ আমাদের জীবন-মরণের সমস্যা উপস্থিত। চাক্রী চাক্রী করলে আর চলবে না; এ পথ ছেড়ে দিয়ে ভিন্নপথ, স্বাবলম্বনের আত্মনির্ভরতার পথ ধর্তেই হবে। আমি বাঙলার তথা ভারতবর্ষের নানাস্থানে ভ্রমণ করেছি। দেশে যাতে বিজ্ঞানচর্চ্চা হয় এবং নব্য যুবক চাকুরীর উমেদারী না ক’রে শিল্পোন্নতির কাজে এবং ব্যবসা বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হন সর্ব্বত্রই আমার এই নিশান।
‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’—তাই আজ আমাদের জাতি বুদ্ধিহারা হয়েছে। কঠিন অন্নসমস্যার মীমাংসা কর্বার উদ্দেশ্যে বাঙ্গালী পিতামাতা পুত্ত্রকে মাট্রিকুলেশন পাশের পর ছুটিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে মুখ করে; এল্-এ, বি-এ পাশ ক’রে ডিগ্রী নিয়ে ছেলে আঁচ্লা বেঁধে টাকা আন্বে, এই একটা মোহের ঘোরে। আশায় আনন্দে সুখের স্বপন দেখ্তে দেখ্তে ৭।৮ বৎসর কাল এই আলেয়ার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটে খুব জাঁকালরকম ডিগ্রী নিয়ে বাঙালী যুবক যখন কলেজ, অধ্যাপক, আর্টস্, সায়ান্স প্রভৃতির হাওয়া থেকে এসে একেবারে শক্ত মাটির পৃথিবীতে দাঁড়ান্ তখনই বুঝ্তে পারেন যে, এই বস্তুর হাটে তিনি নিতান্তই নিঃসম্বল—এ বাজারে কেনাবেচা কর্তে হলে যে যোগ্যতার দরকার, মল্লীনাথের টীকায় বা এম্-এ ক্লাসের অধ্যাপকের পাশকরানো নোটে কোথায়ও তার সঙ্গে পরিচয় হয়নি। জীবনপথে পা দিয়েই এই যে একটা ধাক্কা লাগে, সারা জীবনে অনেকেই তা সাম্লে উঠ্তে পারেন না। একটা নৈরাশ্যের ছায়া এইখানেই ঘনীভূত হয় তারপর কেরাণী মাষ্টার, বা উকিল হয়ে গড্ডলিকা-প্রবাহে ভাসতে ভাসতে অভাবের পেষণে স্বভাব নষ্ট হয়, আর জীবনটা ক্রমে নৈরাশ্যপূরিত অন্তঃসারশূন্য অকাল বার্দ্ধক্যে মুষড়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের ভুল কোথায়? কি উপায়েই বা ভ্রান্তির অপনোদন হতে পারে?
আজ এই জীবন-সন্ধ্যায় রসায়নের পরীক্ষাগার থেকে বাইরে এসে উৎকট অন্নসমস্যা সম্বন্ধে যদি আলোচনা আরম্ভ ক’রে থাকি তবে আপনারা জানবেন সে নিতান্তই প্রাণের দায়ে। বাঙালীর আজ পেটের দায়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “আগে পেট ভ’রে খাও, তবে ধর্ম্ম কর্ম্ম হবে।” হিন্দু আমরা—খুব আধ্যাত্মিক—সর্ব্বদাই ধর্ম্মের অনুশীলন কর্তে চাই। কিন্তু বাতাস খেয়ে ধর্ম্মপালন হয় কি? স্বাস্থ্য, প্রাণশক্তি, উৎসাহ, অধ্যবসায় অক্ষুণ্ণ রাখ্তে হলে যথেষ্ট আহার চাই। কিন্তু আমরা অভাবে, অস্বাস্থ্যে, রোগে—দিন দিন নিস্তেজ হয়ে পড়্ছি, কর্ম্মশক্তি তিল তিল ক’রে ক্ষয় পাচ্ছে, অন্নসমস্যার সঙ্গে অস্তিত্ব-সঙ্কট এগিয়ে আস্ছে। আজ তাই দেশের ছাত্রদের গলা ছেড়ে ডেকে বিমর্ষ ভাবে আমায় বল্তে হচ্ছে—“সাবধান!” বিপদ সন্নিকট! ছাত্র তোমরা, দেশের ভবিষ্যত আশাস্থল। তাই এই সকল অপ্রিয় সত্য তোমাদের কাছে খুব স্পষ্ট করেই বল্ছি। “ন ব্রূয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্”—ঠিক কথা নয়। রোগ ঢাক্লে চল্বে না। রোগ নির্ণয় ক’রে বিধিমত ঔষধের ব্যবস্থা কর্লে তবেই আমরা বাঁচ্তে পারব।
আপনারা সকলেই জানেন সেই পুরাতন হিন্দু কলেজের কথা—যেখানে বাঙালীর ছেলে সর্ব্বপ্রথম ইংরেজীচর্চ্চা আরম্ভ করে। তারপর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি থেকে বরাবর আজ পর্য্যন্ত আমরা চলেছি—একভাবে একই বাঁধাপথে। এই উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চল্বার কালে এখন একবার উচ্চৈস্বরে বলে উঠ্তে হবে “থামো! থামো!” সকলকেই কি সরলরেখাক্রমে একই নির্দ্দিষ্ট পথে যেতে হবে? রেখামাত্র বিচ্যুতি হলে চলে না কি? বাস্তবিক একবার স্থিরচিত্তে বিরেচনা ক’রে দেখ্তে হবে ডিগ্রী ও চাকুরীর মোহে আমরা যে পথে ছুটেছি তার শেষ-সীমায় সফলতার আলোক প্রস্ফুট হয়ে আছে অথবা ধিরাট ব্যর্থতার অন্ধকূপ আমাদের ডুবিয়ে দেবার উদ্দেশে প্রচ্ছন্নভাবে অপেক্ষা কর্ছে!
বর্ত্তমান শিক্ষাপ্রণালী ও জীবিকার্জ্জন—এই দুয়ের মধ্যে এখন কিরূপ সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে তার আলোচনা কর্বার আগে একটা কথা আমি ব’লে রাখি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের “ছাপের” মূল্য যাই হোক্ না কেন, তার বিরুদ্ধে আমি যত কথাই বলি না কেন, প্রকৃত উচ্চশিক্ষা লাভ ক’রে চিত্তোৎকর্ষ সাধন করা চাই। লেখাপড়া চাই, গণ্ডমূর্খ হলে কিছুতেই চল্বে না। কিন্তু অকর্ম্মণ্য ডিগ্রীধারী হয়ে কোন লাভও নেই, গৌরবও নেই। আমাদের পোড়া কপাল যে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ছাপ”কে অন্নসংস্থানের একমাত্র উপায়—“নান্যদস্তি” ব’লে জ্ঞান কর্চি। এই ধারণাটা ভূতের মত আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে—কিছুতেই নাম্তে চায় না।
এই ধরুন বি-এল পাশ ক’রে ওকালতি করা। ছেলেদের ও-একটা বাঁধা গৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে যাই—জেলা মহকুমা, জজ বা মাজিষ্টরের সকল রকমের আদালত-সব জায়গাতেই উকিলের সংখ্যা মক্কেলের দশগুণ, কোথাও বা বিশগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই উকীল হলেও পয়সা রোজগার হচ্ছে না। কিন্তু তবুও বিএ পাশ ক’রেই বাঙালী যুবক আইন পড়তে ছুট্চেন। পালে পালে, দলে দলে, সকালে বিকালে আইন পড়া চলেছে। “পাশটা ক’রে রাখা যাক্”—আইন পড়্বার এই একমাত্র নজীর আছে। কিন্তু যেখানে প্রয়োজনের চেয়ে আয়োজনের আড়ম্বরটা অধিক, সেখানে আয়োজন যে অনেক পরিমাণে ব্যর্থ হবে এ ত স্বতঃসিদ্ধ কথা। “সর্ব্বমত্যন্ত গর্হিতম্।” আইন পড়ো না—আর দরকার নেই—এমন কথা বলি না। কিন্তু এই কথা বলি— যার কাট্তি নেই, আদর নেই, গুমোর নেই, যা গুদামজাত হয়ে প’ড়ে থেকে পচে, সে জিনিষের আবাদ যেমন বন্ধ রাখা ভাল, আইন পড়াও সেই যুক্তিরই বলে স্থগিত রাখা বা বহুল পরিমাণে কমিয়ে দেওয়া দরকার নয় কি? আইনজ্ঞেরা আমার শত্রু এমন উৎকট অদ্ভুত কথা আমি বলিনি। বাঙালার ব্যবহারজীবিদের নিকট আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য। মনোমোহন ঘোষ, লালমোহন ঘোষ, ডবলিউ সি ব্যানার্জ্জি, আনন্দমোহন বসু প্রভৃতি রাজনৈতিক নেতৃগণ, কলিকাতা সায়ান্স কলেজের প্রাণস্বরূপ স্যর তারকনাথ, ও স্যর রাসবিহারী এবং মনস্বী জষ্টিস্ চৌধুরী, স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ব্যোমকেশ চক্রবর্ত্তী, ও সি, আর, দাস প্রভৃতি ব্যবহারজীবিগণ বাঙলার সকল শুভকার্য্যে অগ্রণীস্বরূপ। রাজনৈতিক আন্দোলনে বিজ্ঞ ব্যবহারাজীবির স্থান কোথায়—মহামতি বার্ক তা অতি সুনিশ্চিতরূপে নির্দ্দেশ ক’রে গেছেন। কিন্তু ছোট বড় সকল প্রকার আদালতের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়িয়েও যাঁরা উপোষ ক’রে থাক্তে বাধ্য হন, বার-লাইব্রেরীর চাঁদার পয়সাটা যাঁরা দিয়ে উঠতে পারেন না এবং স্থল বিশেষে এক ছিলিম তামাক পেলে যাঁরা কয়েক পাতা নকল ক’রে দিতে পারেন, এমন সব উকীল কি ওকালতী ব্যাপারটার মর্য্যাদাহানি কর্ছেন না? বল্ছিলাম উকীল তৈরী করবার কলটা যদি বেশ কয়েক বৎসর বন্ধ থাকে তবে গোবেচারী উপোষকারীর দল বেঁচে যেতে পারে। প্রয়োজন ও আয়োজনের মধ্যে অসামঞ্জস্য কত বেশী হয়ে পড়ছে বিবেচনা ক’রে দেখা উচিত। তা হলে আর দফে দফে উকীল তৈরী ক’রে তাদের দফা রফা কর্বার প্রবৃত্তি হবে না।
