আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ ও বক্তৃতাবলী/১৩

১৩

পাঠাগার ও প্রকৃত শিক্ষা[]

 এমার্সন বলেন “গোলাপ বাগান কার?—আমার; আমার দেখে সুখ, চোখের তৃপ্তি, হৃদয়ের আনন্দ! বাগানের মালিক বেড়া বাঁধান, মালি রাখেন, জল সেচন করেন; সে অনেক কাণ্ড। কিন্তু অমন শোভা কাহারও একার নয়।” কারণ গোলাপের সার্থকতা ফুটে, সৌন্দর্য্যের বিকাশ ক’রে। আর সে সৌন্দর্য্য দর্শক মাত্রেই উপভোগ করতে পারেন। কথাটি পাঠাগার সম্বন্ধেও সত্য। পাঠাগারের যাঁরা উদ্যোগী তাঁরা পয়সার যোগাড় করবেন, জমি কিনবেন, ঘর তুলবেন; তারপর উৎকৃষ্ট পুস্তকরাশি সংগ্রহ ক’রে জনসাধারণের হাতের কাছে এনে দেবেন। সে পুস্তকের অধিকার কারো একার নয়। পাঠক মাত্রেই তার সৌন্দর্য্য রস উপভোগ কর্‌তে পার্‌বেন। এই গ্রন্থশালা জ্ঞানলিপ্সুদের বড় আদরের জিনিষ।

 জ্ঞানের অনুশীলন আমি ক’রে থাকি। আমি আজীবন ছাত্রভাবে আছি। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন কখন চ’লে গেছে বুঝ্‌তে পারি নি। আজ বার্দ্ধক্যে পা দিয়ে আমি সেই ছাত্রই আছি। আমি দিনের মধ্যে দু ঘণ্টা নিভৃতে ভাল পুস্তককে সঙ্গী ক’রে কাটিয়ে দি,—দিন সার্থক হয়। জগতে যা কিছু সৎচিন্তা, উৎকৃষ্ট ভাব আছে, যা কিছু উদ্দীপনা সৃষ্টি করে এবং মানুষের হৃদয়ে প্রেরণা দেয়, তার সবই পুস্তকে নিহিত। উপনিষদ্ ও ষড়্‌দর্শনের তত্ত্ব, গ্রীসদেশের সক্রেটীস্, প্লেটো ও আরিষ্টটল্ প্রভৃতি মহানুভবগণের চিন্তারাশি, এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে যে মনীষীগণ জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের বাণী,—সকলই পুস্তকের মধ্যে। তাঁরা যা দিয়ে গেছেন তা অমূল্য সামগ্রী। আমরা সকলেই উত্তরাধিকারসূত্রে তার অধিকারী। যিনি ধনী তিনি স্ত্রীপরিবারকে সুখে রাখেন, তাঁর ব্যক্তিগত রোজগার ছেলে, নাতি, বড়জোর আত্মীয়স্বজনে খায়। তিনি গহনা গড়ান, কোম্পানীর কাগজ করেন, জমীদারী কেনেন, আর পাটা কবুলত লেখেন। তাঁর জিনিষ ঘরের বাইরে যায় না। কিন্তু ভাব ও চিন্তাজগতের কথা স্বতন্ত্র। প্রতিভাশালী ব্যক্তি ভাব-সমুদ্র মন্থন ক’রে যে রত্ন আহরণ করেন তা’তে সকলের সমান অধিকার। ইংলণ্ড, আমেরিকা, জার্ম্মানী প্রভৃতি দেশের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি সকলের সাধারণ সম্পত্তি। তাই গ্রন্থকার ও বৈজ্ঞানিকগণ মহামান্য, জগতকে তাঁরা মহাঋণপাশে আবদ্ধ করে রেখে যান।

 এদেশে লাইব্রেরীর উন্মেষমাত্র হচ্ছে! আমাদের মুস্কিল এই যে পাঠ্যপুস্তক ছাড়া আর কিছু বড় কেউ পড়তে চায় না। তাই বলি, আমাদের কপাল পুড়ে গেছে। ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্ত্তনের সূচনা থেকে ছাত্রগণের একমাত্র চিন্তা হ’য়ে উঠেছে—কি ক’রে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উপাধি নেব। তারপর উকীল, ডাক্তার, মাষ্টার, কেরানী,— এ ছাড়িয়ে যাবার আর যোগ্যতা নেই; কেবল দাসত্ব আর গতানুগতিকে গা ঢালা। স্বাধীন জীবিকা ব’লে যে একটা কথা আছে শিক্ষিতদের সে ধারণা নেই। পোষ্ট আফিসের ছাপের মত তাঁরা ইউনিভার্‌সিটির ছাপটাকেই সার বুঝেচেন। যা হোক এখন সুবাতাস বয়েছে, সময় এসেছে। তাই ধীরে ধীরে পাঠাগারের আদর বাড়্‌ছে।

