আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/টামুর পথে যুদ্ধের বিবরণ
১২ই মার্চ্ ১৯৪৪: কিনাত:
আমাদের প্যালেল্-টামু অঞ্চলে অগ্রসর হইতে হইবে—লক্ষ্য মণিপুর। টামু মণিপুর রাজ্যে—বার্মার সীমান্তে।
কাল কিনাত পৌঁছিয়াছি। এই ক্ষুদ্র শহরটি চিন্দুইন্ নদীর বাম তীরে।
আজ বসু ব্রিগেডের সেকেণ্ড লেফট্ন্যাণ্ট সত্য মুখার্জি আমাদের ব্রিগেডে বদলি হইয়া আসিয়াছেন। তাঁহার নিকট কালাদানের যুদ্ধের গল্প শুনিলাম। কালাদান আরাকানে—চট্টগ্রামের দক্ষিণে। এখানে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদলের সহিত আমেরিকান নিগ্রোদের এক ভীষণ যুদ্ধ হইয়াছিল। এই যুদ্ধে অনেক নিগ্রো সৈনিক নিহত হয়।
১৮ই মার্চ ১৯৪৪: মণিপুর:
আজ আমরা বার্মা সীমান্ত অতিক্রম করিয়া ভারতবর্ষের মাটিতে পদার্পন করিয়াছি। কোন বাধা পাই নাই।
২০শে মার্চ ১৯৪৪: টামুর অভিমুখে:
মাথার উপরে এরোপ্লেনের শব্দ—কয়েকটি বৃটিশ এরোপ্লেন্ আসিতেছে। আমরা পাহাড়ের গা বাহিয়া উঠিতেছি। এখানে থাকা নিরাপদ নয়; দেখিতে পাইলে উপর হইতে মেসিন্ গান্ চালাইবে। আমরা তাড়াতাড়ি নামিয়া পাহাড়টীর সানুদেশে জঙ্গলের মধ্যে গাছের নীচে লুকাইলাম।
ফট্-ফট্-ফট্-ফট্—এরোপ্লেন্ হইতে গুলি বর্ষণ হইতেছে। আমাদের দেখিতে পাইয়াছে। ফট্-ফট্-ফট্-ফট্—ফট্-ফট্-ফট্-ফট্—শব্দের যেন বিরাম নাই; মধ্যে মধ্যে আলোক জ্বলিয়া উঠিতেছে। মাথার উপর এবোপ্লেন্ ঘুরিয়া ঘুরিয়া উড়িতেছে। এমন সময় একটা ভীষণ শব্দ হইল। মনে হইল, সমস্ত পৃথিবী যেন উল্টাইয়া যাইতেছে—চোখের সামনে রাশি রাশি আলাে—
তারপর কি হইল জানি না। যখন চোখ চাহিলাম—আমার পাশে বসিয়া আছে লালতুই। বড় জলতৃষ্ণা; ফ্লাস্ক হইতে জল আমার মুখে ঢালিয়া দিল। এবােপ্লেনের শব্দ আর নাই—শত্রু চলিয়া গিয়াছে। বােমা পড়িয়াছিল কাছেই। আমার পাশে ছিল মহান্তি—বােমার স্প্লিন্টার্ লাগিয়া তাহার মৃত্যু হইয়াছে। আমি আশ্চর্য্যরকম বঁচিয়া গিয়াছি। আমাদের আরও দুইজন সঙ্গীর মৃত্যু হইয়াছে। তাহারা যেখানে শেলটার্ লইয়াছিল, ঠিক সেই জায়গায়ই বােমা পড়ে। তাহাদের দেহের চিহ্ন বিলুপ্ত হইয়াছে।
মহান্তীর বাড়ী কটকের কাছে কি একটা গ্রামে। তাহার স্বদেশের দ্বার প্রান্তে আসিয়া সে শেষ শয্যা গ্রহণ করিল। কয়দিন এক সঙ্গে দিনরাত্রি কাটাইয়াছি; আজ তাহার মৃত্যুতে মন ভারাক্রান্ত হইল। তবু মনে হইল—মহান্তী বীরের মৃত্যু বরণ করিয়াছে। সজল নয়নে নীরবে তাহাকে সমাহিত করিলাম। দাহ করিলে সেই আগুন শত্রুর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে, তাই ইচ্ছা সত্বেও তাহা করা গেল না।