আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/৬
৬
পাতিত্য সমস্যা[১]
বাঙ্গালী বড় ভাবপ্রবণ। বক্তৃতায় তার গত অর্দ্ধশতাব্দী কেটেছে। এখন কাজে নাব্তে হবে।
আজ আমার মহা আনন্দের দিন! হাওয়া ফিরেছে। নবজাগরণের দিন এসেছে। এই মহাপ্রলয়ে তিনটি সাম্রাজ্য ফুৎকারে উড়ে গেল। সেই সময়ে যে-সব আইডিয়া ব্যক্ত হয়েছে তার ধাক্কা এখানে এসেছে। সেদিন বর্দ্ধমানের মহারাজা একটা পাকা কথা বলেছেন—এখন চারিদিকে বড় অশান্তি দেখা দিয়েছে। তাকে বাধা দিলে চল্বে না। একে বাধা দিলে কি হয় জানি না। এর আঘাত-প্রতিঘাতের কথা আজ আমি বল্তে চাই। প্রথমে মনে পড়ে পতিত জাতিদের সঙ্গে তথাকথিত উচ্চ জাতির লোকদের সম্পর্কের কথা।
আমি খুলনা জেলার লোক। এই খুলনার ৭ লক্ষ হিন্দুর মধ্যে ৪ লক্ষ অস্পৃশ্য! ইহারা কৃষিজীবী। ইহারা ধনধান্যে সমৃদ্ধ। এই ৪ লক্ষ বলীয়ানের সঙ্গে ৩ লক্ষের সংঘর্ষ উপস্থিত হলে ব্যাপার কিরূপ দাঁড়ায় তা প্রণিধানযোগ্য। আমি দ্বেষজনক কোন কথা বল্ব না। যাতে কোন জাতিতে জাতিতে বিরোধ বাধে এখানে তেমন কোন রাগের কথা নেই। এখন ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য প্রভৃতি সকল শ্রেণীর লোকেরই বিসদৃশ অবস্থার দিকে নজর পড়েছে।
আমরা ছেলেবেলা গল্প পড়েছিলাম—উদর ও দেহের অবয়ব সম্বন্ধে হিন্দু সমাজের তেমনি সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। লর্ড ডাফ্রীন্ আমাদেৱ বিদ্রূপ করেছিলেন—এরা মুষ্টিমেয় (microscopic minority)—এরা আন্দোলন করে—এদের কে চেনে? কায়স্থ ব্রাহ্মণ প্রভৃতির সংখ্যা ২৩ লক্ষ। আর তথাকথিত নিম্নশ্রেণী কত? একা নমঃশূদ্র ২৫ লক্ষ; ব্রাত্যক্ষত্রিয় ৫ ১/২ লক্ষ। বাঙ্গালার অধিবাসী ৪ ১/২ কোটী। এই ৪ ১/২ কোটীর মধ্যে কায়স্থ ব্রাহ্মণ শতকরা ৬ ১/২ কি ৭ জন। কিন্তু আমরা অপর সবাইকে বাদ দিয়ে ঘরকন্না কর্তে চাই। এ একটা আত্মঘাতী ব্যাপার। সমাজের যাঁরা বলিষ্ঠ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, যাঁরা শিক্ষা পেলে সমাজের নেতা মুখপাত্র হবেন, তাঁদের না টেনে তুলে তাঁদের বাদ দিয়ে ঘর কর্তে চাই এ ত বাতুলতা; এ ত মহাপাপ। কোন কারণে হয়ত আমাদের অবস্থা ভাল, আমাদের গোলায় ধান আছে। দেশে যদি দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয় তাহলে কি আমরা ঘরের দরজা বন্ধ ক’রে বিলাসিতা কর্ব, আর আমাদের প্রতিবাসীরা মারা যাবে? আমাদের কর্ত্তব্য, যারা পশ্চাৎপদ তাদের সকলকে টেনে তুলি। আমরা দেশকে মা বলি। যাঁরা লম্বা লম্বা বক্তৃতা করেন আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করি তাঁরা যদি বাঙ্গালাকে মা বলেন তবে কি সকলকে ভাই বলে আলিঙ্গন কর্বেন না—মায়ের সন্তানকে পদাঘাত ক’রে দূরে ঠেলে কি তাঁরা অগ্রসর হবেন?—তবে তাঁদের কিসের মা বলা?