মধ্যবিত্ত বাঙালীর সন্তান ডিগ্রী পেলেই জীবিকা সংস্থান কর্তে পার্বে আর ডিগ্রীর অভাবে চারিদিক অন্ধকার দেখবে এটা কত বড় ভুল আজ তা নিঃসংশয়ে বুঝে নিতে হবে। বৎসর বৎসর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কল্মা নিয়ে গ্রাজুয়েটের দল জয়পতাকা উড়িয়ে বেড়িয়ে আস্চেন। তাঁদের রাজার-দর আজকাল কত? একটা কর্ম্মখালির বিজ্ঞাপন দেখলে এক ঝুড়ি দরখাস্ত পড়ে—তারপর তার মধ্যে একজন মনোনীত হন। কাজেই বি, এ ৪০৲ টাকা আর এম-এ ৭০৲ টাকা পেলেও ঐ মাহিয়ানার চাক্রী পাবার সম্ভাবনা গ্রাজুয়েট-সাধারণের পক্ষে কত অল্প বুঝিয়ে বল্বার দর্কার নেই—শুধু একটু ভেবে দেখার ওয়াস্তা। সকলেই হা অন্ন! হা অন্ন! ক’রে বেড়াচ্ছেন। এম্-এ পাশ কর্বার পর যখন কাজকর্ম্ম জোটে না তখন মনের দুঃখে বাঙালী যুবককে বল্তে শুনেছি—ফেল হ’লে ভাল হ’ত—তবু আর এক বৎসর দুশ্চিন্তার হাত হোতে নিষ্কৃতি পেতাম। চাক্রীর বাজার আগে ছিল ভাল বটে। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভ থেকে ইংরেজী শিখে বাঙালী চাক্রীই কর্ছে। শিক্ষিত যুবক আগে মুন্সেফী ডিপুটী হতে পার্তেন—গভর্ণমেণ্ট ও সওদাগরী আফিসে নানাপ্রকার কর্ম্ম জুট্ত। ইংরেজ যখন উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ পাঞ্জাব ও বর্ম্মায় রাজ্যবিস্তার কর্লেন তখন বাঙালী সেখানেও গেল চাকরী কর্তে, আর মাড়োয়ারী, বোম্বেওয়ালা প্রভৃতি গেলেন ব্যবসা কর্তে। ডিগ্রী থাক্লে চাক্রীর বড় সুবিধা হ’ত; তাই তখন ডিগ্রীর একটা অকৃত্রিম মূল্য হয়েছিল। আর সেই কারণেই শিক্ষিত বাঙালীর চাক্রীই একধ্যান একজ্ঞান হ’য়ে উঠলো। কিন্তু এখন শিক্ষিতের সংখ্যা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এত চাক্রী জুটবে কোথা থেকে? অবস্থার পরিবর্ত্তনের সঙ্গে ব্যবস্থার সামঞ্জস্য করতে না পার্লে ঘটনাচক্রের পেষণে মর্তে হবে আমাদেরই। সুতরাং চাক্রীর পথ ছেড়ে অন্য পথ ধর্তে হবে।
এইস্থানে আমাদের বর্ত্তমান শিক্ষাপ্রণালীর একটু আলোচনা ক’রে দেখতে হবে। আমি বলেছি যে, আমরা চাক্রীর জন্য ডিগ্রীর চেষ্টা করি, আবার ডিগ্রীর জন্য এক টাকা মূল্যের পুস্তকের পাঁচ টাকা মূল্যের নানারকম নোট কিনে থাকি। এই যেন সেই বার হাত কাঁকুড়ের তের হাত বীচি। কেবল নোট মুখস্থ আর গৎ আওড়ান। কাজেই বিদ্যা আমাদের পুঁথিগত। ডিগ্রীলাভের এইরূপ চেষ্টায় মৌলিকতা নষ্ট হয় এবং প্রতিভার স্ফুরণ হয় না। পাশকরা ছেলে কার্য্যক্ষেত্রে নেমে হাতড়ে বেড়ায়—কোথাও কুল পায়না। ইউনিভারসিটি কমিশন রিপোর্টে অনেক বিশেষজ্ঞের মত আছে। সেই সকল মতের সমালোচনা ক’রে তাঁরা সিদ্ধান্ত ক’রেছেন—
“The present system is like a soul-destroying machine. If the young Indian of ability passes through it, he will lose all his soul and half of his reasoning capacity in the process ...... Our University system instead of encouraging the love of learning, kills it. The universities of India are but factories where a few are manufactured into graduates and a good many more wrecked in the voyage of their intellectual life. The education that is imparted in the colleges, gives a very narrow outlook to their alumni and fails to stimulate any healthy intellectual curiosity in the majority or to develop the powers of initiative when thrown on their own resources of accurate observation and independent thinking and of applying the knowledge gained.”
বর্ত্তমান শিক্ষা-প্রণালী মানুষের অন্তরকে পিষে ফেলবার যন্ত্রবিশেষ। এতে জ্ঞানলিপ্সা উদ্দীপ্ত হওয়া দূরে থাক একবারে বিনষ্ট হ’য়ে যায়; ছাত্রের মন সঙ্কুচিত হ’য়ে অসাড় ও কৌতূহলশূন্য হয়; কোন কাজ আরম্ভ করবার অথবা লব্ধজ্ঞান কার্য্যে প্রয়োগ করবার সাহস বা ইচ্ছা থাকে না। ঐ রিপোর্ট থেকে আর দুই একটি স্থান উদ্ধৃত করচি—
“Matriculation is the key which unlocks the door to all the colleges attractive to the respectable classes of Bengal and at that door the crowd grows larger every year.”
“Pupils at present look upon their school or college life as nothing but a preparation for university examinations”, writes Mr. Jogendranath Bhattacharya. “Their horizon is circumscribed as they have no higher aim than to pass examinations. When a certificate is the chief aim and end, any subject that does not lend itself to the test, becomes neglected. This oppressive system also affected the method of instruction. Teachers are only too careful to teach those things that will be set at the final examination. The number of passes being the goal, the spirit of enquiry in the pupil is smothered, cram lessons and ‘keys’ receive encouragement.”
“Teaching is being unduly subordinated to examination,” writes Mr. Akshoy Kumar Sarcar of Chittagong. “The teacher’s success depends upon the number of students he has made to pass. Some school authorities have taken teachers to task for failing to pass a high percentage of students. Students themselves say that they come not to learn but to pass the examination. Teachers also give way to this view very often. The guardians of students generally endorse this view.”
“The very large majority of the, schools I have seen in East Bengal,” writes Mr. J. W. Gunn, “are cram establishment pure and simple, where everything is subordinated to the immediate requirements of the Matriculation Exanlination.”
