আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/বার্মা ত্যাগের বৃথা চেষ্টা
২০শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪২:
ঘরে চা আছে, কিন্তু দুধ ও চিনি নাই। অনেক কষ্টে উনান ধরাইয়া চা করিলাম। ভাগ্যে বিস্কুট সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলাম। কয়েকখানা বিস্কুট খাওয়া গেল।
ভোর বেলায়ই বাহির হইলাম মং সাইনের সঙ্গে দেখা করিবার জন্য মাচেণ্ট্ স্ট্রীটে। দোকানের উপরেই সে থাকে। তাহার সঙ্গে দেখা হইল। সে-ও বেশী কিছু খবর রাখে না। আমায় বলিল —‘ভারতের লোকেরা দেশে পলাইতেছে। কিন্তু আমাদের তো এই দেশ—আমরা পলায়ন করিয়া কোথায় যাইব?’
এই সময় নাথুভাই আসিয়া পড়িলেন। তিনি মোটরে আসিয়াছিলেন। বলিলেন—‘পেট্রল্ পাইতেছি না। যাহারা এসেন্সিয়াল্ শ্লিপ্ পাইয়াছে তাহাদের অসুবিধা হইতেছে না। আজ বর্মা গভর্ণমেণ্টের সেক্রেটারির অফিসে এ বিষয়ে কথা বলিবার জন্য যাইব।’
নাথুভাই আমাকে বলিলেন—‘আসুন না, একটু ঘুরিয়া আসা যাক্।’ ভালোই হইল —আমিও তাহাই চাহিতেছিলাম। ডালহৌসি ষ্ট্রীটের অফিসে দুজনে গেলাম। চারিদিকে একটা নিস্তব্ধ সন্ত্রস্ত ভাব। তাঁহার পরিচিত এক সাহেবকে নাথু ভাই বলিলেন —‘সকলেই মোটরের জন্য ‘এসেন্সিয়াল্’ লেবেল পাইয়াছেন; আমায় একটা পাইয়ে দিন। বড় অসুবিধা হইতেছে।’
সাহেব ম্লান হাসি হাসিয়া বলিলেন —‘আর ‘এসেন্সিয়াল্’ লেবেলের প্রয়োজন হইবে না। আমার জিনিষপত্র বাঁধা রহিয়াছে; আমরা রেঙ্গুন ছাড়িয়া যাইতেছি। আপনার মোটরে শীঘ্র সম্ভব রেঙ্গুন ত্যাগ করুন।’
ম্লানমুখে নিঃশব্দে আমরা দুজনে বাহির হইয়া আসিলাম। হঠাৎ সাইরেন বাজিয়া উঠিল আহত কুকুরের করুণ আর্ত্তনাদের মতো। আকাশে জাপানী এরোপ্লেনের শব্দ—ভম্ ভম্-ভম্। রাস্তার পাশেই একটা বাড়ীতে আশ্রয় লইলাম। সৌভাগ্যক্রমে বোমা পড়িল না। জাপানী এরোপ্লেনগুলি শহরের উপর উড়িয়া উড়িয়া আবার দূরে মিলাইয়া গেল।
নাথুভাই এতক্ষণ পরে কথা বলিলেন—‘সাহেবরাও পলায়ন করিতেছে। পূর্ব্বে সুবিধা ছিল যাইবার; কিন্তু বাড়ী-ঘর ধন-সম্পত্তি যথাসর্ব্বস্ব আমার এখানে। কি করিয়া ফেলিয়া যাই। তাই যাওয়া হয় নাই। এমন হইবে কে জানিত!’