ব্যাপার কি—একটা বিড়াল ঘরে ঢুক্লে—হয়ত আস্তাকুড় ঘেঁটে, মরা ইঁদুর চট্কে—দুধ খেলে; আমরা কি তা ফেলে দিই? কিন্তু যদি একজন তথাকথিত ব্রাত্যক্ষত্রিয় বা নমঃশূদ্র ঘরের চৌকাটের উপর আসে, আমরা জল ফেলে দিই। বরফ্ লেমনেড্ খাও না? তা কে তৈরী করে? সম্প্রতি আমার স্বগ্রামের নিকট এক শ্রাদ্ধে উপস্থিত ছিলাম। কলিকাতা থেকে বরফ এসেছে—ভট্টাচার্য্য ব্রাহ্মণের অভ্যর্থনার জন্য। যেই বরফ, সেই ত জল—H2O—অর্থাৎ অম্লজান ও উদজানের যৌগিক। জল খাবে না, বরফ খাবে। কারণ,—ভণ্ডামি, প্রতারণা, ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞা। কেবল দেখান—তুই নীচ জাতি, আমি উচ্চ জাতি। সবাই মায়ের সন্তান—সকলকে কোলে টেনে নিতে হবে। যে পেছনে আছে তাকে তুল্তে হবে। যিনি শিক্ষিত তিনি অশিক্ষিতকে টেনে নেবেন। বিবেকানন্দ বলেছেন—“হিন্দুধর্ম্ম দেশাচারে, লোকাচারে পরিণত। ধর্ম্ম এখন আশ্রয় নিয়েছেন—জলের কলসী ও ভাতের হাঁড়ির ভিতর।”
এই কি হিন্দু ধর্ম্ম? হিন্দুধর্ম্ম সার্ব্বভৌমিক ছিল। জন্মগত গরিমা সর্ব্বনাশের মূল হয়েছে। কুলীন ব্রাহ্মণের বিদ্যাশিক্ষার দর্কার নেই। যিনি কুলীন, তিনি বিয়ে ক’রে ৩৪ হাজার টাকা রোজ্গার করেন। এতে অনেক স্থলে অবনতি হয়েছে। জগতের, ইতিহাস দেখুন! যীশুখৃষ্ট ছুতোর, কবীর জোলা। জগৎ নত মস্তকে তাঁদের ধর্ম্ম গ্রহণ করেছে। মান্দ্রাজেও পারিয়া পীর দেখা যায়। ভারতে এক সময়ে চরিত্র দেখে স্বাধুদের পূজা হত। এখন সম্মান জন্মগত হয়েছে। এ আর বেশী দিন টিক্বে না। এখন হচ্ছে from log cabin to white house, অর্থাৎ পুরুষকার ও গুণের আদরের দিন। লয়েড্ জর্জ্জ “জুতিসেলাই”এর পালিত পুত্র। উইলিয়াম কেরি—যিনি এক হিসাবে বাঙ্গালা গদ্যের সৃষ্টিকর্ত্তা, তিনিও—জুতিসেলাই। এইখানে একটা কথা মনে পড়্ল। একবার লর্ড ওয়েলস্লি অনেক গণ্যমান্য সাহেবকে নিমন্ত্রণ করেন। সে ভোজের সভায় কাউন্সিলের অনেক মেম্বরও উপস্থিত ছিলেন। কেরিকে দেখে একজন পার্শ্বের বন্ধুকে কাণে কাণে বল্লেন—“Hallo, Carey is here. Is he not a shoemaker? ওহে, কেরি এসেছে যে! ও জুতা গড়ে না?” কেরি তা শুন্তে পেয়ে বলে উঠ্লেন—“Beg your pardon, sir, I was not a shoemaker but a cobbler মাপ কর্বেন মশাই, আমি জুতা গড়ি না, ছেঁড়া জুতা মেরামত করি।” ইংলণ্ডে জাতিভেদ আছে বটে, কিন্তু তা অন্য প্রকার। আজ যিনি log cabinএ অর্থাৎ কুঁড়ে ঘরে থাকেন, কাল তিনি দেশনায়ক। আমাদের দেশে অন্যপ্রকার দেখ্তে পাই। মহেন্দ্রলাল সরকার, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, কৃষ্ণদাস পাল—এঁদের মধ্যে একজন সদ্গোপ, একজন তন্তুবায়, একজন তিলি। এঁরা সমাজের গৌরবস্থল। কিন্তু একজন কুলীন ব্রাহ্মণ ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের পুত্রকে কন্যা দিতে রাজি হবেন না। বল্বেন—ও যে তাঁতির ছেলে। এতে সমাজের কত অবনতি, কত লোক্সান হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রকার বাগভট বৌদ্ধ ছিলেন। তিনি বলেছিলেন—“আমার গ্রন্থ হয়ত লোকে উপেক্ষা কর্বে। কারণ আমি চরক বা সুশ্রুতের ন্যায় ঋষি নই। কিন্তু