মাট্রিকুলেশন পাশ কর্লে সকল কলেজেরই দ্বার উন্মুক্ত হয়। এই মাট্রিকুলেশনে ছাত্রের সংখ্যা প্রত্যেক বৎসরেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, বুদ্ধিমাত্রেই কি স্বাস্থ্যের লক্ষণ? দেশে জ্ঞানতৃষ্ণা বাড়্ছে এই ভেবে অনেকেই আশ্বস্ত হন। কিন্তু এ কি স্বাস্থ্যকর তৃষ্ণা? অথবা বিসূচিকার তৃষ্ণার মত ভয়ঙ্কর! আমি অনেক সময় পাড়াগাঁয়ে গিয়ে থাকি। বাগেরহাট অঞ্চলে গিয়ে দেখেছি সেখানে শুধু কায়স্থ ব্রাহ্মণ বৈদ্য নয়, নমঃশূদ্র মাহিষ্য বারুইদের মধ্যে লেখাপড়া শিখবার আগ্রহ বেড়ে চলেছে। বেশ কথা। কিন্তু এই জ্ঞানতৃষ্ণাই, অস্বাস্থ্যের লক্ষণ হ’য়ে দাঁড়ায়, যখন প্রত্যেক মাট্রিকুলেট কলেজে প্রবেশ লাভ কর্বার জন্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ছুটাছুটি কর্তে থাকে। কলেজে স্থানাভাব। অথচ মাট্রিকুলেশন পাশ ক’রে প্রত্যেককে কলেজে পড়তেই হবে—কেন না আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ছাপটা’কে জীবিকার্জ্জনের একমাত্র উপায় ব’লে ধ’রে নিয়েছি। অন্য কোন উপায়ে যে অন্নসংস্থান হ’তে পারে এ ধারণা আমাদের নেই বল্লেই চলে। কাজেই কোন রকমে পয়সা-কড়ির যোগাড় ক’রে (দরিদ্রা বিধবা মা-মাসীর গহনা বাঁধা দিয়ে) ছুটে চল ঐ কলেজের দিকে। সেখানে ঠেসাঠেসি ঘেঁসাঘেসি; তবু ছেলেরা ছুটে চলেছে—সম্মুখে গিয়ে বস্বে; ধাক্কাধাক্কিতে প’ড়ে কেউ মারাই বা যায়! ৪০ মিনিটে পিরিয়ড্ দলে দলে ছেলেরা সকালে বিকালে উপরে নীচে পাতালে, সব জায়গাতে পড়াশোনা করছে। ছাত্রদের জ্ঞানলাভে তেমন কোন আগ্রহ নেই—কোনরকমে নোট মুখস্থ ও পার্সেণ্টেজ, রক্ষা ক’রে ডিগ্রী পেলেই বস খুসী। তারা কলেজের পাঠ্যপুস্তকের অতিরিক্ত কোন বই পড়বে না, কারণ পাশ কর্বার জন্যে সে সকল পাঠ কর্বার কোন আবশ্যক নেই। কোন নূতন কথা নয়, কোন অবান্তর কথা নয়—শুধু নোট দাও আর লাল নীল সবুজ পেন্সিলে সব দাগ দিয়ে নিতে বল। পরীক্ষা পাশ করাটাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়ায় শিক্ষাপ্রণালীর এই শোচনীয় দুর্দ্দশা হয়েছে। আবার পল্লীগ্রামের স্কুলে বেশী ছেলে পাশ না হলে বেচারী হেডমাষ্টারকে কর্ত্তৃপক্ষ তাড়া দেন—সে এক বিষম মুস্কিল। কেউ বা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেন আমার স্কুলে এতগুলি ছাত্র পাশ হয়েছে, অতএব চ’লে এস; ইত্যাদি। কলেজের দ্বারে এই যে শত শত ছাত্র আঘাত করছে, মাথা খুঁড়ছে, এরা কি প্রকৃত জ্ঞানপিপাসু বিদ্যার্থী অথবা ডিগ্রী পার্থী মাত্র—উদ্দেশ্য গলাধঃকরণ, উদ্গীরণ ও ডিগ্রীগ্রহণ। আমাদের ছেলে হলে চার বৎসর বয়স হতে বি-এল্-এ ব্লে আরম্ভ হয় আর চব্বিশে চর্ব্বণ শেষ। কিন্তু এতে যে পরিমাণ যোগ্যতা লাভ হয় সঙ্কটপূর্ণ সংসার পথে চল্বার পক্ষে তা একেবারেই যথেষ্ট নয়। যে-কোন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা কর্লেই,জান্তে পারা যায় যে, সে চায় পাশ কর্তে, জ্ঞানলাভ করতে নয়। শিক্ষককে ছাত্ররূপ মনিবের মন জুগিয়ে চল্তে হয়, কারণ পাশ কর্বার যা উপযোগী তাই তিনি পড়বেন, অন্য কিছু দেখবেন না অন্য কথা কানে তুল্বেন না। পঠিত বিষয় আত্মসাৎ ক’রে তা থেকে রসরক্ত সঞ্চিত হলে চিত্তোৎকর্ষ সাধিত হতে পারে। কিন্তু ছাত্র তা চায় না—সে চায় গ্রামোফোনের মত মুখস্থ বুলি উদ্গীরণ ক’রে ডিগ্রী নিতে। কিন্তু অন্নসংস্থানের জন্যে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপের উপর নির্ভর করা ব্যতীত উপায়ান্তর নেই, এই ভয়ঙ্কর ভ্রান্তির হাত থেকে মুক্তিলাভ ক’রে ব্যবসা বাণিজ্য কৃষি শিল্পের দিকে মনোনিবেশ কর্লে ছাত্রও বাঁচতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ও ভারমুক্ত হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ-ফেলের অঙ্কপাতে ভবিষ্যৎ জীবনের শুভাশুভের গণনা না ক’রে যদি আমাদের যুবকগণের আশা উৎসাহ ও বুদ্ধি অন্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত হয় তবে শুভ ফল হবে—সফলতা লাভ হবে—সন্দেহ নেই। অভাব ও অস্বাস্থ্যের তাড়নায় আমাদের জাতীয় জীবনের এমন একটা সঙ্কটকাল উপস্থিত হয়েছে যে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবক—সকলেরই এই কথাগুলি বিশেষ ক’রে অনুধাবন করে দেখা উচিত।
স্বদেশী আন্দোলনের ফলে এ দেশে কতকগুলি কলকারখানা স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ডিগ্রীধারীগণ পশ্চাতে ছিলেন; কোন কৃতিত্ব দেখাতে পারেন নি। তাঁরা কলের মত, কলুর চোখঢাকা বলদের মত। বিদ্যাশিক্ষার ফলে তাঁরা কেরানীগিরির যোগ্যতা লাভ করেন— নিজের চেষ্টা উৎসাহ ও বুদ্ধির বলে কিছু কর্বার সাহস বা শক্তি ছাত্র-জীবনেই তাঁরা হারিয়ে বসেন। বর্ত্তমানে ব্যবসায়-ক্ষেত্রে যে সকল বাঙালী সফলতা লাভ, করেছেন তাঁদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ধারই ধারেন না। স্যর্ রাজেন্দ্রনাথ, জে সি ব্যানার্জ্জি, কয়লাখনির স্বত্বাধিকারী এন্ সি সরকার, রেলওয়ে ট্রাফিকের এস্ সি ঘোষ—এ’রা উপাধির ধার ধারেন না। জে সি ব্যানার্জ্জির কৃতিত্ব বাঙলাদেশ ছাড়িয়ে বোম্বাই-পুনা প্রভৃতি স্থানে পৌঁছেছে। সেখানে এখন এককোটি টাকার কণ্টাক্ট তাঁর হাতে। বাঙ্গালীর বোম্বাই-প্রদেশে এই প্রথম প্রতিষ্ঠা; আমাদের পক্ষে এ বড় গৌরবের কথা! গতানুগতিকের গণ্ডী ভেঙে বাঁধা পথ ছেড়ে নূতন পথে পা ফেলে এবং উদ্যম ও অধ্যবসায়ের বলে সফলতায় মণ্ডিত হয়ে এঁরা আমাদের যুবকের সম্মুখে অন্নসংস্থান ও দারিদ্র্যনিবারণের একটা নূতন পথ উন্মুক্ত ক’রে দিয়েছেন। আমাদের ছেলেরা পাশ না কর্তে পার্লেই মাথায় হাত দিয়ে ব’সে পড়ে—বলে, হায় হায় জীবনটা মাটি হয়ে গেল! আরে, জীবন মাটী হয় তো ঐখানেই ঐ একটানা এক বাঁধাপথে, যা বৈচিত্র্যে সুন্দর নয়, যেখানে আশার আলোকপাত হয় না, যেখানে শুধু দারিদ্র্যের অশ্রু—ভাবনা বেদনা ও কর্ম্ম-পঙ্গুত্ব। ৩০ বৎসরের বাঙালী যুবক সংসারজ্বালায় জর্জ্জরিত, চক্ষু নিষ্প্রভ, মুখে আনন্দচিহ্ন নেই; দুশ্চিন্তাগ্রস্ত—মেয়ে সেয়ানা হচ্চে বিয়ে দিতে হবে—বরের বাজার আগুন। কিন্তু জীবনের প্রারম্ভে যাঁরা সফলতার মুখ দেখেছেন সেই ইংরেজ ও মাড়োয়ারীকে দেখ—কত স্ফূর্ত্তি, কত আশা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে পাঁচ বছরে আমাদের যুবকের ডিগ্রী ও চাকরীর মোহ ঘুচে যায়, ব্যর্থতা ও বিফলতা তাকে ঘিরে ধরে, অবসাদহিমে ডুব্তে ডুব্তে যৌবনেই তার জীবনগ্রন্থি শিথিল হয়ে পড়ে, অকালবার্দ্ধক্যের চিহ্ন দেখা যায়। তাই বলি, প্রথম বয়সে আশা উৎসাহ ডিগ্রী নেবার চেষ্টায় নিঃশেষ ক’রে না দিয়ে আত্মচেষ্টার উপর নির্ভর ক’রে বেরিয়ে পড় দ্রব্যসম্ভারপূর্ণ প্রকাণ্ড এই দেশে, যেখানে ছয়শোকোটি টাকা মূল্যের দ্রব্য প্রত্যেক বৎসরে আম্দানী-রপ্তানি হচ্ছে। এই প্রকাণ্ড ব্যবসায়-ব্যাপারের সব মুনাফা ইংরেজ, জর্ম্মান্, জাপানী প্রভৃতি বিদেশীরা এবং ভারতের ভাটিয়া, দিল্লীওয়ালা, মাড়োয়ারী প্রভৃতি বণিকগণ নিজেদের মধ্যে বণ্টন ক’রে নেয়।
