আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/টোকিও হইতে তোজোর বক্তৃতা
৭ই নভেম্বর ১৯৪৩:
আজ টোকিওতে বৃহত্তর পূর্ব এশিয়ার জাতিসঙ্ঘের অধিবেশন হইতেছে টোকিওতে। এই সুযোেগ টোকিও বেড়ানো হইবে ভাবিয়াছিলাম; কিন্তু তাহা আর হইল না। মধু অভাবে গুড়েই সন্তুষ্ট থাকিতে হইল—রেডিওতে জাপানের প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজোর বক্তৃতা শোনা গেল। তিনি বলিলেন:
‘অস্থায়ী আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং ভারতের দেশপ্রেমিকগণ তাঁহাদের উদ্দেশ্য সাধনে দৃঢ়সঙ্কল্প; সুতরাং আমি এই সুযোগে ঘোষণা করিতেছি যে জাপ গভর্ণমেণ্ট জাপ বাহিনীর অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ শীঘ্রই আজাদ হিন্দ্ গভর্ণমেণ্টের হস্তে সমর্পণ করিতে প্রস্তুত আছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাপান যে সহায়তা করতে উদ্গ্রীব ইহা তাহার প্রথম প্রমাণ। ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধে জাপান সর্ব্বতোভাবে সহযগিতা করিতে প্রস্তুত; জাপান চাহে যে ভারতীয়েরাও এই কার্য্য সাধনের জন্য তাহাদের চেষ্টা দ্বিগুণ করিবে।’
রেডিও শুনিতেছি; এমন সময় জানকী দেবী আসিয়া উপস্থিত। আজ আর মিলিটারি সাজ নয়। চাঁপা রঙের শাড়ী স্কার্টের মতন করিয়া পরা—ফিকে নীল রঙের ব্লাউজ। কাপড়ের রঙের সঙ্গে গায়ের রঙ্ মিলিয়া গিয়াছে।
আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বলিলাম-‘নমস্তে’।
‘একলাটি বসিয়া রেডিও শুনিতেছেন। আসুন, একটু বেড়াইয়া আসি।’
ব্ল্যাক্ আউটের অন্ধকার রাস্তায়। ভূতের বাড়ীর মত সারি সারি বাড়ীগুলি অন্ধকারের মধ্যে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। মাঝে মাঝে এক একটা আলোক চোখে ঠুলি পরিয়া ঝিমাইতেছে। দুইজনে চলিতেছি গল্প করিতে করিতে।
হঠাৎ জানকী দেবীর পায়ে কিসের জন্য হোঁচট্ লাগিল। আমি ধরিয়া ফেলিলাম।
জানকী দেবী বলিলেন—‘আর একটু হইলে পা পিছলাইয়া পড়িয়া যাইতাম। যেরূপ অন্ধকার—একা চলা কঠিন।’
আমার হাতের মধ্যে জানকী দেবীর বাহু ছিল। সেইভাবেই চলিলাম। জানকী দেবীর দিক হইতেও সরাইয়া লইবার কোন চেষ্টা হইল না।
পার্কে গিয়া দুজনে বসিলাম। কতক্ষণ গল্প করিয়াছি জানি না। অন্ধকার গাঢ়তর হইয়া উঠিয়াছে। আকাশের অগণিত তারা আসিয়া নামিয়াছে দূরে সমুদ্রের বুকে স্নান করিবার জন্য। নক্ষত্রমালার মধ্যমণি চাঁদের মতোই জানকীর মুখখানি। তাহার গায়ের নিবিড় স্পর্শ রক্তের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছে।