আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/ঝান্সীর রাণী বাহিনী
২৬শে অক্টোবর ১৯৪৩:
জানকী দেবীর সহিত আলাপ ছিল না—আজ হইল। সুন্দরী না হইলেও—চেহারায় চটক্ আছে। দেহের কমনীয় রেখাগুলিতে স্বাস্থ্যের বলিষ্ঠতা। উজ্জ্বল টানা টানা চোখ—মাথায় বব্-করা কোঁক্ড়া কালো চুল। ধব্ধবে ফর্শা রঙ। পরণে ফুল্ প্যাণ্ট, খাকি সার্ট্ আর মাথায় টুপি বাঁকাভাবে পরা।
ব্যানার্জির বাসায় চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল। চায়ের কাপের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া উঠিতেছিল। তাহার ফাঁকে জানকী দেবীকে দেখিয়া লইলাম। ফয়া সুন্দরী; কিন্তু সে সৌন্দর্য্যের মধ্যে কিসের যেন একটা অভাব আছে। জানকী দেবী যেন তাহার অপেক্ষা সুন্দরী।
তাহার চটুল হাসি ও গল্পের মধ্য দিয়া কখন যে পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হইয়াছে বুঝিতে পারি নাই।
জানকী দেবীর স্বামী গত বৎসর মারা গিয়াছেন। তিনি একটি অফিসে কাজ করিতেন; এখন ঝাঁসীর রাণী বাহিনীতে যোগ দিয়াছেন।
জানকী দেবীর কাছে তাঁহাদের নারী বাহিনীর গল্প শুনিলাম। লক্ষ্মী স্বামীনাথন্ নামে এক মাদ্রাজী মহিলা ডাক্তার ইহার অধিনায়িকা হইয়াছেন। ইনি মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের পাশ করা ডাক্তার; মাত্র তিন বৎসর পূর্ব্বে (১৯৪০) সিঙ্গাপুরে আসিয়া চিকিৎসা ব্যবসায় আরম্ভ করেন। নারী বাহিনী গঠনের ভার নেতাজী তাঁহার উপরে দিয়াছেন।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘আপনাদের কি যুদ্ধকৌশল শিক্ষা দেওয়া হইবে?’
‘হাঁ, আমরা যুদ্ধ করিতেও শিখিব।’
‘আপনারা তাহা হইলে যুদ্ধ করিবেন।’
‘আহত সৈন্যদের সেবাই হইবে আমাদের প্রধান কাজ এবং আমরা নার্সিং শিখিতেছি। তবে প্রয়োজন হইলে আমরাও বন্দুক লইয়া আপনাদের পাশে দাঁড়াইতে পারিব।’
ব্যানার্জ্জি বলিলেন—‘ভারতীয় মেয়েদের মধ্যে বেশী লোক পাওয়া যাইবে বলিয়া আমার মনে হয় না।’
‘আপনার ধারণা ভুল। ইহার মধ্যেই আমাদের সংখ্যা দেড় শত হইয়াছে। আপনাদের বাঙালী মেয়েও আছে ইহার মধ্যে। বেলা দত্ত, মিস্ ভট্টাচার্য্য, মায়া গাঙ্গুলী, রেবা সেন, সিপ্রা সেন এবং আরও কয়েকজন যাহাদের নাম আমি জানি না।’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘আপনারা কোথায় শেখেন?’
‘আমাদের জন্য সিঙ্গাপুরে একটি মেয়েদের সামরিক বিদ্যালয় হইয়াছে; সেইখানে আমরা শিখি। ২২শে উদ্বোধন হয়। নেতাজী বক্তৃতা দিয়াছিলেন। তাঁহার বক্তৃতা কি আপনারা খবরের কাগজে দেখেন নাই?’