ঔষধের যদি গুণ থাকে তাতে রোগ যাবেই—তা ব্রহ্মাই প্রয়োগ করুন বা আমিই করি।” এই ধরুন বিষ—ব্রাহ্মণ প্রয়োগ করুন বা ব্রাত্যক্ষত্রিয় প্রয়োগ করুন—তার ফল ভিন্ন হবে কি না আমি জিজ্ঞাসা করি। আমি বাড়ী গেলে চাষা-ভূষাদের নিয়ে থাকি। তারা বলে—“বাবু, আপনারা কি জাত জাত করেন? এই মোটা ভেটেলের চাল, আমি রাঁধি আর আপনি রাঁধুন। একসঙ্গে মিশিয়ে দিলে কি বল্তে পারেন কোন্টা কার ভাত? দুইজনের একই রকম ভাত হয়।” অথচ আমরা বড় বড় বই থেকে জাতিভেদের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিই। হোটেলে সবাই একসঙ্গে খান, তাতে কারও বেশী উদর পীড়া হয় বলে জানি না। সবাই রেলগাড়ীতে চড়েন—সেখানে কি সকলে নৈকষ্য কুলীন? মেথর দিব্য বাবু হ’য়ে ট্রামগাড়ীতে যাচ্চে, আপনি তার পাশে বসেন; ষ্টীমারে একদিন, দু’দিন, তিনদিন চলেছেন—তাতেই থাকা, খাওয়া-দাওয়া;—জাত বাঁচে কি ক’রে? তখন জাত্ থাকে কোথায়? ঢাকা অঞ্চলের একজন লোক কলিকাতা থেকে ফিরে গিয়ে বলেছিলেন—উইলসেন, ইষ্টেসেন, আর কেশবসেন, এই তিন সেনে মিলে জাতের সর্ব্বনাশ করেছে। যদি পাকস্থলী কেটে বের ক’রে রাসায়নিক বিশ্লেষণ (chemical analysis) করেন, তবে বুঝা যাবে কার কতটুকু জাতি আছে। তবে কেন আমরা জাত্ জাত্ ক’রে মারা যাই?
আমি এখন যোগী, মাহিষ্য, ব্রাত্যক্ষত্রিয় প্রভৃতি সমাজের মুখপত্রগুলি যতদূর সম্ভব পড়্বার চেষ্টা করি। যেখানে দেখি—সেইখানে আর্ত্তনাদ। তাঁরা প্রকাশ্যে বলেন না কে তাঁদের প্রপীড়িত কর্ছেন, কিন্তু তাঁরা ভাবেন তাঁরা অত্যাচারিত। সেদিন যোগীসখায় লেখা দেখলাম— “আমরাও কালের কুটিলাবর্ত্তে পড়িয়া অধঃপতিত ও লাঞ্ছিত হইয়া আছি।” সকল পত্রিকাতেই এক কথা। কে কর্ছে—তাঁরা কারো নাম করেন না। এ বড় দুঃখের কথা। তাঁরা নিজেরা নিজেদের হীন অধঃপতিত মনেই বা করেন কেন, আর সত্যই কেউ অত্যাচার কর্ছে বুঝে তা সহ্যই বা করেন কৈন? কাল এক জায়গায় পেলাম—লেখক লিখছেন—“তথাকথিত উচ্চজাতির অবস্থা দেখি—তাঁহাদের নিকট যোগী প্রভৃতি জাতি অনাচরণীয়। কিন্তু পশ্চিমা-কুর্ম্মী পরিচয় দিলেই তার জল আচরণীয়।” আমরা কি পশ্চিম দেশে C. I, D. পাঠিয়ে তার জাতের খবর নিই! আবার কলিকাতায় ঝি নামক এক জাতীয় জীবের জলও চলে। যাঁরা ছুৎমার্গ অবলম্বন ক’রে চলেন তাঁরা কলিকাতায় গিয়ে অনেক সময়ে মেসে উঠেন। তাঁরা কি অনুসন্ধান করে দেখেন পাচক ব্রাহ্মণ প্রকৃত পক্ষে কি জাতি? প্রিন্সিপ্যাল গিরিশচন্দ্র বসু একদিন তাঁর ঝির সঙ্গে আলাপ কর্ছিলেন। ঝি বল্লে, “বাবু, লোক দেখলেই ধর্ম্ম গেল—না দেখলে আর কিছু নয়। ছোয়াছুঁয়িটা কেবল লোক দেখাদেখি।” এই ঝি হিন্দুসমাজের প্রচলিত ধর্ম্মের সার বুঝেছে।
