আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/জার্মানীতে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিবরণ
৫ই জানুয়ারি ১৯৪৫:
আজ ফতে সিং-এর সঙ্গে আলাপ হইল। ইনি যুদ্ধ আরম্ভের সময় জার্ম্মানিতে ছিলেন এবং গতমাসে জাপান হইয়া এখানে আসিয়াছেন। ইহার নিকট হইতে জার্ম্মানি ও ইটালিতে আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বপূর্ণ-ইতিহাস শুনিলাম। এই সেনাদল জার্ম্মানিতে গঠন করেন নেতাজী।
জার্ম্মানি ও অষ্ট্রীয়ায় কয়েকজন ভারতীয় যুবক অধ্যয়নের জন্য ছিলেন; যুদ্ধ আরম্ভ হইলে ইহারা আটক পড়িয়া যান। ইতিমধ্যে বিজয়ী জার্ম্মান বাহিনীর হাতে বহু ভারতীয় সৈনিক বন্দী হইয়াছিল।
সুভাষচন্দ্র ভারত হইতে পলায়ন করিয়া যখন জার্ম্মানীতে উপস্থিত হইলেন, তখন এই সকল ভারতবাসীকে লইয়া এক সেনাদল তাঁহার নেতৃত্বে গড়িয়া উঠিল। ইহার নাম হইল স্বাধীন ভারত বা ফ্রিস্ ইণ্ডিয়েন্। জার্ম্মানীর কোনিগস্বর্গে ভারতীয় যুদ্ধ বন্দীদের যে সমাবেশ হইয়াছিল নেতাজী তাহাতে উপস্থিত ছিলেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জ্জনের উদ্দেশ্যে একদল ভারতীয়কে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত করা নেতাজীর উদ্দেশ্য ছিল। ইউরোপে যে মহাযুদ্ধ চলিতেছে তাহাতে যুদ্ধ বিজ্ঞান শিক্ষার যে অপূর্ব্ব সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে, হিটলারের সহায়তায় নেতাজী তাহার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিতে চাহিয়াছিলেন। যদি সুযোগ উপস্থিত হয় তাহা হইলে এই সেনাদল ভারতবর্ষকে স্বাধীন করিবার চেষ্টা করিবে।
সুভাষচন্দ্র জার্ম্মানিতে যে স্বাধীন ভারত গর্ভর্ণমেণ্টর সূচনা প্রতিষ্ঠা করেন তাহা কাহারও অধীন ছিল না। ভারতবর্ষ চায় শুধু নিজের স্বাধীনতা; জার্ম্মানির পররাজ্য গ্রাস প্রচেষ্টায় সহায়তা ভারত করিবে না। কেবলমাত্র ইংলণ্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফ্রিস্ ইণ্ডিয়েন্ সৈন্যদল ব্যবহৃত হইয়াছিল। রুশিয়ায় পর্য্যন্ত এই সেনাদল পাঠাইতে দেওয়া হয় নাই। এই সেনাবাহিনীর নীতির উপর হিট্লার বা মুসোলিনীর কোন প্রভাব ছিল না।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘ইউরোপে ফ্রিস্ ইণ্ডিয়েন্ বাহিনীতে সৈন্য কত ছিল?’
‘প্রথমে যখন ১৯৪২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি তারিখে এই বাহিনী গঠিত হয়, তখন সৈন্য বেশী ছিল না; বোধ হয় দেড় হাজার হইবে। কিন্তু পরে বাড়িয়া ঐ সংখ্যা হয় প্রায় পাঁচ হাজার। উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধে তোবরুকে বন্দী ভারতীয় সৈনিকেরা ইটালী ও জার্মানিতে স্থানান্তরিত হয়; তাহাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের ফৌজে যোগ দিয়াছিলেন।’
‘আপনারা কি শুধু জার্ম্মানিতেই ছিলেন?’