 আমেরিকায় প্রায় ৪৮টা ষ্টেট্ আছে। প্রত্যেক ষ্টেটে একটী বা কোনটিতে দুটি ক’রে বিশ্ববিদ্যালয়, তা ছাড়া আবার প্রাইভেট্‌ ইউনিভার্‌সিটিও আছে। জাপানেও তাই,—শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক। জ্ঞানের মহিমা হৃদয়ঙ্গম কর্‌তে পেরেছে ব’লেই তারা নিজের দেশে দরিদ্র জনসাধারণের হিতার্থে জ্ঞানের পথ উন্মুক্ত ক’রে দিচ্ছে। বাতাস, জল যেমন বিনা মাশুলে মেলে, ঐ সব দেশে তেম্‌নি সৎপুস্তকরাশিও দরিদ্রের অনায়াসলভ্য সম্পত্তি হচ্ছে। সকলেই তা বিনা মাশুলে পাচ্ছে, তার জন্যে ব্যয় কর্‌তে হচ্ছে না। সেখানে ধনীরা বলেন—দরিদ্রের গৃহে শিক্ষার পথ পরিষ্কারের সূচনামাত্র এখানে হয়েছে; লাইব্রেরী এই সূচনার প্রধান লক্ষণ। ঐ সব দেশে জ্ঞান পিপাসা অত্যন্ত বলবতী। কিন্তু আমাদের জ্ঞানপিপাসা এখনও হয় নি। পরীক্ষা পাশই আমাদের বরাবর সন্ধান ছিল। তাই দেখ্‌তে পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস (First class) এম-এ পাশ ক’রেও কেউ রিসার্চের (Research) দিকে ঘেঁসে না। কারণ তা’তে বিপুল উদ্যম ও ধৈর্য্য চাই, দিনের পর দিন একটানা খাটুনি চাই। কিন্তু সে উৎসাহ কোথায়? তাই বলি প্রায় কোনো গভীর চিন্তাপ্রসূত ফল হয় নি এই লেখা পড়ায়; এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষায়, পৃথিবীর সামনে দাখিল করা যায় এমন কিছু অল্পই আছে।

 আপনারা কার্ণেগীর নাম শুনেচেন। তিনি স্কট্‌লণ্ডের লোক। ছেলেবেলায় খবরের কাগজ বিলি কর্‌তেন। তারপর নিজের উদ্যমের বলে আমেরিকায় পিট্সবার্গে পৃথিবীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ লোহার কারখানার মালিক হয়েছিলেন। ৯০ কোটি টাকা দিয়ে একজন নয়—একদল লোক মিলে তাঁর কারখানা কিন্‌লে। তিনি টাকা নিয়ে স্কট্‌লণ্ডে ফিরে এলেন। তাঁর আয় বছরে ৪ কোটি টাকা হবে, অর্থাৎ সমগ্র বাংলা দেশ থেকে গবর্নমেণ্ট ভূমির রাজস্ব হিসাবে যত টাকা পান প্রায় তাই। দেশে ফিরে এসে তিনি গ্ল্যাস্‌গো, ডণ্ডী প্রভৃতি বড় বড় সহরে Workingmen’s Institute অর্থাৎ শ্রমজীবীদের জন্যে বড় বড় বিদ্যামন্দির ও গ্রন্থশালা খুলে দিলেন। সমস্ত দিন কলকারখানায় খেটে সন্ধ্যার পর তারা এইসব পাঠাগারে নানারকমের বই, খবরের কাগজ প্রভৃতি পাঠ করে। সেখানে তারা চা, কাফি খায়,—মদ নয়; ইংলণ্ড ও আমেরিকায় মদের বিষময় ফল ফলে। শ্রমজীবীদের পাঠাগারের জন্যে কার্ণেগী অনেক বড় সহরে সাড়ে সাত লক্ষ ক’রে টাকা দিয়েছেন। ইংলণ্ড, আমেরিকা, জাপান প্রভৃতি দেশে এ রকম পাঠাগার স্থাপিত হ’তে আরম্ভ হয়েছে। সে সব দেশে মুটে, মজুর, গাড়োয়ান কাগজ পড়্‌ছে, রাজনীতি আলোচনা ক’র্‌ছে। যারা মাটীর নীচে খনিতে কাজ করে তারাও কাগজ পড়ে। চাকরাণী, মেথরাণীও দেশের খবর রাখে। জাপানেও তাই। রবিবাবু বল্লেন—জাপানে তাঁর বাসার দাসী তাঁর গীতাঞ্জলির খবর রাখে। দেখুন এই সব জায়গায় জ্ঞানস্পৃহা কত বলবতী। আর আমাদের দেশের দিকে চেয়ে দেখুন। যে বই কেনে সে পড়ে না, আর যার পড়বার ইচ্ছে আছে তার কেন্‌বার পয়সা জোটে না। তারপর বই চেয়ে নিয়ে গিয়ে ফেরত দেয় না—ওজর দেখায় অমুক নিয়ে গেছে। এই রকমে দিন কতক কাটিয়ে দিয়ে শেষ বইখানার অস্তিত্ব বিলোপ ক’রে দেয়। এই রকম জঘন্য আচরণে লাইব্রেরী উজাড় হ’য়ে গেছে শুনেছি।

