আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/জাপানী অধিকারের পূর্বে রেঙ্গুনের অবস্থা
৭ই মার্চ ১৯৪২: রেঙ্গুন:
আবার রেঙ্গুনে। জনমানবশূন্য রাস্তা। অধিকাংশ বাড়ীরই দরজা-জানালা খোলা। রাস্তার উপর মধ্যে মধ্যে জিনিসপত্র পড়িয়া আছে।
একদল বার্মিজ কতকগুলি মোট লইয়া যাইতেছিল; নিশ্চয়ই লুণ্ঠিত দ্রব্য।
বাসায় পৌঁছিলাম। টর্চের সাহায্যে আমার ঘরে গিয়া দেখিলাম—আলমারি ভাঙ্গা—কাপড়চোপড় কিছুই নাই।
একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ হইল। জানালা হইতে দেখিলাম, দূরে একটা বিরাট ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এ সব কি?—রেঙ্গুনে কি জাপানীরা আসিয়া পড়িয়াছে—না, ইংরাজরাই এগুলি নষ্ট করিতেছে?
সকালের জন্য অপেক্ষা না করিয়া এখনি একবার শহরটা ঘুরিয়া পাকা খবর সংগ্রহ করিতে হইবে। অন্ধকারেই সুবিধা।
পথে একজন বর্মীর সহিত দেখা হইল। সে বলিল—‘ইংরাজেরা পলায়ন করিতেছে; জাপানীরা আসিতেছে। জেল হইতে কয়েদীদের ছাড়িয়া দিয়াছিল; তাহারা শহর লুণ্ঠন করিয়া চলিয়া গিয়াছে।’
অনতিদূরে একটা দোকানের দরজা খোলা। হারিকেন জ্বলিতেছে দেখিয়া অগ্রসর হইলাম।—দেখিলাম—সেটি মদের দোকান। কয়েকজন শিখ হল্লা করিয়া বোতল হইতে মদ ঢালিয়া খাইতেছে। একজন নৃত্য করিতেছে।
কাছেই একটা বাড়ীতে অংফয়া ও তাহার বৃদ্ধা মা থাকে। তাহাদের সিগারেটের কারবার। উপরের জানালায় দাঁড়াইয়া অংফয়া। নাম ধরিয়া ডাকিলাম। ফয়া দরজা খুলিয়া আসিতে বলিল।
আমি বলিলাম—‘তোমরা এখনো আছ? তোমার মা কোথায়?’
ফয়া কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার মা কয়েকদিন হইল মারা গিয়াছে—রাস্তায় বোমার আঘাতে। সে একা। রেঙ্গুন হইতে ১০ মাইল দূরে তাদাগালে গ্রামে তাহার দিদিমা থাকেন। কিন্তু যে রকম লুঠতরাজ চলিয়াছে, ভয়ে সে ঘরের বাহির হয় নাই। প্রায় সব বড় বড় বাড়ীতেই লুঠ হইয়াছে।
আমি তাহাকে সান্ত্বনা দিয়া আমার অবস্থাও বলিলাম। আমাকে বলিল—‘আপনি যদি আমায় তাদাগালে লইয়া যান, সেখানে দিদিমার কাছে আপনি থাকিতে পারিবেন।’ এ যুক্তি মন্দ নয়।
ফয়া তাহার জিনিসপত্র একটা ছোট ব্যাগে ভরিয়া আমার সঙ্গে বাহির হইল। আমিও বাসা হইতে আমার সুট্কেশটি লইলাম। ফয়ার একটা রিভল্ভার ছিল। দু’জনে অন্ধকারের মধ্যে চলিলাম।
কয়েকদিনের অর্দ্ধাহারে ও অনশনে ফয়া দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল। সমস্ত দিন পথশ্রমে আমার দেহও অবসন্ন। এইভাবে আমরা দু’জনে প্রায় ৭ মাইল পথ চলিয়াছি—তাদাগালে বোধ হয় আর বেশী দূর নয়। এমন সময় মাথার উপর কয়েকটা এরোপ্লেন্ আসিয়া পড়িল—এক ঝাঁক ভীমরুলের মতন তাহাদের গুঞ্জন নিস্তব্ধ বাতাসকে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিল।
ফয়া বলিল—‘জাপানী এরোপ্লেন। আমার শরীর ঝিম্ ঝিম্ করিতেছে। আমি আর দাঁড়াইতে পারিতেছি না।’
রাস্তার ধারে একটা গাছের নীচে তাহাকে শয়ন করাইয়া দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সে মূর্চ্ছা গেল। একটা ছোট ফ্লাস্কে জল ছিল; একটু লইয়া তাহার মুখে চোখে দিলাম। আকাশে গুঞ্জন ধ্বনি অস্পষ্ট হইতে অস্পষ্টতর হইয়া ক্রমে মিলাইয়া গেল।
ফয়ার তখনো জ্ঞান হয় নাই। কোলের উপর মাথাটি তুলিয়া লইলাম। নাড়ী ভালোই মনে হইল—যদিও একটু দুর্বল। কিছুক্ষণ পরে সে চোখ চাহিল।
বলিলাম—‘ভয় নাই; এরোপ্লেন চলিয়া গিয়াছে। তুমি বড় দুর্বল, এখন উঠিতে চেষ্টা করিও না; আমরা না হয় একটু বিশ্রাম করিয়া যাইব।’
ঊষার অস্পষ্ট আলোকে ফয়ার মুখখানি এক অপূর্ব সৌন্দর্য্যে মণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছিল। নিটোল সর্বাঙ্গে উচ্ছ্বলিত ভরা যৌবন। গোলাপী রঙের রেশমি লুঙ্গি ও ব্লাউজের রঙ্ তাহার গায়ের রঙের সহিত মিশিয়া গিয়াছে।
ধীরে ধীরে তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিলাম। সে নিঃশব্দে চোখ বুজিয়া শুইয়া রহিল।
বেশী দেরী করা উচিত নয়। জাপানীরা যদি আসিয়া পড়ে, আমরা পথের মাঝখানে বেড়াজালের মধ্যে পড়িয়া যাইব।
ফয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। দুজনে আবার চলিলাম।
ফয়ার দিদিমা নাতনীকে পাইয়া আনন্দিত হইলেন। আমারও আশ্রয় মিলিল।
২রা মে ১৯৪২: তাগাগালে:
জাপানীরা ব্রহ্মদেশ অধিকার করিয়াছে। গ্রামের মধ্যেই আছি। দেশব্যাপী অরাজকতার মধ্যে এই বর্মী পল্লীর মধ্যে ভালোই আছি বলিতে হইবে। ফয়ার দিদিমার কিছু ধান লুকানো আছে; তাহাতেই চলিয়া যাইতেছে।
বাহিরের জগৎ সম্বন্ধে কোন খবর পাইবার উপায় নাই। ঠিক করিলাম, একবার রেঙ্গুন ঘুরিয়া আসিব। ফয়া কিছুতেই যাইতে দিবে না। আমার যাইবার কথা শুনিয়া অবধি কাঁদিতেছে। তাহাকে বুঝাইলাম— এখনতো এখানে যুদ্ধ হইতেছে না, সুতরাং বিপদের ভয় আর নাই।