আপনাদের আত্মমর্য্যাদা যে দিন দিন জেগে উঠ্ছে এ বড় শুভচিহ্ন। আপনারা যদি বোঝেন—আমরা অধঃপতিত নই, আমরাও বিদ্যাবুদ্ধি বলে উচ্চস্থান পাব তবে উন্নতি নিশ্চয়। রাতদিন অভিযোগ কর্লে উন্নতি হবে না। আপনাদের শক্তি যথেষ্ট। আপনারা নিজের পায়ের উপর দাঁড়ান। আপনারা আজকালকার “উচ্চ” শ্রেণীস্থ মধ্যবিত্তের অবস্থা জানেন—তাদের বাইরে কোঁচার পত্তন, ভিতরে ছুঁচোর কীর্ত্তন। আপনারা কিন্তু কৃষিজীবি, আপনারা সেই “পোদবৃত্তি” করেন। আমার এই খুলনার সন্নিকটস্থ আপনাদের হরিমোহন বাছাড় রাসে ৪০ হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন। সে আজ ৪০ বছরের কথা। আপনাদের মধ্যে অনেকে মোকদ্দমায় হাজার হাজার টাকা ব্যয় করেন। অর্থের অভাব নাই—চেষ্টার অভাব। গ্রামে গ্রামে চাঁদা তুলুন। ক্রিয়া কর্ম্মে কম ব্যয় করুন। যিনি ক্রিয়া কর্ম্মে দশ হাজার টাকা ব্যয় করেন তিনি ২॥০ হাজার ব্যয় ক’রে বাকী ৭॥০ হাজার সমাজের কাজে ব্যয় করুন। চাই শিক্ষা। উন্নতির জন্য কি দরকার? আমি বল্ব—১ম শিক্ষা, ২য় শিক্ষা, ৩য় শিক্ষা। শিক্ষা ভিন্ন পশুত্বে ও মনুষ্যত্বে কোন প্রভেদ নেই। আপনাদের সর্ব্বনাশের কারণ বাড়ী বসে সকলে অন্নসংস্থান করেন। আপনারা শিক্ষালাভ করুন—শিক্ষার দিকে মতি ফেরান—আপনাদের শক্তির প্রতিরোধ কর্তে কেউ পার্বে না। আপনারা যা ভাববেন তাই হবে। Nations by themselves are made, জাতি স্বতঃ গঠিত হয়। বর্দ্ধমান প্রাদেশিক সমিতিতে জষ্টিস্ চৌধুরী বলেছেন—mendicant policy ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করলে চলবে না। আপনারাও mendicant policy ভিক্ষাবৃত্তি পরিত্যাগ করুন। ভিক্ষাবৃত্তিতে কিছু হবে না। মহাশয় অনুগ্রহ ক’রে আমার জল ছোঁন—ও বল্লে চল্বে না। আপনাদের উন্নতি আপনাদের উপর নির্ভর করে। আমি কোন বিরোধের ভাব উপস্থিত কর্তে চাইনে। মান্দ্রাজে পারিয়া ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যে মহা বিবাদ উপস্থিত। বাঙ্গালা দেশে এসব বড় একটা নেই। কর্নেল উপেন্দ্র মুখুজ্জে মশাই জানেন বাঙ্গালাতে প্রায় ৯০০ ম্যাট্রিকিউলেসান বিদ্যালয়। আপনারা যদি হিসাব করে দেখেন গভর্ণমেণ্ট স্কুল প্রায় ৪৭টি হবে। বাকী ৮৫৩টির ভিতর ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্যের চেষ্টাতে হয়েছে এমন স্কুল বাদ দিলে আর কয়টি থাকে? অধিকাংশ স্কুলই প্রধানতঃ তাঁদের চেষ্টাতেই হয়েছে। কিন্তু এমন কোন বিদ্যালয় আছে কি যেখানে তাঁরা তথাকথিত নিম্ন জাতিকে পাশে বসে বিদ্যাশিক্ষা কর্তে বারণ করেন? এই বাগেরহাট কলেজ হয়েছে। তাঁরা কি কোন দিন বলেছেন যে বারুইজাতি কায়স্থ ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কাউকে পড়্তে দেবেন না? এ কথা বলা যায় না যে তাঁরা সব নিজেদেরই সুবিধা করে নিয়েছেন। কেউ দীঘি কেটে বলেন না—এক্লা আমি এই দীঘির জল পান করব। সুতরাং এটাও ভাব্বেন ব্রাহ্মণ কায়স্থ প্রভৃতি স্কুল কলেজ ক’রে সকলের উপকার করেছেন। যদি তাঁরা বলেন আমরা এখানে আর কাউকে পড়্তে দেব না তা হ’লে তাতে ক্ষতি হবে তথাকথিত নিম্নশ্রেণীদের। মোটামুটি আমি বল্তে চাই যে বাঙ্গালা দেশ মান্দ্রাজ অপেক্ষা এইরূপ বিষয়ে অনেকটা উদার।
আমি কোন সমাজভুক্ত নই। আমি হিন্দুর হিন্দুত্ব, মুসলমানের মুসলমানত্ব, ব্রাত্যক্ষত্রিয়ের ব্রাত্যক্ষত্রিয়ত্ব গ্রহণ করি। আমি রাসায়নিক, আমি নিক্তির ওজন ক’রে সকলের ভালমন্দ ওজন ক’রে বিচার কর্তে চাই; আমাদের সামাজিক ব্যাধি দূর কর্তে হলে আগে diagnosis রোগ নির্ণয় কর্তে হবে। সার সৈয়দ আহমদ বলেছিলেন—হিন্দু ও মুসলমান—জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা। যাঁরা জ্যেষ্ঠ তাঁদের উচিত হস্তপ্রসারণ করে টেনে নেওয়া। উচ্চশ্রেণী সুবিধা পেয়েছেন—তাঁদের সুবিধা আছে—তাঁদের উচিত নিম্নকে টেনে আনা ও সুবিধার ও সুযোগের ভুক্তভোগী করা।