 বাঙ্গালী গয়না গড়াবে, চাঁদনীতে নানা ফ্যাসানের কাপড় কিন্‌বে, নানা রকম বিলাসে পয়সা নষ্ট করবে, কিন্তু পুস্তকে নয়! মান্দ্রাজে দেশীয় লোকের খুব বড় পুস্তকের দোকান আছে। উদাহরণ স্বরূপ— গণেশ কোম্পানী ও নটেশন্ কোম্পানীর নাম করা যেতে পারে। নটেশন্ মোটর চড়েন। প্রথম দেখে মনে হয়েছিল বইএর দোকান ক’রে মোটর হাঁকাচ্ছেন অর্থাৎ পৈতৃক সম্পত্তির অপচয় কর্‌ছেন। কিন্তু তা ত নয়—এর পিছনে মান্দ্রাজীদের জ্ঞানের আদর ও পাঠের তৃষ্ণা বর্ত্তমান। তাই তিনি নিজের রোজগারেই মোটর কিনেছেন। আমাদের বাঙ্গলাদেশে Text book ছাত্রপাঠ্য বই না ছাপালে দোকান উঠে যায়; কিন্তু নটেশন্ Text book বা ছাত্রপাঠ্য বই ছাপান না। তাঁরা বাংলা তথা ভারতবর্ষের চিন্তাশীল পণ্ডিতগণের বক্তৃতা ছাপান,; রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, মনস্বীগণের সংক্ষিপ্ত জীবনী, প্রভৃতি নানাপ্রকারের পুস্তক প্রকাশিত করেন। এই কাজে ব্যবসায়ী যে শুধু লাভবান হন, তা নয়, সৎপুস্তক প্রকাশ ক’রে দেশের একটা অভাবও দূর করেন। তাই বলতে হয় সেখানে জ্ঞানতৃষ্ণা বেশী। কলিকাতার বড় পুস্তকবিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা ক’রে জানা যায় “People’s Library ” প্রভৃতি সংস্করণের অল্প মূল্যের বই মান্দ্রাজীরা বেশী কেনেন, বাঙ্গালী বড় একটা কেনেন না। বাংলাদেশে “টেক্‌ষ্ট বুক কমিটি”র—অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তক না হ’লে আর বই উদ্ধারের উপায় নেই। এখানে রসায়ন-সম্বন্ধে ক্ষুদ্র পুস্তকের আদর হয় না। কারণ তার জন্যে “ল্যাবোরেটরী” চাই। কিন্তু ছেলেদের চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেলে জীব জন্তু সম্বন্ধে কৌতূহল হ’তে পারে এই ভেবে একখানা ছোট “প্রাণীবিজ্ঞান” লিখেছিলাম। কিন্তু বইখানা কয়েক বৎসর পড়ে রইলো, কাট্‌তি হ’লো না। কিছুকাল পরে জানি না কেন, সেখানা টেক্‌ষ্ট বুক কমিটি’র (Text Book Commitee) অনুমোদিত হ’য়ে গেল। একজন ইন্স্‌পেক্‌টার পূর্ব্ব বাংলার একটা অঞ্চলের জন্য সেখানা পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্দ্দিষ্ট ক’রে দিলেন; ব্যস্, এক নিশ্বাসে সব বই বিক্রী হয়ে গেল।

