আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/মণিপুরে জাতীয় বাহিনীর প্রবেশ

৩১শে মার্চ ১৯৪৪: মণিপুর উপত্যকা:

 আজ আমরা মণিপুরের সমতল ভূমিতে প্রবেশ করিয়াছি। আমাদের সম্মুখে মণিপুরের রজধানী ইস্ফল।

 আজ মণিপুরের দক্ষিণ অংশ স্বাধীন। নেতাজী ও জাপ সেনানায়ক জেনারেল্ কাওয়াবে এই দুইজনের সম্মিলিত ঘােষণা প্রচারিত হইল। ভারতের এই মুক্ত অঞ্চল আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টের শাসনাধীন হইল। কর্ণেল্ এ. সি. চ্যাটার্জি মুক্ত ভারতের গভর্ণর নিযুক্ত হইয়াছেন। মেজর কিয়ানি তাঁহার অধীনে দেশ শাসন করিবেন। বৃটিশের কবল হইতে মুক্ত অংশে যে সকল সম্পত্তি বা সমর সম্ভার পাওয়া যাইবে তাহা আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট পাইবেন।

 সকলের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার হইয়াছে। আমরা সত্যই নিজেদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করিতেছি—জাপানীদের ক্রীড়নক নই।

 আমার উপর আদেশ হইয়াছে বিষ্ণুপুরে যাইবার জন্য।

১লা এপ্রিল ১৯৪৪: বিষ্ণুপুর

 বিষ্ণুপুর মণিপুর উপত্যকায় প্রায় মাঝামাঝি; ইহার প্রায় মাইল খানেক উত্তরে লোগতাক্ হ্রদ।

 বিষ্ণুপুরে দেখিবার জিনিষ—নিত্যানন্দজীর মন্দির। মন্দিরটীর ছাউনি করগেট্ টীনের। সামনে একটী নাট মন্দির—সেটীরও খড়ের ছাউনি। এই মন্দির মণিপুর রাজ্যের দান হইতে চলে। মণিপুরের রাজারা বৈষ্ণব—বাঙলার বৈষ্ণব মতের প্রবর্ত্তক শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্ত। ইহাদের তীর্থস্থান বাঙলা দেশের নবদ্বীপ। নবদ্বীপ হুগলী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত একটী শহর। নিত্যানন্দ চৈতন্যদেবের একজন প্রধান শিষ্য ছিলেন।

 বিষ্ণুপুরের বাজারের কাছেই একটী টীলা রহিয়াছে। এই টীলার উপরে একটী প্রাচীন কেল্লার ভগ্নাবশেষ রহিয়াছে। ইহার মধ্যে একটী ইঁটের মন্দির আছে। এই জায়গাটার নাম শান্তিপুর।

 লালতুই জাতিতে কুকী। সে নাগা ও মণিপুরী ভাষা জানে বলিয়া আমার খুব সুবিধা হইয়াছে। লালতুই-এর সাহায্যে এক মণিপুরীর সঙ্গে পরিচয় হইল। ভদ্রলোকের নামটী মনে নাই—কি যেন সিং।

খর্বাকার দেহ, নাক খেঁদা, চোখ দুটী ছোট, মুখে গোঁফের অল্প রেখা, রঙ বেশ ফর্সা; বয়স প্রায় ৫০ বৎসর হইবে। চেহারা মঙ্গোলীয় ধরণের। পরিধানে ধুতি ঠিক বাঙালীদের মতন; গায়ে শাদা চাদর, মাথায় পাগড়ী, গলায় তুলসীর মালা, কপালে তিলক।

 সিং-এর কুটীর বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাঁশের বেড়া, খড়ের ছাউনি। কুটীরের সামনে বারান্দা। উঠানে তুলসী মঞ্চ। বারান্দায় একটী তাঁত রহিয়াছে। একটী ১৪।১৫ বৎসর বয়সের মেয়ে তাঁতে ‘ফনেক্’ শাড়ী বুনিতেছিল। এই সাড়ী তিন হাত চওড়া, পাঁচ হাত লম্বা। দেড় হাত করিয়া কাপড় বুনিয়া পরে দুইটী অংশ সেলাই করিয়া জুড়িয়া দেয়। তাঁতটী নূতন ধরণের— কোমরে বাঁধিয়া হাতে চালাইতে হয়।

 আমি বলিলাম—‘বেশ সুন্দর বোনা হইতেছেতো! চমৎকার পাড়।’

 সিং বলিলেন—‘যুদ্ধের জন্য আমাদের কাজকর্ম্ম সব বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। এই কাপড়টী বোনা প্রায় শেষ হইয়া পড়িয়া ছিল। কাপড় নাই। তাই আজ আমার মেয়ে কাপড়টী শেষ করিতেছে!

 মেয়েটাকে দেখিতে বেশ। ইহার পোষাকের মধ্যেও বৈচিত্র্য আছে। পরিধানে ফনেক্ শাড়ী—বক্ষ হইতে পা পর্য্যন্ত অঙ্গ ঢাকিয়াছে। একখানি ওড়নায় মাথা ও দেহের উর্দ্ধাংশ আবৃত। মাথায় এলো খোঁপা, নাকে ও কপালে তিলক। আমার অনুরোধে মেয়েটী কাপড় বোনা দেখাইল।

 আজ সন্ধ্যায় নিত্যানন্দজীর নাটমন্দিরে স্থানীয় লোকদের এক সভা ছিল। নেতাজীর ঘোষণা সিং মণিপুরী ভাষায় অনুবাদ করিয়া শুনাইলেন। কাপ্তেন এম্, এ, মালিক বিষ্ণুপুরের শাসনকর্ত্তা; তিনি নিজে আসিলে ভালো হইত।

 স্বাধীন ভারতের ত্রিবর্ণ-রঞ্জিত পতাকা প্রথম মণিপুর ও নাগা পাহাড়ের ভূমিতে প্রোথিত হইয়াছে। আমরা স্বাধীন—স্বাধীন ভারতের মাটিতে দাঁড়াইয়া আছি। কয়েকটি মণিপুরী যুবক আমাদের সহিত সহযোগিতা করিতেছে। কিন্তু সাধারণ লোকের মনে কোনরূপ রাজনৈতিক চেতনা নাই। স্বাধীনতা ও অধীনতার মধ্যে পার্থক্য তাহারা বুঝে না।

 সন্ধ্যা হইতে ভীষণ মশার আক্রমণ হইল। লাল্‌তুই বলিল—সেই ভদ্রলোক রাত্রে আহারের নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। আজ শরীরটা ভালো মনে হইতেছে না—নিমন্ত্রণ বাদ দেওয়াই ঠিক হইল।

 লাল্‌তুই-এর নিকট মণিপুরের কাহিনী শুনিলাম। প্রায় ৫৩ বৎসর পূর্বে (১৮৯০ খৃষ্টাব্দে) মণিপুরের রাজা কুলচন্দ্র ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তাঁহার সেনাপতি টিকেন্দ্রজিত সম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। এই বিদ্রোহ সফল হয় নাই।