বাঙলা দেশের প্রধান সহর কল্কাতার বাসিন্দাদের শতকরা ৩৫ জন বাঙালী নয়। ইংরেজ, জাপানী, চীনা এবং হিন্দুস্থানী মাড়োয়ারী প্রভৃতি কল্কাতার সর্ব্বত্র বসতি বিস্তার করেছেন। ছোটখাট শ্রমসাধ্য কার্য্যগুলি পর্য্যন্ত বাঙালীর হাতছাড়া হয়ে গেছে। যুদ্ধের সময় মাড়োয়ারী অজস্র টাকা লাভ করেছেন। কলকাতার ব্যবসায়ে তাঁদের কোটী কোটী টাকা খাট্ছে। উদ্বৃত্ত টাকায় তাঁরা বড় বড় জমিদারী কিন্তে আরম্ভ করেছেন; শীঘ্রই মাড়োয়ারী বণিক্ কল্কাতার সব বাড়ীর মালিক হবেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর বাঙলাদেশে বাঙালী আমরা হতাশ হয়ে, নিরুপায় হয়ে বসে আছি। আমাদের এখন উঠে পড়ে লাগতে হবে, এই ভয়ঙ্কর অন্নসমস্যার মীমাংসা কর্তে হবে। যে শিক্ষায় শুধু মেরুদণ্ডহীন গ্রাজুয়েট তৈরী হয়, মনুষ্যত্বের সঙ্গে পরিচয় হয় না, যে-শিক্ষা আমাদের ‘ক’রে খেতে’ শেখায় না, দুর্ব্বল অসহায় শিশুর মত সংসারপথে ছেড়ে দেয়, সে-শিক্ষার প্রয়োজন কি? তাই আমি জীবনে কঠোরতার আশ্রয় ক’রে বাঙালী যুবককে ব্যবসায় বাণিজ্য ও শিল্প শিক্ষা কর্তে আহ্বান করছি; কারণ, বাঁচতে হলে বাঙালীকে আগে অন্নসমস্যার মীমাংসা কর্তে হবে। এতে যদি কেউ দোষ দেন যে আমি বাঙলার যুবককে মাড়োয়ারী হতে উৎসাহিত কর্ছি তবে সে দোষে আমি দোষী সন্দেহ নেই। যাদের দেশে লক্ষ লক্ষ মণ ধান ও পাট উৎপন্ন হয় ও সেই উৎপন্ন দ্রব্য একহাত থেকে আর একহাতে তুলে দিয়ে মাড়োয়ারী প্রভৃতি বণিক্গণ মাঝে থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জ্জন করেন আর সেই দেশের যুবকেরা ‘হা অন্ন’ ‘হা অন্ন’ ক’রে কেঁদে বেড়ান, ধিক্ তাদের লেখাপড়াকে! ধিক্ তাদের ইউনিভার্সিটির ডিগ্রীকে! লেখাপড়া কর, মহামনীষীগণ যে-সকল তত্ত্ব লিপিবদ্ধ ক’রে গেছেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎভাবে পরিচয় লাভ কর, চিন্তা কর, মানসিক শক্তি ও মৌলিকতাকে বিকশিত কর, কিন্তু অন্য শত পথ পরিত্যাগ ক’রে জীবিকাঅর্জ্জনের জন্যে জ্ঞানশূন্য হয়ে ডিগ্রীর লোভে ঐ ইউনিভার্সিটির মুখে ছুটো না।
ইংলণ্ডে যে-সকল বিশ্ববিদ্যালয় আছে তার মধ্যে কতকগুলির নাম করা যেতে পারে যা শিল্পবাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত হয়েছে। যথা ম্যাঞ্চেষ্টার, বার্মিংহাম, লিডস্, শেফিল্ড, লিবারপুল প্রভৃতি শিল্পকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। এক-একটি ইউনিভারসিটি এক-একটি কলেজের মত, হাজার দেড় হাজার ছাত্র সেখানে অতি যত্নে শিক্ষা লাভ ক’রে থাকে; এখানকার মত স্থানাভাবে ঠেলাঠেলি বা মারামারি করতে হয় না। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৯০ লক্ষ অথবা ১ কোটি টাকা দেওয়া (Endowment) আছে। সেই অর্থ থেকে ছাত্রেরা নানারকমের বৃত্তি পায় এবং সাহিত্য, ধর্ম্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, ফলিত-বিজ্ঞান, এঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি নানাবিষয়ে প্রকৃত শিক্ষা দান করা হয়। বড় বড় কারখানার সন্নিকটে স্থাপিত ব’লে এই-সকল শিক্ষাকেন্দ্রে হাতেকলমে শিল্পশিক্ষা হয়—যে-শিক্ষা ক্রমশঃ ছাত্রকে জীবনসংগ্রায়ের উপযুক্ত ক’রে সংসার পথে পাঠিয়ে দেয়। এই সকল ইউনিভারসিটিতে শিল্পশিক্ষাই প্রধান স্থান অধিকার ক’রে আছে, সাহিত্য দর্শন প্রভৃতি কতকটা পিছনে পড়ে গেছে। আমাদের দেশে কল্কাতার বাণিজ্যবিদ্যালয় (Commercial College) স্থাপন কর্বার কল্পনা চলেছে। কিন্তু কল্কাতায় সেরূপ কলেজ স্থাপিত হলে বড় বেশী লাভ হবে না। কারণ সেখানকার বাঙালী গ্রাজুয়েটরা চাকুরীই খুঁজবে আমার এরূপ মনে হয়। বোম্বাই প্রদেশে বড় বড় কার্খানার নিকটে শিল্পবাণিজ্য শিক্ষার কেন্দ্র স্থাপিত হলে দেশের উপকার হবে আশা করা যায়।
অন্নসমস্যার সঙ্গে আমাদের দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা জড়িত আছে। একের কথা আলোচনা কর্বার সঙ্গে সঙ্গে অন্যগুলির কথা আপনা হতেই এসে পড়ে। কারণ ঐগুলি একই সমাজের ভিন্ন ভিন্ন দিক্ ছাড়া ত আর পৃথক কিছু নয়। আমাদের সমাজের জাতিভেদ ব্যাপারটি দেশীয় শিল্পের বিনাশ সাধনে বড় কম সহায়তা করেনি। এ সম্বন্ধে স্যর গুরুদাসের উক্তি বিশেষরূপে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন— “The caste system which has done some good has done this harm that notwithstanding its relaxation at the present day, it has created in the highercastes with all their poverty, a prejudice against agricultural, technological and even commercial pursuits.”— যারা উঁচু জাত, দরিদ্র হলেও তারা কৃষিশিল্প বা বাণিজ্যের দিকে ঘেস্তে চান না; সমাজে আভিজাত্য নষ্ট হবে এই কথাটা কুসংস্কার; আজ জাতিভেদের কঠোরতা কতকটা শিথিল হলেও, এখনও তাঁদের ঘাড়ে চেপে আছে। আপনারা সকলেই জানেন হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা উচ্চ জাতি তাঁরাই অপরের চেয়ে লেখাপড়ায় অধিক অগ্রসর হয়েছেন। বাঙ্লাদেশে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যেরাই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক শিক্ষিত। মান্দ্রাজে আয়ার ও আয়েঙ্গারগণ এবং মহারাষ্ট্রে তিলক, গোখলে, পরঞ্জপে, ভাণ্ডারকর, চন্দাভরকর, এবং চিৎপাবন ব্রাহ্মণগণ বিদ্যাশিক্ষার আলোক অনেক পরিমাণে লাভ করেছেন। কিন্তু এঁরা সকলেই কেরাণী বা শিক্ষক অথবা উকীল এবং ডাক্তার। চাক্রীর ক্ষেত্রে উঁচু জাতের বাঙালী ও মান্দ্রাজীর মধ্যে প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছে। বাঙালী গ্রাজুয়েট্ যদি বা ৩৫৲ টাকা চান, মান্দ্রাজী গ্রাজুয়েট্ ৩০৲ টাকায় খুসী। বাঙালী শাকের সঙ্গে দুটো চিংড়ী মাছ ফেলে ঘণ্ট করেন, আর মান্দ্রাজী ভাতের সঙ্গে একটু তেঁতুলের জল পেলেই তুষ্ট। আজ চালের মণ ১১৲ টাকা, মাছের সের ১৲ টাকা। কাজেই উপবাসে আমরা মারা যাচ্ছি। আমাদের যে স্কুলকলেজের লেখাপড়া শেখা, সে শুধু চাকুরীর জন্যে। উচ্চজাতীয় শিক্ষিত লোকেরা ব্যবসায়ে যেতে অনিচ্ছুক—দ্বিধাবোধ করেন। বহুকাল পূর্ব্বে জাপান ও ফ্রান্সের অবস্থা কতকটা এইরূপ ছিল। অভিজাত বংশের কেউ ব্যবসা বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হতে চাইতেন না। সেদিন তাদের কেটে গেছে—আমাদের কিন্তু কাটেনি। আজ য়ুরোপ ও জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে চলেছে, তার কারণ শিল্প ও বাণিজ্য প্রসার লাভ কর্ছে এবং ছাত্রেরা সেই সকল বিষয়ে শিক্ষালাভ করবার জন্যে উত্তরোত্তর আগ্রহ প্রকাশ কর্ছে! আর আমাদের দেশেও ছাত্রসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু কারণটা কি? বলা শক্ত। চাক্রীর ক্ষেত্র ত প্রসারিত হয়নি, আর আমাদের উদ্দেশ্য শিল্প বা বাণিজ্যশিক্ষা এরূপও ত মনে হয় না। কাজেই শিক্ষালাভের এই আগ্রহকে ঠিক পথে পরিচালিত কর্লে দেশের উপকার হবে, শুধু চাক্রীপ্রিয় গ্রাজুয়েট্ তৈরী করলে কোন কাজে লাগবে না।