 বিজ্ঞান কলেজের জন্য স্যর্ তারকনাথ ও স্যর্ রাসবিহারী পঁচিশ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। দুটি ল্যাবোরেটরীর প্রত্যেকটিতে ২০ জন ছাত্রের জন্য বছরে ৫০ হাজার টাকা খরচ করা হয়, অর্থাৎ মাথাপিছু ২৫০০ টাকার উপর ব্যয় হচ্ছে। তবু কি ব্যাপার! প্রকৃত জ্ঞানান্বেষী কজন পাই? অনেক সময় কাঁদ্‌তে হয়। এখন ক্রমশঃ হাওয়া ফির্‌ছে। তবে কোকিল একবার ডাক্‌লেই যে বসন্ত সমাগত হয় এমন ভাব্‌লে চলে না। সে বসন্তের অগ্রদূত মাত্র। লণ্ডন, প্যারী প্রভৃতি স্থানের Chemical Journals অর্থাৎ রসায়ন সম্বন্ধীয় সাময়িক পত্রিকায় প্রত্যেক বারে বর্ণমালা অনুসারে হাজার দু-হাজার রাসায়নিকের নাম থাকে। তার অন্ততঃ ৫০০ জন রসায়ন সম্বন্ধে মৌলিক গবেষণা করেন। জার্ম্মানীতে ৫০০০, ইংলণ্ড আমেরিকায় কয়েক হাজার, এবং সমস্ত য়ুরোপে অন্ততঃ ১০,০০০ রাসায়নিক প্রতিদিন মৌলিক গবেষণা করেন। আর আমরা? এই কবির কথায় বিংশতি কোটী—এখন ত্রিশকোটি মানুষ, আমরা কি কর্‌ছি? আমাদের গর্ব্বের কিছু নেই। আমায় সভাপতি হবার জন্য টানাটানি করেন্; আজ সমাজ সংস্কারের আলোচনা, কাল পাটেল বিল; কিন্তু এক মুর্গী কবার জবাই হয়? অন্ততঃ ত্রিশ কোটির মধ্যে ত্রিশ জন (chemist) রাসায়নিক হোক, তবে ত নিষ্কৃতি; নইলে বিশ্রাম কোথায়? শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় লণ্ডনে পাঠাগারের প্রচলন দেখে অবাক হয়েছিলেন—

 “আমি গিয়া দেখিলাম শিক্ষিত দেশহিতৈষী ব্যক্তিদিগের মনে নিম্নশ্রেণীর মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের উৎসাহ অতিশয় প্রবল। তাহার ফলস্বপ ঐ শ্রেণীর মানুষের মনে জ্ঞানস্পৃহা দিন দিন বাড়িতেছে এবং ব্যবহারের জন্য চারিদিকে অসংখ্য ছোট ছোট পুস্তকালয় স্থাপিত হইয়াছে। প্রায় প্রত্যেক রাজপথে দুই-দশখানি বাড়ীর পরেই একটি ক্ষুদ্র পুস্তকালয়; নিম্নশ্রেণীর মানুষেরা সেখানে নামমাত্র কিছু পয়সা জমা দিয়া সপ্তাহে সপ্তাহে বই লইয়া যাইতেছে ও ঘরে গিয়া বসিয়া পড়িয়া—সে পুস্তক আবার ফিরাইয়া দিতেছে। ইহার অনেক পুস্তকালয় দোকানঘরের মধ্যে। দোকানদার অপরাপর জিনিসের ব্যবসা করিতেছে, সেই সঙ্গে একপাশে একটি পুস্তকালয় রাখিয়া কিছু উপার্জ্জন করিতেছে। ইহা ভিন্ন স্বল্পমূল্যে বিক্রেয় ব্যবহৃত পুস্তকের দোকান অগণ্য। এইরূপ একটি পুস্তকালয়বিশিষ্ট দোকানে গিয়া একদিন যাহা দেখিলাম ও শুনিলাম তাহা মনে রহিয়াছে। আমি দোকানে অন্য কাজে গিয়া দেখি, একপার্শ্বে দুইটি আল্‌মারিতে কতকগুলি পুস্তক রহিয়াছে। মনে করিলাম পুস্তকগুলি স্বল্পমূল্যের ব্যবহৃত পুস্তক। জিজ্ঞাসা করিলাম—এ-সব পুস্তক কি বিক্রয়ের জন্য?