‘আমি বলিলাম—‘নিয়মিতভাবে খবরের কাগজ পাই না।’
জানকী দেবীর পকেটে সেই অংশটুকু পত্রিকা হইতে কাটা ছিল। আমি তাহা চাহিয়া লইলাম। নেতাজী বলিয়াছিলেন:
‘ঝাঁসীর রাণী বাহিনীর শিক্ষাকেন্দ্রের উদ্বোধন একটি বিশেষ উল্লেখ যোগ্য ঘটনা—পূর্ব্ব এশিয়ায় আমাদের সংগ্রামের অগ্রগতির পথে একটি স্মরণীয় কাহিনী। ইহার সুদূর প্রসারী সম্ভাবনা উপলব্ধি করিতে হইলে, আমাদের অন্তরের সজল অনুভূতি দিয়া মনে রাখিতে হইবে যে আমাদের এই আন্দোলন শুধু রাজনীতিক আন্দোলন নয়। আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে নুতন করিয়া নব আদর্শে গড়িয়া তুলিবার মহান্ কার্য্যে ব্রতী হইয়াছি। ভারতের জন্য আমরা এক নবযুগ আনিব; আমাদের নব জীবনের ভিত্তি সুদৃঢ় করিব। আপনার মনে রাখিবেন—ইহা মাত্র ফাঁকা কথা নয়। আমরা দেখিতে পাইতেছি, ভারতের পুনর্জীবন আসন্ন। ভারতীয় নারীদের মধ্যেও এই নব জাগরণের শিহরণ উঠা স্বাভাবিক।
আজ যে শিক্ষাকেন্দ্রের উদ্বোধন করা হইল, তাহাতে আমাদের ১৫৬ জন ভগ্নী শিক্ষালাভ করিবেন। আমি মনে প্রাণে আশা করি, সিঙ্গাপুরে শীঘ্রই তাঁহাদের সংখ্যা এক হাজার হইবে। থাইল্যাণ্ডে এবং ব্রহ্মদেশেও নারী শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হইয়াছে। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় হইল সিঙ্গাপুরে।
আমার একান্ত বিশ্বাস, এক হাজার ‘ঝাঁসীর রাণী’ এই কেন্দ্র হইতে উঠিবেন।’
২৭শে অক্টোবর ১৯৪৩:
আজ সন্ধ্যায় সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে একটি সভা হইল। সত্যের বিভিন্ন বিভাগের প্রায় ৪০।৫০ জন কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
ব্যানার্জি আমাকে সুভাষচন্দ্রের সহিত পরিচয় করাইয়া দিলেন।
আজাদ হিন্দ্ বাহিনী লইয়া ভারতবর্ষ আক্রমণের ব্যবস্থা হইবে। ভারতবর্ষের বর্ত্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সুভাষচন্দ্র জানিতে চাহেন। তিনি কলিকাতা ত্যাগ করেন ১৯৪১ সালের ২৬শে জানুয়ারি তারিখে; তাহার পর যে সংবাদ পাওয়া যায় তাহা খুবই সামান্য এবং সেন্সরের ফলে বিকৃত।
ব্যানার্জি ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমেই কলিকাতা হইতে রেঙ্গুন ফিরিয়াছেন। তিনি বলিলেন—‘আমি যখন ছিলাম সেই সময় বাংলা দেশে নেতাজীর সমর্থক কংগ্রেস দল ও শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা একত্রে এসেম্ব্লিতে কাজ করিতেছিলেন।’
সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে মহাত্মাজী এবং কমিউনিষ্ট্ দলের মতামত সম্বন্ধে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন।
ব্যানাজি বলিলেন—“কমিউনিষ্ট্রা রাসবিহারী বাবু এবং নেতাজীর বিরুদ্ধে সমালোচনা করে।”
ব্যানার্জি এইখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করিলেন। তিনি ডিসেম্বর মাসে বার্মায় ফিরিবার জন্য চেষ্টা করিতেছিলেন। কিন্তু বিশেষ সুপারিশ ভিন্ন জাহাজে বা এরোপ্লেনে স্থান লাভ অসম্ভব ছিল। এই সম্পর্কে একজন বন্ধু তাঁহাকে হিন্দু মহাসভার নেতা ডাক্তার সন্তোষকুমার মুখার্জির নিকট লইয়া যান। সেই সময় তাঁহার সহিত একজন কমিউনিষ্ট্ ছাত্র দেখা করিতে গিয়াছিল এবং নেতাজীকে বলিয়াছিল—কুইস্লিং।
ইহার উত্তরে সন্তোষবাবু তাহাকে বলেন—“কুইস্লিং নিজের স্বাধীন মাতৃভূমিকে বিদেশীর হাতে তুলিয়া দিয়াছিল। আমরা স্বাধীন নই। সুতরাং কুইস্লিং-এর সহিত সুভাষচন্দ্রের তুলনা করা অন্যায়। সুভাষচন্দ্রের ন্যায় দেশপ্রেমিক বিরল। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগও যে একটি বড় অস্ত্র তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। মহাত্মা, সুভাষচন্দ্র ও সাভারকর প্রভৃতি বিভিন্ন দিক হইতে চেষ্টা করিতেছেন। পথ ভিন্ন হইতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য একই—ভারতের মুক্তি।”
ব্যানার্জি কলিকাতায় কমিউনিষ্ট্দের একদিনের সভার কৌতুকজনক বর্ণনা দিলেন। ইহাদের শ্লোগান্—‘জাপানকে রুখ্তে হবে’—‘রুশকা লড়াই, হামারা লড়াই’। তাহাদের একটি গানের কথাগুলি ব্যানার্জি বলিলেন:
‘কমরেড্, ধরো আজ হাতিয়ার!
