আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/কোহিমা রণাঙ্গনে

২রা এপ্রিল ১৯৪৪:

 আজ পর্য্যবেক্ষণের জন্য এরোপ্লেন যাইতেছে। আমাকে সঙ্গে যাইতে হইবে। আমাকে কোহিমা রণাঙ্গনে রিপোর্ট করিতে হইবে।

 আকাশের বুক চিরিয়া এরোপ্লেন্ চলিতেছে। অনেক নীচে লোগতাক্ হ্রদ-রৌদ্রের আলোকে ঝক্‌ঝক্ করিতেছে। চারিদিকে নীল পাহাড়ের মধ্যে রূপালি হ্রদের জলরাশি ছবির মত দেখাইতেছে। হ্রদের জলের মধ্যেও কয়েকটী পাহাড় মাথা তুলিয়াছে।

 পাহাড়ের পর পাহাড়ের শ্রেণী—ঘন সবুজ ও ঘন নীল হইতে ক্রমে ক্রমে ফিকা নীলে পরিণত হইয়াছে। পাহাড়ের মধ্য দিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া রূপালী চাদরের মত মণিপুর নদী বহিয়া গিয়াছে।

 অদূরে ইম্ফল্ শহর দেখা গেল। এ্যাণ্টি-এয়ার-ক্রাফট্ গানের লক্ষ্য হইতে দূরে থাকিয়া পাইলট এরোপ্লেন্ লইয়া চলিল। শত্রুসেনার অবস্থান যতদূর সম্ভব পর্য্যবেক্ষণ করা হইল।

 মণিপুর নদীর ধারে প্রাচীন রাজপ্রাসাদ ও দুর্গের ধ্বংশাবশেষ দেখা গেল। নদী এখানে আঁকিয়া বাঁকিয়া দক্ষিণ দিকে বহিয়া গিয়াছে। গোবিন্দজীর মন্দিরের চূড়াগুলি নীল আকাশের গায়ে সুন্দর দেখাইতেছিল।

 আমরা যখন কোহিমা ফ্রণ্টের ছাউনির নিকট পৌছিলাম, তখন বেলা একটা বাজিয়া গিয়াছে।

 কোহিমার পখে ভারত আক্রমণের দিকেই বেশী জোর দেওয়া হইবে। কোহিমার উত্তর দিকে পাহাড় এবং নিবিড় জঙ্গলের ভিতর দিয়া এই পথ আসামে গিয়াছে। এই দুর্গম পথে সৈন্য চালনা কঠিন। কিন্তু জাপানীদের নিকট পাহাড় ও জঙ্গল-যুদ্ধ আমরা শিখিয়াছি। এবিষয়ে তাহারা ওস্তাদ।

 কোহিমা ফ্রণ্টে আজাদ হিন্দ ফৌজের তিনটী রেজিমেণ্ট্ লড়াই করিতেছে। সেনানায়কের নামের আদ্যক্ষরে প্রত্যেক দলের নামকরণ হইয়াছে।

 ‘এ’ পার্টি—কাপ্তেন্ আজমীর সিং-এর নাম অনুসারে

 ‘এম্’ পার্টি—লেফ্‌ট্‌ন্যাণ্ট্, মুহম্মদ হুসেনের নাম অনুসারে

 ‘জি’ পাটি—লেফ্‌ট্‌ন্যাণ্ট্ গুরুচরণ সিং-এর নাম অনুসারে ইহা ছাড়া একটা বাড়্‌তি রেইন্‌ফোর্সমেণ্ট (Reinforcement) দল আছে; তাহার নায়ক লেফ্‌ট্‌ন্যাণ্ট্ দল বাহাদুর।

 আমরা কোহিমার পথ চিনি না। জাপানীরা এই পথের সকল বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছে এবং এরোপ্লেন্ হইতে সার্ভে করিয়াছে। কিকারি দলে গুপ্তচরদের মধ্যে বাঙালী, মণিপুরী, অহমিয়া, নাগা ও বর্মীজ্ আছে। ইহারা নানা ছলে ইংরেজদের ঘাঁটীগুলিতে গিয়া সেখানকার সংবাদ সংগ্রহ করিয়া আনে। জাপানী সেনাপতি কর্ণেল্ য়ামামোতা ও জেনারেল্ ইসোভা আজাদ হিন্দ্ ফৌজের সহিত সহযোগিতা করিতেছেন।

 আমরা খুব ছোট ছোট দলে বিভক্ত হইয়া অগ্রসর হইতেছি। পাহাড় ও জঙ্গল—জঙ্গল ও পাহাড়; চড়াই ও উতরাৎ—উতরাই ও চড়াই। পথের যেন শেষ নাই। যতদূর দেখা যায়, ততদূরই কালো পাহাড়ের ‘সারি’ মেঘের ঢেউ-এর মত সাজানো রহিয়াছে। পাহাড়ের গায়ে উঠিবার সময় কাঁটাগাছে লাগিয়া দুটী হাত ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে।

 আমাদের সঙ্গে ভারী মোট বিশেষ কিছু নাই; তাই সুবিধা। অমদের সঙ্গে রাইফেল্ ও পিস্তল আছে। তাহা ছাড়া আমাদের দলে মেসিন গান ও ব্রেন্ গান্ পাইয়াছি। এইগুলি ভারী নয়—বেশ হাল্কা—নাড়াচাড়া করা ও চালানোও সোজা। একজন মাত্র লোক ব্রেন্ গান্ চালাইতে পারে। মিনিটে প্রায় দেড়শত গুলি ছোঁড়া যায় এবং ছয় শত গজের মধ্যে শত্রু থাকিলে ইহা দ্বারা শত্রুনাশ করা চলে।