এই অবস্থায় রেঙ্গুনে আর থাকা চলে না। দোকানপাট বন্ধ খাবার জিনিষ পাওয়া যায় না। এখানে থাকিলে না খাইয়া মরিতে হইবে। তাহার পর অরাজকতা, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডের ভয়তো আছেই।
আমি বলিলাম—‘আপনি যদি যান, আমায় সঙ্গে লইবেন।’
নাথুভাই উত্তর দিলেন—‘আজই মুল্যবান জিনিষ মাটির নীচে পুঁতিয়া ফেলিব; যদি কোনদিন ফিরিয়া আসি তা’হলে হয়তো সেগুলি পাইব। কাল সকালে আমি যাত্রা করিব। আপনাকে তুলিয়া লইয়া যাইব।’
নাথুভাইয়ের নিকট হইতে বিদায় লইয়া ভাবিলাম, এক শিশি এস্পিরিন্ কিনিয়া রাখি—কয়দিন যাবৎ মাথা ধরিতেছে। দে ব্রাদার্সের ডাক্তারখানা নিকটেই। সেখানে এস্পিরিন্ পাওয়া গেল। দে ব্রাদার্সের প্রায় সকলেই চলিয়া গিয়াছেন। গভর্ণমেণ্টের আদেশ যে ডাক্তারখানা খুলিয়া রাখিতেই হইবে, তাই দোকান এখনো কোন রকমে খোলা রাখা হইয়াছে।
নাথুভাই তো বলিলেন, কাল সকালে নিজে আসিয়া লইয়া যাইবেন। কিন্তু যদি না লইয়া যান্, তাহা হইলে মুস্কিলে পড়িব। আর কাহার মোটর আছে? ডাক্তার কুণ্ডু, লোক ভালো। রেঙ্গুনের নামজাদা ডাক্তার। তাঁহার সহিত পরিচয় সামান্যই। তবু চলিলাম তাঁহার বাড়ীতে।
ডাক্তার কুণ্ডু তাঁহার বাড়ীর দরজায়ই ছিলেন। তিনি তাঁহার চাকরদের উপর গরুর ভার দিয়া যাত্রার ব্যবস্থা করিতেছিলেন। চাকরদের বলিলেন, নিকটবর্ত্তী গ্রামে আশ্রয় লইতে। বুঝিলাম—তাঁহার গাড়ীতে স্থানাভাব; সুতরাং নাথুভাই ছাড়া গতি নাই।
২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪২:
ভোরবেলা এক সুটকেস্ হাতে চাঁদ সিং আসিয়াছেন বেসিন্ হইতে। তিনি বেসিনের কারেন্ স্কুলে কাজ করিতেন। আমায় বলিলেন—অনেক কষ্টে জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে রেঙ্গুনে আসিয়াছেন। বেসিনে জাপানীরা একদিন খুব বোমা ফেলে। বেসিন নদীর ধারে অনেক বাড়ী ঘর পুড়িয়া গিয়াছে। তাঁহার বাসায়ও বোমা পড়ে; তিনি খুব অল্পের জন্য বাঁচিয়া যান।
ষ্টীমারে ইরাবতী নদী দিয়া মান্দালয় যাইবার চেষ্টা করেন, কিন্তু ইরাবতী ফ্লোটিলা কোম্পানির ষ্টীমারে বা রেলে জায়গা পাওয়া যায় নাই।
আমি তাঁহাকে বলিলাম—‘আমি আজই রেঙ্গুন ছাড়িয়া যাইতেছি এক পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে।’
এই সময় নাথুভাই আসিয়া উপস্থিত। ভদ্রলোকের কথার ঠিক আছে। তাহার মোটরে চাঁদ সিংএরও স্থান হইল। তিন জনে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।
সুন্দর ছবির মত শহর—সোজা সোজা রাস্তা—আজ সমস্তই যেন প্রাণহীন। নীল আকাশের গায়ে সোনালি ফায়ার চূড়া নবোদিত সূর্য্যকিরণে তেমনি ঝক্ ঝক্ করিতেছিল।