দুনিয়ার জনগণ সাথে চল সবাকার।
কমরেড্, ধরো আজ হাতিয়ার।
যুদ্ধ—মুক্তি ও শৃঙ্খলে;
ফ্যাসিবাদ যাক্ আজ অতলে।
কমরেড্, হও আজ হুঁসিয়ার।’
[গানটি ব্যানার্জির নিকট হইতে সভার পরে লিখিয়া লইলাম। ইচ্ছা আই-এন-এর জন্য এই ধরণের একটি হিন্দী গান রচনা করিব।]
কমিউনিষ্টরা পূর্ব্বে যুদ্ধে যোগদানের বিরুদ্ধে বলিত—‘এটা সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ’। রাশিয়া যুদ্ধে যোগদানের পরেই তাহাদের বুলির পরিবর্ত্তন হইয়াছে। এখন তাহারা বলিতেছে—‘এই যুদ্ধ ফ্যাসিষ্ট বনাম গণতন্ত্রের যুদ্ধ— পরাধীনতার বিপক্ষে স্বাধীনতার সংগ্রাম। সোভিয়েট্ রাশিয়া, চীন, বৃটেন ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সকলকে লড়িতে হইবে।’ জনসাধারণের ধারণা ইহারা সরকারী অর্থসাহায্য পায়।
শরৎচন্দ্র বসুকে ১৯৪১ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে অন্তরীণ করা হইয়াছে।’
ব্যানার্জির সংবাদ প্রায় এক বৎসরের পুরাতন।
এই সময় জানা গেল, এক জন একমাস পূর্ব্বে ভারতবর্ষ হইতে ফিরিয়াছেন। জাপানীরা তাঁহাকে সব্মেরিণে করিয়া লইয়া গিয়াছিল।
তাঁহার নিকট ১৯৪২ সালের ৮ই আগষ্ট তারিখের কংগ্রেস কমিটির গৃহীত প্রস্তাবগুলি এবং মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনের বর্ণনা শুনিলাম। তিনি দাবি করেন—বৃটিশকে ভারতের সকল ক্ষমতা ভারতবাসীর হাতে ছাড়িয়া দিতে হইবে এবং কেবল ভারতরক্ষা ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যতটুকু প্রয়োজন সেইরূপ ক্ষমতা তাহারা রাখিতে পারিবেন। তারপর ১৯৪২ সালের আগষ্ট মাসে বোম্বাইয়ে কংগ্রেস কমিটি অধিবেশনের পর মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য সকল কংগ্রেস নেতাকে গ্রেপ্তার করা হইল। কিন্তু “ভারত ছাড়” এই বাণী দেশের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িল। তাহার পর যাহা হইল, তাহা ভারতবর্ষের ইতিহাসে অভূতপূর্ব্ব। স্বতঃস্ফূর্তরূপে এক আন্দোলন সমগ্র দেশের উপর দিয়া ঝড়ের মত বহিয়া গেল। গভর্ণমেণ্ট এক বিরাট গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হইল। মেদিনীপুর জেলার অধিকাংশ স্থান এবং বিহার ও যুক্ত প্রদেশের অনেক স্থানে সাময়িকভাবে বৃটিশ শাসন বিলুপ্ত হইয়াছিল। নেতৃত্ববিহীন সেই জন-আন্দোলন সংগঠনের অভাবে সাফল্য লাভ করিতে পারে নাই। বাংলার দুর্ভিক্ষে অসংখ্য লোক মরিতেছে। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জন মত প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। নেতাজীর বেতার বক্তৃতা ভারতে সকলেই আগ্রহের সহিত শুনিয়া থাকে।
তিনি বলিলেন যে তাঁহাকে খুব সাবধানে চলিতে হইয়াছিল, এজন্য কোন বিশিষ্ট লোকের সহিত সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয় নাই।