আত্মাভিমানের বশে বাঙ্লার উচ্চজাতি শ্রমের মর্য্যাদা ক্রমশঃ ভুলে গিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যাদি কাজ থেকে অবসর নিলেন। এদিকে লেখাপড়া তাঁদেরই একচেটিয়া ছিল। কাজেই সমাজে এক ভীষণ অনিষ্ট সাধিত হ’ল। শিক্ষাদীক্ষার সহিত ব্যবসা বা শিল্পের আর কোন সম্পর্কই রইল না। আমাদের সমাজে বিদ্যাবুদ্ধি সব উঁচু জাতের। সমাজের নিম্নস্তরে দলিত জনসঙ্ঘের মধ্যে তাই প্রতিভার বিকাশ হ’ল না। ইংলণ্ডে ষ্টিম্ এঞ্জিন্ উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পব্যাপারে, একটা ওলটপালট—একটা যুগ পরিবর্ত্তন হয়ে গেল। হাতে যারা তাঁত চালাত সেই সব তাঁতীরা প্রথমে কলের তাঁত ভেঙে দিলে। কারণ কলে অল্প পরিশ্রমে অনেক কাজ হতে লাগ্ল। কিন্তু ইংলণ্ড শীঘ্রই সে ধাক্কা সাম্লে নিতে সমর্থ হল। গোলমাল ক্রমে থেমে গেল। ইংলণ্ডে জাতিভেদ ছিল না—লক্ষ লক্ষ লোককে সেখানে নীচ জাত ব’লে অসুবিধা ও নির্য্যাতন ভোগ কর্তে হত না। তাই সেখানে সমাজের সকল স্তরেই প্রতিভার বিকাশ হয়েছে। তাই ক্রমে দেখা গেল শিল্পজগতের সেই পরিবর্ত্তনের যুগে নাপিত আর্করাইট—যিনি এক পেনি পারিশ্রমিক নিয়ে ক্ষৌরকার্য্য কর্তেন— তিনি হোলেন আবিষ্কারক। আর তাঁতি (Hargreaves) হার্গ্রিভ্সও তাঁর নব আবিষ্কারের দ্বারা এই কার্য্যের সহায়তা কর্লেন। সে দেশে সকলেরই প্রতিভা সকল ক্ষেত্রে স্ফুরিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই জাতিভেদের দেশে? এখানে উঁচু জাত যেদিন জাত বাঁচাবার জন্যে ৬৪ কলাবিদ্যা একে একে পরিত্যাগ করলেন, সেদিন সার্জ্জন হলেন পরামাণিক, আর বেদেরা হলেন বোটানিষ্ট। তারপর এসব ক্ষেত্রে আমরা যেমন উন্নতির পরিচয় দিয়েছি তার কথায় আর কাজ নেই! বংশগতভাবে চর্চ্চা হওয়ায় হাতের কৌশল খুব নিপুণ হয়েছিল স্বীকার করি এবং শিল্পও সূক্ষ্ম হয়েছিল। ঢাকাই মস্লিন শিশিরসিক্ত হয়ে থাক্লে কাপড় ব’লে কেউ বুঝ্তে পার্ত না। শিল্পও সূক্ষ্ম হয়েছিল। কিন্তু বংশগত হওয়ায় প্রধান ক্ষতি হ’ল এই যে, আমাদের দেশের আবেষ্টনের মধ্যে দেকার্ৎ বা নিউটনের উদ্ভব ভাবে কাজে অসম্ভব হয়ে উঠ্ল—এই জাতিভেদের আওতায় সমাজে স্বাধীনচিন্তা বা প্রতিভার বিকাশ অসম্ভব হয়ে উঠ্ল। কাজেই কলকব্জার রথে চ’ড়ে পাশ্চাত্য দেশে শিল্প যখন আশ্চর্য্য গতিতে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে লাগ্ল তখন বাঙলার ফরাসডাঙ্গা ঢাকা প্রভৃতি স্থানের ও অন্যান্য তাঁতীরা শুধু অবাক বিস্ময়ে অসহায় শিশুর মত সেই দিকে চেয়ে রইল—তাদের সঙ্গে সমান গতিতে অগ্রসর হবার কল্পনাও তাদের মনে উদিত হ’ল না। অথচ এই ভারতের তাঁতী কিছুকাল পূর্ব্বে য়ুরোপের বাজারে উৎকৃষ্ট জিনিষ পাঠিয়ে প্রচুর লাভ কর্ত। যাহোক, এই বাণিজ্যযুদ্ধে ভীষণ পরাজয় হ’ল বাঙ্লা দেশের। বোম্বাই আত্মচেষ্টায় ধাক্কা সামলে নিয়ে এখন আবার মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়াতে পেরেছে। খুব স্পর্দ্ধা ও গৌরবের কথা। বোম্বাই প্রদেশের বণিক দেখ্লেন সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে তুলা উৎপন্ন হয়; তখন ভাব্লেন—বোম্বাইএ কাপড়ের কল হবে না কেন? তাঁরা ১৮৫০ খৃষ্ট্রাব্দে বা ঐ সময়েই কাপড়-কলে কৌশলাদির শিক্ষা কর্তে লাগ্লেন। তারপর কল স্থাপন ক’রে প্রথম প্রথম অনেক লোক্সান দিলেন। এ সব কথা ওয়াচার লিখিত তাতা’র জীবনীতে প’ড়ে দেখ্বেন। তারপর একবার সফলতার মুখ দেখ্তেই তাঁদের আশা ও সাহস খুব বেড়ে গেল। শেষে বাঙলার স্বদেশী আন্দোলনের সময় ত তাঁদের একেবারে পৌষমাস! তাঁরা শতকরা ৭০।৭৫ টাকা লাভ পেলেন। কিন্তু স্বদেশীর উত্তেজনার সময়েও বাঙ্লা দেশ কিছু কর্তে পার্লে না। বাঙালী কল কিনে বসল ৬ লাখের স্থানে ১২ লাখ দিয়ে। কিন্তু কল চালাতে হয় কি ক’রে তার খবর সর্ব্বাগ্রে না রাখায় সুফল হল না। ‘বঙ্গলক্ষ্মী’র কি দশা সে সময় হয়েছিল সে কথা কারো অবিদিত নেই। আমাদের তখন শিক্ষালাভ হ’ল যে শুধু বক্তৃতার উত্তেজনা বা ভাবোচ্ছ্বাসের উপর নির্ভর করে শিল্পোন্নতি হয় না। যাহোক, এখন সুখের বিষয় এই যে যুদ্ধের বাজারে তবু ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ একটু মাথা খাড়া ক’রে দাঁড়িয়েছেন,
এখন বম্বে ও কল্কাতা একবার তুলনা ক’রে দেখুন। বম্বের ধন বোম্বাইবাসীর; কিন্তু কল্কাতার অর্থসম্পত্তি বাঙালীর নয়—ইংরেজ মাড়োয়ারী, ভাটিয়া বা দিল্লীওয়ালা মুসলমানের। মান্দ্রাজের Black Town, কল্কাতার Native quarter—এ সব কাল আদ্মীর পাড়া—বন্ধ, অন্ধকার, স্যাঁৎস্যেতে,—গলির গলি তস্য গলি এঁদো গলি। আর শ্বেতাঙ্গ যেখানে থাকেন সে একেবারে ইন্দ্রপুরী। কিন্তু বোম্বাই এ তা নয়। সেখানে বড় বড় প্রাসাদতুল্য অট্টালিকায় বোম্বাইবাসী ধনকুবের, ক্রোড়পতি বণিক, কাপড় কলের মালিক প্রভৃতি মহাধনী বাস করেন। মোরারজি গোকুলদাস, স্যর্ বিটলদাস ঠাকর্সে, স্যর দোরাব তাতা—এঁরা সব বোম্বাইএর তথা ভারতবর্ষের মুখ উজ্জ্বল করেছেন—য়ুরোপীয় প্রতিযোগিতার সম্মুখে ব্যবসায়-বাণিজ্যে উচ্চশির হয়ে দাঁড়াবার শক্তি এঁদের আছে—বাহাদুরী সেইখানে। ইংলণ্ড থেকে ফিরে আসবার সময়—পি এণ্ড ও ষ্টীমারে একজন বম্বের মুসলমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। পরস্পরের মুখের দিকে কয়েকবার চেয়ে দেখবার পর আলাপের সূত্রপাত হল। আমি ইংরেজীতে কথা বল্লাম। তিনি বল্লেন “নেই সম্ঝেতে” ইংরেজী তিনি জানেন না। বোম্বাইএ তাঁর টুপীর দোকান—টুপী আম্দানী করেন জার্ম্মনী, ইটালী প্রভৃতি স্থান থেকে। কথাবার্ত্তায় বুঝলাম য়ুরোপে যখনই যে বন্দরে নেমে ছিলেন তখন, যাঁদের এজেণ্ট তিনি—তাঁদের লোক আপনি এসে তাঁকে আগ বাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ভাঙ্গা হিন্দীতে কথা বলে কার্য্যনির্ব্বাহ করেছে—কারণ গরজ তাদের। মস্ত বড় ব্যবসায়ী—তাই এত খাতির—য়ুরোপের লোক হিন্দীতে কথা বলে! বাঙলা দেশে এমন কোথাও আছে কি?
বাঙালী যে ব্যবসায়-বাণিজ্যে পশ্চাৎপদ তার অন্য কারণও আছে। আমাদের সুজলা সুফলা বাঙ্লা দেশ—তারপর আবার আমাদের ছেলেরা পাখীর ডাকে ঘুমোয় আর পাখীর ডাকে উঠে। বাঙ্লার স্যাঁৎস্যেতে হাওয়ার জন্যে মেকলে বলেছিলেন এদেশে ভাপ্রা তাপের (Vapour bath) মধ্যে থাক্তে হয়। দেশের হাওয়ার দোষ। মিঃ চার্চ্চিল—এখন যিনি একজন প্রধান রাজমন্ত্রী, তাঁর পিতা ভারতসচিব ছিলেন। ভারত ভ্রমণ করে তিনি বলেছিলেন—এদেশে মানুষগুলো জড়ভরত হয়ে আছে―Lulled by the languor of the land of lotus—উলিসিসের বর্ণিত কমলবিলাসী দেশের ঘুমপাড়ানী হাওয়ায় এলিয়ে প’ড়ে। আমাদের দৌড়ানতে হাঁটা, হাঁটায় বসা, বসায় শোওয়া, আর শোওয়ায় ঘুমোনো। বাঙ্লা উর্ব্বরা—একটু চষে বীজ ছড়িয়ে দিলেই অঙ্কুরোদ্গম হয়। এই নদীমাতৃক দেশে আবালবৃদ্ধবনিতাকে রৌদ্রে পুড়্তে পুড়্তে শস্য উৎপাদন কর্তে হয় না! তারপর ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে যখন দেশের ভয়ানক দুর্দ্দশা হ’ল, লোকাভাব হ’ল, জমি বিনা-আবাদে পতিত রইল, তখন নানাবিধ অসুবিধা দেখে লর্ড কর্ণওয়ালিস বললেন—রাজস্বের পরিমাণ বাঁধাধরা হোক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেল। সকলেই কিছু কিছু জমিজমা যোগাড় ক’রে পায়ের ওপর