 উত্তর—না, একটা সার্কুলেটিং লাইব্রেরী।

 আমি—এ সব পুস্তক কারা লয়?

 উত্তর—এই পাড়ার নিম্নশ্রেণীর লোকেরা।

 আমি—আমি কি বই লইতে পারি?

 উত্তর—হাঁ পারেন, এ ত সাধারণের জন্য।

 তারপর আমি একখানি ৬।৭ টাকা দামের বই লইয়া দুই আনা পয়সা জমা দিয়া ও আমার নাম ও বাড়ীর ঠিকানা রাখিয়া আসিলাম। আবার সপ্তাহান্তে বই ফেরৎ দিয়া আবার দুই আনা দিয়া আর একখানি বই লইয়া আসিলাম। এইরূপ তিন চারি সপ্তাহের পর একদিন গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, এ ব্যবসা তোমরা কতদিন চালাইতেছ?

 উত্তর—গত ৮।৯ বৎসর।

 আমি—মধ্যে মধ্যে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হও না?

 উত্তর—কিরূপে?

 আমি—লণ্ডনের মত বড় সহরে মানুষ এক পাড়া হইতে আর এক পাড়ায় উঠিয়া গেলে খুঁজিয়া পাওয়া ভার। মনে কর যদি বই ফিরাইয়া না দিয়া এ পাড়া হইতে উঠিয়া যায়, তাহা হইলে বই কি করিয়া পাইবে?

 এই প্রশ্নে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া তাহারা বলিল, “তা কি করিয়া হইতে পারে? এ যে আমাদের বই? উঠিয়া যাইবার সময় ফিরাইয়া দিতেই হইবে।”

 আমি—মনে কর যদি না দেয়!

 তাহারা হাসিয়া কহিল, “সে হতেই পারে না”। বই না দিয়া যে কেহ চলিয়া যাইতে পারে—ইহা যেন তাহাদের ধারণাই হয় না।

 আপনারা হাজারখানা বই নিয়ে লাইব্রেরী করুন, মাসিক চাঁদা দু আনা। দেখ্‌বেন মাসে মাসে অনেক বই ফাঁক হ’য়ে যাবে।

 জগতে দেখা যায় যাঁরা বিদ্যাভ্যাস প্রকৃত করেছেন তাঁরা অনেকেই Self-taught অর্থাৎ নিজের চেষ্টায় শিখেছেন। ডাক্তার জন্‌সনের মত বিদ্বান বিরল। তাঁর অবস্থা ভাল ছিল না, কিন্তু তাঁর পিতার পুস্তকের দোকান ছিল। তিনি পাঠাগার থেকে কোনো বই নিতেন আর একটি উচ্চস্থানে ব’সে একমনে পড়্‌তেন। এইরূপ চেষ্টায় তিনি অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জ্জন করেছিলেন। নব্য বাংলার অভ্যুদয়ের প্রধান উৎস রাজা রামমোহন রায়, রংপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট ডিগ্‌বি সাহেবের কাছে-ইংরেজী পড়্‌তে আরম্ভ করেন, আর্‌বী পার্শী শিক্ষার অনেক পরে। কিন্তু অল্প দিনে এমন ব্যুৎপত্তি লাভ করেন যে ইংরেজী নবীশরা অবাক্। দেশে কাশী, নবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে অনেক টোল ছিল। তাই সংস্কৃত কলেজ-প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি ক’রে তিনি একখানা চিঠি লেখেন। বিশপ হিবার সেই চিঠি তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল্ লর্ড আমহার্ষ্ট্‌কে দেন। সে চিঠির ইংরেজী রচনা এত উৎকৃষ্ট হয়েছিল যে তাঁর মৃত্যুর পর সেটি প্রকাশিত হয়,—এশিয়াবাসীর লিখিত ব’লে তার উল্লেখ করে বিশপ্ হিবার বলেছিলেন “Real curiosity অর্থাৎ বিস্ময়ের বস্তু।” তাই বলি যাঁরা প্রতিভাশালী তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধার ধারেন না—নিজের শিক্ষার ভার তাঁরা নিজের উপরেই রাখেন। যদি বল Dr. Ray, D.Sc. তবে বুঝ্‌তে হয় এই যে তাঁর ১৮৮৫ বা ৮৭ সালের ডিগ্রীর কথা হচ্ছে। তার পর ৩৫ বৎসর ধ’রে তিনি রসায়ন বা অন্য কোনো শাস্ত্র সম্বন্ধে যে গবেষণা করলেন, D. Sc., বল্‌লে সেটাত স্বীকার করা হয় না। সুতরাং ডিগ্রীটা কিছু নয়,—ওটা অনেক সময় অজ্ঞতার আবরণ মাত্র। অনেকে অমুক সালে দর্শন শাস্ত্রে পরীক্ষা দিয়ে সুবর্ণ পদক পেয়েছি ব’লে গর্ব করেন; এদিকে হয়ত পরীক্ষার পর পড়া ছেড়েছেন ব’লে হ্যামিল্টন ও রীডের মত ছাড়া নূতন দার্শনিক তত্ত্বের খোঁজ রাখেন না। অনেক ডাক্তার বাবু ১৮৭২ সালের অর্জ্জিত জ্ঞান অনুসারে রোগীর প্রেস্কিপ্‌সন্ লেখেন। সে কালের মতের খণ্ডন হয়ে কত নূতন মত প্রচলিত হয়েছে তার খবরই রাখেন না। আলোচনা না কর্‌লে অজ্ঞতা এইরূপই দাঁড়ায়। কিন্তু ইংলণ্ড, আমেরিকায় লোক এত ডিগ্রী চায় না। তারা চায় প্রকৃত শিক্ষা।