 আজ একজন চর কোহিমার সংবাদ আনিল—কোহিমার পথে ফেক্ ও খারাসন্ গ্রামে ইংরেজদের ঘাঁটী আছে; সেখানে বার্মা ও আসাম রেজিমেণ্টের সৈন্য় রহিয়াছে। কোহিমা শহর ইংরেজদের একটি বড় ঘাঁটী। এখানে ৪।৫ হাজার সৈন্য আছে—তাহার মধ্যে বৃটিশ ও ভারতীয় উভয় সৈন্যই আছে। ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে দ্বিতীয় পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট ও তৃতীয় আসাম রাইফেল বাহিনী প্রধান।

 কোহিমা আসামের নাগা পাহাড় জেলার প্রধান শহর। বেঙ্গল-আসাম রেলপথের ডিমাপুর ষ্টেশন হইতে ৪৬ মাইল দূরে। নাগা পাহাড়ের ডেপুটি কমিশনার এইখানে থাকেন। জি, টি, পাহাড় হইতে কোহিমা শহরে জল সরবরাহ হয়।

 মণিপুর রোড হইতে গৌহাটী মাত্র ১৫০ মাইল। বেঙ্গল ও আসাম রেলপথ ডিমাপুর হইতে লাম্‌ডিং দিয়া গৌহাটী গিয়াছে। ডিমাপুর হইতে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকাও বেশীদূর নয়। পার্বত্য অঞ্চলের যুদ্ধে জয়লাভ হইলে বাঙ্‌লা দেশে আমাদের অগ্রগতি সহজ হইবে। তাই কোহিমা আমাদের চাই।

৩রা এপ্রিল ১৯৪৪: নাগা পাহাড়:

 নাগা পাহাড়ের মধ্য দিয়া চলিয়াছি। বাঝে মাঝে দেখিলাম এক নূতন ধরণের চাষ। পাহাড়ের গায়ের উপর সাজানো ডালা-কাটা ক্ষেত। পার্বত্য নদীর জল ক্ষেতের পাশ দিয়া প্রবাহিত হইতেছে; একটি ডালা কাটা ক্ষেতের জল উপ্‌ছাইয়া অন্য ক্ষেতে পড়িতেছে। পাহাড়ের গায়ে ধানের এরকম ক্ষেত আমি পূর্বে কখনো দেখি নাই। নাগাদের জুম ক্ষেত দেখিবার জিনিষ।

 পাহাড়ের উপর নাগাদের বস্তি। নাগা সর্দার আসিয়াছে আমাদের লইয়া যাইতে। এই বস্তি পূর্বেই অধিকৃত হইয়াছে। দূর হইতে ঐ বস্তি দেখা যায় না—চারিদিকে শাল বন।

 কাছে আসিয়া দেখিলাম—চারিদিকে বাঁশের বেড়া দিয়া ঘেরা। পাহাড়ের উপর এই পল্লীটি যেন একটী কেল্লা। ভিতরে খড়ের ছাওয়া অনেকগুলি কুটীর। একটা কুটীরের দরজার উপর বাইসনের শিং সাজানো রহিয়াছে; দেয়ালের গায়ে ঢাল, কাটারি ও বল্লম টাঙ্গানো।

 নাগা বস্তির বাহিরে আমরা তাঁবু খাটাইলাম। সর্দার ও তাহার সঙ্গীদের সরল ব্যবহার খুব ভালো লাগিল। এরা সাহসে দুর্জয়— হিংস্র পশুর মত, অথচ কত সরল, ঠিক শিশুর মত।

 আজ সন্ধ্যায় একটা নূতন জিনিষ দেখিলাম নাগাদের নাচ। গ্রামের মধ্যে একটু সমতল জায়গা; সেইখানে নাচের ব্যবস্থা হইয়াছে। অনেকগুলি স্ত্রীপুরুষ—বালক বালিকা—যুবক যুবতী সমবেত হইয়াছে।

 নাগাদের পেশীবহুল দেহ ও বিচিত্র সমরসজ্জা চোখের সম্মুখে এক স্বপ্নলোক সৃষ্টি করিল। পুরুষদের ডান হাতে বল্পম, বাম হাতে ঢাল। বল্লম লোহার তৈয়ারী—ধরিবার অংশটী ছাগলের লোম দিয়া বাঁধা। সাজ অদ্ভুত—পরিধানে গাছের ছাল, গলায় কড়ি ও শাঁকের মালা, মাথায় মুকুট। কয়েক জনের মুকুটের সঙ্গে দুটী শিং বাঁধা।

 নাগা মেয়েদের সাজও বিচিত্র। গলায় নানা রঙের পুঁথির মালা, কাণে কাণবালা, হাতে চুড়ি, মাথার খোঁপায় বন্য ফুল।

 কয়েকটী বড় বড় ঢোল বাজিয়া উঠিল। স্ত্রীপুরুষ সবাই মিলিয়া একত্রে তালে তালে নাচিতে লাগিল। তারপর পুরুষেরা একদিকে দল বাঁধিয়া দাড়াইল—অন্য দিকে দাঁড়াইল মেয়েরা। মেয়েরা গান গাহিতে লাগিল।

 এবার পুরুষের একা নাচিতে লাগিল—শিকারীর নাচ। বল্লম উচ্চে তুলিয়া বিভিন্ন ভঙ্গীতে নাচ চলিল। মাঝে মাঝে উচ্চে লাফ দিতেছিল। যেন বন্য পশুর সহিত যুদ্ধের অভিনয়।