পা দিয়ে ব’সে খাবার বন্দোবস্ত কর্তে লাগ্ল। এই ‘পায়ের ওপর পা দিয়ে ব’সে খাওয়া’ কথাটি এখনও দেশে চরম সুখের পরিচায়ক। কিন্তু সবাই মিলে ব’সে খেতে চাইলে চল্বে কেন? যেমন য়ুরোপের কল্কারখানা এসে আমাদের জোরে ধাক্কা দিল, অমনই ব’সে খাবার সুখ ঘুচে গেল, আর ব’সে খাওয়ার প্রবৃত্তিজনিত অলসতা আমাদের সর্ব্বনাশ কর্লে। আবার যাঁদের টাকা জমেছে তাঁরা হয় কোম্পানীর কাগজ বা মহাজনী কর্বেন, নয় জমিদারী কিন্বেন এবং বংশানুক্রমে তা ভোগ কর্বেন; এছাড়া টাকা খাটাবার অন্য কোন মৎলব নেই। কাজেই বাঙালীর ব্যবসায়ে প্রবৃত্তি হয়নি। বরং এই সকল কারণে আমাদের মধ্যে অলসতা, শ্রমবিমুখতা, ও বিলাসপরায়ণতা প্রভৃতি দোষ প্রবেশ করেছে। বাঙ্লার বারভূঁইয়া জমিদার ছিলেন। জমিদারী ও চাক্রী নবাবী আমল থেকে বাঙালীর রক্তে ও ধমনীতে। কিন্তু এখন আর ওপথে গেলে চল্বে না। ডিগ্রী ও চাক্রীর মোহ, জলহাওয়া ও অভ্যাসের দোষ, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসের বলে ছাড়িয়ে উঠ্তে হবে। অনেকে অভিযোগ কর্ছেন—আমি লেখাপড়া ঘুচিয়ে দিয়ে বাঙালীর ছেলেকে মাড়োয়ারী হ’তে বলছি। বড় বড় য়ুরোপীয়ান বণিক—তাঁরা কি গণ্ডমুর্খ? তাতা, বিঠলদাস, ইব্রাহিম করিমভাই—এঁরা কি গণ্ডমুর্খ? লেখাপড়ার অভাবে মাড়োয়ারী এদের মত হতে পারেনি, মাড়োয়ায়ী ব্যবসা শিখলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠায় কোন কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। লেখাপড়া ও ব্যবসা বাণিজ্য পরস্পর-বিরোধী নয়। আমি মাড়োয়ারীকে বল্ব ব্যবসার সঙ্গে লেখাপড়া শেখো; আর বাঙালীকে বল্ব—ব্যবসা কর চাক্রীর মায়া ছাড়।
দেশে অন্নসমস্যা দিন দিন কঠিন হতে কঠিনতর হয়ে উঠ্ছে, অথচ যার বলে ‘ক’রে-খেতে’ পারা যায় এমন কোন শিক্ষার বন্দোবস্ত শীঘ্র হয়ে উঠবে এমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইউনিভারসিটি-ডিগ্রীর প্রসাদে কায়ক্লেশে ৪০।৫০ বা ৬০৲ আস্তে পারে; কিন্তু তার ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালীর দারিদ্র্য-দুঃখ ঘুচে যাবার কোন আশা কারো মনে উদিত হচ্ছে না। চাক্রীর দুর্দ্দশার কথা অনেকবার বলেছি—সেই সম্পর্কে আর-একটা কথা বলি। বাজারে চাক্রী এখনও মেলে জানি—১৫।২০ বা ২৫৲ মাহিনা, কিন্তু এও মেলা বড় ভার হয়ে উঠ্ছে। আগে পাশ কর্লে চাক্রী হত। এখন অবস্থা এমনি দাঁড়িয়েছে যে চাকরীর উমেদারী ক’রে হার মেনে গিয়ে একজন গ্রাজুয়েট রেল-কোম্পানীর সুপারিণ্টেণ্ডেটকে কুলী-লাইসেন্স পাবার আশায় দরখাস্ত লিখেচেন। সে দরখাস্ত আমার কাছে এসেছিল। ব্যাপার ত এই! এর উপর আর কিছু বল্তে হবে কি? আজ অন্নসমস্যার মীমাংসা সম্বন্ধে দুচারটি কথা বল্ব। কোন্ পথ অবলম্বন কর্লে—আমরা এই পেটের দায় থেকে নিস্তার পাব তা আমি ইতিপূর্ব্বে কতকটা নির্দ্দেশ কর্বার চেষ্টা করেছি আজ সেই কথাই আরও স্পষ্ট ক’রে বল্ব। তাই বলে কেউ মনে কর্বেন না যে আমি এখন একটা সোজা এবং বাঁধাপথ দেখিয়ে দেব যা অবলম্বন কর্লে সহজে এই মরাবাঁচার কথার মীমাংসা হয়ে যাবে। তা নয়! সমস্যা যেমন জটিল, আমাদের চেষ্টা ও অধ্যবসায় তেমনই প্রচণ্ড হওয়া চাই।
আমাদের দেশের অনেক যুবক বিদেশ থেকে ইলেক্টিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, রং করা, চামড়া-কষ-করা প্রভৃতি শিখে আস্ছেন। কিন্তু আমরা তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পার্চি কৈ? শুধু রঙ বা চামড়া বা অন্য কিছুর কার্য্য শিক্ষা কর্লেই ত চলবে না। শিক্ষালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ কর্বার জন্যে উপযুক্ত ক্ষেত্র চাই। তাই বল্ছি আমাদের বড় বড় কারখানা খুল্তে হবে। কার্খানা থেকে একদিকে যেমন উৎপন্ন দ্রব্য আমরা দেশ-বিদেশে পাঠাতে পারব, অন্যদিকে তেমনি শিল্পশিক্ষার দ্বার যথার্থভাবে উন্মুক্ত হবে। কল্পনা অনেক দূর ছুটেছে বটে, কিন্তু এই সব কল্পনাকে বাস্তবে পরিণত কর্তেই হবে যদি আমাদের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাক্বার সাধ থাকে। এই দেখুন, মিঃ জি, সি সেন—ইংলেণ্ড থেকে ইনি Dyeing বা রং-করা শিখে এসেছেন। কিছুদিন ইনি বঙ্গলক্ষ্মী মিলে কাজ কর্লেন। কিন্তু বঙ্গলক্ষ্মীতে কাজের ক্ষেত্র সঙ্কীর্ণ। সেখানকার কাজ এত বড় নয় যে ঐরূপ একজন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়। একজন চলনসই লোক থাক্লেই সেখানে চলে যায়। কাজেই তাঁকে ঘুরে ফিরে গবর্ণমেণ্টের চাক্রী নিতে হোলো। এত কষ্ট স্বীকার ক’রে শিল্প সম্বন্ধে যে বিদ্যাটুকু তিনি বিদেশ থেকে নিয়ে এলেন উপযুক্ত ক্ষেত্রের অভাবে সে বিদ্যার কোন ব্যবহারই হলো না। সেইরূপ এ সি সেন, এস কে দত্ত প্রভৃতি। শরৎকুমার দত্ত জার্ম্মানিতে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিখে এসে দেশে কোন কাজ যোগাড় কর্তে না পেরে শেষে জার্ম্মানির যে কার্খানায় কাজ শিখেছিলেন সেইখানেই ফিরে গেলেন। তিনি এখন সেইস্থানে খুব একটা উচ্চপদ অধিকার ক’রে আছেন। এদেশে বড় কার্খানা থাকলে তিনি শক্তির পরিচয় দিতে পার্তেন সন্দেহ নেই। এখানেও অনেক ছাত্র রসায়নে এম-এ বা এম-এস-সি পাশ ক’রে য়ুরোপীয়ানদের কারখানায় চাক্রী নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আফিসে যেমন বাবু কুলী থাকে, এঁরাও তেমনি কেমিক্যাল-কুলী—দেশ থেকে অর্থ শোষণ ক’রে নিতে য়ুরোপীয়ানদের সাহায্য করছেন। তাই বল্ছিলাম—আমাদের কারখানা খুলতে হবে। ফলিত বিজ্ঞানের (Applied Science) সাহায্যে আমাদের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খাড়া ক’রে তুল্তে হবে।
কিন্তু শিল্পোন্নতির আগে চাই সাধারণ কেনাবেচার মধ্য দিয়ে ব্যবসা করা। ব্যবসা আরম্ভ ক’রেই কিছু সফল হওয়া যায় না। চেষ্টা চাই, ধৈর্য্য চাই। কেমিষ্ট্রী বা রসায়ন শিখ্তে হলে যেমন পরীক্ষাগার (Laboratory) চাই, ব্যবসা শিখ্তে হলেও পরীক্ষাগারের তেম্নি দরকার। ক্লাইব ষ্ট্রীট, ক্যানিং ষ্ট্রীট, বড়বাজার, এজরা ষ্ট্রীট—এইসব স্থান হচ্চে ব্যবসা-শিক্ষার পরীক্ষাগার। এইসব রাস্তায় চোখ চেয়ে ঘুরে ফিরে বাজারের হালচাল বুঝতে হবে। কোন মাড়োয়ারী য়ুরোপীয়ান দোকানে সুবিধা গেলেই কাজ শেখবার জন্যে ভর্ত্তি হতে হবে। কারণ ব্যবসায় কার্য্যে শিক্ষানবিশীর বড় প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে ভূঁইফোড়ের স্থান নেই, হাতেকলমে কাজ শিখতে হবে, একথা আমি পূর্ব্বেই বলেছি।
আমাদের দেশে ৬০০ কোটি টাকার মাল আমদানী রপ্তানি হয়। এই আমদানি রপ্তানির কাজ এগিয়ে দিয়ে কল্কাতায় কত য়ুরোপীয়ান ও মাড়োয়ারী মাঝে থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জ্জন করে নেয়। আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে পাট হয়। কিন্তু ক্ষেতে থেকে পাটকলে পৌঁছবার আগে এই পাট অনেক হাত ঘোরে। এই সব middleman হচ্ছেন য়ুরোপীয়ান বা মাড়োয়ারী বা আর্মিনি, পূর্ব্বেই বলেছি। এক হাত থেকে জিনিষ নিয়ে অন্য হাতে তুলে দিয়ে এঁরা মাঝথেকে প্রচুর অর্থ উপার্জ্জন ক’রে থাকেন। কিন্তু যে জমিদার মহাশয়ের জমিতে পাট জন্মায় তিনি ছেলের একটা বড় চাক্রীর জন্যে ম্যাজিষ্টর-সাহেবের দ্বারে ধন্না দিয়ে প’ড়ে থাকেন—একবার ভুলেও চেয়ে দেখেন না যে এরূপে দালালগিরি কর্লে তাঁর পুত্ত্র কয়েকটা বড় চাকুরে অপেক্ষা বেশী টাকা আন্তে পারেন। এরূপ শুধু পাট নয়—ধান, সরিষা, তিসি, ছোলা, গম, যব, প্রভৃতি নানাবিধ ফসল মাড়োয়ারী ও য়ুরোপীয়ানদের হাত দিয়ে চ’লে যায়। এই সব কাজ যদি বাঙালীর নিজের হাতে থাক্ত তবে অন্নসমস্যা আজ এত কঠিন ও জটিল হয়ে উঠ্ত না।