পথে লোক চলিয়াছে, কিন্তু সবই অস্বাভাবিক। দলে দলে চলিয়াছে সর্বহারার দল। ইহাদের মধ্যে অনেকে বর্মায় আসিয়া বড়লোক হইয়াছিল: আজ আবার অদৃষ্টের ফেরে সমস্ত ফেলিয়া চলিয়াছে রিক্ত হস্তে। কেহ চলিয়াছে মোটরে, কেহ পায়ে হাঁটিয়া—কাহারও হাতে সুটকেশ, কাহারও পুঁটলি, কাহারও বা মাথায় বোঁচকা; তাহাতে তাহাদের যথাসর্বস্ব। তাহাদের মধ্যে বাঙ্গালী ও মাদ্রাজীই বেশী—শিখও কিছু ছিল। মাদ্রাজীদের মধ্যে অনেক কুরঙ্গি রহিয়াছে—গায়ের রঙ ঘোর কালো, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল ঝুঁটীর মতন বাঁধা; ইহারা এখানে কুলির কাজ করিত।
বর্মী পরিবারও চলিয়াছে অনেক। পরিধানে রঙিন লুঙ্গি ও গায়ে ছোট জামা—মেয়েদের চুলের গোছা চূড়ার মতো করিয়া বাঁধা।
মোটর ছুটিয়াছে। রেঙ্গুণ শহর ছাড়িয়া চলিয়াছি। থারাওয়ার্দির কাছে আসিয়া মোটর বিগড়াইল। মেরামত করিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল।
রাত্রে একটা আস্তানা দরকার। দুরে একটা প্যাগোডা দেখা যাইতেছে—ওখানে আশ্রয় মিলিতে পারে। সেইদিকে তিন জনে চলিলাম।
প্যাগোডার দরজায় বর্মী ফুলওয়ালী ফুল ও মোমবাতি বিক্রয় করিতেছে। বুদ্ধদেবের মূর্ত্তির সম্মুখে সারি সারি মোমবাতি জ্বলিতেছে। ফুঙ্গী ঘণ্টা বাজাইয়া জয়মঙ্গল গাথা পাঠ করিতেছেন। জগদ্ব্যাপী এই মহাযুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডের মধ্যে বুদ্ধদেবের মুখ তেমনি অচঞ্চল—অধরে তেমনি রহস্যময় হাসি। পূজারীগণের কণ্ঠে ধ্বনিত হইল অহিংসার অবতার বুদ্ধদেবের প্রতি আনুগত্য—বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি—ধম্মং শরণং গচ্ছামি। কিন্তু একা ব্রহ্মের নরনারী শরণ লইলে কি হইবে? যতদিন না সারা জগৎ অহিংসা মন্ত্রে ব্রতী না হয়, ততদিন যুদ্ধ চলিবে—সাইরেন বাজিবে—বোমা পড়িবে—মানুষ পতঙ্গের ন্যায় মরিবে।
ফুঙ্গীর অনুগ্রহে এক বর্মীর গৃহে আশ্রয় মিলিল। এই বিপদের সময় এই পরিবার অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের যেভাবে অতিথি সৎকার করিয়াছিলেন তাহা আমার চিরদিন মনে থাকিবে। বাড়ীর কর্ত্তার নাম মঙ্গ্ মায়া।
ফুঙ্গী আমাদের মঙ্গ্মায়ার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলেন। ভদ্রলোক দরজায় অপেক্ষা করিতেছিলেন। আমরা যাইতেই হাসিমুখে বলিলেন—‘লা গে ছেয়া’ (মহাশয়, আসুন)। আমার বর্মী ভাষার সামান্য জ্ঞান কাজে আসিল। নাথুভাই ও চাঁদ সিং বর্মী ভাষায় অনভিজ্ঞ।
রাত্রে তাহার স্ত্রী পরিবেশন করিলেন। বেশ সুশ্রী চেহারা; পরণে সিল্কের লুঙ্গী; মুখে তানাখা মাখা। খাবার মিলিল—ভাত, ডাল ও পাঁপর ভাজা। আজ তিনদিন পরে ভাত খাইতেছি। রান্না যেমনই হোক তৃপ্তির সঙ্গে খাইলাম।
২৬শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪২: প্রোম্:
প্রোমে আসিয়া আজ চারদিন বসিয়া আছি—ইরাবতী নদী পার হইবার কোন উপায় হইল না। একটা স্টীমার কালো ধোঁয়ায় আকাশকে আবিল করিয়া নদীর জলে তরঙ্গ তুলিয়া গেল। মিলিটারী যাইতেছে। সাম্পান একখানি আছে; কিন্তু যাত্রীর সংখ্যা এত এবং তাহার খাঁই এত বেশী যে পারের আশা ছাড়িয়া দিলাম।