‘আমরা ইউরোপের বিভিন্ন রনাঙ্গনে ছড়াইয়া ছিলাম। আমাদের বেশীভাগ ছিল ফ্রান্সের দক্ষিণ অঞ্চলে এবং হল্যাণ্ডে। ইটালীতেও আমাদের একটি ছোট দল ছিল। লেফট্ন্যাণ্ট যশোবন্ত সিং সিদ্ধা ইটালীতে ছিলেন। আমরা মার্কিন, ইংরেজ ও ক্যানাডিয়ান বাহিনীর সহিত যুদ্ধ করি। লেফট্ন্যাণ্ট আলি খাঁ গত বৎসর (১৯৪৪) আগষ্ট মাসে জেনারেল দ্য গলের বাহিনীর সহিত যুদ্ধে নিহত হইয়াছেন।’
‘রোম রেডিও হইতে বন্দে মাতরম গান এবং ইংরাজী ও হিন্দী ভাষায় প্রচার শুনিতাম। ইহা কি আপনারা করিতেন?
‘আমাদের ফ্রিস্ ইণ্ডিয়েনের প্রচার বিভাগ হইতে ভারতবাসীর নিকট রেডিওর সাহার্য্যে প্রচারের ব্যবস্থা ছিল। বার্লিন ও রোম হইতে বেতার বক্তৃতা হইত। মধ্যে মধ্যে নেতাজী নিজে বক্তৃতা করিতেন। তাঁহার বক্তৃতাগুলির রেকর্ড তৈরী করা হইয়াছিল; অধিকাংশক্ষেত্রে রেকর্ড বাজানো হইত। ইটালীতে প্রচার বিভাগের ভার ছিল লেফট্ন্যাণ্ট জামিল্ খাঁর উপর। লেফট্ন্যাণ্ট ওরবচান সিংও প্রচার বিভাগের একজন কর্ত্তা ছিলেন।’
‘আপনাদের সৈন্যেরা কি জার্ম্মান বা ইটালীয় বাহিনীর মধ্যে থাকিয়া কাজ করিতেন?’
‘ফ্রিস্ ইণ্ডিয়েন্ সেনা বাহিনী স্বতন্ত্র ইউনিট ছিল। আমাদের সেনাদলে এই কয়টি বিভাগ ছিল:—
(ক) ক্ষুদ্র অস্ত্রসজ্জিত দল—তিনটি
(খ) বৃহৎ অস্ত্র সজ্জিত দল—একটি
(গ) ট্যাঙ্ক-ধ্বংশকারী ভারী কামান সজ্জিত দল—একটি
(ঘ) পদাতিক গোলন্দাজ দল—একটি
(ঙ) স্যার্পাস্ ও মাইনার্স দল—একটি।
‘আপনাদের মধ্যে আপনিই কি কেবল এখানে আসিয়াছেন?’
‘আমি ও আরও কয়েকজন বার্মায় আসিয়াছি। আমাদের মধ্যে লেফ্টন্যাণ্ট হাসান নেতাজীর সঙ্গেই ছিলেন।’
‘নেতাজী কি ইউরোপ হইতে ভারত আক্রমণের কল্পনা করিয়াছিলেন?’
জার্মানী চাহিয়াছিল তড়িৎগতিতে মিশর দখল করিয়া অগ্রসর হইতে। মধ্য প্রাচ্যে যদি জার্মানী ও ইটালী জয়লাভ করিত তাহা হইলে এই সকল সুশিক্ষিত সেনাদল ভারতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে আসিয়া কাজ করিতে পরিত। নেতাজী যখন দেখিলেন যে এই পরিকল্পনা কার্য্যে পরিণত করা সম্ভব নয়, তখন তিনি জার্ম্মানি হইতে জাপানে আসিলেন। জাপান পূর্ব্বেই ভারতের সীমান্তে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। এখান হইতে চেষ্টা করাই আমাদের পক্ষে সুবিধাজনক। হিট্লারের সহায়তায় ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে নেতাজী একখানি সাব্মেরিনে করিয়া জার্ম্মানী হইতে টোকিও আসেন।’
‘তিনি কি একা আসেন?’
‘তাঁহার সঙ্গে ছিলেন কর্ণেল হাসান্, লেফ্টন্যাণ্ট গোলাম হায়দার এবং ওয়ালি মহম্মদ। এখানে আসিবার পর ইহাদের কাহারও সহিত আমার আর দেখা হয় নাই।’
ফতে সিং-এর নিকট হিটলারের সহিত নেতাজীর সাক্ষাতের একখানি সুন্দর ফটো দেখিলাম।