তারপর চামড়া, কেরোসিন তৈল প্রভৃতি জিনিষের আমদানী, রপ্তানি আছে। কল্কাতায় ১০।১৫ কোটী টাকার রপ্তানি হয়। ক্যানিং ষ্ট্রীট দিয়ে নাক বন্ধ ক’রে চল্বার সময় চামড়ার কথা খুব ভালরকমই বোঝা যায়। বাঙালীর কিন্তু যেন প্রতিজ্ঞা—ওসব ছুঁতে নেই। তাই ইংরেজ ও মুসলমান চামড়ার ব্যবসা একচেটে করেচেন। আর ২৫৲ মাহিয়ানায় নৈকষ্যকুলীনের সন্তান মুসলমান প্রভুর আদেশমত কোথায় কত চামড়া পাঠাতে হবে নাকে কাপড় দিয়ে কুলীর দ্বারা গণিয়ে দিচ্ছেন। এইসব চামড়া ব্যবসায়ীরা ক্রোড়পতি! আর এই চামড়া ধান সরিষার মত পল্লীগ্রাম থেকেই আসে,—আমরা কেউ সন্ধান লই না। কাষ্টম্স্ হাউসের (Customs house) ত্রৈমাসিক রিপোর্টে ভারতের আম্দানী ও রপ্তানি দ্রব্যের কথা প’ড়ে দেখলে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। কিন্তু আমরা তা চাই না—উপন্যাস আমাদের বড় ভাল লাগে।
আবার ইলিশ ও অন্যান্য মাছের ব্যবসাও খুব লাভজনক। নদীর ধার থেকে বরফ ঢাকা দিয়ে মাছ চালান করা হয়। অনেক হাত ঘুরে মাছ যখন কল্কাতায় পৌঁছায় তখন ৸৵৹ বা ১৲ সের। এরূপ চালানের কাজে বেশ লাভ আছে। তারপর পুকুরে পোনা মাছ ছাড়্তে হয়—নোনা জলে নদীর নোনা মাছ জন্মাবার চেষ্টা কর্তে হয়। এই সব মাছ বড় হলে অর্থাগমের বেশ একটা উপায় হয়। চম্কে উঠো না—আমি তোমাদের মুর্গী ও শূওরের চাষ কর্তে বলি—যাকে বলে Poultry Farm। নিজে দাঁড়িয়ে লোকের দ্বারা কাজ করাবে। একাজেও অর্থোপার্জ্জন বেশ হয়। আর কত নাম আমি কর্ব? তোমরা স্কুলকলেজের ছাত্র। বৎসরে ছয়-সাত মাস ছুটি পাও। ছুটিতে ছেলেরা সবাই দেশে যায়। আমিও আমার দেশে যাই। দেশে গিয়ে দেখি ছুটি পেয়ে ছেলেরা এলিয়ে পড়ে। রাত্রে ৮।১০ ঘণ্টা ঘুম দেবার পর আবার মধ্যাহ্নে বারোটা থেকে তিনটা পর্য্যন্ত নিদ্রা। আর বাকী সময়টা তাসপাশা ও আড্ডায় কেটে যায়। অলস হলে লক্ষ্মীছাড়া হতে হয়। এই নিদ্রা ও চপলতায় যে সময়টা নষ্ট হয় সেই সময়টার সদ্ব্যবহার করিবার দায়িত্ববোধ জন্মান দরকার। নিদ্রা ও আলস্য ত্যাগ ক’রে ছাত্রেরা দেশের নানাস্থান দেখে শুনে সময়টা কাজে লাগাতে পারে। এরূপে দেশের সকল স্থান ও সকল প্রকার লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় লাভ হয়। আর কোথায় কি ভাবে কত বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য উৎপন্ন হয় এবং কত লোকের হাত দিয়ে কত প্রকারে ঐসকল উৎপন্ন দ্রব্য নানাস্থানে চ’লে যায় তার সন্ধান পাওয়া যায়। বেশ সুনিপুণভাবে এই সকলের সংবাদ রাখলে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ হবে এবং চাক্রী ছাড়া ‘নান্যঃপন্থা’ এই ভ্রম ঘুচে গিয়ে অন্নসংস্থানের অনেক নূতন পথ চোখের সুমুখে খুলে যাবে। এই সব অনুসন্ধানের ফলে দেশের কোথায় কোন্ বিদেশী বণিক টাকা দাদন দিয়ে উৎপন্ন দ্রব্য কৌশলে আপন হাতে এনে ফেল্চেন তারও যথার্থ খবর নিশ্চয়ই আস্বে।
আমার অনেক ছাত্র রসায়ন-শাস্ত্রে এম্এ, বা এম্-এস্সি পাশ করেছেন। তাঁদের মধ্যে চার পাঁচ জনে মিলে চক্রবর্ত্তী চাটাজ্জি কোম্পানী নাম দিয়ে একখানা পুস্তকের দোকান খুলেছেন। সে দোকান আজ বেশ চলেছে। এঁরা কয়েক শত টাকা মাত্র মূলধন নিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করেন। এঁরা বাধা কি পাচ্ছেন না? খুবই পাচ্ছেন। কিন্তু এঁদের জিদ্ আছে—প্রতিজ্ঞা খুব দৃঢ়। এঁরা বলেন, “আমরা কৃতকার্য্য হবই হব।” তাই আজ শুধু বই নয় অন্যান্য অনেক বিষয়ে এঁদের লোক নূতন নূতন ব্যবসার পত্তন কর্ছেন। এ সকল স্বপ্নের কথা নয়—অনেকেই উৎসাহ ও অধ্যবসায়ের সহিত চেষ্টা ক’রে এইরূপ কৃতকার্য্য হয়েছেন
ব্যবসায়ে চাই কি? চাই ধৈর্য্য, চাই সাধুতা। আরম্ভ সামান্যভাবে হবে বটে, কিন্তু এই সামান্যের মধ্যে সফলতার বীজ নিহিত আছে। একেবারেই কেহ খুব বড় হয়ে উঠ্তে পারে না; আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া সম্ভব নয়। কার্ণেগী বাল্যকালে সর্ব্বপ্রথম রাস্তায় খবরের কাগজ বেচ্তেন! স্যর দোরাবজী তাতা—যাঁর লোহার কারখানায় আজ লক্ষ লক্ষ টাকা লাভ হচ্ছে—তিনি একবার বলেছিলেন যে তাঁর ম্যানেজার মিঃ তুৎউইলার সংসারপথে প্রবেশ ক’রে প্রথমে নিগ্রো জুড়ীদারের সঙ্গে এঞ্জিনে কয়লা ঢালতেন। আর ধৈর্য্য অধ্যবসায়ের বলে আজ তিনি কত টাকা উপার্জ্জন কর্ছেন। মাড়োয়ারী এক পয়সার ছাতু খেয়ে পিঠে কাপড়ের বস্তা ফেলে ব্যবসায়ে প্রথম চেষ্টা আরম্ভ করে। পরে তারাই লক্ষপতি হয়ে দাঁড়ায়। আর একটা দোকান কর্তে গেলেই তোমাদের প্রথমে চাই বড় বড় আল্মারি টেবিল। ২৭।২৮ বৎসর পূর্ব্বে আমি যখন ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ আরম্ভ করি তখন কুলীর মত খেটেছিলাম। কয়েক বৎসরের মাহিনা থেকে ৮০০৲ টাকা জমিয়ে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ আরম্ভ করি—আজ তার মূলধন ২৫ লক্ষ টাকা।
তারপর বাঙালী কখনও অংশীদারীতে কাজ কর্তে পারে না। বাঙালীর দুর্ভাগ্য যে, যদি সে অংশীদার নিয়ে কাজ আরম্ভ করে তবে অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়—কাজ শিখে নিয়ে অংশীদার পালায়। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের অভাবে যৌথ কারবারেও বাঙালীর চেষ্টা সফল হয় না। এটা হচ্ছে আমাদের জাতীয় দোষ। কোন গ্রাজুয়েটকে অংশীদার হবার জন্যে অনুরোধ কর্লে তিনি আগে বলেন—‘কত মাহিনা দিতে পার?’ বাঁধা মাহিনা আমাদের চাইই। কাউকেও যদি বলা যায়—‘তোমায় ৫০৲ মাহিনা দেব আর সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্য্যন্ত খাটতে হবে’—সে একেবারে মহাখুসী হয়ে যায়। ঘড়ি ধ’রে ১২ ঘণ্টা কলের মত কাজ ক’রে যায়। কিন্তু এম্নি ক’রে চাক্রীকে আঁক্ড়ে না ধ’রে যদি সে প্রথম কয়টা বৎসর কোন ইংরেজ মাড়োয়ারী বা বাঙালীর দোকানে শিক্ষানবিশী করে এবং বাজার ঘুরে নানা তথ্য সংগ্রহ করে তবে ভবিষ্যতে সে ব্যবসায় ক্ষেত্রে বেশ কাজের লোক হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম পয়সা-কড়ি হয়ত আস্বে না, কিন্তু বি-এ বা এম-এ ও তৎপরে বি-এল পাশ কর্তে যে ৬।৭ বৎসর সময় লাগে সে সময়েও ত ছেলে বাড়ীর খায় আর বাড়ীর টাকা খরচ ক’রে পড়াশোনা করে। এখন ডিগ্রির প্রভাবে যখন অতি সামান্য চাকরী ছাড়া আর কিছু মেলে না তখন ম্যাট্রিকুলেশনের পর বাড়ীর খেয়ে ছেলে ত ২।৩ বৎসর ইউনিভার্সিটিতে না হোক কল্কাতার ক্যানিং স্ট্রীট, ক্লাইভ ষ্ট্রীট, বড়বাজার প্রভৃতি স্থানে একটা নূতন শিক্ষা লাভ করতে পারে। তবে এই শিক্ষা পাবার সুবিধা কর্তে হ’লে কোনো দোকানে শিক্ষানবীশ হয়ে প্রবেশ কর্তে হয়। এইরূপ প্রবেশলাভের সুবিধার জন্যে নানাভাবে চেষ্টা করা উচিত। ভবিষ্যতে এসব চেষ্টার সার্থকতা আছেই।