একটী সাম্পানে নথুভাইয়ের স্থান হইল অনেক টাকার বিনিময়ে। নাথুভাই বলিলেন—‘আমি চলিলাম। আমার মোটর আপনারা নিন— দেখুন যদি অন্য কোথাও হইতে যাইবার সুবিধা হয়।’
এখন এ অবস্থায় কি করা যায়? দু’জনে পরামর্শের পর ঠিক করিলাম—রেঙ্গুনেই ফিরিয়া যাই; তবু জানা জায়গা। শহরে না পাওয়া গেলেও কাছাকাছি কোন গ্রামে আশ্রয় লওয়া যাইবে। দেশে প্রত্যাগমনের যখন কোন আশাই নাই, তখন অগত্যা এই পরামর্শ ই অনুসরণ করিলাম। মোটর আবার রেঙ্গুনের পথে ফিরিল। মোটর চালনা জানা ছিল; বিদ্যাটা কাজে লাগিল।
কয়েক ঘণ্টা চলিবার পর মোটর বিগ্ড়াইল। সর্বনাশ, পেট্রল আর নাই— পাইবার সম্ভাবনাও নাই। কি করিব মোটর ফেলিয়া পায়ে হাঁটিয়া শেষে চলিতে হইল।
২৭শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪২: পথে:
সন্ধ্যা ৭টা। পথ দিয়া দুজনে হাঁটিতেছি। রাস্তার অনতিদুরে মিলিটারী ছাউনি—মাঠের উপর কতকগুলি শাদা পাখীর মত দেখাইতেছে। আশ্রয় খুঁজিতেছি। এমন সময় সাইরেন্ বাজিল চারিদিকের নিবিড় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া আহত কুকুরের কাতর আর্ত্তনাদের মতো। সঙ্গে সঙ্গে জাপানী এরোপ্লেনের গুঞ্জন বাতাসে ভাসিয়া আসিল।
লোকালয়হীন পথের ধারে আশ্রয় কোথায় পাই? রাস্তার ধারে একটা খাদ দেখিলাম—একটা বড় গাছের নীচে। চাঁদ সিংকে বলিলাম—‘আসুন এইটার মধ্যে আশ্রয় লই।’
চাঁদ সিং বলিলেন—গর্ত্তের মধ্যে বসিয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই। জাপানীরা হয়তো বৃটিশ তাঁবু আক্রমণ করিবে। এখানে রাস্তায় থাকা আর গর্ত্তের মধ্যে থাকা একই কথা।
আমি বলিলাম—‘আপনি তাহা হইলে থাকুন, আমি ‘শেল্টার’ লই।’
এমন সময় আলোকের ঝলকে চারিদিক আলোকিত হইয়া উঠিল ও বোমা পড়িতে আরম্ভ হইল। পায়ের নীচে মাটি কঁপিয়া উঠিল—গর্ত্তের মধ্যে ছিট্কাইয়া এক পাশে পড়িয়া গেলাম। মাথার উপর দিয়া অসংখ্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ চলিয়া গেল। আবার সেইরকম শব্দ— গুম্ গুম্ গুম্। তারপর বোমা বর্ষণ থামিয়া গেল। এরোপ্লেনের বোঁ-ও-ও-ও শব্দ যেন দুরে অতি দূরে মিলাইয়া গেল।
ধীরে ধীরে খাদ হইতে রাস্তার উপর উঠিলাম। চাঁদ সিংকে নাম ধরিয়া ডাকিলাম। সাড়া পাইলাম না। পথ ধরিয়া অগ্রসর হইলাম তাহার খোঁজে।
রাস্তার উপর কি যেন একটা পড়িয়া আছে। কাছে গিয়া দেখি— চাঁদ সিং। গায়ে হাত দিয়া ডাকিলাম—সাড়া নাই। গা হিমের মতো ঠাণ্ডা নাড়ী নিস্পন্দ— সারা দেহ রক্তে ভাসিয়া গিয়াছে। টর্চ জ্বালিয়া দেখিলাম বোমার স্প্লিণ্টারে তাহার পেট কাটিয়া নাড়ীভুঁড়ি বাহির হইয়া আসিয়াছে। সজলচক্ষে মৃতদেহ পথের ধারে একটি খাদে সমাহিত করিলাম। তারপর আবার চলিলাম; এবার একা।