 আমাদের দেশে একে ত লাইব্রেরীর অভাব, তারপর লাইব্রেরী যেখানে আছে সেখানে পাঠকের অভাব। সাময়িক পত্রে এখন, চুট্‌কী গল্পই বেশী। এতে পাঠকের রুচি বিকৃত হ’য়ে যায়। তাঁরা আর কঠিন ভাবপূর্ণ বিষয় পড়তে পারেন না, ঐ চানাচুর, সাড়ে আঠার ভাজাতেই মস্‌গুল্ হ’য়ে থাকেন। কিন্তু চাই ভাল জিনিষ। উৎকৃষ্ট বিষয়ের অনুশীলন কর্‌তে লোকের যাতে প্রবৃত্তি ও রুচি জন্মে—তারই বন্দোবস্ত কর্‌বার জন্যে আমাদের সচেষ্ট থাক্‌তে হবে। লাইব্রেরীর যাঁরা প্রতিষ্ঠাতা, এই কার্য্যের ভার তাঁদেরই উপর বিশেষ ভাবে ন্যস্ত রয়েছে। আমার ধারণা পাঠাগারে নভেল যত কম থাকে ততই ভাল। উপন্যাস পাঠের সার্থকতা আছে, এ কথা আমি কখনও অস্বীকার করি না। স্কট, ডিকেন্স, অথবা বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরচ্চন্দ্র প্রভৃতি প্রতিভাশালী লেখকগণের উপন্যাসে অনেক বিচিত্র চরিত্র চিত্রিত হয়েছে। কিন্তু বাঙ্গালী পাঠকসাধারণের মধ্যে ভাবুকতা ও রসগ্রাহিতার অত্যন্ত অভাব। তাঁরা উপন্যাস পাঠে গল্পাংশের অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ কর্‌তে পারেন না। আর সেই কারণেই গভীর ভাবাত্মক কোন বিষয় তাঁদের ভাল লাগে না। লাইব্রেরীতে নানা বিষয়ক উৎকৃষ্ট পুস্তক থাকা চাই; যেমন মহাপুরুষগণের জীবনী, ভ্রমণকাহিনী, ভূগোল, ইতিহাস, ভাবুক লেখকগণের সমাজ, শিক্ষা নীতি সম্বন্ধীয় প্রবন্ধাবলী, কাব্যগ্রন্থ এবং অন্যান্য আবশ্যকীয় পুস্তক। আর থাকা চাই সারগর্ভ প্রবন্ধে পূর্ণ সাময়িক। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে আজকালকার সাময়িক পত্রিকাগুলি নিতান্ত মামুলি ধরণের হ’য়ে দাঁড়িয়েছে। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের “বিবিধার্থ সংগ্রহ” বা অক্ষয়কুমারের “তত্ত্ববোধিনী” অথবা বঙ্কিমের “বঙ্গদর্শনের” মত সাময়িক পত্রিকা আর ত দেখি না। নূতনের মধ্যে এই মাসের “প্রবাসী”তে “মেঘদূতের পক্ষিতত্ত্ব” নামক উপাদেয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইংরেজী সাময়িক পত্রিকা থেকে লোকে Aeroplane বা উড়োজাহাজের ও Arctic exploration বা মেরু সন্ধানের খবরও পায় আর দুঃখ এই, আমাদের বিদ্যালয়েও কেউ ভাল ক’রে এর খোঁজ নেয় না।