আর এক কথা। আপনাদের উন্নতির পথ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। Reform Scheme নূতন রাষ্ট্রব্যবস্থায় আপনারা ভোটদাতা হবেন। অনেকে ভোট নিতে আপনাদের দ্বারে উপস্থিত হবেন। আপনারা তাঁদের প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেবেন তাঁরা আপনাদের জন্য কি কর্বেন। যিনি আপনাদের মঙ্গল করবেন—তাঁকে ভোট দেবেন। তাঁরা আপনাদের শিক্ষা, রাস্তাঘাট, সর্ব্ববিষয়ে উন্নতি কর্বেন, এমন অঙ্গীকার করিয়ে নেবেন। উদ্ধারের পথ আপনাদের নিজেদের হাতে।
আপনারা উন্নতির পথে অগ্রসর হোন। আপনারা কায়স্থ ব্রাহ্মণের সমান শিক্ষিত হোন। আপনাদের বলেই আমরা বলীয়ান। আজ ভাই ভাই ব’লে সকলকে আলিঙ্গন করতে হবে। জয়চাদ থেকে আরম্ভ ক’রে ৮০০ বৎসর কেবল গৃহবিবাদে কেটেছে। আর বিবাদের দিন নেই। ‘সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে।’ কে বড়, কে ছোট ঈশ্বরের রাজ্যে? যে আপনাকে বড় মনে করে সে বড়; যে ছোট মনে করে সে ছোট। এমার্সন বলেছেন—you cannot make a slave of Washington ওয়াশিংটনকে দাস করবার শক্তি তোমার নেই। যাতে শক্তি জাগে তার উপায় করুন। তার উপায় শিক্ষা। আপনারা লক্ষ লক্ষ টাকা তুল্তে পারেন। বরং আমাদের দুর্দ্দশা বেশী। আপনারা শতাংশের একাংশ চেষ্টা কর্লেও অনেক বেশী কাজ করতে পারেন। যাঁরা India as a nation অথবা Bengalee as a nation ভাব্তে চান তাঁরা কাউকে বাদ দিয়ে পারেন না। তাঁরা কি দু’চার জনে জাতি গঠন কর্তে পারেন? যদি নৌকার এক জায়গায় একটু ফুটো থাকে তবে সবটা জলে ডুবে যায়। দুর্য্যোধনের উরুতে যেমন একটু দুর্ব্বলতা ছিল ব’লে তার পরাজয় ঘটেছিল, তেম্নি যতদিন শতকরা ৯৯ জন নিরক্ষর থাক্বে ততদিন আমরা বড় হব না।
বিদেশে আমাদের কি অবস্থা? যদি স্যার দোরাব তাতাও Capeএ যান তাঁকে কুলী বল্বে। ভারতবাসী হলেই কুলী নামে অভিহিত। তাকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেয় না, ট্রামে রেলে তার আলাদা বন্দোবস্ত। জগতের দরবারে এই ত আমাদের মান। কিন্তু আফিসে সাহেবের তাড়া খেয়ে যেমন বাড়ীতে এসে নিরীহ সহধর্ম্মিণীর উপর আমাদের চোট্টা বেশী পড়ে, এখানেও আমাদের সেই ভাবটা বেশী। League of Nations হয়েছে। সেখানে লর্ড সিংহকে ভারতের পক্ষ থেকে ভোট দিতে খাড়া করবার কথা হয়। তাতে একজন American Senator, কি বলেছেন শুনুন—
I can give you a picture of India in a word. She has a population of 291,301,056..... Such a people mark and brand themselves at once as not only unfit for the Government of others, but as almost unfit for their own Government; yet I would not deny that right to the lowest of God’s creatures if he lived off with others like himself and wanted a Government of his own.