আমরা একে ত মিলেমিশে কোন কাজ কর্তে পারি না, তার উপর আমাদের অনেকে প্রথম উদ্যমে ব্যবসায়ে প্রবেশ ক’রে অল্পদিনের মধ্যে সফলতা লাভের জন্য অধীর হয়ে উঠেন। আর যদি প্রথমে কিছু লোকসান হয় ত অমনি ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে হা চাকরী হা চাকরী ক’রে বেড়ান! কিন্তু স্থিরভাবে লেগে থাকতে না পারলে ব্যবসায় ক্ষেত্রে সফলতা লাভের আশা দুরাশা মাত্র। তাঁরা বোঝেন না যে লোকসান দিয়ে তাঁরা বরং দক্ষ হলেন। আসল মাঝি সেই, যে পদ্মা পার হয়েছে, মাথার উপর দিয়ে যার অনেক ঝড়ঝাপ্টা গেছে। ঝড়ঝাপ্টা না পোহালে কোন কাজই হয় না। কাজ আরম্ভ করবে, আর ‘আপ্সে অবাধে সহজে সিদ্ধিলাভ হবে, এসব মূর্খের সুখস্বপ্নমাত্র। হতাশ হওয়া একেবারেই ঠিক নয়। তোমরা হতাশ হ’য়ো না—তা হলেই লোক্সান যাকে বল্ছ তার মধ্যে লাভ দেখ্তে পাবে। পাঁচবার ধাক্কা খেয়ে তবেই শিক্ষালাভ হয়। আবার আমরা যদি একবার শুনি অমুক ব্যবসায়ে অমুক খুব লাভবান্ হয়েছে অমনি যে যেখানে আছি সকলেই ছুট্ দি সেইদিকে।—যেন সেই ব্যবসাটা না কর্লে, আর লাভ হবে না। আবার অনেকে এক জায়গায় কিছুদিন কাজ শিখে বলেন ভাল লাগে না—অম্নি আর একটা ধর্তে যান। এমনি ক’রে এটা নয় ওটা কর্তে কর্তে শেষে বাঁধা পড়্তে হয় সেই চাক্রীর খোঁটায়। তাই বলি বিবেচনা ক’রে একটা দিক ঠিক ক’রে ধর, আর সেইখানেই লেগে থাক। অনেক অসুবিধা হবে, অনেক আশাভঙ্গ হবে! কিন্তু আন্তরিক চেষ্টার ফলে শেষে সব শ্রম সার্থক হয়ে উঠ্বে।
শিক্ষানবীশির কথা অনেক বারই বলেছি। আর একটা কথা সেই সঙ্গে বল্তে চাই—সেটা হচ্ছে শ্রমের মর্য্যাদা। এই জ্ঞানটা আমাদের বড় কম। ‘পরিশ্রম কর্লেই ছোটলোক হল’ এরূপ একটা ধারণা আমাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে আছে। আমি সেই যুবকটিকে ধন্যবাদ দিই যিনি বলেন কুলীগিরি কর্ব;—এঁর বাহাদুরী আছে। ‘ব’সে খাব বা কারও স্কন্ধে চেপে খাব,’ এ বড় লজ্জার কথা—বড় জঘন্য কথা! এরূপ লোককে কিছু কর্তে বল্লে রাগ কর্বেন, কারণ কাজ কর্তে হ’লে এঁদের মানের লাঘব হয়। কিন্তু ‘ব’সে খাব’—এই চিন্তার স্থানে ‘ক’রে খাব’—এই চিন্তাই ভাল। য়ুরোপ শ্রমের মর্য্যাদা বোঝে। বাইবেলে আছে—“you shall not eat except by the sweat of your brow” মাথার ঘাম পায় ফেলে যে পরিশ্রম করে ভোগে অধিকার তারই আছে। যে অলস যে পরভাগ্যোপজীবী—তার বেঁচে থাক্বার অর্থ নেই। যে কেউ সৎপথে থেকে আপন পরিশ্রমে আপনি উপার্জ্জন করে সেই আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র—সে ছোটলোক নয়—ভদ্রশ্রেষ্ঠ—এই কথা আমাদের মনে রাখ্তেই হবে।
আমাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে টাকার অভাব তত নয় যত উপযুক্ত মানুষের অভাব। কোনো সভাসমিতিতে ভলাণ্টীয়ারের অভাব হয় না—কিন্তু যথার্থ কষ্টস্বীকার ক’রে যেখানে কাজ কর্তে হয় সেইখানেই আমরা লোকাভাব দেখি। আমাদের উৎসাহ খড়ের আগুনের মত দপ্ ক’রে জ্বলে ওঠে, কিন্তু আবার খপ্ ক’রে নিভে যায়। এরূপ ভাবোচ্ছ্বাস কর্ম্মপঙ্গুত্ব আনয়ন করে। স্বদেশীর সময় গোলদীঘির ধারে অনেক ভাবোচ্ছ্বাস হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসার কার্য্যে শিক্ষানবীশি চাই, অক্লান্ত চেষ্টা চাই—ভাবোচ্ছ্বাস কি ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তি হতে পারে? ভাবপ্রবণ হও, খুব বড় কল্পনা কর, ভাবুকতার বলে গতানুগতিকের গণ্ডী ভেঙে ফেল, নূতন পথে এগিয়ে চল, কিন্তু দেখো পঙ্গু ভাবুক হয়ো না;—ভাবকে কর্ম্মে আকার দাও—কর্ম্মে ভাবের প্রতিষ্ঠা কর। চরিত্রবান্ হও। বাঙালী বড় অলস; সুখ চায়। কিন্তু সুখ খুঁজলেও সুখ কি আর মিল্বে? অলসতা ও সুখপ্রবণতাই ইচ্চে আমাদের জাতীয় দুর্ব্বলতা। এসব ত্যাগ ক’রে আমাদের এখন একনিষ্ঠ সাধনা কর্তে হবে—তবেই এ অস্তিত্ব-সঙ্কট থেকে রক্ষার উপায় হবে। আমাদের এখন আত্মবিশ্বাস চাই। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস চাই, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের উপযুক্ত হওয়া চাই। আমাদের চরিত্রে গলদ কোথায় খুঁজে বার করতে হবে; সঙ্গে সঙ্গে একটি দোষ পরিহার ক’রে তার স্থলে গুণের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের এখন শ্রমশীল হওয়া চাই, অদম্য উৎসাহ চাই, সাহস ও ধৈর্য্য চাই—মোটের উপর খাঁটি ও শক্ত মানুষ হওয়া চাই। নচেৎ ফিন্ফিনে ধুতিপরা, পাঞ্জাবী আস্তিন গায়ে, থল্থলে গোলগাল নাদুসনুদুস নন্দদুলাল—এই ধরণের অকেজো পুতুল নিয়ে এই সঙ্কটকালে আমরা কি কর্ব? কঠিন সমস্যা সকলের মীমাংসা কর্বার ভার আমাদের হাতে— আমাদের কি দুর্ব্বলচিত্ত, চাক্রীপ্রিয়, বিলাসী বাবু হওয়া সাজে? শক্ত হতে হবে, দৃঢ়ব্রত হতে হবে, মেরুদণ্ডবিশিষ্ট মানুষ হতে হবে। অন্নসমস্যার মীমাংসা কর্তে পার্লে সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে। তাই ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়া আজ আমার অন্য কিছু বলবার নেই। এসব কাজে আমাদের স্পৃহা নেই—প্রবৃত্তি নেই। এই প্রবৃত্তি আগে জাগিয়ে তুল্তে হবে, এই স্পৃহা মনে তীব্র হলে নূতন পথে চল্বার সাহস হবে। তাই এত কথা বল্ছি।
ছাত্র যাঁরা তাঁদের বিশেষ ক’রে বল্ছি। প্রতিকারের উপায় তাঁদেরই কর্তে হবে। লেখাপড়া শিখ্তে বারণ করছি না—লেখাপড়া চাই। লেখাপড়ার অভাবে মাড়োয়ারীর টাকা অন্নছত্র বা পিঞ্জরাপোল ছাড়া দেশের অন্য কাজে লাগ্চে না। কিন্তু দেশের অভাব আজ কত বেশী তা কি ব’লে জানাতে হবে? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
“বড় দুঃখ বড় ব্যথা— সম্মুখেতে কষ্টের সংসার—
বড়ই দরিদ্র, শূন্য, বড় ক্ষুদ্র বদ্ধ অন্ধকার!—
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু
সাহসবিস্তৃত বক্ষপট!···········”
আমার সাধের রসায়ন-শাস্ত্রচর্চ্চা ফেলে কেন আমি এসব কথা তোমাদের কাছে বল্তে এসেছি? আমার বিশ্বাস অদূর ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ সকল বিষয়ে প্রাধান্য লাভ কর্বে। যে দেশে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ—প্রভৃতি জন্মগ্রহণ করেছেন, গোখ্লে ও গান্ধীর মত আদর্শ ত্যাগী যে দেশের সন্তান, যে দেশে জগদীশচন্দ্র, রামানুজম্, পরাঞ্জপ্যের প্রতিভায় আজ পাশ্চাত্য জগত মুগ্ধ, সে দেশের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল আমি বিশ্বাস করি। বাঙ্লা দেশে আমরা আমাদের অনেক দোষ ও দুর্ব্বলতা পরিহার ক’রে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থ-নৈতিক ও শিক্ষাসম্বন্ধীয় নানা বিষয়ে নানাপ্রকারের, আলোচনা ও কার্য্য আরম্ভ করেছি—কিন্তু এই অন্নসমস্যাই বাঙালীর আশা, উৎসাহ ও স্বাস্থ্যনাশ ক’রে, সর্ব্বনাশ কর্তে বসেছে। তাই তোমাদের বল্ছি—তোমরা ভাব, বোঝ এবং কাজে লেগে যাও। পৃথিবীতে আমাদের দাঁড়াতে হবে—মানুষের মত উচ্চশির হয়ে দাঁড়াতে হবে।