 “ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ,” কথাটা আমি প্রায়ই ব’লে থাকি। আমার দাঁত পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে কথাটা আমি বুঝতে পারি শুধু খাবার সময়, উৎসাহের সময় কখনও নয়। যুবকেরা আমার সঙ্গে কাজে পাল্লা দিতে পারে না। আমি ৯টা থেকে ৪টা পর্য্যন্ত ল্যাবোরেটারীতে খাটি। আমি তাদের সমকক্ষ, জুড়িদার। কিন্তু মুস্কিল ত এইখানে। যাঁরা অন্বেষণের জন্য ১০০ টাকা বৃত্তি পাচ্ছেন—এদেশে এক-শ’ অর্থাৎ ইংলণ্ডে পাঁচ-শ’—প্রথম বয়সে নবীন উৎসাহে তাঁদের ত আরও বেশী পরিশ্রম করা উচিত। আর যে ছাত্রদের প্রত্যেকের জন্যে সায়ান্স কলেজে বার্ষিক দুহাজার বেশী ব্যয় করা হয় তাঁরাই বা কি করেন? বিশেষ ভাবে বিজ্ঞান অনুশীলন কর্‌বার উৎসাহ ও যোগ্যতা অনেকের মধ্যে ত দেখ্‌তে পাই না; দু-একটির মধ্যে কদাচিৎ পাওয়া যায়।

 কিন্তু যারা বিশেষ অনুশীলনে ব্যস্ত অর্থাৎ যাঁরা বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন তাঁদের দেখে, সময় সময় আমার ভয় হয়। ঘোড়া যেমন চলে তাঁরা নিজের বুদ্ধিটাকে ঠিক তেমনি একরোকে চালান, দুনিয়ায় আর কোন দিকে চেয়ে দেখেন না। চর্ম্মকারের কাছে যেমন Nothing like leather অর্থাৎ দুনিয়ায় চাম্‌ড়াই সার বস্তু, ময়রার কাছে যেমন ঘি আর চিনি, বিশেষজ্ঞের নিকট তেম্‌নি তার Special subject, বিশেষ বিষয়টি Vibration of the Violin string বেহালার তারের অনুসরণ বা অন্য কিছু। (সভায় সায়ান্স কলেজের অন্যতম অধ্যাপক মিঃ রমণ উপস্থিত ছিলেন।) আমার এক ছাত্র আছেন; তাঁর খ্যাতি য়ুরোপে পৌঁছেচে। তিনি একজন এই রকম বিশেষজ্ঞ, একজন D. Sc.। একদিন ছাত্র পরিবেষ্টিত হ’য়ে ব’সে তাঁকে বল্লাম, “আমার ত বয়স হ’ল। B. C. P. W. অর্থাৎ বেঙ্গল কেমিক্যাল আমার মেয়ে আর ছাত্রেরা আমার ছেলে। এখন বুড়া বয়সে দেখ্‌চি আমার King Lear রাজা লীয়ারের দশা হবে। কেউ কর্ডেলিয়া হবেন, কেউ গনেরিল আবার কেউ বা রেগান।” ছাত্র ত শুনে অবাক্—বল্লেন, “তারা কে?—” দুনিয়ার সব রসে বঞ্চিত হয়ে এ রকম রসায়নরসিক হওয়া ত বড় মুস্কিল। আর বিশ্ববিদ্যালয় এর জন্যে বড় কম দায়ী নয়। কুক্ষণে ম্যাট্রিকুলেশনের পাঠ্যতালিকা থেকে ভূগোল নির্ব্বাসিত হয়েছে। পরীক্ষায় কাজে লাগ্‌বে না, সুতরাং আমাদের দুলালরা আর ভূগোল পড়্‌বেন না, কে যেন মাথার দিব্যি দিয়েছে। ম্যাপ (Map) টাঙ্গান রয়েছে; পাশ করা ছেলেকে জিজ্ঞাসা কর্‌লাম “বার্লিন কোথায়?” সে ইংলণ্ডের দিকে চেয়ে রইলো। আমার একজন সহাধ্যাপক, তিনি M. Scতে Figure of the Earth অর্থাৎ পৃথিবীর আকৃতি বিষয়ে গণিতশাস্ত্রমূলক বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজন ভূগোলে সম্পূর্ণ অজ্ঞ—তারা পৃথিবীর আকার নির্দ্ধারণ কর্‌তে এসেছে, কিন্তু ভূতলের উপরে কি কি প্রসিদ্ধ দেশ, নগর বা সমুদ্র আছে সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণাই নেই। তারপর কন্‌স্‌টাণ্টিনোপল্ দেখাতে বলায় ম্যাপের উপর অন্ধের মত হাতড়াতে লাগ্‌লো। ইংলণ্ডে কিন্তু এমন হয় না। সেখানে ছেলেরা ভূগোল, প্রাকৃতিক ভূগোল আগে শেখে; পর্ব্বত, হ্রদ, নদী, নগর, দেশের উৎপন্নদ্রব্য প্রভৃতির কথা জানবার আগ্রহ তাদের খুব। আমাদের দেশে পালে পালে পাশ হয়, কিন্তু কেউ কোন খবরই রাখে না।