Amongst those 294,000,000 people there is no excess of superstition to which they have not gone; there is no shadow of intellectual right so black that they have not wrapped their souls in its sable folds; there is no species of caste by which men have sought to divide themselves and keep oppressed by power and priest-craft their fellowmen that has not been rife in India for centuries of time.
এই ত আমাদের মান! এই মানে মানী হয়ে আমরা বলি জল নষ্ট করিস্নে। এখন আর পৃথক থাক্লে চল্বে না। আমি intermarriage সার্ব্বজাতিক বিবাহের কথা বল্ছি না। আপনারা একটু এগুন, তাঁরাও আপনাদের দিকে একটু আসুন। কিন্তু আমি বলি যাঁরা কুলীন তাঁদেরই আগে এগুতে হবে। আপনারা জাত্ জাত্ কর্ছেন। আমার ওসব আসে না। এখানে চেহারা দেখে কে বড় কে ছোট তা ঠিক কর্তে পারেন?
আপনারা অবনত বল্লে কে? ও যেন ঠাকুর ঘরে কে—না আমি ত কলা খাইনি। আপনারা ব্রাহ্মণ কায়স্থ অপেক্ষা কোন অংশে ছোট নন। আপনারা বড় বড় পদ লাভ করুন—কাউন্সিলে নিজেদের মধ্য থেকে মেম্বর পাঠান। আপনারা অনেকেই লক্ষ্মীমন্ত। আমি করজোড়ে প্রার্থনা করি আপনারা প্রতিজ্ঞা করুন শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রাণপণ কর্বেন। আপনাদের আয়ের অন্ততঃ একদশমাংশ স্বজাতির শিক্ষার জন্য ব্যয় করুন। যেমন কালীপূজার বারোয়ারির জন্য এক পয়সা ক’রে বৃত্তি রাখা হয়, তেমনি ক’রে আপনারা যে ধান পান তার যদি দশমাংশ এমন কি শতাংশও আপনাদের উন্নতির জন্য রেখে দেন, আপনাদের উন্নতি আট্কে রাখে কে? আপনারা নিজেরাই নিজেদের উন্নতি আট্কে রেখেছেন। শিক্ষার বিস্তার করুন। উন্নতি ধ্রুব নিশ্চয়।
আমি আজ বুঝ্তে পারলাম—জাতীয় জাগরণের প্রকৃত স্ফুরণ হয়েছে। প্রকৃত জাতীয় জাগরণের স্পন্দন দেশের সর্ব্বত্র পৌঁচেছে।
কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, বৈদ্য—হিন্দু মুসলমান সকল শ্রেণীর সকলস্তরের সহৃদয় লোক বহু প্রকারে জ্ঞাপন করছেন যে সকলেরই আপনাদের সঙ্গে আন্তরিক সহানুভূতি আছে ও তাঁরা আপনাদের উন্নতি কামনা করেন। এখন যদি আপনারা পুরুষকারের দ্বারা বিদ্যা যশ মান লাভ ক’রে প্রকৃত মনুষ্যত্ব প্রকাশ করতে পারেন তবেই সব আয়োজন ও চেষ্টা সার্থক হবে।
- ↑ ২১শে মার্চ্চ, খুলনা পৌণ্ড্রক-ক্ষত্রিয় সামাজিক সভার সভাপতির অভিভাষণ