 বিলাতে যারা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে তাদের মধ্যে শতকরা ১০।১৫ জন কলেজে যায়, কিন্তু এখানে শতকরা ৯৯ জন। কলেজে পড়্‌তে না পেলে তারা ভাবে জীবনটা নষ্ট হ’য়ে গেল। আরে পাশ কর্‌লেই মাটি! কেবল কতকগুলো অকেজো পুতুল সৃষ্টি! শিবপুর কলেজ থেকে একজন এম-এস্‌সি বা বি-এস্ সি “অনার্স” এর জন্যে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, মাসিক ৫০৲ টাকা। দেখুন কি ব্যাপার দাঁড়িয়েছে। বড় ষ্টেশনে রেলের মুটে মাসে ৫০৲ রোজগার করে। যশোর জেলার শ্রমজীবী গ্রীষ্মকালে পোস্তা থেকে আম কিনে ‘গোপালভোগ’ ‘ক্ষীরভোগ’ নাম দিয়ে দিনের বেলা বেচে। আর রাত্রে বেচে বরফ। এতে তারা একজন গ্রাজুয়েটের চেয়ে বেশী রোজগার করে। এ বিষয় আর কত বলবো! এখন অর্থাগমের নূতন পথ খুলতে হবে, শুধু পাশ করলে চলবে না। বেঙ্গল কেমিক্যালে প্রথম যিনি ৭৫৲ টাকা পেতেন তিনি এখন ১০০০৲ টাকা পাচ্ছেন। গত বৎসর কারখানার কয়েকজন উচ্চশ্রেণীর রাসায়নিককে পরিচালকগণ যথেষ্ট টাকা পুরস্কার দিয়েছেন। ‘Knowledge is power’, “বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য” শুধু মুখে ব’ল্‌লে কি চলে? বিদ্যার জোরে য়ুরোপ এত কর্‌লে; আমরা কি পাশকরা ছাড়া কিছুই কর্‌তে পারি না? লেখা পড়া শিখে আমরা কি কেরানী ছাড়া আর কিছুই হ’তে পারি না? যদি এম্‌নি ক’রে শিক্ষার অপব্যবহার কর্‌তে থাকি তবে আমাদের দুর্গতির শেষ কোথায়? কলিকাতার যত লোকসংখ্যা তার প্রায় তৃতীয়াংশ অ-বাঙ্গালী (non-Bengalee)—অর্থাৎ শুধু ইউরোপীয় নয়— মাড়বারী—ভাটিয়া—দিল্লিওয়ালা—হিন্দুস্থানী—ওড়িয়া—চীনে প্রভৃতি লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে বাঙ্গালীর মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে। ব্যবসা বল—বাণিজ্য বল—যত রকম অর্থাগমের প্রকৃষ্ট উপায় সমস্তই বিদেশীর হাতে সঁপে দিয়ে আমরা অদৃষ্টের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে হাত পা গুটিয়ে ব’সে আছি—আর শিক্ষিত এই ভান ক’রে উপবাসে ক্লিষ্টদেহে দিন কাটাচ্ছি।

  1. কলিকাতার উপকণ্ঠ কস্‌বা (বালিগঞ্জ) লাইব্রেরীর বাৎসরিক উৎসবে প্রদত্ত উপদেশের সারাংশ। শ্রীরতনমণি চট্টোপাধ্যায় কর্ত্তৃক বিবৃত।